ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Friday, February 12, 2021

মনোগল্পের কিউবিজম : কবর, সেক্সোলজি এবং অন্তর্নিহিত

।।অমিতাভ পাল।।

কবর

অফিস, বাসা আর স্বার্থের পিছনে ছুটতে ছুটতে কবে যেন এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেছি- যেখান থেকে আর কোথাও যাওয়া যায় না কেবল বাথরুম, ডাইনিং টেবিল আর বিছানা ছাড়া। আমিও আজকাল সেসব জায়গাতেই যাই আর দিনগত পাপক্ষয় করি অফিসে গিয়ে। এর ফলে এখন ফেইসবুকে কিছু আবছা সম্পর্ক ছাড়া আমার কোন বন্ধু নাই, আত্মীয়স্বজন নাই, স্বপ্ন, নাই, কল্পনা নাই, বিস্তীর্ণতা নাই।

সেইসাথে আমার বাসার দুর্ভেদ্যতা বাইরের কাউকে আসতে উৎসাহিত করে না বলে গাছ হয়ে পাখি, পোকা আকর্ষণ করেও নিজেকে ছড়াতে পারিনা। তবে এতে যে আমার খুব অসুবিধা হচ্ছে- তা না। কেননা স্বার্থের সম্মোহনে এমন এক গোপন পথে ছুটছি আমি, যেখানে এক মূহূর্তে অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়া যায় কোন এক সুখের টানে। এখন ওই সুখ আমাকে ছোটাচ্ছে অন্যসব গতিবিধিকে বানচাল করে দিয়ে।

এখন আমি চোদ্দ ঘণ্টা অফিসে আর দশ ঘণ্টা বাসায় থাকি। দুই জায়গাই দেয়াল দিয়ে ঘেরা। অবশ্য এর মাঝখানে অফিস যাতায়াতের সময় কয়েক ঘণ্টা কাটে জ্যামকবলিত রাস্তায় কিন্তু সেটাও ওই ঘেরা জায়গাতেই- গাড়ির কাঁচের দেয়ালের মধ্যে। ফলে এখন সূর্যের সাথেও আমার বন্ধুত্বে ভাঁটা পড়েছে- আমার ত্বকও এখন অচেনা, কুণ্ঠিত, সাদা।

আজকাল আমি স্বপ্নে বর্হিবিশ্ব দেখি। রিসর্টে রাত্রিবাস, রাস্তায় দেখে ভালো লেগে যাওয়া কোন মহিলা, নিজের সম্পাদিত প্রেমের সিনেমা, যৌনতার অক্টোপাস- এসব আমার স্বপ্নবারান্দার টব। আমি একটা ইজিচেয়ারে বসে তাদের সাথে আড্ডা দেই, মার্কিন মদ খাই, কিউবার চুরুট টানি। তালুতে ডলে মিশিয়ে দেই ঢাকার কোন একটা পাড়ার সাথে প্যারিসের মুল্যারুজকে।

দিন এইভাবেই কাটছিল। আর আমিও স্বার্থের বাড়তে থাকা বৃত্তের কুয়ায় ঢুকে যাচ্ছিলাম। ভয় পাচ্ছিলাম পিছনের আলোকোজ্জ্বল কুয়ার মুখটাকে। ওটা আমাকে জড়ো হতে দেবে না। অথচ আমি জড়ো হতে চাইছিলাম আমার সবকিছু নিয়ে। কোনমতে একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলতে পারলেই তাতে ঢোকাতে শুরু করবো আমার যাবতীয় আমিকে। তারপর দরজা বন্ধ করে নিশ্চিন্তে নিজের মুখামুখি বসে আত্মপ্রেমে মগ্ন হবো। আমার একটা দেশ হবে। এখনকার রাজনৈতিক পৃথিবীর কোন আঁচ তাতে লাগবে না, সবার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেবো। এখন আমার সব পরিশ্রম, সব টাকা, সব বিনোদন, সব আকাঙ্খা ওই ফ্ল্যাট। ওটাই আমার বর্ম।
ফ্ল্যাট কিনেছি বছরখানেক হলো। এখন অফিস থেকে ফেরার পরে মাটিতে পা রাখার আনন্দ হয়। এঘর ওঘর ঘুরতে গেলে মনে হয় প্রধানমন্ত্রীর মতো জেলাসফরে গেছি। দরজাটাকে মনে হয় দারোয়ান, জানালাগুলিকে আকাশ আর পুরা ফ্ল্যাটটাকে কোন বিখ্যাত ব্যাংকের নিরাপদ লকার। আজকাল অনেককেই আমার বাসায় আসতে বলি প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে, গৃহস্বামীর গাম্ভীর্য উপভোগ করি বিদায় জানানোর সময় আর সুখের ক্ষুধা নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসি রাতের খাবার খেতে।
তারপর আমি কবরে ঘুমাই।
আমি এখন সেই সন্ন্যাসী, একদিন কবরে থাকতে হবে বলে যে জীবদ্দশাতেই কবরে থাকা অভ্যাস করতো।

