ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Wednesday, November 18, 2020

ঝিনু্ক ও সমুদ্রের গান।নভেলা সিরিজ।

।।ফারহিন চৌধুরী।।



পর্ব : ১ 🍀
কয়েক মাস হলো মাজেদ ক্যাফেতে কাজ করছে।মুনির চাচার ক্যাফেটি বেশ জনপ্রিয় এবং বহু বছরের পুরনো।সমুদ্র সৈকতের পাড়ে কিছু স্বপ্ন আর ভালবাসা দিয়ে তৈরি এই ক্যাফে যার নাম “ঝিনুক আড্ডা”। প্রতিদিন সকাল সাতটায় মাজেদ ক্যাফেতে এসে পরিষ্কার করার কাজে লেগে যায়।দরকারি জিনিসপত্র কিনতে বাজারে চলে যায়। মুনির চাচা তার হিসাবের খাতাটা চশমাটা বার বার মুছে উল্টে উল্টে দেখে। তেমন একটা লাভ হচ্ছেনা তবে কিছু রেগুলার কাস্টমারের সঙ্গ তার বেশ ভালো লাগে।চাচার বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি।ছোট্ট ছেলে আমির তার ক্যাফেতে মাজেদের সাথে কাস্টমারদের এট্যান্ড করে।তবে আমিরের ঘুম ভাঙে বেশ বেলা করে।

মাজেদের বয়স বাইশ হতে চলল সামনের অক্টোবর মাসে তবে বয়স নিয়ে বা জীবন নিয়ে কিছুটা বেখেয়ালি।
মাসে একবার বাড়িতে চিঠি পাঠায় তবে টাকাটা ঠিক সময়ে না পাঠালে রণক্ষেত্র হয়ে যায়।মাজেদ সবসময়ে একটা নোটবুক নিয়ে ঘুরাফেরা করে।সমুদ্রের পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছু ছোট ছোট কবিতা টুকে ফেলে।মাঝে মাঝে অদ্ভুত কিছু চরিত্রের কথা লিখে চলে।টুরিস্টদের নানান ভূমিকায় অভিনয় করায়।মনে মনে হেসে বেরায় আর দূরে মাঝিদের নৌকা দিয়ে মাছ ধরা নির্বাক হয়ে দেখে যায়। কখনো কখনো জালে বড় মাছ উঠে আসলে দৌড়ে গিয়ে দামাদামি করে বসে।মুনির চাচা আবার মাছ খেতে বেশ পছন্দ করে। মাছের জন্য আলাদা করে টাকা দেওয়া আছে ওর কাছে।তার বিনিময়ে কাঁচা আমের জুস ক্যাফে থেকে ফ্রি পায় মাজেদ। ঘণ্টা পর ঘণ্টা সমুদ্রের পাড়ে বালুর মধ্যে শুয়ে শুয়ে জালে বড় মাছের অপেক্ষা করে।সন্ধ্যে হলে সূর্যাস্ত দেখে ক্যাফেতে ফিরে যায়।

ক্যাফে রাত বারটা পর্যন্ত বেশ সক্রিয়।পাশের রিসোর্টের ম্যানেজার অরবিন্দ বাবু সন্ধ্যাবেলা এক কাপ এক্সপ্রেসো খেতে চলে আসেন সঙ্গে ফ্রেন্চ ব্যেগেট যার রেসিপি চাচা এক ফরাসি পর্যটকের কাছ থেকে শিখেছিলেন। সাথে প্রায়ই অজানা পর্যটকদের সমগমে গান বাজনায় বেশ উৎসব মুখর থাকে ক্যাফে। অরবিন্দ বাবু আবার বেশ ভালো ভায়োলিন বাজায়। ভায়োলিনের সুরের লোভেই মাজেদ তার বেশ আদিখ্যেতা করে থাকে।

ক্যাফে বন্ধ করে মাজেদ আবার সমুদ্রের পাড়ে ফিরে যায়। ঘুম যেন ভালো লাগে না। ঢেউয়ের শব্দ আর কিছু সমুদ্রের গান যেন গভীর রাতে শুনতে পায়।

