।।জাহিদ মুস্তফা।।
চারুকলা শাহনেওয়াজ হল ভবন।ঢাকা, ১৯৯০। |
আমার জন্ম ৭ ভাদ্র ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ, মংগলবার অর্থাৎ ১৯৬০ খিস্টাব্দের ২৩ আগস্ট সকালে টাংগাইলের সাধারণ এক পরিবারে। জন্মস্থান- আমার মাতুলালয় বাসাইল থানা সদরের স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এর পশ্চিম সীমানা সংলগ্ন বাড়ির কর্তা ছিলেন আমার মাতামহ মরহুম আবদুল বারী আলমজিদী, এলাকাবাসী তাঁকে বারী মিয়া বলেই সম্বোধন করতেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জমিটুকু তিনিই দিয়েছিলেন।
বাবা, ইব্রাহিম তালুকদার।মা, জাহানার আলমজিদী। |
শৈশবে |
আমার মাতামহ ছিলেন- শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁদের দু'জনের মধ্যে পত্র যোগাযোগ ছিল। নানি তাঁর বাড়ির সিন্দুক দেখিয়ে আমাকে বলেছিলেন- এর ভেতরে তোর নানাকে লেখা ফজলুল হক সাহেবের চিঠি আছে! আমি তখন নিতান্তই বালক- এর ঐতিহাসিক মূল্য বুঝার বয়স হয়নি। চিঠি দেখতে চেয়েছি- বড়রা আমাকে নিবৃত্ত করেছেন! নানির মৃত্যুর পর তাঁর যক্ষের ধনের কি অবস্থা হয়েছে জানি না। তাছাড়া- আমাদের সমাজে এসব সম্পদের হিস্যা পায় পুত্রেরা, সেখানে কনিষ্ঠতম কন্যার পুত্র তো হিসেবের বাইরে!
বাবা ইব্রাহিম তালুকদার |
আমি আমার বাবা ইব্রাহিম তালুকদারের জ্যেষ্ঠপুত্র। তিনি ছিলেন সরকারি প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক। টাংগাইল শহরের পূর্ব দক্ষিণে ঘারিন্দা, সুরুজ গ্রাম পেরিয়ে ঝিনাই নদীর অপরপাড়ে একঢালা গ্রামের পরের গ্রামটিই জশিহাটি। এর দক্ষিণপাড়ার তালুকদার বাড়িতে গত শতকের ত্রিশের দশকের প্রথমভাগে বাবার জন্ম। তিনি ছিলেন সচ্ছল কৃষক ওয়াহেদ আলী তালুকদারের জ্যেষ্ঠপুত্র।
আমার বাবার কাছে শুনেছি- আমার দাদাও ছিলেন- তাঁর বাবা আলিমুদ্দিন সরকারের জ্যেষ্ঠ পুত্র। তিনি আটিয়া পরগণার জমিদারের কাছ থেকে প্রচুর নিস্কর জমি পেয়েছিলেন! ঘোড়ায় চড়ে তিনি সেসব জমির চাষাবাদ তত্ত্বাবধান করতেন। তাঁর বাবা গিয়াসুদ্দিন সরকার ছিলেন নূর মোহাম্মদ সরকারের জ্যেষ্ঠপুত্র!
মায়ের সাথে, ২০২০ |
বাবার গান শেখার খুব সখ ছিল। তখনকার রক্ষণশীল সমাজে সংস্কৃতিচর্চাকে সুনজরে দেখা হতো না! নিজের অভিভাবকের বাধায় ওস্তাদজীর কাছে গান শেখার সুযোগ হয়নি। বাবার কণ্ঠটা ছিল দরাজ! উত্তরাধিকার সূত্রে তার কণ্ঠের গুণ কিছুটা আমরা পেয়েছি! রাতের বেলা জ্যোৎস্নার মায়াবী আলোয় বাবা আমাদের সংগে সুয়োরাণী দুয়োরাণীর গল্প করতে করতে হঠাৎ গেয়ে ওঠতেন নজরুলের লেখা অমর প্রেমের গান-
লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া
মজনু গো আঁখি খোল.ষকুল
১৯৭১
প্রাথমিক শেষ করে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠেছি মাত্র! জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি কিছু পড়াশোনা হলো বটে- মার্চ তো উত্তাল! বংগবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, বেতারে আমরা শুনলাম পরদিন ৮ মার্চ সকাল আটটায়!
-যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।
-এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম আমাদের মুক্তির, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!
