ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Wednesday, December 2, 2020

তানিজাকি, পিকাসো, সুলতান : ফেটিশ, শুঙ্গা ও ট্রান্সন্জেন্ডার

শিল্পী সুলতানের মূল্যায়নে কেনো তারেক মাসুদের দৃষ্টিকোণ পরিহার জরুরী?

শিল্পী, এস, এম, সুলতান

।।কনক রহমান।।

সাহিত্য ও শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে  যৌন আবেদনের বিচিত্র দিক এ-আলোচনায় তুলে ধরা হয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মূল আলোচনায় এসেছে জাপানের সাহিত্যিক তানিজাকি, স্পেনের পেইন্টার পিকাসো এবং  বাংলাদেশের পেইন্টার সুলতান।আনুষঙ্গিক আলোচনায় এসেছে জাপানের কমিক্স শিল্পী নামিও হারুকাওয়া, মার্কিন পেইন্টার ক্যারলি শ্নিমান, বেটি টমকিন্স, ব্রিটিশ লেখক অস্কার ওয়াইল্ড, হানিফ কুরেশি ও মার্কিন ফটোগ্রাফার রবার্ট ম্যাপেলথর্প।বাংলা ভাষার সমকালীন চর্চায় যাদের কাজে এ জন্রেগুলোর ছাপ পাওয়া যাচ্ছে তাদের পাশাপাশি, বাংলা ভাষাতে এধরনের কাজের বাধাগুলো এবং বিভ্রান্তিকর নির্দেশনাগুলো কিভাবে তৈরি হয়েছে তার ওপরও আলোকপাত করা হয়েছে।

তানিজাকির ফেটিশ এবং নামিওর কমিক্স!

কাছের দেশ জাপানের মাঙ্গা, ফিল্ম, মূলধারার সাহিত্য যৌন ফেটিশে ভরপুর।জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্য পুরস্কার যার নামে, সেই জুনিচিরো তানিজাকির লেখালেখির পুরোটা যৌন ফেটিশ ঘিরে, আবার তার থেকে ব্রিটিশ হানিফ কুরেশি সহ পশ্চিমের অনেক লেখক প্রবলভাবে প্রভাবিত।আমাদের জাপান ফেরত শিল্পী, একাডেমিকেরা হয় এগুলো একেবারেই জানেন না বা লুকিয়ে রাখেন; ফুল, লতাপাতা, বসন্ত দিয়ে জাপান চালিয়ে দেন।

জুনিচিরো তানিজাকি

তানিজাকির আন্তদেশিও ও আন্তভাষিক প্রভাব বলয় খুঁড়লে দেখা যাবে তানিজাকি প্রভাবিত হয়েছে ব্রিটিশ লেখক অস্কার ওয়াইল্ডের কাজ থেকে, আবার পরে ব্রিটিশ লেখক হানিফ কুরেশি প্রভাবিত হয়েছে তানিজাকির কাজ থেকে।মার্কিন হেনরি মিলার, রুশি মার্কিন নাবোকোভ, ফরাসি জর্জ বাটাই, জা জেনে ও আনাইস নিনকে বলা যাবে একই ঘরানার লেখক।

তানিজাকিকে বুঝতে হলে ফেটিশ ব্যাপারটা বোঝা দরকার।অভিধানে ফেটিশের বাংলা : প্রতিমা, দেবমূর্তি, ভক্তির পাত্র, ভালবাসার ব্যক্তি, ভক্তিবস্তু।ব্যবহারিক প্রয়োগ বিচার করলে যৌন আগ্রহের বস্তু  বা অস্বাভাবিক যৌন বাসনার পাত্র / শব্দটা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় আসক্তি বোঝাতে।কোনো কোনো নারী পুরুষকে দেখা যাবে অন্যের পা ও পায়ের আঙ্গুল আদর করে পুরোপুরি রাগমোচন হয়ে যাচ্ছে, এটাকে ফুট ফেটিশ বলে।কেউ বিপরীত লিঙ্গের অন্তর্বাস শুকতে ভালোবাসে। ফিফটি শেডস অফ গ্রে সিনেমাটিতে বিডিএসএম (বন্ডেজ, ডমিনান্স, মাসোকিসম, স্যাডিসম) কেন্দ্রিক ফেটিশ দেখার সুযোগ পেয়েছে মূল ধারার সিনেমা প্রেমীরা।

