।।রাদ আহমদ।।
১৯৯৭-২০০২ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সময় ঘটনাক্রমে একজন সিনিয়ার ভাইয়ের মারফতে রিফাত ভাই (রিফাত চৌধুরী) সম্পাদিত কিছু পত্রিকা দেখতে পাই আমাদের ইনস্টিটিউটের ক্যান্টিনের টেবিলের উপরে জ্বল জ্বল করতেছে এক দুপুরবেলা।
আমি তখন কবিতা লিখি। দু একটা প্রথম সারির মেইনস্ট্রিম পত্রিকা বা সাহিত্য বিষয়ক ম্যাগাজিনে (নতুন আসা ডিটিপি পত্রিকা বা ম্যাগাজিনগুলির কথা বলতেছি) কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এই যে টেবিলের উপরে ছোটো কয়েকটা লিটল ম্যাগ - তাদেরর গেট আপ মেক আপ, আর ভিতরে প্রকাশিত লেখাগুলির কোয়ালিটি দেখে অভিভূত হয়ে যাই। আরে, এইরকম লেখাই তো খুঁজতেছিলাম এতদিন মনে মনে। এগুলাই তো আসল কবিতা।
![]() |
রিফাত চৌধুরী সম্পাদিত, 'ছা্ট কাগজের মলাট' সাহিত্য পত্র, ৯০ দশক। একই শিরোনামে আশির শুরুতে বেরিয়েছিল রিফাত চৌধুরী ও কাজল শাহনেওয়াজের প্রথম যৌথ কবিতা সংগ্রহ। |
তার উপরে সেই পত্রিকাগুলির চেহারা। যখন কর্ণফুলি-ওয়াইটের মতো ঘিয়াটে, আন্তরিক রঙের কাগজ বাজার থেকে উধাও হয়ে যেতেছে প্রায়, কেমন অস্বাভাবিক নীলচে চকচকে ধরণের একটা কাগজে (অফসেট) ভরে যেতেছে চারিপাশ ঠিক তখনই কর্নফুলি ওয়াইট বা সেইরকমের কাগজে প্রকাশিত কিছু পত্রিকা। নানা পাতায় নানা স্থানে ভিন্ন ভিন্ন সাইজের ফন্টের সুষম উপস্থাপনা, ডিটিপি ফন্ট না হয়ে ছাপাখানার ফন্ট, মাঝে মাঝে হাতে আঁকা স্কেচ বা ছবি বলিষ্ঠ ভাবে পুরো পৃষ্ঠা জুরে প্রকাশ করা। ছবিগুলি থেকে আবেগ, অনুভূতি বিচ্ছুরিত হতেছে, চারুকলার ওয়েল-ট্রেইনড স্টুডেন্টদের আঁকা ছবির মতো না। মনে হয় যে এখানেই আসল ক্রিয়েটিভিটির খনি লুকিয়ে আছে। (প্রয়াত সালাম আবদুস ভাই মাঝে মাঝে কিছু স্কেচ দিতেন তখন ঐ পত্রিকায়)
এর পরে নানা ঘটনা। রিফাত ভাইয়ের বাবুপুরা-র ঘর চিনে নেই। নানা ধরণের লোকজনের সমাগম দেখি। মোস্তফা ভাই, শশী ভাই, ফিল্ম মেকার আকরাম ভাই, জাহাঙ্গীরনগরের তুখোর কবি আবু আহসান মিশু ভাই অথবা চমৎকার গদ্যকার তারিক আল বান্না, পুরনো ঢাকার সেন্ট গ্রেগরির আশিক ভাই প্রমুখ। এছাড়াও নানা পেশার মানুষ আড্ডা, মিশেল।
আর এই আড্ডাগুলির পিছে পিছে রিফাত ভাইদের এর আগ পর্যন্ত করে আসা সাহিত্যকর্ম ইত্যাদির সাথে পরিচিত হতে থাকি ধীরে ধীরে। কারা এক সাথে লিখতেন, আড্ডা দিতেন সেগুলি সম্পর্কে জানা শুরু করি। নানা রকমের লিটল ম্যাগ, ক্ষুদ্র প্রকাশনা, নানা জনের সম্পাদনায় চমৎকার সব কাজ আর লেখালেখির সমাহার পরিস্ফুট হতে থাকে।
চেতনাপ্রবাহের মগ্ন জলপ্রপাত :
ক্রিয়েটিভ কাজ আসলে সবসময় একক ব্যক্তি -মানুষে সম্ভব হয় না। অবশ্যই এসবের পিছে একটা না একটা গ্রুপ বা দলবদ্ধতা নিহিত থাকে। এক ধরণের রুচি, চিন্তা, জিজ্ঞাসা, ব্যক্তিত্ব, আইডিয়ার তুমুল আদান প্রদান, হাসি, আনন্দ, দুঃখ, জীবন জিজ্ঞাসা - এগুলি লুকিয়ে থাকে পিছে। ফলে আমি বুঝতে পারি যে এই গ্রুপটা, যাঁরা কিনা আবার প্রচলিত অর্থে বেশ কিছুটা প্রচার বিমুখ - এই ইনাদের যতটা প্রকাশ্যে আসার কথা ছিল , উনাদের কাজকর্ম যতটা মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় প্রচারিত হবার কথা ছিল - সেটা হয়নি।
মেইনস্ট্রিমে বরং পুরনো সাহিত্যের উপর নির্ভর করা একটা 'নিরাপদ' আর ট্রেডিশনাল ধারা চলে আসছে। সেখানে যেন সেই লেভেলের কোনো চমৎকারীত্ব নেই, ইনোভেশন নেই - এইরকম একটা ধারণা আমার মনে গড়ে উঠতে থাকে। আশির দশক জুড়ে ঢাকা শহরে যাঁরা সত্যিকারের সাহিত্যের কাজ করে গেছেন, আমি বলব তাদের মধ্যে অন্যতম এই তুখোর, কবিতাপ্রেমী, প্রচারবিমুখ মানুষগুলি।
![]() |
জলপ্রপাত সাহিত্যপত্র, ১৯৮৬। কাজল শাহনেওজারের প্রথম গল্প, চয়ন খায়রুল হাবিবের প্রথম কাব্যনাট্য খায়রুল হাবিব নামে এখানে প্রকাশিত। প্রচ্ছদ, নাতাশা হাবিব।সম্পাদনা, খায়রুল হাবিব। |
আমি জানি না। সত্যিকার বাস্তবতা হয়ত আরও অনেক কিছুকে ইনক্লুড করবে। পরের কালে এসে এই আমি যাদের দেখছি , তার পিছনে হয়ত আরও অনেকে আছেন যাদের আমি দেখি নাই। সত্যিকারের সমীকরণ হয়ত অন্য রকমের। তারপরেও আমার নিজের দেখা থেকে কিছু বর্ণনা করার সুযোগ নিচ্ছি এখন।
