ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Wednesday, December 2, 2020

মৈতৈ জার্নাল ১

।।খাইদেম সিথি ।।

 খাইদেম সিথি, বামে ও আতিয়া মাইবম

"অহিংচূপ্না
তূমিন তূমিন্না
থৱানমিচাক
খূনমিন্নসি
শোরারেনদৈ
কেন্ধরকপা
থৱানমিচাক
খূনমিন্নসি"-হানুবা
বাংলা অনুবাদ-
"চলো রাতভর চুপিসারে তারা কুড়াই,
আকাশ থেকে ভেঙে পড়া সে তারাগুলো কুড়াই দুইজন মিলে।"
কোনো অন্ধকারচ্ছন্ন রাতে আকাশের বুকে ভেসে থাকা সে তারাগুলো দুজন মিলে কুড়াবে।আকাশের বুক থেকে ভেঙে পড়া সে তারাগুলো আজ দুজন মিলে কুড়াবে।

আমার ভাষা, আমার বেড়ে ওঠা

আমার শৈশব বেড়ে উঠা সিলেট শহরের আম্বরখানা মনিপুরী পাড়াতে।সিলেটের বাঙালিদের মাঝে বেড়ে উঠা হয়েছে।এক পাড়াতে আমরা মনিপুরী-হিন্দু-মুসলিম একসাথে এতবছর ধরে মিলেমিশে থাকছি।
আমার কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় অবদি সবগুলো আমার বাঙালি সহপাঠী,বন্ধুদের সাথে পড়াশুনা করে আসছি।এমনকি আমার প্রতিটি শিক্ষাগুরুই ছিলেন বাঙালি শিক্ষক।আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে খুব কম মনিপুরী স্টুডেন্ট পেয়েছি।তাই সচরাচর বেশীর ভাগ বাংলায় জোর দেয়া হয়েছে কথা বলাতে।তবে আমার বাড়িতে,পাড়াতে সবসময় মনিপুরী ভাষায় কথা বলে আসছি।

রিমি, সিথি, রাফা
ঢাকাতে যতবারই মনিপুরী অনুষ্ঠানে গিয়েছি একজন মনিপুরী হিসেবে আমি সবসময় মনিপুরী ভাষায় কথা বলেছি।১০২৫ থেকে ঢাকাতে থাকছি বাঙালিদের সাথে একঘরে,এক ছাদে এক পরিবার হয়ে।আমার মনিপুরী ভাষা বলাতে কিছু শব্দতে বাংলা শব্দ আসবে সেটা স্বাভাবিক।এমনকি আমার বাঙালি অনেক বন্ধুই আছে যারা আমার মনিপুরী ভাষা অনেক পচ্ছন্দ করে এবং কয়েকটা মনিপুরী বাক্য শিখেছে।আমার অনেক পরিচিতই আমাকে আপুকে না ডেকে চেচে/ইচে ডাকে।এমনকি আমার বান্ধবী সুরাইয়া হেনা আমাকে ইতা বলে ডাকে।আমার মাকে ও "ইমা" ডাকে।আমার প্রেমিককে "ইতেই" বলে ডাকে।আমার সাথে মিশে ওরা আমার থেকে মনিপুরী ভাষা শিখেছে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

বাংলা ভাষাভাষী দেশে মায়ের মুখ থেকে যে মনিপুরী ভাষা শিখেছি তাপরেই আমার বাংলা হচ্ছে দ্বিতীয় মায়ের ভাষা।এই বাংলা ভাষায় আমি আমার ঘরের বাইরের জগৎ কে চিনেছি সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই বাংলা ভাষা দিয়ে আমি আমার শিক্ষা-জীবনে জ্ঞান অর্জন করতে পারছি।বাংলা না জেনে শুধুমাএ আমার মনিপুরী ভাষা এবং ইংলিশ ভাষা দিয়ে আমি এই দেশে টিকে থাকতে পারতাম না।সিলেট হোক কিংবা ঢাকা এমনকি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সবস্তরের মানুষের সাথে কথা বলতে পারতাম না।তবে যেযাই হোক আমার বাড়িতে,আমার পরিবারের সাথে আমি সামনে হোক ফোনে সবসময় আমার মনিপুরী ভাষায় কথা বলি।যারা আমার সাথে চলে তারা এ ব্যাপারগুলো ভালো করে জানে।

সর্বশেষে বলব ভাষা হচ্ছে সম্পূর্ণ স্বাধীন পাখি।যে পাখি মনের ভাবগুলো কথা আকারে বের হয় ভাষার মাধ্যমে।ভাষা ভেবেচিন্তে বলা হয়না।ভেবে-চিন্তা থাকা কথাগুলো আমি আমার সুবিধার ভাষা দিয়ে প্রকাশ করে থাকি।তাই অসাম্প্রদায়িকতা দেশে আমার মুখের ভাষা ও স্বাধীন।

১৮/১১/২০ চন্দন
চন্দন একটি বিশেষ শৈল বা চন্দন গাছের কাঠের টুকরাও হয়। কয়েক ফোঁটা জল দিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে টুকরোটি ঘষে একটি পেস্ট তৈরি করে।  তারপর এটি নাক এবং কপালে রাখার জন্য একটি বিশেষ অভিলাষের কাঠি ব্যবহার করে। এই কাঠির আকৃতি অন্যরকম  দুই প্রান্তে সরু থাকে।প্রতিটি মনিপুরী বাড়িতে এ কাঠি থাকে। নতুনদের জন্য এটি সর্বদা কঠিন আকৃতি এবং সর্বদা লাইন ঠিক আসে না।  চন্দন আমাদের মনিপুরী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক।  পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই বিশেষ অনুষ্ঠানে চন্দন পরেন। একটি বিবাহিত মহিলা প্রতিদিন চন্দন পরেন।এই চন্দন ছাড়া মনিপুরী  অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করা অসম্পূর্ণ সমান।।বিয়েতে বর,কনে কে বিশেষভাবে যারা পারদর্শী এবং য়াইফাবী মহিলারা চন্দন পরার দেয়।
য়াইফাবী(yaifabi) সেই সব মহিলাদেরকে বলে যাদের প্রথম সন্তান ছেলে হয়।তবে কালকের বিবর্তনে এখন যারা পুএসন্তান  জন্ম দিয়েছেন তারাই য়াইফাবি হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে।

