ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Saturday, February 13, 2021

জজ সাহেবের টেরি মাইয়া পেখম মেইলাছে!

ঢাকা শহরের গল্পগাঁথা, কবিতাকথা : 

ইয়ে কালুম্বো সাহিব কা মাকবারা, কাম্পানিকা নাউকার!

।।লুবনা ইয়াসমিন।।

নাগাফোন ঘাট, নারিন্দা, ঢাকা, ১৭৮৭।ইয়োহান ইয়োফানির আকা কলুম্বো সাহিবের স্মৃতিসৌধ ।
নাসরিন-জয়া বলেছে, তরঙ্গে লিখতে।পেটের দায়ে কাজ করছি ঢাকাতে শিল্পাঞ্চল বিকাশ নিয়ে।২০২০এ, কোভিড এর জন্য আর যাওয়া হয় নি, জুম দিয়ে সেরেছি।বেরসিক উপাত্ত, পরিসংখ্যানে ঠাসা কাজ।ফাকে ফাকে পড়ছি ঢাকা নিয়ে লেখা পুরনো বই পত্র।সেসব মিলিয়ে তরঙ্গে যা দেবো, তার শিরোনাম হবে, জজ সাহেবের টেরি মাইয়া পেখম মেইলাছে!একটু আগোছালো লেখাটিতে প্রথমবার অল্প করে লিখছি ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার উদ্ভব,  জার্মান নিও ক্লাসিকাল পেইন্টার ইয়োহান ইয়োফানির ১৮ শতকের ঢাকা ভ্রমনের সময় আকাআকি, কালুম্বো সাহিবের মাকবারা বা স্মৃতিসৌধ এবং রমনা পার্ক ও রমণের সম্পর্ক নিয়ে।

ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট ডিকসন, 
কলুম্বো সাহিবের স্মৃতিসৌধে, 
নারিন্দা ৩০/১০/২১
নারিন্দাতে কলুম্বো সাহিবের  স্মৃতিসৌধ এবং  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর অবস্থিত পুরানো শিব মন্দিরের দুরবস্থা থেকে বোঝা যায় ঢাকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষায় কোনো সচেতন উদ্যোগ নেই আরেকটি ব্যাপার, চারুকলার ডিন বা কবিতা পরিষদের প্রভাবশালী সদস্য বা একজন আমলাকে যাদুঘর, লোক সংস্কৃতি কেন্দ্র এসবের মহাপরিচালক করা ঠিক কি না!এসব রক্ষায় ধারাবাহিক প্রশিক্ষণকে কোনো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না তার প্রমাণ মেলে  একে তাকে দাঁড় করিয়ে ফোকলোর, বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেয়ার ভেতর।সাধে কি আর পশ্চিমি রিয়েল এস্টেট ব্যাবসায়ীয়া দেশি মালদার ভাইদের ভালো বিল্ডিং বেচতে চায় না!এটাতে কোনো বর্ণবাদ নেই।

যে একটা ছোট টু পাইস হোটেল পরিচ্ছন্ন রাখতে পারে, সে প্রাচীন সম্পত্তিও ভালো রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে এবং তার মূল্য বাড়াতে পারে। রানা প্লাজার ধ্বস আর কলুম্বো সাহিবের স্মৃতিসৌধের মর্মান্তিক অবস্থা পাশাপাশি দেখলেই আমরা বুঝতে পারি ঢাকার রিয়েল এস্টেট দর যে পড়ে যাচ্ছে এবং অদক্ষ শ্রম আরো সস্তা কেনো হচ্ছে!

ঢাকাই কোলাজ 
শামসুর রাহমান কুট্টি বুলিতে লিখেছেন, এই মাতোয়ালা রাইতে, তা ছাড়া তার কৈশোরের ঢাকা নিয়ে লিখেছেন স্মৃতির শহর।রবিউল হুসাইন কবিতার ঢাকা বইতে ছাদ পিটানির পুরনো গান তুলে দিয়েছেন, যেখান থেকে আমার শিরোনাম ধার করেছি।চয়ন খায়রুল হাবিব অহরহ তার কবিতায় ঢাকাই অনুষঙ্গ নিয়ে মনোরম যথেচ্ছাচার করেন।কবিদের বাইরে নাজির হোসেন, চার্লস ডয়লি, সরদার ফজলুল করিম, এস, এম তাইফুর মুনতাসির মামুনসহ অনেক গবেষক পেশাদার ও শৌখিন ভাবে ইতিহাসের ঢাকাকে উলটে পালটে দেখেছেন।ঢাকা নিয়ে মেয়েদের লেখা খুব কম।কিভাবে এটা বলা যাবে?জেনানা, রমণী, মাতারি, নারী, মেয়েছেলে, মাইয়া, মাগি, রান্ডি, ছেমরি ঢাকাই তথা দেশি বাংলায় মেয়েদের সম্বোধনসূচক নাম কম না!প্রিয় কবি শামসুর রাহমান লিখেছে,
'রাইতের লগে দোস্তি আমার পুরানা,
কান্দুপট্টির খানকি মাগীর চক্ষুর কাজলের টান
এই মাতোয়ালা রাইতের তামাম গতরে'

