।।কামাল আহমেদ।।
সান্দ্রো বত্তিচেলি, ভেনাসের জন্ম |
যে-কোন শাখার সৃষ্টিশীল কর্মকারীদের একটা শব্দ "মাষ্টারপিস!'' কারো কাজটি যদি অনন্য হয়---ওটা মাষ্টার পিস-এ পড়ে! কারো সারাজীবনে একটি অনন্য কাজ, অনন্য সৃষ্টি---না-ও হতে পারে! গভীর পরিকল্পনা করে, অসাধারণ সচেতনতা নিয়েও তা হয় না! "মাষ্টার পিস'' হয়ে জানান দেয় যে-- "আমি মাষ্টারপিস''!
মাষ্টার পিস একটা এক্সসিডেন্টাল ব্যাপার! মাষ্টারপিস'' হবার আগে কোন প্রভিভানেরই জানা থাকে না যে এটা তাঁর মাষ্টারপিস হবে বা সে-প্রতিভান বলতে পারে না এটা তাঁর মাষ্টারপিস'' হবে; সে হয়েই রূপ নেয় "মাষ্টারপিস!''
ফ্রান্সিস্কো গয়া |
আদমের জন্ম।সিস্টিন চ্যাপেল।মাইকেলেঞ্জেলো। |
*''হাতুড়ি বাটাল ছেনির পয়মন্তরাযদি উইরোপের শিল্পীর হাতে প্রথম মানব "আদম'' হয়, বলবো আমি-- "এশিয়ার শিল্পীর হাতে হয়েছে মানবী "হাওয়া!'' আর এই কাজ দুটি করেছেন উইরোপের বিখ্যাত ভাস্কর চিত্রশিল্পী মাইকেল এঞ্জেলো, অন্যদিকে আমাদের এশিয়ার--ভারত বর্ষের শিল্পী রাজা রবি ভার্মা!মাইকেলেঞ্জেলো সর্বকালের জন্যই অনন্য চিত্রশিল্পী।
মার্বেলে বন্দী ভাস্কর্যের অন্তরা
মূর্তিমতী মূর্তিমান পলাতক মানবি মানব
মাইকেল এঞ্জেলোর ঘটকালিতে বিয়ে বসে দেবদুতি ও দানব
পাহাড়ে নামে ধ্বস অরণ্যে দাবাগ্নি
অক্টোপাস দেয় নিজমুখে মুখাগ্নি
মরা জেলেদের মাথায় মরা মাছের পোনা
সিস্টিন চ্যাপেলে মাইকেল আকে নগ্নতার আলপনা''*
রাজা রবি ভার্মা |
বিষয় উপস্থাপনে-- জড়তা, আনাড়ি আনাড়ি ভাব কিছু একটু অসামঞ্জস্য, বেখাপ্পা সেখানে পাওয়া যাচ্ছে না, সেরকম মনে হচ্ছে না----সেটাই একটি ভাল কাজ!ছবি সমন্ধে তেমন কিছু বলার নেই! ইচ্ছা আছে, বুদ্ধি আছে, বস্তুর গঠন উপর ধারণা, মিষ্টি রঙ বানাও!কাগজে, কোন তলে-- তুলি ঘোরাতে জানো, ঘোরাতে থাকো উদার চিত্তে; যা-ই শেষে পাবে, তাই হলো ছবি; কে বলে ইহা ছবি, --আমি বলি কে না বলে ইহা ছবি না?
