ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Friday, November 27, 2020

বাঙ্গালির পরিচয় কাব্য

।।চয়ন খায়রুল হাবিব।।

বাহিরবাটী বন্দনা

আমাদের যাপনের মাঝপথে, কোনো এক সময় তুমি আসো 

খোজাখোজির পেরেশানি দেখে স্মিত হেসে পাশে এসে বসো। 

আলোর অরন্যে নামে আধার, 

কি খুজে বেড়াচ্ছি মনে করতে পারি না কেউ আর।

কোন সে অরন্য তা মনে রাখাটাও কি যে কঠিন।

বন্যতা, বর্বরতা, রুক্ষতার ভেতর এক নির্মেদ সরলতা!

ভাবতে গেলে ভয় হয়, আবার ভাবনাটা বার বার আসে,

কালো ডাটির চশমা পরা চোখে আন্তরিক আত্মিয়তা।


ভাবনাটা এত প্রেরণাদায়ক, 

একটা  নদীর ভেতর কয়েক অর্বুদ নৌকাবাইচের স্লোক।

শেষ অব্ধি সকল বাইচের সাথে চলে ভরা বাদলের বর্ষা,

হ্যাচকা টান মারে ঘুর্নিপাক, কান্ডারি ভরসা।


আমরা কেউ আর ঠাওর পাই না, চারদিকে ঘন মেঘ।

ঘুমের ভেতর স্বপ্ন, স্বপ্নের ভেতর রেলগাড়ির টানা কুহু।

নদীতে বৈঠার ঝপাৎ, পাড় ধরে রেল লাইন,

ঢেউ খেলানো ধানের সবুজ সার্ফিংয়ে ভুবন বেচাইন।


অরন্য, নদী, জল জংলা পার হয়ে এবার পাহাড়,

চুড়াটা মনে হয় কাছে, আসলে অনেক দূরের।

পাহাড়ী ঢাল প্যাচায়ে প্যাচায়ে আমাদের ঘামের ফোটা,

খুজে বেড়াচ্ছে হন্য হয়ে তোমার সংগ্রামের দাগ।


বৃষ্টির ফোটাগুলোতে রাগ, অনুরাগ, আশা, হতাশা,

সব অনুভূতির হাল, পাল খোলা  চড়াই উতরাই।

একটা মৌসুমি অঙ্ক, একটা প্রলয়ঙ্করি আতঙ্ক।

বিপদ সঙ্কেত কি হবে তা নিয়ে আবহাওয়াবিদদের অনিশ্চয়তা।


প্রবল ঘুর্নিপাকের ভেতর আছড়ে পড়ছে বিজলির ক্ষুর।

বাতাসের সাই সাই আর যুদ্ধ দামামার সুর।

গগনবিদারি ঢেউয়ের চুড়ায় এক সফেদ দিঘল দেহ,

বাংলা অক্ষরের গায়ে বোলাচ্ছে জয় বাংলার স্নেহ।


আর্তজনরব 


স্নেহের পরশে আসে বরাভয়।

কিন্তু অস্বস্তি পুরোপুরি কাটে না।

লক্ষ্যের হদিশ ইশারা সঙ্কেতে ঢোকে

বিশ্বাসহন্তা ভুত, প্রেত, দানো।


দম আটকে আসে, তীরে পৌছানোর পর

পিছ ফিরে দেখতে পাই সেই ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সাগর।

বুঝি যে তুমি এক আগুনপাখি আমাদের পথ দেখাচ্ছো,

আবার পথরেখাতে ছড়ানো সে আগুনপাখির অগ্নিপুচ্ছ!


