জন্মশতবার্ষিকী শ্রদ্ধার্ঘ্য এবং আহমদ শরীফ চেয়ারের মূল্যায়ন।
।।বাবলী হক।।নাসরিন-জয়া হক।।
আহমদ শরীফ, ডক্টরেট উপাধি লাভ অনুষ্ঠানে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পেছনে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। |
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গবেষক ডক্টর আহমদ শরীফ এক অসাধারণ প্রতিভা। ২০২১, ১৩ই ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্মশতবার্ষিকী। তাঁর সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, "ডক্টর আহমদ শরীফ অনন্য। এমন আর নেই, আর পাওয়া যাবে না পলিমাটির এই ছোট ব-দ্বীপে। দ্বিতীয় নেই, তৃতীয় নেই, চতুর্থ নেই তাঁর"।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে তাঁকে পাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। শিক্ষকতা ছিল তাঁর সবচেয়ে বেশি আনন্দ ও আগ্রহের বিষয়। জ্বর নিয়েও তিনি ক্লাস করিয়েছেন। রোল কল করেই শুরু করতেন পাঠ্যবিষয় পড়া। ঘণ্টা বাজার পরও চলত পড়ানো। আমরা উশখুশ করলে খুব রেগে যেতেন। ক্লাসে ছিলেন কড়া মেজাজের শিক্ষক। কেউ কথা বললে বা অমনোযোগী হলে পড়ানো বন্ধ রেখে বকুনি শুরু করতেন। উনি কখনো কোনো ছাত্র-ছাত্রীর নাম মনে রাখতে পারতেন না। অথচ ইতিহাসের ঘটনার সন তারিখ অবলীলায় বলে যেতেন।
বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন বিতর্কিত আলোচিত ও সমালোচিত ব্যাক্তি। নিজস্ব জীবনে তিনি ছিলেন আপোষহীন। তিনি মনে করতেন "নৈতিক শিক্ষার উৎস কোন অবস্থায়েই শাস্ত্রিক হতে পারে না। জ্ঞান-বিদ্যা, নীতি, শাস্ত্র, শেখা-শেখানো আমাদের সেকেলে মত বদলাতে হবে। গুরু-শিষ্য, উস্তাদ-সাগরেদ ধারণাও বদলাতে হবে"। আহমদ শরীফের একটি লেখায় পড়েছি, "সাহিত্য কি জন্য? গ্রন্থ কি? উত্তর ছিল, যে পড়িবে তাহার বুঝিবার জন্য। নতুন চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে যারা নতুন চিন্তাপ্রসূন নতুন কথা বলে তারা নিন্দিত, লাঞ্ছিত কিংবা নিহত হয়। সমকালে তাদের সমর্থক মেলে না। কিন্তু যতই দিন যায়, মৃত্যুর পরে গভীর রাতের জ্যোৎস্নার মতো তাদের বাণী ও ব্যাক্তিত্বের গুরুত্ব ও ঔজ্জ্বল্য বাড়ে। তাই ভয়ে নতুন চেতনা চিন্তা প্রকাশে বিরত থাকতে নেই।"
তাঁর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত সুস্পষ্ট ছিল।
আহমদ শরীফ নিজের সম্পর্কে এভাবেই বলতে পছন্দ করতেন,
"যা ভাবি, যা বুঝি এবং যা জানি তাই লিখি–ডরাই না।"
ব্যাক্তিজীবন-পারিবারিক জীবনেও তিনি ছিলেন
অত্যন্ত স্পষ্টবাদী। 'ভাব-বুদ্বুদ' গ্রন্থে লিখেছেন, "আমি জীবনে কখনো নিজের বা নিজের সন্তানদের জন্য
কারো কৃপা-করুণা-সুপারিশ যাঞ্চা করিনি। আর যেদিন থেকে রোজগার করেছি সেদিন থেকে
পিতৃ বা পিতৃব্য ধন-সম্পদ ভোগ-উপভোগ করিনি। যদিও মালিকানা ছাড়িনি।"
১৯২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিভাগের সমুদ্রতীরবর্তী পটিয়ার সুচক্রদণ্ডী গ্রামে আহমদ শরীফের জন্ম। তার বাবা আবদুল আজিজ ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের করণিক। মা সিরাজ খাতুন ছিলেন গৃহিণী। আবদুল আজিজ ও সিরাজ খাতুনের পাঁচ সন্তান। তিন ছেলে, দুই মেয়ে। আহমদ শরীফ ছিলেন চতুর্থ। ১৯৪৬ সালে পিতা আবদুল আজিজের মৃত্যুর পর তিনি ফুফু ও ফুফার সাথে বসবাস শুরু করেন। তখন তাঁর বয়স পঁচিশ বছর। আহমদ শরীফের ফুফুর নাম বদিউন্নিসা এবং ফুফা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ছিলেন পুরোনো বাংলা সাহিত্যের জীবন্ত লাইব্রেরি। ফুফার সান্নিধ্যে এসে সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে নতুন করে যোগাযোগ সৃষ্টি হয়। এই যোগাযোগের মাঝেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেন তিনি।
