।।কাননবালার দেহাবশেষ।।
।।তৃণা রাব্বানি।।
পুলিশ ইন্সপেক্টর : ভদ্রমহিলার গলার লকেটে এই ছবিটা পাওয়া গেলো।'ছবির পেছনে লেখা, 'আমার অশোক'
পুলিশ সুপার : হুইল চেয়ারের লোকটা তাহলে অশোক মৈত্র, আর মহিলা তাহলে কানন বালা।কিন্তু কানন বালার তো মাথার চুল কালো ছিল।এই মহিলার মাথার চুল সোনালি, বব কাট।চোখের মনিও নীল।দেখতে মেরিল স্ট্রিপের মতো।
ইন্সপেক্টর : বস, গলার লকেটে এই ছবিটা পাওয়া গেলো।ছবির পেছনে লেখা, 'আমার জন'।
সুপার : হুইল চেয়ারের লোকটা তাহলে জন কাজাল।কিন্তু মেরিল স্ট্রিপের চুল তো সোনালি ছিল।এই মহিলার মাথার চুল কালো, ঘাড় ছড়ানো।চোখের মনিও কালো।আবার দেখতে কানন বালার মতো।
ইন্সপেক্টর : বস, লকেটের ছবিটা শুধু দুইটা চেহারাতে বদলাচ্ছে।পেছনের লেখাটাও।থ্রি ডাইমেনশানাল পিকচার।
সুপার : ডেড বডিটাও থ্রি ডাইমেনশানাল না কি।শরীরের সবখানের লোমের স্যাম্পল নাও।ঐ যে এতক্ষণে আমাদের ক্যামেরাম্যান আসছে।এই যে পনির সাহেব, এতক্ষণে আসলেন।
একজন ঘর্মাক্ত চশমা পরা লোককে ঘরে ঢুকতে দেখা গেলো সাদা পোষাকে।নীল ডেনিমের ওপর হাফ হাতা সাদা টি শার্ট, তার ওপর ক্যামেরা ম্যানদের অনেক পকেটওয়ালা ভেস্ট।মাথায় অল্প চুল, সামনের দিকে টাক, রুমাল দিয়ে টাকের ঘাম মুছছে।পায়ে নীল সাদা ক্যানভাসের হকি বুট।
পনির : বইলেন না।প্যারেড গ্রাউন্ডে শেখ মুজিবের জনসভা কভার করতে গিয়ে, মরতে মরতে জান হাতে করে ফিরেছি।কানন দেবী স্ট্যাম্পিডের দশা।
সুপার : অ্যা, কি বললেন? কানন দেবী? প্যারেড গ্রাউন্ডে?এইখানে এইটা কি?আপনি ফরেনসিক ক্যামেরাম্যান।আপনাকে কেনো জনসভাতে পাঠাবে?
পনির : এস পি সাহেবকে বলে আমি নিজে এসাইনমেন্ট নিয়েছিলাম। ঐতিহাসিক ঘটনা স্যার।জয়বাংলার প্রতি মানুষের ভালোবাসা না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
সুপার : ভালোবাসার ঠ্যালাতে স্ট্যাম্পিড!ভালো!কিন্তু কাননবালা এক সময় দুই জায়গাতে কিভাবে?একবার তাকিয়ে আমি নিশ্চিত হয়েছি, ডেডবডি কানন দেবীর।আর হুইল চেয়ারের লোকটা অশোক মৈত্র।
হুইল চেয়ারের লোকটা : আমি অশোক মিত্র না।আমি শিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল শিকদার।ভদ্রমহিলা আগে কাননবালা ছিল, এখন মেরিল স্ট্রিপ।
