ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Saturday, November 21, 2020

ঝিনুক ও সমুদ্রের গান।নভেলা।শেষ পর্ব।

।।ফারহিন চৌধুরী।। 

পর্ব: ১২

🍀
রিসোর্টের বারান্দায় রমলা সেন বেশ গভীরভাবে কাগজে কিছু লিখছে। মেজাজ তেমন একটা ভালো নেই। আজ ক্যাফেতেও ঘুরে আসেনি। সকাল থেকে বারান্দায় বসে আছে। বারান্দার নীচে এসে মাজেদ রমলা সেনকে নেমে আসার অনুরোধ জানাল। “ আমার মনটা ভাল নেই। আজকে আমি বের হব না।”
“ আপনার বুঝি নবণীতা মুখার্জির কথা মনে পড়ছে?” “ না।ডায়েরির কথাগুলো বিরক্ত করছে।ভাবছি শান্তিনিকেতন ফিরে যাব।” “ সাহস হারিয়ে ফেললেন বুঝি? এতটুকই শক্তি ছিল জীবনের মানে খোঁজার? প্রতিটি মুহুর্তে জীবন কিছু শিখিয়ে যাবে।ধৈর্য্য রাখতে হবে নাকি?”

“আচ্ছা, আজকে আমাকে কেমন লাগছে বলুন তো?” “ মজা করছেন?” “ না বলুন না!” “সত্যি বলতে লাল আর বাদামি রঙের কম্বিনেশন আপনাকে মানায় না।নীল বা হলুদ রঙের শাড়ির সাথে কাচের চুড়ি পরলে খুব সুন্দর লাগে।” “ একটু দাঁড়ান, আমি শাড়িটা বদলে আসছি।”
রমলা সেনের মনের অবস্হা যেন রঙের ওপর নির্ভর করে।অন্য কেউ মনের কথা জেনে গেলেই রূপ বদলে নেওয়ার প্রাণবন্ত চেষ্টা করেন।

দশ মিনিটের মধ্যে রমলা সেন তৈরি হয়ে নীচে নেমে এলো।দুজনে সৈকতের পারে হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর এগিয়ে গেল। প্রায় আধ ঘণ্টা পর রমলা সেন যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না~ নাগরদোলা ! মানুষের হৈচৈ আর লোক সমাগমে সমুদ্র সৈকতের দৃশ্যই যেন বদলে গেছে।কিছু ছোট্ট ছেলে মেয়েরা মিলে স্যান্ড ক্যাসেল বানাচ্ছে আর তাদের দুষ্টু বন্ধুরা সমুদ্র থেকে বালতি ভরে পানি এনে ভেঙে দিচ্ছে। রমলা সেন আর মাজেদ এইসব দেখে দুজনের দিকে তাকিয়ে এক মিষ্টি হাসি হাসল।” চলুন, সামনে নাগরদোলার কাউণ্টার। আজ মেলা বসেছে। প্রতি মাসে দুবার বসে। আপনার ভাগ্য ভালো।” “ আচ্ছা, আপনি কি জাদুকর? এত সহজেই আমার ইচ্ছেগুলো বাস্তবে রূপান্তরিত করছেন!” “ সব কিছু ভেবে করতে গেলে কিছুই হয় না। মাঝেমধ্যে অন্যের জন্য করে সুখ পাওয়া যায়।আমার হারানোর কিছুই নেই।”

বিশ টাকা দিয়ে দুটো নাগরদোলার পাস কিনল।রমলা সেন বেশ ভয় পাচ্ছিল একলা উঠতে আর তাই বলেই উপায় না পেয়ে মাজেদ সঙ্গ দিল।প্রতিটি চক্করে নাগরদোলার গতি রমলা সেনের দম আটকে দিচ্ছিল। চিৎকারে যেন থমথম অবস্হা বিরাজ করেছে কয়েক মিনিট। “ বাঁচাও বাঁচাও! মরে যাচ্ছি! “ কথাগুলো শুনে মাজেদ হো হো করে হেসে দিলো। রমলা সেনের হাতটা শক্ত করে ধরে প্রাণের জানান দিচ্ছিল মাজেদ।নাগরদোলা থেকে নেমে রমলা সেন মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলেন।চোখে মুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফিরানো হলো।ডায়েরিক পাতা হতে চতুর্থ ইচ্ছেটা কেটে দিল। পাশে লিখে রাখল “ ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা!”