১৭/০১/২১
ঢাকা

সেক্সোলজি

বিয়ের পর সব পুরুষই সেক্সোলজিস্ট হয়ে ওঠে স্ত্রীর তত্ত্বাবধানে। কিছুটা গাইনোকোলজিস্টও হয়। যেন বিয়ের আগে তারা মাস্টার্স শেষ করে। তারপর বিয়ের পর পিএইচডির জন্য স্ত্রীকে পায় গাইড হিসাবে। অর্জন করে ডক্টরেট ডিগ্রি।

তারও এরকমই হয়েছিল। এর আগে কাপড়ের অজস্র ফালি জড়ানো একটা মমির মতোই মেয়েদেরকে সে দেখেছিল মিউজিয়ামের তাকে। বিয়ে যেন সেই মমিটাকেই তার টেবিলে তুলে দিয়েছিল প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার কাজে। আঙুলের চিমটা আর চোখের ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে অনেক যত্নে কাপড়ের ফালিগুলি সরিয়ে নগ্ন মমিটাকে বের করে এনে তার মরফোলজি শিখেছিল সে এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি লিখে রেখেছিল মস্তিষ্কের নোট খাতায়। সেসময়ই তার মনে প্রশ্ন জেগেছিল মেয়েদের গুরু নিতম্ব ও ভারি উড়ুর ব্যাপারে। কিন্তু গাইড তাকে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। কেবল বলেছিল- মেয়েদের এরকমই হয়। উত্তরটা তাকে তৃপ্ত করতে পারেনি বলে এরপর সে শুরু করে মেয়েদের শরীর নিয়ে গবেষণা। কিন্তু এরকম গবেষণা যেকোন মানব সমাজেই অসহজ কারণ সব মেয়েইতো আর তার স্ত্রী না। ফলে সে দূর থেকেই রাস্তাঘাটে চলেফিরে বেড়ানো মেয়েদের শরীর দেখতে শুরু করে উত্তরের প্রয়োজনে আর নিজের স্ত্রীর ওপর চলে তার ফলিত গবেষণা। তারপর কোন একদিন আর্কিমিডিসের ইউরেকার মতো সে বুঝে ফেলে- যৌনতার সময় ভার সইতে হয় বলে হাজার বছরের বিবর্তনে মেয়েদের নিতম্ব ভারি এবং মাংসল হয়ে উঠেছে। আর তাদের উড়ু পুরু হয়েছে সন্তানের ভার বইবার জন্য।

এভাবেই অভিজ্ঞতা আর ফলিত গবেষণায় মেয়ে নামের অজানা অচেনা যে বিশাল জগতটা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে আছে- তার ভৌতরূপ স্পষ্ট হয়েছে তার কাছে। যৌবনের শুরুতে এরা ছিল অধরা, রহস্যময় আর রূপকথার মতো। আর বিয়ের পরে এরা হয়েছে মানুষ।