ঢাকা নিয়ে মেয়েদের লেখা খুব কম।শিল্পাঞ্চল হিশেবে ঢাকার মূল চালিকাশক্তি গার্মেন্টস এবং সে হিশেবে এর হৃৎস্পন্দনের মূলে আছে মেয়েরা।ঢাকায় যেরকম ছাদ পিটুনির মেয়েদের নিয়ে কোনো ছবি নাই, পেইন্টিং নাই, সেরকম গার্মেন্টসের মেয়েদেরও ঢাকার শিল্পীরা, ফটোগ্রাফারেরা পাতে তোলে নি।যা কিছু ছবি তা ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির ছবি।নাসরিন-জয়া কিছুদিন আগে তরঙ্গের জন্য সম্পাদকীয়তে অভিযোগ করেছে, 'বাংলাদেশে কোনো শিল্পধারা দাড়ায় নাই কেনো'?দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প নগরীতে যদি সৃজনশীলেরা তাদের আর্থিক বুনিয়াদের মেরুদণ্ড ও ধমনিকে না নিয়ে বিমূর্ততা, স্লোগানের দ্বিমাত্রিকতা এবং ইন্টেলেকচুয়াল মৌলবাদে চলে যায় সেখানে আর শিল্পধারা দাঁড়াবে কি করে?এসবের ভেতর ঢাকা নিয়ে নারী লেখিকা পেয়েছি হাফিজা খাতুন, মন্দিরা ভট্টাচার্যকে।তরঙ্গে আমার জজ সাহেবের টেরি মাইয়া পেখম মেইলাছে আপডেটগুলোতে এই পরীবিবি, খনি বেগমদের নিয়ে বলতে বলতে কিভাবে ইয়োহান ইয়োফানির আকা শান্ত ঢাকা গড়াতে গড়াতে হয়েছে ৫২র ঢাকা, ৭১এর ঢাকা, স্বৈরাচার বিরোধিতার ঢাকা, শাহবাগ আন্দোলনের ঢাকার গল্প ধরবার চেষ্টা করবো।

সৈয়দ মোহাম্মদ তাইফুর ও পরিবার
কুট্টি ভাষা এলো কোথা থেকে
কুট্টি ভাষা নিয়ে লিখবার আগে Glimpses Of Old Dhaka'র লেখক সৈয়দ মোহাম্মদ তাইফুর এবং Dhakaiyas On The Move এর লেখিকা অধ্যাপিকা হাফিজা বেগম সম্পর্কে একটু বলে নিতে হয়।তাইফুর ও হাফিজা কুট্টি  ভাষায় বলতে হলে, দুই জমানার মানুষ।

তাইফুরের জন্ম ঢাকার কাছাকাছি সোনারগাঁয়ে  ১৮৮৫সালের তেসরা জুন।ওনার বাবা ছিলেন সোনারগাঁয়ের জমিদার। পড়াশোনা ঢাকা ও কোলকাতার মাদ্রাসায়। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি, উর্দু, ফার্সিতে তার ভালো দখল ছিল।উনিশ শতকের শুরুতে  সরকারি সাব রেজিস্ট্রার পদে যোগ দেন এবং ১৯৪২ সালে  অবসর নেন।অবসর নেবার আগে তাকে খান সাহিব উপাধি দেয় রাজ সরকার। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সমর্থন প্রকাশ করে তিনি এই উপাধি বর্জন করেন।পরে ঢাকা ইডেন মহিলা কলেজ, জগন্নাথ কলেজের পরিচালক পদে কাজ করেছেন এবং ঢাক উন্নয়ন ট্রাস্ট ও ঢাকা যাদুঘর ট্রাস্টের সদস্য ছিলেন ।ঢাকা যাদুঘরকে তিনি প্রায় ২০০ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দান করেন। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত Glimpses Of Dhaka  বইতে তিনি  Dacca ব্যাবহার না করে Dhaka ব্যাবহার করেন।স্ত্রীর নাম সারা তাইফুর।তিন মেয়েকে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ করে দেন, যাদের ভেতর লায়লা আর্জুমান্দ বানু সুখ্যাত গায়িকা ছিলেন।

হাফিজা খাতুন (শীর্ষ ডান) 
তার মায়ের সাথে (বেগম ফয়জুন্নেসা কবিরউদ্দিন), 
ছোট ভাই (আবু মনজুর মোরশেদ), 
বড় ভাই আবু রায়হান মাহমুদ, 
সেক্টর ৩ এর মুক্তিযোদ্ধা, ছোট বোন হামিদা শিরিন, 
বড় বোন অধ্যাপক হাবিবা খাতুন।
ছবি : আবুল হাসান মাসুদ, ১৯৭২
এবার হাফিজা খাতুনের কথা বলা যাক।পুরাতন ঢাকার ধোলাই খালের তীরে, বংশাল এলাকায় হাফিজা খাতুনের জন্ম  জন্ম জুলাই ১২, ১৯৫৪)ও বেড়ে উঠা। মওলানা কবিরউদ্দিন রহমানী এবং বেগম ফয়জুন্নেসার দশ ছেলেমেয়ের মধ্যে হাফিজা  সপ্তম এবং মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ । ২০০০ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের একজন অধ্যাপক। তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন, পরে ১৯৮৬ সালে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন।