৭ই মার্চ, বঙ্গবন্ধুর ভাষন। রেসকোর্স, ঢাকা। |
সেদিন বেতারে ইথারে বংগবন্ধুর ঘোষণা ছড়িয়ে পড়লো সারাবাংলায়। কিছুক্ষণ পর সম্মিলিত কণ্ঠের মিছিলে, শ্লোগানের আওয়াজে প্রকম্পিত হলো টাংগাইল শহর।
কয়েকদিন পর লক্ষ্য করলাম- বড় মামার বাসার প্রতিবেশী কাদের সিদ্দিকী হুডখোলা জিপ নিয়ে শহরময় টহল দিচ্ছেন। বাবার সংগে অভিমান করে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি নিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। পরে সেখান থেকে ফিরে এসে কলেজে ভর্তি হয়ে আবার লেখাপড়া শুরু করেন।
আমরা মার্বেল খেলতে গেলে তিনি কোত্থেকে হুট করে এসে বলতেন
- তোদের সংগে আমায় খেলায় নে।
তাঁর খুব হাত সই ছিল। বলতেন
-- বল, কোনটা মারবো।
যেটা দেখাতাম সেটাতেই লাগাতেন! তাঁর হাতসই দেখে আমরা অবাক হয়ে যেতাম!
পুরো শহরটা কেমন যেন ঝিম মেরে গেছে। সবাই আতংকিত- দেশের অবস্থা কি জানি কি হয়! পাকিস্তানিরা কিছুতেই ক্ষমতা ছাড়বে না। বাঙালিরাও আর ছাড় দেবে না।মিছিল মিটিং বাদ দিয়ে শহরের ছাত্র-যুবকরা লতিফ সিদ্দিকী- কাদের সিদ্দিকী ও আনোয়ারুল আলম শহিদের নেতৃত্বে এক হয়ে মাঠে মাঠে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করলেন।
পঁচিশ মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তাণ্ডবে ঢাকা আক্রান্তের খবরে টাংগাইলের অসংখ্য বাসিন্দা শহর ত্যাগ করে প্রত্যন্ত গ্রামে যাওয়া শুরু করে। আমাদের সামনের বাড়ির ফরিদরা ওদের গ্রামের বাড়ি কাশিল চলে গেল। আমরাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম।সে সময় আমাদের পাশের বাড়িতে সপরিবারে থাকতেন বিআরটিসির একজন স্টাফ। তাঁদের গ্রামের বাড়ি বরিশাল। তাঁদের ছেলেমেয়ে মাহবুব ভাই, মির্জা ভাই, মনি, মিজান, নার্গিসরা শহরেই রয়ে গেলেন। পুলিশের এক ডিআইবিও সপরিবারে পাশেই থাকতেন- তাঁর পিঠাপিঠি তিন ছেলের মধ্যে মোশাররফ ও সোহরাব ছিল আমাদের সমবয়সী- ওরাও থেকে গেলো।
পাকিস্তানিরা টাংগাইলের পথে রওনা দিয়েছে এই খবর পেয়ে আমরাও শহর ছেড়ে গ্রামের পথে পা বাড়াই। দক্ষিণে করটিয়ার আকাশ দিয়ে গল গল করে ধোঁয়া বেরিয়ে আকাশ ছেয়ে যাচ্ছে! শোনা গেল- পাকিরা করটিয়া বাজারে আগুন দিয়েছে।
Stop Genocide, Zahir Raihan
কোলের শিশু আর বয়স্কদের নিয়ে যাত্রাপথে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ দেখেছি, নিজেরাও দুর্ভোগের শিকার হয়েছি! খুব সকালে রওনা দিয়ে গ্রামের পর গ্রাম, চকের পর চক পাড়ি দিয়ে জল-কাদা ভরা জমির আইল ধরে দুপুর পাড় করে আমরা জশিহাটি পৌছাই। পরদিন দুপুর থেকে শহর পালানো মানুষের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বিকেল নাগাদ ঢল নামে। সাদা গেঞ্জি গায় খাকিপ্যান্ট পরা কিছু পুলিশ ইপিআর সদস্যকেও দেখলাম! তাঁরা আমাদের গ্রাম পেরিয়ে আরও পূবদিকে চলে গেলেন।
আমাদের বাড়ির সামনের দিকে সড়কের মুখে রহিম চাচার মনোহারি দোকান। সামনে বাঁশের বেঞ্চ পাতা। কেউ কেউ সেখানে এসে বসে কিছু কিনে মুখে দিচ্ছেন, খানিকটা জিরিয়ে আবার হাঁটা দিচ্ছেন। আমরা চাপকল ঠেলে ঠেলে ঠাণ্ডা জলে জগ-কলস ভরে তৃষ্ণার্তদের খেতে দিয়েছি। ক্ষুধার্তদের জন্য বাড়ি থেকে গুড় মুড়ি এনে দিয়েছি।
দুয়েকদিন পর খবর পেলাম- আমাদের একগ্রাম পর ময়থার স্কুলমাঠে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এক হাটবারে আমার চাচাতো ভাই মঞ্জুর সাথে পায়ে হেঁটে তিনমাইল দূরে ময়থা গেলাম। দেখি স্কুলমাঠে একজনের কমান্ডে অনেক তরুণরা মার্চপাস্ট করছে, হঠাৎ শুয়ে পড়ে ক্রল করছে। তাঁদের চোখে মুখে সেদিন যে দৃঢ়তা দেখেছি তার কোন তুলনা নেই!
