ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Friday, September 15, 2023

মুন্নী ইয়াসমিনের তিনটি গল্প

।।যুদ্ধ বেলার গল্প।।শূন্যতার সীমায়।।খতিবা বেগম।।


যুদ্ধ বেলার গল্প 

ভাদ্র মাসের মধ্য দুপুর। তালপাকা গরমের হলকা বইছে সুপুরি ও নারকোল গাছের পত্রে পত্রে। মাটির উপর পা রাখা বুঝি দায়! নরম স্পঞ্জের পুরু স্তর ভেদ করে আগুনের তাতানো আঁচ দিব্যি টের পাওয়া যায় প্রতিটি পদক্ষেপে। মাথায় উপর বেতের বানানো লাইয়ের ( এক ধরনের ঝুড়ি) বোঝা যতো না ভারী লাগছে মিলিটারি আর তাদের দোসর দালালদের ভয়ে গ্রামের জনহীন মাঠ ঘাট তিতা মিয়ার মনের ভেতর ভয়ের দলা পাকিয়ে গলা অব্দি উঠে আসছে। কিন্তু উপায় নেই! সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে। এই খাবারের বোঝাটা তাকে বাগের ঝিলপাড় অব্দি পৌঁছে দিতে হবে।

এই এলাকায় মুক্তিরা অস্থায়ী ঘাঁটি গেঁড়েছে কিছু কাজ নিয়ে। লেবু মিঞা ভাই এই তামাম ভাওর এলাকার যুদ্ধের দেখাভাল করতেছেন। সবার কাজ ভাগ করে দেওয়া আছে। ট্রেনিং এর জন্য তরুণ ছেলেদের পাঠানো, মুক্তিরা এদিকে এলে তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা, পাঠানো, সর্তক করে খবর লেনদেন করা যাবতীয় কাজ লেবু ভাইয়ের দায়িত্ব, সেই যুদ্ধ শুরুর পর থেকে।

সময়টা ১৯৭১ সাল।

তিতা খুব চেয়েছিল বন্ধুক হাতে যুদ্ধ করবে। পাড়ার সব জোয়ান ছেলেদের যুদ্ধে চলে যাওয়ার খুব হিড়িক তখন। লেবু ভাইকে খুব অনুরোধ করেছিল। কিন্তু বয়স কম বিধায় মিঞা ভাই রাজী হননি।
বলেছিল, " তয়, আমি যুদ্ধ করতে পারমু না?"
লেবু মিঞা বলেছিলেন, " পারবি। বন্দুক হাতে লইয়া না। তরে অন্যকাজ দিমু।"
লাই বোঝাই রুটি। লেবু ভাইয়ের বাড়ি থেকে রুটি নিয়ে যাচ্ছে তিতা। রিনি বুবু আর ভাবি রুটিগুলো বানিয়েছেন। সাথে মন্তার মা বুয়া। মাঝে মাঝে শানু মেয়েটাও হাত লাগায় যেদিন মন্তার মা আসতে পারেন না।
কী সাবধানেই না কাজটা তারা করে থাকেন। এতোগুলো রুটি বানানো! দু'জন মানুষ, রিনি বুবু আর শানু বুয়া বানান, কোহিনূর ভাবি সেঁকতে থাকেন রুটি। গুঁড়, মুড়ি আর নারকোল উত্তর পাড়ার খোন্দকার বাড়ি থেকে আগেই চলে গেছে।
আজ অসময়ে রুটি বানিয়ে পাঠাতে হচ্ছে। কথা ছিল রাতে খাবারের চালান যাবে। কিন্তু মুক্তিদের আজকের অপারেশনটা বাতিল হয়ে গেছে। হয়তো খবর এসেছে, সিডিউল  পরিবর্তন করতে হয়েছে। তাই এই অবেলায় রুটি বানিয়ে পাঠাতে হচ্ছে।

রিনি বুবু অদ্ভুত দক্ষ হাতে রুটি বানিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না! আজকে ভাবির শরীরটা ভালো নেই। মাইগ্রেনের ব্যথা। এতো অল্প সময়ে বিশজন মানুষের রুটি!!  ঢেঁকি ঘরের পেছনে খড়ি সংরক্ষণ করে রাখার ঘর আছে। সেখানে একটি চুলা তোলা হয়েছে। এই অঞ্চলে সবই মাটির চুলা, কতো বিচিত্র নকশা এইসব চুলার। দু'মুখো, তিনমুখো এইসব চুলা। একই আগুনে দুই চুলার, তিন চুলার সংস্করণে একইসাথে ভাত, তরকারি দুই আইটেমই রান্না করা সম্ভব।
রিনি এই অল্প সময়ে একহাতে কুলাতে পারবে না। তাই "ডাবল রুটি" বানানোর সিস্টেমে চলে গেল। দুই গোলা দিয়ে এক সাথে দুটো করে রুটি বানানো। অভিনবত্বটি এসেছে মূলত প্রয়োজন থেকে, সময়কে আয়ত্তে রেখে তাল - লয়- ছন্দ মিলিয়ে চলতে।
এই দেশের হাজার, লক্ষ ছেলেরা জীবনবাজি রেখে মায়ের সম্ভ্রম বাঁচাতে, সম্মান বাঁচতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। রিনির ভাই লেবু মিঞা ভাইও এদেরই একজন। কতোদিন মিঞাভাইকে সে দেখে না। শুধু তার বার্তা পায়, খাবার বানানোর বার্তা। বিশ্বস্ত সঙ্গীরা এসে নিয়ে যায়, পেছনের বাগিচা দিয়ে এসে ঢেঁকি ঘর থেকে। আটার যোগান দেন বড় মিঞা। মনির বেপারি তার মিল থেকে গম ভাঙিয়ে আটা পৌঁছে দেয় সুবিধা মতো সময়ে।
এরা সবাই কেমন যেন একটা চেইনের মতো কাজ করে যায়।
এরা আছে বলেই সব বাধা ও কষ্টগুলো কী স্বচ্ছন্দেই না রিনি আর কোহিনূর ভাবি মোকাবেলা করতে পারছে। এদের দু'জনেরই স্বামীরা কাছে নেই। ভাই যুদ্ধে, আর রিনির স্বামী পশ্চিমের একটি দেশে  পড়তে গিয়েছে।

দুঃসময় যখন আসে, তখন তা চার হাতপায়ে আসে। সময়টা সত্যিই বৈরি! মানুষের পুতুল খেলার মতো গড়া সব স্বপ্নই ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আকাশে শকুন উড়ে নিরঙ্কুশ মাংসের লোভে। যান্ত্রিক দানব যেন একেকটি পাকিস্তানি সেনা, কেড়ে নেয় একেকটি প্রাণ।

