ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Wednesday, November 18, 2020

পাপিয়ার ছবি ও কবিতা

।।দিলরুবা পাপিয়া।।


 আটপৌরে দিন

রাস্তার দিকের আড়াই ফিট বারান্দা,
নিংড়ানো তোয়ালে, অর্কিডের চুঁইচুঁই পানি,
প্রথম সূর্যের স্নিগ্ধ আলো,
অষ্টাদশী কন্যার উঁকিঝুঁকি আর
অফিসগামী ভদ্রমহিলার ছোটাছুটিতো আছেই।
প্রাণান্ত সময়।

স্কুলের টিফিন, সকালের নাস্তা, চায়ের কাপ, অফিসের গাড়ি,
এরচেয়ে ঢের ভালো যদি টানি হাঁড়ি।
হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছে গেলাম কাকলীর
জ্যামে। ব্যাগ খুলে চিরুনিটা লাগালাম চুলে।
হায়- চশমাটা?
মানিব্যাগ, চাবির গোছা আছে ঠিকঠাক।
স্বস্তিতে চোখ বুঁজি, সবে বনানী।
মন নিয়ে ভেসে যাই কোথায় জানি-
চিকচিকে বালি, ঢেউ ভাঙা শব্দ,
সোনালী গাঙচিল, ভেজা ভেজা পা!
হে খোলা আকাশ
ভিজিয়ে দাও আমাকে আলোয় আলোয়!
হঠাৎ ধাক্কা খেলো চলার গতি
চেয়ে দেখি চেনা পথ, চেনা চেনা জন।
এভাবেই চলছে দিন ক্ষণ
এভাবেই পৌঁছে যাই এক দালান থেকে অন্য দালানে।

সময়ের বিবেচনা

সময়ের বৈঠকখানায় সভা হবে।
শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়
সকলকেই ডাকা হলো।
সকলেই নিজেকে সময়ের
শ্রেষ্ঠ বলে হাঁক ছাড়লো।

বয়স বিবেচনায় প্রৌঢ়ের আলোচনা দিয়ে
সভা শুরু হলো।
প্রৌঢ়, কন্ঠে ক্ষীণ হলেও
অভিজ্ঞতার বিশালতা মেলে ধরলেন।
বললেন-
জীবনের সৌন্দর্য নিংড়ে
আবেগ, উচ্ছ্বাস, ভালবাসা,
চঞ্চলতা, উল্লাস, অস্থিরতা-
এমনি বহু বিশেষণের
থরে থরে পা ফেলে
সঙ্গ বেঁধেছি বাস্তবতার সাথে।

বললেন-
বহু বছর ধরে বাস্তবতাই
আমাকে টেনে, হিঁচড়ে,
কঠিন থেকে কঠিনতম বলয়ে পৌঁছে দিচ্ছে
আর আমি মননের টুঁটি চেপে ধরে আছি।
যে মনে এক সময় গোলাপী শাপলায়
বিলিকেটে ডানকিনা সাঁতরাতো,
যে মনে লাজুক কিশোরী
স্রোতের উজানে ভাসতে গিয়ে
বয়োঃসন্ধি ঠেকাতে কোমরে আঁচল পেঁচাতো,
যে মনে নকশি দরমা খুলে
হাওরের চখাচখীতে মন ভাসাতো,
সেই মনে শাল- গজারীর খাম্বা পেতে
বিশাল ইমারত গড়েছি।
সাধ্য কার আমাকে
ডিঙিয়ে যাবার?

ফড়িং তাড়ানো শৈশব বলল-
ছুঁয়ে দাও আমার হাত,
আর চল গোল বাঁধি।
কানা মাছি ভোঁ ভোঁ
যারে পাই তারে ছোঁ।

কৈশোরের দুরন্ত ডাংগুলিপনায়
সভা পণ্ড হতে চলল।
ইচিং বিচিং চিচিং তা
বলে প্রৌঢ়ের হাত ধরে টানাটানি।
বলল- তুমিই কৈশোর
এসো জোড়া জোড়া খেলি।

গাম্ভীর্যের ভাব নিয়ে
উদ্দীপ্ত যৌবন
প্রৌঢ়কে বুকে টেনে নিলো।
যে বাস্তবতা-
সামাজিকতা আর অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে তোমাকে রপ্ত করাচ্ছে আড়ষ্টতার সংকলন,
ছিঁড়ে ফেল সেই জাল।
এসো মনে মনে মিলি,
আর তোমায় কুর্নিশ করি প্রৌঢ়!!