আজ উপলব্ধি করি- ওই প্রশিক্ষণে তখন দেশের মুক্তির জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা, প্রয়োজনে আত্মত্যাগের অদম্য আগ্রহের বীজ তাঁদের বুকের মধ্যে রোপণ করা হয়েছিল। আমার বয়স তখন সাড়ে দশ বছর- প্রবল ইচ্ছে হলো ওদের দলে ভিড়ে যাবার। কিন্তু আমার মতো আর কাউকে খুঁজে পেলাম না! বড়ভাই আমাকে একপ্রকার টেনে নিয়ে হাটের দিকে রওনা দিলো।
বিন্দুবাসিনী বালক স্কুল |
এসময় শফিক আর আমি ডাকঘরের মাধ্যমে ঢাকার ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ, বাংলার বাণী, জনপদ, দৈনিক বাংলায় ছোটদের পাতায় লেখা পাঠাতাম। ১৯৭৪ সালে প্রথমে শফিকের ছড়া ও এর একসপ্তাহ পর আমার লেখা গল্প বাংলার বাণীর ছোটদের পাতায় ছাপা হয়।
বনগবন্ধুর পাঁশে কাদের সিদ্দিকী, কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ |
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বংগবন্ধু বাংলাদেশে ফিরে আসার কয়েক দিন পর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা নিতে তিনি টাংগাইলে আসেন। আমাদের বিন্দুবাসিনী স্কুলমাঠে মঞ্চ বানিয়ে এই অস্ত্রসমর্পণ অনুষ্ঠান হয়। কাদেরিয়া বাহিনী প্রধান আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম বংগবন্ধুর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পণ করেন।এখানে দর্শক হিসেবে আমিও ছিলাম।সে সময় টাংগাইলে কয়েকটি শিশু সংগঠন খুব সক্রিয় ছিল। আমি প্রথমে নজরুল সেনায় নাম লেখাই। নজরুল সেনার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বংগবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেয়। আমিও সে দলে ছিলাম। বংগবন্ধু আমাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার ও অন্য কয়েকজনের মাথায় আশীর্বাদের স্পর্শ দেন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বংগবন্ধু বাংলাদেশে নিয়ে আসেন ও ঢাকার ধানমণ্ডিতে তাঁর আবাসনের ব্যবস্থা করেন। নজরুল সেনা একবার কবিকে টাংগাইলে এনেছিল, আমরা বাকহারা অসুস্থ কবিকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি।
পরবর্তীতে আমি তোফাজ্জল ভাইয়ের পরামর্শে বৈশাখী কচি-কাঁচার মেলার সদস্য হই। সেখানে আমার স্কুল সহপাঠী শফিকুল ইসলাম তালুকদারকে পাই। সংগঠক খান মোহাম্মদ খালেদ, সাথীবোন ফাতেমা রহমান বীনু ছড়া লিখতেন! তাঁদের পথ ধরে আমাদের লেখালেখির সূচনা সেই বাহাত্তরেই! খালেদ ভাইয়া আমাদের আবৃত্তির কৌশল শেখান।
আমাদের বড়দের মধ্যে কচি-কাঁচায় ছিলেন খালেদ রেজা লুলু ভাই, হাবিবুজ্জামান চৌধুরী টুলু ভাই (পরে চিকিৎসক হয়েছেন), সাইফুল ভাই, মতি ভাই (রুশ প্রবাসী) , মৈত্রী দি (যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী), পিন্টু ভাই, লাটভাই, সোহেল, সালেক প্রমুখ। তাঁদের কাজ ছিল পুরাতন আদালত মাঠে কচি-কাঁচাদের মার্চপাস্ট প্রশিক্ষণ দেয়া।
মার্চপাস্টের ফাঁকে ফাঁকে শফিক, অসীম ও আমার সংগে আবৃত্তি শেখে তাহেরা আরিফা অনু (ভোয়ার সংবাদপাঠক)। সিরাজগঞ্জ থেকে এসে আমাদের সংগে যুক্ত হলো সহপাঠী শামসেত তাবরেজী (কবি)। অনুর বড়ভাই পনির (যুক্তরাষ্ট্রে প্রয়াত) ছিল আমাদের সহপাঠী। ওদের ভাগনি সেলিনা ববি (নিউইয়র্ক প্রবাসী) ছিল অনুর নাচের জুটি। গানের দলে ছিল পাপড়ি মুখার্জী (ভারতপ্রবাসী), নুরুননাহার বুলবুল আপা, বকুল, গায়ত্রীদি প্রমুখ। ওদের সহপাঠী জুয়েল, রানী, বৃষ্টি, রিচি, রানু, আফু প্রমুখরা ছিল মেয়েদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় সদস্য। আমার ছোট দুইবোন চিনু- শানু, ছোটভাই কন্নু, নুরুল ইসলাম বাদল, তিন চারুশিল্পী খলিলুর রহমান শাহিন, স্বপন মাহমুদ, রশীদ আমিন, উজ্জ্বল, প্রিন্স, হারুনুর রশীদ বাদল, প্রতিবেশি বুলবুল, সাঈদ ভাইরা বিভিন্ন সময়ে মেলার সংগে যুক্ত হয়।
বিন্দুবাসিনী স্কুলে আমাদের সহপাঠী পনির, মাসুম, শহিদ আজাদ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), খন্দকার ইকবাল হোসেন (পরিবহন ব্যবসায়ী নেতা), ফরিদ আহমেদ (যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী), বিদ্যুৎ কুমার সাহা ও সহদেব বসাক (ভারত প্রবাসী), পরিমল বন্ধু বসাক (সোনালী ব্যাংকের সাবেক ডিজিএম), গোকুল পাল চৌধুরী (জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ) আমাদের সংগে মেলার কাজে যুক্ত ছিল।