নানা সময় আমি এই গোষ্ঠীর কারো কারো কবিতা নিয়ে ফেইসবুকে ছোটোখাটো মন্তব্য করার চেষ্টা করেছি। একেবারে আট ঘাট বেঁধে নয়। মাঝে মাঝে লেখাগুলি ছোটো, হয়ত 'নোট' আকারে, আবার মাঝে মাঝে বড়ো। ছোটো বা বড়ো বিষয় না। যেইরকম প্রস্ততি নিয়ে লেখা উচিৎ সেইরকম প্রস্ততিও কিন্তু নেওয়া হয়নি। বলা যেতে পারে শর্ট নোটস।
আমার লেখালেখির ফাঁকে ফাঁকে উনাদের কবিতাগুলি পড়লে বরং পাঠক পাঠিকা উপকৃত হবেন। হয়ত কিছুটা বুঝবেন কেন আমি একটা টার্মের আওতায় উনাদের লেখালেখি বা গ্রুপটাকে আনতে চাইছি।
আরেকটা বিষয়। এখানে কিন্তু উনাদের সমসাময়িক অনেকের লেখাই বাদ পড়ে গেছে। আসলে আমার লেখা হয়ে উঠেনি, অথবা, এই মুহুর্তে ঠিক ফেইসবুকে খুঁজে পাচ্ছি না। যেমন, বলা যায়, কাজল ভাইয়ের একটা কবিতার ইন্টারেসটিং এক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলাম একদা। কি এক কল্পিত গিটার বিক্রেতার অবতারণা করে কিছু আলাপ করতেছিলাম। কিন্তু সেই লেখাটা , এখন অনেক করে খুঁজেও, ফেইসবুকে খুঁজে পেলাম না।
এই গ্রুপ সংশ্লিষ্ট অনেক অনুজদের লেখা, যাঁরা নব্বইয়ে লেখা শুরু করেছেন, তাঁদের লেখাও বাদ দিলাম। অমিতাভ দা (অমিতাভ পাল) নিশ্চিত ভাবে ওঁদের মধ্যে ছিলেন। উনার সাথে অনেক দেখা হতো , অদ্ভুত সুন্দর পরিচ্ছন্ন লেখাগুলি পড়া হতো। অথচ কোনো কারণে উনার কবিতা নিয়ে লেখা হয়নি এই পর্যন্ত। তবে অবশ্যই সামনে লেখার ইচ্ছা আছে।
নিচের কবিতাগুলি লেখকদের নামের বর্ণানুক্রমিক ধারায় সাজানো হয়েছে।
##################################
ডাস্টবিনে । আহমেদ মুজিব।
##################################
(৯ নভেম্বর, ২০২১)
![]() |
আহমেদ মুজিবের প্রথম কবিতা সংগ্রহ 'প্রেসের কবিতা, ১৯৯১। পেছন ফ্ল্যাপ লেখন, চয়ন খায়রুল হাবিব। ফটোগ্রাফ, বাবু আহমেদ। |
একটা ছবিতে 'ডাস্টবিনের ভালো নোংরাগুলি' ক্যাপশন মতো দিতে গিয়ে মনে পড়ল কবি প্রয়াত আহমেদ মুজিব - উনার এই কবিতাটার কথা । নেটে সার্চ করে যতগুলি ছোটোখাটো সংকলন পাওয়া যায় উনার লেখাগুলির, তার মধ্যে এই কবিতাটি নেই। অথচ অন্যতম ভালো লাগার একটা কবিতা।
ডাস্টবিনে
~~~~~~~~
চুপচাপ, স্থির ডাস্টবিনের ভালো নোংরাগুলি
বৃষ্টির পর মাঝখানে জমা পানিতে ঠিকই চকচক করে আকাশের তারা
এইখানে আমি করি না মানুষের রূঢ় ব্যবহারগুলি জমা,
অনেক নোংরায় ফুলের মতো
বস্ত নিয়ে ইঁদুর ছুটে গেলে
কালো বিড়াল আর শাদা বিড়াল তর্ক করে শুধু
আঁকাবাঁকা নোংরার ভিতর থেকে ভেসে আসে চিৎকার
কিন্তু মানুষের আস্তে কথা বলার চাইতে স্বাদু ও মধুর।
কালো নোংরায় নাদুসনুদুস শাদা বিড়ালিনিকে
অহংকারি দেখায়
গল্পকারদের বানানো গল্পগুলো পড়ে আছে,
শুয়ে আছে কারো কারো বানানো কবিতার লাইন,
একটি ছেঁড়া পেপারে মার্টিনার র্যাকেট খেলায় শিৎ্কারের বর্ণনা,
রেখার ডাবল পার্টের সিনেমার কথা
পড়ে আছে ডাস্টবিনে
('শুধু টের পাই আমি' পুস্তিকা থেকে টুকে নেয়া গেল। প্রকাশক, ফৃ, ২০০৭)
ডাস্টবিন নিয়ে কবিতা লেখা সম্ভব ?!? এরকম অচ্ছুত জিনিসকে এমন মমতায় নিয়ে আসা সম্ভব? খুব অবাক হবার মতো ঘটনা।
"এইখানে আমি করি না মানুষের রূঢ় ব্যবহারগুলি জমা" - এই লাইন মনের মধ্যে গেঁথে আছে আর এই লাইনটি আমি নিজে নিজে মাঝে মধ্যে উচ্চারণ করি।
######################################
চিরন্তন সরল রেখা । কাজল শাহনেওয়াজ
######################################
(২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩)
![]() |
'আমার শ্বাসমূল', একক কবিতা গ্রন্থিকা, কাজল শাহনেওয়াজ। ফৃ একুশ শতক সিরিজ।২০০৭। |
চিরন্তন সরল রেখা
~~~~~~~~~~~~~~~
শরীরে বাকল পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি অ্যাকাশিয়া
ছোট্ট সে একেবারে কিশোর পাতাগুলি ছাগল ছানার মতো লাফাচ্ছে
নিচে তার আলো করে দুটি ছোট্ট চকচকে পোকা
সমস্ত গাছপালা ঝুঁকে আছে আনন্দে কলিজা রঙের পাতায়
দখিনা বাতাসের ঘন ডাক, মাথা কাত করে মুসান্ডা
এলামন্ডার সাথে ফিসফিস করে হাসাহাসি করছে,
কানে হাওয়া লাগাচ্ছে ঘাসেরা, বিনোদনের, ব্যক্তিগত পাতায়
প্রতি পৃষ্ঠায় সমান বর্ণনা
প্রতিটা গাছই আজ একই সমাজের
পোকা দুটির একটি হলুদ কামিজ আর একটি কালো ট্রাউজার পরেছে
ওরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটা সরল রেখার জন্ম দিচ্ছে।
একটা চিরন্তন সরল রেখা।
পাশের পিপুল স্বাক্ষী, স্বাক্ষী গর্জন।
