ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Thursday, November 19, 2020

যুথিকার গল্প

।।আতিয়ান নাহার।।


ট্রেন প্রায় আড়াই ঘন্টা লেট। উঠে বসেছে যুথিকা, তখনো ছাড়েনি। পাশের যাত্রীর ফোন বেজে উঠলো, উনি বলছেন "জ্বী ভাই এখনি ছাড়বে...."। যুথিকার দুচোখ ঝাপসা হয়ে এল। একদিন ছিল যখন বাড়ী রওনা হবার আগে থেকে আব্বার ফোন আসতো? রওনা হইসো, গাড়ি ছাড়সে, এখন কোথায়? কোন অসুবিধা নাইতো? এ্যারিস্ট্রোক্র্যাট পৌছাইসো? আর কতদুর? ক্যাডেট কলেজ পার হইসো? টাউনে ঢুকসো? খুব বিরক্ত লাগতো। তারপর পৌছে দেখতো দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন পথের দিকে তাকিয়ে।
অনেকদিন হলো যুথিকা একাই যায় বাড়ীতে। সাধারণত: গাড়ীতে যায়, এবারই ট্রেনে একা, একটু অস্বস্তি কাজ করছিলো। কিন্তু কেউ এখন আর জানতে চায়না অসুবিধা হচ্ছে কিনা।
একটি ফোন কলের বড় প্রয়োজন যুথিকার। কেউ জিজ্ঞাসা করুক ওর খারাপ লাগছে কিনা,কোন অসুবিধা আছে কিনা। আব্বা আমার অসুবিধা হচ্ছে, আমার খুব কান্না পাচ্ছে। আপনি ফোন করলেই আমি বলব, আমার খারাপ লাগছে।
আব্বা আপনি বারবার ফোন করুন, এখন জিজ্ঞাসা করুন ট্রেন ছেড়েছে কিনা? যখন তাড়াহুড়ো করে অফিসের জন্য তৈরী হচ্ছি তখন ফোন করে বলুন তুমি অফিসে যাচ্ছো? অফিসে পৌছেছো? জিজ্ঞাসা করার গুরুদায়িত্ব আমার উপরে দিয়ে আপনি চলে গেলেন....বিড়বিড় করে যুথিকা, আপনার ফোন কলের বড় প্রয়োজন আমার, বড় প্রয়োজন.....

কান্না লুকাতে করিডোরে এসে দাঁড়ায় যুথিকা। ট্রেন ছেড়েছে অনেক আগেই,শহর ছাড়িয়ে এখন চলেছে গাঁয়ের পথে।যতদূর চোখ যায় দিগন্ত বিস্তৃত সরিষা ক্ষেত, ফুলে ফুলে যেন সেজেছে সবুজ প্রকৃতি। কিশোরী বেলায় পড়া কবিতার চরন মনে পড়ে যায় যুথিকার –
সরষে বালা নুইয়ে গলা
জড়িয়ে দুখান পা
বলছে যেন গাঁয়ের রাখাল
একটু খেলে যা।
সারা মাঠের ডাক এসেছে
খেলতে হবে ভাই,
সাঁঝের বেলা কইব কথা
এখন তবে যাই।
পল্লিকবি জসীমুদ্দিন কি মমতায় গ্রামের প্রকৃতিকে ভালবেসেছিলেন। যুথিকার ইচ্ছে করে সরষেবালার সাথে খেলতে যেতে। সরিষা ফুলের একটা ঝাঁঝালো মিস্টি গন্ধ আছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় তা পৌছেনা তবুও যুথিকা সে ঘ্রাণ পায়, বুক ভরে টেনে নেয়।

ট্রেন এখন যমুনা সেতু পার হচ্ছে। মুল সড়কসেতুর পাশ দিয়ে একটি রেললাইন যুক্ত হয়েছে। নিচে তাকিয়ে মনে হচ্ছে ঢেউএর উপর দিয়ে শুন্যে ভেসে চলেছে। যদিও যমুনা আর আগের মত প্রমত্তা নয়, বড় বড় চর পড়েছে। অনেকটা জুড়েই বালিয়াড়ি।

