ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Wednesday, November 18, 2020

ঝিনু্ক ও সমুদ্রের গান।নভেলা সিরিজ।

।।ফারহিন চৌধুরী।।

পর্ব: ৭ 🍀
রিসিভারটা রাখতেই রমলা সেনের গলা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজে ক্যাফের চারপাশ ভারি হয়ে উঠল। ওল্যাণ্ড আর মিলান বেশ স্বাচ্ছন্দে ক্রেপের সাথে কানে হেডফোন লাগিয়ে রক মিউজিক শুনছিল। মাঝে মাঝে আমির আর মাজেদের কাঁধে হাত দিয়ে হো হো করে হেসে বিড়বিড় করে আবার কাঁটাচামচ দিয়ে ক্রেপটাকে এপিঠ ওপিঠ উল্টে খাচ্ছে।অন্যদিকে আমির আর নিমাই ধনে পাতার ভর্তা দিয়ে বেজায় সস বানিয়ে ক্রেপ খাচ্ছে।মিলান টমেটো কেচআপ আর কোকোয়া পাউডার গরম পানিতে গলিয়ে ব্রাউনির মতো বানিয়ে ডেসার্ট হিসেবে কাজ চালিয়ে নিচ্ছে।নিজেকে ইনভেন্টর মনে করে।
মাজেদ বেশ কড়া নজর রাখছিল রমলা সেনের প্রতিটি পদক্ষেপের। ভদ্রমহিলার আচার আচরণ বেশ সুবিধার মনে হচ্ছেনা ওর কাছে। এত উদারতা কিভাবে সম্ভব বুঝতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল।রমলা সেনের ক্রন্ডন ওর কানে আসতেই ছুটে গিয়ে তার পাশে দাঁড়ায়।হারিকেনের সেই স্বল্প আলোয়ে রমলা সেনের চোখগুলো দিয়ে অবিরল জল গড়িয়ে যেতে দেখল সে।চোখের কালো কাজল গোলাপি গালের সাথে মিশে এক মেটে রক্তবর্ণ রূপ নিয়েছে।হাসিখুশী এই মানুষটাকে বেশ অসহায় লাগছে।চোখের পানি মুছতে মুছতে একবার মাজেদের চোখের দিকে তাকিয়ে সটান দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। রঙিন ছাতাটি জানালার সেই টেবিলে খোলা দাঁড়িয়ে আছে সঙ্গির অভাবে।রমলা সেন শাড়ির আঁচল টানতে টানতে এই বৃষ্টির মধ্যে হুস হারিয়ে সমুদ্রের উদ্দেশ্য যেন নিজেই হারিয়ে গেল।বেরিয়ে যাওয়াটা কেউ পাত্তা দিল না একমাত্র মাজেদ ছাড়া।
দরজার বাইরে আসতেই মাজেদ দূরে রমলা সেনকে চিৎকার করে কিছু বলতে শুনল। “ সবাই স্বাধীন! সবাই স্বাধীন!” এক পা এক পা করে যেন ঢেউয়ের সাথে জল খেলায় মেতে উঠেছেন। হুটহাট করে অজান্তেই হোঁচট খেয়ে নরম বালিতে পড়ে যাচ্ছেন।চোখের পানি বৃষ্টির সাথে মিলে একাকার।হাঁটু গেড়ে রমলা সেন সমুদ্রের দিকে ফিরে দু হাত দিয়ে মুখ লুকিয়ে বসে পড়ল।প্রতিটি ঢেউয়ের সাথে নিজেকে যেন পবিত্র করে নিচ্ছেন। কখনো কখনো মনে হচ্ছে সমুদ্রের উপর রাগ করছেন আর এক হাত দিয়ে ঢিল ছুঁড়ে জিদটা কমানোর অপরিসীম চেষ্টা।কোমরে হাত দিয়ে মাজেদ বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছিল।রমলা সেনকে শক্ত অবস্হান নিতে দেখে রঙিন ছাতাটি নিয়ে দৌঁড়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
“ আপনি এইভাবে কান্না করছেন কেন? কি হয়েছে?”
