ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Tuesday, September 26, 2023

বজলে মওলা : ঢাকা আর্ট স্কুলের প্রথম ছাত্রদের একজন

।।কুদরত-ই-মওলা।।


রাণী এলিজাবেথ ঢাকা এলে (১৯৬১), ঢাকাবাসীর পক্ষ থেকে তাকে দেয়া মাণপত্র লেখার দায়িত্ব পান বজলে মওলা ।

বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে চারুকলা অনুষদ, ১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে তার গোড়া পত্তনি হয়েছিল পুরান ঢাকার জনসন রোডে সরকারি পরিত্যাক্ত হাসপাতাল ভবনের কয়েকটি ঘরে, নাম দেয়া হয়েছিল, 'ঢাকা আর্ট স্কুল'।

জয়নুল আবেদিন ছাড়া ঢাকা আর্ট স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন আনোয়ারুল হক, সফিউদ্দিন আহমেদ, কামরুল হাসান, হাবীবুর রহমান এবং সৈয়দ আলী আহসান। সে স্কুলে প্রথম ব্যাচে যে ১৮জন ছাত্র ছিলেন, তাদের একজন বজলে মওলা।  প্রখ্যাত শিল্পী আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমান, খালেদ চৌধুরী, ইমদাদ হোসেন ছিলেন প্রথম ব্যাচে সহছাত্র।    

বজলে মওলার জন্ম, পড়াশোনা ও গড়ে ওঠা কোলকাতা শহরে পার্ক-সার্কাস ও ভবাণীপুরে । ছবি আঁকায় ঝোঁক থাকায়, কোলকাতা আর্ট কলেজে পড়াশোনা করেন, বিজ্ঞান ছেড়ে দিয়ে।

রায়ট কবলিত দেশান্তর

বজলে মওলার আর্ট কলেজে পড়ার শুরুটা অবিভক্ত ভারতে মুসলিম ঘরের সন্তানদের যেমন হওয়ার কথা তেমনি ছিলো । আর্ট কলেজে ভর্তি হলেন, যখন দাদা হজে গেলেন সেই সুযোগে।

সে সময়, কোলকাতা আর্ট কলেজে নিয়ম ছিলো, মুসলিম পরিবারের কেউ সেখানে ভর্তি হতে হলে একজন লোকাল গারডিয়ান দেখাতে হবে । মুস্কিল হলো, ‘বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাধবে কে?’। মামা কামরুল হাসান ভয়ে রাজি হলেন না । পরে, তার  বাবাকে (দুলা ভাই), হজ থেকে ফিরে জিজ্ঞেস করলে কি জবাব দেবেন এই ভেবে ।

কি করা যায়, অগ্রজ সফি উদ্দিন (পরবর্তিতে বাংলাদেশের ছাপচিত্রের পুরোধা) কাছে গেলেন । তাঁকে মামা সাজিয়ে ভর্তি হয়ে গেলেন কোলকাতা আর্ট কলেজে ।

ভর্তি হলেইতো হলো না! বিধি বাম । পার্ক-সার্কাস থেকে তাড়া খেয়ে বছর তিনেক যেতে না যেতেই, পঞ্চাশের রায়টে দেশ ছাড়তে হলো। সঙ্গী ছিলেন বাবা, স্ত্রী, ভাই আতা-এ –মওলা (গীটারিস্ট) হাসান জান মামা ( বিখ্যাত পটুয়া  কামরুল হাসানের ছোট ভাই)। সে বছর ছিলো আর্ট কলেজে ফাইনাল পরীক্ষা দেয়া হলো না। কোলকাতা আর্ট কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশান নেয়া হলো না।

