ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Thursday, February 18, 2021

লোকটা কি তাহলে বিড়ালের অবতার!

জীবনানন্দ বিচিত্রা, ১২২ তমো জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ 

।।বিনয় মজুমদার।।চয়ন খায়রুল হাবিব।।শঙ্করলাল ভট্টাচার্য।।ক্লিন্টন  বুথ সিলি।।

।।ফারুক মঈনউদ্দীন।।লুবনা ইয়াসমিন।।নাসরিন-জয়া হক।।

জীবনানন্দ দাশ, ১৭ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯, ২২ অক্টোবার, ১৯৫৪

ধূসর জীবনানন্দ

ধূসর জীবনানন্দ, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে
কতিপয় চিল শুধু বলেছিল, ‘এই জন্মদিন’

এবং গণনাতীত পারাবত মেঘের স্বরূপ
দর্শনে বিফল বলে ভেবেছিল, অক্ষমের গান।
সংশয়ে, সন্দেহে দুলে একই রূপ বিভিন্ন আলোকে
দেখে দেখে জিজ্ঞাসায় জীর্ণ হয়ে তুমি অবশেষে
একদিন সচেতন হরিতকী ফলের মতন
ঝরে গেলে অকস্মাৎ, রক্তাপ্লুত ট্রাম থেমে গেল।
এখন সকলে বোঝে, মেঘমালা ভিতরে জটিল
পুঞ্জীভূত বাস্পময়, তবুও দৃশ্যত শান্ত, শ্বেত,
বৃষ্টির নিমিত্ত ছিল, এখনো রয়েছে, চিরকাল
রয়ে যাবে, সংগোপন লিপ্সাময়ী কম্পিত প্রেমিকা-
তোমার কবিতা, কাব্য;সংশয়ে সন্দেহে দুলে দুলে
তুমি নিজে ঝরে গেছ হরীতকী ফলের মতন।


বিনয় মজুমদার


লোকটা কি তাহলে বিড়ালের অবতার 

ইঁদুর হত্যার অনুশোচনায় অক্ষরবৃত্তের চলন্ত ট্রামের সামনে

বার বার থমকানো লোকটা কি তাহলে বিড়ালের অবতার


বিড়ালটা সাদা না কালো

তাতে আর কারো কিছু এসে যায় না

ইঁদুর মারতে পারলেই হলো


কখনো বুদ্ধিস্ট কখনো কমিউনিস্ট কখনো ক্যাপিটালিস্ট

নয়া নিরামিষাশী বিড়ালের চোখে

রাত খুলে দিলো তার দৃষ্টি গন্ধ আর বর্ণনার ক্ষমতা

বিড়ালের নাই দৃশ্যকল্পের পারঙ্গমতা

তাই সে নিলো মানুষের স্নায়বিক সবলতা ও দুর্বলতা 


বাস্তেত বিড়ালিশ্বরির অবস্থান পাও প্রাচীন মিশর

আর কি চাও

বিড়ালের নয় বছর মানুষের নিরানব্বই বছর

সম‍য়ের দিয়াশলাই বাক্স এতো তাড়াতাড়ি ফুরাও

বাস্তেত নয় বার মরে আর এগারো বার জন্মগ্রহণ করে

ইঁদুরেরাও থাকে লোমে লোমে বালুতে ঈকারসমেত অদৃশ্য ঈশ্বরকনিকায় 

জ্বলন্ত চোখগুলা বদলায় নক্ষত্রের মেলায় স্পেসের মহাধুলায়

ইঁদুরকে বিড়াল খায়

না কি ইঁদুরের সাথে অসবর্ণ রতিক্রিয়ায় আরো দীর্ঘ জীবন চায়


ইঁদুর পুরুষ চেনে বিড়ালী রমণীর বলিউড

বিড়াল পুরুষ চেনে ইঁদুর রমণীদের হলিউড 

সখ্যতার তুমুলে নীল সিনেমার তুলতুলে প্রতিপক্ষ

সেচ্ছাসেবী ভক্ষ ঘটনাটা টুইটার-নীল নৃশংস রমণের


রমনা পার্কে এলান পোর কালো বিড়ালের স্মার্ট ফোনে 

গলায় বাঁধা ঘণ্টির টুং টুটুং তুলে বোদলেয়ারের গথিক ময়দানে

জীবনানন্দের কাছে চেনা পরিবেশ অচেনা ঠাওর

জয়নুলের ক্যানভাসে এক গগনবিদারী মন্বন্তর   

সত্যজিতের অশনিসংকেত ঋত্বিকের যুক্তি তর্ক গপ্পো

মিয়াও মিয়াও বদলালো মাওয়ের তত্বযন্ত্রনার থাবায় 

ছেলেমেয়েদের এক পোশাক এক ভঙ্গিমায় মাথার চুল কাটাও

ইঁদুর বিড়াল হাড়ে হাড়ে জানে তাদের দেহছন্দের জিনে

পরস্পরের বেচে থাকবার আদিবাসী একতারা সংগ্রাম

তুমুল সহবাসে দোতারার টেনশান স্টাফ নোটেশান বদলায় 

  

অক্ষরবৃত্তের ভারি ট্রাম গিয়ার বদলাতে না পেরে রেখে যায় ধাক্কা

লাশকাটা ঘর থেকে মহাশুন্যশাটল ছুটে যায় দিক্বিদিক

আমার কবিতার ভাঙ্গা বয়ানে জাগে মহাভংগুর এক ভাঙ্গা লিরিক


জাগে সেই অমোঘ প্রশ্ন আবার :