রেনেসাঁর চিত্রে- জমজমাট পরিবেশ, ফিগারে ভরপুর, বিশাল বিশাল বিখ্যাত বিখ্যাত ছবির চেয়ে-- শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন-এর ছবি অসামান্য শক্তিশালী; ওসব চিত্রে-- ড্রইং, রঙে কোথাও ভুল হলে মুছে হাজার বার ঠিক করার পথ থাকে! জয়নুল আবেদীন-এর দুর্ভিক্ষের রেখার ছবি আঁকায় সে পথ ছিল না! যদি কোথাও কোন ফিগারে, কারো গঠনে- একটু গলদ হয়, হতো পুরো ছবিটি বাদ! রেখার ভুল ওখানে মুছে, কাগজ হতে ঘষে তুলে ফেলবার অবস্থা ছিল না---আমি একজন ও পথের হয়ে তেমনটাই বুঝছি! চিত্রে- রেখা, হাত, পা, মুখ আঁকতে, ড্রইং করতে-- যেভাবে প্রথম দাগ দিবে- সেটা সেভাবেই যথার্থ হতে হবে; যদি তা না হয়- ছবি অসুন্দর হবে, সে ছবিটা পুরো বাদ হবে; তা ঠিক করবার কোন সুযোগ ছিল না--নতুন আরেকটি ছবি আঁকা ছাড়া!
গ্রাফিক্সে ভারতের শিল্পী হরেন দাস ও বাংলাদেশের শিল্পী শফিউদ্দীন আহমেদ!
এগিয়ে--পিছিয়ে যা-ই; বাস্তবতা ছেড়ে ফিগার নিয়ে আধুনিক রীতির নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় শফিউদ্দিন আহমেদ সম্পূর্ণই এগিয়ে একা একজন---যেখানে হরেন দাসের উপস্থিতি নেই! হরেন দাস বাস্তবধর্মী ফিগারের গঠন তুলতে অনেক নিখুঁততে গেছেন, যেখানে শফিউদ্দিন আহমেদ কিছুটা নিজের মতো করে, ঠিক কিছুটা মনের মতো করে,মনের মাধুরি মিশিয়ে আছেন;
উডকাট, হরেন দাস |
যত শিল্পী-ই হোক, যত কাজ-ই করুক-; কালো-সাদা উডকাটের একটা বৈশিষ্ট্য সবার কাজে সহসা-ই এসে যায়---সে-হলো থোকা থোকা আলো বেশি অংশ কালো কিংবা কালো রেখে কালো ঘিরে সাদা সাদা তীক্ষ্ণ কাট কাট আলো! চাইলেও, না চাইলেও---সব শিল্পীর কাছে ইহা এসে যায় আপনা আপনি! এরপর আসে সঠিক ভাবে আলো-ছায়া দেখাতে পারা, না পারা; গুলিয়ে ফেলা, আরো সাথে থাকে ত্রিমাত্রিক ফিগারে প্রকৃত অবস্থা, দূর্বলতা, সবলতা, অসমানুপাত এইসব দিক!
দুই দেশের দুইজন; এক সে-দেশ ভারত, আর এক আমাদের এই বাংলাদেশ! শিক্ষার ভূমি অবশ্য দু'জনের এক ঐ-ভারত! ছাপচিত্রের উভয়ে অত্যন্ত ভাল শিল্পী! যে দিক-টায় সাধারণত শিল্পী- দুর্বল থাকে, আশ্চর্য ব্যাপার সে-দিকেই উভয়ে ভাল, দক্ষ; সে ফিগারে!শফিউদ্দিন আহমেদ ছাপচিত্রের স্বনামধন্য অনন্য শিল্পী ছাড়াও এক সত্যিকারের পেইন্টারও তিনি বটে!
ঐতিহাসিক ঘটনার উপর জয়নুল আবেদীন-এর আঁকা ছবি!
আঁকার বহু বিষয় থাকলেও, বহু বিষয়কে আঁকার করে তোলা কঠিন; এমন কি আঁকার উপযুক্ত করতেও বেগ পেতে হয়! একেবারে আঁকা যায় না---এমনও নয়, তবে ছবিটি "নান্দনিক করে'' তোলবার ব্যাপার থাকে তো সেখানেই বড় সমস্যা টা! ইহা শিল্পী ছাড়া কেউ না বুঝে, কারো না বুঝে আসবে! কি আঁকবো, কি আঁকবো!- এই নিয়ে শিল্পীর ভিতরে চিন্তার আন্দোলন চলতে থাকে!
