ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Thursday, February 11, 2021

দীপা হক : মগ্ন চেতনা প্রবাহের জলপ্রপাতে

।।মাসুদা কাজী।।কাজী রকিব।।
দীপা হক, ১/৭/১৯৫৩, ৪/০১/১৯৯৯

"রওশন হক দীপা। আমার প্রিয় দীপা’পা। শিল্পী দীপা হক। ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৮৪ সালে। পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই ওঁকে আমার খুব ভালো লেগে যায়।ভালো লাগার মতোই একজন মানুষ। যেমন দেখতে সুন্দর, আকর্ষণীয় এক মানুষ, তেমনি তাঁর কাজের দক্ষতাও অসাধারণ আর উন্নত মানের পরিচয় দিত।

শিল্পী, দীপা হক
দীপা’পার সঙ্গে আমার পরিচয়ের সুযোগ ঘটে আমার স্বামী শিল্পী কাজী রকিবের সৌজন্যে। কাজী রকিব ও দীপা’পা সহপাঠী ছিল। ওঁরা একে অপরের সঙ্গে দীর্ঘ ২৭ বছরের বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিল। কাজী রকিবের বউ হিসেবেই নয়, আমার সঙ্গে দীপা’পার বন্ধুত্বও একই রকমের হয়েছিল।

আমার এই ভালো লাগার মানুষটির যে কী হলো! ১৯৯৭ সালের দিকে দীপা’পা একদিন হঠাৎ আমাদের দুজনকে টেলিফোনে ওঁর অসুখের খবরটা জানিয়েছিল। আমরা এই খবর পেয়ে ওঁর বাসায় ছুটে গিয়েছিলাম। দীপা’পার স্বামী কায়সার ভাইও বিষয়টা নিয়ে আমাদের সঙ্গে মানসিকভাবে ভাগাভাগি করল। একে একে দীপা’পার সব ভাইবোনও।তারপর দেশে-বিদেশে অনেক চিকিৎসকের কাছে ছোটাছুটি শুরু হলো।

বড় বড় চিকিৎসকও দেখানো হলো। মনে হচ্ছিল ভালোই চিকিৎসা চলছিল। বিদেশেই সার্জারি করানো হলো। কেমোথেরাপিগুলো ঢাকায় দেওয়া হলো। কেমোথেরাপির সময়গুলোতে ওঁর অনেক কষ্ট হয়েছিল। আমি জানি, কেমোথেরাপির পরের দিন থেকেই শরীরের ভেতর কী যন্ত্রণার উদ্বেগ হয়—কারণ, অল্প কিছুদিন আগে আমিও এই কষ্ট ও যন্ত্রণার মধ্যে ভ্রমণ করে ফিরে এসেছি স্বাভাবিক জীবনে। সৃষ্টিকর্তার কাছে তাই আমি খুবই কৃতজ্ঞ।
শিল্পী, দীপা হক

দীপা’পার সময়ে এই চিকিৎসাপদ্ধতি ছিল অনেক কষ্টের। এই কষ্টের মধ্যেও দীপা’পা বিভিন্ন রকমের বই খুঁজে খুঁজে পড়ত। ক্যানসারের কত ধরনের উন্নত চিকিৎসার গবেষণা চলছে, এই সব বই পড়ে পড়ে ওঁ আমাদের শোনাত। আমার খুব মনে পড়ে—দীপা’পা আমাদের দুজনকে ওঁর দুই পাশে বিছানায় আমাদের দুই হাত চেপে ধরে বসে থাকত। তখন একটা কথা আমাদের দীপা’পা বলেছিল, ‘তোরা একদিন দেখবি, এই চিকিৎসা এত উন্নত হবে, শুধু ট্যাবলেট খেলেই কেমোথেরাপির কাজ হয়ে যাবে।’

দীপা’পার সময়ে যদি এই উন্নত চিকিৎসাপদ্ধতি থাকত, তাহলে হয়তো আমরা এই ভালো মানুষটিকে, গুণী শিল্পীকে হারাতাম না। 'দীপা’পা—তুমি যেখানেই থাকো, খুব ভালো থেকো'।"

মাসুদা কাজী
২৭/০৬/১২


ওপরে বা দিক থেক, উত্তম দে, কাজী রকিব, সুকুমার পাল।
মাঝে বা দিক থেকে, নজরুল হোসেন, তরুণ ঘোষ, বিমল বণিক।
মাঝে কালো পটভূমিতে দীপা হক।
নিচে বা দিক থেকে মাসুদুল আলম, ফাউজুল কবির, শাহনাজ নাসির কুহু।
সৌজন্য, সুকুমার পাল।