কমিক্স, শিল্পী নামিও হারুকাওয়া

জাপানের ইরোটিক কমিক্সের নাম করা শিল্পী প্রয়াত নামিও হারুকাওয়া Namio Harukawa, তার নামের নামিও অংসটি নিয়েছে তানিজাকির উপন্যাস নাওমির নাম চরিত্রকে উলটিয়ে।তানিজাকির নাওমি উপন্যাসের প্রধান পুরুষ চরিত্র জুজির বয়স ২৮, পেশায় সে প্রকৌশলী, বনেদি ও বিত্তবান পরিবার থেকে আসলেও সনাতন সংস্কারের সাথে সে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলতে চায়।জুজি প্রেমে পড়ে ইউরেশিয়ান চেহারার ১৫ বছরের ক্যাফে পরিচারিকা নাওমির সাথে।নাওমিকে জুজি তার বাসায় এসে থাকা, পশ্চিমি কেতা কানুন শেখার ব্যাপারে রাজি করিয়ে ফেলে।কয়েক বছর পর ওরা বিয়ে করে।উপন্যাসের শুরুতে মনে হচ্ছে সব ঘটছে জুজির ইচ্ছাতে বা ডোমিনেশানে, কিন্তু ধীরে ধীরে ডোমিনেশানের পক্ষ বদলে যায়।জুজি ও নাওমি কখনো এক ঘরে ঘুমায় না, নাওমি তার ঘরে জুজির জ্ঞাতসারে অন্য পুরুষদের দেহসংগ দেয়।জুজি নাওমির সব আচরণে সুখী, কারণ নাওমি তার সাথে থাকছে এবং নাওমির বাসনাগুলো পূরণ করেই তার কামনা পুরোপুরি তৃপ্ত।নামিও হারুকাওয়ার আজীবন প্রকট যৌনতা নির্ভর আকাআকির মুল বিষয় ছিল, বিশালদেহী রমণীদের পুরুষ্ঠ পেছনের অংশে আসক্ত পুরুষ।ঘুরেফিরে য্যানো কমিক্স শিল্পী নামিও হারুকাওয়া এক বিপুল, পৃথুলা, রগরগে নাওমিকে এবং তার প্রতি আসক্ত, অনুগত জুজিকেই বার বার একে গিয়েছে।

পিকাসো এবং  শুঙ্গা আর্ট

জাপানি ভাষায় শুঙ্গা বলতে স্পষ্ট যৌন ছবি বোঝানো হয়, যা সাধারণত কাঠখোদাই ব্লক থেকে পরে স্ক্রলে এনে উপস্থাপন করা হয়।বসন্ত ঋতুকেও শুঙ্গা বা যৌনতার প্রতিশব্দ ধরা হয় জাপানে।শুঙ্গা আর্টে নারী, পুরুষ পুরোপুরি নগ্ন থাকে না, তাদেরকে দেখানো হয় ঐতিহ্যবাহী কিমোনো পোষাকে, কিন্তু সঙ্গমের আসনটিকে স্পষ্টভাবে দেখানোর পাশে যৌনাংগ খোলামেলাভাবে দেখানো হয়। 

রাফায়েল এবং লা ফোরনারিনা, পিকাসো

জীবনের শেষ প্রান্তে ৯০ বছর বয়সে পিকাসো যে রাফায়েল এবং লা ফোরনারিনা সিরিজটি আকে, তাতে জাপানের এরোটিক শুঙ্গা শিল্পের প্রভাব সুস্পষ্ট।অথচ সারা জীবন পিকাসো জাপান তথা পূবের শিল্পধারাগুলোর প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করেছে।পিকাসোর প্রেম ছিলো আফ্রিকার শিল্পধারার প্রতি এবং তাকে স্বীকৃতি দিয়ে পিকাসো নিজস্ব ঢংয়ে আফ্রিকার মুখোশ শিল্পকে ভাংচুর করে তৈরি করেছিল কিউবিস্ট শিল্প।