হাফিজা খাতুন তার প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছেন পুরান ঢাকার মালীটোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে, মাধ্যমিক শিক্ষা কামরুন্নেসা সরকারী মহিলা বিদ্যালয় এবং উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেছেন ঢাকা সরকারী মহিলা বিদ্যালয় (বর্তমানে বেগম বদরুন্নেসা সরকারী মহিলা বিদ্যালয় ) থেকে ।হাফিজা খাতুন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের প্রথম ব্যাচের একজন ছাত্রী । তিনিই প্রথম  যিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তথা ভূগোল বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী যে কিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষদ হিসাবে নিযুক্ত হন । তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ক্রীড়াবিদ এবং প্রথম মহিলা ব্লু (Blue)।

হাফিজা খাতুন ১৯৭১ সালে তার ভাই আবুল হাসান মাসুদের সেক্টর -৩ এর অধীনে সিলেট ফ্রন্টে সম্মুখ  যুদ্ধে লড়াই করেছেন এবং আবুল হাসান মাসুদ সেক্টর -২ এর আওতাধীন ঢাকা মহানগরীর কোতয়ালী থানা বংশাল অঞ্চলের গেরিলা কমান্ডার ছিলেন। তার  পৈতৃক নিবাস ‘৩৭, হাজী আবদুল্লাহ সরকার লেন বংশাল ছিল (মাসুদ বাহিনীর) গেরিলা ইউনিটের কেন্দ্র। তিনি ও তার অন্যান্য ভাইবোনেরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার, ঔষধ সরবরাহ, প্রাথমিক চিকিৎসা , বার্তা প্রেরণ, তাদের লুকিয়ে রাখা এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গয় অস্ত্র বহন করা ইত্যাদি কাজে জড়িত ছিলেন। ডঃ হাফিজার দুই মেয়ে, এক ছেলে এবং ছয়জন নাতি – নাতনী ।

এবার আসি ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার কথায়।তাইফুর ও হাফিজার ভাষ্যের সাথে হাকিম হাবিবুর রহমানের ঢাকা, পাচাশ বরস পাহলে এবং নাজির হোসেনের কিম্বদন্তীর ঢাকা মেলালে আমরা পাই যে কুট্টি ভাষার উদ্ভব হয় মুঘল আমলে, ধান কাটা থেকে এসেছে কুট্টি।আঠারো শতকের শুরু থেকে চাল বাংলার প্রধান রপ্তানি পণ্য হয়ে ওঠকহএবং ঢাকা ছিল সুবে বাংলার রাজধানী।চাল রপ্তানিকারকদের বেশির ভাগই ছিল অবাঙ্গালি মাড়োয়ারি।এরা পূর্ব বাংলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ধান সংগ্রহ করতে হতো।সে ধানকে ঢেঁকিতে ভানতে বা কুটতে হতো, যার জন্য দরকার হতো বিপুল পরিমাণ শ্রমিক।এই শ্রমিকেরা আসতো ঢাকার আশপাশের এলাকা ছাড়াও দূর দূরান্ত থেকেও আসতো।ধান কোটার কাজ শেষে নিজেদের এলাকায় না ফিরে গিয়ে এদের অনেকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বসবাস শুরু করলো।সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবাসস্থলগুলো গড়ে উঠলো ধোলাই খালের তির ধরে।এই প্রান্তিক শ্রমিক জনগোষ্ঠীর পারস্পরিক কথোপকথনে মিশতে থাকলো উর্দু, হিন্দি শব্দ এবং বলবার ঢং।মাড়োয়াড়িরা এই ধান কোটার এই শ্রমিকদের কুট্টি ডাকা শুরু করলো।

