ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Tuesday, April 13, 2021

সিরিয়ার চিঠি ২।। বিলকিস ও অন্যান্য কবিতা।।

।।নিজার কাবানি।।খায়রুল আলম চৌধুরী।।

বিলকিস ও নিজার কোবানি

নিজার কাবানির কবিতা

ভূমিকা ও  অনুবাদ: খায়রুল আলম চৌধুরী

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২২ শালে আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে অটোমান সাম্রাজ্যের এবং কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে জাতিপুঞ্জের তত্বাবধানে ফ্রান্সের সরাসরি উপনিবেশে পরিণত হয়ে আধুনিক ইতিহাসে নতুন দেশ হিশেবে শুরু হয় পরাধীন সিরিয়ার যাত্রা। ঠিক এক বছর পর, ১৯২৩ শালের ২১ মার্চ দামেস্কের এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আধুনিক সিরিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি নিজার কাবানি।

কারখানা-মালিক বাবা ছিলেন পুরাদস্তুর রাজনীতিবিদ। দেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে জেলও খেটেছেন। দাদা ছিলেন নামকরা কবি, গীতিকার ও অভিনেতা। শিক্ষা, রাজনীতি আর শিল্প-সাহিত্যের পারিবারিক আবহে বড় হওয়া নিজার পরবর্তিতে যে কবিতা লিখবেন তাতে আর আশ্চর্যের কিছু ছিল না। কিন্তু মাত্র পনর বছর বয়সে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়েতে রাজি না হয়ে বড় বোনকে আত্মহত্যা করতে দেখেছেন তিনি। ঘটনাটি গভীর ভাবে নাড়া দিয়েছিল ভবিষ্যত কবি নিজারের কিশোর মননে। দামেস্কের প্রাইভেট স্কুলে আরবির পাশাপাশি ফরাসি ভাষা শেখার মাধ্যমে ফরাসি সাহিত্যের বিপুল ঐশ্বর্যের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেন নিজার। এর পাশাপাশি স্কুলের আরবি ভাষার শিক্ষক, সে সময়ের আলোচিত কবি ও সিরিয়ার জাতীয় সংগীতের গীতিকার খালিল মারদামের সংস্পর্শও পরবর্তিতে তাঁর কবি হয়ে ওঠার পিছনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াকালীন সময়েই বের হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। রিরংসা ও আসঙ্গলিপ্সু আবেদনময়তাপূর্ণ কবিতাগুলো তখন রক্ষণশীল সিরিয় সমাজে তীব্রভাবে নাড়া দেয়। ১৯৪৫ শালে আইন বিষয়ে পড়াশুনা শেষ করে কুটনীতিক হিশেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সরকরি চাকুরিতে ক্যারিয়ার শুরু করেন তরুণ কবি নিজার কোবানি। কুটনীতিক হিশেবে কায়রো, বৈরুত, আঙ্কারা, মাদ্রিদ, লন্ডন ও বেইজিংয়ে চাকুরি শেষে ১৯৬৬ শালে পেশাগত জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এর মধ্যে লেখালেখির কাজ থেমে থাকেনি। লিখেছেন দুই হাতে, ব্যাপকভাবে এবং প্রচুর স্বাধীনতা নিয়ে। তাঁর লেখায় কয়েকটি বাঁক খুবই স্পষ্ট। ১৯৬৭ শালের ’ছয় দিনের যুদ্ধে’ ইসরাইলের কাছে আরবদের পরাজয়ে ব্যথিত হয়েছেন তিনি। আরব একনায়কদের নিয়ে রচনা করেন বেশ কিছু কালজয়ী কবিতা, যা সাম্প্রতিক ’আরব বসন্তের’ আন্দোলনের কর্মীদের প্রেরণা যুগিয়েছে। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর বিয়ে করেন ইরাকি স্কুল শিক্ষিকা বিলকিসকে। বৈরুতের ইরাকি দূতাবাসে কাজ করতেন তিনি। কিন্তু ১৯৭৫-১৯৯০ পর্যন্ত চলমান লেবাননের গৃহযুদ্ধের নির্মম বলি হয়ে ১৯৮২ শালে দূতাবাসে বোমা হামলায় তাঁর নির্মম মৃত্যু নিজারের জীবনে গভীর শোকের ছায়া ফেলে। বিলকিসের শোকে এ সময় তিনি রচনা করেন সিরিয় সাহিত্যের অমর শোককবিতা ’বিলকিস’