 ডিগ্রী মিল্লো, ঢাকা আর্ট কলেজ হবার সাড়ে তিন বছর পর শিল্পচার্য জয়নুল আবেদীনের অধীনে। দেরীর কারণে, বাবা সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে ফেল্লেন, অন্যারাও সেরকম । বাংলাদেশের বিমূর্ত আর্টের পুরোধা মোহাম্মাদ কিবরিয়া ওনার ক্লাশমেট ছিলেন, কিছুকাল ছিলেন আমাদের গেন্ডারিয়ার বাসায় । পরীক্ষা নিতে দেরী দেখে, উচ্চ শিক্ষার জন্য, তিনিও জাপান চলে যান । 

পরে মোহাম্মদ কিবরিয়া আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন এবং প্রিন্সপিাল হিসাবে অবসর নেন। অন্যদিকে, বজলে মওলা সরকারি চকরিতে ‘নিপা’ ( NATIONAL INSTITUTE OF PUBLIC ADMINISTRATION) তে (বর্তমান PATC) যোগ দেয়ায়, আর ঢাকা আর্ট কলেজে সরাসরি শিক্ষক হিসাবে যোগ দেয়া সম্ভব হয়নি । সেখানে খন্ডকালীণ শিক্ষকতা করেছেন কিনা আমার জানা  নাই । তবে উনি সেখানে  ফাইনাল পরীক্ষার এক্সটারনাল এবং এ্যাডমিশান টেস্টের সময় বোর্ডে থাকতেন ।

ঢাকা আর্ট স্কুলের প্রথম দিককার ছাত্রদের সাথে জয়নুল আবেদিন।
চারুকলার নিজস্ব ভবনের নির্মাণকাজ চলছিল শাহবাগে।১৯৫৬।
 সামনের সারিতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন (বা থেকে চতুর্থ)। ছবিতে এ ছাড়া আছেন
জুনাবুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, বিজন চৌধুরী, আলী রেজা, আব্দুর রাজ্জাক, আখতারুজ্জামান, কাইয়ুম চৌধুরী, রশিদ চৌধুরী, কাজী আবদুর রউফ, দেবদাস চক্রবর্তী, বজলে মওলা(সর্ববামে), মোহাম্মদ কিবরিয়া(বজলে মওলার পাশে), আলী হুমায়ুন ও শফিকুল আমীন।

রনবীর ভাষ্যে

কোলকাতা আর্ট কলেজ থেকে আসায়, সে সময় ঢাকার অন্যান্য অনুজ ছাত্রদের কাছে তাদের বিশেষ আকর্ষণ ছিলো । সম্প্রতি একথা জানতে পারি, বাংলাদেশের প্রবীণ চিত্রকর ও জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র ‘টোকাই’ এর প্রবর্তক রফিকুন্নবী –রনবি’র থেকে ।

শিল্পী রণবী স্যারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ মিলেছিলো ডিবিসি টিভিসি’র এক বিশেষ অনুষ্ঠানে ফাঁকে। কথা হলো  ‘টোকাই’ এর স্বর্ণ-যুগ নিয়ে, যখন পাঠকরা সাপ্তাহিক 'বিচিত্রার' প্রকাশনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুণতো। পরবর্তিতে 'সাপ্তাহিক -২০০০' এ এই কার্টুন প্রকাশ পায় বছরেরর পর বছর । সময়ের আবর্তনে ও প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনে কার্টুনের আবেদনও পাল্টেছে । সে নিয়েও কথা হলো ওনার সাথে, বল্লেন কার্টুন, ছড়া, প্যারোডি সমাজ-বদলে কতটা শক্তিশালী ভূমিকা রাখে ও রেখে চলেছে । কথা হলো, পরবর্তিতে যারা,  কার্টুন নিয়ে এদেশে কাজ করেছেন এবং বর্তমানের কার্টুনের দশা নিয়েও ।

এক অণু-সাক্ষাৎকারে  তিনি বল্লেন, ‘ওনারা  আমাদের বেশ কবছর সিনিয়ার ছিলেন । যখন শুনতে পেলাম মোহাম্মাদ কিবরিয়া ও বজলে মওলা ভাইরা ঢাকা চলে এসেছেন, তখন তাদের দেখতে গেন্ডারিয়া গিয়েছিলাম’।