বামে বসা গার্ট্রুড স্টেইন, পাশে দাঁড়িয়ে পিকাসো

তরুণ পিকাসো প্রথমবার গার্ট্রুড স্টেইনের সাথে দেখা করতে গেলে স্টেইনের ছোট ভাই লিও পিকাসোকে তার সংগ্রহ করা জাপানের কাঠখোদাইগুলো দেখায়।পিকাসো গার্ট্রুডকে বলে যে তার ছোট ভাই অত্যন্ত অমায়িক এবং তাকে পিকাসোর ভালো লেগেছে।তার পরক্ষনে পিকাসো বলে যে আমেরিকানদের সাথে দেখা হলেই তারা জাপানের আর্ট দেখায়, তার জাপানি আর্ট ভালো লাগে না।এখানে মাতিসের সাথে পিকাসোর পার্থক্য।মাতিসের জন্য জাপানি শিল্পধারার সুষমা ও শান্তভাব অনুকরণীয় হলেও, পিকাসোর লাতিন মানসের আরাধ্য ছিল জান্তবতা এবং আফ্রিকার শিল্পধারায় পিকাসো সে প্রবল জৈবিকতাকে খুঁজে পেয়েছিল।তবে পিকাসো একসময় শুঙ্গা আর্ট সংগ্রহ শুরু করে।

পিকাসো

উনিশ শতকের ইয়োরোপে ও এমেরিকায় মূলধারায় শিল্প সংগ্রাহকেরা ব্যাপকভাবে জাপানি শিল্প ধারার প্রদর্শনী করতে থাকে।পিকাসো কোনো ধারাকে পুরোপুরি অনুকরণ করে নাই, বরং কোনো কিছুকে মূলধারাতে আদরণীয় হতে দেখলে তা থেকে সরে গেছে।২০১০সালে বার্সিলোনার পিকাসো যাদুঘরে, পিকাসোর সংগ্রহ করা শুঙ্গা আর্ট নিয়ে একটি প্রদর্শনী হয় যার শিরোনাম ছিল, Secret Images, Picasso and the Erotic Engravings of Japan’। ঐ প্রদর্শনীতে পিকাসোর বিভিন্ন  কাজ ও বিখ্যাত শুঙ্গা আর্ট পাশাপাশি দেখানো হয়।

জাপানের শুঙ্গা এরোটিকা, আফ্রিকার জান্তব মুখোশ, পর্নোগ্রাফি সবখান থেকে পিকাসো নিয়েছে এবং তারপর সেক্সকে নিজস্ব ভঙ্গিমায় তুলে ধরেছে পিকাসো।এই তুলে ধরার রাসায়নিক প্রক্রিয়াতে তার অধীত বিষয়দের যে দফারফা হয়েছে তা বোঝা যায় পিকাসোর মৃত্যুর পর তার মডেল, বিখ্যাত ফটোগ্রাফার ডোরা মারের মনোবিশেষজ্ঞ জ্যাক লাকা'র শরণাপন্ন হওয়াতে।এ বিষয়ে কবি ও নাট্যকার চয়ন খায়রুল হাবিব বিশদভাবে লিখেছে।আমার এখানে বলার এটুকু একজন ডোরা মারকে যেভাবে পিকাসো কিউবিক ত্রিভুজে কাটাছেড়া করেছে, সেরকম শুঙ্গার প্রকরণকেও কাটাছেড়া করে পৌঁছেছে যৌনতার নিজস্ব রেখাচিত্রে।অনেক সময় মনে হয়েছে অক্টোপাসের অনেক শুঁড়ের মতো পিকাসোর ছবির আদলে যৌন আসন করতে হলে অনেকগুলো হাত, পা, মাথা, যৌনাঙ্গ দরকার।