প্রায় দুই ডজন কাব্যগ্রন্থের জনক নিজার কাবানি। ১৯৬৭ শালে আরব দেশসমুহের পরাজয়ের পর রাজনৈতিক কবিতা রচনায় বেশি মনোযোগ দিলেও তাঁর অধিকাংশ রচনাই মূলত প্রেমের কবিতাই। সিরিয় সাহিত্যে প্রেমের কবি বলতে নিজার কোবনি তুলনাহীন। জীবনের অধিকাংশ সময় দেশের বাইরে থাকলেও সিরিয়াই ছিল তাঁর লেখা ও চিন্তার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। দেশের বাইরে থাকায় বরং সেনাশাসন, ধর্মীয় অনুশাসন আর উগ্রবাদের বিপক্ষে তাঁর লেখা ছিল স্পষ্ট ও তীব্র লক্ষভেদী।

ভালোবাসার কবি, সিরিয়ার রক্ষণশীলতার দূর্গে নারী স্বাধীনতার সপক্ষে আলোর মশাল জ্বালানো কবি, আরব বিশ্বে একনায়কতন্ত্রের অবসানকামী, মানবতার এই মহান কবি ১৯৯৮ শালে লন্ডনে স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকার সময় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃতুবরণ করেন।


গ্রানাডা

আলহামব্রার দরোজায় দেখা হল অকস্মাৎ আমাদের,

কী মধুর সে দেখা অতর্কিত রঙিন।

নিখুঁত ফ্রেমের কালো দুই অতল চোখের গভীরে,

জেগে উঠে সহসা সুদূর অতীত দিন।

তুমি কি স্পেনিশ? সুধাই আমি তারে,

জবাব দেয় সে: জন্মেছি আমি গ্রানাডায়।

গ্রানাডা! ঘুম থেকে যেন জেগে উঠেছে সাতশ বছর,

স্পষ্ট দেখি আমি তার চোখের তারায়।

ঐ দেখি নিশান উড়িয়ে উমাইয়ারা আসে

ধায় চারদিকে শতশত ঘোড়সওয়ার

ইতিহাস কী অদ্ভুত, কেমন করে ফিরে আসে

রূপবতী এক দৌহিত্রী আমার রক্তধারার!

দামাসকিন মুখপানে তাকিয়ে দেখি আমি

শেবার* চোখের পাতা আর সু’আদের* গ্রীবার মধুরিমা

দেখি আমাদের পুরনো বাড়ির ঘরের মেঝেয়

আমার জন্য শিথান পেতে দিচ্ছেন মা।

তারাখচিত উজ্জ্বল বেলিফুলের বাগান

জলসত্র উদ্ভাসিত সোনার সংগীতে।

কোথায় দামেস্ক? বললাম, তারে পাবে তুমি

তোমার দোদুল চুলের কালো নদীর স্রোতে,

তোমার মুখবিবরে, যেখানে ঘুমায় আমার দেশের সব সূর্য

সে আছে তোমার আরব আননে,

আল-আরিফের পাতার খুশবু আর জলের রোশনিতে

আরবি বেলিফুল, তুলসী পাতা আর লেবুর আঘ্রাণে।

আমার সাথে আসে সে, ফসল উঠে গেলে

পড়ে থাকা গমের শিষের মতো পিছনে বইছে তার চুল

বড়দিনের সন্ধ্যাবাতির মতো

আলোর চমক ছড়ায় তার লম্বা কানের দুল।

শিশুর মতো তাকে অনুসরণ করি আমি, পথ দেখাচ্ছে সে

আমার পিছনে পড়ে থাকে ইতিহাস, সারি সারি ছাইয়ের স্তুপ।

আমি যেন শুনতে পাই হৃৎস্পন্দন আলহামব্রার

কারুকার্যময় নকশার। তারা যেন ডাকছে আমায় খুব।


সে বলল, আলহামব্রা! আমার পূর্বপুরুষের উজ্জ্বল অহংকার

দেয়ালে দ্যাখো, কী অপরূপ সৌন্দর্যের গৌরব আঁকা আমার!

তার গৌরব! আমার কাটাঘায়ে নুনের ছিটা লাগলো,

হৃদয় দীর্ণ হল আরেক অনড় আঘাতে আবার ...