প্রথমে দেখা যাক কেন এটাকে ট্রেডিশনাল কবিতা বলব না। ট্রেডিশনাল ছন্দ নেই । গদ্যছন্দ যদি কেউ বলেন তো বলতে পারেন, তবে 'গদ্যছন্দ' জিনিসটায় তো জগতের প্রায় সবকিছুকেই শ্রেণীভূক্ত করা যায়, ফলে সেটা আমি আর বললাম না। গল্প বলার ভাষা, অথচ একটা চলা, একটা থামা আছে যা ইনস্টিংটিভ ভাবে আমরা পাঠ করার সময় বুঝে নেই।
"ছাগল ছানার মতো লাফানো" এই দৃশ্য বা শব্দগুলি কি আমাদের এখনকার কবিতা লেখকেরা এত সহজে ব্যবহার করবেন? মনে হয় না। একটু কাব্যিক ঢঙ নিয়ে আসবেন, ছাগলের আরও 'গ্রহণযোগ্য' কাব্যময় প্রতিশব্দ হয়ত খুঁজবেন। একইভাবে ট্রাউজার শব্দটি। "কালো ট্রাউজার" আমরা কত না দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে যেতেছি বছরের পর বছর , কিন্তু বাংলা কবিতায় এই শব্দ ততটা আসছে কই?
নিজের কথাটা কবি নিজের মতো করে বলতে না পারলে সেখানে কবিতা এসে জমা হবে কিভাবে। কবিতা তো একজন কবি বা একজন মানুষের অত্যন্ত ব্যক্তিগত কথা। কলিজা রঙের পাতা। বলিষ্ঠ উপস্থাপন। মুসান্ডা আরে এলামন্ডা - দুই ধরণের দুটি ফুলের গাছ। এদের অবশ্যই দেশী প্রতিশব্দ আছে, খুব প্রচলিত গাছ, চেনা ফুল, কিন্তু এইখানে এই দুটি বিদেশী নাম অবলীলায় কবিতার আবহে মিলে গেল। অর্থ না বুঝলেও তাদের 'ফিসফিস করে হাসাহাসি' বোঝা সম্ভব। এখানে এ দুটি নাম ব্যবহার, পাঠক আমার মতে, সার্থক।
সর্বোপরি একটা চিরন্তন 'সরল রেখার' বয়ান। দুটি পোকার মধ্যকার একটা সরল রেখা। এবং কবি একে বললেন চিরন্তন। এখানেই কবিতার ফিলোসফি। দুটা পোকার মধ্যে বাস্তবিক অর্থে কোনো সরল রেখা নাই, কিন্তু কবি, দর্শক, মানুষ তাকে তৈরি করতেছে, আর এই নশ্বর দুনিয়ায় - এত সুন্দর আর মনকাড়া যতসব ভঙ্গুরতার মধ্যে সেই কল্পিত, আরোপিত সরল রেখাটাই যেন শেষ পর্যন্ত চিরন্তন। সরল রেখাটা একজন দর্শক মানুষের দাবী, একজন কবির দাবী। কার কাছে দাবী? কেন দাবী? এই ভাবনাগুলাই কবিতা করে তুলে একে।
চমৎকার দৃশ্যের সমাহার, যাকে যেই নামে ডেকে আমরা অভ্যস্ত - সেভাবেই এ কবিতায় ডাকা হচ্ছে। অথচ নতুন। কোনো কাব্যিক ভান নাই। ভঙ্গিমা নিজের মতো, প্রকাশের কায়দা কবি নিজে পাথর কুঁদে বের করতেছেন। আর কী চাই?
###############################
জয় সুরাইয়া, জয় আমাদের চমচম মিয়া ।
চয়ন খায়রুল হাবিব।
###############################################################
(৪ জুন, ২০২৩)
![]() |
'মৌল রূমাল', ১৯৯১। চয়ন খায়রুল হাবিবের প্রথম একক গ্রন্থিকা। ফটোগ্রাফ, কাফি বিল্লাহ |
আজকে লিখতে চাই চয়ন খায়রুল হাবিবের একটা কবিতা নিয়ে।
উনার মনে আছে কিনা জানি না। একটা অনলাইন চিঠি চালাচালির ফোরামে ২০০৩ কি চারের দিকে ছাত্র-রাজনীতি বিষয়ে একটা বক্তব্য নিয়ে মারাত্মক টক্কর লেগে যায় উনার সাথে । দুই তিনটা চিঠি চালাচালি আর বক্তব্য পরিষ্কার-করণ ইত্যাদির পরে পরে আমার পক্ষ থেকে যুদ্ধ বিরতি (Truce)-এর আহবান জানানো হয় আর উনার পক্ষ থেকেও তা মেনে নেয়া হয়। সেই Truce এখনও চলমান আছে। অর্থাৎ সেটি নিয়ে পরে আর কখনও কথাবার্তা হয়নি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে অনেক সময় অনেক পর্যায় গড়িয়ে গেছে।
যাই হোক । ঐ ঘটনার দু চার বছর পরে চয়ন ভাইয়ের কবিতা প্রথম পাই কাজল শাহনেওয়াজ ভাই প্রকাশিত 'ফৃ' গ্রন্থিকা সিরিজে। তখনও লোকেট করতে পারি নাই যে এই চয়ন ভাই আসলে সেই মানুষটি-ই যার সাথে বিতর্ক হয়েছিল অতীতে। এই মিল খুঁজে পেতে আরও দুই কি চার বছর পার হয়ে যায়।
ফৃ গ্রন্থিকা সিরিজের কবিতাগুলি খুব 'দগদগে' বলা যায়। একটা কবিতায় এমন একটা দৃশ্য ছিল যে একজন সদ্য-কিশোরী একটা আয়নার নিজেকে দেখছে। নিজের পরিবর্তন দেখছে। এই দৃশ্য এত প্রবল আর আচমকা এসে গ্রাস করছিল যে, এখনও সেই দৃশ্য, আর টোন বা সুর পাঠক আমার ভিতরে জ্বলজ্বলে হয়ে আছে। এর পরে নানা সময় উনার আরও বেশ কিছু লেখা পড়েছি। সর্বদাই অন্যরকম। আলাদা টোনের। আর এদিকে আজকে একটা কবিতা নিয়ে বলতে চাই, যেটা আবার ইদানীং টাচ করে গেছে নানা কারণে।