স্কুলে প্রতিটি ক্লাসে ছিল দু'টি সেকশন। দুই সেকশন মিলিয়ে প্রথম ছিল- বায়েছ খান (চক্ষুবিশেষজ্ঞ- সৌদি প্রবাসী), সেরা ছাত্রদের মধ্যে ছিল তপন সাহা, হাফিজুর রহমান (চিকিৎসক), বিভূতি ভূষণ সরকার (কৃষিবিদ), মাসুদ জামাল জাহেদী (প্রকৌশলী- যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী), স্কুলের ইংরেজিশিক্ষক মুসলিম স্যারের জ্যেষ্ঠপুত্র জুবায়ের খালেদ লাবু (ফার্মাসির অধ্যাপক), শফিকুল ইসলাম তালুকদার (অধ্যাপক ড. ও কবি)।
এ ছাড়াও সহপাঠী মেধাবী বন্ধুদের মধ্যে আরও ছিল ওয়াহিদুল ইসলাম খান (মহামান্য রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের সচিব), নীহার সরকার (আইনজীবি), ইমদাদুল হক খান (নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন), স্কুলটিমের ফুটবলার বাদল, খন্দকার আবদুল ওয়াদুদ (জনতা ব্যাংকের সাবেক ডিজিএম), পুলক চৌধুরী (কলকাতা প্রবাসী), স্বপন সাহা, শংকর বসাক (কৃষিবিদ), আশুতোষ সাহা (নিউইয়র্ক প্রবাসী), মীর শামীমুল আলম, সিরাজুল ইসলাম, প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম (কানাডা প্রবাসী), রাজনীতিক সুভাষ রায়, সরদার আজাদ ও শাহ আলম, ব্যবসায়ী ওয়াহিদ সেলিম, আলম, তোতন (অকালপ্রয়াত চিত্রশিল্পী), সৈয়দ আমিনুল হক কায়সার, প্রদীপ পাল, আবুল কালাম আজাদ, শাহাদাৎ হোসেন বাবলু (টাংগাইল হোমিওপ্যাথি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ), বারেক, রফিক চৌধুরী, আবিদ আনোয়ার খান খোকন, দুলাল সাহা (অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক), থানাপাড়ায় আমাদের প্রতিবেশি লাভলু, বেল্টু, উদয়, অসীম রায়, দুলাল দত্ত, হেদায়েতুল ইসলাম ফারুক প্রমুখ। ১৯৭৩ সালে সিরাজগঞ্জ থেকে এসে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয় খোন্দকার শামসেত তাবরেজী। আমাদের উপরের ক্লাসের মিজানুর রহমান পিন্টু (সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্মকর্তা, চারুশিল্পী) ও মোহাম্মদ খালেক (নিউইয়র্ক প্রবাসী) আমাদের সংগে যুক্ত হয় ১৯৭৫ সালে দশম শ্রেণিতে।
বিন্দুবাসিনী স্কুলে আমরা যখন ভর্তি হই- তখন প্রধান শিক্ষক ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। স্কুল সরকারি হলে প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন তাজুল ইসলাম স্যার। সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন শামসুদ্দিন আহমেদ। পরে তিনি প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন। শিক্ষক হিসেবে আমরা পেয়েছি- হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (পাপড়ির দাদু), আবদুল গফুর (সিন্টুভাই, লুলুভাই ও বন্ধু মাসুমের বাবা), মুসলিম উদ্দিন আহমেদ (সহপাঠী লাবুর বাবা ), নূরউদ্দিন বাদল, শশধর বসাক, সুধীর চক্রবর্তী, নারায়ণ চন্দ্র সাহা, তোজাম্মেল হোসেন, তাঁর পুত্র তোফাজ্জল হোসেন, দুলাল বিএসসি, ছাদের আলী, বিনয় কুমার, জামান স্যার, উর্দু, আরবী ও সংস্কৃত বিষয়ের শিক্ষক। উর্দু স্যার আমাদের আত্মীয় ছিলেন, আমাদের থানাপাড়ায় ছিল তাঁর আবাস।
প্রধান শিক্ষক তাজুল ইসলাম স্যার ভালো পড়াতেন, তাঁর মধ্যে খানিকটা ক্ষ্যাপাটে ভাব ছিল। হাতে একটা বেত নিয়ে সব ক্লাসের সামনে দিয়ে যেতেন, অন্য শিক্ষকদের পড়ানো খেয়াল করতেন, প্রয়োজনে কোন ক্লাসে ঢুঁ মারতেন, ছাত্র- শিক্ষকের সংগে কথা বলতেন। একবার স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সমবেত সংগীতে নাম দিয়ে স্যারের কাছাকাছি আসার সুযোগ পাই। মহড়ায় স্যার থাকতেন, গাওয়ায় আমাদের সুর ঠিক আছে কিনা খেয়াল রাখতঙ্গাই শামসুদ্দিন স্যার সাহিত্য ভালো জানতেন। তিনি ইংরেজি ও বাংলা উভয় বিষয় পড়াতেন ভারী সুন্দর করে। গফুর স্যারের ক্লাস বেশিদিন পাই নি। মুসলিম স্যার ইংরেজি গ্রামার পড়াতেন।হরেন স্যার আমাদের ছবি আঁকার ক্লাস নিতেন। ব্ল্যাকবোর্ডে ছবি এঁকে দিতেন, আমরা তা দেখে দেখে আঁকতাম। আমার আঁকার হাত ভালো থাকায় তাঁর কাছ থেকে বেশি নম্বর পেতাম! কখনও কখনও স্যার আমাকে বোর্ডেও আঁকতে দিতেন। হরেন স্যার আমার বাবারও শিক্ষক ছিলেন। তাই আমাকে আদর করে বলতেন
- তুমি আমার নাতি ছাত্র হে!