পর্ব : ২ 🍀
মাজেদের ছোট্ট ঘরটা হতে সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাওয়া যায়। জানালা দিয়ে হঠাৎ একটা মাথা উঁকি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল “ওরে মাজেদ গো, একটা বড় বোয়াল ধরেছিরে। ভালো টেকা পামু মনে হইতাছে। এইবার তাইলে বাড়িত যামু মাইয়াডারে দেকতে।তোর লাইগা কয়ডা চিংড়ি আনসি। নিজে রাইন্ধ্যা খাইস, তুই আবার তোর কর্তারে দিতে যাইস না।” চিংড়ির পোটলাটা জানালা দিয়ে ফেলে হাশেম কাকা তার বড় জাল আর বোয়ালটা নিয়ে গান গাইতে গাইতে বাজারের পথে চলল।সাধারণত হাশেম কাকার কাছ থেকে মাছ কিনে নিয়ে যায় মাজেদ তবে আজকের মাছটা হাত থেকে ফসকে গেছে বৈকি। মাজেদ কথাগুলো শুনে চোখ কচলাতে কচলাতে মুচকি হেসে দূর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল।শ্রাবণের মেঘ বেশ জমেছে আকাশে। সমুদ্র আজ উত্তাল আর চারপাশ যেন এখনো জেগে ওঠেনি।পুরনো সেই সাদা শার্ট আর কালো প্যান্টটা পরে মাজেদ ক্যাফেতে গিয়ে টেবিল চেয়ার ঝাট দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।ইতিমধ্যে শিলা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।ক্যাফের জানালা দিয়ে বাইরেরটা ঘোলাটে দেখাচ্ছে। কাষ্টমারও তেমন একটা আসেনি সকাল থেকে।আমিরের তৈরি ক্যাপাচিনো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে ঘণ্টাখানেক আর সেই ঠাণ্ডা কফিটা বিরক্ত হয়ে আমির নিজেই সরবতের মতো গিলে খাচ্ছে।মুনির চাচা অন্যমনস্ক হয়ে কাউন্টারে বসে খাতায় বৃষ্টি নিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেছে।

“এক্সকিউজ মি? ক্যাফে কি খোলা? হ্যালো?” কথাটা কানে পৌঁছতেই মাজেদ দেখল দরজার বাইরে মাথায় শাড়ির আঁচল দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে দাঁড়িয়ে আছে একটি মধ্যবয়স্ক নারী। চোখের চশমাটা খুলে হাতের ব্যাগটা টেবিলে রাখল।টিসু দিয়ে ভেজা মুখটা মুছল।মাজেদের কাছে ভেজা শাড়িটা বদলানোর জন্য একটা শুকনো শাড়ি চাইল। “মানে, ম্যাডাম আমারা শাড়ী কোথায় পাব? “ “উফ্, ওয়াটএভার! একটা এক্সপ্রেসো দিন জলদি।” মহিলার কথাবার্তা শুনে মাজেদের মাথায় রক্ত উঠে গেল তবে কাষ্টামার বলে কথা! ভদ্রতা আর নম্রতাই যেন তাদের পেশা।মহিলা নিজে নিজেই হাসতে লাগলেন। বৃষ্টিতে ভিজে ভদ্রমহিলার ঠাণ্ডা লেগে গেছে। হাঁচি দিতে দিতে নাক লাল হয়ে গেছে। মহিলাকে দেখে মাজেদের বেশ খারাপ লাগল। এক্সপ্রেসোর সাথে এক কাপ কড়া আদা চা নিয়ে গেল। চায়ের দিকে তাকিয়ে মহিলা বলল” এই চায়ের দাম দিতে আমি মোটেই ইচ্ছুক না।” “এই চা কম্প্লিমেন্টারি।ফ্রি।” আমিরের সাথে চোখাচুখি হলো মাজেদের। চলে যেতেই মহিলা পেছন থেকে মাজেদকে ডাকলেন।”মিষ্টার! চেয়ারটা টেনে বসে পড়ুন।একলা চা বা কফি খাওয়া অভ্যেস নেই আমার।” একটু ইতস্তত করে মাজেদ বসে পড়ল।আমির দৌড়ে একটা কফি মাজেদের জন্য নিয়ে এলো।“ আমি রমলা সেন। শান্তিনিকেতন থাকি।আপনাদের সমুদ্রের কথা বহু শুনেছি।এবার দেখতে চলে এলাম। পাশের রিসোর্টেই আজ সকালে উঠেছি। আপনাদের ক্যাফেটার নাম বেশ টেনে আনল আমায়।ধুম করে বৃষ্টিটা সব নষ্ট করে দিল।” মহিলা একটানা কথা বলে যেতে লাগল।” আচ্ছা জানালাটা খুলে দেওয়া যাবে? দমবন্ধ হয়ে আসছে।বৃষ্টিটা আরেকটু অনুভব করতে ইচ্ছে করছে।” মাজেদ মনে মনে বলল “ শখ কত! ভিজে এসেও শখ মেটেনি।নিজে ভিজেছে আর এখন আমাদের ভেজাতে উঠে পড়ে লেগেছে। আচ্ছা ঝামেলা তো ! “