খুব কষ্টের! অথচ এখানে কারোরই বুঝি কিছু করার নেই। এরা কথা বলে গুলি, টোটা, বেয়নেট চার্জের ভাষায়।
এই পৃথিবীর ঈশ্বর বধির, কখনো একপেশে, কখনো শোধ বোধহীন। নিষ্পাপ সাধারণ মানুষের আর্তনাদ কারো কানে পৌঁছায় না।

শুধু এটুকুই বলা যায়, কারো সব হারানোর বেদনাকে উপশম করার উপায় কারো জানা নেই। প্রতিটি যুদ্ধ একেকটি পরিবারকে সর্বস্বান্ত করে দেয়। কোথায় ফরিয়াদ করবে? কে শুনবে?
কোনো ন্যায় -সালিশ কারো প্রিয়জনকে ফিরিয়ে দেবে না। এই মেরে ফেলাকে নিয়তির বিধান বলার মতো ভন্ডামীর আশ্রয় কেউই  নিতে পারছে না।
ভর দুপুরের তপ্ততা তিতা পা'দুটি আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। কদম শিথিল হয়ে আসে। টপ টপ করে নোনা ঘাম কপাল বেয়ে চোখ ছুঁয়ে যায় বারবার। চোখ জ্বলে উঠে জ্বলুনি দিয়ে। বাহুতে বাঁধা গামছা দিয়ে বারকয়েক মুখটা মুছে নেয় তিতা।

আজ রিনি বুবু বারবার জিজ্ঞেস করছিল তার মিঞা ভাইয়ের কথা। এই বাড়ির প্রত্যেকেই খুব আতঙ্কে আছে। তিতা শুনেছে, যে কোন সময়ে ভাওর গ্রামে হানা দিবে মিলিটারির দল। বিশেষ করে লেবু ভাইয়ের বাড়িতে। তার বোবা বোনটা থেকে থেকেই বিচিত্র সুরে কষটে কণ্ঠে কাঁদে। ভাষাহীন কড়কড়ে সে কণ্ঠের চাপা ব্যথার ফোঁপানো রাত্রির নিঃসঙ্গতাকে ব্যঙ্গ করে।

যে কোন সময় লেবু মিঞাদের বাড়ির বাসিন্দাদের বাড়ি ছেড়ে যেতে হতে পারে। গ্রামে পাকিস্তানি আর্মিদের টার্গেট এই বাড়ি। বাড়ির কিছু শরীক খুবই নাখোশ সেজন্য।  হাসেম মিঞা সখেদে প্রায় বলেন হালিমার দিঘির পাড়ে ময় মুরুব্বিদের সাথে, " কি নিয়ে তরা পারাপারি করছিস!? মুসলমান হয়ে মুসলমানগের বিপক্ষে দাঁড়াইছিস!! ভারতের কু'শলাপরামর্শ শুইনেছিস! মেয়ে মানুষের বুদ্ধি শোনা লাগে শেখ মুজিবের! আরে, যে দ্যাশে মহিলা কারবারি, ছেলে দরবারি, গাই গরু দিয়ে হাল চাষ করে.... তাগের উন্নতি কস্মিনকালেও হবিনে!!
অকর্মা ছাওয়ালডা কি বিপদে না ফেলেছে!!
তিতা জোরকদমে ঘোরা পথ দিয়ে বাগের ঝিলপারের দিকে ছুটছে। কতোগুলো মানুষের ক্ষুধার্ত মুখ মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করলো। বাগের ঝিলপাড়ের কিছুটা আগে মোস্তাকের মুড়ার মধ্যে  ( বেতগাছের ঝোপ) লাইটা রেখে ফিরে আসবে সে। ওই মুড়া থেকে আরেকজন লাইটা নিয়ে জায়গা মতো পৌঁছে দেবে।
এখানে কে রাজাকারের চর, কে চর নয় বুঝা মুশকিল, তাই কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। খুব সাবধানে থেকে কাজগুলো করতে হয়। 

ময়রা পাড়ার পাশের দিঘিটা পার হয়ে সবেগে হাঁটতে লাগলো তিতা। সূর্য ঠিক মাথার উপরে। থেকে থেকে মৃদু হাওয়া এসে শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে। চোখ চলে যায় দিঘির প্রান্ত পেরিয়ে বাগিচার দিকে, যেখানে সুপুরির গাছগুলো গায়ে গায়ে লাগিয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে।
থোকা থোকা সুপুরি ঝুলছে, খানিকটা লালচে বর্ণ ধারণ করে আছে। বেশ লাগছে দেখতে।
এই তপ্ত শীশাগলা দুপুরে অল্প-বিস্তর রনা গাছ ক'টি নির্নিমেষ নয়নে চেয়ে দেখছে, এই সুনসান প্রকৃতির ধ্যান ভাঙ্গছে এক ছুটন্ত মানব। আর গাছগুলো এক অতন্দ্র প্রহরী যেন,প্রতিমুহূর্তের সঙ্গী। বাতাসের দোলায় রিনিঝিনি ঝঙ্কার তুলে বলছে,  "আমি আছি। ছায়ায় ছায়ায়, বেলায় বেলায়।"
সত্যিই নিরবতার একটি ভাষা আছে, তিতা আনমনে ভাবলো। সেটা মালুম হচ্ছে এই মুহূর্তে। এই জনমানবহীন ছিমছাম ভরদুপুরে দিঘির পাড়ের বাঁশঝাড়ের উপর পড়ন্ত রোদেলা দুপুর অদ্ভুত লাগছে। বাতাসের মৃদু কাঁপনে গাছগুলো কেমন হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে একটি আরেকটির ওপরে।
এমন অসামান্য একটি দেশের মাটিতে তিতার জন্ম। শৈশব পেরিয়ে কৈশোর অতিক্রান্ত প্রায়। এদেশেরই একঝাঁক তরুণ রোদেলা দুপুর, গোধূলি -সন্ধ্যা, স্বর্ণালি ভোরের জন্য সব আরাম আয়েশের গলায় টুঁটি চেপে বাদাড়ে, বাগিচায়, মাঠে - বিলে খেয়ে না খেয়ে ঘাম, রক্ত আর প্রাণ ঝরাচ্ছে অকাতরে। রিনি বুবুর ডাবল রুটি বানানো , কোহিনূর ভাবি, শানু বুয়া কিংবা মন্তার মা বুয়ার অক্লান্ত পরিশ্রম এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জন্য মুখে এক গ্রাস আহার তুলে দেয়ার এই প্রয়াস শুধু একটি আশা বুকে ধরে রেখে যে, একদিন স্বাধীনতার ভোর আসবে পরাধীনতার গ্লানি মোচন করে।
তিতার জোর করে গামছায় চোখ মুছে নিলো। ঘাম আর চোখের জল একাকার হয়ে গামছাখানি আরো ভিজে উঠলো।