একা ও একসঙ্গে

মাঝে মাঝে অন্যরকম ইচ্ছে করে
আলগোছে খোঁপা খোলা চুল
কপালে টকটকে লাল টিপ
বাতাসে আঁচলটা যেমন তেমন
হাতটা দুলিয়ে হাঁটছি।

হাঁটছি কোনো কোলাহল পথ ধরে
দশ বিশ কতজন ছুটছে
ফেরিওয়ালা, চিৎকার, হাঁকাহাঁকি
কানতালা শব্দের বাহাদুরি
তবুও আনমনে চলছি।

অতখানি কোলাহলে আনমনা
তুমি আমি কী করে তা পারছি?
চারপাশে শত চোখ এড়িয়ে
হাত ছুঁয়ে গাল টিপে হাসছি
সবটাই মন শুধু ভাবছে।

কেন নয় তুমি আমি চলছি
কানপেতে কোলাহল শুনছি
চোখ বুঁজে কতশত ভাবছি
আকাশে ঘুড়ি কাটা খেলছি
আর স্বপ্নের সুতো ধরে টানছি।

অপেক্ষার স্নিগ্ধতা

একদিন তুমি আমায় খুঁজবে।
একদিন সত্যিই তুমি আমায় খুঁজবে।
তখনও সকালের স্নিগ্ধতা,
নিঃসঙ্গ বিকেল আর
রাতের পরতে পরতে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকবে।

হয়তো তখনও বিরহীর মতো কোকিল ডাকবে,
বৃষ্টিভেজা আকাশ চুঁইয়ে চুঁইয়ে একবিন্দু নীল জমবে
অথবা, এক চিলতে মালটার নির্যাসে
তৈরি হবে অমৃতস্য এক পেয়ালা চা।
তখন আমার অপেক্ষায় অবশ্যই থাকবে।

কাঁটাতারের পাশ কাটাতে গিয়ে
যখন আমার দোলানো আঁচল ছিঁড়ে
বুকটা সপাং করে উঠবে
তখন নিশ্চয়ই তুমি আমার হাতটা ধরবে।

হাজারও কোলাহল পেরিয়ে ফাল্গুনি বিকেলে
যখন আমি আনমনে হাঁটব,
তখনও কোনো গৃহস্থিনী ক্ষিরের পায়েশ রাঁধবে,
বাতাস উড়িয়ে নিবে শিমুল পলাশ কৃঞ্চচূড়ার
আভা ছড়ানো মনোহারী সুগন্ধ
আর আমার খোঁপায় থাকবে লাজুক সরষেফুল
তখন তুমি সত্যিই আসবে।

তুমি আসবে তো?

 

স্মৃতিদিন তাথৈ তাথৈ

দিনে দিনে এ-শহরে আমার দম আটকে আসছে। আইডাঁই করি,ছটফটানি লাগে- মনে হয় কোথাও বাতাস তো নেই; দৃশ্যমানে, দৃশ্যের বাইরে পাথর, কেবল নুড়ি,পারদের বাতাসে হাসফাস করি! কাছে পেতে ইচ্ছা করে ফড়িং ডানার স্বচ্ছ, নির্মল গাঁয়ের মানুষ।

ডাংগুলি, গুলতি খেলার সেই দুরন্ত কিশোরবেলা হাতছানি দিয়ে ডাকে। বিলের পানিতে ভেলায় ভেসে শালুক কুড়ানো দিনগুলি আবার কি ফিরে আসবে? আজো ভরা বর্ষায় পিছল খেলার সাথীদের মুখ মনের মুকুরে ভাসে! কে জানে, কোথায় কে আছো!

মনে পড়ে, শ্রাবণের রাতে মেঠো পথ ধরে উদ্ভ্রান্ত জ্যোৎস্নায় ঘোরলাগা হাঁটার কথা!
কতোদিন অগণন তারার আকাশে ঝলমল
ধ্রুবতারাটিকে খুঁজি না!

প্রাণের সাথী মোমেনা, শরৎ, বাবলা, মায়মুন, শেফালি আমাকে কি ভুলে গেছে? কে জানে -কতোদিন তো গেছে সময় বানের জলে ভেসে!

ঈদগা মাঠের নকশি মিনার কালের সাক্ষী হয়ে
আজও কী টিকে আছে? আজও কী বিলের ডাহুক-ডাহুকী মিলেমিশে ভৈরবী গায়?

আজও বোধকরি শনশন হাওয়া বয় দীঘল মাঠের উপর!

সুধীর ঘোষের গাওয়া ঘি গরম ভাতে ফু ফু করে
কতোকাল খাই না- সরষে ফুলের বড়া, নক্সাকাটা পিঠা, কলার মোচার চচ্চড়ির স্বাদ আজো মুখে লেগে আছে!

আহা! ফিরে পেতে চাই সেইদিন যেখানে আলো-আঁধারি চোখের সীমায় খেলা করে, মুছে যায়, ফের ফিরেফিরে আসে!


কবিতা ও পেইন্টিং, দিলরুবা পাপিয়া