আবুল হাসান আর সুরাইয়া খানম বাংলাদেশের অনেক পাঠক-পাঠিকার কাছে একটা উজ্জ্বল, আকর্ষনীয় প্রসঙ্গ। আবুল হাসান তো নিজের কবিতা-গুণেই বিখ্যাত। আর উনার ব্যক্তি জীবন আলোচনা করতে করতে সুরাইয়া খানমের বিষয় সামনে চলে আসে। সুরাইয়া খানমের সেই সময়কার একটা সুন্দর, মিষ্টি ফটোগ্রাফও ফেসবুকে আজকাল অনেক চালাচালি হয়। সেই সময়কার সৌন্দর্যমণ্ডিত। উনাদের পারস্পারিক সম্পর্ক নিয়ে চিন্তাভাবনা কিংবা আলোচনা একটা অন্যধরণের স্পার্ক তৈরী করে অনেকের ভিতরে। মুখরোচক বপলা যাবে না, কিন্তু ঐদিকেই যেন বিষয়টা বার বার যেতে চায়।
কিন্তু এত আলোচনা - এসবের সবই গদ্য আকারে। এই আবুল হাসান আর সুরাইয়া খানম - উনাদের ব্যক্তি উপস্থিতি যে কবিতায় ব্যবহার করা যায় - এটা কয় জন আমরা ভাবতে পারি? কবিতা জিনিসটাই যেন আমাদের কাছে সেরকম একটা বিষয় না।
সে-ই - র-ক-ম ঐতিহাসিক চরিত্র হলে অবশ্য আনা যায়।
"বায়েজিদ বোস্তামী শৈশোব হতে জননীর সেবা ..."
অথবা হুমায়ুন, আওরঙ্গজেব। এর আগে মধ্যযুগে অবস্থা ছিল আবার আরও অন্যরকম।
কিন্তু আধুনিক কবিতায় ঐতিহাসিক চরিত্র - এটা যেন একেবারে অভাবনীয় একটা ব্যাপার। আবার চরিত্র দুটি (হাসান, খানম) সেইরকম ঐতিহাসিক চরিত্র না, কিন্তু আবার ঐতিহাসিক না - সেটাই বা কিভাবে বলি?
কবিতায় ইচ্ছা হলে আবুল হাসান আর সুরাইয়া খানমকে রিক্রিয়েট করব। আধুনিক কবিতাতেই করব। একজন কবির এই ড্যাম-কেয়ার এটিচিউড ভালো লাগে। মানব চরিত্র, ঐতিহাসিক চরিত্র ইদানীংকার কবিতায় ব্যবহার করা মানা, তারপরেও যদি ইচ্ছা হয়, লিখে দিব , কার বাপের কী।
নিচের কবিতাটায় একটা রাজনৈতিক অর্থে টালমাটাল সময়কে ধরা হচ্ছিল। আবুল হাসান যেন সেটি দেখছেন, আবার এক পর্যায় হাসান নিজেই তার অংশ হয়ে পড়তেছেন।
হাসান-খানম কে নির্ভর করে লেখা কবিতায় বেহুলা লখিন্দর চলে আসে, অথচ বেহুলা লখিন্দরের যেই কাহিনী লোকমুখে প্রচলিত সেখানে কিন্তু যৌনতার কোনো উল্লেখ নাই। খুব বেশি হলে বাসর ঘরের কথা আর তার পরে পরেই স্বামীকে বাঁচানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। অথচ এ কবিতায় বেহুলা আর লখিন্দরের মধ্যে সেই প্রাকৃতিক সংস্পর্শ, সেই কাচা জিনিসটা আছে।
অন্যদিকে, আবুল হাসানের সিগনেচার কবিতা: "ঝিনুক নীরবে সহো /ঝিনুক নীরবে সহো, /ঝিনুক নীরবে সহে যাও /ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও!"
-এই কবিতা থেকে মোলায়েম ভাবে মুক্তার প্রসঙ্গ উৎকলন করে নিয়ে এসে স্থাপন করা হয় এই কবিতায়। চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয় না। কিন্তু হাসানের মুক্তা ঠিকই থেকে যায়।
"... এ দুজন এখন অবিনশ্বর / মুক্তি ও মুক্তার মালিক ও মালকিন // ধিন্তাধিনাত মহুয়ায় মাত বেহুলা চিৎকার করে:/ অই লখিন্দর আমার মুক্তা ফিরায় দে/ লখিন্দরে কয়: অরে আমার মরা মুক্তার মা/ গার্মেন্টসে যা, কাম কৈরা খা..."
কবিতায় কবি আর পাঠকের স্বাধীনতা অপার। স্বপ্নের মতো উদ্ভট অনেক কিছু আমরা মেনে নেই। এই কবিতায় সেইরকম কিছু কাজ করা হয় তৎক্ষণাৎ। হাসান-খানম থেকে বেহুলা লখিন্দর হয়ে, গার্মেন্টস কর্মী হয়ে, তার পরে পরেই চলে আসে একজন অনুজ কবির কথা। (কোন সেই কবি? জানা নাই। জানার দরকারও নাই) এই কবির যার সাধাসাধিতে পোড়াবাড়ির চমচমের দৃশ্য চলে আসে, তার সাথে মিষ্টি বানানোর কারিগর, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়কার জ্বলজ্বলে ক্যারেকটার, জিঞ্জিরা হোটেল এবং পুনরায় খানম, হাসান।
জিঞ্জিরা হোটেলের চায়ের উল্লেখটাই প্রথম মনোযোগ কেড়ে নিছিল আমার। প্রথমবার কবিতাটা পড়ার সময়। গ্রীন রোডে একটা জিঞ্জিরা হোটেল ছিল (এখনও আছে) - যার চা ছিল বিখ্যাত। এক সময় ওর উল্টাপাশেই ছিল গ্রীন স্টোরস। আর জিঞ্জিরা হোটেলের বেঁটে প্রশস্ত কাপে সুস্বাদু চা আমরা খেতাম এক সময়। এখন অবশ্য সেই বেঁটে কাপ আর নাই, চায়ের সেই সুঘ্রাণও নাই। জিঞ্জিরা হোটেল আছে, সিনিয়ার রিকশাওয়ালারা এক নামে চিনে। জুনিয়ার-রা চিনে না।
জানি না - এই গ্রীন রোডে অবস্থিত জিঞ্জিরা হোটেলের কথাই কবি বলতেছেন কি না, তবে যে হোটেলই হোক, সেখানে এক জ্বলজ্বলে দৃশ্যে পুনরায় আবুল হাসান আর সুরাইয়া খানম ফিরে আসেন, একটা খেই হারানো চিন্তা ফিরে আসার মতো মোলায়েম, ন্যাচারাল আর তাৎক্ষণিক ভাবে।
আমরা দেখি যে আবুল হাসান সরে যাওয়া আঁচলের দিকে তাকিয়ে আছেন।
সাহিত্যে ঐতিহাসিক চরিত্রকে নির্ভর করে ঘটোনা সাজানো বর্জনীয় কিছু না। উপন্যাসে যেরকম। কবিতায় হলে ক্ষতি কী?