পর্ব : ৩ 🍀
জানালা খুলতেই বৃষ্টির ঝাপটা এসে পুরো শরীর ভিজিয়ে দিল।কিছুটা নিরুপায় হয়ে মাজেদ চেয়ারে বসে গেল।
“ আচ্ছা, আপনাদের এখানে স্পেশাল কোন মেন্যু আছে? ইউ নো, যাস্ট স্পেশাল বীচ ড্রিংক্স? “ “ আপনি বসুন, আমি আনছি” কাউন্টারে গিয়ে আমিরকে স্পেশাল ডাবের শাসলিক দিয়ে ডেকোরেটেড ডাবের পানির সাথে মিক্সড স্ট্রবেরী জুসটা নিয়ে আসতে বলল। মিনিট পাঁচেক পর জুসটা নিয়ে রমলা সেনের টেবিলে রাখল।” বাহ! চমৎকার! নাম কি জুসটার?” “ওসেন ক্রাস্ট”
“বেশ ক্রিয়েটিভ বলতে হচ্ছে! আচ্ছা, আপনাদের এখানে ভালো ডাব পাওয়া যাবে প্রতিদিন?” “আপনার রিসোর্টের সামনেই রসুল চাচা ডাব নিয়ে বসেন দুপুর নাগাদ।আপনি চাইলে ওনাকে বলে রাখতে পারেন। ওনার ছেলে, নিমাই ডাব দিয়ে আসবে আপনার কাছে।” “ বেশ ভালো ব্যবস্হা মনে হচ্ছে। কত টাকা দিতে হবে আমার? “ “ ওটা নিয়ে চিন্তা করবেন না। গরীব মানুষ ওরা। তেমন চাহিদা নেই শুধু খেয়াল রাখতে হয় শ্রদ্ধ্যার স্হানটা নড়বড় না হলেই হয়। বাচ্চাটাকে চাইলে একটা দুটো চকলেট দিতে পারেন তাতেই খুশী হয়ে যাবে।” “ বেশ কিছুদিন থাকব আমি এখানে। প্রতিদিন কফি আর এই স্পেশাল জুসটা এখানেই খাব। ভাবছি সন্ধ্যার আড্ডাটাও বেশ জমবে।” “ জ্বি, যা ভালো মনে করেন আপনি। আপনার বিলটা তৈরি ম্যাডাম।আপনার দ্রুত ভেজা কাপড় বদলে নেওয়া উচিত নাহলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে।” রমলা সেন পাঁচ শত টাকার একটা নোট টেবিলে রেখে বললেন “ কিপ দ্যা চেঞ্জ! ভালো সার্ভিস পেয়ে খুশী হয়েছি!” কথাটা শুনেই মাজেদের ইচ্ছে হলো পুরো টাকাটাই ফেরত দিতে। খুব কষ্ট করে অপমানটা লুকিয়ে রেখে মাজেদ বেশ নম্রভাবে বলল “ এক্সট্রা টাকা লাগবেনা। আপনি আমাকে একদিন একটা ডাব খাওয়ালেই হবে। ওই টাকাটা রসুল চাচার বেশ কাজে আসবে আর আমার তৃষ্ণাও মিটবে।” কথাটা মনে হয় রমলা সেনের বেশ ভালো লেগেছিল।ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি হেসে নোটটা ফেরত নিলেন। সাড়ে তিনশ টাকা রেখে দরজার দিকে পা বাড়ালেন।বাইরে যেতেই পেছন ফিরে বললেন “ আমাকে ম্যাডাম বলবেন না।কেমন জানি আলাদা মনে হয় মানব কাতারে নিজেকে। মিস রমলা বা রমলা সেন বললেই খুশী হব।”