সুলতানের ট্রান্স জেন্ডার উন্মোচন  

সুলতানের কাজ দেখা ও বোঝার ক্ষেত্রে তারেক মাসুদ নির্মিত প্রামাণ্য চিত্রটির দৃষ্টিকোণ পরিহার আমাদের জন্য কেনো জরুরী, এখানে তাতে আলোকপাত করেছি।বাংলাদেশের বেশির ভাগ শিল্পী বিমূর্ত কাজ করেন।যারা ফিগারেটিভ মূর্ত কাজ করেন তারাও বেশির ভাগ সময় বাস্তব বা রিয়ালিজমের জায়গা থেকে কাজ করেন।সুলতানের কাজ কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ফিগারেটিভ, বিশেষ করে অতিরঞ্জিত যৌন আবেদনময় শিল্প ধারার যে বিকাশ হতে পারতো, তার কাজকে ডগমার জায়গা থেকে দেখানোর ফলে তার ধারাবাহিকতা বা পরম্পরা এবড়োখেবড়ো হয়ে গিয়েছে।

শিল্পী, সুলতান

সুলতান যে মানস পর্যটন থেকে তার অতিরঞ্জিত, পেশিবহুল, যৌন আবেদনময় চরিত্রদের ক্যানভাসে আনেন, তার সাথে আমাদের গন আহরিত নান্দনিকতা মিলবে না।অথচ সুলতানকে নিয়ে যারা কাজ করেছে তারা গনরাজনীতির আলোকে সুলতানকে দেখাতে চাচ্ছে।আমাদের পপুলার কাজগুলো সচেতনভাবে হয় বিমূর্ত, নয় অযৌন কিম্বা অযৌনভাবে বিমূর্ত।জাফর  ইকবালদের ধরি মাছ না ছুঁই পানি ধরনের ক্লীবলিংগবোধক সাইফাই আসলে নীতিশাস্ত্র, চালানো হচ্ছে সাইফাই বলে।আমাদের যারা ম্যাজিক রিয়ালিজম শৈলী হিশেবে অনুশীলন করেছেন, তাদের চরিত্রগুলো অযৌন এবং ঘুরে ফিরে সেই নীতিশাস্ত্র, ফলে যাদু-টোনাতেও টুপি, অজু, চরণামৃতের ঘোলা পানি।মেঠো ভাষায় বলতে গেলে, মাল মাথায় ওঠা যে হুমায়ুন আহমেদ কিশোরী শাওনকে ফুসলিয়ে ফেললেন, তাকে ঘিরে সিনেমায় ইরফান খানকে মনে হলো অবসাদের রোগী।তারপর তাদের ছোট ভাই আহসান হাবিবের কার্টুন, সেগুলোতে হাত পা থাকলে কি না থাকলেই বা কি, স্যাটায়ারের এক মাত্রিকতা সেগুলো ছাড়াতে পারে না।

শিল্পী, সুলতান

সুলতানের আকা চরিত্রগুলোর মুখ, বুক, পেট, হাত, পা সব জ্যান্ত, পেশল ও যৌনতায় ভরপুর।সে চরিত্রগুলোর সেক্স আপিলে মুগ্ধতার পাশাপাশি তাদের কাহিনী জানতে ইচ্ছে করে।কে বলে সেক্স আপিল দিয়ে বুদ্ধির তারিফ করা যায় না।আমাদের প্রিয়ভাজন তারেক মাসুদ ও নাসির মামুন দুজনেই এখানে রক্ষণশীল থেকেছেন, তাদের ভালো, মন্দ, গনমানুষ ইত্যাদি জায়গা থেকে আলো আধারিতে সুলতানের ছবি তুলেছেন।কিন্তু যে সুলতান বাঙ্গালির দেহছন্দকে আলোআঁধারির বাইরে এনে বাইরে এনে প্রবল যৌন আবেদনের জায়গা থেকে দেখিয়েছেন, তা ধরবার সেলুলয়েড, লেন্স নাসির মামুন ও তারেক মাসুদের নেই।এরা বিখ্যাত হয়েছে বলে এদের দেখাটাকে শেষ দেখা বা পুর্নাংগ দেখা বলে ভাবলে, বডি ল্যাঙ্গুয়েজের আড়ষ্ঠতা ভাংতে আমাদের মাওলানা ভাষানির শরণাপন্ন হতে হবে।