আজ পথ যেন ফুরোতে চায় না। লম্বা, বিজন পথে এখন কোনো কামলা, কৃষাণের দেখা মেলে না। চাষের জমিগুলো  ঠা ঠা করছে রোদে পুড়ে। কি আশ্চর্য, একটা কুকুরের দেখাও পায়নি আজ তিতা।
কোনো বিপদ  ঘাপটি মেরে বসে নেই তো! লেবু ভাই বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলেন শুরুর দিকেই। "এক পথে বারবার যাবিনে। পথ বদল করবি। ফেউ ধরলে কাটাতে না পারলি, গন্তব্যে যাবিনে।"
তাহলে!?  মনটা খচখচ করছে। নাহ, পথ ছেড়ে তাহলে আরো পশ্চিমে সরে যেতে হবে। শরীর - মন অবসন্ন হয়ে আসছে। বড় ইচ্ছে করছে জিরিয়ে নিতে। কিন্তু সবাই অপেক্ষা করবে! ক্ষুধার্ত মুক্তিযুদ্ধের সেনানিরা!  কিন্তু আরো পথ যে বাকী!
নাহ, চলার উপরেই থাকলো তিতুমীর হোসেন ওরফে তিতা মিয়া।

মুক্তির আনন্দটাই অন্যরকম। যে কোন মুক্তিই। স্বপ্ন থেকে মুক্তি, দুঃখ থেকে মুক্তি, সম্পর্ক থেকে মুক্তি, ভুল জানা থেকে পরিত্রাণ...  সবই স্বস্তি বয়ে আনে।

পরাধীনতার শেকড় পরেই জন্মেছি আমরা। দেখেছি এক ভয়াবহ শোষণের কারাগারে আমরা সবাই বন্দী। আমরা পরাধীন পূর্ব পাকিস্তান!  পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ - বঞ্চনায় প্রতিনিয়ত সর্বস্বান্ত হচ্ছি। তাই লড়াইটা এখন অধিকার অর্জনের সীমা পেরিয়ে স্বাধীনতার অর্জনের লড়াই। মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম.....  লেবু ভাইয়ের কথাগুলো মজ্জায় মিশে গেছে, রক্তে যেন এক খরস্রোতা নদীর জোয়ারে মুহূর্তেই ভেসে যায় কী এক অদৃশ্য আবেগে। পিতৃ - মাতৃহীন ছেলেটার মানসচোখে এই ভাওর গ্রামটার নির্মল পটভূমি ভেসে ওঠে। এই গ্রামটিই তার দেশ, তার পৃথিবী,  তার মা।
কিছুক্ষণ ধরে মৃদু চলার শব্দ কানে বিঁধছে। কখনো মনে হচ্ছে নিজেরই পদধ্বনি। কিন্তু ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন বলছে অন্যকিছু। এবার আরেকটু দক্ষিণে একটু এবড়োখেবড়ো পথ ধরেই অগ্রসর হলো তিতা মিয়া। খানিক উঁচু টিলার মতো এক জায়গায় উঠতে লাগলো। কিছুটা পথ এগিয়ে সঘন গাছগাছালির ঘের দেয়া জায়গাটিতে ঢুকে পড়লো। একটু থেমে রুটিভর্তি লাইটা নামিয়ে রাখলো। কিছুক্ষণ ঘাপটি মেরে বসে থাকলো তিতা। মন যখন অজানা আশঙ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে, তখন পরখ করে দেখা দরকার।  কোনকিছু নির্দোষ ভাবার কিছু ঘটেনি।

শঙ্কায় শঙ্কায় আধমরা পুরো গ্রামখানি। স্থলে- জলে সবখানেই নির্মমতার আলামত নিত্যকার এখন। কেউই বেখবর নয়। কেমন করে জানি সব খবর চলে আসছে। পাকিস্তানের বেজন্মা চরদের জুলুম - অত্যাচার, অসহযোগিতা কারো অজানা নেই। তেমনি মুক্তিসেনাদের অভিযানের খবর, প্রাণপণ লড়াইয়ের খবর আধমরা মানুষগুলোর কাছে পৌঁছে যায়।

এই মুহূর্তে মন, কান, চোখ,প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের সজাগ অনুভূতির উপর ভরসা করছে তিতা। ধরা পড়ে যাওয়া যাবে না। কিংবা যদি ধরা পড়ে তা যেন এই রসদসহ নয়। যুদ্ধরত মানুষগুলোর আহারের বিলি ব্যবস্থা না করে নয়।
এ শুধু শুকনো রুটি তো নয়, ভাওর গ্রামের তরুণী, বধূ, মাতা, সব নারীদের ভালোবাসা মাখানো অনুপ্রেরণা, নিজেদের সংহতি প্রকাশ, নিজেদের নিবেদন করা। এও তো এক যুদ্ধ!
যারা প্রতিদিন এই অর্ঘ্য নিবেদন করে যাচ্ছে। আর ডাকহরকরার মতো সেই নৈবেদ্য পৌঁছে দিচ্ছে তিতা। এই অসামান্য স্বস্তি ও তৃপ্তিটুকু দু'ফোঁটা জলের ধারায় গড়িয়ে পড়লো তিতার চোখ বেয়ে।

শুধুমাত্র বোকারাই অপেক্ষা করে। ভালোবাসা নামের চোরাবালিতে ডুবে মরে। সুন্দর জীবনের মাহাত্ম্য বুঝতেই পারে না। কেউ কারো জন্য বাঁচে না, অপেক্ষা করে না। প্রতিটি মানুষই নিজের স্বার্থে চলে, বলে আর নকল চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

কিছু মানুষ বহু দেরিতে বোঝে আর আক্ষেপ করে।
কেউ কেউ শুধু নিজের জন্য বাঁচতে চায় না। সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চায়। আর সেই বাঁচাটা যদি হয় একটি স্বতন্ত্র ভূখণ্ড, নিজের মার্তৃভূমিকে বাঁচাতে। যেখানে সমগ্র জাতির ঠাঁই হবে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার জন্য।
শুধু নিজের জন্য। কিছু মানুষ কখনোই কারো হতে পারে না। এমনটি ভাবলে বোকার স্বর্গে বাস করো তুমি। মানুষগুলো নিজের স্বার্থেই কাউকে ব্যবহার করে কিংবা নিজেই ব্যবহৃত হয়।
ভেক মানুষদের যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত।