মহিলার কথাগুলো মাজেদকে বেশ তাক লাগিয়ে দিল। রমলা সেন চলে যেতেই মাজেদ টেবিলটা পরিষ্কার করে জানালার দিকে তাকিয়ে বাইরে সমুদ্রের কথায় মনোযোগ দিল।পৃথিবীতে কি অদ্ভুত রকমের মানুষ বাস করে। কখনো তিক্ততা বা কখনো মিষ্টি বাক্যলাপে কেমন বিচলিত করে তুলে মনটাকে। টেম্পার কল্ট্রোল বেশ ভালোভাবে আয়ত্ত করেছে এই কয়েকমাস।ক্যাফেটা নিজেরই মনে হয় মাজেদের আর আমির একদম ছোট ভাইয়ের মতো। অনেক স্বাধীনতার সাথে বিচরণ করে এই ক্যাফেতে।মনটা খারাপ হলেই সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে গোপনে অভিযোগ করে। প্রতিটি ঢেউয়ের সাথে অভিযোগগুলো ধুয়ে মুছে যায়। তখন মনটাতে বেশ শান্তি অনুভত হয়।সূর্যাস্তের সময়ে সমূ্দ্রের পাড়ে প্রতিদিনের মতো দু হাত মাথার পেছনে দিয়ে রক্তিম আকাশের বদলে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকে। বুকের মধ্যে মেঘগুলো জমা হয়ে যেন চোখ হতে নিরবে অর্থহীন বৃষ্টির দেখা মেলে।আর আজ ব্যতিক্রম ছিল রমলা সেনের সাথে চোখাচুখির ব্যপারটা। রিসোর্টের সি ভিউ বারান্দা থেকে তিনিও ডুবে যাওয়া সূর্যের সাথে গল্প করতে ব্যস্ত ছিলেন। অজানা সমুদ্রের সুর যেন পথিকদের পথচলা ও সময় থামিয়ে দিয়েছিল।

পর্ব:৪ 🍀
আজ কাকভোরে ক্যাফের সামনে গিয়ে হতভম্ব হয়ে যায় মাজেদ। ক্যাফের বাইরে টুল নিয়ে বসে আছেন রমলা সেন! পরনে লাল পাড়ের হলুদ শাড়ি আর কানে ঝিনুকের দুল। হাতের কাচের বালাগুলি বেশ শব্দ করছিল।মৃদু বাতাস আছে বটে তবে বৃষ্টির কোন নাম গন্ধও নেই।এক হাতে রঙিন একটা ছাতা আর অন্য হাতে বেশ গাম্ভির্যের সাথে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলী পড়ছেন।মাঝে মাঝে বালুর ওপর রাখা একটি কাচের বোতল তুলে নিয়ে গলা ভেজাচ্ছেন।ডাবের পানি জমিয়ে তার সাথে কাঁচা আম মিলিয়ে নিজের একটা জুস বানিয়েছেল মনে হলো।অন্যদিকে শান্ত সমুদ্রে লাল পতাকা দেখা যাচ্ছে।ভাটা চলছে।বেশি দূর এগোলেই বিপদ।মাজেদের কোমরে ঝুলানো কাপড়ের ব্যাগটা থেকে অজান্তেই অজস্র ঝিনুক গড়িয়ে পড়ল রমলা সেনের পায়ের কাছে।ঝিনুকের শব্দে রমলা সেন মুখটা উপরে তুলে অন্যমনস্কভাবে একবার মাজেদের দিকে তাকালেন।