সুপার : এই লুলা মারানির পুতরে কেউ একটা থাবড়া লাগাওতো।শালার পুত দর্শন মারাচ্ছে হোমিসাইড মামলাতে।হিশাব সোজা।কেউ একজন কানন বালার বাসা, উত্তম কুমারের বাসা, প্যারেড গ্রাউন্ডে হদিশ লাগাও।এই রমিজ তুমি যাও।ওনারা বেচে থাকলে ভালো।না পাওয়া গেলে, এখানের ডেড বডি কানন বালা।আমরা বলে দেবো প্যারেড গ্রাউন্ডে স্ট্যাম্পিডে মারা গেছে।এই কেউ একটু কফি দাও।পনির বাবু, প্যারেড গ্রাউন্ডের ঘটনা বলেন।
পনির : শেখ মুজিবর যখন পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হল, আনন্দ বাজার থেকে সন্তোষ কুমার ঘোষ , ও হচ্ছে পাগলা, শেখের মুক্তি উপলক্ষে Clarion call দিলেন যে নাগরিক সম্বর্ধনা হবে;ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে শেখ মুজিব বক্তৃতা দেবে, ফিল্ম এক্টররা আসবে...দুপুর থেকে ময়দানে লক্ষ লক্ষ মানুষ; এক্টর-ফ্যাক্টর আসবে, এই আসবে, সেই আসবে।উত্তম কুমারের গাড়িটা এলো।এর আগে যখন মাধবির গাড়ি এলো তখন থেকেই উন্মাদনা বাড়ছে।জনতা উন্মাদ হয়ে গেছেঃগুরু, গুরু, গুরু বলে একটা ঢেউ উঠছে আর নামছে।উত্তম কুমারের ড্রাইভার গাড়ি বাকিয়ে পগারপার।যেসব মহিলা এসেছিল তারাও অবস্থা দেখে পালিয়েছে।কানন বালাকে চোখের সামনে পিষে মেরে ফেলবার অবস্থা, stampede…অজয় কর বলে এক ক্যমেরাম্যন ছিলেন, ফিল্ম-টিল্ম করতেন; অজয়দা বললেন: দেখছ কি, বাচাও...ধরো।কাননবালা দুই গাছের মধ্যে জনতার চাপের মধ্যে stampede.ত সেইখান থেকে তুলে অজয়দার গাড়ির মধ্যে কোন রকমে ছুড়ে ফেলা হল।এই রকমের অবস্থা...
সেইখানে শেখ সাহেব বক্তৃতা দিচ্ছেন, বল্লেনঃ আমার নেতা, নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু...।আর সাথে সাথে তুমুল করতালি, আকাশ ফাটানো চিৎকার।তারপর বলতে থাকলেন: আমার নেতা চিত্তরঞ্জন, আমার নেতা শেরে বাংলা...এইসব বলেই জেতে থাকলেন...যেতে, যেতে যেই সোরোয়ার্দির নাম নিলেন...
সুপার : এহ এইটা উনি বুঝতে পারেন নাই।এখানকার লোকেরা সরোয়ার্দিকেত এক্কেবারে পছন্দ করেনা।বলে সুরাবর্দি
হুইল চেয়ারে বসা লোকটা : ফোরটি সেভেনে ডাইরেক্ট একশান ডেতে যে হানাহানি হয়েছিল,সেদিন যদি সরোয়ার্দি না দাঁড়াত তাহলে মুসলমান সমাজ একেবারে কচুকাটা হয়ে যেতো।এই কারণে হিন্দুদের কাছে ও একেবারে খলচরিত্র হয়ে গেল, সেদিন থেকে ওকে ওরা আর পাত্তা, ফাত্তা দিতনা, সুরাবর্দি ডাকা শুরু করলো।
সুপার : চুপ ব্যাটা। শেখ যখন সরোয়ার্দির নাম করলেন তখন কি পিন ড্রপ সাইলেন্স?