আমার সুন্দরী ওয়ারিশ যদি জানতো কেবল

যাদের কথা বলছে সে, তারা আমারই কওম

তাকে যখন বিদায় দিলাম, যেন আমি খুঁজে পেলাম

তারিক বিন জায়িদ, আমার আরবি তেজ অসম।


পাদটিকা :

আলহামব্রা প্রাসাদটি স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চলের গ্রানাডায় মুসলিম স্থাপত্যের এক

অনন্য নিদর্শন। ৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে মুসলমান শাসকরা এই অপরূপ প্রসাদটি নির্মাণ করেন।

প্রাসাদটি এক সময় স্পেনের রাজা ফার্দিনান্ড ও রাণী ইসাবেলার বাসভবন হিসাবেও ব্যবহৃত

হয়েছে। দুঃসাহসিক অভিযাত্রী খ্রিস্টোফার কলম্বাস এ প্রাসাদ থেকেই তাঁর সমুদ্র

অভিযানের রাজসনদ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৬৫ শালে মাদ্রিদে অবস্থানকালে গ্রানাডার

আলহামব্রা প্রসাদটি দেখার অভিজ্ঞতায় লেখা এ কবিতাটিকে আরবি সাহিত্যে নিজার

কাবানির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসাবে গণ্য করা হয়।

* বাইবেল ও কোরানে বর্ণিত রূপবতী রাণী শেবা। আর সু’আদ নামটি আরবি সাহিত্যে

প্রেমিকার নাম হিসাবে সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়।


জেরুজালেম

জেরুজালেম, আলোকোজ্জ্বল নগর নবীর

সংক্ষিপ্ততম রাস্তা বেহশত আর পৃথিবীর!

হাজার মিনারের নগর জেরুজালেম

তুমি আজ পোড়া আঙ্গুলের সুন্দরী

বিষাদ ভরা দু’চোখ তোমার

ব্যথাবিধুর আওরাত কুমারী।

নবীদের স্মৃতিঘেরা বালু বাগান

ঢেকে আছে অতল আঁধারে,

পাথরগুলোর মন খারাপ আজ

তোমার সব রাস্তার কিনারে।

মসজিদের গম্বুজগুলো আজ বিষণ্ণ

অন্ধকারের চাদরে ঢাকা নগরে

কে বাজাবে ঘন্টা যিশুর সমাধিমন্দিরে

রবিবার সকালের জন্য?

কে দিবে খেলনা শিশুদের বড়দিনের উৎসব হলে?

চোখের পাতা ভাসছে তোমার প্রবল কান্নার জলে।

কে দেখবে বাইবেল?

কে বাঁচাবে কোরান?

কে বাঁচাবে যিশু,

কে বাঁচাবে ইনসান?