ভাষানির রাজনীতি এবং সুলতানের শরীরী উদ্ভাসন, উন্মোচন পুরোপুরি বিপরীত মেরুর ব্যাপার।নাসির মামুন ও তারেক মাসুদের সুলতান পর্যবেক্ষণে যে শুধু পুর্নাংগতার অভাব আছে তা নয়, তাদের দুজনের সুলতানকে এবং তার কাজকে দেখানোর জায়গাটা আমার দেখাতে ভুল।এদের দুজনের জায়গা থেকে সুলতান ও তার কাজকে কেউ দেখা শুরু করলে, একটা স্যানিটাইজ দৃষ্টিকোণ তৈরি হবে।সুলতানের শরীরী সেক্সুয়াল এক্সপোজারের পুরোটা সামাজিক স্যানিটাইজেশানের বাইরে।

সুলতানের নিজস্ব ট্রান্স-জেন্ডার আচরণ ও তার আকা চরিত্রদের ট্রান্স-জেন্ডার অবয়ব আমাদের সমঝদারেরা তাদের রক্ষণশীলতা থেকে এড়িয়ে গেছেন।নাসির মামুন সুলতানকে দেখিয়েছেন আলখাল্লা পরা, বাঁশি বাজানো, কুপি জ্বালানো এক মিস্টিক হিশেবে।আর তারেক মাসুদ সুলতান ও সুলতানের কাজকে কি চোখে দেখেছেন, তা তারেক মাসুদের লেখনীতে পড়া যাক, ''সুলতানের বাংলাদেশ পল গগ্যার তাহিতি নয়।সুলতানের নারী শিল্পীর নয়, কৃষকের স্বপ্নের নারী।গগ্যা যেখানে তাহিতির নারীদের আদর্শায়িত করেছেন, তেমনই সুলতান সমগ্র কৃষিসমাজকে মহিমান্বিত করেছেন।''(তারেক মাসুদ, আদম সুরত, বেঙ্গল প্রকাশনা, ২০১১, পৃষ্ঠা ১২।)

তারেক আগে থেকে যে একটা দৃষ্টিকোণ তৈরি করে, তারপর সুলতানের কাজকে দেখেছেন তা শুধু নয়, সে দৃষ্টিকোণের ভেতর কিছু ডগমা যে কাজ করেছে তা বোঝা যায় একই পৃষ্ঠায় তার লেখা পরের প্যারাতে, ''তথাকথিত উন্নয়নের দৌড়ে পিছিয়ে পড়া একটি কৃষিপ্রধান দেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সুলতানের জীবন ও কর্ম প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে' ধরনের লাইনগুলো পড়লে।চিত্রনির্মাতা অবশ্যই লেখক নন, তারেক মাসুদ থেকে প্রাঞ্জল লেখনী আমি আশা করছি না।আবার তার লেখাটিকে ব্লা ব্লা ব্লা চর্বিত চর্বণ বলে উড়িয়ে দিতে চাইছি না।উনি কিভাবে, কোথা থেকে সুলতান ও তার কাজকে দেখেছেন, তা সৎ ভাবে আমাদের জানিয়ে গেছেন।এবং তার জন্য আমাদের ধন্যবাদার্হ।সুলতানের কাজকে কেউ এখন সুলতানের জায়গা থেকে দেখতে হলে  তারেকের দেখার জায়গাটি কেনো বাদ দিয়ে দেখতে হবে, তা বলছি নিচে।

মূলত তারেকের দেখার জায়গাটি একটা ধারনাকে আরেকটা ধারনা দিয়ে জায়েজ করবার জায়গা, এটা বিষয়কে উদ্ঘাটন না করে তার ওপর প্রলেপ তৈরি করে, এখানে ব্যক্তি গৌণ হয়ে পড়ে।তারেকের এ দৃষ্টিকোনটি আরো বিস্তৃতা হয়েছে তার 'মাটির ময়না' ছবিতে, যেখানে উনষত্তরের গন আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিসহ সম্পর্কের টানাপোড়েনগুলো উনি দেখছেন এক মাদ্রাসা বালকের দৃষ্টিকোন থেকে।ছবিটিতে দৃষ্টিকোন ক্যামেরার লেন্স হয়ে যায় এবং বালক চরিত্রের চেয়ে বেশি প্রকট হয়ে পড়ে, এপোলজিস্ট এবং রিভিশনিস্ট ধারাবর্ণনার ফ্রেমে চরিত্রটি আর খুলতে পারে না।   