পনির : পিন ড্রপ মানে...রেকর্ডটা যদি বাজান স্যার, তাহলে শুনবেণ...সব কিছু থেমে গেল।’
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
হুইল চেয়ারে বসা লোকটা : এই ধরনের ছোটখাটো জিনিস দিয়ে কিন্তু অনেক কিছু মাপা যায়।
সুপার : চুপ ব্যাটা।ঠিক ধরেছেন। এটাকেত ডায়াবলিকাল ঘৃণার প্রকাশ বলা জেতে পারে।
হুইল চেয়ারে বসা লোকটা : হ্যাঁ, ডেফিনিটলি।একদম গেঁথে গেছে।সরোয়ার্দিকে এদিককার লোক কখনো মেনে নেয় নি।ওরা ছিল মেদিনীপুরের ।আব্দুল্লাহ সরোয়ার্দি কোরানের চমৎকার অনুবাদ করেছিলেন।স্যার জাহেদ সরোয়ার্দি ছিলেন হোসেন শহিদের কাকা, উনি ছিলেন কোলকাতা ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর, কম কথা নাকি!শাহেদ সরোয়ার্দিত ছিলেন মহা স্কলার;জামিনী রায়কে প্রথম চিনিয়েছিলেন উনি;কোলকাতার সবার কাছে, এই যে কমল কুমার মজুমদারের কাছেও শুনেছি, বলছে যে এই যে বিষ্ণু দে, ফিশ্নু দে এরা শিখেছে কোথ্যেকে,এরা সব শিখেছে শাহেদ সরোয়ার্দির কাছ থেকে।তা ঐসব ডামাডোলে পরিবারটি একদিকে সর্বোচ্চ এলিট হয়ে গেল, আর কোলকাতায় এক্কেবারে তলিয়ে গেল।
সুপার : চুপ ব্যাটা! পারস্পরিক অবিশ্বস্ত এক দিনে ঘটে নি।সংখ্যালঘু যেখানেই সংখ্যাগুরুদের শাসন করেছে, তার ঘাত প্রতিঘাতত থাকবেই।দ্রাবিড় ভারতে আর্জদের আগ্রাসন, তারপর আর্জাবর্তে মুসলিমদের আগ্রাসন, তারপর ব্রিটিশের শাসন...একটা পর্যায়ে আমাদের ইতিহাসের দোহাই পাড়া বন্ধ করা উচিত নয় কি?
পনির : দু-সম্প্রদায়ের মধ্যবিত্তদেরই falls prideও কাজ করেছে।আমি আমার শিক্ষকদের দেখেছি।ওনারা insecured feel করেছে।মেয়েদের ব্যপারটা আছে, কেউ আমাদের বিশ্বাস করতে পারে নি।।বিজেতারা সবসময় মেয়েদের ওপর জবরদস্তি করেছে, ছিনতাই করেছে।রোমানরা করেছে, অন্যান্য বিজেতারাও করেছে।হিন্দুদের মনে ঐ সবকিছুই কাজ করেছে।মুসলমানদের প্রতি একটা ভিতিবোধ আগে থেকেই ছিল।কিন্তু এই আমিতো কারো মেয়েকে ছিনতাই করতে যাচ্ছি না।পনির বলা ঠিক আছে।পনির হোসেন বললেই সুরাবর্দি হয়ে গেলাম।
হুইল চেয়ারে বসা লোকটা : এসব পার হয়েত পশ্চিম বঙ্গের অধিবাসীরা ১৯৭১এ পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তু লাখ, লাখ লোকের প্রতি অতুলনীয় আতিথিয়েতা দেখিয়েছিল।
সুপার : কোলকাতার বিশাল একটা অংশই ৪৭ এর দেশভাগের শরণার্থী গোষ্ঠী।শিয়ালদার আশপাশের শরণার্থী শিবিরে অনেকে কাটিয়েছে ১৫/২০ বছর।এই যে চিত্রকর যোগেন চৌধুরী, প্যরিসে গিয়েছিলেন, বিখ্যাত হয়েছিলেন,উনিও মানুষ হয়েছেন শিয়ালদাতে।এরা সবাই নতুন উদ্বাস্তুদের মেনে নীল। একটা রোগ ছড়ালো খুব দ্রুত, কনজিভাইটিস, রোগটার নামই হয়ে গেল জয় বাংলা রোগ।
পনির : এর সাথে কোলকাতার নিজস্ব দারিদ্র।
হুইল চেয়ারে বসা লোকটা : সেই দারিদ্রের মধ্যে এরা সপ্তাহে দুই দিন রাইসলেস ডে মেনে নিয়েছে ৭১এ।হোটেলেও ঐ দুই দিনভাত পাওয়া যেতনা।বাঙ্গালির কাছে রুটি কখনোই উপাদেয় না।ত সেই হাজার হাজার আগের ভাসমান শরণার্থী যারা হোটেলে খেত তারাও এটা মেনে নিয়েছিল।
পনির : আপনি কি তখন স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ করতেন?