যুথিকার গন্তব্য চাটমোহর। নামটির সাথে ছেলেবেলার গন্ধ মেশানো। নানাবাড়ির এই স্টেশনে নামতেই পৃথিবীর সব সুখ আর আনন্দ ঘিরে ধরত কিশোরী মনে।
চাটমোহরে ট্রেন থামতে বুকের ভিতর সেই আনন্দটা ছলকে উঠলো। যুথিকা দেখতে পাচ্ছে সারি সারি ঘোড়া গাড়ি দাঁড়ানো, ঘোড়ার চোখের দুপাশে পিতলের ঠুলি পড়ানো, গলায় ঝুলানো ঝুনঝুনিওয়ালা দড়ি। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন থামাতে ঘোড়াগুলো এদিক ওদিক মাথা নাড়ছে আর তাদের গলার ঝুন ঝুনির সম্মিলিত আওয়াজ তৈরী করছে আনন্দের সিম্ফনি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঘোড়ার বর্জ্য আর বিচালীর সোঁদা গন্ধ নাকে এসে লাগছে। যুথিকার পিছনে দাঁড়ানো যাত্রী তাড়া দেয়, আপা তাড়াতাড়ি নামেন ট্রেন ছেড়ে দিবে। সম্বিত ফিরে পেয়ে পাদানিতে পা রাখে যুথিকা। স্টেশনে নেমে আগের মত কিছুই খুঁজে পায়না। লাল রঙের ছোট স্টেশন ঘরের ঐ পাশটাতে ছিল বিশ্রামাগার। স্বল্প পরিসর ঘরের ভিতরে বেশ কয়েকটি কালো কাঠের হাতল ওয়ালা চেয়ার বসবার জায়গাটা বেতের বুনন, একটি টেবিল -উপরটাতে ড্রেসিং টেবিলের আদলে আয়না লাগানো, দেয়ালে ঝোলানো পেন্ডুলাম ওয়ালা ঘড়ি। খোলা জানালা দিয়ে কিছু ঘর বাড়ি গাছপালা দেখা যায়। ঘরের সামনে হেলনাসহ কাঠের বেঞ্চি, সেখানে পরিবারের পুরুষেরা বসত অথবা প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে সময় কাটাতো।নানাবাড়ি থেকে ফেরার সময় যুথিকা মায়ের সাথে ভিতরেই ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতো। ট্রেন লেট হলে খুব খুশি লাগতো, আরও কিছুক্ষণ নানাবাড়ির স্টেশনে তো থাকা হলো।

এবার বাড়িতে যাচ্ছে যুথিকা একটি বিশেষ কাজে।
যে কাজটি করার জন্য যুথিকা এবার এসেছে, সেটি তার একেবারেই পছন্দ নয়। বৈষয়িক বিষয়গুলি যুথিকা ভাল বোঝেনা আগ্রহীও নয়। কিন্তু খালেক সাহেবের ছিল ভীষন আগ্রহ। পৈত্রিক সূত্রে তিনি যথেষ্ট সম্পদ পেয়েছিলেন। তদুপরি নিজে বেশকিছু সম্পদ কিনেছিলেন শহরে বাড়ী, জমি ছাড়াও ধানী জমি, বাঁশঝাড়, ভিটে জমি, পুকুর জোলা অনেককিছু্। সম্পত্তি থেকে আয় যাই হোকনা কেন এগুলোর প্রতি ছিল অসীম মমতা, জোলার পাড়ে বাঁশঝাড়ের ছায়ায় বসলে প্রানটা তার জুড়িয়ে যেত। আর ওই মসজিদের সামনে যে খানে ঘুমিয়ে আছেন তার মা-বাবা সেই পারিবারিক কবরস্থানে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে হাত তুললে পৃথিবীর সব ভার যেন নেমে যেত, অপার্থিব শান্তিতে ভরে যেত মন। গ্রাম থেকে উঠে আসা খালেক সাহেব তার কষ্টে নির্মিত বাড়ীর ফাউন্ডেশন দেন ছয় তলার। স্ত্রী রেগে বলেন- " ছয় তলা করার মুরোদ আছে তোমার ?"
তিনি হাঁসেন “আমি দোতলা পর্যন্ত করব বাকী গুলো আমার ছেলেমেয়েরা করে নিবে। দোতলায় আমরা বুড়াবুড়ি থাকব।" তিনি স্বপ্ন দেখতেন এই বাড়ীতে ছেলেমেয়ে সবাই জড়াজড়ি করে থাকবেন। ছেলেরা সংসারের হাল ধরবে, জোলায় মাছ ছাড়বেন, বাঁশঝাড়ের ছায়ায় বিছানো থাকবে ভালবাসার শয্যা। কিন্তু নাহ্ বিধিবাম। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শেষ করে কর্পোরেট জীবনের মোহে পড়ে গেলো। তিনি চেয়েছিলেন বড় ছেলে তার ব্যবসার হাল ধরবে, বাড়ীর নিচতলায় তার সাদামাটা অফিসটা জাকজমক করে সাজিয়ে তুলবে। ব্যবসা বাড়বে।