হরেন্দ্রনাথ স্যারের বাবা এই স্কুলের এক সময়ের প্রধান শিক্ষক। হেড স্যারের অফিস কক্ষে বেশ ক'জন প্রধান শিক্ষকের বাঁধানো ছবির মধ্যে আমরা যোগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ছবিও দেখেছি!
শশধর সাহা ছিলেন লম্বা, স্বাস্থ্যবান ও গোলগাল। তিনি বাজিতপুর থেকে আর সুধীর চক্রবর্তী সাকরাইল গ্রাম থেকে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসতেন। তাঁরা দু'জন পরস্পরের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। দু'জনেই গণিত পড়াতেন। উপরের ক্লাসে বাণিজ্য বিভাগের বিষয়গুলো তাঁরাই পড়াতেন। আমরা কয়েকজন সাইকেলে করে সাকরাইলে সুধীর চক্রবর্তী স্যারের বাড়িতে পড়তে যেতাম। তিনি এখনও বেঁচে আছেন।
শিক্ষকদের মধ্যে তরুণতম নূরউদ্দিন বাদল খুব স্মার্ট ও স্টাইলিশ ছিলেন। সবসময় ইস্ত্রি করা শার্টপ্যান্ট পরতেন। মেজাজ ছিল খুব কড়া। ইংরেজি চিত্রলেখানামে শাহ আলম, খোকনকে বেশি টার্গেট করতেন, আমিও দু' একবার তাঁর জালে আটকেছি! তিনি দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন। না পারলে- ভয়ংকর বিপদ! অন্যদের ছুটি দিয়ে ওদেরকে আটকে দিতেন। বলতেন
- বাইরা- এই পড়া দিবি, তারপর বাড়ি যাবি।
সহপাঠী বায়েছ খান, সরদার আজাদ ও প্রদীপ পাল এখনও বাইরা বলে পরস্পর পরস্পরকে সম্বোধন করে মজা নেয়! প্রায় প্রতিদিন ভোরে উঠে স্কুলমাঠে আমরা ফুটবল খেলতে যেতাম। বিকালে আদালত মাঠে কচি-কাঁচায় শরীরচর্চা, বইপড়া, আবৃত্তি আর ছবি আঁকার চর্চা করতাম।
মাঝে মাঝে টাংগাইল সাধারণ গ্রন্থাগারে যেয়ে বই আর পত্র-পত্রিকা পড়তাম। গ্রন্থাগারের সম্পাদক আবদুর রহমান রককু (প্রয়াত নাট্যব্যক্তিত্ব) সস্নেহ দৃষ্টিতে আমাদের খেয়াল রাখতেন। গ্রন্থাগার কর্মচারি হালিম ভাই তা জেনেই হয়তো আমাকে বেছে বেছে ভালো বই পড়তে দিতেন। কলকাতা থেকে আসা সুনীল গংগোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শ্যামল গংগোপাধ্যায় ও মতি নন্দীর শ্রেষ্ঠগল্পের বই পেয়ে গোগ্রাসে গিললাম!
