ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Tuesday, December 1, 2020

মারাডোনা : কথা ও রুপকথা

।।তৃণা রাব্বানি।।অমিতাভ পাল।।চয়ন খায়রুল হাবিব।।


মারাডোনা : আঘনের রুপকথায়

প্রতিদিন দুলে বেড়াই সে ফুটবল দুনিয়াতে
যে ফুটবল মারাডোনাকে  দোলায়
গোলবারে গোল গোল গোল সোরগোল ভেদ করে
একটা মানুষের ইতিহাস আমাদের সবার ইতিহাসের মাঠে
বাংলার ধানক্ষেত ধেয়ে এলো বুয়েনস আইরেসের বস্তিতে

আউশ গতিতে ছুটে এলো আঘন মাসের কোলাহল
আমন ফুলে ফেঁপে ভাত আর ভাত ফুলে হলো ফুটবল

ব্রিটানির সাগরপারে গল্পের ভেতর গল্পের কল নেড়ে
ছেলে মাতিসের সাথে ২০১৯এর ভ্যান শহরে
দেখেছিলাম আসিফ কাপাডিয়ার মারাডোনা বায়োস্কোপ
বৃষ্টি পড়ছিলো সেদিন নাইন টেন টেলিস্কোপ

প্রাসাদে মহানরম পালঙ্কে মনে পড়ে গেলো : 
মাটি আর খড়ের কুড়েঘরে
কাঠের দরোজাওয়ালা প্রথম বাড়ি
সবকিছু বিক্রি হতো ওখানে সুই সুতা থেকে শুরু করে
ভাজাভুজির বাসনকোসনসহ তামাকের প্যাকেট
ভাঙ্গাচোরা রোয়াকে বসে দিনখাটা মজদুরেরা জটলা পাকিয়ে
মদ খেতো আর চাপাবাজিতে আসর মাতাতো

ঐ ভেল্কিবাজ চাপাবাজদের সবাই মারাডোনার চাচাচাচি মামামামি 
এমনসব ফুটবল খেলার বয়ান ওরা দিতো যেগুলো কখনো ঘটে নাই
কিন্তু সে খেলাগুলো স্বপ্নে দেখতে মুখিয়ে থাকতো ওদের সবাই 
বলার গুনে খেলাগুলো হয়ে উঠতো জীবন্ত সত্য
ছুটন্ত কামান গোলার মত
ছুটে আসছে অথচ দেখা যাচ্ছে না

মোজায় ভরা বল খেলতে খেলতে 
গল্পাচার্যদের বানোয়াট গুলতানি থেকে 
পিচ্চি মারাডোনা শিখতো না শেখার ভান করে
শুনতো না শোনার ভান করে 

তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো রাস্তা ধরে চলে যাওয়া
কচ্ছপগতির সে-সময়কার টি-মডেলের ফোর্ড মোটরযান
নিস্পৃহ গদাই লস্করি যাদুঘরের প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী
এখনকার পরিবেশখোর ধাবমান সময়ের মোটরগাড়ি থেকে একেবারে ভিন্ন

যেহেতু ঐ চাপাবাজদের কোনো টাকাকড়ি গাড়িবাড়ি ছিলো না
যখন ওর হাতে আসলো কল্পনাতীত টাকা
তা দিয়ে কি করবে সে আর বুঝতে পারলো না
আশা ভালোবাসার দোলাচল পথ খুজে পায় রূপকথার জাবরে

সাগরমত এক নদীর ধারে স্প্রিং এর চাবি আটা
পানের বাটা হাতে মনিমালা পায়ে পায়ে আগায়
ঢেউ এর পর ঢেউ ঢেউ চাঁদমাখা মুক্তামালা বিবিয়ানা
তাজা বাতাসের বৈঠকখানায় চিরস্থায়ী এখন রাজকুমার মারাডোনা

আউশ গতিতে ছুটে এলো আঘন মাসের কোলাহল
আমন ফুলে ফেঁপে ভাত আর ভাত ফুলে হলো ফুটবল

চয়ন খায়রুল হাবিব

২৫/১১/২০
ব্রিটানি, ফ্রান্স


যদি এই ম্যাচেই মারাদোনা আসে...