যা হোক তবুও তিনি খুশী ছিলেন। ঈদে পার্বনে তার চাকুরীজীবি পুত্র কন্যা, জামাই বউ, নাতি পুতি আসলে ঝলমল করে হেঁসে উঠত তার পুরনো দোতলা বাড়ীটি। ক্ষনে ক্ষনে হাঁসির রোল উঠত, ছেলে মেয়েদের খুনসুটি, নাতি পুতিদের দুষ্টমী, উপহার সামগ্রী, সব মিলিয়ে কয়েকটা দিন কখন গড়িয়ে যেত বুঝতেই পারতেন না। তারপর আবার অপেক্ষা আরেক পার্বনের। মন্দ কাটছিলনা সময়।

কিন্তু সেই সুখটুকুও সইলোনা খালেক সাহেবের কপালে। কিভাবে কি হলো এক এক করে চার সন্তানই পাড়ি জমালো বিদেশে। মাটি আঁকড়ে শুধু পড়ে রইলো যুথিকা। ঈদে পার্বনে যুথিকা যেত বটে কিন্তু সেই আনন্দ আর রইলনা। সময় গড়িয়ে খালেক সাহেব পৌঢ় থেকে বৃদ্ধ হলেন, জড়াগ্রস্থ হলেন। ঈদ পার্বন আকর্ষন হারালো তার কাছে। তখন শুধুই যুথিকার আসার পথের দিকে তাকিয়ে থাকা। যুথিকা আসবে একবার জানলে তাই বারে বারে ফোন করতেন আর বারান্দায় দাঁড়িয়ে পথের পানে তাকিয়ে থাকতেন।
তারপর এক সকালে চলে গেলেন তিনি যুথিকার কাঁধে সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে, না ফেরার দেশে। বেশ কয়েক বছর যুথিকা আপ্রান চেষ্টা করেছে আব্বার সম্পদ আগলে রাখতে। কিন্তু এসব বিষয়ে জ্ঞান ও আগ্রহ কম থাকায় সর্বোপরি চাকুরী, সংসার সামলে সময় দিতে না পারায় একে একে হাতছাড়া হতে থাকে আব্বার হাতেগড়া প্রিয় সম্পদ। ভাই বোনদের সাথে আলাপ করে যুথিকা। প্রবাসের ব্যস্ত আর কঠিন জীবনে তাদের ফুসরৎ কোথায় এসব ভাববার। তারাও আগ্রহ দেখায়নি। অবশেষে চরম সিদ্ধান্তটি নিতেই হলো। ওরাও মত দিলো শুধু বসতবাড়ী রেখে বাকী সব জমিজমা বিক্রি করে দেওয়া হবে। বিক্রিত অর্থ হিস্যা অনুযায়ী ভাই বোনেরা ভাগ করে নিবে। অনেক ভেবেচিন্তে মাও মত দিতে বাধ্য হলেন, এছাড়া উপায়কি।