এ সময় আমাদের স্কুলের অগ্রজ আবু হেনা মোস্তফা কামাল (কবি মাহমুদ কামাল) এর সংগে আমাদের ঘনিষ্ঠতা হয়। এক ঝাঁক পায়রা নামে তিনি একটি সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন ও একই নামে দেয়ালিকা প্রকাশ করেন। আমরা ওই দেয়ালিকায় লিখতাম। এর অনুপ্রেরণায়- আমরা শ্বেত বলাকার দেশ নামে একটি দেয়ালিকা প্রকাশ করি। পরে মাহমুদ কামাল কবি জাহাংগীর ফিরোজ ও শফিকুল হাসান ও আমাদের নিয়ে অরণি সাহিত্য গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। বিন্দুবাসিনী স্কুলেও অসীম, শফিক, তোতন ও আমি মিলে দেয়ালিকা করেছিলাম। শামসুদ্দিন স্যারসহ কয়েকজন শিক্ষক আমাদের উৎসাহিত করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে স্কুলবার্ষিকীতে 'দীপুর দুপুর বেলা' নামে আমার একটি গল্প ছাপা হয়।
জয়নুল আবেদিন, ১৯৭৬। পিজি হাসপাতাল, ঢাকা। |
১৯৭৪ সালে টাংগাইলে কচি-কাঁচার মেলার জেলা সম্মেলনে আসেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কবি সুফিয়া কামাল, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই ও শিল্পী হাশেম খান। আমি ও তোফাজ্জল ভাই শিল্পাচার্যকে আমাদের আঁকা ছবি তাঁকে উপহার দেই। তিনি আমাকে সাদরে কাছে টেনে নিয়ে বলেন
- তুমি চারুকলায় পড়বে। আর আমার শান্তিনগরের বাসায় এসো। আমি তোমাকে আমার ছবি উপহার দেবো।আমি যখন চারুকলায় পড়তে যাই- তার অনেক আগেই কর্কটরোগে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে।
১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতি বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টাংগাইলে আসেন। টাংগাইলের পথে পথে সেবার অনেক স্বাগত তোরণ নির্মাণ করা হয়। বাসস্ট্যান্ডে পরিবহন শ্রমিকদের তোরণ নির্মাণের নকশা ও কাজে তোফাজ্জল ভাইয়ের সংগে আমিও যুক্ত ছিলাম। মওলানা ভাসানীর অনুরোধে সেবার বংগবন্ধু কাগমারি কলেজ সরকারিকরণ করেন। বংগবন্ধুর সফরসংগী ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক। এর মাত্র পাঁচমাস সাতদিন পর বংগবন্ধুর প্রিয়বন্ধু ও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী খন্দকার মোশতাক বংগবন্ধু ও তাঁর পরিবার-স্বজনদের রক্তাপ্লুত নিথর দেহ দাফন না করেই অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার নেন!
কৈশোরে, লেখক পেছনে দাঁড়িয়ে, গলায় হাত। |
ভারত ভাগের পর সন্তোষের রাজপরিবার সব ছেড়েছুড়ে ওই বাংলায় পাড়ি জমান। পরিত্যক্ত রাজবাড়িতে আসামফেরত মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আশ্রয় হয়। সিরাজগঞ্জের ধানগড়ায় তাঁর জন্ম হলেও মাটির মায়ায় তিনি টাংগাইলকেই নিজের করে নেন। তিনি সেখানে ঐতিহাসিক কাগমারি সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। এরপর তিনি কাগমারি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ঊনসত্তরের ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানে মওলানা ভাসানীর ভূমিকা অবিস্মরণিয়! আফ্রো এশীয় নির্যাতিত গণমানুষের নেতা হিসেবে তাঁর বিশেষ পরিচিতি ছিল। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকার গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি ছিলেন।
আমরা দলবেঁধে গেছি সেখানে। দেখি অসংখ্য ড্যাগে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে আর শয়ে শয়ে লোক বসে খিচুড়ি খাচ্ছেন। আমরাও খেয়েছি মজার সে খিচুড়ি।
মাত্র সাতদিন পর অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর পিজি হাসপাতালে মওলানা ভাসানীর মহাপ্রয়াণ ঘটে!
পরে তাঁর নামে টাংগাইলের সন্তোষের রাজবাড়িতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
এরপর মওলানা সাহেব তাঁর এক জনসভার বক্তৃতায় বললেন,
- মুজিবর, তোমার পুলিশ বাহিনীর কাছে কতো অস্ত্র আছে? তার চেয়ে বেশি অস্ত্র আছে আমার এই মুছা চৌধুরীর কাছে।
সভাশেষে মুছা চৌধুরী গ্রেপ্তার হলেন।
১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আয়োজিত জনসভায় মওলানা ভাসানী তাঁর একসময়ের রাজনৈতিক শিষ্য বংগবন্ধুর সমালোচনা করে বক্তৃতায় বলেন
- মুজিবর, ইন্দিরা তোমার মাথায় ঝোলাগুড় রাখছে, আর সে ঝোলাগুড় খাচ্ছে।
আরও বলেন
-চাইলের দাম বাড়ছে, ডাইলের দাম বাড়ছে। তেলের দাম বাড়ছে।
তারপর মওলানা সাহেব মাইক্রোফোন থেকে মুখ খানিকটা পেছন দিকে ঘুরিয়ে মঞ্চে বসে থাকা মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে ইংগিত করে বললেন
-মদের দাম বাড়ছে কিনা- যাদু মিয়া জানে!