জেরুজালেম, আমার ভালোবাসার নগর,

দিন আসবে দিন যেদিন আবার


ফুটছে ফুল তোমার সব লেবু গাছে,

ফসলের সবুজ ডগা আর পাতারা সব আনন্দে নাচে,

চোখগুলো তোমার উঠেছে হেসে। অভিবাসী কবুতর

ফিরে এসেছে ছাদে। শিশুরা ফিরে গেছে খেলার মাঠে।

বাবা-মা আর শিশুরা মিলছে সব তোমার উজ্জ্বল রাস্তায়,

আমার নগর, জলপাই আর শান্তির নগর, প্রণতি তোমায়।


কবিতাগুলি লিখো তুমি আর আমি শুধু সই করি

তোমাকে বদলানো কিংবা ব্যাখ্যা করার কোনো মুরোদ আমার নেই

কখনো বিশ্বাস করি না যে কোনো পুরুষ কোনো নারীকে বদলাতে পারে

সেই লোকগুলো আসলে মিথ্যাবাদী

যারা মনে করে যে নারীকে তারা সৃষ্টি করেছে

তাদের বুকের পাঁজর থেকে

নারীরা কোনো পুরুষের পাঁজর থেকে জন্ম নেয়নি, কখনোই না,

পুরুষই বরং জন্ম নিয়েছে নারীর জঠর থেকে

যেভাবে জলের গভীর থেকে উঠে আসে একটা মাছ

যেভাবে একটা নদী থেকে বের হয়ে আসে খালের ফল্গুধারা

এটি পুরুষ, যে নারীর চোখের মণির চারদিকে ঘোরে

আর মনেমনে ভাবে যেন এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে


তোমাকে পোষ মানানো কিংবা বশীকরণ

অথবা তোমার ইষ্টিপূরণ

এসবের কোনো মুরোদ আমার নেই

এ এক অসম্ভব কাজ

তোমার কাছে বুদ্ধি ও বোকামির পরীক্ষা দিয়েছি আজ

সবই গেছে বিফলে, না পেয়েছি দিশা না প্রলোভন

তুমি থাকো আদিম, যেমন আছো তুমি এখন

তোমার অভ্যাস বদলে দেয়ার কোনো মুরোদ আমার নেই

এমনই আছো তুমি তিরিশ বছর ধরে

তিনশ বছর ধরে

তিন হাজার বছর ধরে

বোতলে আটকানো একটা তীব্র ঝড়

একটা দেহ প্রকৃতির স্বভাবে পুরুষের গন্ধ যে পায়

উড়ায় তাকে খামখেয়ালে

স্বতঃস্ফ‚র্ত বিজয়োল্লাসের করতলে


কখনো বিশ্বাস করো না যখন কোনো পুরুষ বলে

সে কবিতা লিখে কিংবা

সন্তান জন্ম দেয়

এটি নারী যে কবিতা লিখে

আর পুরুষ কেবল সই করে

এটি নারী যে সন্তান ধরে

আর পুরুষ কেবল মাতৃসদনে পিতার নামে সই করে


তোমার নিজস্বতা বদলানোর কোনো মুরোদ আমার নেই

আমার পুস্তক তোমার কোনো কাজে আসবে না

আমার দৃঢ়বিশ্বাস তোমাকে আশ্বস্ত করবে না

পিতাসুলভ আমার পরামর্শেও তোমার কোনো কাজ নেই

তুমি রাণী তুঘলকি রাজত্বের, কালাপাহাড়ের

তুমি নও কারো ব্যক্তিগত অধিকারের

এমনই থেকো তুমি

তুমি মানবীবৃক্ষ বেড়ে উঠো আধারে

আলো-জল অবহারে

তুমি ভালোবেসেছো সবাইকে সাগরকন্যা

কিন্তু কাউকে না

ঘুমিয়েছো তুমি সব পুরুষের সাথে ... তুমি ঘুমাওনি কারো সাথে

তুমি ঘুরেছো সব সম্প্রদায়ের দোহার বেদুইন নারী

আর ফিরে এসেছো কুমারী।

এমনই থেকো তুমি।


যখন আমি ভালোবাসি

যখন আমি ভালোবাসি

নিজেকে এই সময়ের রাজা মনে হয় আমার

এই পৃথিবী আর এর সবকিছুর মালিক বনে যাই আমি

আর ঘোড়ায় চড়ে উঠে যাই সূর্যের দিকে।

যখন আমি ভালোবাসি

আমি গলে যাই অদৃশ্য আলোর মতো

নোটবুকের কবিতাগুলো হয়ে যায়

লজ্জাবতী আর পপি’র বাগান।

যখন আমি ভালোবাসি

ঝরনার মতো ঝরে জল আমার আঙুল থেকে

গজায় ঘাস আমার জিহŸায়

যখন আমি ভালোবাসি

সময় ছাড়িয়ে আমি হয়ে উঠি সময়।

যখন আমি একজন নারীকে ভালোবাসি

সব বৃক্ষ

খালি পায়ে ছুটে আসে আমার দিকে।


আমি লিখি

আমি লিখি

একটা বিস্ফোরণ ঘটাতে; সব লেখাই এক-একটা বিস্ফোরণ

আমি লিখি

আলো যেন অন্ধকারকে জয় করতে পারে

এবং জয় যেন হয় কবিতার

আমি লিখি

গমের শিষ আমাকে পড়বে

বৃক্ষরা আমাকে পড়বে

আমি লিখি


গোলাপ আমাকে বুঝবে

নক্ষত্র, পাখি,