এবার শুরু হলো আরেক যুদ্ধ। উকিল ঠিক করা হলো। সম্পত্তি বিক্রি করতে হলে যারা প্রবাসে রয়েছে তাদের আমমোক্তার নামা বা পাওয়ার অব এটর্নী দিতে হবে দেশে অবস্থানরত কাউকে। যুথিকা প্রথমে কিছুতেই এ দায়িত্ব কাঁধে নিতে রাজী না হলেও উকিল সাহেবের পরামর্শে তার নামেই পাওয়ার অব এটর্নী করতে হবে। এর অর্থ দাঁড়ায় যে, যারা বিদেশে আছেন তারা একটি রেজিষ্ট্রিকৃত দলিলের মাধ্যমে তাদের সকল পৈত্রিক সম্পত্তি ভোগদখল, বিক্রি বা যে কোন কিছু করার জন্য যুথিকাকে ক্ষমতা অর্পন করবে। সে এক মহা কর্মযজ্ঞ। চার ভাইবোনের দুজন থাকে অষ্ট্রেলিয়ায়, দুজন কানাডায়। পাওয়ার অব এটর্নী তৈরী করে তাদেরকে পাঠাতে হলো। সংশ্লিষ্ট হাই কমিশন তা সত্যায়ন করে দেয়। সেই দলিল ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়ে সংগ্রহ করতে হয়েছে তাদের সত্যায়ন। অতঃপর জেলা প্রশাসকের দপ্তরে জমা দিলে তারা আবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তা যাচাই করে তাদের সীল ছাপ্পড় দিয়ে তা পাঠায় রেজিষ্ট্রি অফিসে। এবার রেজিষ্ট্রি অফিসে পাওয়ার অব এটর্নী রেজিষ্ট্রি হবে। এতশত কাজ করতে কেটে গিয়েছে প্রায় দুবছর। সেই রেজিষ্ট্রির কাজেই এবার যুথিকার বাড়ী আসা।

সকাল থেকে শরীরটা ভাল নেই যুথিকার ছোট বেলায় স্বাস্থ্য কথায় পড়েছে “ মন ভাল না থাকিলে শরীরও ভাল থাকেনা।” যুথিকা ভাবে আসলে তার মন ভাল নেই তাই শরীরটাও কেমন করছে। এতদিন ধরে এসব কাজকর্ম করলেও যুথিকা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা আব্বার এত শখের কষ্টের জমা-জমি সব বিক্রি করে দেবে? শেকড় ছেঁড়ার বেদনায় নীল হয়ে যায় যুথিকার মন। মনে মনে বলে “আমাকে মাফ করে দেন আব্বা, আমি পারলামনা আপনার স্মৃতি ধরে রাখতে, শেষরক্ষা হলোনা।” মা বললেন “আজ না হয় থাক, কাল যাস।” কিন্তু তাতো হবার নয়, আজই যে রেজিষ্ট্রির শেষ তারিখ। সাব রেজিষ্ট্রার সাহেব জানিয়েছেন বড্ড দেরী হয়ে গেছে। বিধি অনুযায়ী ২৪ তারিখের মধ্যেই রেজিষ্ট্রি না হলে সব ভেস্তে যাবে। দুবছর জুড়ে সকল কর্মকান্ড জলে যাবে।

পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী সকাল ১১টায় সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে পৌঁছাল যুথিকা। সেখানে ভীষন ভীড় অনেক মানুষের আনাগোনা। অনেকক্ষণ বসে আছে যুথিকা, কেন দেরী হচ্ছে ঠিক ঠাহর করতে পারেনা সে। অবশ্য সাব রেজিষ্ট্রার সাহেব তাকে খাতির করেই বসিয়েছে হাতল ওয়ালা ছেঁড়া গদির চেয়ারে, চাও খেতে দিয়েছে। টি ব্যাগ দেওয়া চা দোকান থেকে অফিস পর্যন্ত পৌঁছাতে কালো তিতা আর ঠান্ডা হয়ে গেছে। যুথিকা যথাসম্ভব চেষ্টায় মুখায়বব বিকৃত না করে চা খায়।