শিল্পী সুলতান। ফটো, নাসির আলি মামুন

সুলতানের নারী, মাঝি, কৃষক, জেলে একান্তভাবে সুলতান নামের শিল্পীর মনোগত ভীষণ বা ঈক্ষণ থেকে তৈরি।সুলতানের নারী আবশ্যিকভাবে শিল্পীর নারী এবং তার আয়ত্তাধীন শিল্প শৈলী দিয়ে তৈরি।সে শিল্প শৈলীতে কৃষিপ্রধান সমাজকে মহিমান্বিত করবার চেয়েও বেশি কাজ করেছে, যে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দিয়ে আমরা সেক্সুয়াল আপিল বিবেচনা করি, সে অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোকে হাইলাইট করবার ক্ষেত্রে।এখানে সুলতানের তুলিতে কোনো আড়ষ্ঠতা, সামাজিক শর্ত কাজ করে নাই।পেশিবহুল, পুরুষ্ঠ নারী, পুরুষদের পোশাক হিশেবে সুলতান যেটুকু সাংস্কৃতিক শর্ত পালন করেছে, তাকে মঞ্চের ভাষাতে প্রপসের বেশি কিছু বলা যায় না, সে প্রপসও ব্যাবহার করা হয়েছে হাইলাইটেড প্রত্যঙ্গগুলোকে আরো আবেদনময় করতে।সুলতান যখন বন্যা আক্রান্ত জনপদ আঁকছেন, তখনো নদীতীরে জমায়েত পেশিবহুল নারীপুরুষ য্যানো এলিয়ে, হেলিয়ে গরম ঝর্নার জলে স্নান করছে, বাইরের প্রপস সরিয়ে নিলে তাকে হামামখানা বলে চালিয়ে দেয়া যাবে।একজন বলতে পারে, ভাই আপনার চোখ শুধু ঐসবই দেখে।কিন্তু সুলতানের কাজে তার চরিত্রদের রক্ত, মাংস, পেশি, দেহজ আবেদন সরিয়ে দিয়ে আর্থসামাজিক কাঠামোকে সামনে নিয়ে আসলে, সেটা ওয়াইনের বোতলে রুহ আফজা চাখার সামিল, তাতে ওয়াইন ও রুহ আফজা দুটার প্রতি অন্যায্যতা দেখানো হয়।

পরিশিষ্ট

তানিজাকির ফেটিশ, পিকাসোর শুঙ্গা কাতরতার ধারাবাহিকতায় দেহজ্জ যৌনতার সরাসরি ভাষাতে পরবর্তীতে  এমেরিকায় আমরা পাচ্ছি আলোকচিত্র শিল্পী রবার্ট ম্যাপেলথর্প, পেইন্টার ক্যারলি শ্নিমান, বেটি টমকিন্সকে।ষাটের দশকে ম্যাপেলথর্পের সাদোমাসোকিস্ট মডেলদের নগ্ন বা যৌন উস্কানিমূলক ছবি এমেরিকার গ্যালারিগুলো ও সমালোচকেরা বরন করে নিলে একই সময় বেটি টমকিন্সের পর্নোগ্রাফিক ব্লো আপ স্কেচগুলো থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নেন।বেটি টমকিন্সের বয়স এখন ৭৫, প্রায় ৫০ বছর আগের তার যৌন আবেদনময় কাজগুলোকে এখন সমালোচকেরা যৌনতা এবং জেন্ডার উভয় দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে।