ইঁদুর হত্যার অনুশোচনায় অক্ষরবৃত্তের চলন্ত ট্রামের সামনে 

বার বার থমকানো লোকটা কি তাহলে বিড়ালের অবতার


চয়ন খায়রুল হাবিব

১৭/০২/২১

ব্রিটানি, ফ্রান্স

সনেট : জীবনানন্দকে ধরো কালো জাম বিনয়কে ধরো কালো ভ্রমর


কবি কুসুমকুমারী দাশ,
জীবনানন্দ দাশের মা
জীবনানন্দ দাশের মা, বাবা ও রসবোধ

মা, বাবাকে নিয়ে জীবনানন্দ কোন কবিতা লেখেন নি, আত্মজীবনী লেখা না হলেও নিজের বাবা ও মা’কে নিয়ে সুন্দর একটা প্রবন্ধ রেখে গেছেন, যার শিরোনামাটিও সরল— ‘আমার মা বাবা’।
শুরুটাও সরল— ‘‘আমার মা শ্রীযুক্তা কুসুমকুমারী দাশ ১৩… সালে ২১ শে পৌষ বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাঝে মাঝে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার কথা লিখে রাখতেন মনে পড়ে। তার পরে কলেজে উঠেও তাঁকে কোনো কোনো সময় তাঁর নিজ জীবন ও নানা বিষয় সম্পর্কে ধারণা ভাবনা লিখে রাখতে দেখেছি। সে সব লেখা কোথায় তিনি রেখে দিয়েছিলেন— কিংবা নিজেই ছিঁড়ে ফেলেছেন কিনা কিছুই জানি না। তাঁর কয়েকটি অপ্রকাশিত কবিতা ছাড়া অন্য কোনো লেখা আমাদের কারো কাছে নেই। এখন সে সব কবিতাও খুঁজে পাচ্ছি না।’’
এই মায়ের ওপর নির্ভরতার একটা মিষ্টি ছবি আছে ছাত্রাবস্থায় হার্ডিঞ্জ হস্টেলে থেকে ওঁকে লেখা জীবনানন্দের একটি চিঠিতে। লিখছেন:
‘‘Golden Treasuryটা পাঠাইতে লিখিয়াছিলাম, পাঠাইয়া দিও। আমার Hostel ও Law College-এর টাকা এখনও আসিতেছে না কেন? তা ছাড়া বইর জন্য ৫০ টাকা পাঠাইতে হইবে।… Paradise Regained আমাদের পাঠ্য। আগে কিনি নাই। আজকাল তো পাওয়া যাইতেছে না। জিতেন মুখার্জ্জীর বইটা থাকিতে পারে। ভুবন যদি তাহার নিকট হইতে সেই বইটা এবং Scott-এর নভেলের তিনটা (Kenilworth, Old Morality, Talisman) লইয়া আসে তাহা হইলে ভাল হয়।’’
বাবা সম্পর্কে জীবনানন্দের বিচারটা এমন ছিল:
‘‘একমাত্র জ্ঞানযোগই যে বাবার অন্নিষ্ট ছিল সে কথা সত্য নয়; কিন্তু মধ্যবয়স পেরিয়েও অনেক দিন পর্যন্ত সাহিত্য শিল্প বিজ্ঞান এমনকি গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চ্চায় তাঁকে প্রগাঢ় হয়ে থাকতে দেখেছি মানুষের জীবন ও চরাচর সম্বন্ধে যত দূর সম্ভব একটা বিশুদ্ধ ধারণায় পৌঁছবার জন্যে, নিজের হিসেবে পৌঁছতে পেরেছিলেন তিনি। উচ্ছ্বাস দেখিনি কখনো তাঁর, কিন্তু জীবনে অন্তঃশীল আনন্দ স্বভাবতই ছিল— সব সময়ই প্রায়। কিন্তু গদ্য লেখা ছাড়া বাবা সাহিত্য সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেননি, কিন্তু পাঠ করেছিলেন অনেক, আলোচনার প্রসারে ও গাঢ়তায় আমাদের ভাবতে শিখিয়েছিলেন— দৃষ্টি তিনিই খুলে দিয়েছিলেন।’’
নাতিদীর্ঘ এই রচনা থেকে জীবনানন্দের চিন্তা ও চলনের উৎসমুখ শনাক্ত করা অসুবিধের না। এই প্রবন্ধ এবং ‘লেখার কথা’, ‘কেন লিখি’, ‘কবিতা সম্পর্কে’ শীর্ষক রচনাত্রয়ী এবং ওঁর চিঠিপত্র, দিনলিপি ও কবিতার বইগুলো মিলিয়ে পড়লে কবির একটা আত্মজীবনী পড়া হয়ে ওঠে।
বোন সুচরিতা দাশের বিবরণে জানা যাচ্ছে কী ‘ভীষণতম হিংস্র দুর্দিন’ ঘনিয়ে আসায় সাধের বরিশাল ছাড়তে হয়েছিল কবিকে। কিন্তু তাতেও তাঁর ‘এষণাশক্তি, ভাবনাপ্রতিভা, mother wit’ (কথাগুলো কবির থেকেই নেওয়া) বিস্রস্ত হয়নি এতটুকু।
সুচরিতা লিখছেন: ‘‘বাইরে থেকে যাঁরা তাঁকে দেখেছেন তাঁরা তাঁকে গম্ভীর নির্জন, স্বপ্নালোকবাসী বলেছেন, বলেছেন সর্বক্ষণ একটা অদৃশ্য বেষ্টনী তৈরি করে তাঁর নিজের চারিদিকে তিনি সবার থেকে আলাদা হয়ে থাকতেন। …
যে মানুষ অত গুরুগম্ভীর কবিতা লিখতেন, তিনি যে অমন চারিদিক উচ্চকিত করে প্রকম্পিত হাসি হাসতে পারতেন, বা অন্যকেও হাসিয়ে হাসিয়ে ক্লান্ত করে দিতে পারতেন, তা যেন না দেখলে বিশ্বাস করাই যায় না।’’
জীবনানন্দ ও স্ত্রী লাবণ্য বিয়ের আসনে
জীবনানন্দের যাবতীয় রচনার সাক্ষ্যে একটা ভয় কিন্তু থেকে যায়। তা হল আত্মজীবনীটা লিখে ফেললেও নিজের witty, কৌতুকপ্রিয় সত্তাটাকে সেখানে মেলে ধরতেন কিনা। এখানেও তুলনাটা এসে পড়ে অন্য নির্জন কবি কিটসের। যাঁর চরিতের জীবনোচ্ছল ছবিগুলোর জন্য নির্ভর করতে হয় সমসাময়িক ও জীবনীকারদের বৃত্তান্তে। আমাদের সৌভাগ্য জীবনানন্দের এরকম একজন ছিলেন অরবিন্দ গুহ, যিনি অগ্নিমিত্র নামে চমৎকার রসরচয়িতা হয়েছিলেন পরে। তাঁর বর্ণিত জীবনানন্দের কতিপয় রসিক ছবির একটি দিয়ে শেষ করব।—
‘‘সিনেমায় গান লেখার ব্যাপারে একদা জীবনানন্দ কিঞ্চিৎ আগ্রহী হয়েছেন, তিনি আমাকে এক দিন জিজ্ঞেস করলেন— সিনেমায় গান লিখলে নাকি অনেক টাকা পাওয়া যায়? তুমি কিছু জানো এ বিষয়ে?
আমি জানি না এমন কোনো বিষয় জগতে নেই, আমি সর্বজ্ঞ— আমার নিজের মতে। সর্বজ্ঞের গলায় বললাম— হ্যাঁ, আমিও শুনেছি সিনেমায় গান লিখলে অনেক টাকা পাওয়া যায়।
তিনি বললেন— আমি লিখতে পারি না?
বললাম— নিশ্চয়ই পারেন।
—আমাকে কী করতে হবে?
—বাংলা সিনেমার পরিচালক হিসেবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের খুব নামডাক, প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
জীবনানন্দ বললেন— খুব ভালো,
বললাম— তা হলে আর কী কথা? তাঁকে বলুন। উনি অনায়াসে একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।
দিন কয়েক বাদে আবার রাসবিহারী এভিনিউতে দেখা। জিজ্ঞেস করলাম— প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে দেখা করেছিলেন?
জীবনানন্দ বললেন— না, এ বার করে ফেলব।
ইতিমধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা করেছি— সর্বজ্ঞের অনেক দায়। আবার রাসবিহারী এভিনিউতে দেখা। বললাম— প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে…।
জীবনানন্দ বললেন— না, এখনও ঠিক হয়নি, কিন্ত এ বারে আর দেরি করব না।
বললাম— থাক, এ ব্যাপারে প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে দেখা করার দরকার নেই। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
জীবনানন্দ বললেন— খুব ভালো।
আমি তুড়ি মেরে বললাম— তা হলে আর কথা নেই। ওঁকে বলুন সিনেমার ডিরেক্টর হিসেবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের চেয়ে ওঁর দাপট অনেক বেশি। তা ছাড়াও একটা কথা আছে।
জীবনানন্দ আগ্রহী হলেন— কী কথা?
বললাম— প্রেমেন্দ্র মিত্র নিজেই সিনেমার গান লেখেন, কিন্তু শৈলজানন্দ নিজে সিনেমার গান লেখেন না। এই অবস্থায়…
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে জীবনানন্দ বললেন— বুঝেছি, আর বলতে হবে না। আমি শিগগিরই শৈলজাকে বলব।
বলব— ঠিক আছে।
দশ-বারো দিন বাদে আবার রাসবিহারী এভিনিউতে এক দিন। নির্ঘাত শৈলজানন্দের সঙ্গে কথা বলেছেন?
জীবনানন্দ বললেন— না, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
বলে আমাকে নিয়ে গেলেন ফুটপাথের এক পাশে। সেখানে সাবধানে গোপন কথা বললে আর কারও শোনার আশঙ্কা কম। বললেন— শৈলজার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলিনি কেন জান?
বললাম— না। কেন?
খুব হতাশভাবে বললেন— যদি শৈলজা আমার জন্য কোথাও একটা ব্যবস্থা করে দেয় তা হলেও আমি কেমন করে লিখব, ‘রাধে-এ-এ-এ ঝাঁপ দিলি তুই মরণ যমুনায়’।
এখনো আমার মনে গেঁথে আছে চোখমুখের সকৌতুক ভঙ্গির সঙ্গে জীবননান্দের গলায়— রাধে-এ-এ-এ…
বলা বাহুল্য হলেও বলা দরকার, ইহজন্মে সিনেমার গান লেখার সৌভাগ্য জীবনানন্দের হয়নি,’’
মৃত্যুশয্যায় এই জীবনানন্দকে দেখে অরবিন্দর মনে হয়েছিল যেন নীচের ঠোঁট কামড়ে দুরন্ত হাস্যস্রোতকে ঠোঁটের ওপারে বন্দি করে রেখেছেন। হয়তো খানিক আগেই সেই নিজস্ব হাসি হেসেছেন। নাকি একটু পরেই হেসে উঠবেন প্রচণ্ড শব্দে?
(লুবনা ইয়াসমিন, ফেসবুকে জুলেখা সিরাপ ফাইল থেকে, জীবনানন্দ সমগ্র অবলম্বনে শঙ্করলাল ভট্টাচার্য)
জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথের সাথে।
জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথকে বেশ কয়েকবার লম্বা, লম্বা চিঠি দিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ উত্তর সেরেছে
কয়েক লাইনে।একটি উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছে,
''তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এতো জবরদস্তি করো কেনো বুঝতে পারি নে।'
আরেকটি আরো কম শব্দের উত্তরে
রবীন্দ্রনাত জীবনানন্দের কবিতাকে 'চিত্ররুপময়' বলেছে।
জীবনানন্দ 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামে পাচটি কবিতা লিখেছিল যেগুলো গ্রন্থবদ্ধ না হলেও
সঞ্জয় ভট্টাচার্য,  সুধীন দত্ত ও জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র সম্পাদিত সাহিত্য পত্রে প্রকাশিত হয়।