“মিস রমলা, আমাদের ক্যাফের অদৃশ্য জানালা দিয়ে সমুদ্রের সূর্যোদয় দেখছেন বুঝি?” “ না, খোলা আকাশের নীচে বসে সমুদ্রের গর্জন শুনছি।ঝিনুক কুড়াচ্ছিলেন নাকি?” “ না মানে, এই আরকি, একটু আট্টু শখ।আমির ঝিনুকগুলো দিয়ে ভালো মালা বানাতে পারে। সেগুলো মাঝেমধ্যে বাজারে গিয়ে বিক্রি করে। ক্যাফে আধ ঘণ্টার মধ্যে খুলবে। আপনি চাইলে ভেতরে এসে বসতে পারেন।” রমলা সেন একগাল হেসে আবার বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলেন।মাজেদ এই কাণ্ড দেখে কিছুটা বিব্রত হয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।মুনির চাচার শরীরটা তেমন ভালো নেই। আজ ক্যাফের দায়িত্ব মাজেদ আর আমিরের।আজ শুক্রবার বলে স্পেশাল ম্যেনু আর ডিস্কাউন্ট রয়েছে।ডাবের প্যানাকোটা শুধুমাত্র আজকের দিনটিতেই পাওয়া যায় আর সাথে মিক্সড অরেঞ্জ আর লেমনের টক মিষ্টি জুস ফ্রি।কফিতে দশ শতাংশ ছাড় আর সারাদিন ব্যাপী বহিমিয়ান সঙ্গীতের সুর পুরো ক্যাফে জুড়ে থাকবে।দুপুরে রসুল চাচা আর নিমাইয়ের মধ্যাহ্ন ভোজ এই ক্যাফেতেই হয় আমির আর মাজেদের সাথে প্রত্যেক শুক্রবার।তখন ঘণ্টাখানেক বন্ধ থাকে ক্যাফে। এত আনন্দের দিন কিসের? সেটিও এক মজার ব্যাপার। মাজেদের শখ সপ্তাহের সাত দিনের একটি নিজেদের মতো করে সবাইকে নিয়ে যাপন করা। টাকা কামিয়ে খরচ করা মূল উদ্দেশ্য নয় বরং জীবনকে সমুদ্রের প্রতিটি ঢেউয়ের সাথে উপভোগ করাও দরকার।

প্রায় তিন ঘণ্টা পর রমলা সেন ক্যাফের ভেতর প্রবেশ করলেন। গলা ফাটিয়ে একটা এক্সপ্রেসো অর্ডার করলেন আর সাথে ফ্রেঞ্চ টোস্ট। অমলেটও চাইলেন তবে পরে অর্ডার নিজেই ক্যান্সাল করলেন।আজকের আয়োজনের ব্যাপারে শুনে রমলা সেন বেশ উত্তেজিত হয়ে গেলেন। জানান দিলেন দুপুরে এখানেই খাবেন। মাজেদ কোন তর্ক না করে সম্মতি জানালো।মাজেদ আমিরের সাথে নাস্তাটা সেরে নিতে রমলা সেনের পাশের টেবিলে গিয়ে বসল। হঠাৎ দরজায় একটা নতুন কাষ্টমার। বেশ লম্বা চওড়া সুট টাই পরা এক ভদ্রলোক। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। মাথায় হাল্কা সাদা চুল বেশ স্পষ্ট। হাতে ল্যাপটপের একটি ব্যাগ আর বেশ দামি একটা মোবাইল নিয়ে বারবার হাওয়ায় কিছু খোঁজার চেষ্টা করছেন। মনে হচ্ছে নেটওয়ার্ক পাচ্ছেন না। হঠাৎ পেছন থেকে একটি বার তের বছরের বালক ভদ্রলোককে জড়িয়ে ধরে এক অজানা ভাষায় কি জানি বলল।মাজেদ ও আমির কিছুই বুঝতে পারলনা।রমলা সেন মুচকি হেসে দুজনের দিকে তাকাল।