যাহোক দুপুর নাগাদ স্বাক্ষর করার জন্য দলিল প্রস্তুত হলো। সাবরেজিষ্ট্রার সাহেব একটু উশখুঁশ করছেন, সম্ভবত তার দুজন সহকারীও মনে হয় কিছু বলতে চাচ্ছেন। এরপর বলেই ফেলে “ আপা মিষ্টি খাওয়ার জন্যে তো কিছু দিতে হবে।”
যুথিকা থমকে যায়। এবার সহকারী একজন বলে “আপাতো একটা মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়েও আসেন নাই। এসব কাজেতো অন্যেরা সারা অফিসকে খাওয়ায়।”
“এসব কাজে” – কথাটা যুথিকার কানে বাজে। ওদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তার চেহারায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঝুলে থাকে। এবারে অসহিস্নু সাবরেজিষ্ট্রার সাহেব উত্তরটা দেয়- “
এত কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক বনে যাচ্ছেন, আমাদের সামান্য কিছু ভাগ দেবেন না?”
যুথিকার বুকের মধ্যে কে যেন হাতুড়ি পেটায়। কম্পিত কন্ঠে বলে উঠে-
“নানা এগুলোতো বিক্রি করে.............”
কথা শেষ করতে দেয়না ইলিয়াস সাহেব,
“রাখেন এরকম কত দেখলাম। চুলে তো আর এমনি এমনি পাক ধরে নাই।”
যুথিকা এতক্ষনে ইলিয়াস সাহেবকে ভাল করে দেখে। চুলে সত্যিই পাক ধরেছে। ফর্সা লম্বাটে মুখ, লিকলিকে শরীর, চোখদুটো কোটরাগত। দাঁত বের করা হাসিটা খুব অশ্লীল লাগে যুথিকার। তার দ্বিতীয় সহকারী সূত্র ধরিয়ে দেয়
“ সুরুজ মিয়ার মেজ ছেলেটা বাপ মরলে এই পাওয়ার অব এটর্নীর নামে মা-ভাই বোনদের সব সম্পত্তি লিখে নিলোনা। এখন পায়ের উপর পা তুলে জমিদারী করছে। তবে লোক খুব দিলদার আমাদের সবাইকে খুশী করে দিছে।”

যুথিকার বুকের হাতুড়ি পেটানো বেড়ে যাচ্ছে, বিশাল ওজনের হাতুড়ির আঘাতে বুক ভেঙে যাচ্ছে।
হঠাৎ চেয়ারটা যেন দুলে উঠল, পুরো অফিস ঘরটাই দুলছে, ভূমিকম্প কি? নাহ্ মাথা ঘুরছে, শরীরটাও গুলিয়ে উঠছে। বেশ জোড়েই তো ফ্যান ঘুরছে। তবুও যুথিকা ঘেমে একশা। শরীরটা বেশ কিছুদিন খারাপ যাচ্ছে। এইতো মাস খানেক আগেই অফিসে এমন হলো। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছিল হাত-পা ঠান্ডা। কলিগরা দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেল। ইমার্জেন্সিতে ইসিজি আরও কিছু টেষ্ট, নাকে অক্সিজেন হাতে ক্যানোলা সে এক মহাকান্ড। ইসিজি রিপোর্টে কিছু পরিবর্তন পাওয়া গেল। করোনারী কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করা হলো যুথিকাকে। দুদিন ধরে নানা প্রকার পরীক্ষা নিরীক্ষা আর প্রতি বেলায় ইসিজি এর মনিটরিং চলল। এ যাত্রায় বেঁচে গেল যুথিকা, হার্ট এ্যাটাক হয়নি। সাতদিন রেষ্টের পরে ইটিটি বা ষ্ট্রেস টেষ্ট করে দেখাতে হবে। সাতদিন পরে ষ্ট্রেস টেষ্ট হলো। নাহ্ নিঃসংশয় হওয়া গেলোনা। রিপোর্ট ইউনিভোকাল অর্থাৎ হার্টে ব্লক থাকার সম্ভাবনা পঞ্চাশ ভাগ। যাকে বলে ফিফটি ফিফটি।
" তবে দ্রুতই এনজিওগ্রাম করে ফেলা উত্তম হবে এবং প্রয়োজনে ষ্টেন্টিং বা যা প্রয়োজন করে ফেলতে হবে।"
ডাক্তার সাহেব কড়া ভাবে বললেন ।
"তবে সে পর্যন্ত নাইট্রোমিন্ট স্প্রে চব্বিশ ঘন্টা সাথে রাখতে হবে। কোন সমস্যা দেখা দিলেই জিভের নিচে দুই চাপ স্প্রে করতে হবে।"
নিকটস্থ হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে এটাই প্রথম করনীয়। প্রায় দিন পনের অনেক ধকল পোহাতে হলো। এরপর মোটামুটি বিশ্রাম আর ঔষধপত্রে শরীরটা ঝরঝরেই লাগছিল। মন থেকে মৃত্যুভয়টাও উবে গেল। ডাক্তার সাহেব তো অতি সতর্কতা অবলম্বন করবেনই। আজকাল এদেশেও ডাক্তারের বিরুদ্ধে কেস কালাম শুরু হয়ে গেছে। হঠাৎ যুথিকার কিছু হয়ে গেলে যেন তিনি কেস-কাচারীর ঝামেলায় না পড়েন, তাই বেশী সতর্কতা। যুথিকা বেশ বুঝতে পারছে তার তেমন কিছুই হয়নি। দিব্যি ভাল আছে। অফিস করছে, দাওয়াৎ টাওয়াতেও যাচ্ছে। খামোখা একটা ইনভেসিভ প্রসিজিওর এ যাওয়ার কি দরকার। যদিও আজকাল ঢাকায় প্রতিদিনই অসংখ্য এনজিওগ্রাম, ষ্টেন্টিং, বাই-পাস অপারেশন সবই হচ্ছে। কিন্তু কেউ আবার হাসপাতাল থেকে আর বাড়ীও ফিরছেনা। কারনটা কি আর সাধারন মানুষ বুঝতে পারে।