ইরানের শাহ রেজা পাহলভি ও রানি ফারাহ দিবার সাথে করমর্দন করছেন বজলে মওলা।
বাফার দল নিয়ে তিনি ইরানে যান।

মুকুল ফৌজ থেকে মুকুল মেলায় 


নাট্যকার তারিক আনাম স্বাধীনতার আগে ঢাকায় শিশু-কিশোর সংগঠন গড়ে ওঠা প্রসঙ্গে, এক সাক্ষাৎকারে জানান, তাঁর চাচাতো ভাই টুটুলের কাছে মুকুল মেলার কথা শুনে গেন্ডারিয়া গিয়ে তাদের কার্যক্রম দেখছেন।

শিল্পী বজলে মওলা ওরফে মাণিক কোলকাতা থাকাকালে, ভারত বিভাগের আগে, মুকুল ফৌজ তথা ব্রতচারী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সে সময়ে এ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বেগম সুফিয়া কামালের সন্তান এবং গণযোগাগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ডক্টর শাহেদ কামাল। ডক্টর শাহেদ কামাল আমার সরাসরি শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের। উনি একদিন আমাকে আবিস্কার করে বল্লেন, ''তুমি মাণিক- দা'র ছেলে? আমিতো কোলকাতা থাকাকালে মুকল ফৌজে ওনার শিষ্য ছিলাম।" (১৯৮৭-৮৮).দেশ বিভাগের আগে,১৯৪৭এর আগে, ওনারা কোলকাতা থাকতেন। থাকতেন জয়নুল চাচারাও, আমাদের পার্ক সার্কাসের বাসায় আসতেন।

সেই ধারাবাহিকতায় বজলে মওলা, স্বাধীণ বাংলা বেতারের অন্যতম কর্ণধার আশফাকুর রহমান মাণিক (গানের শিক্ষক), আলী যাকের ছটলু (ড্রাম বাদক ও সংগঠক) ও তাঁর বোন' 'ঝুনু' (নাচের শিক্ষক) এবং আরো বেশ কজন সিনিয়র সংগঠককে সঙ্গে নিয়ে, ষাটের দশকের মাঝামাঝি, ঢাকার গেন্ডারিয়ায় গড়ে তোলেন 'প্রান্তিক মুকুল মেলা'। এতে সভ্য ছিলেন সাইদুল আনাম টুটুল (পরবর্তিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা)।

এছাড়াও বজলে মওলা জড়িত হন বন্ধু গওহর জামিল ও তার স্ত্রী রওশন জামিলের স্বামীবাগে গড়া সংগঠন ' জাগো ললিত কলা' (প্রধান শিল্প নির্দেশক), বাফা'সহ আরো অন্যান্য সংগঠনে। সেই সুবাদে ষাটের দশকের শুরুতেই (১৯৬৪?) বাফার দল নিয়ে ইরানে যান। সেসময় রাণী এলিজাবেথ ঢাকায় এলে (১৯৬১) ঢাকাবাসীর পক্ষ থেকে তাঁকে দেয়া মাণপত্র লেখার দায়িত্ব পান বজলে মওলা ।

রক্ষনশীলতার সীমান্ত ভেঙ্গে

কোলকাতা থেকে ঢাকায় এসে, ১৯৫০ সালে বামপন্থী নেতা নাসিম আলী খান কে সঙ্গে নিয়ে অন্যান্য অনুজদের সহায়তায় গেন্ডারিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন 'সীমান্ত গ্রন্থাগার' পাঠাগার।