ধান কোটা বা ধান ভাঙ্গার মতো এদের অনেকে জড়িত ছিলো ইট ভাঙ্গা বা ইট কোটার কাজে।তাইফুর ঢাকার প্রান্তিক সনাতন  পেশাজীবীদের চার ভাগে বিভক্ত করেছিল : কুট্টি, খোশবাস ও সুখবাস, বসাক ও শাঁখারি।প্রথম দুটি মুসলমান, পরের দুটি হিন্দু।ধোলাই খালের তির সহ এই কুট্টিদের বসবাস ছিল তাঁতিবাজার, শাঁখারিবাজার, পটুয়াটুলি, বাংলাবাজার, ফরাশগঞ্জ, গেণ্ডারিয়া, লক্ষ্মীবাজার, নারিন্দা, মৈশুন্দি, মদনমোহন বসাক রোড, নবাবপুর, ওয়ারী, বনগ্রাম, হাটখোলা, টিকাটুলি, কায়েতটুলী, নবাবগঞ্জ।এদের উচ্চারণে বাংলা বর্ণমালার মহাপ্রাণ ধ্বনি যেমন, ঘ, ধ, ড়, ভ  বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।মহাপ্রাণ ধ্বনি বিশিষ্ট বর্ণ ঝ এবং ঢ এর কিছুটা সঠিক ব্যাবহার দেখা যায়।শ, ষ, স এর জায়গায় ছ এবং ছ এর জায়গাতে চ করে থাকে।

লালবাগ কেল্লা, দক্ষিণ তোরণ, ১৭৮৭।
ল্যান্ডস্কেপ পেইনটিং, ইয়োহান ইয়োফানি।
শামসুর রাহমান, ঋত্বিক ঘটক, আজম খান 
কবি শামসুর রাহমানের জন্ম পুরান ঢাকার মাহুতটুলিতে ১৯২৯ সালে।চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের জন্ম পুরান ঢাকার জিন্দাবাহারে হৃষিকেষ লেনে ১৯২৫ সালে।শামসুর আজীবন ঢাকাতে কাটিয়েছেন।১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় ঋত্বিক পরিবারের সাথে কোলকাতা চলে যায়।তর্ক যুক্তি আর গল্পে ঋত্বিক যে বাচিক বাংলা বলছে তা কিন্তু জহির রায়হানের বাচিক বাংলার থেকে দূরে নয়।জহির রায়হানের জন্ম ১৯৩৫ সালে বাংলাদেশের ফেনিতে, পড়াশোনা ঢাকায়।আজম খানের জন্ম ঢাকাতে ১৯৫০ সালে এবং আজীবন ঢাকাতে বসবাস।একদিকে যেরকম ঢাকা হয়ে উঠেছিল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মেল্টিং পট, যা থেকে আমরা পেলাম কুট্টি ভাষা, সেরকম বাংলা প্রমিতের নবায়নেও পুরান ঢাকা অবদান রেখেছে। ঋত্বিক ঘটক, চয়ন খায়রুল হাবিবদের মতো যারা পুরান ঢাকাতে বড় হবার পর অন্য দেশে চলে গেছে, শামসুর রাহমানের পাঠের পাঁশে, আজম খানের গানের পাঁশে  তাদের পাঠ নিয়ে আসলে আমাদের পক্ষে প্রান্তিক ও প্রমিতের যোগসূত্র বুঝতে সুবিধা হবে।এখানে আমার শিরোনাম সংলগ্ন ছাদ পিটুনির গানটা পুরো তুলে দিচ্ছি, সাথে ঢাকাই অনুষঙ্গ নিয়ে লেখা আরো দুটি কবিতা :

''জজ সাহেবের টেরি মাইয়া পেখম মেইলাছে
মহব্বতের রশির টানে উধাও হইয়াছে
কেলাস নাইনের ছাত্রী আছিল
গতর-শোভা ভালাই আছিল
কেম্বে কমু হগল কথা সরম অইতাছে।
জজ সাহেবের টেরি মাইয়া পেখম মেইলাছে
তাইরে নারে তাইরে নারে
কোথাও খুঁজে পায়না তারে
চান্দিঘাটে নসা ডিপটি মজা লুটতাছে
জজ সাহেবের টেরি মাইয়া পেখম মেইলাছে।''
(সংগ্রহ রবিউল হুসাইন কবিতার ঢাকা

এরপর খোড়াখোড়ি করা যাক শামসুর রাহমানের আমার অহংকার কবিতাটি :

''আমার জননী এত বেশি দুঃখ
সয়েছেন, এত বেশি
ছেঁড়াখোঁড়া স্বপ্নের প্রাচীন
কাঁথা করেছেন সেলাই নিভৃতে,
দেখেছেন এত বেশি লাল
ঘোড়া পাড়ায় পাড়ায়,
এতবার স্বপ্নে জাগরণে
ভূমিকম্পে উঠেছেন কেঁপে, তার
ভয়ানক কোনো মাথার অসুখ
হওয়া ছিল স্বাভাবিক; কিন্তু
ঘোর উন্মত্ততা তাঁর
পাশাপাশি থেকেও
কখনো তাঁকে স্বাভাবিকতার
ভাস্বর রেহেল
থেকে পারেনি সরাতে একচুলও।''
(শামসুর রাহমান, আমার অহংকার কবিতার অংশ।)