তাঁকে নিয়ে আলোচনা অল্প কথায় সারা যায় না। তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর পরিবারকে নিয়ে কিছু লেখার জন্য কিছু উদ্ধৃতি তাঁর ডায়রি থেকে তুলে ধরছি।স্ত্রী সালেহা সম্পর্কে বলেছেন, "আমার অন্তরের আনন্দ ও ঘরের শোভা জীবন সঙ্গিনী মনে করেন আমি তাঁর প্রতি চির উদাসীন, আমার কাছে তাঁর আদর কদর নেই, অন্তত তিনি তা ঘন ঘন প্রাত্যহিক জীবনে অনুভব
করেন না।"
তিনি সন্তানদের নিয়ে বলেছেন,
"আমার ছোট সন্তান যাহেদ করিম স্বপন যেন আমার
জন্যই তার মর্তজীবন উৎসর্গ করে বসে আছে। সে তার হাইকোর্টের আইনের পেশায় অনীহ, নিজের শরীরের ও স্বার্থের প্রতি উদাসীন, তার একমাত্র নেশা কিংবা ব্রত আমাকে ভাবী
গবেষণার বিষয় গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা। আমার মেজ ছেলে ডক্টর নেহাল আমার শান্তি-সুখ-স্বাস্হের প্রতি সদা উদ্বিগ্ন দৃষ্টি রাখে দূরে দূরে থেকে। আমার বড় ছেলে মাহমুদ করিম রেজভী এসব ক্ষেত্রে
উদাসীন ও নীরব অনুরাগী। আমার পুত্রবধূমাতা ইসমত আরা কাজলের কাছে আমি যেন তার অন্যতম সন্তান। তিনিও
আমার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার, আমার লেখার কাজ ও সময় অবিঘ্নিত প্রয়াসে সদা সচেতন। মেজ বউমা বেলি আমার ওষুধ-পথ্যের খোঁজখবর রাখেন
দু' বেলাই। কয়েক বছর ধরে আমার কন্যা ডক্টর প্রথমা
রায় মণ্ডলও আমাকে বাঙলা সাহিত্যের অঙ্গনে ও সাহিত্যিকের সমাজে মর্যাদার মঞ্চে বসানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।" এই কন্যা তাঁর রক্ত সম্পর্কের নন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স পড়ার সময় প্রথমা রায় আহমদ শরীফের
ভাষণের ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর দিনের প্রতিটি ক্লাসে অনধিকার প্রবেশ করে ভাষণ
শুনতেন। লেখাপড়া শেষ করে কলকাতায় গিয়ে সংসার পাতেন। অনেক বছর পর স্বামী-পুত্র নিয়ে
পিত্রালয়ে যাবার সময়ে প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গেও দেখা করতে আসেন। এর বেশ কয়েক বছর পর
পিএইচডি
উপাধি অর্জন লক্ষ্যে আহমদ শরীফের কাছে কিছু তথ্যের ও
বইয়ের সন্ধান চান। স্যার আগ্রহের সঙ্গে সহায়তা-সহযোগিতা করেন। এরপর প্রথমার নিয়মিত চিঠিপত্র আসতে থাকে। একদিন একটা চিঠি পেয়ে আহমদ শরীফ চমকে উঠলেন।
সরাসরি প্রস্তাব স্যারকে তিনি বাবা সম্বোধন করতে চান। স্যার নির্দ্বিধায় সম্মতি
জানান কারণ তাঁর কোনো মেয়ে ছিল না। আহমদ শরীফের কলকাতায় কম যাওয়া হয় বলে প্রথমা
পিতৃদর্শনে বহু-ব্যয়ে বছরে একবার ঢাকায় এসে দেখা করতেন। প্রথমার স্বামী-পুত্র
স্যারকে পরিবারের পরমাত্মীয় রূপেই মানেন। স্যার লিখেছেন, " এসব প্রিয়জনই যে আমার দেহ-প্রাণ-মন-মননের
স্বাস্থ্য, আমার বল-ভরসার উৎস, তা তাদের কীভাবে জানাব, এর কি কোনো ভাষা আছে?"
অবাক হই এই ভেবে একজন ভাষাবিদ আবেগের কাছে ভাষা হারিয়ে ফেলেন! আজ এই জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় নমিত হই।
বাবলী হক
১০/০২/২১
তথ্যসূত্র : 'আহমদ শরীফের ডায়েরি ভাববুদ্বুদ', 'সংকটঃ জীবনে ও মননে' - আহমদ শরীফ , উইকিপিডিয়া ৷
আহমেদ শরীফ চেয়ারের মূল্যায়ন