বিমূর্ত পথের ধুলাতে প্রাণ পায় মূর্ত মশাল।

যত আগাই দেখতে পাই এক জ্বলন্ত ভাস্কর্য,

আশ্চর্য ব্যাপার, কাছে গেলে লাগে জীবনের উম।

মাতৃ মেরির কোলে যেরকম সন্তান জিসাসের ঘুম।


যারা ছিলাম খোড়া , তারাও দৌড়াতে পারলাম।

যারা ছিলো দৌড়ের ওপর, তারা দিলো উড়াল।

গাছগাছালি, পাখপাখালি সবাই একে একে জলন্ত মশাল।

সবাই সবাইকে উদ্ধারে পাঠিয়েছে বন্ধুত্বের পয়গাম।


কিন্তু কোনো কোনো ধুলিকনা ইচ্ছে করে জ্বলে উঠলো না।

আবার জ্বলে ওঠা ছাড়া তাদের অন্য উপায়ও ছিলো না।

এদের প্রানপঙ্ক পৃথিবীর কাঠকয়লা নয়, 

এরা সেই প্রাচীন অভিশপ্ত সৌরপাতক নিশ্চয়।


শুভাশুভ মশালে জ্বলন্ত পাখিকুল, জন্তুকুল

এদের এড়াতে চাইলো।

বিভিন্ন ফিকিরে এরা ফ্যাসাদ বাধালো।

চারদিকে পাতলো মশাল নেভানোর ফাদ।


কিন্তু সেই যে জ্বলন্ত ভাস্কর্য, 

যার ছায়ায় ছায়ায় আমরা এদ্দুর এলাম।

সে আমাদের দেখাতে থাকলো 

ফাদ এড়াবার সব গোপন কৌশল।


একটা কৌশল আর গোপন থাকলো না।

যখন সে জানালো, আমরা যাতে ফাঁদ এড়াতে পারি,

তার জন্য তাকে বরন করে নিতে হবে মরনযন্ত্রনা।

তার আত্মত্যাগ ছাড়া আমাদের আগানো সম্ভব না।


উত্তরের ভঙ্গিতে সে ছুড়ে দিলো এক প্রশ্ন অমোঘ!

আমরা কি হতে চাই, কোন শব্দে ফোটে আমাদের বুলি?

বাঘের হুঙ্কার, না কি আমরা বাঘের বাসাতে ঘোগ?

জানালাম, আমরা বাংলাদেশের মানুষ, হতে চাই বাঙালি।


তখন সে জানালো, যাদের এখনো জন্ম হয় নাই,

তাদের সাথে আমাদের বার বার দেখা হবে।

তাদের অনেকে জন্মাবে না, অনেকে জন্মাবে।

শরীরী অশরীরী সকলে ৭ই মার্চের জনসভায় যাবে! 


১৯৭১, ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্সে জাগে বাঙ্গালির হুশ

শব্দের সম্ভ্রমে জাগে এক কীর্তিমান সুন্দর মানুষ

বৈরি সীমান্তে যেরকম শিকারির ওয়াচ টাওয়া্র

বাংগালি নিধনে নামে অপারেশান সার্চলাইটের পাওয়ার


অন্দরমহলি ধুয়া


মুষলধারায় বৃষ্টিনিশুতি ছুঁয়ে হতবাক এক মহাপ্রান্তর

হাজারে হাজারে সৈনিক হাজারে হাজারে সাজোয়া বহর

তোমাকে আমাকে খুঁজছে

প্রিয়তমো, তোমাকে আমাকে খুঁজছে


অক্সিজেন মানুষের প্রাচীনতম নেশা      

ভুমিদস্যুতা মানুষের প্রাচীনতম পেষা

ভাসমান কাফনে আমাদের পরম যাপন

প্রিয়তমো, আমাদের পরম যাপন 


পাতালপুরীর রক্ত এখন রক্তরঙ্গনে ভেসে

খনিতল থেকে বস্ত্রশ্রমিকের ধমনিতে উঠে আসে

ওরা পৃথিবীপ্রাচীন খনিশ্রমিক

প্রিয়তমো, ওরা পৃথিবীপ্রাচীন খনিশ্রমিক 


মাটির গহিনে পাটের মেশিনে

ফিরলে পরে মনে হয় ভুতের যমজ

রাত্রির সন্তান ওদের দিবস গেছে চুরি

প্রিয়তমো, ওদের দিবস গেছে চুরি 


এই নাও যন্ত্রণা ও দূরত্বের পানপাত্র

এই নাও বন্দী মানুষের মুক্ত প্রেমপত্র

ভুতুড়ে অন্ধকারে কালবৈশাখী বার্তা

প্রিয়তমো, ভুতুড়ে অন্ধকারে কালবৈশাখী বার্তা  


তুমি বুঝতে পারো আমিও বুঝতে পারি

পাটের মেশিন নামছে খনির গহিনে

আদিবাসের সংগ্রাম স্বচ্ছতার সংগ্রাম

প্রিয়তমো, আদিবাসের সংগ্রাম স্বচ্ছতার সংগ্রাম


সংগ্রাম কি সাঁওতাল সংগ্রাম কি গারো

সংগ্রাম কি জোনাকি পাঙ্খো না কি ম্রো

হাজং খেলে যায় লুসাই পাহাড়ের খ্যালা

প্রিয়তমো, হাজং খেলে যায় লুসাই পাহাড়ের খ্যালা


মুন্ডা পল্লিতে যদি খোড়ো খনিসুড়ংগ

আদিকয়লাতে আকা খিয়াং নারীটির নাকছাবি তরঙ্গ

ক্রমশ রাজবংশী মনিপুরী বিশ্বায়িত ইস্পাত

প্রিয়তমো, রাজবংশী মনিপুরী বিশ্বায়িত ইস্পাত


তামাটে বাঙ্গাল বিয়ে করেছে নাকবোচা বর্মি কন্যাকে

মুড়িটিন বাস হর্ন বাজায় গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রাস্তার বাকে

