ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Sunday, November 22, 2020

জ্যানেট উইন্টারসন, প্লাবিত সন্ত্রাসের গল্প

।।নাসরিন-জয়া হক।।

জ্যানেট উইন্টারসনের, 'মেসেজ ইন আ বটলের' অনুবাদ।


*'সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো।ঘর-ফেরা রঙিন সন্ধ্যার ভীড়ে

যারা তন্দ্রালস দিগ্বিদিক ছুটলো, চৌদিকে......'

প্রতিটা শক্ত জিনিস তার জলতরলতা ফিরে পেয়েছিল!

বৃষ্টি লম্বা, সোজা ভাবে পড়ছিল, প্রতিটা ফোঁটা দীর্ঘ লাইনে শেষ ফোটাটার সাথে জড়িত, লোহা-ধূসর আকাশ থেকে নেমে সুরক্ষা-শাটারের মতো  শহরের পর শহর রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল।

সোজা চালাও - না, রাস্তা দুর্গম; বৃষ্টিতে গোসল করে গাড়ির ডানা পাখির মতো ছড়িয়ে পড়ছে।আজ বিকেলে কোনও পাখি উড়ছে না।কোনও পাখি অগভীর পাথরের পানিতে স্নান করছে না।সন্ধ্যা নাগাদ রাস্তাগুলি খাল হবে এবং উপত্যকাটি  জলপ্রপাতে গড়াবে।নদী এবং রাস্তা এখন একই জিনিস, আমরা কেউই পানির উপর দিয়ে হাঁটতে পারি না।

"আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে," রোডব্লকের পুলিশকে বলি, সে মাথা নাড়ে, বৃষ্টি তার গাল বেয়ে কাঁদছে।সামনে তাকাই; সবকিছু ভিজে যায়, সরে যায়, কেবল বৃষ্টি বাদে, সমস্ত উপস্থিত ঘটনায় তার অস্তিত্ব অবিরল।তার ফাঁক গলে কেউ কিছু দেখতে পাচ্ছে না, অতীত দেখতে পাচ্ছে না। বৃষ্টি এমন ঘরের মতো যেখানে দেয়ালগুলি ধীরে ধীরে একসাথে আরও কাছাকাছি চলে এসেছে।শিঘ্রি আমি কাচে বানানো সাধুর মতো হয়ে যাব, অন্য সময়ের একটি প্রতীক। বৃষ্টি আমার চারপাশে বন্ধ হয়ে যাবে, যেমন আমি বোতলবন্দী একটি বার্তা, যেমন আমি বোতলবন্দী  এক দানো। সীসা আকাশের সবচেয়ে উঁচুতে আমাকে প্লাগ করবে এবং আমি কখনই বৃষ্টি থেকে বের হব না, কখনই না।বৃষ্টির কাচের গায়ে নাক চেপে ধরলাম, এই আলকেমিক্যাল বিকেলে যখন প্রকৃতি তার তরল এবং কঠিন পদার্থগুলিকে বদলাবদলি করছে , গাড়িসহ আমার দেহরেখা অস্পষ্ট হতে শুরু করেছে।পুলিশকে বলি - "আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে।"

তিনি আস্তে আস্তে মাথা নাড়ান, কারণ অভিব্যক্তিগুলি পানির নিচে আরও ধীরলয়ে, ধীরগতির ধুন।তিনি হলুদ জলরোধী জ্যাকেট পরে এক লরি ড্রাইভারের সাথে কথা বলতে চলে যান, তার লালচে রোদপোড়া ফোলা মুখে ঝোলা থুতনিটাকে মনে হচ্ছে  রোদ ঝলসানো দাগফুটকির কানওয়ালা ইয়া বড় কোরবানির লাল ষাঁড়ের পেটের গোস্তের ঝুরি কাবাব।মোবাইলে চেষ্টা করলাম বাসাতে কাউকে পেতে, বৃষ্টি হাতের কনুই পর্যন্ত গড়ালো।পুলিশ যখন লরি চালকের সাথে একটি ম্যাপ পেতে তার ক্যাবের দিকে এগিয়ে গেল, বুঝলাম এটাই আমার সুযোগ, পুলিশকে ফাকি দিয়ে আমি সটকে পড়তে পারবো।হ্যান্ডব্রেকটা ছেড়ে দিলাম এবং পাহাড়ের নিচের দিকে নামতে থাকলাম।