এই ভাবে আরও কিছু কাজ সেরে কবিতাটা শেষ হয়। আন্ডারলাইং ভাবনা-ধারা নিয়ে আমি আর কিছু বললাম না। কারণ পাঠক পাঠিকা যে যেভাবে কবিতাটি নিবেন কবিতাটি সেভাবেই রূপ পাবে আমার বিশ্বাস।
তো এই যে একটা ডেয়ারিং এবং স্মার্ট, বাঙালীর চিরায়ত নাকি-কান্না হীন কবিতা, এই জিনিসটা আমার ভালো লাগে।
"খুলিতত্ত ।৪। জয় সুরাইয়া, জয় আমাদের চমচম মিয়া
—---------------------------------------------------
পিলখানার বি,ডি,আর গেট থেকে
শহিদ মিনার অব্দি উনিশশো পচাত্তরে
মহাবট অশ্বত্থ রেন্ট্রির খোন্দল থেকে খোন্দলে
ডাক হরকরা মাটির পাতালে ছড়ায়েছে
মাইলকে মাইল লম্বা আবুল হাসানের কবিতার রাত
সে-রাতের একপাশে অমাবস্যা
অন্যপাশে পূর্ণিমার চাঁদ
চাদের বুকের বোটায়
দুরকম বাংলাদেশকে চুমোচুমির হাহুতাশ শেষে
ঢাকার রাস্তাঘাটে বাজারে ক্যাম্পাসে পার্কে
আর পুলিশের চৌকিতে শাপলা শালুকের ডাটায়
বানভাসি ফনাগোটানো গোখ্রাদের লুকানোর
আয়োজনে মুগ্ধ কবি আবুল হাসান দেখেছিল
রাতের বেলাকার আজিমপুর কলোনির পুকুরগুলোর বুকে
খোলা আর বন্ধ জানালাগুলায়
লাল নীল সবুজ পাঁচমিশেলি ছায়াদের সাথে
পর্দাদের ধন্ধ
পর্দা ও ছায়াদের দোলাচলে
আবুল হাসান এখন লখিন্দর
আর সুরাইয়া খানম হলো বেহুলা
এক লখিন্দরকে লুকিয়ে আরেক আবুল হাসান
এক বেহুলাকে না জানিয়ে আরেক সুরাইয়া
গোলাপি কাঁকড়াদের উত্তেজনায় এফোঁড় ওফোঁড়
কামড়াকামড়ি জড়াজড়ি শেষে দুজনের ঘামে ঝলসায়
সাগরশেচা বালির মিহিদানা মুক্তার নেকলেস
এ-দুজন এখন অবিনশ্বর
মুক্তি ও মুক্তার মালিক ও মালকিন
ধিস্তাধিনাত মহুয়ায় মাত বেহুলা চিৎকার করে:
অই লখিন্দর আমার মুক্তা ফিরায় দে
লখিন্দরে কয়: অরে আমার মরা মুক্তার মা
গার্মেন্টসে যা, কাম কৈরা খা
অই অই ঝগড়া কাজিয়া ভালা না
এ-বলে আবুল হাসান ও সুরাইয়া খানমকে
আমি লখিন্দর ও বেহুলার স্বপ্ন সিথানে বসাই
অনুজ কবির বিনীত নিবেদনে
পোড়াবাড়ির চমচম শুধাই
চমচমগুলা এখন লোমশ কান্না হয়ে
কাচের শোকেসে বসে আছে
এবং বসে বসে আঠাআঠি ফাটাফাটি মজায় দেখছে
মিষ্টির কারিগরেরা হাঁটুর ওপর লুঙ্গি তুলে
রফিক জব্বার নুর হোসেন চলেসের
মৃত্যুর বার্তাবাহক পুরানো খবরের কাগজ ঘষে ঘষে
শোকেসের কাচের ওপর থেকে
মিষ্টির আঠা পরিষ্কার করছে
রাস্তার অন্যপারে জিঞ্জিরা হোটেলে
ডিম বাদাম দারুচিনি মেশানো
ভুতুড়ে চায়ের চুমুকে চুমুকে
আবুল হাসান সুরাইয়ার আচল সরানো বুকে
হটাৎ থমকে গুলিয়ে ফেলেছে
কোনটা গণতন্ত্রের এন্টিকাটার
আর কোনটা বারবার বিক্রি হওয়া
আত্মার ধনুষ্টংকার
তোমার ডাকনাম কি
ঘুম-জড়ানো সুরাইয়ার এ-প্রশ্নে
আবুল হাসান বলেছিল :
ডাকনামগুলা
জীবন ও যত্নের সীমান্ত
আমার ডাকনাম জ্যোতি
মেয়ে হলে ডেকো মৌলিক বোলে
ছেলে হোলে ডেকো দ্বৈত
আর ওদের বোলো
আমার আরেকটা ডাকনাম হ'লো চমচম মিয়া
শোক ও স্বৈরতন্ত্রের দেশে
ওরা যাতে সবসময় হাসে
জয় আবুল হাসান জয় চমচম মিয়া
জয় সুরাইয়া খানম জয় চমচম মিয়া
(কবিতাটি লেখা হয়েছিল লন্ডনে, ২০০৭। গ্রন্থবদ্ধ, 'ডৌল : জুলেখার জেরা পর্ব।')
##########################
এই আমার কবিতা । রিফাত চৌধুরী
#################################
(২৯ অক্টোবর, ২০২০)
![]() |
সমুদ্রে নুনের পুতুল / রিফাত চৌধুরী। কাঁটাচামচ প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০০৭। |
আশা করি রিফাত ভাই কিছু মনে করবেন না উনার কবিতা হঠাৎ এইভাবে ফেইসবুকে শেয়ার করার জন্য। অনেকদিন ধরে যোগাযোগ নাই। মাঝ রাত্রের গভীরে আরো নীরবতার মধ্যে কবিতা নিজের স্ফূরণ ঘটাতে শুরু করতেছে!