দুর্ভিক্ষের অবস্থা-তো বলতে দৃশ্য রূপেই ছিল উপস্থিত; গ্রামের দৃশ্য, প্রাকৃতিক দৃশ্য তো---সাজানোই থাকে জীবন্ত হয়ে; কেবল দেখে দেখে ওগুলো আঁকা- কাগজে ক্যানভাসে, কিংবা অন্যকোন তলে! অন্যদিকে যার চোখের সামনে সাজানো থাকা নেই, তোলা নেই; যার রূপ কল্পনা করে-- বাস্তব রূপ, চরিত্র, আকার দিতে হয়---নিশ্চয়ই তা চোখের সামনে প্রকৃতির সাজানো, তৈরী-দৃশ্যের চেয়ে কঠিন নয় কি? কারণ, ওটা ভাবতে-- চিন্তা, বুদ্ধি, ধ্যান, বিচারবোধ ব্যবহার করতে হয়, ওসব ক্ষয় করতে হয়---এটাই ওটার আমি বলি দুর্বোধ্য দিক!
ইউরোপের শিল্পীদের হাতে "ঐতিহাসিক ঘটনা'' বিষয়-এর উপর অজস্র ছবি আঁকা থাকলেও, আমাদের বাংলাদেশে ঐতিহাসিক ঘটনার উপর ক্যালেন্ডারের পাতায় রফিকুন নবীর আঁকা কিছু ছবি আর জয়নুল আবেদীন-এর আঁকা "তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা আক্রমণ''এই চিত্রটি ছাড়া আর কিছুনেই বললেই চলে! আমার কাছে এটাই শিল্পাচার্যের-- গভীর ভাবনার ছবি, চিন্তার ছবি, উদ্ভাবনী ছবি। এই চিত্র আঁকতে তাঁকে যত বেশী পেরেশানি--জীবনীশক্তি ব্যয় করতে হয়েছে তাঁর অন্য কোনো ছবি আঁকা নিয়ে মোটেই অত ভাবতে হয় নি! এই ছবির পরিবেশ- তাঁকে কল্পনা করে সৃষ্টি করতে হয়েছে! মানুষের অবস্থা, অবস্থান- তাঁদের নানা কর্ম তৎপরতা সব সব! আমার কাছে খুবই ভাললাগার, সৌন্দর্যপূর্ণ, আবেদন বহুল এক ছবি। এই ধরনের ছবি আঁকতে কারো- স্ব-দক্ষতার দিক অনেক উঁচু হতে হয়!
জয়নুল আবেদীনের শিল্পাচার্য খেতাব এই ছবির মধ্যে প্রমাণ আছে! অন্যের হাতে এই ছবিটি হলে-- হয়তো আনাড়ি ছবি হয়ে যেতো; এমন একটি সুন্দর শিল্প হিসেবে হয়তো পাওয়া যেতো না! শিল্পাচার্য যে শিল্পাচার্য---এবং তাঁর যে নান্দনিকতায় নিজ-বহু উচ্চে উত্তোলন গমন তাঁর আঁকা "বাঁশের কেল্লা'' ছবি তার নিদর্শন! পৃথিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত গালারীতে, বিখ্যাত বিখ্যাত ছবির পাশে-- এই চিত্রকর্মটি শক্তিশালি কর্ম হিসেবে স্থান পেতে পারে; ছবির ছোট ফিগারগুলো ডিটেইল না এঁকেও এত বাস্তব সম্মত, সৌন্দর্য, রুচির, জড়তা মুক্ত করে তুলেছে; অভাবনীয়! ঐ দুর্ভিক্ষের দু' একটি মানব অবয়ব কিংবা একটি গরু এঁকে দেখানোর চেয়ে বড় শিল্পীর প্রমাণ এইছবি আরো বেশী বহন করে!বাঁশের কেল্লার চাঙ্গে মানুষগুলো নিখুঁত নয়, তুলির এলোমেলো দাগে ওদের উচ্ছল করা হয়েছে---এমনটা কোন শিল্পীগুরুর দ্বারাই, শিল্পীগুরুর পক্ষেই সম্ভব!