উর্দিধারী কোনও কর্মকর্তার আদেশ পালনে ব্যর্থতাকে আম অপরাধ মনে করি।কিন্তু গাড়ী পার্ক করে পুলিশগিরি থেকে উদ্ধার পেতে  কতক্ষণ অপেক্ষা করবো?জীবন রূপকথার গল্প নয়।বিয়ের পর বুঝেছি আমি রাজকন্যা নই এবং জীবনে কোনো সুখ নেই।

গাড়ি গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে।আমার হৃৎপিণ্ড এমনভাবে ধুকপুক করছে যেন এটি অন্য কারো শরীর এবং আমার হৃদয়ও অন্য কারো।যার কাছে আমার হৃদয় তার কাছে বাড়ি যাব। আমি বাড়ি যাচ্ছি, মোবাইলে বাড়ির লোককে ধরবার চেষ্টা করছি, কিন্তু আমার বোতলবন্দী বৃষ্টিভেজা চিঠি যেতে পারছে না।

চালাও :

আমি গাড়ি চালাচ্ছি অফ-রোড টায়ারগুলি কখনও ক্যাটামারান ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য ডিজাইন করা হয়নি।বর্তমান, বন্যায় আমার ভেতর   হাঁসবুদ্ধি কাজ করছে, মনে পড়ছে যে পানি সবসময় স্তরে স্তরে বয়ে চলে - কখনও কখনও নয়, সবসময়। আর্দ্রতা বাদে পানির বৈশিষ্ট্যগুলির একটি হ'ল এটি সবসময় স্তরযুক্ত।বুঝতে পারছি, অনেক দেরী হয়ে গেছে, আমার হাসবুদ্ধি কাজ করলেও আমি হাস নই।আমার মানুষবুদ্ধি রাস্তাটির পানির স্তর যেভাবে গণনা করেছে তার চেয়ে অনেক গভীর।এ-রাস্তায় আমি হাজার বার গাড়ি চালিয়েছি।রাস্তাটা তখন পুরো ডুবে গেছে, আমি সোজাসুজি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি। একটি ভেজা রাস্তা, একটি বিশ্বাসঘাতক রাস্তা, কিন্তু একটি সরল রাস্তা।*পুলিশবুদ্ধি, হাসবুদ্ধি ও মানুষবুদ্ধি পারস্পরিক হলে আমরা কতো সর্বনাশ থেকে বেচে যেতাম।

ভুল :

ধীর গতিতে পানি  উইন্ডস্ক্রিনের ওপরে মাছের ট্যাঙ্ক ভরাটের মতো উঠে আসে।জানালার কাচ পুরো তুলে দেই।ছোটবেলায় ঘরে ফিরে গেলাম, আমার নাক  একোয়ারিয়ামের কাচের গায়ে চেপে বসেছে।বাবা বিশেষ ধরনের মতাপাতা,  প্রবাল, এবং পোসাইডনের ছোট্ট প্লাস্টিকের মূর্তি দিয়ে একোয়ারিয়ামটা সাজিয়েছে।দুই জোড়া দেবদূত মাছ এবং এক জোড়া জেব্রা মাছ কাছ ঘেঁষে ঘুরে ঘুরে সাতার কাটছে, বাবাকে জানাচ্ছে ওদের ক্ষুধা লেগেছে,  এবং বাবার আঙ্গুলগুলো  মাছের খাবার ছিটিয়ে দিচ্ছে পানির ওপর।

তারপরে গাড়ির ওপরের দিকে পানি উঠে এলো।

ওহ যীশু! এই গাড়িতে বৈদ্যুতিক জানাল রয়েছে।কিন্তু এখন বিদ্যুৎ নেই।পানি গভীর হওয়ায় আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।আমি কি যথেষ্ট অক্সিজেন পাচ্ছি?এটি হ্যাচব্যাক, তাই অতিরিক্ত টায়ারটি কার্পেটের নীচে পিছনে ছিল।একবার একটি ফিল্মে দেখেছিলাম,  জেমস বন্ড টায়ারের টিউব থেকে নিশ্বাস নিচ্ছিলো, তবে আমি জেমস বন্ড নই, এবং দরজা খোলার জন্য আমাকে চাপ সমান করতে হবে গাড়ির ভেতরে। এটি করতে হলে আমাকে জানালার কাচ ভেঙে ফেলতে হবে।