হুইল চেয়ারে বসা লোকটা : সেটাত অনেক পরে।১৯৬৫তে পাক-ভারত যুধ্বের সময় ভারত সরকারের পলিসি অনুযায়ী আকাশবাণী কোলকাতার তত্বাবধানে একটা ক্ল্যন্ডেস্টাইন স্টেশান করা হয়েছিল।ওখানে আমরা কয়েকজন স্ক্রিপ্ট লিখতাম, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে ওখান থেকেই পরিচয়।২৫ শে মার্চের পরেই দেবদুলালকে দিল্লি থেকে কোলকাতা নিয়ে আসা হয়।পঁচিশে মার্চের পর পরই সীমান্তের আস পাস থেকে, ঢাকা থেকে যেসব তরুণ পালিয়ে গিয়েছিল তাদের নিয়ে দেবদুলাল রেডিও থেকে “সংবাদ সমীক্ষা” নামে একটা অনুষ্ঠান করতেন। এ-অনুষ্ঠানের জন্য উনি পরে পদ্মশ্রী উপাধি পান।উপেন গঙ্গোপাধ্যায় প্রযোজনা করতেন।
সুপার : আপনি ঐ অনুষ্ঠানে কোন স্ক্রিপ্ট করেন নি।
হুইল চেয়ারে বসা লোকটা : স্ক্রিপ্ট করিনি।কিন্তু অন্যান্য কাজ করতাম।শরণার্থী শিবিরগুলোতে যেতাম, আনন্দ বাজারে কাজ করতাম।এর মধ্যে এম আর আখতার মুকুল বললেন যে ফজলে লোহানি কোলকাতায়।এর মধ্যে সতের আঠার বছর দেখা হয় নি।ফজলে লোহানির ব্যপারে আমার এক ধরনের মুগ্ধতা আছে।ওর কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছিলাম, আধুনিক কবিতার পাঠ আমি ওর কাছেই নিয়েছিলাম।লোহানি ভাইর সাথে আমার একটা আলাদা সম্পর্ক ছিল, সেই যখন আমি প্রথম বাড়ি পালিয়ে পালিয়ে ঢাকাতে আসা যাওয়া করতাম তখন থেকে।কোলকাতায় দেখা হবার পর দুজন এক সাথে খাওয়া দাওয়া করলাম; লোহানি ভাইও আমাকে এখানে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে, আমিও ওনাকে নিয়ে গেলাম বিভিন্ন খানে।প্রথম দিন ওনাকে নিয়ে গিয়েছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে।লোহানি ভাই ওখানে একটা ভুল করল।আরেক লোক ওখানে লিখত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামে, ও লিখত সুনীল কুমার গঙ্গোপাধ্যায় নামে, সে ছিল টেকো।সে “নীল পদ্ম করতলে” নামে একটা কবিতার বই লিখেছিল।লোহানি ভাই বললেন ঃ আপনার “নীল পদ্ম করতলে” পড়েছিত, এই সেই।সুনীল একটু ইয়ে হয়ে গেল।তার পর ওনাদের সম্পর্কটা, মানে সেদিনের আসরটাই আর জমল না।এর পর লোহানি ভাই আমাকে নিয়ে গেল এক সিলেটি ভদ্রলোকের বাড়িতে।ওখানেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্ল্যান পোগ্রাম হচ্ছিল।এর পর উনি বোম্বে হয়ে লন্ডন চলে জান।বোম্বে থেকে কিছু চিঠি উনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন।এর মধ্যে রাইটার্স বিল্ডিং থেকে আমার ডাক পড়ল।ওখানে এক অফিসে ডেকে আগের পরিচিত এক লোক বলোলেনঃ বেলাল, তুমি এই ফজলে লোহানির সাথে ঘোরাঘোরি করছ, ওকেত ইয়াহিয়া খান মরিয়া হয়ে দালালি করতে পাঠিয়েছে।
সুপার : এটা কি সঠিক ধারনা ছিল?