৩০/০৭/২০

লৈ
মনিপুরীরা ফুলকে "লৈ" বলে ডাকে।। প্রতিটি ফুলের মনিপুরী ভাষায় নিজস্ব নাম রয়েছে। প্রতিটি ফুলের পিছনে রয়েছে এক একটি অর্থ,কাহিনী এবং ইতিহাস।
গাঁদা ফুলের মনিপুরী নাম 'সানারৈ', পদ্ম ফুল 'থাম্বাল' , স্বর্ণচাঁপা ফুল 'লৈহাও’, জুঁই ফুল 'কুন্দলৈ',বাবলা গাছের ফুল 'চিগোংলৈ' ইত্যাদি অনেক সুন্দর নাম রয়েছে প্রতিটি ফুলের। মনিপুরী মেয়েদের সাথে ফুলের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। মেয়েদেরকে অনেকে 'লৈরাং' নামেও অভিহিত করে।
লৈ বা লৈরাং প্রতীকি শব্দ হিসেবে মনিপুরী সাহিত্যে মেয়েদেরকে নিয়ে অনেক কবিতা, গান রচনা করা হয়েছে।
প্রাচীনকালে ফুল (লৈ) দিয়ে নারীকে বিবাহিত-অবিবাহিত চিহ্নিত করা হত। প্রাচীন মনিপুরী দেবীদের থেকে শুরু করে আজো মনিপুরী মেয়ে-মহিলারা কানে ফুল অলংকরণ করে, একে বলে "নাচোম"। মনিপুরী ভাষায় এক লাইন না বললেই নয়- “ না দা চেল্লে হায়না নাচোম কোউরি" অর্থাৎ ইনা- ‘না’ হচ্ছে কান।এই নাচোম দুইভাবে পরা হয়। ১) বিবাহিত মহিলারা নাচোম ডান কানে রাখে। অর্থাৎ যে মহিলারা ডান কানে নাচোম পরে সে হচ্ছে বিবাহিত- এটি তার বিবাহের প্রতীক। বিবাহিত মহিলাকে মনিপুরীরা বলে "নুপী"।
২) অবিবাহিত মহিলারা নাচোম বাম কানে রাখে। অবিবাহিত মেয়েদের কাছে নাচোম বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অবিবাহিত মেয়েদেরকে মনিপুরীরা "লৈসাবী/চনু" বলে।

২৮/০৭/২০
ইঙেলৈ হচ্ছে একটি ফুল।মনিপুরী ভাষায়  প্রতিটি ফুলের নিজস্ব নাম রয়েছে এবং সে নামকরণের পিছনে ও রয়েছে গুরুত্ববহ অর্থ এবং ইতিহাস।আজকে ইঙেলৈ নিয়ে অজানা তথ্য তুলে ধরব।
মনিপুরী ভাষায় জুন/আষাঢ় মাসকে বলা হয় 'ইঙা' থা(মাস) এবং শ্রাবণ/জুলাই মাসকে বলা হয় 'ইঙেল'।এ ফুল 'ইঙা'(জুন) মাসে কলি এসে 'ইঙেল'(জুলাই) মাসে ফুটে।ইঙেল(জুলাই) মাসে এ ফুল ফুটে বলে এর নামকরণ হয়েছে 'ইঙেলৈ/ইঙেল্লৈ'। ইঙেলৈ ফুলের নামকরণের পিছনেও কিছু মনিপুরী মীথ কাহিনী রয়েছে বলে জানা গেছে।এ ফুল বাকিদের চেয়ে আলাদা হওয়ার পিছনে অনেক কাহিনী পাওয়া গেছে মনিপুরী ইতিহাসে।তাছাড়া এ ফুল নিয়ে মনিপুরী সাহিত্যে বিশেষ চর্চা রয়েছে।কবিরা এ ফুলের জীবনী নিয়ে কবিতা লিখেছেন এবং আজো মনিপুরী ফোক/লোক শিল্পীরা ইঙেলৈ ফুল নিয়ে গান গেয়ে চলেছেন। এ ফুল শুধুমাত্র পাহাড়েই ফুটে।তবে কালের বিবর্তনে এ ফুল খুব দুর্লভ এবং খুব কম সংখ্যক সমতল এলাকায় পাওয়া গেছে।ইঙেলৈ ফুল নিয়ে একটি কবিতার কিছু লাইন তুলে ধরলাম-
"চীংদা শাৎপী ইঙেলৈ
চিন্নদনা কেনখিবা
         কল্লকই দে।"
বাংলা অনুবাদ-
"পাহাড়ে ফুটে ইঙেলৈ
অজান্তেই ঝরে গেল
         হায় আফসোস"।
এ ফুল নিয়ে মনিপুরী মীথ/পুরানকল্পমূলক ২টি কাহিনী রয়েছে।আগামীতে সে কাহিনী দুটে আপনাদের সামনে তুলে ধরব

৬/০৮/২০


খাইদেম সিথি

ছবি, খাইদেম সিথির সৌজন্য।পেইন্টিং, খাইদেম সিথি।