মাঝখানে ব্যনার ধরে আছে কামরুল হাসান,
তার বামে শামসুর রাহমান।ষাটের  দশক।
ঢাকাই অনুষঙ্গে তিন জমানার গান ও কবিতার আনুষঙ্গিক প্রতীকগুলো তুলনামূলক আলোচনার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে।ফেসবুকে জুলেখা সিরাপ গ্রুপে সামিনা আহসান ফারুক আমার অহংকার কবিতাটির উল্লেখিত অংস তুলে দিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, শামসুর রাহমান লাল ঘোড়া বলতে কি বুঝিয়েছেন। তৃণা রাব্বানি দুষ্টামি করে বলেছিল যে সামিনা সিভিল সার্ভিস দিচ্ছে কি না।স্বরূপ সরোওয়ার্দি এবং তৃণা দুজনেই পরে লাল ঘোড়াকে দেশ, ভালবাসার প্রতীক হিশেবে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিল।

ব্যাপারটা ভুলে গিয়েছিলাম।অনেক দিন পর ফরিদা রুবি জানালো যে শামসুর রাহমানের মায়ের বাসাতে ওনার যাতায়াত ছিল এবং উল্লেখিত রমনীকে তিনি দেখেছেন।সেই রমণী না কি শুধু ইদে সে বাসায় আসতেন, থাকতেন আহসান মঞ্জিলে শত শরিকের ভিড়ে।লাল ঘোড়ায় চড়ে তরুণ সওয়ারিরা তরুণীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইতো।এরকম এক লাল ঘোড়ার সওয়ারির সাথে রমণী ইলোপ করেছিল এবং পরে স্বামীর পঙ্গুত্বের সূত্র ধরে দারিদ্রে নিপতিত হন।শামসুর সেই রমনীকেই  আমার জননী বলেছেন।রুবির মন্তব্যের পর পর একজন প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করে যে এসব শামসুর রাহমানের ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং রুবি মন্তব্যটি সরিয়ে নেয়।আমার কাছে ফরিদা রুবির ব্যাখ্যাটি খুব গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে।ঢাকার নবাবি যুগ, রমনার রেসকোর্স সব মিলিয়ে ঘোড়াগাড়িতে তরুণীদের ভ্রমণ, পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ভালো লাগা লাল ঘোড়ার সওয়ারির প্রতি রুমাল দোলানো, খুবই প্রাসঙ্গিক।শামসুর রাহমানের কবিতার শক্তি এখানেই যে তিনি স্থানীয় অনুষঙ্গকে বিস্তৃত প্রতীকে ছড়িয়ে নিতে পেরেছেন।

তার পর আমরা চলে আসি প্রবাসের জানালা থেকে ফিরে দেখা ঢাকাই মাল্লার এর মূর্ছনায়  :

''বুঝুন অবস্থা
বৃষ্টির কাঁটাচামচে গাথা চকবাজারি গাজরি মোরব্বা
শহরজুড়ে জানালা দরজা খোলা কোনো রকম পর্দা নাই
খুশবাত বাসিন্দারা ভিজে একেবারে কাই

ভেজা দেহে নবদম্পতিরা হাত বাড়ালো
বৃষ্টির ক্রসফায়ারে বৃষ্টির মাল্লারে
চর কামরাঙ্গিতে একটা চাপা কিন্তু তিব্র লণ্ডভণ্ড
চানখাঁর পুলে বাজের শব্দে আজম খানের ক্রেসেন্ডো''
(চয়ন খায়রুল হাবিব, ঢাকাই মাল্লার কবিতার অংশ)

আজম খান, উচ্চারণ ব্যান্ড, ১৯৮৬
চয়নের কবিতা যে  আজম খানের ক্রেসেন্ডো দিয়ে শেষ হয়েছে, কিম্বদন্তিতুল্য সেই মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান ওরফে আজম খানের জন্ম চয়নের মতো ঢাকার আজিমপুরে  ১৯৫০ সালে।চয়ন  সচেতন ভাবে এই লাইনটি লিখে থাকলে এটি মগ্ন চেতনা-প্রবাহ বা স্টিম অব সেলফ কনশাসনেসের সেতুপথে যুক্ত হয়েছে আজম খানের অবিস্মরণীয় রেল লাইনের ঐ বস্তিতে, ওরে সালেকা ওরে মালেকা, আলাল ও দুলাল, অনামিকা, অভিমানী, আসি আসি বলে গানগুলোর সাথে। আজম খান এবং হাফিজা খাতুন য্যানো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যমজ স্মারক। 

আজম খানের বাবা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে তাঁর ছেলেবেলা কাটে আজিমপুরের ১০ নম্বর সরকারি কোয়ার্টারে। ১৯৫৫ সালে তিনি প্রথমে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে তাঁর বাবা কমলাপুরে বাড়ি বানান। এরপর থেকে সেখানে বসতি তাঁদের। সেখানে তিনি কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে প্রাথমিক স্তরে এসে ভর্তি হন। তারপর ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে টি অ্যান্ড টি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন।