ভারী ধাতবের চাকা বন্ধনী খুঁজে পেয়ে, এবং পেছনের জানালার কাচে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘা মারতে থাকলাম।কাচ  টুকরো টুকরো ভেঙে, পাওয়ার জেটের মতো পানি আমার সাথে লড়াই করে করে,,গরম পেছনের ভাঙ্গা জানালার তারগুলি আমার দিকে ছুটে এলো।ভাঙ্গা জানালায় একটি গর্ত তৈরি করার চেষ্টা করতে থাকি যা আমাকে বাইরে নিয়ে যাবে।এখনো আমি অ্যাকোরিয়ামের ভেতরে। যদি কোনও গর্ত যথেষ্ট বড় করতে না পারি,  পানি  গাড়িটা থেকে না সরা পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হবে, অপেক্ষা করতে হবে ...  পানির সন্ত্রাস এবং আমার শ্বাসপ্রশ্বাসের সংগ্রাম, আমার চুলে জড়িয়ে আগাছার মতো ভাসছে।

আমাকে আস্তে আস্তে সামনের দিকে ফিরে যেতে হবে এবং 'ওহ যিশু দরজাটার হ্যান্ডেল যাতে কাজ করে...'

হ্যান্ডেলে চাপ দিতেই দরজাটা খুলে যায়,আমি শুয়ে পড়ি এবং দুই পা পেছন দিকে নিয়ে উপুরমুখি রকেটের মতো নিজেকে নিক্ষেপ করি।য্যানো আমি গাড়িটার ভেতর থেকে জন্ম নিলাম।আমার পিছনে আমার ছোট্ট টাইটানিক আমার জীবনটি বহন করছিল।আমি এখন একোয়ারিয়ামটার  বাইরে।

আনন্দের তাড়নায়, হঠাৎ বাতাসের মতো আমি হঠাৎ নিঃশব্দে শ্বাস নিতে পারি, পড়ে যাওয়া গাছটি মিস করেছি; না  আমি এটি মিস করিনি, গাছটার ডালে আমার মাথা বাড়ি খেলো।

'সুজান এখনও বাড়ি আসেনি - সে গাড়িতে ছিল - হ্যাঁ, আমরা চিন্তিত ... তার মোবাইল - না। সারা দিন কোনও সিগন্যাল ছিল না।'

আমি যখন ওফেলিয়ার মতো নদী-রাস্তায় চুপি চুপি ভাসছিলাম, উইলস্টন চার্চিলের জানাজা-বার্জের মতো, টেক দ্যাট! চূড়ান্ত সফর, সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল তৈরির জন্য পাথরগুলি টেমসে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল, যিনি ভাবেন যে তিনি আস্তে আস্তে অতীতকে অতিক্রম করতে পারবেন বেংগলি ব্রজেন দাশের* মতো চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ফিরে বিশাল তিমির মতো, বাইরে বিশাল, ভিতরের ছোট সেই তিমি, যে ভাবে যে সে আস্তে আস্তে অতীতকে অতিক্রম করতে পারবেন, বোম্বে, চট্টগ্রাম চারদিকে ঘুরলেন এবং বুঝলেন তিনি আর কখনও বাড়ী ফিরতে পারবেন না, কারণ তিনি জানেন  নদীটি তার চেয়ে বড়, এবং নদীটি এতটা গভীর ছিল না যে, এককালে হয়তো ছিল, প্রাচীন কালে, গল্পগুলিতে যেরকম এক তিমি অন্য তিমিকে বলে, কাচের টিউব সমুদ্রের মতো ফুটে উঠেছে!

আপনার কাছে ... দুটি নতুন বার্তা এবং একটি সংরক্ষিত বার্তা। মার্টিন ... এটা সুজান।এবং এটি আমিই ছিলাম, কাচের নলটিতে পুরোপুরি সিল মেরে দেওয়া হয়েছিল, যেখানে পানি আমার চারপাশে রজনের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল।আর সেটাই ছিল আমি, ভাসমান বাড়িতে।

মার্টিন বাড়ির পিছনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল।নদী বাড়িতে আসতে পারবে না -  তীরের অনেক ভেতরে বাড়িটা - তবে বাগানটি এখন একটি হ্রদ।তিনি বৃষ্টি দেখেন, ভাবেন যে বৃষ্টি সাধারণত স্বচ্ছ হয়, এবং এই বৃষ্টিটি কীভাবে এতো অন্ধকার, প্রতিটি ফোঁটা সীসা শটের মতো। শীতকাল না, অথচ বৃষ্টি ছিল কঠোর এবং ভারী, শিলাবৃষ্টি। নতুন ধরণের বৃষ্টি, শত্রুতাপূর্ণ, ক্ষমা নয়, করুণার মতো নয়, শাস্তির মতো। মানুষের কোনও দয়া আশা করা উচিত কি এই বৃষ্টির কাছে? সুসান কোথায় ছিল?