আমি ক্রিকেটের ভক্ত, টেনিসের মুগ্ধ দর্শক। ফুটবল আমাকে খুব একটা টানতো না। জীবনে একটা লাথিও দেইনি ফুটবলে, এমনকি পায়ের কাছে একটা ফুটবল চলে এলে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ যে কাজটা করবে, অর্থাৎ একটা লাথি মেরে বলটাকে প্রাপকদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া- সেটাও করতাম না। আমার মনে হতো, ফুটবল বর্বরদের খেলা, এটা কোন ভদ্রলোক খেলে না কারণ এতে শরীরী শক্তি লাগে এবং খেলতে গেলে গায়ে কাদামাটি লেগে যায়। তারপরও বিশ্বকাপ হাইপের কারণে এবং বন্ধুদের সাথে আলোচনায় পিছিয়ে পড়ার ভয়ে বিশ্বকাপটা দেখতাম। সেই দেখার ভিতরে ছিল ১৯৮৬র বিশ্বকাপটাও।

এই বিশ্বকাপটা আমার ফুটবল ধারণা বদলে দিয়েছিল প্রায় নব্বই ডিগ্রি। এর কারণ- এক ফুটবলারের অসাধারণ ক্ষমতা এবং নিয়ন্ত্রণ। সেইসাথে বুদ্ধির অপরূপ প্রয়োগে পুরা মাঠটাকেই সে বানিয়ে ফেলতো তার সাম্রাজ্য এবং মাঠের বাকি একুশজন হয়ে থাকতো তার বিহ্বল প্রজা। এই ফুটবলার- দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। এরপর থেকেই আমি মারাদোনার খবর রাখতে শুরু করি। নাপোলিকে একার ক্ষমতায় সিরি আ জেতানোর পরে ভাবতে বাধ্য হই- ফুটবল দলগত খেলা কেবল তাদের জন্য, যারা মোটামুটি খেলতে পারে বা মিডিওকার। জিনিয়াসরা একাই খেলে।

সেই থেকে আমি ফুটবল দেখতে শুরু করি এবং প্লাতিনি, রুদ গুলিত, জাঁ টিগানা, সক্রেটিস ও ফ্রান্সের প্রেমেও পড়ি। এদের স্কিল, তাৎক্ষণিক কিছু ঝলক, মরিয়া চেষ্টা আমাকে মুগ্ধ করতো ঠিকই কিন্তু মারাদোনাকে আর পাইনি কোথাও। পাওয়া সম্ভবও ছিল না। জীবনানন্দের কবিতা পড়ার পর যে ঘোরের সৃষ্টি হয় এবং অন্যদের কবিতাকে ঠিক সেই জায়গায় রাখা যায় না- এটাও ঠিক সেরকমই।

ফুটবলের দুনিয়ায় মারাদোনার তুলনা করার জন্য একজনকেই আমি খুঁজে পেয়েছি এতাবৎ। তার নাম জর্জ বেস্ট। দুজনেই একইরকম উন্মাতাল, দুজনেরই ফুটবল দক্ষতা অভাবনীয়, দুজনেরই একা দলকে টানার ক্ষমতা ছিল, আর ছিল নেশার টান। মারাদোনা একেবারেই আমাদের সময়কার নায়ক, যে হিপিদের শেষ প্রতিনিধি। হিপিরা দেশ, কাল, সীমান্ত- কিছুই মানে না, সমাজের সব নিয়ম ভাঙার জন্য তারা এক পায়ে খাড়া, তারা সমাজপতিদের মুখের ওপর কথা বলতে ভয় পায় না এবং তারা নিজেদের দক্ষতা ও ক্ষমতায় সেরা।