ক্লিন্ট বি সিলির ‘অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট’ :
বনলতা সেন
‘কবিতা’ পত্রিকার ডিসেম্বর ১৯৩৫ সংখ্যায় প্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের চারটি কবিতার একটি ‘বনলতা সেন’, যেটা পরিণত হয় তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতায়। বেশ কজনের হাতে এটার শিল্পসম্মত ইংরেজি তর্জমা হয়েছে। মূলত জীবনানন্দ নিজেই এটা অনুবাদ করেছিলেন; তুলনার জন্য আমার নিজের অনুবাদটা করি তার পর (যদিও দুটো অনুবাদ লক্ষণীয় রকম ভিন্ন ছিল, দুটোই করা হয় মূল কবিতা থেকে_জীবনানন্দ তাঁর কাব্যিক স্বাধীনতা প্রয়োগ করেছিলেন)।
সিংহল (বর্তমানে শ্রীলঙ্কা) এবং মালয়ের পরিচিতি নিষ্প্রয়োজন। বিম্বিসার ও অশোক একদা প্রাচীন ভারতের শাসক ছিলেন। বিদর্ভ, বিদিশা, শ্রাবস্তীর মতোই নগর, যেখানকার কারিগরদের ছিল চমৎকার দক্ষতা। এদিকে নাটোর বাংলাদেশের একটা সাধারণ ছোট মফস্বল শহর; আর বনলতা সেন, শুধু একজন রমণীর নাম। ওর প্রকৃত পরিচয় অনুমান করা সাহিত্যরসিকদের একটা প্রিয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যা হোক, সবার জানা মতে বনলতা সেন কোনো বাস্তব চরিত্র নয়। এর গুরুত্ব নিহিত নামটির সাধারণত্বে; সেন বলতে বৈদ্য গোত্র বোঝায়, যেটি জীবনানন্দেরও গোত্র। অন্য বাংলা নামের মতো বনলতারও রয়েছে একটা আক্ষরিক অর্থ। নামটির অর্থ বনের লতা, যা রূপসী বাংলার নৈসর্গিক পরিবেশের প্রতি জীবনানন্দের প্রবণতার কারণে তাঁকে প্রলুব্ধ করতে পারে।
জীবনানন্দ তাঁর সবচেয়ে নিশ্ছিদ্রভাবে রচিত কবিতাগুলোর একটি উপস্থাপন করেছিলেন ‘বনলতা সেন’-এ। বাংলা ছন্দের প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে সাধারণ পর্যায়ের ওপরই নির্ভর করেছেন তিনি। তিন পঙ্ক্তির স্তবকেরঃপ্রতিটি স্তবক পাঠকের মনোযোগকে বিশাল থেকে ক্ষুদ্রতে সংকীর্ণ করে আনে। একইভাবে তিনটি স্তবকই তুলনামূলকভাবে বড় থেকে ছোটর দিকে চালিত মনে হয়। প্রথম স্তবকে বিশ্ব থেকে সমুদ্র, রাজ্য, নগর হয়ে আমরা যাই মূল লক্ষ্যবিন্দু এক রমণীর কাছে। দ্বিতীয় স্তবকে আবার রাজ্য থেকে এক ব্যস্ত বাণিজ্যিক নগরী, এক দ্বীপ হয়ে আমরা আবার সেই রমণীর কাছে পেঁৗছাই। তৃতীয় স্তবকে আমরা আরো একবার একটা সম্পূর্ণ দিন থেকে সন্ধ্যার প্রারম্ভ, তারপর সেই দিনের শেষ এবং তার সমস্ত আয়োজন হয়ে বিশ্রাম নিতে পেঁৗছে যাই সেই রমণীর কাছে। প্রথম স্তবক বিস্তৃত প্রাচীন রাজ্যের ভুবনে। দ্বিতীয় স্তবক সেই রমণীর ওপর আলো ফেলতে শুরু করে, তবে তাকে বিস্তৃত পৃথিবীর সাথে যুক্ত করে_তার চুলকে বিদিশা, মুখমণ্ডলকে শ্রাবস্তির সাথে:বিশাল থেকে ক্ষুদ্রত্বে পেঁৗছানোর সংশ্নেষণ। তৃতীয় স্তবক কেন্দ ীভূত হয় ক্ষুদ্রের ওপর: চিল, জোনাকী এবং সবশেষে আবারো একজন। শুধু স্থানিক নয়, কালিক ভাবেও পুরো কবিতাসহ স্তবকগুলো রাজত্বগুলোকে মুহূর্ত হিসেবে উপস্থাপন করে এগিয়ে নিয়ে যায় মুহূর্তের শান্তিকে অনন্তের দিকে।
‘বনলতা সেন’ সম্পর্কে দীপ্তি ত্রিপাঠী লেখেন, ‘দেশকালে সীমাবদ্ধ নাটোরের বনলতা সেনের পশ্চাতে রয়েছে ভূগোলের বিস্তৃতি ও ইতিহাসের বেধ (ফবঢ়ঃয)। এই দুই আয়তনের যোগে একটি ক্ষুদ্র লিরিক কবিতা মহাকাব্যের ব্যাপ্তি পেয়েছে।’
‘ধূসর পান্ডুলিপি’ এবং ‘রূপসী বাংলার’ ‘তুমি’ এ কবিতায় একটা যথাযথ নাম খুঁজে পায়:বনলতা সেন, এক স্বস্তিদাত্রী নারী, যে মানবসংসারের আর সবার চেয়ে আলাদা। সে অন্তত এই কবিতায় কবিকে উপলব্ধি করতে পারে। পক্ষান্তরে কবিও বিম্বিসার যুগ থেকে অদ্যাবধি সদ্য ক্লান্তিকর মানবসমাজকে যেরকম পরিহার করে এসেছেন, তাঁকে সেভাবে পরিহার করেননি। ঐতিহাসিক মাত্রা তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনের আবেগকে আরো জোরালো করে তোলে। তাঁর কুশীলবরা যে মঞ্চে পদচারণা করে, সেটাকে তিনি ঐতিহাসিক এবং ভৌগোলিক উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহারের মাধ্যমে আরো বিস্তৃত করেন, আর এভাবে ঘটনাস্থলকে প্রসারিত করে তিনি তাঁর বক্তব্যে দান করেন গতি।
কবি সরাসরি বলেন, জীবনের চার দিকের ফেনিল জলরাশি থেকে বনলতা সেন তাঁকে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছে। কবিতার শেষ দু-চরণে সিদ্ধান্তহীন অস্পষ্টতা রয়ে যায় যে, বনলতা সেন আরাম ও ক্লান্তিকর জীবন থেকে বিশ্রাম অর্থাৎ মৃতু্যকে প্রতীকায়িত করে কি-না। অবশ্যই বনলতা সেন সান্ত্বনার প্রতীক, আর জীবনানন্দ ওর এই গুণটির কথা ব্যক্ত করেন দ্বিতীয় স্তবকের শেষ চরণের বিখ্যাত চিত্রকল্পটির মাধ্যমে :পাখির নীড়ের মতো চোখ। কল্পিত কর্ম (নিরাপত্তা ও শান্তি) এবং কারণ (নীড়)_এই সংশেস্নষের মতো বাংলাভাষার কোনো শব্দ বা গতানুগতিক উপমা তখন শুধু নয়; আজ পর্যন্ত ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’-এর মতো পাঠককে চ্যালেঞ্জ করেনি।
জীবনানন্দ অন্যত্রও একই চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। ১৯২৯-৩০ সালে দিলস্নীর রামযশ কলেজে শিক্ষকতা করার সময় বরিশালে তাঁর সতীর্থ ব্রাহ্ম এবং বছরখানেকের ছোট সুধীরকুমার দত্ত তাঁকে কিছুটা সাহচর্য দিয়েছিলেন। জীবনানন্দ যখন দিলস্নী আসেন তখন সুধীর কুমার তাঁর সঙ্গে রেল স্টেশনে দেখা করেন। পাঁচবছরেরও বেশি সময় পর জীবনানন্দ সেই উপলক্ষে সুধীর কুমার সন্বন্ধে লেখেন ‘ঃমুখে তার পাখির নীড়ের মতো আশ্বাস ও আশ্রয়ের হাসি।’ বনলতা সেন কবিতার ক্লান্ত পথচারীর দিকে চোখ তুলে সেই একই আশ্রয়ের স্বস্তি ও আশ্বাস প্রদান করেছে। এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, কোনটা আগে, সুধীর কুমার সম্পর্কে (মৃতু্য :জুন ১৯৩৫) বক্তব্য, নাকি বনলতা সেন (১৯৩৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত)।
নয় মাস পর আরেকটি কবিতায় বনলতা সেনের দেখা পাওয়া যায়, এটিও ছাপা হয় কবিতায়। ছয় পঙক্তির ‘হাজার বছর শুধু খেলা করে’ কবিতাটি স্তবকবিন্যাসে ‘বনলতা সেন’-এর মতো। উভয় কবিতাতেই প্রাথমিকভাবে হাজার বছরের কালিক বিস্তারের অস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়, উপান্তের চরণগুলো জীবনের লেনদেনের সমাপ্তির কথা বলে, সর্বোপরি দুটো কবিতাতেই মূর্ত বনলতা সেন।
‘হাজার বছর শুধু খেলা করে’ কবিতাটির দুটো প্রকাশিত ভাষ্য পাওয়া গেছে। দুটোর পটভূমি ছিল আলাদা।

হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো;চারিদিকে পিরামিড_কাফনের ঘ্রাণ; (চিরদিন রাত্রির নিধান;)বালির ওপরে জ্যোৎস্না_খেজুর ছায়ারা (দেবদারু ছায়া) ইতস্ততবিচূর্ণ থামের মতো :এশিরিয় (দ্বারকার)_দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত, মস্ন্নান।শরীরে মমির (ঘুমের) ঘ্রাণ আমাদের_ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন;‘মনে আছে?’ শুধালো সে_শুধালাম আমি শুধু, ‘বনলতা সেন?’

(দ্বিতীয় কবিতাটিতে কেবল বন্ধনীর ভেতরের শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত_অনুবাদক)


একটি কবিতায় ব্যবহূত হয় মধ্যপ্রাচ্যের চিত্রকল্প, অন্যটিতে ভারতীয়। জীবনানন্দের প্রথম গ্রন্থ ‘ঝরা পালক’-এ মধ্যপ্রাচ্যের চিত্রকল্পের বহুল ব্যবহার রয়েছে। এ গ্রন্থে এসবের ব্যবহার ছিল মূলত আক্ষরিক, কোনো ক্রিয়ার প্রাসঙ্গিকতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য ব্যবহূত। ‘বনলতা সেন’ কবিতায় উৎকীর্ণ ইতিহাস ও ভূগোলের ভূমিকার সমার্থক স্থান সময়ের দূরত্বের ভেতর যেরকম দ্যোতনা পাওয়া যায়, পরবর্তীকালে তাঁর মধ্যপ্রাচ্যের চিত্রকল্পগুলো আক্ষরিকভাবে তেমন বেশি কিছু প্রতীকায়িত করে না। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক চিত্রকল্পসমূহ ব্যবহারের মাধ্যমে সৃষ্ট দূরত্বকে আরো দূরবর্তী করার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের চিত্রকল্পগুলো যোগ করে অ-ভারতীয় বিচিত্র চমকপ্রদ উপাদান।

সাধারণভাবে ঐতিহাসিক ভৌগোলিক চিত্রকল্প এবং নির্দিষ্টভাবে মধ্যপ্রাচ্যের চিত্রকল্পসমূহের ব্যবহারিক সাদৃশ্যের কারণে জীবনানন্দ উপলব্ধি করেন যে, কবিতাটিকে ক্ষতিগ্রস্ত না করেও মধ্যপ্রাচ্যের চিত্রকল্পের বিকল্প হিসেবে ভারতীয় চিত্রকল্প ব্যবহার করা যায়। বস্তুত ‘হাজার বছর শুধু খেলা করে’ কবিতায় ‘এশিরিয়’-র পরিবর্তে ‘দ্বারকা’ (ভগবান কৃষ্ণের প্রাচীন রাজধানী), খেজুরগাছের (এই গাছ ভারতেও জন্মে, তবে কবিতায় যেগুলোর কথা বলা হয়েছে, সেগুলো নিশ্চিতভাবে মিশরীয় কিংবা এশিরীয়) পরিবর্তে ভারতীয় দেবদারুর ব্যবহার যথার্থ। কবিতাটির জন্য পিরামিড কিংবা মমি আক্ষরিক অর্থে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়; কিন্তু প্রথম পঙ্ক্তির ‘হাজার বছর’-এর ভেতর অনির্দিষ্ট মহাকালের ধারণাকে আরো বেগবান করে। একই উদ্দেশ্য সাধন করে এশিরীয় এবং দ্বারকার উলেস্নখও।

 