মার্টিন সুজানকে ক্যারোলিন সম্পর্কে বলতে যাচ্ছিল।ফ্রিজার থেকে তার কাছে দুটি পিজ্জা এবং  সালাদের কয়েকটি ব্যাগ ক্লোরিন বা টয়লেট ব্লিচ বা ধুয়ে ফেলা বা সুপারমার্কেটের যা কিছু ছিল তা সালাদকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করতে বা জীবাণুগুলো মেরে ফেলার জন্য ছিল। ও নৈশভোজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

তার অনেক আগে বাসায় ফেরা উচিত ছিল।ও চেয়েছিল যে সে ঠিকঠাক, নিরাপদে থাকুক - এবং তার দেহের একটা অংশ, বড় অংশ নয়, কেবল একটি নখ বা একটা নাকের ফুটো  চেয়েছিল যেন সে মারা যায়। পরিষ্কার এবং সহজ মৃত্যু। তারপর ও দুঃখিত হতে পারে, এবং তিনিও দুঃখিত হবেন, কারণ সে একবার ওকে ভালবেসেছিল, যখন প্রেমটি পরিষ্কার এবং স্বচ্ছ বলে মনে হয়েছিল, অন্ধকার আরো  গাড় হওয়ার আগে। হ্যাঁ, যদি সে মারা যায়, পানিতে ডুবে একটি তাত্পর্যহীন মৃত্যু, তবে ও সমস্ত ভাল জিনিস মনে রাখতে পারতো এবং পরে, এমনকি তার নিজের বাবা-মা কেউই তাকে ক্যারলিনের কাছ থেকে  ফেরাতে পারবে না।সে  মুক্তি পাবে।

সে জানতো যে পারস্পরিক আর কোনো পরিণতির সুযোগ নেই।

সে আকাশের দিকে তাকালো।

পানি বাড়ছে।পেডালের মতো আমার হাত ও পা দু'পাশে পাশাপাশি দুলিয়ে দেহটাকে  ভাসিয়ে রাখতে পারি।আমি কীভাবে পানির ভিতরে এসেছি তা ব্যাখ্যা করতে পারছি না, তবে এটিই ঘটেছে।পানির ভিতরে কোনও পানি নেই, এবং আমি শ্বাস নিতে পারছি।বৃষ্টি ঝরেই চলেছে, আমি জানি যে ডুব দেওয়ার পরে সেতু নদীর নিচে চলে, যার অর্থ ... হু!এই নদীটি আমাদের নদী এবং এখন আমাকে যা করতে হবে তা হ'ল নিজেকে পাড়ে তুলে মার্টিনকে  ডাকা।

মার্টিন তখন পিছনের দরজায় দাঁড়িয়ে, ও ভাবছে যে স্বপ্নে নিজের নাম শুনতে পাচ্ছে, কণ্ঠস্বরটি পরিচিত।সে ইতস্তত করল, তারপরে সে তার  রেনকোট গায়ে চাপালো ।

নদী ফুলে ফেঁপে উঠেছে।সম্পর্কগুলো নদী হওয়ার কথা ভাবছিল এবং একই নদীতে সে কখনও দু'বার পা রাখে নি , তবে যদি সময়মতো ফিরে যেতে পারতো তবে তার জীবনের স্রোত আবার জাগিয়ে তুলতো যতক্ষণ না সে ভালোবাসার শুকনো জায়গায় পৌঁছে যায়,সেখানে জল ছিল না, কোন বেদনা ছিল না, কেবল পাথরের ঘন বিছানা ছিল।সুসানের সাথে বিছানায় থাকা এমনই ছিলো - পাথরের সাথে সহবাস।

মার্টিন দাঁড়িয়ে রইল। নদীতে ভাসমান জিনিস ছিল: বই, একটি ফটোগ্রাফ অ্যালবাম, সাদা গোলাপের একটি তোড়া, একটি জুতো।কারও বাড়িত ইতিমধ্যে, তাকে এই জিনিসগুলি পানি থেকে তুলে ফিরিয়ে দিতে হবে।ও ভাবল যে তার নিজের বাড়ি বন্যার পানিতে ডুবে যেতে থাকলে সরে পড়বার আগে কি কি জিনিস সাথে নেবে।