আর্জেন্টিনা দেশটাকে আমি ভালোবাসি দুইজনের জন্য। একজন মারাদোনা- যিনি আমাকে ফুটবল ভালোবাসতে শিখিয়েছেন, আর আরেকজন হোর্হে লুই বোরহেস- যিনি আমাকে ছোটগল্প ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। বোর্হেসের গল্পগুলিতে যে আর্জেন্টিনার পরিচয় আমরা পাই- মারাদোনা যেন ঠিক সেটাই, সেই বীর গাউচো- ঘোড়ার পিঠেই কাটে যার যুবক জীবন, তরুণীদের হৃদয়ে যে দোলা দিয়ে হারিয়ে যায় দূর দিগন্তে, এক ঢোকে শেষ করে ফেলে মদের গ্লাস, আর ছুরিযুদ্ধে ওস্তাদ। বোর্হেসের সাহিত্য যেন মারাদোনার ভবিষ্যতবাণী।

আমি এখনো ফুটবল ম্যাচ দেখতে বসলেই মারাদোনাকে খুঁজি। অবশ্য এরমধ্যে ফুটবল মাঠ দিয়ে গড়িয়ে গেছে অনেক ফুটবলারের ঘাম কিন্তু কৌতুহলের নৌকা কোথাও ভিড়াতে পারি নাই।তাই একটা ম্যাচ শেষ হলেই আরেকটা ম্যাচ দেখার আগ্রহ জাগে- যদি এই ম্যাচেই মারাদোনা আসে...

অমিতাভ পাল
২৬/১১/২০
ঢাকা

আমার মায়ের মারাডোনা


চাইকোভস্কির 'হাসের হ্রদ' ব্যালে দেখবার সময় দর্শকদের ভেতর ছেলেরা কি ব্যালেরিনার দেহবল্লরির দিকে আলাদাভাবে তাকায়?ভাবে কি, ইশ আমি যদি নর্তকের মতো আলতো ভঙ্গিতে হালকা তুলোর মতো ব্যালেরিনাকে শূন্যে তুলে নিতে পারতাম।
মারাডোনার ক্যারিয়ারের উত্যুংগ সময়ে আমি একেবারে বাচ্চা, পরে ইউটিউবে দেখতাম কিভাবে, বলটাকে ব্যালেরিনার মতো নাচিয়ে বেড়াচ্ছে, আর যখন গোল দিচ্ছে তা ফ্ল্যামেঙ্কোর আগুনঝরা ফিনালের ছুরিতে সবচেয়ে নরম ফ্রেঞ্চ পনির কাটার মতো।মারাডোনা হলো সুন্দরের ষাঁড় আর নন্দনের ময়ূর, পেখম মেলে ময়ূরীরা যার কাছে আপনাআপনি যায়।
আমার ভেতর ফুটবলারদের নিয়ে আসক্তি এসেছে মায়ের থেকে।পাড়ার লেডিস ক্লাবে মা ছিলো নাচের মাস্টারনি।মা ছিলো আবাহনীর সালাউদ্দিনের ভক্ত, বলতো, 'নাচলে খুব ভাল করতো, কি যে সব ভ্যাদামাছগুলো নাচ শিখতে আসে।' মহামেডানের মঞ্জু, নান্নুর জন্যেও মার কাতরতা ছিলো।বাবা ছিল পাড় জুয়াড়ি, আবাহনী মহামেডান সবকিছু ছিল বাজির বিষয়, পাড়ার মুদি থেকে ব্যবসার পার্টনার সবার সাথে বাজি ধরে বসে থাকতো।বাংলাদেশে তখন মাঝেমাঝে টিভিতে বড় খেলাগুলো দেখাতো, তওফিক আজিজের কমেন্ট্রি শুনে বিরক্ত হয়ে মা বলতো, 'না বোঝে নাচ,না বোঝে খেলা।'অন্য সময় বলতো, ' নাচের লোকগুলো খেলা বুঝলে, আর খেলার লোকগুলো নাচতে জানলে আমাদের নাচ আর খেলা দুটোই ভালো হতো।'