এই পাঠাগার গড়ে তোলার পেছনে কার শ্রম ছিলো না বলা মুস্কিল অনেকের মধ্যে ছিলেন --ভাষ্যকার অব্দুল হামিদ, ডক্টর কুদরাত-ই-খুদার ভাই বরকত-ই-খুদার সন্তান এবং জগন্নাথ কলেজের প্রাণীবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডক্টর মেহের-ই-খুদা, বজলে মওলার ছোট ভাই আতা-এ- মওলা, ডিআইজি ওসমান আলী খানের বড় ভাই, বর্তমানে আশফাকুর রহমানের ভাই মুরশেদ ভাই তা দেখাশোনা করছেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার অল্প কিছু বছর আগে, মুকুল মেলার মতো, নিজের বাসায় গড়ে তোলেন 'পূবালী' নামে নাচ-গান শেখার প্রতিষ্ঠান, সেখানে যৎসামান্য (৫/১০ টাকা) সন্মানীর বিনিময়ে ক্লাশের ব্যবস্থা থাকলেও কারো কারো পক্ষে তা দেয়া সম্ভব হতো না। পাশাপাশি রক্ষনশীল সমাজের দৃষ্টি এথেকে এড়িয়ে যায়নি, পত্রিকায় (যতদূর মনে পড়ে দৈনিক ইত্তেফাকে) লেখা হয়, ''তোয়াক্কা না করে, মুসলমানের মেয়েদের নাচ-গান শেখানো হচ্ছে।'' যদিও কয়েক বছরের মধ্যে প্রেক্ষাপট পাল্টে গেলে, সেসব ঘরের মেয়েরাও সেখানে ছাত্রী হতে আসে। এতে নাচের শিক্ষিকা ছিলেন জিনাত জাহান, নজরুল সঙ্গীত শেখাতেন খালিদ হোসেন, রবীন্দ্র সঙ্গীত মৃণ্ময় দাশগুপ্ত, ক্লাসিকাল কে শেখাতেন মনে নাই। পরবর্তিতে, পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন স্কোন ( উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন চৌধুরী আনোয়ার হোসেন মিন্টু), দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য এফএভিএইচ (প্রধান উদ্যোকতা ছিলেন গোলাম মোস্তাফা)।

এর বাইরে হবি ছিলো ছবি তোলা বাসায় এনলারজার ছিলো, ছবি প্রিন্ট করার জন্য আমাদের একতলার গোসলখানা ব্যবহার হতো ডার্করুম হিসাবেদেশ স্বাধীন হবার পর, ঢাকার রাজপথে দুই ভাই বজলে মওলা, আতা-এ- মওলা যে কত ছবি তুলেছিলো তার হিসাব নাই, সেসব নেগেটিভ হয়তো উদ্ধার সম্ভব। এছাড়া কোলকাতা থাকাকালে , আব্বা একসময় দাদার চোখ ফাকি দিয়ে, গীটার-সেতার শিখতে যেতেন রাতে বাফার প্রতিষ্ঠাতা ও গীটারিস্ট ওয়ারেস আলীর কাছে, ফিরতেন রাত একটা দেড়টার দিকে। এতো রাতে অন্দরমহলে ঢোকা নিষেধ থাকায় গৃহভৃত্যদের থাকার জায়গায় আশ্রয় নিতে হতে।

ওয়ারেস আলী চাচার মৃত্যুর ঘটনাটা খুব হৃদয় বিদারক।  উনি মারা যান প্লেন ক্র্যাশে, শীতলক্ষা থেকে বডি উদ্ধারের জন্য জাল ফেলার দায়িত্ব নেন তৎকালীণ বিখ্যাত ব্যবসায়ী এস মুজিবুল্লাহ।