ঝুঁকে পড়ে দু'টি বই এবং ফটোগ্রাফের অ্যালবামটিকে পানি থেকে বের করে আনলেন। একটি টেডি বিয়ার আর বাচ্চাদের কিছু খেলনা কান্নাভেজা চেহারা নিয়ে তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলো।টেডি বিয়ারটাকে সে পানি থেকে তুলে নিলো।মার্টিন ফটোগ্রাফ অ্যালবাম খুললেন। নতুন চুল কাটা একটি যুবক তাকে দেখে হাসল। তার পাশের মহিলাটি তার হাতটি ধরে ছিল, ওরা নতুনভাবে ঘর বেঁধেছে।

তার পায়ে কিছু ধাক্কা খাচ্ছিল।একটি বিছানা।বিছানাটা টেনে তুলতে তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছিল। সে কাঁপতে কাঁপতে কাঠের ফ্রেমের পাশে বসে রইল। বিছানার লাগোয়া পেছনের ড্রয়ারে বই ছিল, তারপর পিকনিকের টেবিল, তারপর একটি গ্যাস কুকার, তারপর ষাটের দশকের একটি খাট।খাটটি কাঁদছে। খাটটি খালি ছিল।

এখন মার্টিন নদীর মাঝখানে, কিন্তু নদীটি একটি পরিবাহী বেল্ট হয়ে  এবং তার দেহের নিচে রাগতভাবে দুলছিল, আধ ভাসমান, আধো ডোবা তার অতীতের প্রতিরূপ, দীর্ঘ-যাপনের বস্তুগুলি ভুলে গিয়ে ফেলে দেওয়া, হারানো এবং সমাহিত, চিরতরে অদৃশ্য হয়ে গেল এবং শেষ হয়ে গেছে, জীবন একটি সরলরেখা, সময়ের তীর, সময়ের নদী, প্রবাহিত, প্রবাহিত। বন্যা এলে কি হয়?

তাঁর দিকে একটি মৃতদেহ ভেসে আসছিল। সে চিৎকার করে মুখ লুকালো। দেহটা মহাশূন্যে নভোচারীর মতো  ওজনহীন এবং আলগা, পুতুলের মতো একটি গাছের ডাল ধরে আছে।

তাঁর সাথে এখন নদীর পারে বসবাসকারী আরও কয়েকজন, সে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।বন্ধুদের সে পেছনে ফেলে এসেছিল - মার্টিন একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ - সহকর্মীদের অনেককে সে  বরখাস্ত করেছিল - মার্টিন ছিল একজন নেতা - তার ছেলের খুব বেশি কিছু সে দেখে নি।নদী  এতটা ফুলে উঠেছিল।

এই কি, ভাসমান নিকটবর্তী, নিকটাত্মীয় যখন মার্টিন  বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে?সে জীবিত, এবং তাঁর স্ত্রী মৃত।সে তার পা দেখতে পাচ্ছে পোপের পা দেখবার মতো। সে কি কোনো বিভ্রান্তির শিকার?নিছক সাবানের ফ্যানা গোলানো বুদ্বুদ চারপাশে ফেটে যাচ্ছে।সুসানের ফাটা মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল, আহত বৃষ্টির মতো লাল ফোঁটায় ফোঁটায়।

সুজান আহত।

কল্পনা করো।বন্যার পানি নেমে এলো।তোরার দশটা আদেশ সংরক্ষিত সিন্দুকটা আরাফাত পাহাড়ের চুড়ায় আটকে গেলো। ঘুঘু তার মুখে জলপাইয়ের ডাল নিয়ে ফিরে এলো।

এটা কল্পনা।অনেক বছর পর, মাটি শুকনো এবং উর্বর হওয়ার পর, নুহের নৌকাটি সেখানে থেকে গেছে, পাহাড় চুড়ায় সাগরের স্মৃতিবিন্দুর মতো - যা কখনও ঘটে না এমন কোনও অযৌক্তিক সাক্ষ্য।

কিন্তু এটা ঘটেছে।

আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে বাড়ি ফেরার জন্য আমি মরিয়া ছিলাম।কারণ, আমার দেহমন জানতো যে বাড়িটা আর আগের মতো থাকবে না।মার্টিনের সাথে আমার জীবন, আমাদের যৌথ জীবন ধুয়ে যাচ্ছিল; আরও একদিন বৃষ্টি হবে এবং তা আমাদের দ্বৈত জীবনকে পুরোপুরি ধুয়ে উবে যাবে।।

