ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Saturday, December 5, 2020

সোফিয়া লরেন, ৮৬ বছর বয়সে

সোফিয়া লরেনের সর্বশেষ ছবি, হলোকস্ট, অভিবাসন, ইয়োরোপ ও বাংলাদেশের সম্পর্ক!
সোফিয়া লরেন, তার সামনের জীবন, ২০২০

।।প্যাট্রিসিয়া গিদাস।।।শ্যামল দত্ত।।নাসরিন-জয়া হক।।

তরঙ্গ ওয়েবজাইন মূলত সাহিত্যকেন্দ্রিক, প্রবর্তনার দিক থেকে মাল্টি জন্রে UFO!তরঙ্গের প্রথম প্রকাশ হচ্ছে ফেসবুক  জুলেখা সিরাপ গ্রুপে যারা ২০২০ সালে অংশ নিয়েছে তাদের সালতামামি।লিড কি হবে, তা নিয়ে মাথায় সুনামি তুলবার সময়, দত্ত কুলোদ্ভব শ্যামল প্রস্তাব দিলেন সোফিয়া লরেনের নাম।প্রস্তাবটা আমরা লুফে নিলাম।লেখাটা তৈরি করেছি শ্যামল ও আমি মিলে, প্রাসঙ্গিক তথ্য গবেষণা করেছে প্যাট্রিসিয়া গিদাস। সিনেমাটির প্লট  প্রসঙ্গে ইউরোপের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের দৃষ্টিকোণগুলো এসেছে প্যাট্রিসিয়া ও শ্যামলের কাছ থেকে।

সাহিত্যের যত্নবোধ, শিল্পের অঙ্গিকার, সামাজিক অধিকার, জেন্ডার সচেতনতা, বর্ণ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সাম্প্রতিক বিশ্বজনীন তৎপরতাগুলোকে এক সুতোতে গাঁথলে সোফিয়া লরেনকে পাওয়া যাচ্ছে, আবার গত অর্ধ শতকের পূর্বপশ্চিমের চড়াই উতরাইগুলোর বিনি সুতার মালার লকেটও সোফিয়ার সাজে।মনকাড়া পিন আপ তো আছেই।করোনাকালীন প্রাসঙ্গিকতায়ও ইটালিয়ান সোফিয়া আমাদের নিকটজন, বাংলাদেশের বাইরে বাঙ্গালির সবচেয়ে বড় ডিয়াস্পোরাগুলোর একটি ইটালিতে।অভিবাসনের বড় ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে প্রথমে ইটালিতে।ফেসবুকে জুলেখা সিরাপ গ্রুপে তরঙ্গের বিজ্ঞপ্তিতে সোফিয়াকে আদর করে সুফিয়া ডাকাতে অনেকে আমাদের শুধরে দিয়েছে প্রকাস্যে ও ইনবক্সে।আদর কি আর তাতে থামে!

La vita davanti a sé : তার সামনের জীবন : 
ছেলে এডোয়ার্ড পন্টির নির্দেশনায় সোফিয়া সম্প্রতি যে ছবিটিতে কাজ করেছে তার আরেক প্রধান চরিত্র হলো,এতিম টোকাই কিশোর, সেনেগালিস মুসলিম, কালো মমো, যে চরিত্রে অভিনয় করেছে ইব্রাহিম গুয়ে।এটা য্যানো জর্জ ফ্লয়েড গল্পটার আরেক ভার্শন।ছবিতে সোফিয়া লরেনের নাম রোসা, যে হলোকস্ট থেকে বেচে গেছে।৮৬ বছর বয়সে সবচেয়ে সাদামাটা স্ক্রিনশটেও সোফিয়া ঝলসে ওঠে লাল কার্পেটের গ্ল্যামারে।

উল্লেখিত ছবিটির নাম, The Life Ahead, (La vita davanti a sé), তার সামনের জীবব।প্রয়াত ফরাসি উপন্যাসিক রোমা গারির লেখা অবলম্বনে ছবিটি তৈরি হয়েছে।নাম রোমান কাতসেভ, রাশিয়া থেকে পোল্যান্ড হয়ে ফ্রান্সে এসেছিলেন কৈশোরে মায়ের সাথে ইহুদি অভিবাসী হিশেবে।লিখতেন অনেক ছদ্মনামে, যার ভেতর বিখ্যাত হয়েছিল, রোমা গারি, এমিল আজার, ফস্কো সিনিবাল্ডি, শাতান বোগাত।
১৯৭৫ সালে রোমা সংশ্লিষ্ট উপন্যাসটি লেখেন এমিল আজার ছদ্মনামে এবং সর্বোচ্চ ফরাসি সাহিত্য পদক প্রি গঙ্কু পান সে নামে।মূল ফরাসি লেখাটির নাম ছিল La vie devant soi, আমাদের সামনের জীবনরোমা দুটো ছদ্ম নামে দুবার প্রি গঙ্কু পদক পান।লেখালেখি ছাড়া কূটনীতিক, চলচ্চিত্র নির্দেশক ও বৈমানিক ছিলেন।ইহুদি রোমা গারি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফরাসি মিত্র পক্ষের বৈমানিক ছিলেন, কিন্তু ইহুদি হবার কারণে তাকে কমিশন দেয়া হয় নি।

