ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Saturday, November 21, 2020

নেগ্রিচ্যুড বা নিগ্রো-চৈতন্য!

 ।।তৃণা রাব্বানি।।

বাংলাদেশে একটা পক্ষ আছে চেতনা শব্দটিকে এলার্জিতে পরিণত করতে আদাপানি খেয়ে লেগে আছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ প্রবর্তনাগুলোকে বিতর্কিত করে তুলে বাঙ্গালির নিষ্পত্তি হওয়া পরিচয়কে

বুদ্ধিবৃত্তিক সঙ্কটে ফেলে করে খাওয়া।সে বিতর্কে আমি নিরপেক্ষ নই, আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের লোক।আজকের লেখাটিতে চেতনা শব্দটি উপপাদ্য হলেও, সম্পাদ্য বিষয় হলো নেগ্রিচ্যুড শব্দটি।শব্দটির ভেতর অবশ্য স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, চেতনা মিলেমিশে আছে।কে বা কাহারা শব্দটিকে 'নিগ্রোবাদ' লিখছে, তা জানার আগে 'নেগ্রিচ্যুড' শব্দটির কারা, কেনো ব্যাবহার করেছিলো, তা দেখা যাক।

১৯৩০ এর দশকে প্যারিসে বসবাসরত আফ্রিকান ডিয়াসপোরার মার্টিনিক কবি এমে সেজার, সেনেগালের কবি লিওপোলড সেদার সেঙ্ঘর যিনি পরে, সেনেগালের প্রথম রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন এবং ফরাসি গায়ানার লিও দামা তাদের লেখালেখিতে নেগ্রিচ্যুড শব্দটি ব্যাবহার শুরু করেন।চেতনাগত দিক থেকে এরা সবাই ছিল উপনিবেশবাদ বিরোধী এবং বিশ্বের সবখানে আফ্রিকান বংশতভুতদের ভেতর প্যান আফ্রিকিয় চেতনা ধারণ ও লালনের ওপর জোর দেন।সংশ্লিষ্ট লেখকেরা মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে, কালো আফ্রিকার ঐতিহ্যকে র‍্যাডিকাল ভাবে তুলে ধরেন।এখানে র্যাডিকালের সরাসরি বাংলা উগ্রপন্থা বা চরমপন্থা নিলে তাদের শৈলী বুঝতে অসুবিধা হবে।শৈলী ও উপস্থাপনার দিক থেকে এদের সবাই পরাবাস্তব ধারায় প্রভাবিত ছিল এবং সে ধারাতে আত্মপরিচয়, ভূমা, প্রেম, নিসর্গ, প্রবাস ও দেশকে তুলে ধরতো।নেগ্রিচ্যুড আন্দোলনের প্রভাব দেখা গেছে পরের আফ্রো-পরবাস্তব,ক্রিয়লাইট ও Black Is Beautiful  আন্দোলনে।ফ্রাঞ্জ ফানন পরে তার লেখায় অনেক বার নেগ্রিচ্যুড ব্যাবহার করেছে।

বাংলাতে সাধারণত ইজমের ক্ষেত্রে বাদ শব্দটি যোগ করা হয়, মার্ক্সবাদ, পুঁজিবাদ, বর্ণবাদ ইত্যাদি।নেগ্রিচ্যুড এ ইজম শব্দটি নেই।না থাকলে যে বাদ যোগ করা যাবে না, তা নয়।তবে যারা প্রথম নেগ্রিচ্যুড ব্যাবহার করেছিল তারা এটা যাতে ইজমে না গড়িয়ে চৈতন্য বা চেতনাতে চলিষ্ণু থাকে তাতে সচেতন থেকেছে, যার ফলশ্রুতিতে তারা আফ্রিকার শেকড়ের প্রতি নিষ্ঠ থেকেও পশ্চিমি পরাবাস্তব শৈলীতে নিজেদের উপস্থাপন করতে কুণ্ঠা বোধ করেন নাই।সেজার, সেঙ্ঘর, দামার লেখালেখি থেকে নেগ্রিচ্যুডের ইংরেজি অর্থ উঠে আসে,
'the quality or fact of being of black African origin.'
'the affirmation or consciousness of the value of black or African culture and identity.'
'কালো আফ্রিকার শেকড় সংশ্লিষ্টতা এবং তার গুনগত দিক'
'আফ্রিকার সংস্কৃতি এবং পরিচয়ের সাথে সংহতি বোধ অথবা চৈতন্য ধারণ।'