বিড়াল, মাছ, শামুক ও ঝিনুক

আমাকে বুঝবে

আমি লিখি

হালাকুর কুকুর-কামড় থেকে এ পৃথিবীকে বাঁচাতে

মিলিশিয়াদের শাসন থেকে বাঁচাতে

দস্যুদের পাগলামির হাত থেকে বাঁচাতে

আমি লিখি

স্বৈরশাসকদের জেলখানা, মৃতদের শহর, বহুগামীদের দেশ

আর একঘেয়ে দিনগুলোর শীতলতা আর পৌনঃপুনিকতা থেকে নারীদের বাঁচাতে

আমি লিখি

কুকুরের গন্ধ শোঁকার মতো শব্দগুলোকে খুঁজে সেন্সর করা থেকে বাঁচাতে

আমি লিখি

আমার ভালোবাসার নারীকে

কবিতা আর ভালোবাসাহীন শহর

নিরাশা আর বিষাদময় শহর থেকে বাঁচাতে

আমি লিখি তাকে এক ফালি রহস্যময় মেঘ বানাতে

শুধু নারী আর লেখা

মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখে আমাদের।


শব্দ দিয়ে আঁকা ছবি

বিশ বছর ধরে আমি হাঁটছি ভালোবাসার পথে

কিন্তু পথের মানচিত্র এখনো রয়ে গেছে আমার অজানা।

কখনো বিজয়ী হয়েছি।

হেরেছি তারও বেশি।

বিশ বছর পরও, হে ভালোবাসার কিতাব

এখনো প্রথম পাতাতেই আছি আমি।


শব্দ দিয়ে বিশ্ব জয় করি আমি

শব্দ দিয়ে বিশ্ব জয় করি আমি

জয় করি মাতৃভাষা

ক্রিয়া, বিশেষ্য, বাক্যরীতি।

জলের সংগীত আর আগুনের বারতাবহ

নতুন এক ভাষায়

আমি মুছে দেই সব আদি-অনাদি

ভবিষ্যতকে আলোকিত করি আমি

সময়কে স্থির করে দেই তোমার চোখে

এবং মুছে ফেলি

সময় আর এই মুহূর্তের ভেদরেখা।


বোকামী

স্মৃতির বই থেকে

তোমাকে যখন মুছে ফেলি আমি

আমি খেয়াল করি না যে আমি মুছে ফেলছি

আমার অর্ধেক জীবন।


ভাষা

প্রেমিক যখন প্রেমে পড়ে

পুরনো শব্দ কি আর

সে ব্যবহার করে?

ব্যাকরণ আর ভাষাবিদ কি

প্রেমপিয়াসি নারীর

মনে ধরে?

প্রেয়সীকে কিছুই বলিনি আমি

শুধু একটা তোরঙ্গে

তার সব বিশেষণ ভরে

ভাষা থেকে পালিয়ে গেছি অনেক দূরে।


কাপ এবং গোলাপ

ভালোবাসা ভুলতে আর

আমার দুঃখগুলোকে কবর দিতে

আমি কফি হাউজে এলাম, কিন্তু

তুমি উঠে এলে আমার

কফির কাপের তলা থেকে,

একটা শাদা গোলাপ।


সমীকরণ

আমি তোমাকে ভালোবাসি

সুতরাং আমি এখন

বর্তমান কালে আছি।

আমি লিখি, প্রিয়া,

আমি অতীতকে তুলে ধরি।


মুষ্ঠিবদ্ধ দেশ থেকে একটা অতি গোপন রিপোর্ট

বন্ধুগণ!

কবিতা কী যদি তা বিদ্রোহ ঘোষণা না করে?

যদি তা স্বৈরশাসককে উৎখাত না করে?

কবিতা কী যদি তা আমাদের প্রয়োজন যেখানে

সেখানে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ না ঘটায়?

কবিতা তাহলে কী যদি তা বিশ্বের শক্তিশালী রাজাদের মাথায় শোভিত

মুকুট উড়িয়ে না দেয়?


১৯৮১ শালের ১৫ ডিসেম্বর বৈরুতে ইরাকি দুতাবাসে আত্মঘাতি জঙ্গি হামলায় নিহত হন

নিজার কোবানির ইরাকি বংশোদ্ভত স্ত্রী বিলকিস। প্রিয়তমার শোকে লেখা হয়েছিল

আরবি সাহিত্যের এ অমর কবিতাটি।


বিলকিস


বিলকিস ও রাজকন্যা,

তুমি পুড়ে গেছো, বলি হয়েছো সাম্প্রদায়িক জিঘাংসার,

আমার রাণীর মৃত্যুতে

কি লিখবো আমি?

শব্দ এখন আমাকে পোড়ায়

হতাহতদের লাশের স্তুপের ভিতর আমরা খুঁজছি

একটি খসে পড়া তারা, কাচের টুকরার মতো ছড়িয়ে পড়া একটি দেহ।

আমরা জানতে চাই, ও আমার ভালোবাসা:

এটি কি তোমার কবর

নাকি আরব জাতীয়তাবাদের?

আজকের পর আমি আর ইতিহাস পড়বো না,

আমার আঙ্গুল পুড়ে গেছে, আমার জামাকাপড় আজ রক্তাক্ত,

আমরা এসে পড়েছি এখন এক প্রস্তর যুগে

প্রতিদিন আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি হাজার বছর।

কি বলে কবিতা এই যুগে, বিলকিস?