এই আমার কবিতা
................................................
কাগজ-কলম তুলে নেবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে
চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে।
হাত থেকে মেঝেয় গড়ায় কাগজ,
বাতাসে এদিক-সেদিক চলে যায়।
আমার কাগজের ছেঁড়া পাতা
উড়ছে এখন ফ্যানের হাওয়ায়।
একটা প্রকাণ্ড ঘুমের মধ্যে আমি নিহত হয়ে যাই।
নিবিড় নিঝুম নিদ্রা।
ফুলফোর্সে ফ্যানের পাখা ঘুরছে।
শিয়াল যেমন হাঁসের হাড় মাংস খেয়ে
তার সাদা সাদা পালকগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়
তেমনি আমার কাগজগুলি সেই বাতাসে
ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে।
(সমুদ্রে নুনের পুতুল / রিফাত চৌধুরী। কাঁটাচামচ প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০০৭)
ভালো কবিতা নিয়ে আলোচনা করা সমস্যাজনক। একটা জীবন্ত জিনিসকে যেন হত্যা করা হয়। তথাপি, যেহেতু, যেইরকম আলোচনা উনার লেখা নিয়ে হওয়ার কথা ছিল - সেইরকম খুব একটা চারিপাশে হয় না দেখে এই অধমই একটা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা নিতেছে।
আলোচনার ফরম্যাট এইভাবে স্থির করা যেতে পারে। "কেন এই কবিতা আমার কাছে ভালো লেগেছে"
আমার কাছে ভালো লেগেছে কারণ:
ক) একটা প্রশান্তি নিয়ে আসতেছে - যেটা শুধুমাত্র প্রশান্তির গণ্ডি ছাড়িয়ে আরও বড়ো কিছুকে ধরে। মনের মুলে গিয়ে নাড়া দেয়। শান্ত করতে চায় । বলতে চায় যেন 'এতদিন কোথায় ছিলেন'। নিজের কাছেই নিজের ফেরা আরকি ...
খ) এই "বড়ো-কিছু" জিনিসটাকে ধরতে গিয়ে খুব মহান জিনিসপত্র কবিতায় নিয়ে আসা হয় নাই। মানবতা, ইতিহাস, সমাজনীতি, ভালো-মন্দ চেতনা। 'আমি' কি ব্যক্তিগত 'আমি', নাকি সামষ্ঠিক 'আমি'। অবশ্যই ব্যক্তিগত আমি। এই আমি 'হাজার বছর পথ হাটিতেছি'-র আমি না।
খুব সাধারণ একজন মানুষের সাধারণ একটা ঘটনা। 'আমি' বিষয়ে কোনোরকম ভণিতা নাই।
গ) কোনো চোখ ধাঁধানো চমৎকারীত্ব নাই। চমক নাই। খেলা নাই।
ঘ) শব্দগুলা কষ্ট-কল্পিত না, কিন্তু ফ্রি-ফ্লো হয়ে আসছে। "ফুলফোর্সে" শব্দটা বলতে গিয়ে কবিকে দুইবার ভাবতে হয় নাই। ইংরেজি শব্দ, নাকি বাংলা। খুব স্বাভাবিক ভাবে চলে আসছে শব্দটা।
ঙ) পুরা কবিতায় শব্দগুলা এত স্বাভাবিক যে , হঠাৎ করে একটা লাইনে এসে পর পর তিনটা আপাত স্বল্প-ব্যবহৃত শব্দ (মৌখিক ভাষায় কম ব্যবহৃত আরকি) যখন চলে আসে - সেগুলা চোখে লাগে না। এই শব্দগুলার আগমণ যেন খুব স্বাভাবিক ছিল। "নিবিড় নিঝুম নিদ্রা"
চ) "শিয়াল যেমন হাঁসের হাড় মাংস খেয়ে / তার সাদা সাদা পালকগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়" - এই দৃশ্য এক অর্থে একটা যেন দৈনন্দিন বা কিছুটা চিরায়ত দৃশ্য। (নগরবাসীর কাছে ১০০% অবশ্য নয়। গ্রাম থেকেও শিয়াল প্রায় অনুপস্থিত হতেছে, তথাপি) - একটা খুব জীবন-ঘনিষ্ট দৃশ্য। যার পালিত হাঁস আছে, শখ, ভালোবাসা কিংবা অর্থনৈতিক কারণে- এরকম ঘটনায় তার মর্মবেদনা একটা খুব গাঢ়-সত্য মর্মবেদনা পৃথিবীর। এই দৃশ্যটাও - সেইসব ফলাফল কিছু ইঙ্গিত না করে খুব সাধারণ ভাবে চলে আসছে - আর সাধারণ গতিতে চলে গেছে। দৃশ্যের চিরায়ত হবার গুণ - এটা লক্ষ্যনীয়।
ছ) ফ্যানের বাতাসে সাদা কাগজের ওড়াউড়ির সাথে বিচ্ছিন্ন হাসের পালক ওড়ার যে দৃশ্য তৈরী করা হলো - সেটা বাস্তবিক, জ্বলজ্বলে ভাবে জেগে উঠে, মনে হয় পাঠক নিজেই যেন ফ্যানের বাতাস ছেড়ে একটা খালি ঘরে ঘুমিয়ে আছে - আবার নাই।
জ) বাংলা কবিতার অনেকধরণের ক্লিশে মুক্ত লেখা এটি। পদ্য-ছন্দ নাই। কাব্যিক আবহ জাগাতে উদ্যত হয় যেই টিপিকাল ধরণের শব্দগুলা - তাদের সেইরকম কায়দায় ব্যবহার নাই। 'নিবিড়', 'নিঝুম' আসছে বটে - তবে সেটা যেন কথার ফ্লো-তে চলে আসা। এই শব্দ দিয়ে কোনো আবহ তৈরির দিকে যাওয়া হয় নাই।
ঝ) অনেকে বলেন যে, এইরকমের সহজ কবিতাও তো অনেক লেখা হয়েছে বাংলাতে। ঠিক আছে, সেটা মেনে নেয়া যায়, কিন্তু দেখা যেতে পারে সহজতার মাধ্যমে রিফাত ভাই আর কি কি এক্সট্রা দিতেছেন, যেটা অন্যেরা এই ভাবে দেন নাই...। খুব জ্বল জ্বল করে উঠা চিত্র। চিত্রের মধ্যে পাঠককে অংশীদার করে ফেলা। কোমল নরম শব্দ আর কথার ফ্লো। সরাসরি উল্লেখ না করেও একটা নিঃস্পঙ্গতা, অস্বাভাবিকতার প্রকাশ (প্রকাণ্ড ঘুমের মধ্যে নিহত হয়ে যাচ্ছেন কবি, তাইলে ফ্যান, কাগজ, হাঁস - এগুলা দেখতেছেন কে? কিভাবে দেখতেছেন?) এই মেলানকোলি আবার মন কে দমিয়ে দিচ্ছে না, বরং - এটাই যেন একটা সুন্দরতা, একটা ফুলের মতো জীবন্ত আর কোমল।
ঞ) প্রচণ্ড গদ্য ভাষা। কবিতার আবহ এমন ভাবে পাঠককে পেয়ে বসে যে - ভাষাটা যে আসলে গদ্য - এটা মনে থাকে না। মাপা মাপা বাক্য। অর্থ গড়ে তোলার দিকে যাচ্ছে - গদ্য তো এইরকমই। কিন্তু চলে আসে অন্য একটা সুর। এই বৈপরীত্য একরকমের ঝিম ধরিয়ে দেয়।
এইসবই ...