বেটি টমকিন্স

প্রামাণ্য চিত্র নির্মাতা, ফটোগ্রাফার, রিভিউকার হচ্ছে সেকেন্ডারি সৃজনশীলতা, এ জায়গাতে যদি পূর্ব নির্ধারিত তত্ব বা ধারনা শর্ত হয়ে যায়, তাহলে বিষয়ের উপস্থাপনায় আপোষ করা হয়।কিছুদিন আগে বাবলী হকের অষ্টপ্রহর নভেলার রিভিউ করতে গিয়ে সুমী সিকানদার একই কাজ করেছেন, নভেলাটির শক্তি যেসব চরিত্রদের যৌন আচরণের জায়গাতে সে জায়গাগুলো উনি পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন।এড়ানোর জায়গা থেকে শক্তিশালী রক্ষণশীল ধারার তৈরি হতে পারে, বাম ও ডান দুই ঘরানাতেই।ফ্রান্সে জর্জ বাটাই, আপোলিনেয়ার, আনাইস নিন, এমেরিকাতে হেনরি মিলার, নাবোকোভ, ইটালিতে মোরাভিয়ারা যখন খোলামেলাভাবে লিখতে থাকলেন এবং তা মূলধারায় ব্যাপকভাবে পাঠ শুরু হলো, তখন চার্চ কেন্দ্রিক রক্ষণশীল লেখকেরা যেরকম তাদের চরিত্রদের আবেগের লেনদেন ঈশ্বরের সাথে প্রতিশ্রুত পাপ, পুণ্যে বেধে নবযোশে লিখতে থাকলেন, সেরকম মার্ক্সবাদীরা তাদের চরিত্রদের বেধে ফেললেন শ্রেণী সংগ্রামের নিক্তি পাল্লায়।পাস্তেরনাকের মতো যারা দুই ঘরানার কোনোটাতে থাকতে চাইলেন না তাদের ওপর নেমে এলো নিষেধাজ্ঞার জোয়ার।

বিভিন্ন ধর্মের কট্টরদের সেক্স নিয়ে বিধিনিষেধ তো আছেই, তার সাথে আছে কথিত প্রাগ্রসরদের সেক্স নিয়ে ছোটলোক, বড়লোক, শ্লীলতা, অশ্লীলতা। যৌনতা আসলে একটা বিপুল, বিচিত্র রান্নাবান্নার আলা কার্তে মেনু, সেটাকে কার্পেটের তলে, পর্দার আড়ালে নিতে নিতে উপমহাদেশের যৌন ভাষা মলিন হতে হতে এখন শুধু প্রজনন ও ধর্ষণের আলাপে কেন্দ্রীভূত।ফেসবুকে জুলেখা সিরাপ গ্রুপের ২০২০ সালতামামি ওয়েবজাইন তরঙ্গের ঘোষণাতে দেখলাম, সেক্স সাইফাই ও সাইকোসেক্স জন্রেতে তৃণা রাব্বানি, অমিতাভ পাল ও চয়ন খায়রুল হাবিবের লেখা নেয়া হয়েছে।ওনাদের লেখা আগে পড়েছি, বিচিত্র বিষয়ে লেখেন তিনজন।আসলে ব্যাপক পাঠক ও কম পাঠক পাওয়া দিয়ে কথা নয়।একটা কিছু পড়ে, তার থেকে আরেকটা কিছুকে দেখার পথ পাওয়া হচ্ছে ঘটনা।যারা ব্যাপকভাবে আলোচিত, পঠিত তারা যদি সুলতানসহ বড়, ছোটো আরো অনেকের দেখার বা বোঝার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ান, তা আমাদের সরাতে হবে।আর্ট ফর আর্টস সেক বা কলা কৈবল্যের কথা বলছি না, কিন্তু শিল্পকে বোঝার জন্য, উপভোগের জন্য রাজনীতি, ধর্ম, তত্ব ভালো লেন্স হতে পারে না, যখন এগুলো আমাদের দেহের ও মনের ভাষাকে আড়ষ্ঠ, অবসাদগ্রস্ত করে ফেলছে। 

শুধু যৌনতা একঘেয়ে ব্যাপার।পর্নোগ্রাফি ব্যাবহারিক রাগমোচনে আবশ্যিকভাবে সহায়ক।কিন্তু যৌনতা নির্ভর শিল্প ব্যাবহারিকতার বাইরে দেহকে এমন সীমান্তে নিয়ে যায়, যেখানে মন তার প্রথাশাষিত অবসাদগুলো ছুড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যায়।  

প্রায়োগিক মজাদার, উদ্ভট, উৎকট কিম্বা হুবহু যেভাবে ঘটে সেভাবে উপস্থাপনার দিকে তাকিয়ে আমরা নিজেদেরকে দেখতে পাই নিজেদের ছাড়িয়ে।


কনক রহমান
২৬/১১/২০
নরওয়ে

সম্পাদকীয় সংযুক্তি :