।।কুদরত-ই-মওলা।।
রাণী এলিজাবেথ ঢাকা এলে (১৯৬১), ঢাকাবাসীর পক্ষ থেকে তাকে দেয়া মাণপত্র লেখার দায়িত্ব পান বজলে মওলা । |
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে চারুকলা অনুষদ, ১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে তার গোড়া পত্তনি হয়েছিল পুরান ঢাকার জনসন রোডে সরকারি পরিত্যাক্ত হাসপাতাল ভবনের কয়েকটি ঘরে, নাম দেয়া হয়েছিল, 'ঢাকা আর্ট স্কুল'।
জয়নুল আবেদিন ছাড়া ঢাকা আর্ট স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন আনোয়ারুল হক, সফিউদ্দিন আহমেদ, কামরুল হাসান, হাবীবুর রহমান এবং সৈয়দ আলী আহসান। সে স্কুলে প্রথম ব্যাচে যে ১৮জন ছাত্র ছিলেন, তাদের একজন বজলে মওলা। প্রখ্যাত শিল্পী আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমান, খালেদ চৌধুরী, ইমদাদ হোসেন ছিলেন প্রথম ব্যাচে সহছাত্র।
বজলে মওলার জন্ম, পড়াশোনা ও গড়ে ওঠা কোলকাতা শহরে পার্ক-সার্কাস ও ভবাণীপুরে । ছবি আঁকায় ঝোঁক থাকায়, কোলকাতা আর্ট কলেজে পড়াশোনা করেন, বিজ্ঞান ছেড়ে দিয়ে।
রায়ট কবলিত দেশান্তর
বজলে মওলার আর্ট কলেজে পড়ার শুরুটা অবিভক্ত ভারতে মুসলিম ঘরের সন্তানদের যেমন হওয়ার কথা তেমনি ছিলো । আর্ট কলেজে ভর্তি হলেন, যখন দাদা হজে গেলেন সেই সুযোগে।
সে সময়, কোলকাতা আর্ট কলেজে নিয়ম ছিলো, মুসলিম পরিবারের কেউ সেখানে ভর্তি হতে হলে একজন লোকাল গারডিয়ান দেখাতে হবে । মুস্কিল হলো, ‘বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাধবে কে?’। মামা কামরুল হাসান ভয়ে রাজি হলেন না । পরে, তার বাবাকে (দুলা ভাই), হজ থেকে ফিরে জিজ্ঞেস করলে কি জবাব দেবেন এই ভেবে ।
কি করা যায়, অগ্রজ সফি উদ্দিন (পরবর্তিতে বাংলাদেশের ছাপচিত্রের পুরোধা) কাছে গেলেন । তাঁকে মামা সাজিয়ে ভর্তি হয়ে গেলেন কোলকাতা আর্ট কলেজে ।
ভর্তি হলেইতো হলো না! বিধি বাম । পার্ক-সার্কাস থেকে তাড়া খেয়ে বছর তিনেক যেতে না যেতেই, পঞ্চাশের রায়টে দেশ ছাড়তে হলো। সঙ্গী ছিলেন বাবা, স্ত্রী, ভাই আতা-এ –মওলা (গীটারিস্ট) হাসান জান মামা ( বিখ্যাত পটুয়া কামরুল হাসানের ছোট ভাই)। সে বছর ছিলো আর্ট কলেজে ফাইনাল পরীক্ষা দেয়া হলো না। কোলকাতা আর্ট কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশান নেয়া হলো না।
ডিগ্রী মিল্লো, ঢাকা আর্ট কলেজ হবার সাড়ে তিন বছর পর শিল্পচার্য জয়নুল আবেদীনের অধীনে। দেরীর কারণে, বাবা সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে ফেল্লেন, অন্যারাও সেরকম । বাংলাদেশের বিমূর্ত আর্টের পুরোধা মোহাম্মাদ কিবরিয়া ওনার ক্লাশমেট ছিলেন, কিছুকাল ছিলেন আমাদের গেন্ডারিয়ার বাসায় । পরীক্ষা নিতে দেরী দেখে, উচ্চ শিক্ষার জন্য, তিনিও জাপান চলে যান ।
পরে মোহাম্মদ কিবরিয়া আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন এবং প্রিন্সপিাল হিসাবে অবসর নেন। অন্যদিকে, বজলে মওলা সরকারি চকরিতে ‘নিপা’ ( NATIONAL INSTITUTE OF PUBLIC ADMINISTRATION) তে (বর্তমান PATC) যোগ দেয়ায়, আর ঢাকা আর্ট কলেজে সরাসরি শিক্ষক হিসাবে যোগ দেয়া সম্ভব হয়নি । সেখানে খন্ডকালীণ শিক্ষকতা করেছেন কিনা আমার জানা নাই । তবে উনি সেখানে ফাইনাল পরীক্ষার এক্সটারনাল এবং এ্যাডমিশান টেস্টের সময় বোর্ডে থাকতেন ।
রনবীর ভাষ্যে