“আচ্ছা মাজেদ, সব কিছু পরিকল্পনার মতো হয় না।মানুষগুলো, অভিজ্ঞতা, চিন্তাভাবনা- সব সময়ের সাথে বদলে যায়।” “একদিন হয়তবা চোখ খুললে প্রিয় মানুষটাকে দেখতে পারবেন।কি জানি, যদি নবণীতা সেনই ফিরে আসে।”

পর্ব: ১৩ 🍀 ( শেষ পর্ব)
সাধারণত রাত বারটায় ক্যাফে বন্ধ করে আমির আর মাজেদ বাসায় ফিরে যায় তবে আজ যেন নিয়মের ব্যতিক্রম।ক্যাফের ভেতর বেশ শোরগোল হচ্ছে।মনে হচ্ছে ভেতরে পার্টি হচ্ছে আর আমন্ত্রিত অতিথিরা বেশ আনন্দের সাথে সঙ্গিতের তালে তালে নাচ্ছে।রমলা সেন সমুদ্রের পাড়ে নীরবে হাঁটছিল। সমুদ্রের ঢেউয়ের খেলায় নিজেকে ভিজিয়ে নিচ্ছে আর চাঁদের মিষ্টি আলোয়ে নিজেকে মাখিয়ে নিল।ক্যাফের বাইরে বেশ লাইটিং আর জানালা দিয়ে ভেতরে মোমবাতির আলোয়ে কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে।নিমাই বাইরে বসে ক্লান্তিহীনভাবে ডাব কেটে চলেছে।রমলা সেনকে দেখে শাড়ির আঁচল ধরে চকলেটের বায়না করে বসল।নিমাইয়ের দিকে মুচকি হেসে ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বের করে মাথায় হাত বুলিয়ে ক্যাফের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।

দরজা খুলতেই ভেতরের দৃশ্য দেখে রমলা সেনের পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাওয়ার অবস্হা।একটা টেবিলে এক কাপ ক্যাপাচিনোর সাথে ক্যাণ্ডেল লাইট ডিনারের অপেক্ষায় বসে আছেন হাল্কা বেগুনী শাড়ি পরা এক নারী! টেবিলে ড্যাফোডিল ফুলের গুচ্ছ আর পাশে হাতের তৈরি একটি ডায়েরি।নবণীতা মুখার্জি! মানুষটি মোটেও বদলাইনি আর ক্যাফেতে বেজে চলেছে তার প্রিয় সোনালী দিনের গান।রমলা সেনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণায় সেই সরল হাসিটি হাসছে।পাশের টেবিলে মুনীর চাচা আর মাজেদ যেন এই মুহুর্তটি তার নোটবুকে আটকে রাখার অপেক্ষায় ছিল। রমলা সেনের চোখ জলে ভিজে গেছে।

“মুনীর ভাই আমার বেশ কাছের একজন মানুষ।কখনো বলার সুযোগ হয়নি তোকে।শান্তিনিকেতনে একসাথে সাহিত্যর সহপাঠি ছিলাম।সেদিন ওনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওনার স্বপ্ন কি আর উত্তরটা এমন ছিল “একটা স্বপ্নের ক্যাফে চাই। সমুদ্রের সাথে নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে চাই।পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে সমুদ্রকন্যা” কুয়াকাটায়” ফিরে আসলেন যেখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মনভোলানো দৃশ্য উপভোগ করা যায়।সত্যি বলতে টাকা পয়সা দিয়ে কখনো স্বপ্নের সীমানা তৈরি করা যায় না। তীব্র ইচ্ছে ও সাহস প্রয়োজন।মানুষটিকে ভালবেসেছিলাম এক সময়ে তবে এক সাথে থাকার ভাগ্য ছিলনা। পরবর্তীকালে বেশ ভাল বন্ধু ছিল তিনি আর আমিরের কথা চিঠিতে জানতে পারি।”