এই ছয় পঙ্ক্তির কবিতাটা তিন স্তবকবিশিষ্ট ‘বনলতা সেন’কে পুনর্দখল করে। ‘হাজার বছর শুধু খেলা করে’ কবিতাটি বোঝার জন্য পাঠককে ‘বনলতা সেন’ এবং সে যা উপস্থাপন করে, তার সাথে পরিচিত হতে হবে। দীর্ঘ কবিতাটা যত দূর করে ছোটটিও তা-ই করতে চেয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেটা খুম কমই কার্যকর হয়। ছয়টি পঙ্ক্তি বিশাল নৈর্ব্যক্তিকতা থেকে বনলতা সেনের সাথে ঘনিষ্ঠতার দিকে এগিয়ে যায়। পথরোধকারী লাইনগুলো মাঝপথে এসে পড়ে। কোনো সত্যিকার গতি নেই সেখানে। প্রথম এবং শেষ পঙ্ক্তির মধ্যে নেই তেমন কোনো বন্ধন। যে পরিবেশে কথক এবং বনলতা সেনের দেখা হয়, তা পরিবর্ধিত হয়, ইতিহাসের পরোক্ষ উলেস্নখের কারণে ধারণ করে বিচিত্র সুবাস, কিন্তু ‘বনলতা সেন’-এ রয়েছে সত্যিকার গতিময়তা_প্রাচীন থেকে অব্যবহিত বর্তমান পর্যন্ত উত্থান। প্রাচীনকালের উলেস্নখ্য কবিতার মধ্যকার চরিত্র যেসব জায়গাগুলোতে ভ্রমণ করছিল, সেসব স্থানের প্রতি বিশেষত্ব আরোপ করে। সে তুলনায় ‘হাজার বছর শুধু খেলা করে’ উপস্থাপন করে একটা স্থিরচিত্র।

 

‘বনলতা সেন’ কবিতায় জীবনের সব লেনদেন সাঙ্গ হওয়া-বিষয়ক বক্তব্য (সব পাখি ঘরে আসে/সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন) কর্মতৎপরতার প্রস্তাবনা বহন করে। এই অংশের পূর্ববর্তী কবিতার সম্পূর্ণ অংশে আলোকপাত করা হয় জীবনের সক্রিয়তার ওপর (‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’)। একই রকম একটা বক্তব্য যখন ‘হাজার বছর শুধু খেলা করে’তে আসে (‘ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন’), সেটা অনুমানসিদ্ধ হিসেবে আসে না, কারণ জীবন এবং জীবনের লেনদেনের তেমন কিছুই এখানে উন্মোচিত হয় না। এই কবিতায় বনলতা সেন এবং কথকের মধ্যকার সংক্ষিপ্ত কথোপকথনের ভেতর কেউ কিছুটা সান্ত্বনার রেশ পেতে পারেন_বস্তুত ‘বনলতা সেন’ কবিতা এটাকেই সঠিক ব্যাখ্যা হিসেবে ইঙ্গিত প্রদান করে_কিন্তু পূর্ববর্তী পঙ্ক্তিগুলো এরকম সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পাঠককে খুব একটা সাহায্য করে না। কেবল দীর্ঘটির সামস্বরিক হওয়া ছাড়া কবিতাটির ব্যর্থতা ‘বনলতা সেন’-এর সার্থকতার একটা মূল অনুষঙ্গ_সঙ্গত বিস্তারকে বিশেষায়িত করে। কেউ ভাবলেও ভাবতে পারে ‘হাজার বছর শুধু খেলা করে’ ‘বনলতা সেন’-এর প্রাথমিক খসড়া থেকে সুচিন্তিতভাবে বাতিল করে দেওয়া কোনো স্তবক কি না।


জীবনানন্দ : কবিতার রাজনীতি


‘সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্র’ নামে আরেকটি সাহিত্য সংগঠনের জন্ম হওয়ার কারণ ছিল শিল্পের রাজনীতিকীকরণ। ‘পরিচয়’ পত্রিকার মতো একটা মুখপত্রসহ একটা পরিচিত কমিউনিস্ট সাহিত্যগোষ্ঠীর উপস্থিতিই  অ-কমিউনিস্ট লেখকদের এটির বিরুদ্ধবাদী একটা সাহিত্যগোষ্ঠী গঠনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এ রকম একটা অংশ পরিচিত ব্যক্তিত্ব সজনীকান্ত দাসের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়, যা ‘শনি চক্র’ নামে পরিচিত হয়। ফলে সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্র নিজেকে পশ্চিমবঙ্গে তৃতীয় একটা শক্তি বলে বিবেচনা করত (প্রগতি লেখক শিল্পী সংঘ এবং শনি চক্র উভয়ের বিপরীতে)।

পশ্চিমবঙ্গের সব ধরনের সাহিত্য আত্মসচেতনভাবে রাজনৈতিক হয়ে যায়নি। ‘কবিতা’ পত্রিকা তখনও শক্তিশালী ছিল, ‘পূর্বাশা’ও ১৯৪৩ সালে আবার বের হওয়া শুরু করে; নিয়মিত বেরুচ্ছিল ‘চতুরঙ্গ’। এই তিনটি সাহিত্য পত্রিকার তিন সম্পাদক_ বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং হুমায়ুন কবির; সবারই ছিল নিজস্ব রাজনৈতিক মত, কিন্তু তাদের পত্রিকাগুলোর কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। এতদসত্ত্বেও ‘মার্ক্সবাদী’ এবং ‘পরিচয়’ পত্রিকায় দৃষ্টান্তমূলকভাবে সাহিত্যের মধ্য দিয়ে সক্রিয় ও মারমুখী রাজনীতিচর্চা কলকাতার লেখকদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যা শেষ পর্যন্ত ‘সমকালীন সাহিত্য কেন্দ্র’ গঠন পর্যন্ত গড়ায়।

 

আবু সয়ীদ আইয়ুব আমন্ত্রিত হয়ে ‘পরিচয়’-এর সম্পাদকীয় বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত হন চলি্লশের দশকে। ১৯৪৮ সালের দিকে পদত্যাগ করেন বলে স্মরণ করতে পারেন তিনি। এই শুদ্ধ সমালোচক লেখকটিকে তাদের অভীষ্টের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য দলভুক্ত করা যাবে, নিঃসন্দেহে এই আশায় প্রায় একই সময়ে কমিউনিস্টরা সাহিত্য বিষয়ে তার কাছ থেকে একটা লেখা চান। আইয়ুব এমন একটি বিষয় বেছে নেন যাকে তিনি বলেন সাহিত্যের চূড়ান্ত এবং সহায়ক মূল্যবোধ। তিনি দুই ধরনের সাহিত্যকে চিহ্নিত করেন : একটি নিজের মধ্য থেকেই চূড়ান্ত সর্বোচ্চ বিষয়; আরেকটি সমাজ পরিবর্তনের চালক। খাঁটি এবং প্রায়োগিক_ এই দুই ধরনের সাহিত্য অস্তিত্বশীল, ঠিক যেমন বিজ্ঞানেও আছে এই দুই শাখা, এই যুক্তিবলে তিনি বলেন যে, বিশুদ্ধ শিল্প হিসেবে প্রায়োগিক সাহিত্যের মূল্য সামান্যই। আইয়ুব উপসংহারে বলেন যে, কমিউনিস্টরা প্রায়োগিক সাহিত্য রচনা করে, এ রকম সৃষ্টির কোনো চূড়ান্ত সাহিত্যমূল্য নেই। লেখাটি যেহেতু চেয়ে নেওয়া হয়েছিল, সেটা পরিচয়_ এ ছাপা হয়। তবে আইয়ুব স্মরণ করেন, তার লেখাটির পাশাপাশি দুটো যুক্তিখণ্ডনকারী লেখাও সনি্নবিষ্ট করা হয়েছিল।

 