কোলকাতা আর্ট কলেজ থেকে আসায়, সে সময় ঢাকার অন্যান্য অনুজ ছাত্রদের কাছে তাদের বিশেষ আকর্ষণ ছিলো । সম্প্রতি একথা জানতে পারি, বাংলাদেশের প্রবীণ চিত্রকর ও জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র ‘টোকাই’ এর প্রবর্তক রফিকুন্নবী –রনবি’র থেকে ।
শিল্পী রণবী স্যারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ মিলেছিলো ডিবিসি টিভিসি’র এক বিশেষ অনুষ্ঠানে ফাঁকে। কথা হলো ‘টোকাই’ এর স্বর্ণ-যুগ নিয়ে, যখন পাঠকরা সাপ্তাহিক 'বিচিত্রার' প্রকাশনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুণতো। পরবর্তিতে 'সাপ্তাহিক -২০০০' এ এই কার্টুন প্রকাশ পায় বছরেরর পর বছর । সময়ের আবর্তনে ও প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনে কার্টুনের আবেদনও পাল্টেছে । সে নিয়েও কথা হলো ওনার সাথে, বল্লেন কার্টুন, ছড়া, প্যারোডি সমাজ-বদলে কতটা শক্তিশালী ভূমিকা রাখে ও রেখে চলেছে । কথা হলো, পরবর্তিতে যারা, কার্টুন নিয়ে এদেশে কাজ করেছেন এবং বর্তমানের কার্টুনের দশা নিয়েও ।
এক অণু-সাক্ষাৎকারে তিনি বল্লেন, ‘ওনারা আমাদের বেশ কবছর সিনিয়ার ছিলেন । যখন শুনতে পেলাম মোহাম্মাদ কিবরিয়া ও বজলে মওলা ভাইরা ঢাকা চলে এসেছেন, তখন তাদের দেখতে গেন্ডারিয়া গিয়েছিলাম’।
ইরানের শাহ রেজা পাহলভি ও রানি ফারাহ দিবার সাথে করমর্দন করছেন বজলে মওলা। বাফার দল নিয়ে তিনি ইরানে যান। |
মুকুল ফৌজ থেকে মুকুল মেলায়
শিল্পী বজলে মওলা ওরফে মাণিক কোলকাতা থাকাকালে, ভারত বিভাগের আগে, মুকুল ফৌজ তথা ব্রতচারী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সে সময়ে এ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বেগম সুফিয়া কামালের সন্তান এবং গণযোগাগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ডক্টর শাহেদ কামাল। ডক্টর শাহেদ কামাল আমার সরাসরি শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের। উনি একদিন আমাকে আবিস্কার করে বল্লেন, ''তুমি মাণিক- দা'র ছেলে? আমিতো কোলকাতা থাকাকালে মুকল ফৌজে ওনার শিষ্য ছিলাম।" (১৯৮৭-৮৮).দেশ বিভাগের আগে,১৯৪৭এর আগে, ওনারা কোলকাতা থাকতেন। থাকতেন জয়নুল চাচারাও, আমাদের পার্ক সার্কাসের বাসায় আসতেন।
সেই ধারাবাহিকতায় বজলে মওলা, স্বাধীণ বাংলা বেতারের অন্যতম কর্ণধার আশফাকুর রহমান মাণিক (গানের শিক্ষক), আলী যাকের ছটলু (ড্রাম বাদক ও সংগঠক) ও তাঁর বোন' 'ঝুনু' (নাচের শিক্ষক) এবং আরো বেশ কজন সিনিয়র সংগঠককে সঙ্গে নিয়ে, ষাটের দশকের মাঝামাঝি, ঢাকার গেন্ডারিয়ায় গড়ে তোলেন 'প্রান্তিক মুকুল মেলা'। এতে সভ্য ছিলেন সাইদুল আনাম টুটুল (পরবর্তিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা)।
এছাড়াও বজলে মওলা জড়িত হন বন্ধু গওহর জামিল ও তার স্ত্রী রওশন জামিলের স্বামীবাগে গড়া সংগঠন ' জাগো ললিত কলা' (প্রধান শিল্প নির্দেশক), বাফা'সহ আরো অন্যান্য সংগঠনে। সেই সুবাদে ষাটের দশকের শুরুতেই (১৯৬৪?) বাফার দল নিয়ে ইরানে যান। সেসময় রাণী এলিজাবেথ ঢাকায় এলে (১৯৬১) ঢাকাবাসীর পক্ষ থেকে তাঁকে দেয়া মাণপত্র লেখার দায়িত্ব পান বজলে মওলা ।
রক্ষনশীলতার সীমান্ত ভেঙ্গে
কোলকাতা থেকে ঢাকায় এসে, ১৯৫০ সালে বামপন্থী নেতা নাসিম আলী খান কে সঙ্গে নিয়ে অন্যান্য অনুজদের সহায়তায় গেন্ডারিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন 'সীমান্ত গ্রন্থাগার' পাঠাগার।