বজলে মওলা

পেশাগত জীবন ও ভ্রমণ

ছাত্র অবস্থাতেই ছবি আঁকার জন্য এপেশায়  অল্পবিস্তর পরিচিতি ছিলো। সেরকম একটি কথা, প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডক্টর আনিসুজ্জামান ঢাকার একটি দৈনিকে নব্বইয়ের শুরুতে লিখেছিলেন। তার ভাষায়  : ছাত্র জীবনে, কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে একটি ম্যাগাজিন বের করার পরিকল্পনা করা হলো। সমস্যা হলো অঙ্গসজ্জার কাজটা, প্রচ্ছদ  করবে কে! সবাই মিলে যাওয়া হলো, জয়নুল আবেদীনের কাছে । জয়নুল আবেদীন বল্লেন মওলা’র কাছে যাও (বোধ করি, তিনি আনিসুজ্জামানের অগ্রজ ছিলেন)। যথারীতি, তার সহযোগীতায়, ম্যাগাজিন বেরিয়ে গেলো ।

আমার জানা মতে, বাবা ১৯৫০ এ ঢাকা এলেন, যারা কোলকাতা থেকে এসেছিলো তাদের পরীক্ষা নেয়া হলো সাড়ে ৩ বছর পর। এসময়টা ফ্রীল্যান্স বুক কভারের কাজ করে আয় করার চেষ্টা করেন-- জানা মতে এসময় বুক কভারের কাজের অংশ হিসেবে, মিউজিক ডিরেক্টার ও প্রাক্তন সচিব এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ টুডের এডিটর আসাফউদ্দৌলা'র শ্বশুর ডক্টর নাফিস আহমেদের 'ইকোনমিক জিওগ্রাফি' বইটির বুক কভার ও অঙ্গসজ্জার কাজটি করেন।

১৯৫৬, বাফার একটা ইভেন্টে,
সর্ববামে বজলে মওলা।
 এটি BAFA(Bulbul academy of fine arts,
 established1955) আয়োজিত
প্রথম চারু ও কারুকলা প্রদর্শনী  
তারপর সরকারি চাকুরী শুরু করেন জুট রিসার্চ ল্যাবরেটারিতে চীফ আর্টিস্ট হিসাবে। পরবর্তীতে যোগ দেন নিপা'তে (National Institute of Public Administration, now PATC) চীফ আর্টিস্ট ও অডিও ভিজুয়াল অফিসার, সিনিয়র ইন্সট্রাক্টরসহ ইত্যাদি পদপদবীতে কাজ ফার্স্ট ক্লাশ গেজেটেড অফিসার হিসাবে অবসরে পূর্ব এলপিআর এ যান সম্ভবত ১৯৮২, দুয়েকবার এক্সটেনশন হয়েও থাকতে পারে।

মালয়শিয়ার রাস্ট্রপতি টিংকু আব্দুর রহমানের আমন্ত্রণে, সরকার প্রধান শেখ মুজিবর রহমানের অনুরোধে, প্লানিং কমিশনের চেয়ারম্যান একেএম আহসানের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের প্রতিনিধি দলের একজন হিসাবে মালয়শিয়া যান ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে, উদ্দেশ্য মালয়শিয়ার আদলে সরকার প্রধানের সচিবালয় সাজানো গণভবনে।

সব মিলিয়ে ১৯৮৫-৮৮ এর দিকে চাকরি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটান, যদিও প্লানিং ট্রেনিং একাডেমি, কোটা, গোটা ও নিপা (পিএটিসি) সহ সরকারী অফিসগুলো পোস্টার এবং ট্রেনিং এর ক্লাশের দায়িত্ব থেকে রেহাই দেয়নি বা উনিও চাননি। এর মধ্যেই চলতে থাকে ছিটেফোটা বুক কভার আর সমাজ সেবার কাজ।


১৯৭৫ সালে কুয়ালালামপুর থেকে পরিবারের কাছে পাঠানো
বজলে মওলা স্বাক্ষরিত ইংরেজি চিঠি।

যে আবহে সন্তানদের বড় করেছিলেন 

ছোটবেলায়, বিশেষ করে ছুটির দিনে, গান শুনে ঘুম ভাংতো, হয় বড় বোনের রেওয়াজে, কিম্বা চাচার গীটারের সুর, নয়তো মাণিক ভাই (আশফাকুর রহমান) এর গান শেখানোর কোরাসে-- 'আমার দেশের মাটির গন্ধে, ভরে আছে সারা মন......নেই কিছু প্রয়োজন'। 