########################
শশী হক। অসামাজিক।
########################
(৬ মার্চ, ২০১৭)
'একত্রে'-র এই কবিতাটার কথাই বলতেছিলাম (অসামাজিক)। কীরকমের জানি একধরণের সততা বা সিনসিয়ারিটি আমি ব্যক্তিগতভাবে খুঁজে পাই এই সংকলনের সবগুলা লেখায়। মন খুব বিক্ষিপ্ত থাকলেও টেনে নিয়ে আসে। শান্তি দেয়। শশী ভাই আর রিফাৎ ভাইয়ের এই যৌথ প্রযোজনাটা আমার কাছে এক অসাধারণ সংকলন ছিল।
এই স্পেসিফিক লেখাটা অনেকদিন ধরে খুঁজছিলাম। রিফাত ভাইয়ের সাথে একটা ডুয়েট বই, নাম খুব সাধারণ, 'একত্রে', অথচ সেই ডুয়েট পুস্তিকা ঐ দু'জনেরর চমৎকার সব কবিতায় ঠাসা। শশী ভাইয়ের এই কবিতাটা প্রথম পাঠেই আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। কবিতা, অথচ বলা যায় পুরাপুরি গদ্য। লেখাটাকে তথাকথিত 'কবিতা' করে তোলার জন্য লেখকের মধ্যে যেন বিন্দুমাত্র কোনো প্রয়াস নেই। তারপরেও বলব, শেষ পর্যন্ত এটা একটা কবিতা হিসাবেই পাঠক আমাকে আচ্ছন্ন করে দিয়ে যায়। এখান থেকে বুঝতে পারি যে, কবিতা হবার জন্য মাপা মাপা লাইন, ছন্দের দোল, এসব লাগে না। কবিতা আরও অনেক 'র' আর আন্তরিক একটা জিনিস।
অসামাজিক
-----------
বাস আসছে। বাস যাচ্ছে। ঠাসা ঠাসা মানুষ। পোকামাকড়ের মত মানুষ। কেউ কারো দিকে পর্যন্ত তাকাচ্ছে না।
ছাউনির পাশে কোলে বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবতী মা। কিছুতেই উঠতে পারছে না বাসে। পুরুষ মানুষদের হুলুস্থুল পেশী-বুহ্যের মধ্যে একটা ছোট্ট দরদী ফাঁক খুঁজে পেতে বার বার ব্যর্থ হয়ে, ধাক্কা ঠেলা চাপ খেয়ে, শেষে ফিরে এসে দাঁড়িয়ে আছে ছাউনির পাশে;
নিরেট মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকা কোন এক ভেজা কাকের মত।
মানুষেরা আর মোটেই সামাজিক মানুষ নেই। ভিড়ের মুখোশের আড়ালে দেখি, প্রত্যেলেই অন্তর্বাসী কুকুর হয়ে উঠছে।
আজ বাসে করে বাসায় যাওয়া যাবে না।
স্কুটার নিলাম। উঠে পড়লাম একটা সিগারেট ধরিয়ে। ধরাতে গিয়ে মনে হলো আমিতো খুব সহজেই এই বিপন্ন মা ও শিশুকে ডেকে নিতে পারতাম স্কুটারে। কিন্তু নিলাম না। নেয়া যায় না। নিয়ম নেই। আমাদের সমস্ত শরীর মাছির মত সন্দেহের চোখে ভরে গেছে। আর সহানুভূতি খুঁড়ে এই কূট ও ক্রুর সময়ে ঝামেলা বাড়াতে কে চায়! কেউ না। খুব কুৎসিত এক ব্যবস্থাপনার জীব হয়ে গেছি। সমাজের দাসানুদাস আমি স্কুটারে চেপে একা একা বাড়ি ফিরি।
বাবুল শেখের পায়রাগুলো?