কলেজে ব্যবসা প্রশাসন পড়াতেন নাট্যকার কাদের শাহ। ওখানে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলাম তরুণ খালেকুজ্জামান ইলিয়াস ও আহমদ রেজাকে। প্রথমজন বরেণ্য সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অনুজ ও নিজেও নামকরা অনুবাদক। আহমদ রেজা ১৯৮২ এর বিশেষ বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে চলে যান। তাঁর স্ত্রী সেতারা বেগম ছিলেন বিন্দুবাসিনী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক।
কলেজমাঠে প্রায়শ আমরা ফুটবল খেলতাম। একবার ফুটবলে আন্তঃশ্রেণি প্রতিযোগিতাও হয়েছিল।ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে লাইব্রেরিতে যেয়ে পড়ার বইয়ের সংগে সাহিত্যের বই পড়তাম। লাইব্রেরিয়ান ছিলেন তৈয়বউদ্দিন চাচা। তিনিও আমার বাবার বন্ধু, বেঁচে আছেন। ভাড়াবাড়িতে আমাদের প্রতিবেশি ছিলেন। তাঁর বড় দুইকন্যা ডেইজি ও প্রেইজি আমার দুই বোন চিনু-শানুর সহপাঠী বান্ধবী।তাঁদের আরেক কন্যা রুমি চিকিৎসক- বিদেশে আছে। ছোটমেয়ে রুমানা আক্তার পুলিশ কর্মকর্তা। ওদের একটাই ভাই ভালো ফুটবলার ছিল।
ইচ্ছে ছিল এসএসসির পর আর্ট কলেজে ভর্তি হব। আব্বার আর্থিক অসামর্থতায় সেটি আর হয়ে ওঠলো না! আব্বা অবশ্য আমার আগ্রহকে বিবেচনায় নিয়ে তাঁর চাচাতো বোন মমতা ফুপুর সংগে আলাপ করেছিলেন ঢাকার বাসায় আমাকে রেখে পড়ানো যায় কিনা। তিনি সম্মত হননি। আব্বা আমাকে উচ্চমাধ্যমিকের পর চারুকলায় পড়ার প্রতিশ্রুতি দেন। টাংগাইল ডাকঘরের ডাকবাবুর পুত্র আমার স্কুল সহপাঠী তোতন চট্টগ্রাম আর্ট কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হলো ১৯৭৬ সালে।
১৯৭৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েও বিষয় মনপুত না হওয়ায় আমার ভর্তি ফর্ম তোলা হয়নি। দূরত্ব ও অনাত্মীয় পরিবেশের দোহাই দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায়ও যেতে পারলাম না! এ সময় স্কুলসহপাঠী কলেজ পাড়ার কায়সারের সংগে বেশ খাতির হয়। ও আর তাবরেজী বাংলায় ভর্তি হয়, ফরিদ হিসাববিজ্ঞান, পরিমল-ওয়াদুদ মার্কেটিং শফিক জাহাংগীরনগরে রসায়নে ভর্তি হলো। পরের বছর কায়সার সমাজবিজ্ঞানে, শফিক সরকার ও রাজনীতিতে ঢোকে।
বন্ধুদের মাঝে |
এদিকে ১৯৭৮ এ চারুকলার ভর্তি পরীক্ষা আগেই শেষ! আমি টাংগাইলে ফিরে এলাম। ফিরে আসায় আমার আব্বা খুশি! বললেন- ভালো হয়েছে। বাড়ির ভাত খেয়ে করটিয়া কলেজে অনার্স পড়। হিসাববিজ্ঞান সম্মানে ভর্তি হলাম রউফ স্যারের অধীনে। ওই ক্লাসে পেলাম সহপাঠী খালেক ও খোকনকে। মাসুদ জামাল জাহেদীর বেয়াই বাবু ও রমেন্দ্রনাথ বসাকসহ আরও অনেককেই ওখানে পেলাম।
কবি মাহমুদ কামাল বাংলা বিভাগে উঁচুক্লাসে পড়েন। উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয় কচি-কাঁচার মেলার অনু। নবীন কবিবন্ধু শ্যামল সেন বাংলায় ভর্তি হয়। কবি মাহবুব সাদিক ছিলেন বাংলার প্রভাষক। কলেজ লাইব্রেরিয়ান কবি আবু হাসানকে পেয়ে আড্ডা ও পাঠের একটা সুন্দর পরিবেশও জুটেছিল।আমার স্কুল-কলেজ জীবনের সহপাঠী নীহার করটিয়া কলেজে ভর্তি হলো জিওলোজিতে। পরে ও স্নাতকোত্তর করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। নীলফামারির জলিল আহমেদের সংগে নীহারের সহপাঠীত্ব সূত্রে আমার সংগেও তাঁর বন্ধুত্ব সেই আশির দশক থেকে বিদ্যমান।