প্রথম সংস্করণ, ১৯৭৫
এমিল আজার ওরফে রোমা গারি ওরফে রোমান কাতসেভের একই লেখা অবলম্বনে ১৯৭৭ সালে ইসরায়েলি পরিচালক মোশে মিজরাহি বানিয়েছিল মাদাম রোসা ছবিটি।সোফিয়ার বর্তমান ছবিটি মাদাম রোসাকেও অনুসরণ করেছে।দুটো ছবিতেই মাদাম রোসা কেন্দ্রীয় চরিত্র।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান ফ্যাসিবাদী শক্তি চালিত ইহুদি নিধনযজ্ঞ হলোকস্ট থেকে রোসা বেচে গেছে, পরে সে দেহজীবি হিশেবে কাজ করে।দেহজীবিতা থেকে অবসরের পর সে অন্য দেহজীবি  মহিলাদের বাচ্চাদের দেখাশোনা করার একটি কেন্দ্র চালাতে থাকে।একদিন ১২ বছরের সেনেগালিস কিশোর মমো  পথে তাকে ছিনতাই করে এবং একই কিশোরকে মাদাম রোসা তার কেন্দ্রে আশ্রয় দেয়।পুরো ছবি জুড়ে কিশোর মমো এবং মাদাম রোসার ভেতর বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে দেখা যায়, রোসা জানতে পারে মমোর কাহিনী, মমো জানতে পারে যে রোসা একজন সাবেক দেহজিবী এবং হলোকস্ট থেকে বেচে গিয়েছিল।  

পৃথিবী জুড়ে অতিমারির সময় সোফিয়া লরেন একটি উদযাপন, একটি উচ্ছ্বাস।যাকে নিয়ে সব বলার পরও কথা থেকে যায়।

ইব্রাহিম গুয়ে, সোফিয়া লরেন, তার সামনের জীবন
সোফিয়ার সাম্প্রতিক ছবি প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সাথে ইয়োরোপের সম্পর্কের ওপর আলোকপাত :  
এডোয়ার্ড পন্টি ও মোশে মিজরাহির সিনেমার  আলোচনা প্রসঙ্গে কেনো আমরা ইয়োরোপের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ না ভালো তা টেনে আনছি?

অস্কার পুরস্কার, কান চলচ্চিত্র উৎসব, ভেনিস বাই এনাল পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি নিধনযজ্ঞ হলোকস্ট এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামকে ইউরোপের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মেরুকরণে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়।সেখান থেকে জাতি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আইন ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে।

ঐতিহাসিক উপনিবেশিক সূত্রে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ডিয়াস্পোরা গড়ে উঠেছে।যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের ৪ জন মহিলা সাংসদ আছেন।ঐতিহাসিক সূত্র ছাড়া ইটালিতে বাংলাদেশের আরেকটি বড় ডিয়াস্পোরা গড়ে উঠেছে।এ ছাড়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হচ্ছে ইয়োরোপ।স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সেনাকর্তাদের প্রশিক্ষনেও ইয়রোপ ভূমিকা রেখেছে।মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ সরাসরি ইয়োরোপে থেকেছেন এবং বাংলা ভাষার সাথে ইয়োরোপীয় প্রকরণের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন।জীবনানন্দসহ ৩০শের প্রধান কবিরা ইয়োরোপে বসবাস না করলেও এখানকার মননশৈলির সাথে মিথস্ক্রিয়া করেছেন অবিরাম।ইয়োরোপের ম্যাক্সমুলার, রোমা  হ্রলা বাংলার মননশীল জাগরণে উৎসাহ দেখিয়েছিলেন, ফরাসি নতুন ধারার চলচ্চিত্র নির্দেশক লুই মাল তার বিখ্যাত প্রামান্য চিত্র ফ্যান্টম ইন্ডিয়ার ধারন শুরু করেছিলেন পশ্চিম বঙ্গে, একই জায়গা থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার উল্লেখ করে সে সময়ের ফরাসি সংস্কৃতি মন্ত্রী আদ্রে মালরো বলেন, আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা।'মুক্তিযোদ্ধা' শব্দটি মালরো বাঙ্গালির মত বলেছিলেন।