মেয়েরা এটা বোঝে। জানে, ঝোড়ো যৌনতার শেষে তচনচ, এলোমেলো, উন্মোচিত হয়ে যায় তারা। আর তখন কাজ হয়ে যাবার ফলে পুরুষের চোখ থেকে মায়া অঞ্জন উঠিয়ে নেয় প্রকৃতি। শুরু হয় সভ্যতার। এই মায়া অঞ্জনটুকুকে আরেকটু দীর্ঘস্থায়ী করতে, আরেকটু উপভোগ্য করতে মেয়েরা নিজেদের ঢেকে রাখে আগাপাশতলা। উন্মোচনের আলোর চেয়েও রহস্যের ছায়া তাই তাদের প্রিয় প্রসাধন।

তার থিসিস এখন এগোচ্ছে ভৌত থেকে অজৈবের দিকে। ভেঙে যাচ্ছে যুগ্মতার জল, আলাদা হচ্ছে অনু। তাদের বৈশিষ্ট আলাদা, আঁকড়ে ধরবার হাত আলাদা, আলাদা তাপ, চাপ, পরিস্থিতি। অবশ্য তার গাইড দিচ্ছে অন্য পরামর্শ- সন্তান, সংসার, ভবিষ্যত। কিন্তু গবেষণার তথ্য, কল্পনা আর সৃজন অন্য কথা বলছে। বলছে স্থানিক যুগ্মতার ভাঙচুড়ের কথা, একক হয়ে উঠবার কথা। একক ও সম্পূর্ণ। তারপর একক পূর্ণ হলে এক বৃহৎ যৌথতায় তারা লীন হবে- সবাই মিলে তৈরি করবে এক বিরাট পরিবার- সমাজ।

এখন তারা বন্ধুর মতো থাকে। শিক্ষক ও ছাত্রের বন্ধুত্বের মতো, দুই সহপাঠীর বন্ধুত্বের মতো, মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ দুই দেশের মতো। সেখানে ঝগড়া আছে, মিল আছে, মমতা আছে, আনন্দ আছে, বিষণ্নতা আছে, ফাঁকি আছে এবং নিজের নিজের শরীরকে তৃপ্তি দেয়ার যৌনতাও কখনো কখনো আছে। সেখানে আত্ম আর বহিঃপ্রেম একসাথে জেগে ওঠে ফলে আমরা হয়ে যায় আমি বা আমি হয়ে ওঠে আমরা।
সে এখন নিজের নামের আগে ডক্টর লিখতেই পারে।

৩০/০১/২১

ঢাকা


অন্তর্নিহিত

বিয়ের পর অনেকগুলি বছর কেটে গেছে। এখন আর একদেশদর্শী যৌনতায় সেই প্রাবল্য নেই, নেই তেমন ক্ষুধাও। যদিও বিয়ের আগের কিছু প্রেমের স্মৃতি অ্যালবামের মতো মাথার ভিতরে গাঁথা ছিল, কিন্তু তারাও এখন রঙ জ্বলে যাওয়া বিবর্ণ সাদাকালো ছবির মতো। তাতে মুখই স্পষ্ট চেনা যায় না, অঙ্গসংস্থানতো দূরস্থান। তাই বউয়ের সঙ্গে বিছানায় বা স্মৃতির সঙ্গে বাথরুমে- কোথাও নিজের স্ফুর্তি খুঁজে পায় না সে। ফলে কেমন যেন মিয়িয়ে যাচ্ছিল তার জননযন্ত্র, হতাশায় সবসময় মাথা নীচু করেই রাখতো সেটা। সে নিজেও ছেড়ে দিচ্ছিল সব আশা, গুছিয়ে নিচ্ছিল শেষ হয়ে যাওয়া জীবনের অর্জনের ছোট্ট পোটলাটা। এবার মৃত্যুর পথে রওনা হলেই হয়।

