ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Saturday, November 21, 2020

কিসিং গোরামি এবং মঞ্চনাটকে অভিনয়

।।চয়ন খায়রুল হাবিব।।

'ডৌল, জুলেখার জেরা পর্ব' নাটকে জুলেখা চরিত্রে পারভিন পারু।

'কিসিং গোরামি' কবিতাটা লিখেছিলাম কয়েক যুগ আগে।'ডৌল, জুলেখার জেরা পর্ব' নাটকে কবিতাটা ব্যাবহার করেছিলাম জুলেখার মনোগত সংলাপ হিশাবে।নাটকে ডিজাইনার ছিলো জুনাইদ ইউসুফ, অভিনয়েও ছিলো।পারভিন পারু ছিলো জুলেখা, আর শিশির রহমান সূত্রধর।

অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বাংলাদেশের নাটকে সবচেয়ে দুর্বল অংশ হচ্ছে অভিনয়।যেখানে অভিনয় দুর্বল, সেখানে মনোগত অভিনয় আদায় আরো কঠিন। জামিল আহমেদের মতো অনেকে আছে, অভিনয় সৌকর্শকে গুরুত্ব দেন না, না পেতে পেতে এটা হতে পারে।আমি অভিনয়কে গুরত্ব দেই।কিন্তু গুরুত্ব দিলেইতো হবে না, অভিনয় বের করে আনতে হলে কি করা?বিশেষ করে কম সময়ে, তার উপায় বের করাটা আসল।এর একমাত্র উপায় হচ্ছে, কুশিলবদের বার বার টেক্সট পড়ানো, মুখস্থের পরেও বার বার, বার বার, বার বার।

'জুলেখা ট্রিলজি'র সুরকার শিশির বলছিলো, টেক্সটা কঠিন, সুর দিতে ঝামেলা হবে।বলেছিলাম, টেক্সট আপনাকে সুরে নিয়ে যাবে।তাই হয়েছিল, যখন সুর এলো তোড়ের মুখে শিশির একের পর এক ট্র্যাকে সুর দিয়ে দিলো।অভিনয় হচ্ছে একটা ভাষা, সুর তাকে বেধে রাখে, যে যত টেক্সট পড়ে সে তত ভালো ভাষা এবং সুরটা আয়ত্তে আনতে পারে।এটা ইম্প্রোভাইজেশান দিয়ে হয় না।অনেক চমক, গমক, তেলেসমাতি ইম্প্রোভাইজেশানের পর এ জায়গাতে জামিল ভাইর কাজ আমার কাছে বেসুরো মনে হয়।কানে লাগে।নির্দেশক হিশেবে যদি আপনার হাতে সময় কম, কুশিলবেরা ইম্প্রোভাইজ করতে চাচ্ছে, সে নাটক না করা ভালো।সেটা হবে ভাষাদুষিত উপস্থাপনা।

এ-জায়গাতে আমার ঢাকার 'পালাকার', 'বটতলার' সাথে বনিবনা হয় নাই।ভিজুয়াল দিয়ে টেক্সট প্রকাশ তো ফিল্মের ছেলেমেয়েরা করবে, এহ।আবার ফিল্মেও যে টেক্সটের দরকার তা মেরিলিন মনরোর স্ক্রিপ্ট পড়বার ভঙ্গি দেখলে বোঝা যায়, বিয়েও করেছিলো স্ক্রিপ রাইটারদের বাবা আর্থার মিলারকে।সময় যত কম থাকবে, টেক্সটে তত বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

বাংলাদেশের কথিত অভিজ্ঞ এবং নাট্যকলায় স্নাতোকোত্তরদের অভিনয় আক্ষরিকভাবে বাচ্চাদের এক্সারসাইজ থেকেও খারাপ।বাচ্চাদের স্কুল ফাইনালের পরপর স্কুলের ইয়ার্লি নাটকে দেখা যাবে কেউ কেউ সংলাপ ভুলে গেছে, মুখ নিচু করে প্রানপনে সংলাপ মনে করার চেষ্টা করছে।ভ্যাবাচেকা খেয়ে ইম্প্রোভাইজেশানও কুলিয়ে উঠতে পারছে না।ঐ যে মরিয়া মুহুর্তটি, থিয়েটারের জন্ম হয় ঠিক সে মুহুর্তে।সামনে বসা সবাই আন্তরিকভাবে তখন চায় শিশুটি সংলাপ মনে করতে পারুক, সে মুহুর্তটিকে ব্রেখট নাম দিয়েছিলো এলিয়েনেশান, বেকেট নাম দিয়েছিল পজ, আমি তাকে বলি যখন লিরিক ভেঙ্গে 'ভাঙ্গা লিরিক' তৈরি হয়, যখন বয়ান ভেঙ্গে 'ভাঙ্গা বয়ান' তৈরি হয়।