  সূর্য ক্রমশ অস্তে হেলে যাচ্ছে। তিতা মিয়ার অপেক্ষা বুঝি ফুরায় না। ঝোপের পাশ দিয়ে দড়ি হাতে ছাগলের গলায় বাঁধা এক যুবক হেঁটে গেল। ধেনু চরানো রাখাল কি সে? দ্বিধা আর সন্দেহে চোখ দুটি ছোট হতে হতে পিটপিট করে তার। ছাগল হাতে বেলা পেরিয়ে নিরালা ঝোপের কাছে কোন্  রাখাল ঘাসের খোঁজে ইতিউতি ঘুরে বেড়াবে?
ঘোর সন্দেহে তিতার নিঃশ্বাস উঠানামা করছে। এ নির্ঘাত রাজাকারের চর। খোঁজ চায়, খবর চায়। তিতার কাছে তথ্য চায়, লাইয়ের ভেতরের রুটির ইতিবৃত্ত কি! তথ্য চায়!
রসদ নিয়ে কই যাও তিতা মিয়া!? তুমি ধরা পড়ে গেছো! তোমারে নিংড়ে সব খবর জেনে নেয়া হবে! মনে মধ্যে কথাগুলো যেন গুমরে উঠলো।
-- কই যাস! তখন থেইক্যা পূবে, পশ্চিম, উত্তরে ঘুরাঘুরি কইতাছোস! তুই মুক্তি। ধরছি তোরে! দেশের শত্তুর, শেখ মুজিবের পা চাটা কুত্তা লেবু মিয়ার চর তোরা!!
মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে তিতা মিয়ার।  কিন্তু লাই কোথায়, নির্দোষ ছাগলটি দাঁত দিয়ে ঘাস ছিঁড়ে খাচ্ছে নির্বিকারে।
কিছুতেই দেঁতো লোকটির হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছে না।
-- কি আবোলতাবোল বকতাছো!! আমি কাউরে চিনি না। ক্যাডায় মুজিব?
-- তর বাপের বাপ! হারামজাদা। তর লেবু বাপের বাপ! তর মুক্তিগের বাপ। এইবার চিনছোস হারামখোরের বাচ্চা।
-- ওই গাইল দেস ক্যান!? কারোর বাপ দাদারে আমি চিনি না।
মনে মনে ভয়ের শীতল স্রোত কলিজা পানি করে দিচ্ছে। যদিও আর কাউকে দেখতে পাচ্ছে না তিতা। লোকটা একা। ডান পাশ দিয়ে ছোট্ট বিল চলে গেছে। কচুরিপানায় ভরা। হালকা বেগুনি রঙের ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে গোটা বিলের এপাশ ওপাশ। সাঁতারে পার হওয়া মুশকিল হবে।
লোকটা অপেক্ষা করছে কারো জন্য কি!? এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কি?
-- আমারে ছাড় দেহি! মুতবার গেছি, কামডা সারবারও পারলাম না। আমি পথিক, কথা কেনা-বেচা করি না। অসীম সাহসে চনমনে কণ্ঠে উত্তর দিয়ে কালক্ষেপণ না করার প্রস্তুতি নিলো মনে মনে। নাহ, রুটিভর্তি লাই ঝোপের ভেতর নিরাপদেই আছে। এখন এদিকে একটু নিশ্চিত হওয়া গেলো।
-- তুমি মুতবার নাম কইরা কোন থান থেইক্কা বার হইছো বাপজি, আমি বুঝবার পারি নাই মনে করছো!! অচিন মানুষ খাড়া রইদের মইধ্যে ঘুরাঘুরি, মুক্তিগের চর ছাড়া আর কোন মাজরা নাই।
-- তর মাথা....  আৎকা ধাক্কা দিয়া তিতা মিয়া অচেনা লোকটির হাত ছুটিয়ে দৌড়াতে লাগলো। অনাহুত লোকটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আকস্মিক ঘটনায় নিজের টাল সামলাতে পারলো না, পড়েই গেলো।
দৌড়াচ্ছে তিতা দিকবিদিকশুন্য হয়ে।  তাকে এই জায়গা থেকে দূরে সরে যেতে হবে। কতোটা দূরে জানে না! কিন্তু ধরা পড়া চলবে না। আরো, আরোও সাবধান হওয়া উচিত ছিল। পেছনে ফেউ লাগতে পারে মিয়া ভাই বারবার বার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন।  সকলকে এই মর্মে জানিয়ে দেয়া হয়। গ্রামে গ্রামে মিলিটারি হানা দিচ্ছে, গ্রামগুলো চিনিয়ে দিচ্ছে দেশি দালালেরা। সব দেশে, সব কালেই কিছু সুবিধাবাদী ও বিশ্বাসঘাতক থাকবেই।

দৌড়ের ওপরে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে দেখলো রাস্তা আর খুঁজে পাচ্ছে না। কচুরিপানা রাজ্য ছাড়া জমিনের দেখা নেই। বিশাল গড়ের আরেক মাথায় এসে পড়েছে। এখন উপায়!?  আপনমনে বলে উঠলো তিতা। ভাববার সময় নেই। আগুপিছু না করে নেমে পড়লো গড়ের মধ্যে। কচুরিপানা সরিয়ে মাথা ভাসিয়ে এগুতে শুরু করলো। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ছে। কতক্ষণ ধরে সাঁতরে চলছে সে খবর মালুম করতে না পারলেও কচুরিপানা সরিয়ে সরিয়ে খুব বেশিদূর যে সে এগুতে পারেনি তা বেশ বুঝতে পেরেছে। কিন্তু শত্রুর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছে সেটাই বড় কথা। তার চেয়ে বড় কথা, সে ধরা পড়া মানে সাড়ে সর্বনাশ!!  অনুচ্চস্বরে বলে উঠলো তিতা মিয়া।

আজ খুব ভোরে কোহিনূর ভাবির ভয়ার্ত চিৎকারে রিনি বেগমের ঘুম ভেঙে গেলো।  কি হলো!

-- সদরে মিলিটারি এসে গেছে। তোমার মিয়া ভাইরে খুঁজতেছে। এই বাড়িতে যে কোন সময়ে পাকিস্তানি মিলিটারি হানা দিবে। পালাতে হবে। বাড়ির সব শরিক পালাচ্ছে। উঠো তাড়াতাড়ি!
রিনি কোন প্রত্যুত্তর ছাড়াই তিন বছরের মেয়ে মুনিয়াকে নিয়ে পশ্চিমের বাগিচার দিকে ছুটলো। মেয়েটিও কি এক ভয়ার্ত উৎসাহে মায়ের হাত ধরে, মামীর পাশাপাশি দ্রুত হেঁটে যেতে লাগলো। সারা বাড়ির সব মহিলা আর শিশুদের এই পলায়নপর কাফেলায় দেখা গেল। আজ আর কারো মুখে রা নেই, শব্দ নেই, ছুটন্ত পায়ের শব্দ ছাড়া। বিশাল বাগিচার আরো গভীরে যেতে যেতে ভাবছিল রিনি, এই অচিন গ্রামটিকে মিলিটারিরা কিভাবে জানে!  আর ভাওর গ্রামের কোন অখ্যাত লেবু মিয়াকেও বা কিভাবে চেনে বা জানে!