বিশেষ অনুষ্ঠানের রিহার্সালের সময় আব্বা আমাদের  নিয়ে যেতেন গওহর জামিল চাচার স্বামীবাগের বাসায়, দেখতাম ওরই মধ্যে  কান্তা আপা, রাজ ভাইদের পড়াশোনা চলতো। এইচএসএসসিতে বোধ হয় কান্তা আপা স্ট্যান্ড করেছিলেন। উনি বোধ হয়, মনিজা রহমান মহিলা বিদ্যালয়ের হেড মিস্ট্রেস বাসন্তী গুহ ঠাকুররতার মেয়ে মেঘনা গুহ ঠাকুরতা দোলা আপার সতীর্থ ছিলেন। মনে পড়ে, দোলা আপাদের স্কুলের বাসায় বড়দের স্টাডি সার্কেলের আড্ডা হতো-- নিয়মিত সদস্যদের মধ্যে ছিলেন-- দোলা আপার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক জোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, ওনার সতীর্থ পূন্যবাবু স্যার (মনিজা রমানের ইংরেজির শিক্ষক), বাসন্তী আপা, আর বাবা-- আর কে কে থাকতেন অতটা মনে নেই।

আমি, দোলা আপা, আর দোলা আপার সতীর্থ  মনিজা রহমান স্কুলের সানজিদা আপার তাতে অংশগ্রহণের অনুমতি ছিলো, খানিকটা পর্যবেক্ষক হিসাবে।  ওনাদের আলাপের মধ্যে শিল্প সাহিত্য দর্শন বিজ্ঞান কোনটাই বাদ যেতো না। সেসময় শেখানোর কায়দাটাও ছিলো দারুণ।  যেমন আমাদের মধ্যে কে যেনো উচ্চারণ করেছি ওভেন ( oven), জ্যোতিরময় স্যার বল্লেন, ' বলো আওভেন' , সরাসরি ভ নয় তাও বল্লেন। আর, নিয়মিত মাঠে যেতে হতো বলে, বাসার বিকালটা সবসময় দেখা হতো না। বিকালে চাচার ঘরে প্রায় বসতো রেডিও প্রোগ্রামের রিহার্সাল। থাকতেন ওনার ব্যান্ডের অনেকের মধ্যে কুতুব চাচা, বশাক চাচা ( সিনেমার নায়িকা শবনমের মামা, পরবর্তীতে হ্যাপি জুয়েলার্সের মালিক)। দেওরের আবদারে চলতো আম্মার নিরলস মেহমানদারী-- আব্বার দেশী-বিদেশী বন্ধু-বান্ধবদের মেহমানদারীতো ছিলোই।

আব্বা, আম্মার সাথে আমরা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বড়াতে বেরাতাম। বেড়ানো বলতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাষ্ট্রপ্রধান, প্রেসিডেন্ট আসলে তাঁকেসহ শহরের লাইটং সাজগোজ দেখা।  আব্বার শিল্পনির্দেশনায় নকশীকাঁথার মাঠ, তাশের দেশ অনুষ্ঠানগুলো দেখতে যেতাম। স্বাধীনতার আগের বছর, মধুমিতায় হলো 'নিখিল পাকিস্তান সঙ্গীত সন্মেলন'। রাতভর চমৎকার পরিবেশনায় অংশ নিয়েছিলেন পশ্চিম থেকে মেহেদী হাসান, ফরিদা খানম, ক্লাসিকালের দুই ভাই নাজাকাত আলী- সালামত আলী  এবং ঢাকার একমাত্র শিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ । স্বাধীনতার পর, একই ভেন্যুতে একের পর মনভূলানো অসমীয়াসহ বিভিন্ন ভাষায় গান পরিবশন করেছিলেন ভূপেন হাজারিকা। 