হুইল চেয়ারে বসা লোকটা : ভুল, আমিত মনে করি ভুল।কিন্তু সামহাউ এটা রাষ্ট্র হয়েছিল।যে আমাকে ডেকে নিয়েছিল সে ইন্টেলিজেন্সের লোক।জানতে চাইল, লোহানির সাথে আমার কি সম্পর্ক?তখন তাকে বললাম যে লোহানিরা এই কোলকাতাতেই বড় হয়েছে।তার বড় ভাই কিরণ কুমার নামে বিখ্যাত, “দুখে যাদের জীবন গড়া” নামের ফিলিম করেছে।
সুপার : ফজলে লোহানি সম্পর্কে ওপর মহলের ঐ ধারনা কি পুরো নয় মাশই ছিল?
হুইল চেয়ারে বসা লোকটা : পুরো নয় মাস কোথ্যেকে? লোহানি চলে গেছে ইংল্যান্ডে।ও ততদিনে লস্ট কেস। এত দ্রুত সব ঘটছে,একের পর এক উত্তেজক খবরের তলে লোহানির খবর চাপা পড়ে গেছে।আমি তখন জড়িত হয়েছিলাম বিজু পাটনায়েকের মেয়ে গিতা মেহেতার সাথে।উনি কাজ করত এক এমেরিকান পাবলিশার্সের সাথে।গিতা মেহেতা যেত বর্ডার, ফর্ডারে, ছবি তুলত, তুলে পাঠাত এমেরিকান এক ম্যাগাজিনে।তখন আমি কিছুদিন গিতা মেহেতার সাথে কাজ করতে বর্ডারে গেছিলাম।
পুলিশ সুপারের ওয়াকিটকি বেজে ওঠে।তাতে শোনা যায়, কানন দেবীকে খোজা হচ্ছে, তাকে শেষ দেখা গেছে প্যারেড গ্রাউন্ডে।
সুপার লাশটার দিকে তাকিয়ে বলে, আমি বলছি নিশ্চিত করে স্যার, আমরা যে লাশটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি তা কানন দেবীর।
ওয়াকি টকি ওকে আমি আসছি।জানালা দিয়ে একজন লম্বা পুলিশ অফিসার ঢোকে।সুপারের খুব কাছে নিচুস্ববরে বলে, এই লাশকে কানন দেবী বলা যাবে না।ওনার নামে কোটি টাকা লগ্নি করা আছে।এর ভেতর একটা কানন দেবী বানিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।এই লাশটাকে গুম করতে হবে।ঐ হুইল চেয়ারের লোকটা কে?
সুপার : উনি অশোক মৈত্র স্যার।কিন্তু অস্বিকার করছে।
লম্বা অফিসার : মৈত্র ফৈত্র পরে।এই সিনে কাউকে পাও নি লিখবে।
সুপার : হুইল চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, তাহলে ওনার কি হবে?
লম্বা অফিসার : যা হবার তা তুমি করবে।এই সিনে কোনো লাশ, কোনো কানন দেবি, কোনো হুইল চেয়ার থাকতে পারবে না।
এটা বলে লম্বা অফিসার জানালা থেকে নিচে লাফ দেয়।
হুইল চেয়ারে বসা লোকটা পুলিশ সুপারের কোমরের পিস্তল অকস্মাত কেড়ে নিয়ে সবার দিকে তাক করে বলে, গল্পটা আবার শুরু করেন, এই লাশটি তিন মিলিওন বছরের পুরানো।মহিলার নাম লুসি।
সুপার : লুসি?লুসি কে?