“বেশ ভালো। তবে আমাকে এইভাবে চমকে দেওয়ার কারণ?” “ আয় বস।” চেয়ারটা টেনে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রমলা সেন চুপটি করে বসে পড়লেন।” তোর ডায়েরিটা খুল।মনে আছে তোকে আমি তোর পাঁচটি ইচ্ছের কথা লিখতে বলেছিলাম?” “হ্যাঁ। জেনে খুশী হবে চারটি ইচ্ছে পূরণ হয়ে গেছে।” “ শেষ ইচ্ছেটা মনে আছে?” ডায়েরির পাতার শেষ পৃষ্ঠেতে পাঁচ নম্বর ইচ্ছের জায়গাটি খালি। তার পাশে লিখা” মা, তুমি বলো, মাথায় কিছু আসছেনা।তবে একটি ইচ্ছে খুব উঁকি মারছে~ নি:স্বার্থভাবে কিছু যদি করতে পারতাম।সত্যিই অন্যের হাসি দেখে হাসতে পারতাম।তুমি লিখে দিও আমাকে শেষ লাইনটা।” “মানব জীবন বেশ অল্প সময়ের।প্রতিটি মানুষ একে অপরকে বিচার করে চলি আর ভুলে যাই প্রতিটি মুহুর্ত উপভোগ করার কথা।আমি ভাবতাম সমুদ্রের পাড়ে কোন একদিন তোর বাবা হয়তবা ফিরে আসবে যদিও সেটি শুধু স্বপ্নই।নিজেকে নিজের মতো চিন্তে চেয়েছি আর চেয়েছি তুই নিজেকে নিজের মতো ভালবাসতে পারিস।তোর ডায়েরিটা দে, শেষ কথাটা লিখে দেই।

~ অন্ধকারের প্রদ্বীপের আলো হবো, আমার জীবনের প্রতিটি পাতার শব্দ হব, প্রতিটি মুহুর্তে নিজে নিজের সঙ্গি হব।” কথাগুলো বলে রমলা সেনকে নতুন ডায়েরিটা দিয়ে বললেন” এই পাতাগুলোতে নতুনভাবে আগামি জীবনের কথাগুলো লিখে ফেলিস।আমার খুব ইচ্ছে ছিল তোর সাথে এইরকম একটা ডিনার করব সমুদ্রের পাড়ে আর সাথে থাকবে তোর বাবার প্রিয় ড্যাফোডিল যার সুবাসে তার উপস্হিতি প্রতিটি মুহুর্তে উপলব্ধি হবে।”

দুজন দুজনকে অশ্রুসিক্ত চোখে আলিঙ্গন করল।রমলা সেন যেন নবণীতা মুখার্জিকে কখনো চিনতেন পারেননি।সিকির একটি পিঠই দেখেছিল, অন্যটি বোঝার চেষ্টা করেননি কখনো।কিচেন কাউন্টারে গিয়ে ক্যাপাচিনো বানিয়ে রমলা সেন বেশ গর্বের সাথে নবণীতা মুখার্জিকে দিলেন। “ রমলা , আমার এক্সপ্রেসো খেতে ইচ্ছে করছে। সময়ের সাথে আমার স্বাদ বদলে গেছে হয়তবা।” রমলা সেন হো হো করে হেসে নবণীতা সেনকে আকড়ে ধরলেন।

আজ দুজনের ফিরে যাবার পালা। তবে দুজনের পথ ভিন্ন। রমলা সেন প্যারিসে মিলান আর ওল্যাণ্ডের আমণ্ত্রনে সাড়া দিয়েছেন।মনমার্তের পবিত্র গির্জা “ সাক্রে কহ” আর বিখ্যাত “সঞ্জ এলিজে” দেখার পালা। নবণীতা মুখার্জি বাংলাদেশের সিলেটের চা বাগানে মাসখানেক কাটাবেন। সঙ্গে আমির ও মাজেদ ঘুরে আসবে বলে ঠিক করেছেন। মুনীর চাচা তার ক্যাফে ছেড়ে যেতে নারাজ।যাবার বেলায় মাজেদ রমলা সেনকে পেছন ফিরে বলেছিল- “ নীল শাড়ি পরা সেই একরোখা রমলা সেনকে আমি ভালবেসে ফেলেছিলাম।”


ফারহিন চৌধুরী
১৬/০৫/২০
ঢাকা

ছবি, জুলেখা সিরাপ রিডার্স লাউঞ্জ ফাইল।