যুদ্ধই বুঝি মানুষের চরিত্র চিনিয়ে দেয়। ভণ্ডামির দায় যুদ্ধ বা কোন দুর্যোগ আমলে নেয় না। যুদ্ধটা ঘরেও চলে, বাইরেও চলে। বিভীষণেরা তাদের কাজ নিষ্ঠার সাথেই করে চলেছে।
আর এই যুদ্ধে নারী ও শিশুদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। প্রতি পদে পদে কি ভয়ানক জিল্লতি। তাদের যুদ্ধটা দেখা যায় না।
বাগিচা, পগার পার হয়ে ধানি জমির আল  ধরে চলছে কাফেলা। দূর থেকে দুটি কিশোর বয়সের ছেলে হাত নেড়ে কি যেন ইশারা করছে। আরো কিছুটা এগিয়ে যেতেই বকুলকে চিনতে পারলো রিনি।
-- রিনি বুজি, মিলিটারির বড় গাড়ি বড় রাস্তা ধরে রামগঞ্জের দিকে চলে গেছে। লেবু ভাই খবর পাঠিয়েছেন, ভয় নাই, সবাইকে বাড়িতে ফিরে যেতে বলেছেন।
এতোক্ষণে সবার গুনগুন আওয়াজ শোনা গেলো।  সম্বিত ফিরে পেলো যেন একটি গ্রামের বিভিন্ন বয়েসী মানুষগুলো। তারা কারো মা, কারো বোন, কারো পত্নী।
মুনিয়া বলে উঠলো, " মা, পানি খাবো।"
সত্যিই তো। এতো বেলায়ও ক্ষুধা -তৃষ্ণার কথা কারো মনে হয়নি।
প্রাণের ভয়ে, সম্মানহানির ভয়ে সব বোধ-শোধ ভুলতে বসেছিল ভাওর গ্রামের মেয়ে ছেলেরা ও শিশুরাও।

বিশাল গর্ত খোঁড়া হয়েছে শোয়ার ঘরের মাঝ বরাবর। বাড়ির মহিলাদের বুদ্ধি। দামি জিনিসপত্র সব পুঁতে রাখবে। যে কোন সময়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে। আজ ভাওর গ্রামটি এড়িয়ে অন্যত্র চলে গেলেও আগামীতে একই কাজ করবে মিলিটারি - রাজাকারের দল এমন বিশ্বাস কারো মধ্যে কাজ করছে না।
রিনি তার গহনাপত্র অল্প- সল্প যা ছিল, কিছু শাড়ি কাপড় একটি টিনের ট্রাংকের মধ্যে ভরে গর্তের মধ্যে রেখে দিল। কোহিনূর ভাবি, রিনির মা সবাই তাই করলেন, বাড়ির অন্যান্যরাও, কাঁসার জিনিসপত্র, কেউ কেউ কাঁচের তৈজসপত্রও ভারী ট্রাংকে ভরে ওই গর্তে রেখে দিল। সবাই মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়ে রাখলো, যে কোন সময়ে বাড়ি ছাড়তে হতে পারে।
সাথে শুকনো খাবারের ব্যবস্থাও নেয়া হলো।
আজ কোন বার্তাবাহক আসছে না। খাবার নেয়া হবে কিনা কিছুই বুঝতে পারছে না।
কোহিনূর ভাবি তাগাদা দিচ্ছেন, " প্রস্তুতি রাখো। আটা মেখে রুটিগুলো বানিয়ে রাখো। শীতের সময়ে নষ্ট হবে না। ওরা এলে ভাজি ভুনা বসিয়ে দেবো। আজ আর অন্যকিছু দেবার মতো নেই। কিছু বাজার-ঘাটের ব্যবস্থা করতে হবে।
কিন্তু রিনি বেগমের মনে শান্তি নেই। মুনিয়ার বাবার কোন খবর পাচ্ছে না। মাসখানেক ধরে কোনো চিঠিই আসছে না।
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আটা গুলতে বসে গেলো রিনি রসুই ঘরের পেছনে ঢেঁকি ঘরে।

নারীর জন্য সত্যিকারের সমস্যা হচ্ছে বাস্তবতা থেকে পলায়নকে প্রত্যাখ্যান করা এবং সীমাতিক্রমণতার মধ্যে আত্মশুদ্ধি খোঁজা।

প্রাতিষ্ঠানিক অল্পবিস্তর পড়াশোনা ও পারিবারিক লাইব্রেরি থেকে কিছু বই পুস্তক পড়ে, সর্বোপরি জীবনের বাস্তবতা, বড় ভাইয়ের রাজনৈতিক জীবন সবকিছু মিলিয়ে রিনি  নিজের মধ্যে এক স্বাধীন মন মানসিকতা পোষণ করে। সে স্বপ্ন দেখে একদিন স্বাধীন দেশের মুক্ত হাওয়া, জলকাদায় মাখা সূর্য- জলের প্রকৃতিতে তার মুনিয়া বড় হবে, শিক্ষার আলোকচ্ছটায় পরিণত হবে, ভেদাভেদ থাকবে না নারী-পুরুষের এমন একটি সমাজব্যবস্থায় তার সন্তানেরা বড় হবে, বিস্তার লাভ করবে।
তিতার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে রিনির। মার্তৃপিতৃহীন ছেলেটা অসীম সাহসের সাথে কত ভালোবেসেই না কাজ করে যাচ্ছে, প্রাণটা হাতে নিয়ে। চারপাশে চরদের আনাগোনা বেড়ে গেছে, এটা ঘরে বসেই অনুমান করতে পারে। আজ রাতে কবরখোলায় রাত পোহাবে সবাই, আপাতত এই ভাবনাটা কিছুটা সোয়াস্তি দিচ্ছে।

