ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Wednesday, November 18, 2020

করোনা ভাইরাস ও সুদের হার

।।খায়রুল আলম চৌধুরী।।


গাড়ির চাকা নষ্ট হয়ে গেছে। বদলাতে হবে। বসন্তের শেষ দুপুর। বেলা পড়ে এসেছে। বিকাল জুড়ে ছড়িয়ে আছে মরা রোদ। রাস্তার পাশেই টায়ারের দোকান। মহাজনের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে।শশ্রুমন্ডিত হাসিমাখা চেহারা। দেখলে মনে হয় কত দিনের পরিচিত! দেখার সাথে সাথেই আমাকে যত্ন করে বসতে দিলেন।
আট ফুট বাই চল্লিশ ফুটের দোকান ঘর। নানা দেশের নানা ব্র্যান্ডের টায়ার আর চকচকে চাকার রিংয়ে ঠাসা দোকানঘর। একটাই টেবিল ফ্যান। পশ্চিমমুখি ঘর, একফালি রোদ তাপ ছড়াচ্ছে ভিতরে। আমাকে ছায়ায় বসতে দিয়ে ফ্যানের বাতাসটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে একগাল হেসে দোকানদার সোহেল ভাই আমাকে প্রাথমিক সমাদর করলেন। মুন্সিগঞ্জের মানুষ। বংশ পরম্পরায় ব্যবসায়ি। সোহেল ভাই চায়ের অর্ডার দিলেন। আমি দেখছি কোন টায়ার নেয়া যায়। দাম আর সামর্থের মিলনবিন্দুটা খুঁজে পাবার চেষ্টা করছি।

‘ব্যবসা-বাণিজ্য তো একবারে বন হৈয়া যাইতাছে স্যার। দ্যাশের যেই অবস্থা! কী এক করোনা ভাইরাস আইলো’ বলতে থাকেন সোহেল ভাই। আমি মাথা নাড়ি। দুই একটা হা-না বলি। তাতে কোনো সমস্যা নাই তার, কথা বলে চলেন তিনি। ‘কোনোহানে কোনো মানুষ নাই। শপিংমলে নাই, সুপারস্টোরে নাই, বাজারে নাই। বিশেষ দরকার ছাড়া কেউ এহন ঘর থাইকা বাইর হৈতাছে না। দেহেন না রাস্তাঘাটে কোনো মানুষ নাই, রাস্তায় কোনো জাম নাই, পাবলিক বাসে ভিড় নাই। সব ছয়ছাপ্পা হৈয়া গেছে।’

করোনার প্রভাব যে কিভাবে পড়ছে আমাদের অর্থনীতিতে তার একটা বাস্তব পাঠ পেলাম টায়ার বিক্রেতা সোহেল ভাইয়ের কাছ থেকে।
এবার তিনি উৎসাহী হলেন অর্থনীতির আরেকটি সাম্প্রতিক বিষয়, সুদের হার নিয়ে। শুরুতে ভেবেছিলাম সুদটুদ নিয়া হয়ত খুব বেশি আগ্রহ দেখাবেন না। কিন্ত তিনি সরাসরি জানতে চাইলেন, ‘সুদের রেট কি কমছে? নয় পার্সেন্ট হৈছে?’ আমার অবাক হবার পালা।
-না, এখনো হয় নাই, তবে কাজ হচ্ছে, দেখা যাক’, বললাম আমি।
-কেন, সমস্যা কি?
-সমস্যা হইলো, ব্যাংক যাদের থাইকা টাকা নিয়া লোন দিবো তাদের যদি লাভ দিতে না পারে, তাইলে তো তারা ব্যাংকে টাকা রাখবো না। টাকা না পাইলে লোন দিবো ক্যামনে?
-কথা ঠিক। তয় কইলাম একটা জিনিস খেয়াল রাইখেন। সুদের রেট কমলে কিন্তু রিস্ক আছে!
আবার আমার অবাক হবার পালা। ক্রেডিট রিস্ক নিয়া কথা বলছেন টায়ার দোকানদার সোহেল ভাই!
-কি রকম? কৌতুহলি না হয়ে পারি না আমি।
-একটা গল্প কই আপনারে। গল্প না ঠিক, আমার অভিজ্ঞতা।
-জ্বি বলেন। চা শেষ করে মনযোগ দিয়ে তার কথা শুনি আমি।
-ব্যাংকের ম্যানেজারেরা আইয়ে আমার এহানে। আমিও যাই তাগোর চেম্বারে। আপনাগোর দোয়ায় আমার বাইরে বওন লাগে না। ডাইরেক্ট ম্যানেজারের চেম্বারেই বই আমি। দুই ব্যাংকের দুই ম্যানেজার আমারে লোন দিবার চাইছিলো। লগেলগে নেই নাই। তবে আল্লার রহমতে আট নয় বছর আগে খিলখেতে একটা বাড়ি কিনছি আমি। তখন বিশ লাখ টাকার শর্ট পড়ছিলো। ব্যাংক থাইকা লোন নিছিলাম তখন। সময়মত শোধ কইরা দিছি। এহন আর কোনো পাওনা-দেনা নাই।
একটা তৃপ্তির হাসি দেখা যায় সোহেল ভাইয়ের মুখে। একটু বিরতি নিয়ে আবার শুরু করেন তিনি।
-সবাই তো আর এক রকম না। ডিফল্টারও আছে! এদের থাইকা সাবধান থাইকেন। সুদের রেট কমতাছে তো, বহুত ডিফল্টার পার্টি আইবো লোন লওনের লাইগা। কোনোরকমে একবার নিতে পারলেই হইল, আর টাকা ফেরত পাইবেন না।
চোখ চকচক করে উঠে তার। কত সহজে অর্থনীতির কত গভীর বিষয় নিয়ে কথা বলছেন তিনি। আমি ভাবতে থাকি।

খায়রুল আলম চৌধুরী
১৪/০৩/২০
ঢাকা


পেইন্টিং, ইকবাল আহমেদ।'জুলেখা সিরাপ' ফেসবুক গ্রুপে শিল্পীর পোস্ট থেকে প্রাপ্ত।