ফরেনসিক ক্যামেরাম্যান পনির সুপারের কাছাকাছি গিয়ে পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে কানে কানে ফিশফিশ করে বলে, স্যার আমি ক্যামেরাম্যান, আমি কিলার না। আল্লার দোহাই স্যার, আমাকে আর ক্রসফায়ারে পাঠায়েন না।আমি ঘুমাতে পারি না। আমার বৌকেও ঘুমাতে দেই না।
সুপার সমব্যাথিভাবে পনিরের দিকে তাকায়।বলে, আই ডু আন্ডারস্ট্যান্ড, আই ডু।আপনি তো ট্রিগার টিপছেন না।শুধু ইন্সিডেন্টের পর ফটো তুলছেন।
পনির হতাশায় মাথা নাড়তে থাকে, তারপর ডেডবডির দিকে তাকায়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে, দেখেন, দেখেন স্যার, আবার চেহারা বদলায়ে গেছে!
সুপার : ধর্মও দেখি বদলায় গেছে।সিথিতে সিঁদুর ছিল না।এখন দেখি সিঁদুর জ্বলজ্বল করছে।
পনির : স্যার ওটা সিঁদুর না।রক্ত।
সুপার : পনির বাবু, আপনাকে একটা জিনিস দেখাই।
য্যানো ঐ ঘরে এখন আর হুইল চেয়ারে বসা লোকটা আর নাই।সুপার আর পনির স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে থাকে।
সুপার পকেট থেকে একটা মুঠো সমান পলি ব্যাগ বের করে, ব্যাগের ভেতর থেকে একটা চ্যাপ্টা কাচের লকেট বের করে, লকেটটার মাঝখানে চোখ আকা, মনি গাড় নীল/
পনির : এটাকে স্যার টার্কিশরা নাজার বা নজর বলে, আর গ্রিকরা বলে মাটি।ভুত বা অশুভ থেকে দূরে থাকবার মাদুলি।আমাদের মঙ্গলসূত্রের মত।কোথায় পেলেন?
সুপার : কোথায় পাই নি, তা বলেন।ডেড বডির চার পাঁশে ছড়ানো ছিল।কপালে একটা রাখা, নাভিতে, নারী অঙ্গে, দুধের বোটাগুলোতে, ঘরের এখানে, ওখানে।সব জড়ো করে ল্যাবে পাঠিয়েছি।আমি নিশ্চিত, সবগুলোতে এই লুলার হাতের ছাপ পাওয়া যাবে।
পনির : এটা তো স্যার ব্ল্যাক ম্যাজিকের দিকে গড়াচ্ছে।
সুপার : ব্ল্যাক না হোয়াইট জানি না।তবে এই লুলাকে চেপে ধরতে হবে।
পনির : ডেডবডি যে চেহার বদলাচ্ছে, স্যার!সেটার কি হবে।আর বড় বস যে ক্রসফায়ারের ইঙ্গিত দিলেন, তার কি করবেন?
সুপার : কোনো ক্রস ফায়ার এ যাবো না।আমি একে রিমান্ডেও আনতে চাই না।গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলগেটে গিয়ে কথা বলবো।যত দিন লাগে।লোকটা আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে।এই নজর, মাটি, ডেডবডির চেহারা বদল এক সুতোয় গাথা।লোকটা জানে।
পনির : নাও জানতে পারে।
সুপার : ডেড বডিটা এখানে রেখে যাবো আমরা।চেহারা বদলাতে পারলে, বেচেও উঠতে পারবে।বাইরে থেকে বাসাটার ওপর কড়া নজরদারি রাখবেন আপনি।টিম যা দরকার আমি অথোরাইজ করে দিচ্ছি।আর লুলাটাকে গ্রেপ্তার করে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে যান।যা বলার রেকর্ডে নিন।রিমান্ডের দরকার নেই।
পনির হুইল চেয়ারের কাছে যায়।বলে, চলেন আমার সাথে।
হুইল চেয়ার : কিন্তু ভাই আপনার দিকে আমি পিস্তল তাক করে আছি।হুকুম আমি দেবো।
হুইল চেয়ারের পেছন থেকে ইন্সপেকটর পিস্তলের বাট দিয়ে জোরে হুইল চেয়ারে বসা লোকটার মাথায় আঘাত করে।
শায়িত লাশটি তখন উঠে বসেছে মেঝেতে।কপালের দু'পাশ চেপে বলছে, একটু জল দাও।
তৃণা রাব্বানি
পরের পর্বের নাম : 'নগ্ন হেলেনের মাটিনজর'!