এ রকম সময়ে, কমিউনিস্ট পণ্ডিতবর্গ উচ্চকণ্ঠ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আইয়ুব এই সিদ্ধান্তে পেঁৗছান যে, সাহিত্যে একটা তৃতীয় ধারা থাকা উচিত। আইয়ুবের বক্তব্য অনুযায়ী, এই তৃতীয় শক্তিকে আবশ্যিকভাবে তাদের সামাজিক প্রতিবেশ এবং সমসাময়িক সমস্যাগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে; তৎসত্ত্বেও তারা লিখবে স্বাধীন একক ব্যক্তি হিসেবে, কমিউনিস্টবিরোধী হিসেবে নয় এবং তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক পারিপাশর্ি্বকতা সম্পর্কে সচেতনতাহীন লেখক হিসেবেও নয়। এই তৃতীয় শক্তির লেখকরা কমিউনিস্ট ধাঁচের ‘প্রায়োগিক’ কিংবা ‘যান্ত্রিক’ সাহিত্য সৃষ্টি করবে না, লিখবে ‘চূড়ান্ত’ সাহিত্যিক মূল্যবাহী লেখা।

 

১৯৫০ সালের জুন মাসে ‘দ্বন্দ্ব’ নামে একটা মাসিক পত্রিকার চতুর্থ বর্ষ শুরু হয়। এটির সম্পাদক হিসেবে নাম ছিল আবু সয়ীদ আইয়ুব, জীবনানন্দ দাশ এবং নরেন্দ্রনাথ মিত্রের। এ সংখ্যাটির শেষ পৃষ্ঠার আগের পৃষ্ঠায় ছাপা হয় সুহৃদ রুদ্র-প্রকাশিত সমকালীন বাংলা কবিতা সংকলনের একটি বিজ্ঞাপন। তিন বছর আগে ‘দ্বন্দ্ব’ শুরু হয়েছিল বিশ্বনাথ ভট্টাচার্যকে সঙ্গে নিয়ে এই সুহৃদ রুদ্রের হাতে; দু’জনই খাঁটি সমাজতন্ত্রী। সমাজতান্ত্রিক দলের সাংস্কৃতিক কমিটির সেক্রেটারি আনন্দগোপাল সেনগুপ্তের প্রচেষ্টায় ১৯৫৯ সালে ‘দ্বন্দ্ব’ সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্রের মুখপত্রে পরিণত হয়।

 

তবে সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্র কিংবা ‘দ্বন্দ্ব’ কোনোটাকেই সমাজতান্ত্রিক দল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি। এই গোষ্ঠীর বহু সদস্য এমনকি সমাজতান্ত্রিক দলের সঙ্গেই ছিল না। আনন্দগোপালের মতে, বিশেষ করে জীবনানন্দ সম্ভবত কেন্দ্রের একজন সদস্য ছিলেন, সমাজতান্ত্রিক দলের নয়। বলাবাহুল্য যে, কেন্দ্রের সদস্যরা সমাজতান্ত্রিক ধারণার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। জীবনানন্দ সমাজতন্ত্রের জন্য কতখানি সংকল্পবদ্ধ ছিলেন সেটা পরিষ্কার নয়। আইয়ুব নিশ্চিতভাবে স্মরণ করতে পারেন যে, জীবনানন্দ সাহিত্যে একটা তৃতীয় শক্তির ধারণার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন।

১৯৪৯-এর শেষ দিকে জীবনানন্দ সমকালীন বাংলা কবিতার পরিস্থিতি আলোচনা করে ‘বেঙ্গলি পোয়েট্রি টুডে’ শিরোনামে ইংরেজিতে একটা প্রবন্ধ লেখেন। ‘মার্ক্সিস্ট’ শব্দটি যদিও মাত্র একবার ব্যবহার হয় এবং কমিউনিস্ট একবারও নয়, তবুও এটা পরিষ্কার যে কমিউনিস্ট দর্শনের অনমনীয় চরিত্র তাকে বিরক্ত করে। তিনি যুক্তি দেখান_ একজন সত্যিকার কবি হবেন স্বাধীন, কারণ তিনি সৃষ্টি করেন নিজস্ব দর্শন এবং তৈরি করেন নিজস্ব ভুবন। তবে তিনি স্বীকার করেন, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা যুগের দাবি হিসেবে যা বিশ্বাস করে তার প্রাঞ্জল স্বীকারোক্তি চাইতে পারে, যার আবার প্রয়োজন হতে পারে নতুন সাহিত্য এবং সাহিত্যের প্রতি নতুন মনোভাব। এতদসত্ত্বেও কবিরা যখন সামাজিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতায় আবিষ্ট হয়ে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের কাব্যিক সাফল্য গড়তে চান অথবা সে রকম ভাবেন, তখন তারা স্থায়ী মূল্যবোধসম্পন্ন কিছু সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হন।

 

জীবনানন্দের প্রবন্ধটি প্রকাশের অল্প কিছুদিন পরই ‘সমকালীন সাহিত্য-কেন্দ্র’ আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় : আবু সয়ীদ আইয়ুব সভাপতি, সন্তোষ কুমার ঘোষ সাধারণ সম্পাদক এবং আনন্দগোপাল সেনগুপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক। ১৯৫০ সালের মাঝনাগাদ সাহিত্য-কেন্দ্র কেবল সভা করত তা নয়, তাদের মাসিক পত্রিকাও বের করে। আইয়ুবের সভাপতিত্বে এমন একটা সভায় ভারতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রধান নরেন্দ্র দেব ভাষণ দেন। খবরটি সমাজতান্ত্রিক কাগজ ‘জনতা’য় নিম্নোক্ত শিরোনামে ছাপা হয় : ‘গণতন্ত্র, আন্তর্জাতিকতাবাদ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রচার করুন : লেখকদের প্রতি আচার্য নরেন্দ্র দেবের আহ্বান।’ সেখানে নরেন্দ্র দেবের ভাষণের সংক্ষিপ্তসার ছাপা হয়, যেখানে তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান এবং বক্তব্য রাখেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, এটা হচ্ছে গণতন্ত্র, আন্তর্জাতিকতাবাদ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের যুগ। সাহিত্যের মাধ্যমে আমাদের লেখকরা এইসব নতুন মূল্যবোধ প্রচার করবেন।

 

জীবনানন্দ সংগঠনের প্রথম সভায় যোগ দিতে সক্ষম হননি। তার পরিবর্তে তিনি রাজনীতির সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক বিষয়ে তার কিছু মতামত জানিয়ে আনন্দগোপালের কাছে একখানা চিঠি পাঠান_ যা এরকম :

পৃথিবীর নামকরা সভ্য দেশগুলো সাহিত্য বলতে প্রায়ই অল্পাধিক অতীতের সাহিত্য বোঝে; কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে কি তার মূল্য পরিষ্কারভাবে বুঝে দেখবার চেষ্টা নেই; সমসাময়িক সাহিত্য সম্বন্ধে কোনো কথাই বড় একটা ভাবে চায় না; আজকের সাহিত্যিক যা খুশি ভাবুক লিখুক স্টেটের তাতে কিছু এসে যায় না এমনই অকিঞ্চিৎকর মনে করা হয় সাহিত্যকে। এই হল এক দিককার ছবি। অন্য দিকে দু-একটি বড় রাষ্ট্রে সাহিত্য সম্বন্ধে চেতনার সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে; সে সব জায়গায় রাষ্ট্র সবই চালাচ্ছে, সাহিত্যকেও, সাহিত্যিকের মনন ও ধ্যানের কিছু মাত্র স্বাধীনতা থাকলেও রাষ্ট্রের প্রভুত্ব খর্ব হয়, এই তাদের ধারণা। অসত্য এবং অন্যায়। সাহিত্যের উচিত স্বাধীনতায় স্টেট বিপদগ্রস্ত হবে, আমার মনে হয়, বাংলাদেশ এভাবে এখনও ভাবতে শুরু করেনি, কিন্তু শিগগিরই করতে পারে। সমকালীন সাহিত্য-কেন্দ্র এক দিকে সমাজ ও জনতার বিমূঢ় উপেক্ষা ও অন্য দিকে রাষ্ট্র ইত্যাদির অন্যায় ও অবৈধ কর্তৃত্বের হাত থেকে সাহিত্যকে যথাসম্ভব মুক্ত রাখবার কাজে ধৈর্য, জ্ঞান ও বিনয়ের সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে অনুভব করে আমি আনন্দিত হয়েছি। সাহিত্যের উন্নতি ও সার্থকতার জন্যে আপনারা মিলিত হয়েছেন; আপনাদের পরিপূর্ণ সাফল্য কামনা করি।জীবনানন্দ দাশ