এমনিতে তার অভ্যাস একটু গা বাঁচিয়ে চলার। ফলে রাস্তাঘাটে
কিংবা অফিসে মেয়ে কিংবা ছেলে- পারতপক্ষে কারো সাথেই তার শরীরি সংঘর্ষ হয় না। নিরাপদে, নিজের পথে একলা হাঁটে সে। কিন্তু আজ হঠাৎ কোন এক সিঁড়ি বাইবার সময় এক মেয়ের সাথে ধাক্কা লেগে গিয়েছিল। তবুও তাতে কোন সমস্যা ছিল না কেননা জীবন গুটিয়ে নেয়া এবং নিজের মধ্যে থাকা তার কাছে ওই ধাক্কাটা নিছক জড়রূপেই দেখা দিয়েছিল। একসময় সেটা ভুলেও গিয়েছিল সে। বিকালে অফিস শেষে বাসায় ফিরে নিজের জগতে ডুবেও গিয়েছিল। কিন্তু রাতে ভাতটাত খেয়ে শোবার আগে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে যখন সিগারেট খাচ্ছে- হঠাৎ ওই ধাক্কাটার কথা মনে পড়ে গেল। আর মনে পড়ে যাবার সাথেসাথে সে যেন স্পর্শটা পেলো আবার। সত্তরভাগ নরম এবং তার ভিতরে ডুবে থাকা তিরিশভাগ কাঠিন্য নিয়ে হাজির হওয়া স্পর্শটা আরো অনেক খুঁটিনাটি মনে করিয়ে দিচ্ছিল তাকে। সাথে আবহের মতো হাজির হচ্ছিল একটা মিহি সুগন্ধ।

একেবারে ঝকঝকে নতুন আর টাটকা ওই স্মৃতিটা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল যৌবনের দিনগুলিতে। সেসময় অবশ্য গা বাঁচিয়ে চলতো না সে বরং অপরিসীম কৌতুহলে মেয়েদের খুব কাছ দিয়ে হাঁটতো যাতে ওদের স্পর্শ পায়। আর যেসব স্পর্শ সে পেতো, তাদের যত্ন করে রেখে দিত নিজের শরীরে- এমনকি স্নান পর্যন্ত করতো না যাতে সেসব ধুয়ে না যায়। এখন এই টাটকা স্পর্শের স্মৃতিটা সেইসব স্পর্শগুলির কথাও তাকে মনে করিয়ে দিতে থাকলো একের পর এক। সাদাকালো বিবর্ণ ছবিগুলি হয়ে উঠলো রঙিন। তবে প্রাবল্য ছিল নতুনটারই এবং বাকিগুলি ফিলারের কাজ করছিল।

এবার নতুন স্পর্শটার পিছনের মেয়েটার কথা মনে পড়লো তার। মনশ্চক্ষে দেখতে পেলো শাড়ি দিয়ে হালকা পাতলা শরীরটাকে মুড়িয়ে রাখা মেয়েটা বয়সের একেবারে মধ্যগগণে সূর্যের মতো জ্বলছে। তাতে আকাশের মতো ঝকঝক করছে তার ত্বক, চোখের তারায় ব্ল্যাকহোল, সীমার মধ্যে বাঁধা পড়েছে অসীম স্তন আর নাভিসমেত কোমরের খাঁজ যেন উল্কার আঘাতে গর্ত হওয়া চাঁদের কোন মসৃণ উপত্যকা। তার ইচ্ছা করলো মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে, আদরে আদরে বিবশ করে দেয়, ভূপৃষ্ঠের পোশাক সরিয়ে বের করে আনে গ্রহের ভিতরের উত্তপ্ত ও গলিত আগুন এবং তারপর তাতে নিজে পুড়ে যায়।

হাতের সিগারেটটা তখনো জ্বলছিল। কিন্তু হঠাৎ সে টের পেলো তার মাথা নীচু করে থাকা হতাশ জননযন্ত্রে যেন এক নতুন রক্তের ধারা এসে হাজির হয়েছে এবং তার উত্তপ্ত স্রোত জাগিয়ে দিয়েছে ম্রিয়মাণ পেশীটাকে। সিগারেটটাকে অ্যাসট্রেতে ফেলে সে বাথরুমে গেল এবং এক নতুন যৌনতার স্বাদ নিয়ে ফিরে এলো বিছানায়। এরপর রাতটাকে সে পার কডরলো এক ঘুমে।
ইদানিং একটা নতুন যৌনজীবন কাটাচ্ছে সে। একা একা, খুব সন্তর্পণে।

৩/০২/২১
ঢাকা

।।অমিতাভ পাল।।


অলঙ্করণ : আইওনা ভাউত্রা/Iona Vautrin 'কামাসুত্রা' কমিক ইলাস্ট্রেশান।