পর্ব: ৫ 🍀
ভদ্রলোকের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে মাজেদ আর আমির।কি করবে বুঝতে না পেরে একটা টেবিলের সামনে গিয়ে চেয়ারটা টান দিয়ে ইশারায় বসার অনুরোধ জানালো।ভদ্রলোক বেশ দৃঢ় পায়ে সাহেবি কায়দায় চেয়ারটাতে গিয়ে বসলেন।ছেলেটি আবার অজানা ভাষায় বলে উঠল “ পাপা, লো সিয়েল এ লা মেহ এ থ্রে বেল! “ কথাগুলো শুনে আমির ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।রমলা সেন মুচকি হেসে মাজেদের দিকে তাকিয়ে বললেন “ ফরাসি ভাষায় কথোপকথন হচ্ছে।ছোট্টটি আকাশ আর সমুদ্রের প্রশংসা করছে।শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন সময়ে ফরাসি ভাষা নিয়ে একটি কোর্স করেছিলাম।যাই হোক ওদের কথায় মনে হচ্ছে বেশ পছন্দ হয়েছে আপনাদের ক্যাফে।” স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মাজেদ অর্ডার নিতে গিয়ে আবিষ্কার করল তাদের কোন কথাই সে বুঝতে পারছেনা। রমলা সেন বেশ আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে এসে অর্ডার নিলেন।” ম্যাডাম, ক্যাফে লাতে সিলভু প্ল্যে” রমনা সেন আবার সেই রহস্যময় হাসি মুখে এনে বলল ”আমির, একটা ক্যাফে লাতে চাইছেন। সাথে তোমাদের স্পেশাল ওসেন ক্রাস্টাও দিতে ভুলনা।” মহিলার এমন তৎপরতা মাজেদকে বেশ ভাবিয়ে তুলল।তার এত কি উঠে পরে লেগেছে ওদের সাহায্য করার? রমলা সেন মুহুর্তের মধ্যে ভদ্রলোকের সাথে গল্পে মেতে উঠলেন।এক কাপ এক্সপ্রেসো আর লাতে দুজনে শেষ করেই কিচেন কাউন্টারের দিকে এগোতে লাগলেন।রমলা সেন তার খোলা চুল খোপা করে শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে কিচেনে ঢোকার বেশ ধরলেন।কাণ্ড দেখে মাজেদ মাথায় হাত দিয়ে জানালার এক কোণে দাড়িয়ে রইল। রমলা সেন জোর গলায় বললেন “ ভদ্রলোক ক্রেপ বানানো শেখাবেন। ফরাসিদের বিখ্যাত খাবার।অফিস আদালতে যাওয়ার সময়ে দোকানগুলো থেকে চট করে কিনে হাতে নিয়ে খেতে খেতে যায়।আজ শখ মিটবে আমার। তাড়াতাড়ি আসুন, শিখে নিবেন।” ব্যাপারটা মন্দ নয়। মাজেদের জন্য বেশ আনন্দের বিষয় নতুন কিছু শেখার। এই নতুন রেসিপির খুশিতে আজকে তাদেরকেও দুপুরের ভোজের আমন্ত্রণ জানালো মাজেদ। ভদ্রলোক মাজেদকে টেনে নিয়ে কিচেনে ঢুকলেন। “ জো মাপেল ওল্যাণ্ড” মাজেদ নামটা বেশ বুঝতে পেরে করমর্দন করে হাসিটা অক্ষত রাখল।

ছেলেটির নাম মিলান। বেশ অদ্ভুত ছেলে। তার ব্যাগ থেকে গোলাপের গুচ্ছ বের করে টেবিলগুলোতে সাজাতে লাগল।আমির সেখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে চোখ দুটো বড় করে এই রঙ তামাশা দেখছিল। ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে ছেলেটির সাথে কথা বলতে শুরু করল। মিলান আমিরকে বলল “ ফুল গাছেই ভালো লাগে তবে একবার তুলে ফেললে সাজানোর ভালো জায়গা খুঁজতে হয়।প্রতিটি ফুলের সাথে আমি ছোট্ট একটি চিরকুটে “ বোনোহ” মানে গুডলাক লিখেছি।” ছেলেটির এই নিরীহ অসাধারণ শিশুসুলভ আচরণ পুরো ক্যাফের পরিবেশটাই পাল্টে দিল। আমির একটা টেবিল থেকে গোলাপ উঠিয়ে ঘ্রাণ নিতেই কাঁটা হাতে বিঁধে গেল। রক্তের ফোঁটা পড়তেই মিলান একটা কাপড় দিয়ে আঙ্গুলটা বেধে দিল। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে দিল যেন বড় কিছু করে ফেলেছে।