সহধর্মিনী নূরজাহান বেগম


নূরজাহান বেগম

আম্মা, নূরজাহান বেগম, ঘর সামলানোর পাশাপাশি গীটারিস্ট বোরহান উদ্দিনের মা বদরুন্নেসার নেতৃত্বে গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতির সক্রিয় কর্মী ছিলেন। প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন উভয়েই। তবে, একটু বেছে চলতেন।

সিনেমা দেখা হতো আম্মার সাথে ঢাকায় আর নানাবাড়ী বর্ধমান গেলে, কোলকাতায় কম। আম্মার সাথে ঢাকায় 'অবুঝ মন', বর্ধমানে উত্তম-সূচিত্রার ছবি সঙ্গে হিন্দিও। আব্বা বাসায় ব্রডস্ক্রীনে দেখাতেন sleeping beauty, আর বিবর্তনবাদসহ বিজ্ঞানের বিচিত্র ডকুমেন্টারি। বলতে বাধা নাই, বাসায় শুদ্ধ উচ্চারনে ( বাংলা বা ইংরেজী যাই হোক) কথা বলার নির্দেশ ছিলো।  বাবা-মাকে কোনদিন অশুদ্ধ বাংলা বলতে শুনিনি। এমনকি গৃহশিক্ষক কেউ বকায়দা ইংরেজি উচ্চারণ করে ফেল্লে আম্মাই সংশোধন করে দিতেন।  

ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করায়, আমাদের প্রাথমিক ইংরেজিটা আব্বার পাশাপাশি  আম্মাও দেখতেন। আম্মা প্রায় বলতেন, Patience Is A Great Virtue, তখন মর্মটা তেমন একটা বুঝতাম না। এখন হাড়ে হাড়ে  টের পাই । আর আব্বা বলতেন সভাসমিতিতে গেলে মনে রাখবে ' where to talk where to talk not, when to talk when to talk not, and what to talk and what to talk not'. আব্বা দেখতেন  সার্বিক বিষয়গুলো, ভোরে ওঠা- বিকালে মাঠে খেলাধূলা সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা। পড়াশোনার পাশাপাশি দৈনিক বাংলা-ইংরেজী পত্রিকা পড়া, ১টা বাংলা ১টা ইংরেজি সংবাদ শোনা, আর সপ্তাহে ২/১টা ইংলিশ ফিল্মশো।
 
মায়ের বাবা অর্থাৎ আমার নানা ছিলেন ডেপুটি পোস্টমাস্টার বর্ধমান প্রধান পোস্ট অফিসে, চৌধুরী আব্দুল হাই (হাকু), মা মুশফিকা খাতুন। মা ২বোন এক ভাইএর মধ্যে সবচেয়ে বড়, জন্মসাল জানা নাই, বোধ করি ১৯১২। পড়াশোনা করতেন কনভেন্ট ইংলিশ হাই স্কুলে (২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় পানোয়া গ্রামের বাড়ীতে আশ্রয় নিলে কোএডুকেশনে বড়দের সাথে পড়েছেন (শিল্পী..মীর মোস্তফা আলী, পরবর্তিতে ঢাকা আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল হন )। কনভেন্ট স্কুলে   ক্লাশমেট ছিলেন সাংবাদিক সালিম সামাদের মাতাজি রোকেয়া খাতুন, ওনার ছোটবোন ও সায়েন্স ফিকশান রাইটার হাসান খুরশীদের মাতাজি রাবেয়া খাতুন একই স্কুলে পড়তেন। ওনাদের বাবা অ্যাডভোকেট নাজির উদ্দিন আহমেদ, যিনি ছিলেন ব্রিটিশ পরবর্তী ভারতীয় পার্লামেন্টের সদস্য এবং সংবিধান রচয়িতা।  