মা তার লাতিন ফুটবল রক্ত কোথায় পেয়েছিল আল্লা মালুম।হরিণ চামড়ার মোকাসিন পায়ে, ইজিপশিয়ান কটনের শার্ট গায়ে নানাজানকে অবশ্য ট্যানারিতে যাবার সময় পাড়ার বাচ্চাদের বল লাথাতে দেখতাম হরহামেশা।নানু সেই পুরানো শতভরি সোনার, রাশভারী গিন্নি।বাসার উঠানে বিশাল ফোর্ড।আমাদের খানদানে ছেলেমেয়েদের পাঠানো হতো ইংলিশ মিডিয়ামে, অল্প একটু পড়ে ছেলেরা চকের গদিতে, মেয়েদের বিয়ে বসিয়ে গিন্নি।এর ভেতর মা নাচ শিখে মাস্টার হয়েছে, মায়ের বান্ধবী পাইলট হয়েছে।এই শ্রেণির ছেলেমেয়েরা এখন ক্রিকেট ভক্ত হয়।মায়েদের সময়েও অনেক মহিলা ক্রিকেট দেখতে যেতো, স্টেডিয়ামে ফুটবল একেবারেই না, পাড়ার ফুটবলে অবস্য চেয়ার পেতে দেখতো।

মা কিভাবে ফুটবল পাগল হলো, আমি কিভাবে আমারি মায়ের পেটে আসলাম প্রশ্নের পর প্রশ্ন।নানাজান নানুকে বলতো, 'তোমাগো জামাইতো ট্যানারির ব্যাক্তের লগে জুয়া খেলে, নোয়াখাইল্লাগুলার লগেও।ট্যানারি চাঙ্গে।মাইয়ারে বানাইছো নাচনেওয়ালি।নয়া টাউনের মৌজ বাপ গেলে বুঝবো।' মাকে দেখা মাত্র নানার মুখে কুলুপ, পাইপে হাভানা টোবাকো টিপে বলতো, 'আবাহনী ক্লাবের চেয়ারম্যানরে কইছি, সালাউদ্দিনের লগে তোর দেখা করায়া দিব।' মায়ের ব্লাশ দেখে কে!

মারাডোনার মেয়েদের, বৌদের নিয়ে পার্টিবাজি দেখলে আমার বাবা মাকে মনে পড়ে।বাবা রাজনীতি বুঝতো কি না জানি না, এতো অবলিলায় ট্যানারি শ্রমিকদের সাথে জুয়া খেলতো যে শ্রেনী রাজনীতির অনেক নেতা তাতে অস্বস্তি বোধ করবে, করতো।মঞ্জরুল আহসান খান, মেনন ওনারাও ঢাকার পুরোনো পরিবারের।ব্রদার্স ইউনিয়ন, রহমতগঞ্জ, ওয়ারি, মহামেডান, আবাহনী ক্লাবে এসব পরিবারই কর্তা, এদের বৌ ঝিরাই ক্রিকেট মাঠে জাপানি পাখা দোলায়, ঢাকার সব লেডিস ক্লাবে ওনারাই গিন্নিবান্নি।এদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের বাসায় বসতে দেবে, ইউনিতে বন্ধু বানাবে তা এখনো ভাবা যায় না।একজন মারাডোনা তারকা হলে তা নিয়ে অবস্য খাতির জমিয়ে বলবে, লিখবে।আমিও লিখছি।

জিগাতলাতে নানাজানের ট্যানারির আশেপাশে শ্রমিকদের যেসব বস্তি ছিলো, বুয়েনস আইরেসে সে ধরনের বস্তিতে মারাডোনার জন্ম।বাদবাকিটা রুপকথা।আমার মা পরির মতো সেসব রুপকথায় উড়ে বেড়াতো।আমিও উড়ে বেড়াই।

তৃণা রাব্বানি
২৬/১১/২০
নিউজিল্যান্ড