ডাক্তার বলেছেন-
“ সিদ্ধান্তটা আমরা পেশেন্ট আর তার ফ্যামিলির উপর ছেড়ে দেই। আপনারা এনজিওগ্রামের সিদ্ধান্ত নিলে ডেট নিয়ে যাবেন।”
সিদ্ধান্ত নিতে যুথিকা একটু সময় নিচ্ছে তার অন্য একটি কারনও আছে। ওইযে পাওয়ার অব এ্যাটর্নির কাজটা ঝুলে আছে। অষ্ট্রেলিয়া আর কানাডায় কাগজ চালাচালি করে আর লাল ফিতায় আটকে থেকে সময় প্রায় শেষ হয়ে গেছে। অষ্ট্রেলিয়ান বা কানাডীয় হাই কমিশন স্বাক্ষর করার চার মাসের মধ্যে পাওয়ার অব এটর্নী রেজিষ্ট্রি হতে হবে। নাহলে পুরো প্রক্রিয়াটাই বানচাল হয়ে যাবে। চার মাস শেষ হবে ছাব্বিশ তারিখে অথচ ছাব্বিশ, সাতাইশ তারিখ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। কপাল মন্দ হলে যা হয় এদিকে পঁচিশ ডিসেম্বরও বড় দিনের সরকারী ছুটি। চব্বিশ তারিখের মধ্যে রেজিট্রি করতে হবে।
অফিসে বসে যুথিকা ক্যালেন্ডারে চোখ রাখে আজ একুশ তারিখ, এখন কি আর এনজিওগ্রামের টেবিলে শুয়ে পড়া যায়? “ভালই তো আছি, এইতো কয়েকটা দিন, কাজটা সেরে এসেই এনজিওগ্রাম করাবো।” যুথিকা ভেবেছিল।

হঠাৎ সাব রেজিষ্ট্রি অফিসের দরোজার সামনে খালেক সাহেবকে দেখতে পায় যুথিকা।
“আব্বা আপনি?”
সর্বশক্তি একত্র করে বলতে চেষ্টা করে যুথিকা কিন্তু কথা জড়িয়ে যায়। চোখেও ঝাপসা দেখছে। ব্যাগ থেকে নাইট্রোমিন্ট স্প্রে বের করতে চায় সে, কিন্তু চোখে ঝাপসা দেখায় হাতরাতে থাকে। বুকটা ভীষন ভারী লাগছে, যেন বুকের উপর বিশাল পাহাড় চেপে বসেছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
বুকের উপর পুরো দোতলা বাড়ী, মেহেগনী বাগান, বাঁশঝাড়, ভিটে, জোলা সবকিছু চেপে বসেছে। যুথিকা এদিক ওদিক মাথা নাড়ায় ওগুলো ফেলতে পারেনা। আব্বার মুখটা ব্যাথাতুর দেখায়।
খালেক সাহেব হাত বাড়িয়ে দুহাতে সরিয়ে দিতেথাকেন বাড়ী ঘর জমি জমা সব। তারপর ঝুকে এসে যুথিকার হাত ধরেন। যুথিকার খুব হালকা লাগছে। আব্বাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে এবার। হালকা হয়ে যেন ভেসে উঠছে। খালেক সাহেবের হাত ধরে যেন দুজনেই ভেসে চলেছে। যুথিকা অবাক হয় আব্বা কি উড়তে জানতেন? নিচে পড়ে থাকে বাড়ী, জমি, বাগান, জোলা সব কিছু।

আতিয়ান নাহার
৬/০৪/২০
ঢাকা