ফাকা রাস্তায় এখন কোনো বাসট্রাক নাই

প্রিয়তম কেনো বাসট্রাক কেউ কোথাও নাই


শ্রমদায়িনী কিষানি মায়ের গল্পে  

শিশুরা জেনেছে রূপকের দুয়োরানী বাচে খুব অল্পে

এই নাও সেই রূপক পানপাত্র

প্রিয়তমো, এই নাও সেই রূপক পানপাত্র   


পান করা মাত্র বুকে ধুকপুক ধানকাট্টির ভালোবাসা

মনপবনের উল্লাসে বোঝো এ-বাদলের জল কত খাসা

একজন নয় এ-বর্ষাকে গাজিয়েছে বহুজন

প্রিয়তমো, এ-বর্যাকে গাজিয়েছে বহুজন  


ভোরের অক্ষরমালা


একটা স্রোত নয় বরং অনেকগুলো নদী

জননায়ক একজন এবং সে জনতার প্রতিনিধি

সংগ্রামে সকলের মিলিত সম্মান

প্রিয়তমো, সংগ্রামে সকলের মিলিত সম্মান 


নদীর পতন হলে ডুবে যাবো আমরা সবাই

নদীকে ধরবো যেভাবে গোলাপকে ধরে মরুর বস্রাই

তারপর যে ফুটন্ত নদী তা আমাদের প্রাণাাভা

প্রিয়তমো, তা আমাদের প্রাণাভা


যদি তারা স্পর্ধা দেখায়ে ছুঁয়ে দেখে বুড়িগঙ্গার কপাল

সেখানে ধানকুটানিয়াদের মুঠিমুঠি রাশিরাশি তরতাজা লাল

রোগসংক্রমণে গোপন এক নীরোগ লোহিতভান্ডার

প্রিয়তমো, গোপন এক নীরোগ লোহিতভান্ডার


দুঃখকে যত সূক্ষ্মভাবে বলি দুক্ষতো দুক্ষই

সুইয়ে পরাই সুতা না কি সুতায় পরাই সুই

মসলিনের আয়নায় বংগবন্ধুকে কি দেখতে পাও

প্রিয়তমো, আয়নায় বংগবন্ধুকে কি দেখতে পাও


মেঘ থেকে মেঘে রক্তবাহী উপগ্রহের দোলা

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর দোতালার জানালা পর্দা ফুড়ে

সিঁড়ির ধাপেরা উড়ে যায় বিশ্বায়িত বাংলাদেশে

প্রিয়তম, সিঁড়ির ধাপেরা উড়ে যায় বিশ্বায়িত বাংলাদেশে


আলোর উৎসে আত্মাহুতি ঠাণ্ডা মাথার খুনি

ওরা মূলত শেকলবাধা অমাবস্যার প্রেতযোনি

বুলেটে বেয়নেটে চলটা উঠে দেয়ালগুলো ঝাঁঝরা

প্রিয়তম, বুলেটে বেয়নেটে চলটা উঠে দেয়ালগুলো ঝাঁঝরা


জল্লাদদের পুরানো পোশাকগুলো

অন্ধকারের চেয়ে অন্ধকার ভীষণ ভুতুড়ে কালো

মৃতের হাড় গোড়ে নাচে উর্দিধারির ডাকিন-টিসু

প্রিয়তম, মৃতের হাড় গোড়ে নাচে উর্দিধারির ডাকিন-টিসু


কালো কারচুপি সাদা টুপি যত শবেবরাতের রাতভর

সামনে পিছে তথ্যটুইস্ট হিজিবিজি সব কাগজি বছর

পুরো দৃশ্যটা কাগজে আকা ভোরবেলাকার মোরগের ডাক

প্রিয়তম, পুরো দৃশ্যটা কাগজে আকা ভোরবেলাকার মোরগের ডাক


বাংলা অক্ষরগুলো মোরোগছানাদের চিক চিক চিক

বাংলা অক্ষরগুলো বাঘরেখার ভেতর হুঙ্কারের নিরবতা

আমাদের স্বরবর্ন হাসে কল্পকথার বাঙ্গালির স্বল্প ব্যঞ্জনে

প্রিয়তমো, স্বরবর্ন হাসে কল্পকথার বাঙ্গালির স্বল্প ব্যঞ্জনে



চয়ন খায়রুল হাবিব

জানুয়ারি/অগাস্ট, ২০২০

ব্রিটানি, ফ্রান্স


প্রেরণাসূত্র : ভার্জিলের ইনিড মহাকাব্য,  পাবলো নেরুদা Cancion de Gesta/Song of protest, 

W. H. Auden, "Calypso", "Refugee Blues".