কি বলে কবিতা এই কাপুরুষের যুগে ?

আরব দুনিয়াকে আজ গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে, মিশিয়ে দেয়া হয়েছে, এর জিহŸা কেটে

নেয়া হয়েছে।

আমরা আজ অপরাধি


বিলকিস

আমি তোমার ক্ষমা ভিক্ষা চাইছি।

হতে পারে তোমার জীবন ছিলো আমার মুক্তিপণ,

আমি ঠিক জানি

খুনিদের উদ্দেশ্য ছিলো

আমার শব্দগুলোকে খুন করা!

সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসায় শান্তিতে ঘুমাও, হে সুন্দরী আমার,

কবিতা তোমার চলে যাবার পর আর সম্ভব নয়

দরিয়ার কবিতা

তোমার চোখের নীল বন্দরে

মধুর আলোর বৃষ্টি ঝরে

চপল সূর্য আর খোলা পাল

ছবি আঁকে অজানা অসীমকাল।

তোমার চোখের নীল বন্দরে

আছে এক খোলা জানালা দরিয়ায়

তাই হেরি দেখি দূর দিগন্তরেখায়

পাখিরা খুঁজে ফিরে দ্বীপ অজানায়।

তোমার চোখের নীল বন্দরে

তুষার ঝরে জুলাই মাসে।

জাহাজ ভরা নীলকান্তমণি উপচায়

ভেসে যায় দরিয়ায় অনায়াসে।

তোমার চোখের নীল বন্দরে

এলোমেলো ছড়ানো পাথরে

খেলি শিশুর মতো, টেনে নেই দরিয়ার সৌরভ বুকের গভীরে,

আর ফিরে আসি আমি যেন ক্লান্ত পাখি এক তমসার তিমিরে।

তোমার চোখের নীল বন্দরে


পাথরগুলো গান গায় রাতের ললিতা।

তোমার চোখের বন্ধ বইয়ে

কে লুকিয়েছে হাজার কবিতা?