“আমি কান্না করছিনা। এগুলো বৃষ্টির পানি। বৃষ্টি অনুভব করতে ইচ্ছে হয়েছে তাই বেরিয়ে এসেছি।”
“ম্যাডাম, আপনি মনে হয় রসিকতা করতে খুব পছন্দ করেন। কেন অযথা মিথ্যে কথা বলছেন। ছলনায় সব কিছু আড়াল করা সম্ভব নয় সবসময়।ভেতরে আপনার এক্সপ্রেসো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। এই নিন, আপনার রঙিন ছাতা।আবার ঠাণ্ডা লাগিয়ে বসবেন। এবার কোন চা দিতে পারবনা।” “ ছাতাটির নাম রংধনু। এই নামে ডাকলে খুশী হব।এক্সপ্রেসো একবেলা না খেলে খুব একটা ক্ষতি হবে না। আপনার ফ্রিজের ঠাণ্ডা সরবত দিয়ে হয়ে যাবে।” “আচ্ছা মানুষ তো আপনি।আমি চললাম। আসুন ভেতরে।” “ ও চলে গেছে! সবাই স্বাধীন” সেই একই শব্দ আবার শুনতে পেল মাজেদ! “ কি বললেন আপনি ? সবাই স্বাধীন? কে চলে গিয়েছে?” “ নবণীতা মুখার্জি চলে গিয়েছেন। আজকের ট্রেনে চলে গেলেন।”

“নবণীতা কে?” “আমার মা। ৭০ বছর বয়স।সাদামাটা মনের মানুষ।আমার মতো মোটেও তিল কে তাল করতে পারেন না। নিজের রুমের গ্রামোফোনটিতে প্রতিদিন মান্না দের একই গান” খুব জানতে ইচ্ছে করে “ শুনতেন।সামনে গেলেই বলতেন “তুই কি বদলে গিয়েছিস? কত বড় হয়ে গেলি চোখের সামনে। তোর স্বাদ আহ্লাদ ও বদলে গেছে? এখন মনে হয় তুই আর আমার হাতের বানানো খাবারে অভ্যস্ত নয় আর প্রতিদিন দেখি নিজের মনের মতন শাড়ি পরেছিস। এখন আমাকে আর জিজ্ঞেস করিস না।” প্রতিদিনের রুটিন ছিল গানের ছলনায় আমার খবর নেওয়া।আমার এক্সপ্রেসো পছন্দ বলে বেশ খারাপ লাগত তার।মায়ের ক্যাফে ক্যাপাচিনো বানাতে পারতাম না বলে মুখ গোমড়া করে বসে থাকতেন।বাসার পাশের কফি শপটাতে প্রতিদিন বিকেলে আলমারি থেকে নতুন শাড়ি পরে কফি খেয়ে আসতেন। রয়েল কাষ্টমার বলে কথা। আমাকে ফোন দিয়ে কফি খাওয়ার বেশ অনুরোধ করতেন।মাঝে মাঝে বলতেন “ তোকে কফি শপে কাজ করাব, সেখানে তুই আমার জন্য কফি আর নতুন নতুন খাবার বানাবি।”কফি শপের প্রতিটি চিত্রই বেশ মনে ধরে নবণিতা মুখার্জিকে।আসার আগে কথা হয়েছিল আমাদের।একটু আট্টু মনোমালিন্য হয়েছিল আমাদের।কথা ছিলো আমার সাথে সমুদ্র দেখবেন। একই ট্রেনে হাওড়া স্টেশন ছেড়ে গল্প করতে করতে বহু দূর ছুটে যাব।এমনই কথা হয়েছিল।