১৯৭১ সালে আজম খানের বাবা আফতাব উদ্দিন খান সচিবালয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর ছিলেন। বাবার অনুপ্রেরণায় যুদ্ধে যাবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন তিনি।। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে, তিনি পায়ে হেঁটে আগরতলা চলে যান। আগরতলার পথে সঙ্গী হন তাঁর দুই বন্ধু। তিনি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভারতের মেলাঘরের শিবিরে। সেখানে তিনি শহিদ জননী জাহানারা ইমামের জ্যেষ্ঠ পুত্র শাফী ইমাম রুমীর কাছে এলএমজি, রাইফেল চালানোসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।এ সময়ে তাঁর লক্ষ্য ছিল সেক্টর ২ এ খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধে যোগদান করা। 

আজম খান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ২১ বছর বয়সে। তাঁর গাওয়া গান প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যোগাতো। যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কুমিল্লায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নেয়া শুরু করেন। কুমিল্লার সালদায় প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করেন। এর কিছুদিন পর তিনি পুনরায় আগরতলায় ফিরে আসেন। এরপর তাঁকে পাঠানো হয় ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য। আজম খান ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইন-চার্জ। আর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল খালেদ মোশাররফ। ঢাকায় তিনি সেকশন কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন। আজম খান মূলত যাত্রাবাড়ি-গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান।ওয়াইকিপিডিয়া। 

রমনা পার্ক তোরণ, ১৯০১
রমনা পার্ক কি রমণ থেকে?
রসিক নানাভাইকে বলি , নানাভাই আজ তোমার রমণ কেমন হোলো।ও ব্যাটা প্রতিদিন ভোরে রমনা পার্কে হাটতে যায়। রমণক্রিয়ার জোর আছে কি নাই বুঝি না, তবে আমাকে যখন রসিয়ে রসিয়ে অন্যদের হাহাহাটির ভঙ্গি নিয়ে বলে, পার্কে ফুটবল, ক্রিকেট খেলার অভিযোগ করে তখন আমি বুড়ির চুল খাওয়া, পনিরের স্লাইস রাখা বাকের খানি খাওয়ার রমণের আনন্দ পাই।এটা কি দুবার বলা হলো, ক্যাচ ধরবার মত? 

ইতিহাস গবেষক বলে প্রচারিত অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম ঐতিহাসিকের নোটবুক বইটিতে অনেক কিছুর সাথে লিখেছেন, রমনা পার্কের রমনা এসেছে রমণ থেকে।সেটা নিয়ে সিরাজুল সাহেব একটা পৃষ্ঠার ভেতর মুঘল আমলের ছড়া থেক হবসন, ডবসন ইত্যাদি করেছেন।রসিকতার দিক বাদ দিলে সিরাজুল সাহেবের মত দেশের অনেকের ইতিহাস বিষয়ক লেখা এখন একটি বইয়ে কয়েকশ অনুগল্প ঢুকিয়ে দেবার পর্যায়ে নেমেছে।অনুগল্পতো পড়ি না, এখন দেখছি ইতিহাস বিষয়ক অনুগল্প সঙ্কলন শুরু হয়ে গেছে।

রমনা কালী মন্দির।১৯৭১, ২৭শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী 
মন্দিরটি গুড়িয়ে দেয়
ওয়াইকিপিডিয়াতে ঢাকা নিয়ে কম পাওয়া যায় না।তবে রমণ থেকে রমনা এসেছে, এটা ওয়াইকিতে নাই।না থাকলে অসুবিধা নাই।ওয়াইকিসহ আরো অনেক গ্রন্থ থেকে যা পাওয়া যায় তা হলো, রমনা পার্ক বা উদ্যান হলো মুঘল আমলে গড়ে তোলা বিশাল রমনা এলাকার একটি অংশ মাত্র।তাহলে দাঁড়ালো, বিশাল অংশটি গড়া হয়েছিল রমণ বা আনন্দের জন্য।এটা ঠিক আছে।এলাকার নাম গুলশান, বারিধারা, বনানী, হলে রমনা হতে পারে।

রমণক্রিয়ার সরাসরি অর্থ রতিক্রিয়া, সহবাস।মোঘলেরা ঢাকাতে কয়েক হাজার একর জুড়ে একটা এলাকা বানিয়েছিল রতিক্রিয়া বা সহবাস করতে, এটা ভাবতে একটু খটকা লাগে।আবার রমণ এর একটা মূলগত শব্দ রাম, যার আরেক অর্থ আনন্দ, যার ফলে যে কিছুতে আনন্দ তাতে বৈদিকেরা রাম যোগ করে, সেখান থেকেও রমনা আসতে পারে।রমনার এক প্রান্তে কিন্তু শিবের মন্দির ছিল।আরেক প্রান্তে এখনো আছে ঢাকেশ্বরী।রমণের মূল রমণী থাকলে শব্দটিকে ফেলে দিতে হবে তার কোনো মানে নাই।আবার মহিলা শব্দের মূলে মহা আছে বলে সেটা বেশি ভদ্রস্থ হবে এবং ঢাকাইয়া মাগি শব্দটি অভদ্র বিচারও ঠিক না।একটা সময় খুব স্বাভাবিকভাবে বলা হতো, মহোদয় ও মাগিগন!