গোলক তার পরিবার পরিজন ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে মুজিব মাস্টারের পরিবারের সাথে। পরিস্থিতি বুঝে ঝুঁকি নিতে চাইলো না। হাটে একটি মুদির দোকান আছে তার। যুদ্ধের ডামাডোলে সবকিছু মন্দা যাচ্ছে আজকাল। তারপর হিন্দু বলে মন্দলোকেরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কথায় কথায় ভারতের দালাল বলে গালি দেয়। তার বাপ- দাদার ভিটে সে হিন্দু বলে তার আজন্ম অধিকার এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়া এতোই সহজ!? গোলক ভেবে পায় না, শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে আরেকটি অচেনা দেশে কেনো ঠেলে দিতে চায় পাকিস্তানের পক্ষের দালাল গোষ্ঠী।  এরা নিজেরা তোষামোদ করে পরাধীন থাকতে চায় পাকিস্তান নামের দেশটির সাইনবোর্ড গলায় ঝুলিয়ে আবার অন্যদেরও নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিবেচনা করে।

দেবকড়ির হাট থেকে ফেরার পথে তোফর আলীর সাথে দেখা। সে তিতা মিয়ার খোঁজ জানতে চাইলো। খাবার নিয়ে বহু আগে আসার কথা কিন্তু বিকেল গড়িয়ে যায়।
তিতার খোঁজ নিতে তোফর আলী বেরিয়ে পড়ে। খুব সন্তর্পণে এপথে সেপথে ঘুরে লেবু মিয়ার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো। রিনি বেগমের মাথায় হাত।
-- সেকি, কোন বিয়ানের কালে তিতা খাবার নিয়ে চলে গেছে! কোনো বিপদ হলো নাকি!?

কচুরিপানার ভেতরে কালো ঘোলা জলে আঁধার অব্দি কখনো ডুবে, কখনো মাথা জাগিয়ে খুব ধীরে চলেছে তিতা মিয়া। এভাবে কালক্ষেপণ করে তিতা সন্ধ্যার পর জমিনে পা রাখলো। কোণাকুণি ধানকাটা জমির মাঝ বরাবর হেঁটে গেল। মাঝে মাঝে ঝোপের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে পরখ করেছে ফেউ লেগেছে কিনা! জীবন বাজি রেখে এই লুকোচুরির খেলায় নিজেকে বারবার মনে হচ্ছিল সে এমনই একজন বাজীকর যে নিজের মাতৃভূমিতে প্রতি পদে পদে শত্রুর গায়ের সোঁটা গন্ধ খুঁজে মরছে! ভেজা কাপড়ে উত্তুরে হাওয়া কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। মন বলছে আবার ফিরে গিয়ে রুটির লাই'টা ঝোপ থেকে বের করে নিয়ে আসে। কিন্তু শান্তির বাচ্চারা যদি ফাঁদ পেতে রাখে!

ঝুঁকিটা নেবে কী!?
মনে পড়ে গেল, রিনি বুবুর একহাতে শতেক বানানো ডাবল রুটি!!  এই রুটি বানানোর গল্প রিনি বুবু কতো গর্ব নিয়ে বলে। মুক্তিসেনা ভাইদের জন্য বানানো রুটি - ভাজি সে বয়ে নিয়ে যায়। আর আজ সে ব্যর্থ হলো!?
উত্তরের শিহরণ ধরা বাতাসে হাত নেড়ে যেন নাকচ করে দেয় তিতা। প্রারম্ভিক পৌষের হিমের বিপরীতে ধাবিত হলো তিতা তীব্র অভিমান। সারাদিন নাওয়া- খাওয়া নেই, দিন গড়িয়ে রাতের আঁধারের যাত্রী তিতা মিয়া।

নিখোঁজ থাকার প্রায় তিন /চার দিন পর আঁটিবাজারের আরো পরে মিরবাড়ির দক্ষিণে পগার পার হয়ে  বাঁশ ঝাড়ের পাশে তিতা মিয়ার লাশ পাওয়া যায়। কেনো, কিভাবে সে ওই এলাকায় গিয়েছিল সেটা কোনো বড় রহস্য ছিল না কারণ এটা পরিষ্কার ছিল, সে স্বেচ্ছায় সেখানে যায়নি। কুরবানির পশু জবাই করার মতো খুব নৃশংসভাবে তিতার গলায় ছুরি চালিয়ে দেশি বিশ্বাসঘাতকের দল তাকে হত্যা করেছিল।

তবে তোফর আলী সেই রুটি বোঝাই লাইটি পেয়েছিল ঝোপের মধ্যেই। তিতাকে খুঁজতে গিয়েই সংরক্ষিত খাবারের চালান পেয়ে কারো বুঝতে বাকি থাকেনি, কতোটা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঠানো খাবার তিতা মিয়া লুকিয়ে রেখেছিল। ধারণা করা হয়, পরে খাবারের লাই'টি নিতে এসেই সে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে।

প্রচন্ড ভীতিকর পরিস্থিতিতে তিতাকে সেই বাঁশঝাড়ের পাশেই সমাহিত করা হয়। স্বজন ছাড়া, বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে নিরবে নিশ্চুপে মুক্তিযুদ্ধের এক অখ্যাত সৈনিক এভাবেই হারিয়ে গেলো।
শোনা যায়, তিতার অন্তিম যাত্রায় লেবু মিয়াসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারাও উপস্থিত হয়েছিলেন যারা সেসময় ওই এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন।

এ দেশের বহু সংগ্রামী মানুষের আত্মত্যাগের ফসল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ যাদের অনেকেই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছেন লেবু মিয়ার মতো মুক্তিযুদ্ধের একজন দক্ষ ও ত্যাগী সংগঠক যারা কখনোই কোন সুযোগ গ্রহণ করেনি। কখনো বলতে আসেননি তাদের রক্ত- ঘাম ঝরানোর ইতিবৃত্ত।

কেউ কখনো জানেনি রিনি বেগমদের ডাবল রুটি বানানোর ইতিহাস। এইসব মুক্তিসেনাদের গল্প কখনো কেউ জানবে না। যারা জানা অজানার সীমানা পেরিয়ে বহুদূরে হারিয়ে গেছে।।

শূন্যতার সীমায়

অসাধারণ এক রাত ছিল সে রাত। রিমঝিম বৃষ্টির গানে প্রকৃতি সেজেছিল এক মায়াবী রাতের শাড়ী পরে।  মমতার টিপ ছিলো প্রকৃতির কপালে। এমন অতুলনীয় সে দৃশ্য! বৃষ্টির জলে স্নান করা নারিকেলের পাতার উপর আলো আঁধারির ছোঁয়া, যেন হীরের দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। ওরা দুইজন বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করছিলো প্রকৃতির অসাধারণ সেই খেলা। হয়তো আলোটা ছিল না চাঁদের। ধার করা আলোতে বৃষ্টির ছটার এই অপূর্ব সুধা!! ছেলেটি বলে উঠলো, "চাঁদের আলোও তো ধার করা,  কি আর করা, ধার করা আলোতে তো এতোটুকু কমনীয়তা ক্ষুন্ন হয়নি! 