 

কীভাবে প্রগতি এবং সাহিত্যবোধ কার্যকর হবে সমকালীন লেখক-কেন্দ্রের মেনিফেস্টোতে তার খসড়া উপস্থাপন করা হয়। ‘সমকালীন সাহিত্যের পথ’ শীর্ষক আবু সয়ীদ আইয়ুবের একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালের জুন সংখ্যা ‘দ্বন্দ্ব’-এর সম্পাদকীয় ভূমিকা হিসেবে। বহু আগে লেখা এবং ইতিমধ্যে প্রকাশিত (দেশ, ডিসেম্বর ১৯৪৯) প্রবন্ধটির বিষয়বস্তু কেন্দ্রের সদস্যদের কাছে সুপরিচিত ছিল।

আইয়ুব লেখেন, রেনেসাঁ মনকে চার্চ থেকে মুক্ত করেছে। কিন্তু আজ চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আর একটি নতুন প্রয়াস, ‘মধ্যযুগীয় চিত্তবন্ধনের দ্বিতীয় পালা আরম্ভ হচ্ছে’।

এই রাজনৈতিক ধারার অধিবক্তাদের কাছে শিল্প সাহিত্যের কোনো মূল্য থাকে না যদি সে শিল্প সাহিত্য তাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের অস্ত্র হিসাবে মূল্যবান না হয়। এরা ভুলে যান যে, রাজনৈতিক সংগ্রামের উদ্দেশ্যই হল এমন এক শ্রেণীহীন সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে জনসাধারণের জৈব অভাব মোচন করে তাদের জীবনকে শিল্পে সাহিত্যে সংস্কৃতিতে নব নব রূপে উন্মুক্ত ও বিকশিত করা সম্ভব হবে।

 

শৈল্পিক সৃষ্টির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, কমিউনিস্ট পার্টির এই আনুষ্ঠানিক ঘোষণার সমালোচনার পর মার্কসবাদীতে প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করে আইয়ুব এই ধরনের দর্শনের বহিঃপ্রকাশের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রবন্ধটিতে বলা হয়, রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যে সংস্কৃতি ধারা চলে আসছে সেটা ‘বুর্যোয়া ঐতিহ্যের জঞ্জাল। এর যথোপযুক্ত স্থান ইতিহাসের ডাষ্টবিনে।'(মার্ক্সবাদী, সংখ্যা ৪, পৃ ১১৯)।তাদের ধার করা বক্তব্য সত্ত্বেও আইয়ুব মার্কসবাদীদের তাদের প্রাপ্য ঠিকই দিয়েছেন :

মার্ক্সবাদী সাহিত্যে নীতির সঙ্গে আমাদের অল্প বিস্তর মতভেদ আছে বলে আমরা যেন ভুলে না যাই তাঁরা সাহিত্যে এক নতুন সমাজ চেতনা এনেছেন এবং পূর্বতন সমাজ চেতনাকে দৃঢ় ও প্রশস্ত করেছেন। এই সমাজ চেতনার সাহিত্যিক ও সামাজিক মূল্য স্থায়ী।

 

আইয়ুবের মতে, সমকালীন সাহিত্য কেন্দ্র ছিল রাজনৈতিক গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং চূড়ান্ত শৈল্পিক স্বাধীনতার পক্ষে। এ রকম একটা রক্ষণশীল বিষয়সূচি থাকা সত্ত্বেও কেউ নিশ্চয়ই অবাক হবেন জীবনানন্দ কেন আনন্দগোপালের মাধ্যমে একটা সাবধানী এবং সতর্ক করা চিঠি পাঠিয়েছিলেন সংগঠনের কাছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পশ্চিমবঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, বন্ধ করে দেওয়া হয় এটির মুখপত্র। যখন তিনি লেখেন, ‘সাহিত্যের উচিত স্বাধীনতায় স্টেট বিপদগ্রস্ত হবে, আমার মনে হয়, বাংলাদেশ এভাবে এখনও ভাবতে শুরু করেনি, কিন্তু শিগগিরই করতে পারে’, তখন কি তিনি ভয় পেয়েছিলেন? যখন তিনি নিশ্চয়তার চেয়ে আরও বেশি আশা নিয়ে ঘোষণা করেন, ‘সমকালীন সাহিত্য কেন্দ্র এক দিকে সমাজ ও জনতার বিমূঢ় উপেক্ষা ও অন্য দিকে রাষ্ট্র ইত্যাদির অন্যায় ও অবৈধ কর্তৃত্বের হাত থেকে সাহিত্যকে যথাসম্ভব মুক্ত রাখবার কাজে ধৈর্য, জ্ঞান ও বিনয়ের সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে অনুভব করে আমি আনন্দিত হয়েছি’, তখন কি তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, আইয়ুব এবং অন্যরা আরও বেশি রেডিক্যাল হয়ে যেতে পারেন?

 

যে পত্রিকাটিতে সম্পাদক হিসেবে তার নাম ছিল, সেটিতে খুব কমই লিখেছেন জীবনানন্দ। প্রথম সংখ্যায় ‘আশা ভরসা’ নামে তার একটা কবিতা ছিল, আর সেপ্টেম্বর ১৯৫০, চতুর্থ সংখ্যায় (পূজা সংখ্যা) ছিল তার প্রবন্ধ ‘আধুনিক কবিতা’। এটিতে তিনি তার বিষয়বস্তুকে চিহ্নিত করেন : ‘মানুষের মনের চিরপদার্থ কবিতায় বা সাহিত্যে মহৎ লেখকদের হাতে যে বিশিষ্টতায় প্রকাশিত হয়ে ওঠে তাকেই আধুনিক সাহিত্য বা আধুনিক কবিতা বলা যেতে পারে।’ জীবনানন্দ যেভাবে বলেন, তার সংজ্ঞা অনুযায়ী, সংস্কৃত এবং গ্রিক সাহিত্য থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বহু মহৎ লেখাকে আধুনিক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তবে তিনি ‘আধুনিক সাহিত্য’ শব্দগুচ্ছটির আরও ব্যাপকভাবে গৃহীত আরেকটি অর্থের কথা বলেন, ‘প্রথম ধরনের’ আধুনিকতা : ‘নিজের যুগের স্থূল সব লক্ষণে অতিরিক্ত সংক্রমিত হয়ে প্রথম ধরনের আধুনিক কবিতা যুগের ভিতরে পর্যবসিত হয়ে, নষ্ট হয়ে যেতে পারে।’ রবীন্দ্রনাথ এবং তার ধরনের সাহিত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, যা ‘কল্লোল’ প্রজন্মকে প্রজ্বলিত করেছিল, তার ফলে এই ধরনের আধুনিক ক্ষণজীবী কবিতার জন্ম হয়েছিল। গদ্যছন্দ নিয়ে ত্রিশের দশকের কাঠামোগত নিরীক্ষা যুগের অংশে পর্যবসিত হয়, এগুলো উপভোগ্য ছিল কিন্তু সাহিত্যের মূল্যবোধের নিরিখে অবশ্যম্ভাবীভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল না। সাময়িক বিষয়ীভূত ধারণাসমূহ সেসব কবিতার বেশিরভাগে ছড়িয়েছিল বিশের দশক থেকে পঞ্চাশ অব্দি, তবে এসব সাময়িক কবিতাই প্রথম ধরনের (নিকৃষ্ট) আধুনিক কবিতার উদাহরণ।