আমি যদি নাবিক হতাম

যদি কেউ একটা নাও দিতো আমায়

পাল গুটিয়ে নিতাম আমি

তোমার চোখের নীল বন্দরের সীমানায়।

শিক্ষা

তোমার ভালোবাসা শিখিয়েছে আমাকে

কিভাবে ভালোবাসা বদলে দিতে পারে বয়সের মানচিত্র

শিখিয়েছে কিভাবে পৃথিবী স্থির হয়ে যায়

যখন আমি তোমাকে ভালোবাসি।


বাতির চেয়ে আলোর গুরুত্ব বেশি

বাতির চেয়ে আলোর গুরুত্ব বেশি

নোটবইয়ের চেয়ে এই কবিতার গুরুত্ব বেশি

অধরের চেয়ে চুম্বন গুরুত্বপূর্ণ

তোমাকে লেখা আমার চিঠি

আমাদের দুজনের চেয়ে

অনেক বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ

এগুলোই একমাত্র দলিল

যেখানে সবাই খুঁজে পাবে

তোমার সৌন্দর্য আর আমার পাগলামি।


যখন আমি তোমার অধরসুধা করি পান

দীর্ঘ বিরহের বিরতির পর

যখন আমি তোমার অধরসুধা করি পান

মনেহয় আমি যেন অনন্তর

পোস্টবক্সে করছি চকিত প্রেমপত্র দান।

যদি

যদি কেউ তোমাকে মেঘ দেয়

আমি দিব বৃষ্টি

যদি কেউ বাতি দেয়

আমি দিব চাঁদ

যদি কেউ দেয় শাখা

আমি দিব বৃক্ষ

যদি কেউ দেয় জাহাজ

আমি দিব ভ্রমণ।

গ্রীষ্মে


গ্রীষ্মের দুপুরে আমি

সমুদ্র সৈকতে হাঁটি

আর তোমার কথা ভাবি।

তোমাকে নিয়ে আমার ভাবনার কথাগুলি

যদি সমুদ্রকে বলি,

এই সৈকত, ঝিনুক আর মাছ ফেলে

সাগর চলে আসবে আমার কাছে।


চন্দ্রগ্রস্ত কবিতা


১. সিয়েস্তা

তোমার কথাগুলি পারসি কার্পেট

চোখগুলি দেয়াল থেকে দেয়ালে উড়ে বেড়ানো

দুটি দামাসকিন চড়–ই।

আমার হৃদয় অই ঘুঘুটির মতো বিরহত

তোমার হাতের জলায়

যায় সিয়েস্তায়

দেয়ালটির ছায়ায়।


২. বিপরীত ভালোবাসা

আমি প্রার্থনা করেছি

তোমার চুলগুলি যেন আর বড় না হয়

যেন কাঁধের নিচে আর নেমে না আসে

যেন তা আমার জীবনে দুঃখের দেয়াল না হয়।

কিন্তু আমার সব চাওয়া হতাশায় ডুবিয়ে

চুলগুলি তোমার দীঘলই রয়ে গেল

আয়নার কল্পনা না হতে বলেছিলাম তোমার দেহকে

কিন্তু সে তা শোনেনিÑ

রয়ে গেছে অপরূপ কুহকে।

তোমার ভালোবাসাকে বলেছি

এক বছর ছুটি কাটাতে, সাগর কিংবা পাহাড়ে

কিন্তু সুটকেসটা ঘরের কোণায় রেখে

তোমার ভালোবাসা বলে দিল আমায়

কোথাও যাবে না সে।


৩. শৈশব

আজ রাতে আমি তোমার সাথে থাকবো না

আমি কোথাও থাকবো না

বেগনি পালতোলা জাহাজ আর রেলগাড়ি কিনেছি আমি

এগুলো থামে কেবল তোমার চোখের ইস্টিশনে

শুধু ভালোবাসার জোরে ওড়ে কাগজের উড়োজাহাজ

আমি কাগজ আর রং পেনসিল এনেছি

আমি আজ সারারাত জেগে থাকবো

আমার শৈশবের সাথে।


৪. আঙুর বাগান

আমার পর তোমাকে চুমু দেয়া প্রত্যেকে

তোমার ঠোঁটে আবিস্কার করবে

আমার চাষ করা

এক টুকরো আঙুর বাগান।


৫. শীতকাল

শীতে তোমার ভালোবাসার কথা মনে আছে আমার।

বৃষ্টির কাছে প্রার্থনা আমারÑ

তুমি ঝরো অন্য কোনো দেশে

তুষারের কাছে প্রার্থনা আমারÑ

তুমি ঝরো অন্য কোনো নগরে

পরওয়ারদিগারের কাছে প্রার্থনা আমারÑ

তুমি ক্যালেন্ডার থেকে শীতকাল মুছে দাও

আমি জানি না তুমি বিহনে

কেমনে বাঁচি আমি এই শীতদিনে।


৬. জলের উপর হাঁটা

আমাদের ভালোবাসার সবচেয়ে সুন্দর দিকটি হলো

এখানে কোনো চিন্তা কিংবা যুক্তির বালাই নেই

আমাদের ভালোবাসার সবচেয়ে সুন্দর দিকটি হলো

এটি জলের ওপর হেঁটে যায়Ñ ডুবে না।


৭. জ্যামিতি

আমার প্রেমের সীমানার বাইরে

সময়ের কোনো অস্তিত্ব নেই তোমার

আমিই তোমার সময়

আমার হাতের কম্পাসের বাইরে

কোনো মাত্রা নেই তোমার

আমিই তোমার সব মাত্রা

তোমার কোণ, তোমার বৃত্ত

তোমার ঢাল

তোমার সরলরেখা।


৮. খুঁজে ফিরি তোমাকে

প্রেম আমার আরাধনা

তুমি আমার আরাধনা

প্রেম ঘুরে বেড়ায় আমার ত্বকে

তুমি ঘুরে বেড়াও আমার ত্বকে

আর আমি পিঠে বয়ে বেড়াই বৃষ্টি-ধোয়া রাস্তা আর ফুটপাথ


খুঁজে ফিরি তোমাকে।


প্রেমপত্র


১.

আমি কোনো শিক্ষক নই

যে তোমাকে শিখাবো কিভাবে ভালোবাসতে হয়

সাঁতার শিখতে মাছদের কোনো শিক্ষকের দরকার হয় না

উড়তে শেখার জন্য পাখির কোনো শিক্ষক লাগে না

নিজেই সাঁতার কাটো

নিজেই উড়তে শিখো

ভালোবাসার কোনো নোটবই নেই

ইতিহাস-বিখ্যাত প্রেমিকদের কেউই

পড়তে জানতো না।


২.