আম্মাদের স্কুলজীবনের প্রায় পুরোটাই ২য় বিশ্বযুদ্ধের মৌসুম (১৯৩৯-৪৫)। ১৯৪১এ আমেরিকার ঘাঁটি পার্ল হারবারে বোমা পড়ার ঘটনাটা সেসময় আমেরিকার ও ব্রিটিশদের মনোবল ভেঙে দেয়। সেজন্য, ঐ প্রসঙ্গ উঠলে ওরা খেপে উঠতো। ঐসময়ের একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা বলি: আম্মাদের স্কুলের গাড়ি ব্রিটিশ আর্মির গাড়ির পাশ থেকে গেলে, মেয়েরা ওদের উদ্দেশ্য করে, সমস্বরে বলতো,
 ' সারেগামা পাধানি, বোম ফেলেছে জাপানি, বোমের ওপর কেওটে সাপ, ব্রিটিশ বলে বাপরে বাপ'--- অনেকদিন ভারতে থাকা য় ব্রিটিশ  সৈন্যরা বাংলা বুঝতো বিধায় রেগে গিয়ে, গাড়ী থেকে মেয়েদের দিকে অস্ত্র  উঁচিয় বলতো " I will shoot you",।

মনে হয়, যুদ্ধের পর, ১৯৪৬এ, বাবা-মা'র বিয়ে হয়। কোলকাতায়, দু'পক্ষের আত্মীয় পুলিশ অফিসার  মোহাম্মাদ ইউনুসের কোলকাতার বাসায় (উনি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এনএসআই'র ডাইরেক্টর হন)। ঐ সময়, একদিকে চলছে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন, পাশাপাশি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। এই অবস্থায়, যতদূর জানি পার্ক সার্কাসের বাসা ছেড়ে দাদা, চাচা সহ আব্বা-আম্মারা ভবানীপুরের  বাসায় শিফ্ট করলেন। সেখান থেকে ১৯৫০ সালে, সনাতনি প্রতিবেশীদের থেকে জানা গেলো আমাদের বাসাসহ মুসলমানদের বাড়ীগুলোতে  আক্রমণ হবে, কট্টরপন্থীরা আসবে জগুবাবুর বাজার থেকে। বলা যায়, একরকম,  এক কাপড়ে, খালি হাতে বাড়ী থেকে বেরুতে হলো। আশ্রয় নিলেন, বাড়ির কাছেই আলীপুর জেলখানায়। 

দাদা'র (আজীজ আহমেদ) দাদা তিফলে আহমেদ জেলার ছিলেন বিধায় দাদার পরিবারের থাকার সমস্যা হয়নি। তবে, বাসা থেকে জেলখানার দূরত্বটাও, ঐ বৈরী আবহে, অতিক্রম করা সহজ ছিলো না। তাই, ঐ পথটুকু পাড়ি দিতে সাহায্য করেছিলেন আমাদের শিখ ভাড়াটিয়ারা। আম্মা বলেছেন, ওনারা দুপাশে পাহারা দিয়ে জেলখানা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন। তারপর, সেখানে গিয়ে জুতা-স্যান্ডেল কিনে পরের দিন একটি প্রাইভেট এয়ারলাইনস বিমানে ঢাকা রওনা দেন। আশ্রয় নেন উয়ারির ভূতের গলিতে  দাদার এক কাজিনের বাসায়। সেখানে থেকেই, গেন্ডারিয়ার বাসাটা কেনা হয় -- এতে আম্মার ও আব্বার বিশেষ অবদান ছিল।  

বাবা-মা এখনো আমাদের সবার মাঝে আছেন বিভিন্ন কাজেকর্মে প্রেরণা হয়ে, থাকবেন সেভাবেই আশা করি।

।।কুদরত-ই-মওলা।।


বাবা বজলে মওলা কলকাতায় যে আর্ট স্কুলে ছিলেন দেশভাগের আগে
তার সামনে পুত্র কুদরত-ই-মওলা। ২০১৯।

ফটো সৌজন্য : কুদরত-ই-মওলা।