কলুম্বো সাহিব সৌধ, নারিন্দা, ১৮৭৫।
ফটো, জনসন এন্ড হফম্যান, ক্যালকাটা।
কালুম্বো সাহিবের খোঁজে
জার্মান নিও ক্লাসিক পেইন্টার ইয়োহান ইয়োফানি ইংল্যান্ড, ইটালি ঘুরে, ভারতের এদিক ওদিক ঢুঁড়ে হাজির ঢাকাতে, সেই আঠারো শতকে, একে রেখে গেছেন মহা সুন্দর সব ওয়েল পেন্টিং।ইয়োফানির পেইন্টিং সংগ্রহ করেছে টেট মডার্ন, ব্রিটিশ ন্যাশনাল গ্যালারিসহ অনেক নামি শিল্প সংগ্রহশালা। ২০২০ সালে কোভিড লকডাউনের ভেতর ঢাকার ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিক্সন গেলেন নারিন্দাতে কলম্বো সাহিবের স্মৃতিসৌধে।দেয়ালে বট গজানো, চার পাঁশে ঝোপ ঝাড়ের ভেতর টিকে থাকা সৌধটির সামনে মাস্ক পরা রবার্ট ছবি তুলে তা স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে দিলেন।কারো টনক তাতে নড়েছে বলে শোনা যায় নি।নারিন্দাতে কলম্বো  সাহিবের  স্মৃতিসৌধের প্রথম পেইন্টিং পাওয়া গেলো ইয়োহান ইয়োফানির ল্যান্ডস্কেপে ১৭৮৭ সালে।তারপর ১৮৭৫সালে কোলকাতার জনসন এন্ড হফম্যান কোম্পানি ঢাকায় লোক পাঠিয়ে তুল্লো স্মৃতিসৌধটির সাদাকালো ছবি।কে এই কলম্বো সাহিব?স্মৃতি সৌধটির স্থাপত্য রীতিই বা কি ধরনের?

কলুম্বো সাহিব সৌধ, ১৯৫০।
ফটো, ডক্টর নিজামুদ্দিন আহমেদ
নাম কলম্বো বা কলুম্বো এসেছে কলম্বাস থেকে।ইটালি, পর্তুগালে এরকম বিভিন্ন প্রজন্মে হাজারে হাজারে কলম্বো আছে, যারা অভিবাসী হয়ে সারা দুনিয়াতে ছড়িয়েছে।স্থাপত্য রীতির দিক থেকে এই স্মৃতিসৌধটির সাথে সুরাটের ওলন্দাজ, আর্মেনীয়, ইংরেজদের তৈরি মুঘল রীতি মিলে যায়।বাংলাদেশের ডেইলি স্টার পত্রিকায়, ওয়াকার এ খান এ বাবদে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ডক্টর রোজি লেওয়েলিন জোন্সের।রোজি জানাচ্ছে, 'আমার ধারনা কলম্বো সাহিবের সৌধ একজন ওলন্দাজের কবর।এটা আমি বলছি, সুরাটে ওলন্দাজদের সৌধের সাথে তুলনা করে, আবার সতেরশো শতকে ওলন্দাজদের বেঙ্গলে পাঠানো হয়েছিল শ্রীলঙ্কা থেকে বস্ত্র ব্যবসায়ের জন্য।অবশ্য, আমরা এ ব্যাপারে কখনো নিশ্চিত হতে পারবো না, যদি না কি হেগে গিয়ে গত কয়েক শ বছরে ভারতে আসা সব নাম পরীক্ষা করে।ওয়াকার খানের নিজের ধারনা, শ্রীলঙ্কার কলম্বো থেকে আসবার কারণে কলম্বো সাহিব নাম পেয়েছিলেন, হতে পারে যে ভদ্রলোক আদৌ ইউরোপীয় নন, শ্রীলঙ্কার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোক।ওয়াকারের এ ধারনা নেয়া যায় না, কারণ তাহলে সুরাটের ওলন্দাজদের সৌধের সাথে এ সৌধটি কেনো মিলবে?

এটলাস অবস্কিউরাতে কলম্বো সাহিবের সৌধের স্থাপত্য রীতির বর্ণনায় আমরা পাচ্ছি, সৌধটি তিন তলা ভবনের সমান।ভেতরে কেন্দ্র খালি রেখে তিন পাঁশে তিনটি কবর, সেগুলোতে কোনো এপিটাফ নেই।ধরে নেয়া যায় এরা কলম্বো সাহিবের পরিবারের ঘনিষ্ঠজন।কলম্বো সাহিবের কবর কোনটা তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই।স্থাপত্য রীতিটি আসলে অনেকগুলো রীতির মিশেল।নিচের কাঠামো মুঘল মসজিদের মত, চার দিকে চারটি খোলা দরজা, ওপরে ছাদের দিকে চমৎকার গথিক রীতি ও বারোক রীতির মিশ্রণ পাওয়া যাচ্ছে।কিন্তু এই কলম্বো বা কলুম্বো নামটি প্রামাণ্য ভাবে কোথায় পাওয়া গেলো?