হঠাৎ বাইরের বিকট শব্দ কানে ভেসে এল। জানালার কাচ ভেঙে যাওয়ার পর্যায়ে।আকাশ তীব্র অন্ধকারে ঢেকে গেছে। মেঘগুলো জমে জমে দৈত্যের রূপ নিয়েছে।ক্যাফের বাইরের স্ট্রীট লাইটটা বিদ্যুতের আঘাতে নিভে গেল। ক্যাফের ভেতর পুরো অন্ধকার হয়ে গেলো। কালো কালো মুখ ছাড়া কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।রমলা সেনের বৃষ্টির ভব্যিষ্যৎবাণী সত্যি হতে চলল। সমুদ্রের ঢেউগুলো ক্ষেপে গিয়েছে আর রমলা সেন কিচেন থেকে আলোর জন্য চিৎকার করতে লাগলেন। মিলান আমিরকে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছিল। মাজেদ হারিকেনটা জ্বালিয়ে আবার ক্রেপ বানানোর ইঙ্গিত দিল।

পর্ব:৬ 🍀
কালো অন্ধকার কিচেনে হাল্কা হারিকেনের আলোতে রমলা সেন, ওল্যাণ্ড ও মাজেদ।মাঝেমধ্যে দুজনে ফিসফিসিয়ে কিছু ফরাসি ভাষায় আলাপ করছে আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে।আবছা আলোয়ে রমলা সেনের মুখটা বেশ মনোরম লাগছিল। ভদ্রমহিলার হাসিটা মনে হয় সময় সময়ে বদলে যায়।কখনো রহস্যময় মনে হয় যেন বুকে ব্যাথা চেপে রেখে নকল হাসি হেসে মানুষকে বোকা বানাচ্ছে আবার এমন ম্যাজিক দেখায় যা খুব সহজে অন্যকে হাসিয়ে ছাড়বে।মাজেদ ক্রেপ বানানো শেখার থেকে বেশি মনোযোগি ছিল দুজনের মুখভঙ্গি পড়তে ও বুঝতে।রমলা সেন হঠাৎ ক্রেপের প্রতি উত্তজিত হয়ে বেখেয়ালে কনুই দিয়ে মাজেদকে ধাক্কা দিল। অমনি অন্ধকারে হাত লেগে কিচেন কাউন্টারে রাখা কাচের বোতলগুলো ভেঙে গেল।রমলা সেন তার চেতনা শক্তি ফিরে পেল।মাজেদ চেনা স্হান থেকে ন্যাকড়া তুলে নিয়ে পরিষ্কার করে ফেলল।রমলা সেন একটু কষ্টের হাসি হেসে, একটু অনুতপ্ত দৃষ্টির সাথে ক্রেপ তৈরিতে পুন:রায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।কিচেন থেকে বেশ উচ্চস্বরে ভিনদেশী গানের আওয়াজ কানে ভেসে আসছিল। মিলান বেসুরা গলায় ফরাসি ভাষায় বৃষ্টির গান ধরেছে “ জেম লা প্লুই” আর আমির বাংলা অনুবাদে “ আমি বৃষ্টি ভালবাসি “ পুন:রায় মিলানের সাথে গলা মিলিয়ে গাইছিল।থেমে থেমে “ আ আ আ লা লা লা “ শব্দগুলো বেশ উত্তেজিত স্বরে অপেরার ধাঁচে শোনা যাচ্ছিল। রমলা সেন বলে উঠল “ ওমা, দেখুন মাজেদ, আপনার ক্যাফে অপেরা হাউস হয়ে গেছে! ক্যাফের নাম বদলাবেন নাকি ? “ লা লা অর্কেস্ট্রা হাউস !” বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন। মাজেদের আড়ালে মুখটায় রমলা সেনকে ইঙিত করে ভেঙ্চি কাটল।আর মনে মনে বলল” হ্যা , আপনার ক্যাফে তো, আমি তো মেহমান। যত সব ধং।” “ কিছু বললেন মাজেদ ?” “ জ্বি, প্রস্তাবটি বেশ মনে ধরেছে।নতুন নামকরণ হবে মনে হচ্ছে। কত দূর এগোলে ক্রেপ? “ এবার টেবিলে সাজানোর পালা।” ওল্যাণ্ড চট করে মোবাইলটা বের করে নানা রকমভাবে প্লেটটাকে রেখে কয়টা ছবি তুলে নিল। মুখ দেখে মনে হলো ফরাসি ভাষায় গালাগাল করছে। “ কেল ডোমাজ! “