 

তারপর জীবনানন্দ আধুনিক কবিতার প্রত্যয়ের অভাবের কথা উল্লেখ করেন। ‘মার্ক্সবাদী’র লেখকরা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে নৈরাশ্যবাদের কথা উল্লেখ করে তার সমালোচনা করেছিলেন। জীবনানন্দও সেই সাহিত্যের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছেন, যেখানে কবিদের দৃঢ় ইতিবাচক বিশ্বাস নেই : 

আশা করা যাক আধুনিক বিজ্ঞানের (ফলিত বিজ্ঞানের কথা বলছি না আমি) ফলাফল কেবলই নিরাশাবাদকে প্রশ্রয় দেবে না। বিজ্ঞানের বা অন্য কোনো অনুভূতি বা সত্যের সিদ্ধান্ত কবির নিকট সৎ মনে হলে যে বিশ্বাসে স্থিত হয়ে কবিতা লেখা সম্ভব তার অভাবেও ভালো এমন কি মহৎ কবিতা রচিত হতে পারে_ অবিশ্বাস বা অনিশ্চয়তার বিষয়ের মাহাত্ম্য রয়েছে বলে নয়_ কিন্তু যে কোনো বিষয় এমন কি অনিশ্চয়তা ও অবিশ্বাসও_ বিশেষ কবির হাতে শিল্পের সিদ্ধি লাভ করতে পারে বলে। কিন্তু এ রকম কবি ও তার এ ধরনের সম্ভাবনা ও সিদ্ধার্থ সাহিত্যের ইতিহাসে বেশি রয়েছে বলে টের পাইনি।

 

সংগঠনের সভায় প্রদত্ত ভাষণ থেকে সংশোধিত এই প্রবন্ধটি যখন ছাপা হয়, জীবনানন্দ তখন এক মফস্বল কলেজে চাকরি নিয়ে সাময়িকভাবে কলকাতা ছেড়েছেন। সমকালীন লেখক-কেন্দ্র নিজেই স্বল্পজীবী বলে পরিগণিত হয়। ‘দ্বন্দ্ব’-এর তিন কিংবা চারটি সংখ্যা বের হওয়ার পর তিন সম্পাদকের মধ্যে দু’জনই কলকাতা ছাড়েন_ আবু সয়ীদ আইয়ুব যান শান্তিনিকেতনে আর জীবনানন্দ কলকাতা থেকে পঁচাত্তর মাইল দূরে মেদিনীপুর জেলার খড়গপুরে। পত্রিকার উপসম্পাদক প্রবন্ধের দায়িত্বে নিয়োজিত অম্লান দত্তকে জীবনানন্দ তার এই প্রধান লেখাটি সম্পর্কে লেখেন :

১৮৩ ল্যান্স ডাউন রোড কলকাতা – ২৬১৫.৯.৫০প্রিয়বরেষু অম্নান বাবু,আপনাদের নির্দ্দেশমত আশ্বিনের দ্বন্দ্বের জন্যে ‘আধুনিক কবিতা’ লেখাটি তৈরি করে এই সঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম। এই লেখাটি আপনি আশ্বিনের সংখ্যায় সম্পাদকীয় হিসেবে ব্যবহার করবার কথা বলেছিলেন, কিন্তু প্রথম প্রবন্ধ হিসেবে ব্যবহার করলে ঠিক হবে হয়তো।ঋরহধষ চৎড়ড়ভ আমি একবার অবশ্যই দেখে দিতে চাই।আসছে বিবশবহফ-এ আমি কলকাতায় আসব কিনা বলতে পারছি না; কিন্তু তার পরে এলেও চৎড়ড়ভ দেখবার সুযোগ পাব আশা করি। প্রীতিনমস্কার। ইতি জীবনানন্দ দাশ

 

সমকালীন সাহিত্য-কেন্দ্রে তার সদস্য হওয়ার অর্থ ছিল নির্জনতম একান্তচারী এই কবির কোনো রাজনৈতিক ব্যাপারে ঘনিষ্ঠ হয়ে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করা। জীবনানন্দ নিশ্চয়ই ১৯৫০ সালে সমাজতান্ত্রিক পার্টি কিংবা সমাজতন্ত্রের আগ্রহী সমর্থক হয়ে যাননি। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের পত্রিকায় লিখতেন যেমন, ১৯৫০-এর অক্টোবরে তার কবিতা ‘আজ’ ছাপা হয় ‘নির্ণয়’-এ, এটি ছিল পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কিত একটা সাংস্কৃতিক প্রকাশনা। কংগ্রেসের প্রতি তার কোনো সহানুভূতি আছে তা নয়, সেখানে লেখার কারণ, সম্পাদক অমিয় কুমার গঙ্গোপাধ্যায়কে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন।

আজ অন্ধ সাগরের বেগে উৎসারিত রাত্রির মতনআলোড়নে মানুষের প্রিয়তর দিকনির্ণয়েপথ আজ প্রতিহত; তবুও কোথাওনির্মল সন্ততি দেশ সময়ের নব নব তীর_পেতে পারে হয়তো বা মানবহৃদয়;মহাপতনের দিনে আজ অবহিত হয়ে নিতে হয়।যদিও অধীর লক্ষ্যে অন্ধকারে মানুষ চলেছেধ্বংস আশা বেদনায়বন্য মরালের মতো চেতনার নীল কুয়াশায়_কুহেলী সরিয়ে তবু মানুষের কাহিনীর পথেভাস্বরতা এসে পড়ে মাঝে মাঝে_স্বচ্ছ ক্রান্তিবলয়ের মতন জগতে।মনে হয় মহানিশীথের স্তন্যপায়ীমানুয় তবুও শিশুসূর্যের সন্তান,স্থিরতর বিষয়ী সে_যদিও হৃদয়ে রক্তে আজও ভুল অকূলের গান।

 

যে প্রত্যয়ের কথা তার প্রবন্ধে দেখিয়েছেন তা দেখাতে সংকল্পবব্ধ বলে মনে হয় জীবনানন্দকে। নির্ণয়ের পথ (এটি পত্রিকাটিরও নাম) রুদ্ধ হতে পারে অথবা আজ তেমনই মনে হচ্ছে, কিন্তু মধ্য বিংশ শতাব্দীর সভ্যতার অন্ধ সাগরের দূর তীরভূমিতে এখনও বোধকরি পেঁৗছা যাবে। আপাতদৃষ্টিতে অন্ধকারের এক শিশু, মানবজাতির জন্ম হয়েছে উদীয়মান সূর্য থেকে। এতদসত্ত্বেও নিরাশাবাদ আধিপত্য করে : মানুষ এখনও গায় সেই, ‘ভুল অকূলের গান’। জীবনানন্দের বিশ্বাস আছে নতুন তীর পাওয়া যাবে। তার নিজের জীবনের পথও মনে হয় ১৯৫০-এর শরতে অপেক্ষাকৃত ভালো কিছুর জন্য একটা সাময়িক বাঁক নিয়েছিল, যদিও পূর্ববর্তী কিছু চরম হতাশ সময় গিয়েছে তার।

 

জীবনানন্দ দাশের ওপর ক্লিন্ট বুথ  সিলির ‘অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট’ বইটি থেকে নির্বাচিত অংশবিশেষ

অনুবাদ : ফারুক মঈনউদ্দীন

সূত্র : ফেসবুক জুলেখা সিরাপ গ্রুপ ফাইল


সম্পাদনা

নাসরিন-জয়া হক

তরংগ