সেজার, সেঙ্ঘর, দামা তিনজনই ফরাসি ভাষী, ফ্রেঞ্চ অর্থের দিক থেকেও নেগ্রিচ্যুডে ইজম আসে না।
নেগ্রিচ্যুডের বাংলা হিশেবে 'নিগ্রোবাদ' পেয়েছি, শিবনারায়ণ রায় ও শামীম রেজা সম্পাদিত 'আফ্রিকার সাহিত্য সংগ্রহ ২' সঙ্কলন।এখানে সেঙ্ঘরের কবিতার অনুবাদ সূত্রে শামীম রেজা না কি খালেদ হোসাইন এরকম করেছে তা সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠায়, (১৪৫) বোঝা যায় না।পৃষ্টার অর্ধেকে সেঙ্ঘরের ১১ লাইনের একটা কবিতা, বাকি আধা পৃষ্ঠায় নেগ্রিচ্যুড নিয়ে লেখা, শেষে লেখা খালেদ হোসাইন।সেঙ্ঘরের বানান ওখানে করা হয়েছে, 'সাঁগর', সা এর ওপর চন্দ্রবিন্দু দ্রষ্টব্য, লিওপোল্ডকে লেখা হয়েছে 'লিওপলদ' , দ এর নিচে হসন্ত বসিয়ে।সেজারকে 'সেজেয়ার', নেগ্রিচ্যুডকে 'ন্যাগ্রিচ্যুড' লেখা হয়েছে।সঙ্কলনটি আন্তরিক এবং ব্যাপক বিষয় ধারণ করেছে, কিন্তু ভিন্নভাষী উচ্চারণ নিয়ে দুই বাংলার কেরদানি এড়াতে পারে নাই।

অনেক দিন ধরে আমরা দেখছি, ফরাসি কবি র্যাবোকে হ্র্যাম্বো না খ্র্যাম্বো করা হবে এসব ছেলেমানুষির সাথে এবারকার নোবেলজয়ী কবি লুইস গ্লুককে গ্লুক না গ্লাক বলা হবে তা যোগ হয়েছে।উনিশশো আশির দশকে গুন্টার গ্রাস কোলকাতা, ঢাকাতে সফরের সময় জার্মান Uর ওপর দুটো ফোটা থাকলে তা যে উ তা নিষ্পত্তি হয়ে গেছিলো।যেসব বিষয় নিষ্পত্তি হয়ে গেছে তাকে বিতর্কিত করতে আমাদের ভালো লাগে, কেউ এসে মেক্সিকোকে মোহিকো বলে তা স্প্যানিশ মূলগত উচ্চারণ এসব বললে আমরা বলি, বাহ বেশ জানেতো!৩০শের দশকের বাংলাদেশের প্রধান কবিরা র্যাবো, বোদলেয়ারের দেশি উচ্চারণ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, তা নিতে আমার আপত্তি নেই।সেঙ্ঘরকে কেনো জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চন্দ্রবিন্দুসহ সাগর লিখছেন তা বুঝতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টির সামগ্রিক পাঠরিতির দিকে তাকাতে হবে।

জাহাঙ্গীর নগরের ইংরেজির পুরনো অধ্যাপক ছিলেন নামজাদা কবি মোহাম্মদ রফিক।ওনার লেখালেখি মূলত লোকজ প্রতীক ঘিরে বিবর্তিত, সমকালীন যেসব লেখাতে উনি লাইমলাইটে এসেছেন সেগুলো কাব্যিক মাত্রায় কখনো কথিত দ্রোহ নির্ভর গালাগাল, কখনো দ্বিমাত্রিক আলঙ্কারিকতায় পর্যবসিত।একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক নামজাদা শিক্ষক নাট্যকার সেলিম আল দিন, ওনার লেখালেখিও লোকজ মোটিফ নির্ভর।একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ সমকালীন অর্থনীতির বিষয়ে যা লিখেছেন তার ফিরতি অনুবাদ করলে দেখা যাবে ওনার ভাষা মার্কসবাদের আরকাইক জায়গাতে বসে আছে।

মেক্সিকো কারো হাতে মোহিকো হচ্ছে অতি শুদ্ধতা থেকে, সেঙ্ঘর কারো হাতে 'সাঁগর' হচ্ছে ভাষাগত প্রবর্তনায় বহুভাষিক দুর্বলতা থেকে।জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাগত বুনিয়াদ যে দুর্বল হয়ে গেছে তা বোঝা যায় অনুবাদ ও মৌলিক দু'ধরনের লেখালেখি পড়লে।এই দুর্বলতার সুযোগে ভাষাগত ভাবে আঞ্চলিক, অপ্রমিত ও খিস্তি জোরালো হয়েছে।প্রমিত ও ভাষাগত চলিষ্ণুতার ক্ষেত্রে যারা এগিয়ে আছে তাদেরকে জানার ব্যাপারে, ছাত্রদেরকে জানানোর ব্যাপারে অনীহা, ঈর্ষা, ছাত্রদেরকেও প্রজন্মগতভাবে দুর্বল করে ফেলছে।একই প্রবণতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও দেখা গেছে।জাহাঙ্গীর নগরের কথা বিশেষ ভাবে এসে যাচ্ছে কারণ, তুলনামূলকভাবে ছাত্রসংখ্যা কম হলেও বাংলাদেশের মিডিয়াতে এদের অবস্থান আনুপাতিক হারে অনেক বেশি।সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মঞ্চে দেখা যাবে কোনো কোনো পুরুষ শিক্ষককে এরা পিরের পর্যায়ে নিয়ে গেছে, আবার এখানে শিক্ষক হ্যানস্তা তুলনামূলক বেশি।