১৮ শতকের শুরুতে কোলকাতায় বিশপের পদে কাজ করতে এলো তরুণ রেজিনাল্ড হেবার।কিছুদিন পর ভ্রমণে বেরিয়ে এক পর্যায়ে এলো রেজিনাল্ড ঢাকায় এলো এবং কলম্বো সাহিবের সৌধ দেখতে পেয়ে চৌকিদারকে জিজ্ঞেস করলো, এটা কার সৌধ?চৌকিদার উত্তরে জানালো, 'ইয়ে কালুম্বো সাহিব কা মাকবারা, কাম্পানি কা নাউকার!' লন্ডনে স্ত্রী এমেলিয়ার কাছে লেখা চিঠিতে রেজিনাল্ড চৌকিদারকে উদ্ধৃতি করলো হুবহু, যা এমেলিয়ার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়, 'Narrative of a journey through the Upper Provinces of India, from Calcutta to Bombay, 1824-5, with an account of a journey to Madras and the Southern Provinces,' শিরোনামে।তবে বিশপ রেজিনাল্ড খোজ নিয়ে দেখেন নাই যে এই কলম্বো সাহিব কে বা কোথা থেকে এসেছিলেন।ফটোগ্রাফিতে স্মৃতিসৌধটিকে ১৯৫০ এর দশকে ডক্টর নিজামুদ্দিন আহমেদের তোলা সাদা কালো ছবিতে স্মৃতিসৌধটিকে পরিচ্ছন্ন ও সংরক্ষিত মনে হয়েছে।ইয়োফান ইয়োফানির আকা ছবির সাথে তুলনা করলে বোঝা যায় যে জনসন এন্ড হফম্যানের ছবিতে যে তোরণটি দেখা যাচ্ছে তা পরে নির্মিত।এমন কি হতে পারে যে ঢাকার আরমানিটোলাতে আর্মেনীয় চার্চ নারিন্দাতে এই সৌধটির যত্ন নিচ্ছিল পুরো খ্রিস্টান কবরস্থানের সাথে। ৫০ দশকের পর যখন আর্মেনীয়রা দলে দলে পাকিস্তান ত্যাগ করে যেতে থাকে, তখন কবরস্থানগুলো এবং সংলগ্ন সৌধগুলো সংরক্ষণে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আর মনোযোগ দেয় নি, আর বাংলাদেশ পর্যায়ে সেই অবহেলা বহাল থেকেছে।

কোনো একটা রমণীয় টান, পাগলাটে ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে, না হলে , মসজিদ, প্রাইভেট মেডিকেল, মাদক নিরাময় কেন্দ্র নিয়ে ঢাকা কেবল বাড়ছে তো বাড়ছেই বা কেনো?কালুম্বো সাহিবের ভাগ্যান্বেষণে আসা এই শহরে দাপিয়ে প্রেম করেছে খনি বেগম ও আগা বাকের, পিয়ারি বেগম ও শহীদ কাদরী, সুরাইয়া খানম ও আবুল হাসান, তাহমিনা নীলা ও চয়ন খায়রুল হাবিব।আবার এই শহরের পোষা, পেয়ারের খলনায়ক ও তাদের গড ফাদার, গড মাদারদের ফিরিস্তিরও শেষ নেই।উপাত্ত ফুরায়, পরিসংখ্যানের একঘেয়েমি ঝিমুনি ধরায়, কিন্তু ঢাকার গল্প য্যানো ফুরাতেই চায় না!টেরি মাইয়াগুলো আরো ঘাড় তেড়াভাবে পেখম মেলতেই থাকে!

লুবনা ইয়াসমিন

তথ্যসূত্র :
এস, এম তাইফুর Glimpses Of Dhaka
হাফিজা খাতুন, Dhakaias On The Move
হাকিম হাবিবুর রহমান ঢাকা, পাচাশ বরস পাহলে 
নাজির হোসেন কিম্বদন্তীর ঢাকা
শামসুর রাহমান, রচনা সমগ্র, স্মৃতির শহর
রবিউল হূসাইন, কবিতার ঢাকা
ওয়াকার এ, খান, প্রবন্ধ
চয়ন খায়রুল হাবিব, ব্লগ
ব্রিটিশ ন্যাশনাল গ্যালারি, টেট মডার্ন, ক্রিস্টি, সদাবি, স্মিথসোনিয়ান ক্যাটালগ
রেজিনাল্ড হেবার, এমেলিয়া হেবার ওয়াইকিপিডিয়া
এটলাস অবস্কিউরা, ওয়াইকিপিডিয়া, জুলেখা সিরাপ ফেসবুক গ্রুপ
সামিনা আহসান শাহরুখ, ফরিদা রুবি