নিউইয়র্ক - ঢাকা তারিখে হেরফের হয়ে যায়। এখন নিউইয়র্কে ৪ জানুয়ারী ঢাকায় ৫ হয়ে গেছে। ৪ জানুয়ারি ১৯৯৯ দিপা ( দিপা হক>রওশন হক ) চলে গেলো পরপারে। দুই বছর ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে। ওই আমার কাছের কারো প্রথম দেখা ক্যান্সার। দিল্লী থেকে ফিরে এলো যখন এয়ারপোর্টেই কথা দিয়েছিলাম প্রতিদিন যাবো ওর বাসায়, আমি আর মাসুদা তাই করেছিলাম যতদিন উত্তরায় ছিলো।

খুব বেশি ভাগ্য থাকলে দিপার মতো বন্ধু মিলে। আমার সাথে দেখা ১৯৭২ জুন/জুলাই আর্টকলেজে ভর্তি পরীক্ষার দিন। সেই থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত অটুট ছিলো। ক্লাসে, মোহাম্মদপুরের বাসায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রেনে, ফরেস্টহিলের বাসায়, জুবিলি রোডের উত্তমদের বাসায় , মোমেন বাগের বাসায় , ডিওএইচএসের বাসায়, উত্তরায় আমাদের বা ওদের বাসায় আমার বহু স্মৃতি। যোজন গ্যালারির সময় গুলি সবই স্মৃতি এখন।

পাশে থাকতাম না শুধু ড্রইং ক্লাশে, সাহস হতোনা। দুর্দান্ত ড্রইং করতো। ঢাকা পেইন্টংসের প্রদর্শনীর আগে ছবি আঁকা, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়া নিয়ে তরুণ, নজরুল , সুকুমারের সাথে দিপার ফরেস্টহিলের বাসা থেকে প্রায় প্রতিদন ট্রাংককলে কথা বলা, কত কি স্মৃতি।

আমাদের সময়ে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের একজন উল্লেখযোগ্য শিল্পী দিপা হক। মাঝে অজানা কারনে দিপা চুপচাপ ছিলো আঁকায় কয়েক বছর। আবারও ফিরে এসেছিলো তীব্র উজ্জ্বলতায়। মাত্র ৪৬ বছর আয়ু নিয়ে এসেছিল।

কাজী রকিব

৫/০১!২১

দীপা হক

দীপা হকের জন্ম ঢাকাতে, ৭ই জানুয়ারি  ১৯৫৩ সালে।১৯৭৮ সালে ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ।বারোদার এম, এস, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেইন্টিংএ স্নাতকোত্তর।১৯৮৭র গ্রীষ্মকালে আবাসিক শিল্পী হিসেবে যোগ দেন নিউ ইয়র্কের সারাটোগা স্প্রিং এর স্কিডমোর কলেজে।তাকে বলা যেতে পারে ক্ষুধার্ত, সতৃষ্ণ একজন শিল্পী।

ক্যানসার নির্ণয় এবং প্রচণ্ড যাতনাদায়ক কেমোথেরাপির পর বেশ কয়েকটি আত্মপ্রতিকৃতি আঁকেন।শিল্পের তত্ব ও সমালোচনার প্রতি আগ্রহী ছিলেন, তা নিয়ে স্থানীয় পত্রিকায় লিখতেন, দা লন্ডন ম্যাগাজিনেও তার লেখা ছাপানো হয়েছে।আর্ট নামে বাংলাদেশে সেসময় একমাত্র চতুর্মাসিক ফাইন আর্টস ম্যাগাজিন শুরু করেছিলেন।তার সময়ের সবগুলো এশিয়ান বিএনাল প্রদর্শনীতে অংশ নেন।শেষ একক প্রদর্শনী হয় ১৯৯৮সালে, ঢাকা শিল্পকলা একাডেমি গ্যালারিতে, মৃত্যুর এক বছর আগে, এখানে তার নির্বাচিত কাজগুলো প্রদর্শিত হয়।শিল্পকলা একাডেমি এ-উপলক্ষে দীপা হক নামে একটি বই প্রকাশ করেছিল।তরঙ্গ