আমি জানতাম ও আমাকে কি বলতে যাচ্ছে। আমি জানতাম, আমি যাচ্ছিলাম কেবল প্রতিক্রিয়া জানাতে।আমরা দুজনেই পরিণতিটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম, এবং তারপরে বৃষ্টি এসেছিল নির্মম স্বচ্ছতায়, এবং নদী ফুলে  ফুলে আমাদের উভয়ের দেখার জন্য অতীতকে জমা করেছিল ঢেউগুলোর চুড়ায়; আমাদের সূচনা, এবং তারপর আমাদের সমাপ্তি।

মার্টিন সবকিছুর পরিকল্পনা করে, কিন্তু এটি পরিকল্পনাতে ছিল না। আমার হৃদয় ফুটে উঠেছিল প্রবল বেগে, আমি ডুবেছি, কারণ আমি আগে থেকে ডুবে ছিলাম। শুধু মাথাটা পানিতে ভাসিয়েছি, আশায়।

জাহাজ ডুবি এবং ক্ষয়ক্ষতির গল্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত কিছু জিনিস তীরে যাওয়ার পথ খুঁজে পায়।বিধ্বংসী বন্যাও আবার ফিরে আসে এবং আমি অবতরণ করেছি সেখানেই আমি যেখানে অনেক আগে চলে গিয়েছিলাম - এমন একটি অবতরণ স্থান যেখানে আমি আমাকে আমার নিজের নামেই ডাকতাম। আবার শুরু করার জায়গা।

আমি ইতিমধ্যে বোতলটা সিলবন্দী করেছিলাম এবং স্টপার্ড লাগিয়েছিলাম, তালাবন্ধ সিন্দুকে পেরেক ঠুকেছিলাম, ভয়ের মায়াবী বোতলে প্রতিটি তরল উপাদান আমার চারপাশে শক্ত হয়ে উঠছিল, ব্যথার অন্ধকার রূপান্তর।

ধ্বংসস্তূপে আমি পালিয়ে গেলাম। আমি উঠে দাঁড়ালাম, আমার শরীরের উপর দিয়ে জল বয়ে গেল, আমার মুখের উপরে রক্ত। তবে এগুলি ছিল তরল এবং পাথর নয়, এটি ছিল আন্দোলন, ভর নয়।দেহঘড়ি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল - ভিতরে যা ছিল তা সুন্দর ছিল না, তবে তা বেঁচে ছিল। আমি জীবিত.

বোতলটির ভিতরে, এক টুকরো কাগজ, কাচের নলের মধ্যে একটি গল্প। এটি উন্মোচন, এটি কি বলে?

অনেক পানি ভালবাসা তৃষ্ণা মেটাতে পারে না, বন্যাও তা ডোবাতে পারে না।

এবং কাগজটি শুকনো জমি, কবিতাটা* আবার শুরু করার জায়গা :

*'নেমে আসলে থেকেই যাবে

বৃষ্টি ভাবুন বৃষ্টি লিখুন পরান জুড়ানিয়া চরম বৃষ্টির ব্লেড'....


মূল, জ্যানেট উইন্টারসন

অনুবাদ, নাসরিন-জয়া হক


*অনুবাদের শুরুতে কবিতার পংতি শহীদ কাদরী, 'বৃষ্টি, বৃষ্টি'।অনুবাদের শেষে কবিতার পংতি, চয়ন খায়রুল হাবিব, 'ঢাকাই মাল্লার'

*পুলিশ-বুদ্ধি, অনুষঙ্গ ঠিক রেখে সার্বজনীন স্থানীয়করণের নিরীক্ষা।

*বেংগলি ব্রজেন দাশ।মূলে ফ্রান্সিস ড্রেকের আর্মাডা থেকে ফেরা ছিলো।

*কবিতাটা...মূলে ছিল, 'গল্পটা আবার শুরু করার জায়গা।' 


কভার, ডেভিড হকনির 'পুল উইথ টু ফিগার' পেইন্টিং এর দিকে এক তরুণী তাকিয়ে আছে/


জুলেখা সিরাপ ফেসবুক গ্রুপে  প্রথম প্রকাশ উল্লেখ করে,কপি/পেস্টে কোনো অংশ বদলানো যাবে না।পানি, জল যেখানে যেরকম ব্যাবহার করেছি, সেরকম থাকবে।শেয়ার করা যাবে।