পরের দিকে এসে, হয়ত ২০১২/১৩ এর দিকে - আমি উনাদের এই গোষ্ঠীর একটা নাম দিতে চাই। একটা নাম দিতে পারলে, আর সেই নামে যদি অনেকে তাদেরকে ডাকতে পারে, চিহ্নিত করতে পারে, তাইলে কিন্তু তাদের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করা, প্রচার, বিশ্লেষণ, প্রতিষ্ঠা ইত্যাদিতে অনেক সুবিধা হয়। অথচ তাঁদের এই কর্মকাণ্ড কোনো 'আন্দোলন' নয়। যদিও লেখালেখির কিছু কমন বৈশিষ্ট উনাদের লেখায় পাওয়া যাবে। মাঝে মাঝে দেখা গেছে কিছু নামের আওতায় উনারা উনাদের লেখালেখিকে রাখার উদ্যোগ নিতেছেন। এই বিষয়ে বেশ কিছু প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাই, কিন্তু কোনো কারণে ওভার অল ভাবে সেই নামগুলি নিয়ে উনারা নিজেরাই কন্টিনিউ করে যান নাই।
আমি ভাবলাম একজন বাইরের মানুষ হিসাবে আমি নাম দেবার চেষ্টা করি। আমি তো আসলে উনাদের ব্যাকগ্রাউন্ডের আদান প্রদান জানি না, কিন্তু হাতে আসা লেখালেখি কিংবা প্রকাশনাগুলির ফেইস-ভ্যালুর ভিতিতে কোনো নাম কি আমি দিতে পারি? কী নাম দেয়া যায়? সহজে নাম পাওয়া যায় না। হঠাৎ একদিন একটা নাম মনে আসল, আর সেটা উনাদের মধ্যকার একজন কবিরই একটা কবিতা , কিংবা বলা যায় কবিতার বইয়ের শিরোনাম, সেটা হলো শশী ভাইয়ের 'বাবুল শেখের পায়রারা" (কাজল ভাই কর্তৃক 'ফৃ' গ্রন্থিকা সিরিজে প্রকাশিত) - এই নামের বইটার কথা বলতেছি - এই নামে আমি উনাদের চিহ্নিত করব বলে ভাবলাম। অর্থাৎ, উনারা হলেন যেন "বাবুল শেখের পায়রারা"।
কেন এই নামকরণ? বাবুল শেখ কে? উনার পায়রাগুলির কথাই বা কেন?
নব্বই দশকে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার রাস্তা-ঘাট চিনতেন তারা জানেন কাঁটাবন রাস্তায়, অর্থাৎ, নীলক্ষেত থেকে কাঁটাবনের দিকে আসতে থাকলে হঠাৎ করে বাম দিকে একটা খুব ছোটো, চিপা আর অন্ধকার গলি দেখা যেত। লোকজন কিংবা যানবাহন চলাচলের গলি সেটা নয়, বরং দুটা বিল্ডিঙের চিপায় সরু একটা চলাচলের পথ যেটা কিনা আসলে কয়েকটা আধা পাকা ঘরে গিয়ে শেষ হয়েছে। সেই গলিটা আমরা চিনতাম বাবুল শেখের গলি নামে। বাবুল শেখ পায়রা পুষতেন আর এই স্থান থেকে ভালো কোয়ালিটির তামাকের ডিলারশিপ চালাইতেন। ('তামাক' কিন্তু এক সময় বাংলাদেশে লিগালি বিক্রয় হতো। সম্ভবত মেডিসিনাল কারণে কিংবা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ধর্মীয় বা স্বকীয় কালচারাল অবস্থানকে সম্মান জানিয়ে। নওগাঁর তামাক প্রায় বিশ্ব-বিখ্যাত বলা যায় । সুদুর আমস্টার্ডামেও এক সময় পাওয়া যেত নওঁগার দ্রব্য - এমন শুনছিলাম। নওগাঁয় অবস্থিত সরকারী গুদামগুলি এখনও বর্তমান আছে। ছেলেপুলেরা ছাদের উপরে ফুটবল খেলে। তবে যেই সময়ের কথা বলতেছি, ৯০ দশক, সেই সময় এটি আর 'লিগাল' নয়।)
বাবুল শেখ পায়রা পুষতেন। আমি একদিন রিফাত ভাইয়ের সাথে ভিতরের ঘর পর্যন্ত গিয়ে সেই পায়রাগুলির কয়েকটাকে দেখছিলাম মনে পড়ে।
তো এই যে, বাবুল শেখের বিক্রি করা দ্রব্যের সাথে কারও কারও সংশ্লিষ্টতা (সকলেই সংশ্লিষ্ট না অবশ্যই), আবার পায়রার মতোই ন্যাচারাল আর সুমিষ্ট তাদের কাজ, অবস্থান, স্বতস্ফূর্ততা অথচ আন্ডারগ্রাউন্ডে ইচ্ছা করে থেকে যেতে চাওয়া এই শিল্পীদের সেই কারণে আমি বলতে চাই বাবুল শেখের পায়রা রা। বাবুল শেখ যেমন আন্ডারগ্রাউণ্ডের মানুষ। উনাদের আড্ডা, ঘোরাঘুরি, তর্কাতর্কিও জানা মতে সেই এলাকাটা ঘিরেই বেশি ছিল। কাঁটাবন, নীলখেত, আজিমপুর, এটাও একটা কারণ।
আমি অবশ্য একদিন কাজল ভাইকে (কাজল শাহহনেওয়াজ) গল্পচ্ছলে প্রস্তাব দিছিলাম, কাজল ভাই, আপনেদের গ্রুপ বা কর্মকাণ্ডটাকে আমি চিহ্নিত করতে চাই 'বাবুল শেখের পায়রারা' নামে। এটা কি ঠিক হবে কিনা। উনি অবশ্য সায় দেন নাই আমার কথায়। কেন দেন নাই সে নিয়ে আর আলোচনা করা হয় নাই। উনাদের হয়ত এই বিষয়ে অনেক সিস্টেমেটিক ভাবনা চিন্তা আছে আর কে, কিভাবে, কেন লিখছেন - সেই সম্পর্কে আগে থেকে সুনির্দিষ্ট ভাবনা চিন্তা আছে - ছক কাটা আছে, দর্শণ আছে - এইসব কারণে উনি হয়ত সায় দেন নাই। কিন্তু আমি ভাবলাম আমি একজন তৃতীয়, বহিরাগত মানুষ হয়ে উনাদের লেখালেখি বা কর্মকাণ্ডকে একটা একক নামের আওতায় ফেলার চেষ্টা করতেই পারি। পরের কালে হয়ত আরও অনেক পাঠক, গবেষক এই টার্ম টা গ্রহণ করবেন। না-ও করতে পারেন। না করলেও হয়ত তেমন কোনো ক্ষতি নাই।
আবার এটাও ঠিক, এই রচনার প্রেক্ষিতেই হয়ত আরও আলোচনা শুরু হবে উনাদের পক্ষ থেকে, নিজেদের চিহ্নিত করার বিষয়ে, আর ফলতঃ শেষপর্যন্ত আরও কংক্রিট কোনো একটা নাম বেরিয়ে আসবে। তবে আপাতত আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে আপাতত 'বাবুল শেখের পায়রারা' সঠিক। এটা একটা ফ্যান্সি উদ্যোগ বলা যায়। আমি চাই এই নিয়ে আরও কথা হউক।