আমি গুনগুন করে গাই তোমার ছোট ছোট উজ্জ্বল বর্ণিল স্মৃতি

পাখি যেমন গায়

আন্দালুসিয়ার এক হাভেলির ঝরনা যেমন গায় তার

নীল জলের গান।


৩.

বৃষ্টির রাতের মতো দুটি চোখ তোমার

যেখানে ডুবে যাচ্ছে সব জাহাজ

আর যা লিখেছিলাম সব ভুলে গেছি আমি

আয়নায় নেই কোনো স্মৃতি আজ।


৪.

আমি জানি যখন আমি বলি

আমি তোমাকে ভালোবাসি

তখন আমি একটা নতুন অক্ষর আবিস্কার করি

একটা শহরের জন্য যেখানে কেউ পড়তে পারে না

আমি যেন আমার কবিতা পড়ছি

একটা শূন্য নাট্যশালায়

এবং ঢালছি সুরা তাদের জন্য

যারা চেখে দেখতে পারে না।


৫.

যখন শুনি লোকেরা

তোমার প্রশংসা করছে

আর শুনি মহিলারা

করছে সমালোচনা

আমি বুঝি

তুমি কতো সুন্দর।


বিলকিসের খোপায় তিনটি গোলাপ

১.

আমার কাছে সদাই মনে হতো হায়

যেন সে চলে যেতে চাইছে অবেলায়

তার চোখে দেখেছি আমি তোলা পাল

উড়াল দিতে প্রস্তুত যেন চির কাল

সারি সারি উড়োজাহাজ আছে অপেক্ষায়

কখন যেন দিবে উড়াল দিগন্তের মায়ায়।

বিয়ের পর থেকেই দেখেছি আমি তার ব্যাগে

একটা পাসপোর্ট ... আর প্লেনের টিকেট

ছিল ভিসা কত দেশের কখনো যায়নি আগে

যখন চেয়েছি জানতে তার কাছে:

কেন রাখো তুমি এসব তোমার পকেটে?

বলত সে হেসে:

একটা রংধনুর সাথে কথা হবে আমার অকপটে


২.

ধ্বংসস্তুপের ভিতর থেকে তার খুঁজে পাবার পর

যখন ওরা আমাকে তার হ্যান্ডব্যাগটি দিল

তার ভেতর আমি দেখলাম তার পাসপোর্ট

প্লেনের টিকেট

এন্ট্রি ভিসা

আমি জানতাম আমি বিলকিস আল-রাভিকে বিয়ে করিনি

আমি একটা রংধনুকে বিয়ে করেছিলাম ...


৩.

যখন একজন সুন্দরী নারীর মৃত্যু হয়

পৃথিবী তার ভারসাম্য হারায়

একশো বছরের শোক ঘোষণা করে চাঁদ

আর কবিতা বেকার হয়ে যায়।

নতুন বছরে আমার প্রিয়তমার জন্য

আমি তোমাকে ভালোবাসি

পুরনো কোনো স্মৃতির সাথে আমি দিব না তোমার তুলনা

চলে যাওয়া রেলগাড়ির সাথেও তোমাকে মিলাবো না

তুমি আমার শেষ রেলগাড়ি, ঘুরছো দিন-রাত সারাক্ষণ

তুমি আমার শেষ রেলগাড়ি, আমি তোমার শেষ ইস্টিশন

আমি তোমাকে ভালোবাসি

জল কিংবা অনল

মুসলিম কিংবা খ্রিস্টান ক্যালেন্ডার

জোয়ার কিংবা ভাটার দহন

সূর্য কিংবা চন্দ্রগ্রহণ

কারো সাথে দিব না তুলনা তোমার

জ্যোতিষবাণী কিংবা কফির আলপনা

কিছুতেই আমার কিছু আসে যায় না

তোমার চোখে দেখো তুমি ভবিষ্যত

তোমার চোখই আমার মধুর মহরত


আমি তোমাকে ভালোবাসি

প্রতিদিন তোমাকে আমি তিরিশ বছর ভালোবাসি

ব্যস্ততায় পারি না দিতে সময় তোমাকে খুব বেশি


মিনিটগুলো ধায়, পিছন থেকে আমাকে তাড়ায়

মনে হয় আমি যেন কিছু রোপন করেছি দুনিয়ায়

একটা বীজ করেছি বপন ধরণীর জঠরে

আমার কেনো যেন কেবলি মনে হয়

তোমাকে ভালোবাসার প্রহরে প্রহরে

রূপান্তর করি আমি আমাদের এই সময়।


।।খায়রুল আলম চৌধুরী।।