ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Wednesday, November 18, 2020

মান্দিতে লিখি? মনিপুরীতে লিখি? গোরখপুরিতে লিখি?দলিত ভাষাতে লিখি?

।।লুবনা ইয়াসমিন।।

চলেশ রিসিল

বাংলাতে তারিখ লিখতে বলছেন!

মান্দিতে লিখি? মনিপুরীতে লিখি? গোরখপুরিতে লিখি?দলিত ভাষাতে লিখি?

একজন আমাদের গ্রুপে(জুলেখা সিরাপ) সবাইকে বাংলাতে তারিখ লিখতে বলেছেন।বাংলা তারিখের নিচে রোমান হরফে রোমান তারিখটাও দিয়েছেন।সাধু, সাধু।এই যে কয়েকটা বাক্য লিখলাম, তাতে কিন্তু বাংলা ছাড়াও, সংস্কৃত তৎসম, ততভব, প্রাকৃত, মায় ইংরেজি, আরবি শব্দও রয়েছে।একটা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার বাড়ে অন্য ভাষা থেকে নিয়ে।দেয়া নেয়া থেকে ভাষার শব্দ ভাণ্ডার বাড়ে।ব্যাপারটা যখন একতরফা হুমকি ধামকিতে চলে আসে তখনই বিপদ।রোমানদের কথিত সভ্যতা, আর্য আগ্রাসী সংস্কৃত, অশোকের চাপানো পালি, সোভিয়েতের ভুয়া সাম্যবাদী রুশ সবগুলোকেই প্রজারা একসময় ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।

বাঙ্গালিকে তার ভাষার ব্যাপারে কিন্তু অন্যভাষি অনেক সম্প্রদায় ঢালাওভাবে সহায়তা, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে।ব্রিটিশ রাজের শুরুতে কেরানি বানাতে হোক বা ভৌগলিক কারণে হোক, মিশনারিরা বাঙ্গালিকে অভিধান করে দিয়েছে, ছাপাখানা বানিয়ে দিয়েছে, বাঙ্গালির রেনেসা নিয়েও সেন্সরের দুরমুজ চাপায় নি।১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি গণহত্যার শিকার পূর্ব বাংলার বাঙ্গালিদের পাশে ভারতীয় ইউনিয়ন এসে দাড়াবার মানে ভারতের বিভিন্ন ভাষি, বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন জাতের লোকজন বাঙ্গালির জন্য মরণপণ লড়াই করেছিল।বাংলা ভাষার, বিশেষ করে বাংলাদেশের সাহিত্যে কি সেই ভিন্নভাষী, ভিনজাতের ভারতীয়দের যথার্থ সম্মান জানানো হয়েছে?আমার চোখে পড়ে নাই।বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের স্মারক একুশে ফেব্রুয়ারিকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের মর্যাদা দিয়েছে।পহেলা বৈশাখ মঙ্গল শোভাযাত্রাকেও ইউনেস্কো বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের মর্যাদা দিয়েছে।এসব থেকে আশা করা যেতে পারতো যে বাঙ্গালি অন্য ছোট, বড় ভাষার প্রতি সম্মান দেখাবে।গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস বলে যে বাঙ্গালি তার আশেপাশের ছোট ভাষাগুলোকে অবজ্ঞা করে ক্ষান্ত হয় নি, তাদের নেতাদের হ্যানস্থা থেকে হত্যা সব কিছু করেছে।

পশ্চিম বঙ্গের গুর্খারা যখন দার্জিলিঙের চা বাগান গুলোতে তাদের ন্যায্য হিস্যা চেয়েছে, তাদের নেতা সুভাষ ঘিসিং এর গতিবিধি প্রতি পদে আটকানো হয়েছে।মান্দি নেতা চলেশ রিচিলকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে বাংলাদেশের আইনরক্ষি বাহিনী।চলেশের বিরুদ্ধে সীমান্তে সন্ত্রাসী তৎপরতার অভিযোগ আনা হয়েছিল।মূলত চলেশ প্রতিবাদ জানিয়েছিল, ইকো পার্কের নামে গারোদের জমি দখল বন্ধ হোক।