মেয়েটি ভাবছিল এমন রাতে মানুষ চলে যেতে পারে সমস্ত চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে, শূন্যতার সীমা পেরিয়ে অনেকদূর....। সব গৃহী মানুষ- জন, কর্ম কোলাহল দিনের শেষে ক্লান্ত শরীরকে ছেড়ে দিয়েছে ঘুমের কাছে। এতো সময় কোথায়? টুপটাপ জলের মূর্ছনায় নিজেকে সঁপে দেয়ার। প্রিয় পুরুষের সান্নিধ্যে এমন অসংখ্য রূপকথার রাতকে চেখে দেখার সাধ হয় ক'জনের? সে নিজে কী করেছিল!! কতো অপার সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করেছিল নিস্তব্ধ রাতের অতল গহবরে, একাকী নির্জনে। কালো রাত্রির নিখাদ মায়ায় মৌন থেকেছে, কুয়াশায় গা ভাসিয়েছে ধ্যানী গুবরে পোকা যেন। অব্যক্ত কৃতজ্ঞতায় চেয়ে রয় ছেলেটির দিকে। সামান্য একটি রাতকে যে অসামান্য করে তুলতে পারে সে কী হতে পারে?

কখনো প্রশ্ন জাগে সুখের স্থায়িত্ব কতক্ষণ? অধরা মুহূর্তগুলো মানুষ কেনো পারে না চিরদিনের জন্য কয়েদ করতে?  কতো দ্রুত না হারিয়ে যায় সময়ের হিসেব, প্রদীপের আলোয় রচিত আনন্দগুলো। দুঃখবিলাসী মানুষগুলো বড় দ্রুত ভুলের যায় অত্যাশ্চর্য ভালোলাগা গুলোকে। সপ্তদশ পদাবলীর সমাপনে বেঁধে রাখতে চায় সব সুকুমারবৃত্তি। যা কখনোই হবার নয়। কে দেখেছে জীবন কখনো চলে নিয়মের শৃংখলে। প্রতিনিয়ত ভণ্ডামি দেখে দেখে মেয়েটি অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে।

পিচ্ছিল কাদা মাড়াতে মাড়াতে সে হেঁটে যায়। ব্যস্ত নগরীর বৃষ্টির ছাঁট তাকে প্রচণ্ড নির্লিপ্ততা এনে দেয়। অবিশ্বাসী মন তো কোন বাঁধনের ধার ধারে না। সে তো চায়নি কোন শরীরসর্বস্ব কল্পকথা। সব আসক্তির সীমা তো বহু আগেই পার করেছে। সে তো পৃথিবীর মানুষ, কারাগার ভেঙ্গে বহু আগেই বের হয়ে এসেছে। অথচ এ সমাজের পায়ে পায়ে কারাগার। প্রতিমুর্হূতে সংসারের কারাগারে নিজেকে বন্দী রাখে প্রতিটি মানুষ। কী পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখে প্রতিদিনের জীবন- যাপন। আহারে!! কী মায়া, আশ্চর্য মায়ায় সব ধরে রাখতে চায়। 

সেই আশ্চর্য মায়া কী তাকেও টানছে! ভাবছে মেয়েটি। সেই দুঃসহ জীবনে ফিরে যাওয়া! সেই প্রতারিত সময়কে আলিঙ্গন করা। কেউ সাথী হতে চায় না, শুধু চায় দখল, যেন চরদখল। এ কোন্ রিপু, মিশে আছে মজ্জায়, মহাকালের অমোঘ ফয়সালা। ঝুলে পড়ো, জীবন শুরু করো!! বিনা ফি তে কী দারুণ পরামর্শ!!  নিজেরা যেমন হাভাতের মতো দখল করে সুদসমেত দিনাতিপাতের কারখানায় খাস মজুর হয়েছে একেকজন, রাজ্যপাট চালাচ্ছে মহাসুখে। 

মেয়েটি ভাবে এখানে আমি আছি কোথায়? আমার কঠিন বলয়ের অন্তরালে অসহায়ত্বকে যেন কেউ চিহ্নিত করে। বেলা পড়ে এলে সবাই ঘর খোঁজে, পরিশ্রান্ত শরীর মেলে আরামের কাছে। এটা কী কারো কারো বর্ষা অবগাহনের দিনলিপি!!  শূন্যে দাঁড়িয়ে প্রসারিত হাত মেলে দিয়ে দিগন্তে, ধূপছায়ারা যেন পিছু হটে। 

কখনো তীব্র দাবদাহে সেদ্ধ হবে, বাতাসের তীব্রতায় শান্ত হবে কিংবা অবিশ্রান্ত জলধারা ধুয়ে ফেলবে সব পঙ্কিলতা। 

আজ তার মন বড়ই অশান্ত। শীতল ছায়াঘেরা এই ব্যালকনিতে, ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনে কাঁঠাল গাছের মাঝ বরাবর ডাল পাতার ফাঁকে ফাঁকে দুটো কাক খড়, কাঠি, সরু শিকের টুকরো নিয়ে জমাচ্ছে। অনেকটা স্তুপ করে রাখা, এখনো কোনো আকৃতিতে আসেনি। 

মাঝরাতে নিশাচর পশুর আর্তনাদ, সাথে মেয়েটির নিজের সাথে বাদানুবাদ এভাবেই চলতে থাকে। 

কিন্তু কতোক্ষণ!! ঘুরে ফিরে সেই দুষ্টক্ষত বারবার ফণা তুলবে, আহত করবে।  তার চেয়ে এই ভালো, ফিরে যাও মাটির টানে। মাটির কাছেই  হও সমার্পিত। 

মেয়েটি ভাবে আনমনে, কখনো বিড়বিড় করে উঠে অস্পষ্ট কথার জালে। একসময়ে পরিষ্কারকন্ঠে বলে ওঠে,  "ক্ষমা করো, ক্ষমা করো!! যোজন দিগন্তই যে ঠিকানা। আমি খুঁজি না আর কোন অনিকেত!" 

বিচিত্র মানুষ,  কতো না তাদের নানান রঙের খেলা, নানান সাজে কতো ব্যস্ততা। কতো স্বপ্ন, কতো পরিকল্পনা!  দুঃখবিলাসী মন একান্তে পুড়বে,  বিলীন হবে বারবার ঋতুচক্রের বিচিত্রবর্ণের সমাহারে।

বুকের ভেতর বাজে ঝনঝন বৃষ্টির শব্দ। গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ কেমন করে চলে যায় আকাশের এ মাথা থেকে ওমাথা। অসীম শূন্যে ভেসে বেড়ানো মেঘগুলোও কি আমার মতো বোহেমিয়ান!!  ঠিকানাবিহীন এ পথচলা অনেকটা সময় ধরে বন্ধুর এই দিগন্তে, শূন্যতার সাথে যার সখ্য সে হাঁপিয়ে ওঠে লোকালয়ে। 

তারপর একসময় বলে উঠলো মেয়েটি, "সব চালবাজ"......