এই পাঠাগার গড়ে তোলার পেছনে কার শ্রম ছিলো না বলা মুস্কিল – অনেকের মধ্যে ছিলেন --ভাষ্যকার অব্দুল হামিদ, ডক্টর কুদরাত-ই-খুদার ভাই বরকত-ই-খুদার সন্তান এবং জগন্নাথ কলেজের প্রাণীবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডক্টর মেহের-ই-খুদা, বজলে মওলার ছোট ভাই আতা-এ- মওলা, ডিআইজি ওসমান আলী খানের বড় ভাই, বর্তমানে আশফাকুর রহমানের ভাই মুরশেদ ভাই তা দেখাশোনা করছেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার অল্প কিছু বছর আগে, মুকুল মেলার মতো, নিজের বাসায় গড়ে তোলেন 'পূবালী' নামে নাচ-গান শেখার প্রতিষ্ঠান, সেখানে যৎসামান্য (৫/১০ টাকা) সন্মানীর বিনিময়ে ক্লাশের ব্যবস্থা থাকলেও কারো কারো পক্ষে তা দেয়া সম্ভব হতো না। পাশাপাশি রক্ষনশীল সমাজের দৃষ্টি এথেকে এড়িয়ে যায়নি, পত্রিকায় (যতদূর মনে পড়ে দৈনিক ইত্তেফাকে) লেখা হয়, ''তোয়াক্কা না করে, মুসলমানের মেয়েদের নাচ-গান শেখানো হচ্ছে।'' যদিও কয়েক বছরের মধ্যে প্রেক্ষাপট পাল্টে গেলে, সেসব ঘরের মেয়েরাও সেখানে ছাত্রী হতে আসে। এতে নাচের শিক্ষিকা ছিলেন জিনাত জাহান, নজরুল সঙ্গীত শেখাতেন খালিদ হোসেন, রবীন্দ্র সঙ্গীত মৃণ্ময় দাশগুপ্ত, ক্লাসিকাল কে শেখাতেন মনে নাই। পরবর্তিতে, পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন স্কোন ( উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন চৌধুরী আনোয়ার হোসেন মিন্টু), দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য এফএভিএইচ (প্রধান উদ্যোকতা ছিলেন গোলাম মোস্তাফা)।
এর বাইরে হবি ছিলো ছবি তোলা – বাসায় এনলারজার ছিলো, ছবি প্রিন্ট করার জন্য আমাদের একতলার গোসলখানা ব্যবহার হতো ডার্করুম হিসাবে—দেশ স্বাধীন হবার পর, ঢাকার রাজপথে দুই ভাই – বজলে মওলা, আতা-এ- মওলা যে কত ছবি তুলেছিলো তার হিসাব নাই, সেসব নেগেটিভ হয়তো উদ্ধার সম্ভব। এছাড়া কোলকাতা থাকাকালে , আব্বা একসময় দাদার চোখ ফাকি দিয়ে, গীটার-সেতার শিখতে যেতেন রাতে বাফার প্রতিষ্ঠাতা ও গীটারিস্ট ওয়ারেস আলীর কাছে, ফিরতেন রাত একটা দেড়টার দিকে। এতো রাতে অন্দরমহলে ঢোকা নিষেধ থাকায় গৃহভৃত্যদের থাকার জায়গায় আশ্রয় নিতে হতে।
ওয়ারেস আলী চাচার মৃত্যুর ঘটনাটা খুব হৃদয় বিদারক। উনি মারা যান প্লেন ক্র্যাশে, শীতলক্ষা থেকে বডি উদ্ধারের জন্য জাল ফেলার দায়িত্ব নেন তৎকালীণ বিখ্যাত ব্যবসায়ী এস মুজিবুল্লাহ।
বজলে মওলা |
পেশাগত জীবন ও ভ্রমণ
১৯৫৬, বাফার একটা ইভেন্টে, সর্ববামে বজলে মওলা। এটি BAFA(Bulbul academy of fine arts, established1955) আয়োজিত প্রথম চারু ও কারুকলা প্রদর্শনী |
যে আবহে সন্তানদের বড় করেছিলেন
ছোটবেলায়, বিশেষ করে ছুটির দিনে, গান শুনে ঘুম ভাংতো, হয় বড় বোনের রেওয়াজে, কিম্বা চাচার গীটারের সুর, নয়তো মাণিক ভাই (আশফাকুর রহমান) এর গান শেখানোর কোরাসে-- 'আমার দেশের মাটির গন্ধে, ভরে আছে সারা মন......নেই কিছু প্রয়োজন'।
সহধর্মিনী নূরজাহান বেগম
' সারেগামা পাধানি, বোম ফেলেছে জাপানি, বোমের ওপর কেওটে সাপ, ব্রিটিশ বলে বাপরে বাপ'--- অনেকদিন ভারতে থাকা য় ব্রিটিশ সৈন্যরা বাংলা বুঝতো বিধায় রেগে গিয়ে, গাড়ী থেকে মেয়েদের দিকে অস্ত্র উঁচিয় বলতো " I will shoot you",।
।।কুদরত-ই-মওলা।।
বাবা বজলে মওলা কলকাতায় যে আর্ট স্কুলে ছিলেন দেশভাগের আগে তার সামনে পুত্র কুদরত-ই-মওলা। ২০১৯। |
ফটো সৌজন্য : কুদরত-ই-মওলা।