ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Thursday, February 11, 2021

মোচড়ানো সময় এবং গাছের গান

।।লুৎফর রহমান বাবু।।

 The Persistence of Memory (Spanish La persistencia de la memoria) স্মৃতির চাপাচাপি!সালভাদর দালি।

স্থানের বক্রতায় মোচড়ানো সময়

২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ইন্টারস্টেলার’চলচ্চিত্রে দেখা যায়, নায়ক একটি ব্ল্যাকহোলের আশেপাশে ভ্রমণ করে। যখন তিনি পৃথিবীতে ফিরে আসেন তখন নিজের মেয়েকে নিজের থেকে বয়সে বড় হিসাবে দেখতে পান। তার মেয়ে তখন একজন বয়স্ক মহিলা, আর তিনি তখনও মধ্যবয়সী। প্রকৃতপক্ষে এটি হলিউডের ফ্যান্টাসি নয। উদ্ভট কল্পনা মনে হলেও বিশ্বব্রহ্মান্ড সত্যই এভাবে কাজ করে।

ইন্টারস্টেলার চলচ্চিত্রটির বৈজ্ঞানিক পরামর্শদাতা ছিলেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ কিপ এস থর্ন যিনি দুটো কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষে জন্ম নেয়া মহাকর্ষীয় তরঙ্গ (গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ) সনাক্ত করে ২০১৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে রাইনার উইস ও ব্যারি সি ব্যারিশের সাথে যৌথভাবে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। তিনি তার বিষয় জানেন। ফলে ইন্টারস্টেলারের কাহিনী যথাসম্ভব বিজ্ঞানভিত্তিক রূপায়ন ছিল তা বলাই যায়।

প্রেম জীবনের উন্নতিকল্পে কিভাবে
সময়েক বাকানো যায়।
মার্গারেট আন উইদার্স।


আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আবিষ্কারগুলির মধ্যে চমকপ্রদ একটি হলো এই যে, প্রকৃতিতে সময় আমাদের পরিচিত স্বজ্ঞা থেকে আলাদাভাবে কাজ করে। স্থানে বস্তু কোথায় কি গতিতে আছে তার উপর নির্ভর করে সময়। আপনি কোথায় আছেন, পাহাড়ের চূড়ায় না সমুদ্র সৈকতে না মহাকাশে, স্থির আছেন না কোন গতিতে চলমান আছেন ইত্যাদির উপর নির্ভর করে ‘সময়’ ভিন্ন ভিন্ন গতিতে প্রবাহিত হয়। এর কারণ সময়ের বিকৃতি বা মোচরানো সময়। আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে সময়ের এই বিকৃতি অনুভব করি না, তার একমাত্র কারণ পৃথিবীতে এগুলি আমাদের নজরে আসার পক্ষে খুবই সামান্য। এটি প্রথমবার নয় যখন বিজ্ঞান আমাদের স্বজ্ঞাকে ভুল হতে দেখায়। যেমন, আমাদের অন্তর্নিহিততা চায় পৃথিবী সমতল এবং স্থির হোক এবং সময় সর্বত্র একই হোক। কিন্তু বাস্তবে এর কোনটিই সত্য নয়।

একটি পাহাড়ের শীর্ষে একটি ঘড়ি রাখুন। অন্য একটি সৈকতে রাখুন। অবশেষে, আপনি দেখতে পাবেন যে প্রতিটি ঘড়ি আলাদা সময় বলে। কেন? আপনি পৃথিবীর কাছাকাছি যাওয়ার সাথে সাথে সময় ধীরে ধীরে চলবে।, কারণ আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে দেখিয়েছেন, পৃথিবীর মতো বিশাল ভরগুলি তার চারপাশের স্থান এবং সময়কে মোচড়িয়ে দেয়।

বিজ্ঞানীরা এই "সময় বিসারণ" প্রভাবটি মহাজাগতিক স্কেলে প্রথম পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যখন একটি তারা কোনও ব্ল্যাকহোলের কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিলো। তারপর ২০১০ সালে গবেষকরা আরও অনেক ছোট স্কেলে একই প্রভাব লক্ষ্য করেছিলেন, দুটি অত্যন্ত নির্ভুল পারমাণবিক ঘড়ি ব্যবহার করে। একটি ঘড়িকে অপর ঘড়িটির চেয়ে মাত্র ৩৩ সেন্টিমিটার বেশী উচ্চতায় স্থাপন করে সময়ের পার্থক্য লক্ষ্য করেছিলেন। আবারো দেখা গেলো, পৃথিবীর কাছাকাছি থাকা ঘড়িটিতে সময় বয়ে যাচ্ছিল অপেক্ষকৃত ধীর গতিতে। অর্থাৎ, উঁচুতে স্থাপিত ঘড়িটির সময় থেকে পৃথিবীর নিকটতর (৩৩ সেন্টিমিটার দূরত্বের পার্থক্য) ঘড়িটি অপেক্ষাকৃত ধীর ছিল। সময়ের পার্থক্য ছিল অতি ক্ষুদ্র, তবে এর তাৎপর্য ছিল বিশাল: পরম সময় নেই। বিশ্বের প্রতিটি ঘড়িতে এবং আমাদের প্রত্যেকের ঘড়িতে সময় কিছুটা ভিন্নভাবে বয়ে যায়।