বলছিলাম, 'কিসিং গোরামি' কবিতাকে মনোগত সংলাপে ব্যাবহার করার কথা।পারু তা করেছিলো খুব ভালো, টেকস্টকে গাইড হিশেবে নিয়েছিল, আর টেক্সটের সাথে তাল মিলিয়ে জুনায়েদ সরঞ্জাম যোগাড় করেছিলো, শিশির সুরের আবহ তৈরি করেছিল।টেক্সট যে পারুর রক্তের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল, তা বুঝেছিলাম মঞ্চায়নের বছর খানেক পরে কিছু সংলাপ ও গানের স্টুডিও রেকর্ডিং এর সময়।মঞ্চায়নে বিপুল গ্যাপ থাকার পরও কোনো মহড়া ছাড়া পারু এই অংশটাসহ অন্য অংশগুলাও যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলেছিল।টেক্সট ধরে ফেলতে পারলে, শ্রুতি ও অভিনয় একই ভাষার মেলবন্ধন হয়ে যায়।

শিল্পি বন্ধু টুটুল আহমেদ ইদানিং 'জুলেখা সিরাপে' অনেক রকম এ্যাকোয়ারিয়ামের মাছের ছবি দেয়।মজা করে বলতে ইচ্ছে করে, কি বন্ধু কাটাবনে দোকান খুল্লা না কি।টুটুলরা নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের লোক, তারা কি আর গেয়ো চয়নের 'কিসিং গোরামি' পাতে তুলবে!কিন্তু এই যে টুটুলের ছবিগুলো আমাকে কাটাবন মনে করিয়ে দিলো, কিসিং গোরামি মনে করিয়ে দিলো, আজিম্পুরের খড়কি বাবুকে মনে করিয়ে দিলো, তাও কম না।সেদিক থেকে 'জুলেখা সিরাপ'ও একটা বিকল্প মঞ্চ, একটা বিকল্প গ্যালারি।খড়কি বাবু হচ্ছে আজিম্পুরের সেই বালক, যে টিনের বাসাতে বসে সত্তর দশকে ইত্যাদি সোনালি, দেবদুত মাছ বিক্রি করতো, তারপর আশির দশকে কাটাবনে প্রথম এ্যাকোয়ারিয়ামের দোকান খোলে।

এবার এখানে 'কিসিং গোরামি' কবিতাটা উঠিয়ে দেই।আর যাদের আরো বেশি পেতে ইচ্ছে করবে, তারা লিঙ্ক ধরে 'নৈকট্যধামে'র কবিতাগুলো খেয়ে নিতে পারেন।

কিসিং গোরামি

কবিতাটা আমি হারায়ে ফেলেছিলাম
কিসিং গোরামি খুব অদ্ভুত মাছ
নারি পুরুষ সবসময় জোড় বেধে থাকে
কিছুক্ষন পরপর মুখোমুখি থেমে
একে অন্যকে ঠোটে ঠোট ঘষে সুধায়ঃ
এটাকে কি চুমু বলে, এটাকে কি চুমু বলে

মুল কবিতাটির সময় আমার য়্যকোয়ারিয়ামে
মাত্র এক জোড়া কিসিং গোরামি ছিল
জোড়ের পুরুষটি হঠাট মারা গিয়েছিল
নারি-গোরামিটি প্রবালে , শ্যাওলায়, গুগলিতে
চুমুর স্মৃতিতে চুমু দিতে দিতে সুধায়ঃ
এটাকে কি চুমু বলে, এটাকে কি চুমু বলে

ঠোট ঘশতে ঘষতে নারিটিকে ঠোট হারাতে দেখে
পুরো মুখ মাথা উপুড় করে ডুব দিয়েছিলাম
ছোট্ট য্যকোয়ারিমটাতে
পোকি পোকি গোরামিগুলো এখন আবার
হাজার জোড়া কিসিং গোরামিতে হাসে


চয়ন খায়রুল হাবিব
২০/১১/২০
ব্রিটানি, ফ্রান্স