রমলা সেন বলল “ হায় হায় করছে নিজের ফুটো কপালের জন্য। ভদ্রলোক ইন্সটাগ্রামে ইন্টারনেট নেই বলে আপলোড করতে পারছেন না বলে।”

দরজায় ধুম ধাম আওয়াজ হচ্ছে। আমির আর মাজেদ সর্বশক্তি দিয়ে দরজায় কিছু আটকানোর চেষ্টা করছে।মাজেদ এই দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে গেল “ কি হচ্ছেটা কি” “ বৃষ্টি ভুত এসেছে। সব বৃষ্টির পানি এক সাথে এক দৈত্য আকার ধারণ করেছে। হামলা করবে এখানে। এই ভূত ঝিনুক খাদক। ক্যাফেতে ঝিনুক নাম দেখে তেড়ে আসছে।” “ তোকে এই কথা কে বলল? “ “ মিলান বলেছে। সে বইয়ে পড়েছে” “ মাইরি ! যা বাবা ! তোর মাথাটা খেলো বৈকি! দরজাটা খুল এবার।” দরজা খুলতেই দেখল রসুল চাচা আর নিমাই কলা পাতা মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুরনো ছেড়া পাতলা হাফ হাতা শার্ট পরা সেই রসুল চাচা আর বৃষ্টিতে ভিজে নিমাই প্রায় বেহাল দশা।হাতে কয়টা ডাব আর মুখে সরল হাসি।মাজেদের দিকে রসুল চাচার সেই দুর্লভ চাওনির তুলানায় যেন প্রতিদিনের রোদে পুড়ে ডাব বিক্রির কষ্ট তুচ্ছ।রসুল চাচা কখনো মানুষের কাছে কোন বিষয়ে অভিযোগ করেনি ।

ভাগ্যের খেলায় বিশ্বাসী হওয়ার চেয়ে সৎ পথে আনন্দের সাথে আয় করাটাই প্রাধান্য দিয়েছেন। রোজ নতুন নতুন পর্যটকের সাথে কথা বলতে বেশ ভালো লাগে। মা মরা ছেলেটাকে একাই কোলে পিঠে মানুষ করেছেন। মাজেদ দুজনকে একটা তোয়ালে দিয়ে গা শুকিয়ে নিতে বলল।টেবিলে ক্রেপটা দেখে নিমাই চিৎকার করে উঠল “ আব্বা, পাটিসাপটা পিঠা বানাইসে আজকে! হেভি আয়োজন।ওম্মা শশাও দেহি দিছে উপরে। আয়হায় লাল ওইডা কি? বরই নাকি ? “ রমলা সেন মুখে কাপড় দিয়ে চুপটি হেসে নিল। আমির বলল “ নিমাইরে, এটা ফরাসি খাবার। ক্রেপ ! মিলানের বাবা বানিয়েছেন।নিমাই বেশ স্বাভাবিকভাবে পুন:রায় খাবারটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মাজেদের পেছনে দাঁড়িয়ে গেল।ডাবগুলো দিয়ে আমির স্পেশাল ওসেন ক্রাস্ট বানিয়ে আনল আর রমলা সেন আজ সবার জন্য এক্সপ্রেসো বানিয়েছেন। রসুল চাচার এসব কফি পানের অভ্যেস নেই বিধায় ওনার অনুরোধে রমলা সেন এক কাপ কড়া লেবুর চা বানিয়েছিলেন।সবাই নরমাল টেবিল চেয়ারে না বসে মাটিতে আসন বিছিয়ে ক্রেপ দিয়ে দুপুরের আয়োজন করল।অন্ধকারে হারিকেনের অল্প আলোতে সব মুখই একই রকম লাগছিল। তবে সবচেয়ে মজা হয়েছিল যখন সমতার জায়গাটা উপলব্ধি হয়েছিল। হঠাৎ ক্যাফের টেলিফোনটা বেজে উঠল। রমলা সেন দ্রুত গিয়ে রিসিভারটা তুলল।তার চেহারার ভাবভঙ্গি যেন পাল্টে গেল। কোন এক অজানা তুফানের আর্তনাদ ক্যাফের দেয়ালগুলো শুনতে পাচ্ছিল।


ফারহিন চৌধুরী
৯/০৫/২০
ঢাকা