যদিও বাংলাদেশের উন্নয়নে ইয়োরোপের গুরত্বপুর্ন ভূমিকা আছে, কিন্তু জাতিগত সহনশীলতার প্রতি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর ইয়োরোপীয় প্রয়াসগুলোর সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে।যে চিন বাংলাদেশে জেনোসাইড মেনে নিয়েছিল, সে চিন বাংলাদেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নিতি পাকিস্তানের প্রক্সি হয়ে পড়েছে।স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলাদেশের পাসপোর্টে আনুষ্ঠানিক ভাবে লেখা হয়েছে, ইসরায়েল এবং তাইওয়ানে ভ্রমণ নিষেধ।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক ইহুদি নিধন বা হলোকস্টও বাংলাদেশের পাঠ্যক্রমে নেই।অথচ জেনোসাইডের কবলে পড়া একটি দেশের পাঠ্যক্রমে হলোকস্ট এবং অন্যান্য জাতিগত গণহত্যা স্বাভাবিকভাবে আসতে পারতো।

ইব্রাহিম গুয়ে, সোফিয়া লরেন
সোফিয়া লরেনের ছবি নিয়ে আলোচনায় শ্যামল দত্ত ওপরের দৃষ্টিকোণটি উপস্থাপন করেন।আমি একমত হবার পর দেখতে পাই, বাংলাদেশিরা ডিয়াস্পোরাগুলোতে সংখ্যালঘু হিশেবে সম অধিকারের যে ন্যায্য দাবিগুলো তুলছে, ইহুদি সহ অন্য সংখ্যালঘুদের প্রতিও তাদের সে মনোভাব থাকা দরকার।দেশে ও ডিয়াস্পোরাতে এ মনোভাবের অভাবে, আমরা যেরকম আমাদের আশেপাশের সংখ্যালঘুদের প্রতি নিপীড়ন, নির্যাতন এড়িয়ে যাচ্ছি, সেরকম তুরস্কে কুর্দি ও পাকিস্তানে আহমদিয়া মুসলিমদের প্রতি অত্যাচারে নীরব থাকছি।রোহিঙ্গা সমস্যায়ও ইয়োরোপ অং সান সুচিকে আন্তর্জাতিক আদালতের মুখোমুখি করেছে, চিন যার বিরোধিতা করেছে।

ইয়োরোপে ইহুদিরা সংখ্যার দিক থেকে খুবই অল্প এখন।তাদের প্রতি ঐতিহাসিক অন্যায়কে স্মরণ করে ইউরোপ নিজেকেই শুধরে নেবার চেষ্টা করছে।বিভিন্ন প্রকাশনা, চলচ্চিত্র, আইন, শিক্ষাক্রমের ফাকে এখানে বসনিয় মুসলিম, ক্রোয়াট খ্রিস্টানদের জেনোসাইড ঘটেছে সার্বিওদের হাতে।অর্থাৎ এ বিপদটা থেকে যাচ্ছে, যার ফলে মননের প্রতিরোধও জরুরি।সে প্রতিরোধে অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর সংগ্রামে সহানুভূতিশীল না হলে, কেবল সাংসদ হওয়া, স্টুডেন্ট ভিসা ও তৈরি পোশাক বিক্রির জন্য সম্পর্ক ভালো রাখতে চাইলে, তা আসলে শোভন নয়, দীর্ঘ মেয়াদে তা সুফলও বয়ে আনে না।

ছেলের কাছ থেকে স্ক্রিপ্ট বুঝে নিচ্ছেন সোফিয়া
হলোকস্টকে আড়াল করা এক অর্থে অস্বিকার, তা করে ফিলিস্তিনদের অধিকার আদায়ে বাংলাদেশ যে অন্যদের চেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে তাও নয়।কিন্তু হলোকস্ট আড়াল করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহল, সাংস্কৃতিক মহল নিজেদের ওপর এরকম একটি সেন্সর আরোপ করেছে, যার শিকার হয়েছে হাজার হাজার আন্তর্জাতিক প্রকাশনা ও চলচ্চিত্র, যেসব প্রকাশনা পাশের দেশ ভারতে পাওয়া যাচ্ছে।এসব প্রকাশনা যে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ তাও নয়।কিন্তু একটি মানসিক অবরোধ আয়না আরোপ করা হয়েছে, যাতে করে নিজেদের স্বাধীনতা সংগ্রামের আয়নাটিতেও বিভিন্নভাবে চিড় ধরছে।

যে সিনেমাটি নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করেছি, যে বইটি এবং তার লেখক নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করেছি, সে লেখক লড়াই করেছেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, সিনেমাটির নির্দেশক ও কেন্দ্রীয় চরিত্র যে ইটালির সেখানে চলছে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের সংগ্রাম।সিনেমাটির আরেক কেন্দ্রীয় চরিত্রে যে কালো কিশোর সে এসেছে আফ্রিকার একটি দরিদ্র দেশ থেকে।বই থেকে সিনেমা অব্ধি এটি একটি বহুসাংস্কৃতিক, বহুসচল সম্পর্কের কাহিনী, যা এগিয়ে যাবে আমরা প্রত্যেকে যার যার জায়গা থেকে পারস্পরিকভাবে এগিয়ে গেলে!

প্যাট্রিসিয়া গিদাস।শ্যামল দত্ত।নাসরিন-জয়া হক।

Copyright, JSRL, Julekha Syrup Readers Lounge