জাহাঙ্গীর নগরকে সিঙ্গেল আউট করবার কারণ হচ্ছে, 'নেগ্রিচ্যুড' শব্দের বাংলাতে আমি যে চেতনা যোগ করতে প্রস্তাব করছি, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন মোড়কে তার বিরোধীর সংখ্যা অনেক বেশি।একটি বড় সঙ্কলনের একটি পৃষ্ঠার জন্য পুরো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগত দুর্বলতা নিয়ে পড়াটাকে অনেকে বাড়াবাড়ি বলবেন।কিন্তু কোনো শিক্ষক যখন তার কথাটাকে শেষ কথা হিশেবে ভাষণ দেন, আর সেভাবে তার অনুসারী গড়ে ওঠে, তখন তা গণতান্ত্রিক কোনো চেতনাকে সহায়তা করে না।ধরা যাক সে শিক্ষককে বাংলা একাডেমি পদক দেয়া হলো, তখন কি এ্যাটিচ্যুডের বাংলা হিশেবে 'মতবাদের( 'বাদকে' আমরা মেনে নেবো?সেঙ্ঘরকে 'সাঁগর' লেখা মেনে নেবো?

জাহাংগীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লার বার্ড তৈরি হয়েছিল জেনারেল আইয়ুবের কথিত মৌলিক গণতন্ত্রের অভিধান অনু্যায়ি, যার মুল লক্ষ্য ছিল কায়েমি স্বার্থের ধ্বজাধারী আমলা বানানো।এখানে কথিত লোকজ ধারাকে ধারন করে যেসব প্রিটেনশান তৈরি হয়েছে, তা হয়তো আইয়ুবি পত্তনিকে ঢাকা দেবার প্রয়োজনে।একই প্রিটেনশান দেখা যাবে বার্ডের সাহেবি গ্রাম্যতায়।বলছি না যে খালেদ হোসাইন তার লেখালেখিতে আমলাতন্ত্রকে ধারণ করেন।বরং বলতে চাইছি, 'আফ্রিকার সাহিত্য সংগ্রহ' সঙ্কলনটিতে ওনার ১১ লাইনের ও ৬১ শব্দের যে অনুদিত কবিতাটি আছে তার পাশে একই সঙ্কলনে যে বড় লেখাগুলো আছে তা সুধীমহলে ও ছাত্রদের কাছে তুলে ধরবার দায়িত্ব কিন্তু ওনার মত শিক্ষকদের।পাবলিকের করের টাকা তাহলে আদায় হয় সুদাসলে।আর কথিত না ফেরার দেশে যাওয়া অব্ধি নেগ্রিচ্যুডকে আমি নিগ্রো-চেতনা হিশেবেই ধারণ করবো, নিগ্রোবাদ বলে নয়।

এখানে লেখা ভালো, নিগ্রো শব্দটা তৈরি হয়েছিল অবজ্ঞা হিসেবে, গালাগাল হিশেবে, ছোটলোকি অর্থে, সেটা ফিরিয়ে দিয়ে চৈতন্য হিশেবে ধারণ করে এ্যাটিচুডে নিয়ে আসা থেকে আফ্রিকা থেকে এমেরিকায় আমরা পাচ্ছি বিচিত্রমুখি লুথার কিং, মান্ডেলা, ওলে সোয়িঙ্কা, মায়া আঞ্জেলু, টনি মরিসন, মোহাম্মদ আলি, ম্যালকম এক্স, ওবামা, হেইল বেরি, এলেক্স হেইলি, জেডি স্মিথ, রিয়ান্না, নাগিব মেহফুজসহ আরো অনেককে যাদেরকে একটি ইজমের ফ্রেমে বাধা যায় না, কিন্তু যারা প্রত্যেকে স্বকীয় এ্যাটিচ্যূড ধারণ করে, যারা তাদের ওপর নিগ্রহ নিয়ে সচেতন।আবার যারা নেগ্রিচ্যুডকে হীনমন্যতার দিকে না নিয়ে, গর্ববোধের দিকে নিয়ে যেতে পেরেছে।নিগ্রো-চৈতন্যও নেগ্রিচ্যুডের জন্য শেষ কথা নয়, বিশ্বায়িত মানবতা ধারণ করেই নেগ্রিচ্যুড, যার কারণে পরাবাস্তবতাকে সেঙ্ঘর, সেজার, দামা ধারণ করেছিল অনায়াসে।

তৃণা রাব্বানি
১৩/১১/২০
নিউজিল্যান্ড