ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Thursday, September 21, 2023

মণিপুরী বিয়ে এবং কুন্দ ফুল সমাচার

।।খাইদেম সিথি।।



মঙ্গলাচরণ হেইজিংপত


বিয়ের মঙ্গলাচরণ অনুষ্ঠানকে মণিপুরী ভাষায় বলা হয়"হেইজিংপত"বলে। এই দিন ছেলে পক্ষ থেকে কনের বাড়িতে মিষ্টি, ফলমূল,কনকে দেওয়ার আশীর্বাদের জিনিসসামগ্রী নিয়ে আসে এবং উভয় পক্ষের পুরুষ বায়োজৈষ্ঠ্যরা মন্দিরে বসে বিয়ের দিন ক্ষণ সবকিছুই ওইদিনে আলাপ করে।শেষে বরযাত্রী,কনের পাড়া প্রতিবেশী,অতিথি যারা মন্দিরে উপস্থিত তাদেরকে মিষ্টি বিরতন করে থাকে।
বর পক্ষ থেকে আগত  অনুষ্ঠানের যাবতীয় পূজার সামগ্রী,মিষ্টি বাঁশের এক ঢাকনাওয়ালা ঝুড়িতে করে নিয়ে কনের বাড়িতে আসা হয়। এই ঢাকনাওয়ালা ঝুড়িকে বলা হয় "ফিঙ্গারুক"। ফিঙ্গারুক মাথায় করে মহিলারা নিয়ে যায়। বিশেষ করে যাত্রায় যে মহিলারা থাকে তাদের "যাত্রাপুবি" ,বলে। যাইফাবীরা সাধারনত যাত্রার সামগ্রী বহন করে থাকে।

সিড়ি চৈ কাঙবা


মণিপুরী অনুষ্ঠানে চন্দন পরা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নাকে চৌকোনো সেইপের এবং নাক থেকে কপাল বরাবর যে লম্বা লাইন সিড়ি বলে।

চন্দন একটি বিশেষ শৈল বা চন্দন গাছের কাঠের টুকরা ও হয়। কয়েক ফোঁটা জল দিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে টুকরোটি ঘষে একটি পেস্ট তৈরি করে। তারপর এটি নাক এবং কপালে রাখার জন্য একটি বিশেষ অভিলাষের কাঠি ব্যবহার করে।

এই কাঠির আকৃতি অন্যরকম দুই প্রান্তে সরু থাকে। প্রতিটি মনিপুরী বাড়িতে এ কাঠি থাকে। নতুনদের জন্য এটি সর্বদা কঠিন আকৃতি এবং সর্বদা লাইন ঠিক আসে না।

চন্দন আমাদের মণিপুরী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই বিশেষ অনুষ্ঠানে চন্দন পরেন। একটি বিবাহিত মহিলা প্রতিদিন চন্দন পরেন।এই চন্দন ছাড়া মণিপুরী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করা অসম্পূর্ণ সমান। বিয়েতে বর,কনে কে বিশেষভাবে যারা পারদর্শী এবং য়াইফাবী মহিলারা চন্দন পরার দেয়।
য়াইফাবী(yaifabi) সেই সব মহিলাদেরকে বলে যাদের প্রথম সন্তান ছেলে হয়। তবে কালকের বিবর্তনে এখন যারা পুএসন্তান জন্ম দিয়েছেন তারাই য়াইফাবি হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে।

জামাই বার্তন


মণিপুরী বিয়ের আগের দিন কনের ভাই বরের বাড়িতে গিয়ে বরকে বিয়ের দিন আসার জন্য আমন্ত্রণ জানানোর রীতি রয়েছে। এই রীতিকে জামাই বার্তন বলে।