আমি কখনো জোর করিনি ওনাকে। সব কিছু নিজেই পরিকল্পনা করেছিলেন। আসার দিন নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে বসে রইলেন। খুব জেদ করলেন আমাকে একলা ভ্রমণে যাওয়ার বিষয়ে। খুব রোমাঞ্চকর মানুষ। একটু হাস্যকর বিষয় বটে তবে আমারা একটা জিনিস করেছিলাম সেদিন। কি ভূত ছিল মাথায় ঈশ্বর জানেন।একটা মিছে চিঠি লিখেছিলেন যেটা আমাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন সেদিন। নিজেকে আবিষ্কার করতে হবে আমার। দেশ বিদেশ ভ্রমণে চিন্তা শক্তির জায়গাটা বিস্তার করতে হবে।আর বলেছিলেন, যেদিন আমি সমুদ্রের কোন এক ক্যাফেতে বসে এক কাপ এক্সপ্রেসোর চুমুক দিব, তখন একটি ফোন আসবে।তিনি তার জীবনের এক ইচ্ছে বলবেন।কথা ছিল মন ভাল হলে সমুদ্রে আমার সাথে দেখা হবে।ফোনটা এসেছে তবে ব্যাথা আরো বাড়িয়ে দিল।একটা লাইন বলেছেন “ আমি নবণিতা, জল্পাইগুড়ি হয়ে আসাম পেরিয়ে ওপার বাংলার পাহাড়ি গুহায় চলে যাব।ভালো থাকিস।” কেন ? এমনই কেন হবে?”

পর্ব: ৮ 🍀
গোধূলির ডাকে পুরো আকাশ জুড়ে উৎসবের আমেজ।সূর্য মেতেছে আবিরের হলি খেলায়।পাখির কলকাকলীতে মুখরিত চারপাশ আর দূরে সমুদ্রের পাড়ে গাঙচিলের খেলা।মিষ্টি গানের গলায় সেই পরিচিত গান “ যখন বেলা-শেষের ছায়ায় পাখিরা যায় আপন কুলায়-মাঝে,সন্ধ্যাপূজার ঘণ্টা যখন বাজে, তখন আপন শেষ শিখাটি জ্বালবে এ জীবন -
আমার ব্যথার পূজা হবে সমাপন ।” রমলা সেন নিজের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল।অচিরেই সমুদ্রের সাথে সূর্যের মিলন সন্ধিকাল দু চোখ ভরে উপলব্ধি করছিলেন।সময়টা মনে হয় মানুষ তার নিজের প্রয়োজনেই থামিয়ে দেয়। কখনো কখনো নিশ্চুপ হয়ে মনের ভেতরের কথাগুলো গভীরভাবে বুঝতে হয় আর অফুরন্ত পথের খোঁজে বেরিয়ে পড়া আবশ্যক হয়ে পড়ে।
মানুষ যতই আনন্দ করুক না কেন, নিজের জীবিকার প্রয়োজনটি কখনো ভুলতে পারেনা। নিমাই একটা কচি ডাব কেটে এনে রমলা সেনকে দিল।সেই সুযোগে লুফ নিল একটা চকলেট ও ডাবের পয়সাটা।মাজেদ তার নোটবুকটা বের করে অজান্তেই রমলা সেনকে নিয়ে লিখে চলেছে। লেখার ফাঁকে ফাঁকে রমলা সেনের ছবি এঁকেছে। টাইটেল - “রমলা সেনের রোজনামচা ! “ “ ভারি অদ্ভুত মহিলা বটে! যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি।কখনো মনে হয় আমি ওনার দাস আবার কখনো ওনার প্রিয় সঙ্গি। নিজের ভূমিকাটা নিয়ে বড়ই বিচলিত আমি।সূর্যাস্তের সময়ে সমুদ্রকে নিজের কথা আর গানের ছলনায় বশ করে ফেলেন। আবার কখনো আমার প্রিয় ক্যাফেতে রানীর মতো রাজত্ব করেন।”রমলা সেনের দিকে তাকালেই যেন ঠোঁটের কোণে চোখের জলের আড়ালে এক অদ্ভুত হাসি দেখতে পায় সে।