সংখ্যালঘুদের সাথে দুর্ব্যবহার করতে করতে, আমরা নিজের ভাষায় কথা বলাদের সাথেও দুর্ব্যবহার করি।বাংলাতে তারিখ লিখে যদি সে দুর্ব্যবহার বন্ধ হতো তাহলে তো কথাই ছিল না।মজার ব্যাপার যে অবাঙ্গালি মুঘল আকবরের সুবাদারেরা বাংলা ক্যালেন্ডার শুরু করেছিল।ক্যালেন্ডারকে আমরা পঞ্জিকা বলতে পারি, বছর শুরুকে আমরা হালখাতা বলতে পারি, কিন্তু আকবরের প্রবর্তনার প্রতি সম্মান জানাতে হলে, ভারতের অন্য ভাষাগুলোকেও সম্মান জানানো দরকার।

নিজেদের বড় অর্জনগুলোকেও আমরা সামন্তবাদী স্নবারির পর্যায়েনামিয়ে এনেছি।একজন বলছে, সে ১৯৭১ নিয়ে কাজ করেছে, কিন্তু তা শেয়ার করছে নির্বাচিতভাবে।একজন বলছে, সে লালনকে নিয়ে ভাবান্দোলন করছে, মোহাম্মদপুরে NGO খুলে বেলের সরবত বিক্রি করছে ২০০টাকা গেলাস প্রতি, হেফাজতিদের লেলিয়ে দিচ্ছে শাহবাগিদের বিরুদ্ধে।আমাদের নৃতাত্ত্বিক আত্মীয় ছোটো ছোটো সম্প্রদায়গুলোকে অমর্যাদা করে আমাদের একদল আরব সংস্কৃতির পূজা করি, আরেকদল সুভাষ চন্দ্রের জাতীয়তাবাদে হত্যা দেই।এসব তর্ক, বিতর্কে আস্তিক, নাস্তিক দু পক্ষকে দেখা যায় নারীবিদ্বেষের কমন গ্রাউন্ডটি আকড়ে থাকতে।

এসবের ভেতর মনে হতে পারে যে এতরকমের ঐতিহাসিক সমর্থন পাওয়া বাংলা ভাষার বিশ্বজনীন ফন্ট আছে!আসলে নেই।বেশির ভাগ লোক ইউনিকোডে টাইপ করছে।যারা বাংলা নিয়ে অভিমান দেখাচ্ছে, বাংলা ফন্ট নিয়ে মুস্তফা জাব্বারের এক তরফা হাইকোর্ট রুলিং এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার মতো বুকের পাটা তাদের নেই।ব্লগিং ও ফেসবুকের এর শুরুতে প্রয়াত উপন্যাসিক কামরজ্জামান জাহাঙ্গীর ও কবি চয়ন খায়রুল হাবিব বিশ্বজনীন বাংলা ফন্ট নিয়ে একাধারে লেখেন।কিন্তু অভিমানীদের ঘুম তাতে ভাঙ্গে নাই।ভাদ্র এলে যেরকম পুরুষ কুকুরের জিহ্বা লম্বা হয়, সেরকম বাংলা নিয়ে মৌসুমি স্লোগানের ইয়ত্তার শেষ নেই।সেরকম স্লোগান আমাদের গ্রুপেও দেখি।দেখতে হয়।প্রত্যেক গ্রুপের মতো আমাদেরও এথোস আছে, অর্জন ও বিসর্জনের ভেতর দিয়ে জুলেখা সিরাপের চারিত্র্য তৈরি হয়েছে, যার অন্যতম হচ্ছে, যাদের নিয়ে কম বলা হয় তাদের কথা বলা।বাহবা পাওয়াটা লক্ষ্য নয়, কিন্তু পাশে সহযোগীদের দেখলে অবশ্যই আমরা উদজিবিত হই।কিন্তু পাশে কেউ নেই দেখে স্লোগান গেলবার গ্রুপ এটা নয়।

চলেশ রিসিলের হত্যাকাণ্ড নিয়ে শোকগাথামূলক গানটি কতজন শুনেছে, তার চেয়ে বড় ব্যাপার যে হত্যাকারীদের যে বাংলা ভাষা, তা থেকে সরে এসে এক যত্নবান প্রবর্তনার বাংলা ভাষাতে গানটি লেখা হয়েছে।আমরা লজ্জিত হই।আমরা নত হই।




লুবনা ইয়াসমিন
২/০৭/২০
প্যারিস