খতিবা বেগম

আগারগাঁও বিএনপি বাজার সংলগ্ন বস্তিঘরটা স্যাঁতসেঁতে হলেও মন্দ ছিল না

দিনভর ভিক্ষের ঝুলিটা বয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে বেলা গড়িয়ে গেলেও বেশিরভাগ দিনই ভরে যেতো কিন্তু সময় খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে, এখন আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষে মেলে না;বারান্দা ঘরটায় এসে টানটান হয়ে শুয়ে শান্তির শ্বাস ফেলতো খতিবা বেগম।

ডিম ডাইল ভুনার সোয়াদ, পরিশেষে তৃপ্তির ঢেকুর খুব দ্রুত গভীর ঘুমে তলিয়ে নিয়ে যেতো তাকে নাক ডাকার ছন্দ তুলে সময়ে গো গো স্বরে কথা বলে ওঠে খতিবা বেগম। 

পাশের ঘরে ছেলের বউ ছবিতুন বিরক্তি ভরে বলে ওঠে আছিকো, ও মাইলো! মাইয়াডা ডর ফাইতো না!! কী আইজরাইলের মতন ডাক লয় তুমার মায়!?

-- বুড়া হাড্ডি আরাম লয়। থাম দেহি! ঘুমাইপার দে! ছেলে ক্লান্ত স্বরে কপট ধমক দিয়ে পাশ ফেরে

খুব সকালে, আঁন্ধার কাটে নাই। আজানের ডাকে ভয়ার্ত সারমেয়রা তারস্বরে সদলবলে চিৎকার করে ওঠে মৌলভী সাহেব পরিষ্কার বিরক্তি নিয়ে আজান দেন। ভোরের ঘুমের আমেজ ভেঙ্গে ওঠে তার সুরহীনতা, একঘেয়ে প্রার্থনা ধ্বনি

খতিবা বেগম মনোযোগ দিয়ে আজান শোনে তারপর পাশ ফিরে শোয়। কলপাড়ে থালাবাটি মাজা-ঘষা আর ঝপাঝপ জলের তরঙ্গধ্বনি শোনে গায়ে পানি ঢালার তাগিদ তাকে উঠিয়ে দেয়। রাতের রয়ে যাওয়া ভাত চাট্টি মুখে পুরে ব্রিজের ওপর আজ বসবে আজ এটাই তার পরিকল্পনা

বেশিদূর যেতে ইচ্ছে করছে না এই বারান্দা ঘরের ভাড়া তুলে পেটের ধান্দা করতে হয়। ছেলের ছত্রছায়ায় আছে এটাই উপরি পাওনা

ছেলের বউটি বড্ড মুখরা ফলে সেও চোপা বাড়ায় সময়ে সময়ে কিন্তু লাভ হয় না অযথা কথা খরচ, ক্লান্তি বাড়ে

ছেলে বলে, " মাও, তুই চুপ কইরা থাকপার পারোস্ না! আমারে চক্ষে দেহোস না!? চোপা চালাইস ক্যান্!? খেচর খেচর কম করিস!!"

কী নসিব! ভাতে- ফেনে কতো জিল্লতির সাথে ছাওলডারে পালছে ভিটাবাড়ি সব জোরদারের করাল গ্রাসে সমূলে গেছে প্রতিবেশী জয়গুণের লগে কামাইপাতি কইরা খাওনের আশায় ছাওয়ালডা নিয়া এই শহরে ভাইস্যা বেড়ায় খতিবা বেগম।

শুরুতে খুঁজে খাওয়ার ইচ্ছেয় নামেনি কিশোর ছেলেটিকে নিয়ে রুক্ষ নাগরিক সভ্যতার সহস্র স্রোত ধারায় সদ্য পা রাখা গ্রামের এই পল্লী বালা

কাজ করে খেটে খাওয়া শ্রমিক সে, তাই শুরুতে বাসা বাড়িতে কাজ, মাটি কাটা, ইট ভাঙ্গাসহ প্রায় সব কাজই করেছে আর ছেলেটাকে কিছুদিন চায়ের দোকানে কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়। পরে রিকশা চালানো, শেষে রিকশা গ্যারেজে কাজ শিখে কামাই পাতি শুরু করে

মা- ছেলের দিনগুলো বেশ চলছিল। সারাদিনের পর রান্না খাওয়া, স্নেহময় মায়ের আঁচলে ঘুম, ভালোবাসার মেঘ বৃষ্টির ঘরকন্না!!

পেটে খাওয়া ছিল, গাল ভরা পানের খিলিও, আহা আমার ছাওয়ালডা! বিড়বিড় করে নিশিতে পাওয়া কন্ঠে বলে ওঠে খতিবা

ছেলেটা মাথা তোলা হয়ে ধমাস করে একদিন বিয়ে করে বসলো

মেয়েটা গ্যারেজের পাশের বস্তিতে থাকে গার্মেন্টসে কাজ করে তখন ছবিতুন। চাঁপা গায়ের রঙ, দেখতে ভারি মিষ্টি

তবুও কেঁদেছিল ভারী, খতিবা বেগম।

-- পোলাডা একডু সময় দিলা না কওয়া বলা নাই, বিয়া কইরা নিয়া আইলি

ঘর ছেড়ে দিয়ে বারান্দায় বসত হলো খতিবার।

বয়স পড়ে এলো বলে আর তো খাটাখাটুনি সয় না একসময় শরীর আর চলতে চায় না শুরু হলো চেয়ে- চিন্তে নাওয়া খাওয়া

তারপর, একদিন হাঁড়ি চড়িয়ে আলাদা খাওয়া  একই ঘরে দুইজীবন, নতুন করে খতিবার বারান্দা সংসার।

একদিন মা খতিবা লোকমা ধরে তার ছেলেকে খাইয়েছে অতি যত্নে, সাবধানে পরম আদরে, স্নেহে তার কলিজার ধন, একমাত্র বন্ধন।

আজ, ছেলে লোকমা তুলে দিচ্ছে তার পরিবারের মুখে সেই পরিবারে তার মায়ের ঠাঁই হয় না

খতিবা আর কাঁদে না নিদেনপক্ষে মনখারাপও না। সে তার নিয়তির বালুকাবেলায় বহু আগেই হাঁটতে শিখে গেছে


।।মুন্নী ইয়াসমিন।।


তিনটি প্রচ্ছদ : এস, এম, সুলতান।