ইতালীয় তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী কার্লো রোভেলি তাঁর "দ্য অর্ডার অফ টাইম" বইয়ে বলেন যে আমাদের সময় সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি - আমাদের চেতনা এই যে সময় চিরকাল এগিয়ে চলেছে - এটি একটি অত্যন্ত বিষয়গত প্রক্ষেপণ হতে পারে। তৎসত্ত্বেও, আপনি যখন ক্ষুদ্রতম স্কেলে (অন্ততপক্ষে, কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণ সমীকরণগুলি ব্যবহার করে) বাস্তবতা দেখেন তখন সময় উধাও হয়ে যায়।

রোভেলি লিখেছেন, "আমি যদি জিনিসের অণুবীক্ষণিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করি, তবে অতীতের এবং ভবিষ্যতের মধ্যে পার্থক্য অদৃশ্য হয়ে যায় – কোনো ঘটনার 'কারণ' এবং 'প্রভাব' এর মধ্যে কোনও পার্থক্য থাকে না।সুতরাং, কেন আমরা উপলব্ধি করি সময় সন্মুখপানে প্রবাহিত হচ্ছে? রোভেলি নোট করেছেন যে, যদিও অতি ক্ষুদ্র স্কেলে সময় অদৃশ্য হয়ে যায়, তবুও আমরা স্পষ্টতই বুঝতে পারি যে ঘটনাগুলি বাস্তবে ধারাবাহিকভাবে ঘটে। অন্য কথায়, আমরা ‘এন্ট্রপি’ পর্যবেক্ষণ করি: শৃংখলা বিশৃংখলায় পর্যবসিত হয়। রোভেলি বলেন, সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি থার্মোডিনামিকসের দ্বিতীয় আইন দ্বারা বর্ণিত হয়েছে, যা বলে যে তাপ সর্বদা গরম থেকে ঠাণ্ডায় যায়। এটি একমুখী রাস্তা। উদাহরণস্বরূপ, একটি বরফ খন্ড একটি গরম চায়ের কাপে গলে যায়, কখনও এর বিপরীত হয় না। রোভেলি প্রস্তাবনা দেন, এই ধরণের ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারে যে আমরা কেবল অতীতকেই বুঝতে পারি, ভবিষ্যতকে না।

গাছের গান’ যখন ‘কলের গানে’


আমরা জনি, কাঠবহুল উদ্ভিদ বা বৃক্ষের কান্ডের অনুভূমিক প্রস্থচ্ছেদ করলে অনেক বৃত্তাকার রেখা দেখতে পাওয়া যায় যেগুলোকে বৃক্ষ-রিং (Tree Ring) বলা হয়। গাছের এই রিংগুলো ‘বৃদ্ধি চক্র’ বা ‘বৃক্ষ চক্র’ বা ‘বর্ষবলয়’ ইত্যাদি নামেও অভিহিত।

বিজ্ঞানের আলোকে এই বৃক্ষ-রিং একটি গাছ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য দিতে পারে। রিং এর সংখ্যা গণনা করে যেমন গাছের বয়স নির্ণয় করা যায় , পাশাপাশি এই রিংগুলি গাছের জীবনকালে তাকে যে সমস্ত পরিবেশগত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিলো তারও আভাস বা নির্দেশ পারে, যেমন- খরা, বৃষ্টি, ঝড়, রোগ, বন আগুন, ইত্যাদি। হালকা রঙের রিংগুলি দ্রুত বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়, অন্যদিকে গাঢ় রিংগুলি এমন সময় নির্দেশ করে যখন গাছটি তত দ্রুত বাড়েনি। গাছের বিভিন্ন অংশের ফালিগুলি ভিন্ন ভিন্ন হয় এবং তারা সকলেই গাছের ইতিহাস সম্পর্কে একটি গল্প বলে।

জার্মানীর মিউনিখে জন্মগ্রহণকারী বার্থোলোমাস ট্র্যাবেক এমন যন্ত্র তৈরি করেছেন যা গাছের রিংগুলিকে টার্নটেবলে বাজিয়ে সঙ্গীতে অনুবাদ করতে পারে। রেকর্ডের পিন বা শলাকার পরিবর্তে তিনি সেন্সর ব্যবহার করেছেন। সেন্সরগুলি কাঠের রঙ এবং টেক্সচার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে এবং একটি অ্যালগরিদম সেই সংগৃহীত তথ্যগুলোকে পিয়ানোয় ভিন্ন ভিন্ন নোটে অনুবাদ বা রূপান্তরিত করে। ট্র্যাবেক পরবর্তীতে 'Years' শিরোনামে নামে একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেন যেখানে সাতটি পৃথক গাছের জীবনের গল্প আছে পিয়ানোর সুরের মূর্ছনায়, যেমন- স্প্রস, অ্যাশ, ওক, ম্যাপেল, ওল্ডার, আখরোট এবং বিচ।

।।লুৎফর রহমান বাবু।।

তথ্যসূত্রঃ কার্লো রোভেলির "দ্য অর্ডার অফ টাইম" এবং কিছু বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