মণিপুরীদের বাড়ির সামনে দুটো জিনিস থাকা আব্যশক। বাড়িতে ঢুকেই খালি জায়গা রাখতে হয় একে "মাঙ্গন" বলে এবং উঠান "সুমাং"। বেশীরভাগ মনিপুরীদের আচার রীতি সব মাঙ্গনে করা হয়।
কনের মা,আত্নীয় বায়োজৈষ্ঠ্যদেরকে কনের ভাই ফুল-চন্দন দিয়ে আশীর্বাদ নেন এবং রওনা দেন বরের বাড়িতে আমন্ত্রণ (বার্তন) দিতে। সে সময় ভাইকে বেশ সমাদর করে নিয়ে যাওয়া হয়। ভাইয়ের একজন সহচর থাকতে হয় সে কনের ভাইকে আচারের নিয়মগুলো শিখিয়ে দিবে। এই বর বার্তন না পাওয়া পর্যন্ত বর কনের বাড়িতে বিয়ের জন্য আসতে পারে।
বরের বাড়িতেও বেশ সমাগম করে এই আমন্ত্রণ গ্রহন করা হয়। ছেলে মা-বাবা,আত্নীয়,বায়োজৈষ্ঠ্যরা ও আসন পেতে বসে থাকে। বর সর্বপ্রথম বায়োজৈষ্ঠ্যদের আশীর্বাদ নেওয়ার পরেই কনের ভাইয়ের থেকে বিয়ের আমন্ত্রণ (বার্তন)গ্রহন করে।


মণিপুরী বিয়ের ফুল লোহংবা লেই-লেংবা


মণিপুরী মেয়েরা বিয়ের দিন সাদা ফুল দিয়ে বিয়ের বরমালা গেঁথে থাকে। Kundo- কুন্দ এই ফুল আবশ্যক মালা গাঁথার জন্য। কুন্দ ফুল, জুঁই ফুলের গন্ধহীন জাত সাদা,শুভ্র। এই ফুলকে পবিত্র ফুল বলে গণ্য হয়। এই ফুলকে মনিপুরীরা ভালোবাসার ফুল বলে মান্য করে তাইতো বিয়েতে কনে এই ফুলের মালা গেঁথে বরমালা পরিয়ে বরের কাছে নিজেকে নিবেদন করে।

বিয়ের দিন সকালে কনে তার ছোট বোনদেরকে নিয়ে মালা গাঁথতে বসে। বরমালা গাঁথার সময় ছেলেরা থাকেনা কিংবা বরমালা সর্বপ্রথম বরের মালায় গলায় দেওয়া আগেও কোনো ছেলে যেনো এই বরমালা স্পর্শ না করে খেয়াল রাখা হয়। তবে বাংলাদেশে মণিপুরী বিয়েতে বরমালা গাঁথার প্রচলিত রীতি কিছুতা ভিন্ন। যেমন সিলেট শহরে কুন্দ ফুল তেমন পাওয়া না গেলে অন্য কোনো সাদা ফুল দিয়ে মালা গাঁথে।

সেক্ষেত্রে মালার প্রথম শুরুটা করে "যাইফাবী" হাত ধরে। যে মহিলার ছেলে সন্তান হয় তাদেরকে সাধারণত "যাইফাবী/য়াইফাবী" বলে থাকে। সামাজিক বা ধর্মীয় রীতিতে ভালো কাজের শুরুটা তাদেরকে দিয়েই শুরু করানো হয়।

অপরদিকে গ্রামের রীতিও বেশ মজার হয়। বিয়েরদিন খুব সকালে কনে পাড়ার যুবতীদেরকে নিয়ে "লুকমাই"(বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরী করা থালা) তে কুন্দ ফুল কিংবা ভাঁটফুল সংগ্রহ করতে যায়। গ্রামাঞ্চলে মণিপুরী বিয়েতে ভাঁটফুল দিয়ে খুব সুন্দর বরমালা গাঁথা হয়ে থাকে। ভাঁটফুলের খুব সুন্দর মনিপুরী নামও আছে "পুথাবলৈ"Puthablei.

বিয়ের দিন বরমালা গাঁথার এই রীতিকে "লোহংবা বা লেই-লেংবা"বলে। এই আচারে একটি বিশেষত্ব হল সবুজ কান্ড থেকে প্রথমে কুন্দ ফুলটি সমস্ত পাপড়ি মাঝখানে সূচ দেওয়া হয়। দ্বিতীয় ফুল পাপড়ি মাঝখান থেকে সূচ করতে হয়। এভাবে দুটো ফুল একে অপরের মুখোমুখি হবে। এটি দম্পতিকে একত্রিত করার আরেকটি প্রতীকি উপায়,নববধূ এবং বর উভয়ের আত্মাকে একত্রিত করে।

।।খাইদেম সিথি।।

অঙ্কনে, খাইদেম সিথি

ফটো সৌজন্য : খাইদেম সিথি।