“নবণীতা মুখ্যার্জীকে আপনার বেশ মনে পড়ছে না?” “হয়তবা ! সময় সবকিছু বলে দিবে। সবকিছু ঘটে যাওয়ার পেছনে একটা কারণ থাকে।আপনি জানেন সমুদ্র কেন ভালো লাগে আমাদের দুজনের?” “ কেন?” “ বাবা, মৃণাল সেন, সমুদ্রের জাহাজের কাপ্তান ছিলেন।বছরের ৩৬৫ দিনই সমুদ্রে কাটাতেন।প্রতিদিন বাবার চিঠির জন্য মা অপেক্ষা করতেন আর সেই চিঠি মাসের শেষ রবিবার এসে পোষ্টবক্সে পেতাম। মোমবাত্বির আলোয়ে গ্রামোফোনে হাল্কা কোন গান ছেড়ে মা পড়ে শোনাতেন।বলতেন, ভালো কিছু পড়তে ভালো পরিবেশ লাগে। প্রতিটি শব্দে যত্ন করে হাতের ছোঁয়া লাগাতেন আর প্রতিটি লাইন পড়ে আনন্দের নিশ্বাস ফেলতেন।বাবা সমুদ্র নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখাতেন আর প্রতিটি স্বপ্নের সাথে জড়িয়ে থাকত মা ও আমার কথা।একটা সময়ে চিঠি আসা থেমে যায়। মা বেশ অস্হির হয়ে প্রতি রবিবার পোষ্টঅফিসে গিয়ে বসে থাকতেন। একবার দুবার রাগারাগিও করে এসেছেন। বাবা সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে দূরে চলে গিয়েছেন, ভুলে গিয়েছেন পাড়ে আটপৌরে শাড়ি পরে মা আমার হাতের আঙ্গুলগুলো শক্ত করে ধরে অপেক্ষা করছেন।তিনি মনে করেন এইভাবেই কোন এক সূর্যাস্তের সময়ে বাবা জাহাজ থেকে নেমে মাথার ক্যাপটা খুলে এক হাতে নিয়ে অন্য হাত উঁচু করে আমাদের দিকে তাকাবেন। আলিঙ্গনে ভুলিয়ে দিবেন সব অভিমান। নিশ্চই বলবেন”এই দ্যেখো কাণ্ড এই বক্সে তোমাদের সব চিঠি জমে আছে। সব পড়ে শোনাব আজ।” এইভাবেই মানুষ আশা নিয়ে বেঁচে থাকে । কখনো কখনো মিথ্যের জালটা না ভাঙলেই নয়।”
“আপনার জীবন বেশ অন্যরকম ম্যাডাম। সবাই সব কিছু এত সুন্দরভাবে বলতে পারেন না।” “ উহু! আবার ম্যাডাম! “ “ মাপ করবেন , রমলা সেন ! আপনি নিশ্চই আজ এক্সপ্রেসো পরিত্যাগ করছেন ?” “ জ্বি! ভাবছি যদি আপনি আমায় ক্যাপাচিনো অফার করেন তবে মন্দ নয়।স্বাদটা একটু বদলে নিতে চাইছি।যদি এই সুযোগে ক্যাপাচিনো শিখে ফেলি ।“ “ মন্দ বলেননি। আমি সচরাচর কিচেনে কাউকে ঢুকতে দিইনা তবে আপনি হয়তবা ব্যতিক্রম।আজকে রাতে আপনাকে আর ফরাসি ভদ্রলোক ও মিলানকে একটা জিনিস দেখাবো। তৈরি থাকুন সমুদ্রের খেলার জন্য । “

ফারহিন চৌধুরী
১০/০৫/২০
ঢাকা