১৯৭৮-৭৯তে সা'দত কলেজে সাহিত্য প্রতিযোগিতায় কয়েকটি বিষয়ে নাম দিয়ে স্বরচিত কবিতা, গল্পবলা ও উপস্থিত বক্তৃতায় প্রথম হয়ে সাহিত্য চ্যাম্পিয়ন হই। এ সময় কলেজ ভিপি মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামান খান ভাই, থানাপাড়ার স্বাধীন ভাই, ছাত্রলীগের খোকাভাই, আনিস ভাই ও মনি ভাইয়ের সংগে সুসম্পর্ক হয়। সাহিত্য প্রতিযোগিতায় ভালো করায় ছাত্রদল থেকে ভিপি প্রার্থী (নির্বাচিত হয়েছিলেন) কলেজপাড়ার বডিবিল্ডার স্বপন ভাই সাহিত্য সম্পাদক পদে আমাকে নির্বাচনের প্রস্তাব দেন। আমি বিনয়ের সংগে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।
সকালে কলেজে যাই, বিকেলে কচি-কাঁচার মেলার কাজ করি। এ সময় খান মোহাম্মদ খালেদ ভাইয়া আইন শিক্ষায় নিয়োজিত, বীনু'পাও উচ্চতর শিক্ষায় ব্যস্ত। লুলুভাই, টুলুভাই ময়মনসিংহ মেডিকেলে পড়ছেন। আকুর টাকুর পাড়ার কৃষিবিদ লাটভাই, আদালত পাড়ার পিন্টু ভাই, সাঈদ ভাই, থানাপাড়ার আতিক ভাই বুলবুল আর আমি মেলার কাজের দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নিলাম। বোনদের মধ্যে ববি, পাপড়ি, জুয়েল, রানীরা উপরের শ্রেণিতে উঠায় পড়া-লেখায় ব্যস্ত। তাবরেজী, অসীম, শফিক ঢাকায়। এ সময় নূরুল ইসলাম বাদল, স্বপন মাহমুদ, খলিলুর রহমান শাহীন, খোকন, শামসুল আলম প্রিন্স, বজলুর রশীদ আমিন, শানু, শিখা, লাভলিরা কর্মী হিসেবে সামনে চলে আসে।
এর প্রায় তিন বছর আগেকার মজার এক পুতুল বিয়ের প্রসংগ না তুললেই নয়! পুতুল বিয়ে অনেক দেখেছি, তবে এমন বিয়ে আর দেখিনি! বৈশাখী কচি-কাঁচার মেলার বান্ধবী দুইবোন পাপড়ি মুখার্জির কন্যা পুতুলের সংগে, সেলিনা হোসেন ববির ছেলে পুতুলের বিয়ের আয়োজন হলো বেশ ঘটা করে। ববির সংগে বরযাত্রী হয়ে ঢাকঢোল বাজিয়ে তাবরেজী, শফিক, শিশির, জুয়েল, রানীদেরকে নিয়ে আমরা গেলাম পাপড়িদের আবাস আদালত পাড়ায় ওর দাদুবাড়িতে।
অতিথিদের খাওয়ার জন্য মোরগ পোলাওয়ের আয়োজন ছিল! খেয়ে দেয়ে পাপড়ির মেয়ে পুতুলটাকে তুলে দেয়া হলো ববির হাতে। পুতুল কন্যার বিদায়ে মা পাপড়ির মন বেশ খারাপ! আমরা ওদেরকে ববির বাসায় পৌছে দিয়ে যার যার বাসায় ফিরলাম। দু'দিন পর ফিরানিতে এলো বউ- জামাই। এবার ববি গম্ভীর, পাপড়ির মুখে বিজয়ীর হাসি!
এরপর আমাদের রঙিন শৈশবে হানা দেয় যৌবনের আবেগ, কাছের মানুষের প্রতি অজানা টান আর ভালোলাগা-ভালোবাসার গভীর গোপন প্রেমঘোর! সে আবার আরেক কাহিনী।
শিশির ভট্টের স্কেচবুক
দেশের কৃতিশিল্পী আমাদের পরম বন্ধু শিশির ভট্টাচার্যের জন্ম ২ বৈশাখ ১৩৬৭ বংগাব্দ বাংলাদেশের দিনাজপুরের জেলার ঠাকুরগাঁ মহকুমা (বর্তমানে জেলা) শহরে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। চার ভাই আর দুই বোন তাঁরা। শিশির ভাইদের মধ্যে তৃতীয়। বড়দা ছিলেন পুলিশ অফিসার, মেজদা তুষার ভট্টাচার্য ঠাকুরগাঁয়ে ব্যবসায়ী, ছোটভাই অসীম ভট্টাচার্য।
শিশির ভট্টাচার্য |
অসীম তখন ওর গ্রামের বাড়িতে গেছে, পরদিন ওর ফেরার কথা। অসীমের বড়বোন মঞ্জু দি বিকেলে আমাদের বাসায় এসে খবর দিলেন- ঢাকা থেকে শিশির এসেছে! আমি ছুট লাগালাম! অনেক গল্প শুনেছি শিশিরের। সেও অসীমের কাছে শুনেছে আমাদের কথা। লম্বাটে একহারা গড়নের শ্যামলা ছেলেটির গালে সামান্য দাড়ির আভাস! প্রথম দেখে কথা বলে ভালো লেগে গেল! সেই থেকে বন্ধুত্বের সূচনা!
আমাদের বন্ধু সহপাঠীরা সবাই তখন টাংগাইলে। আড্ডার প্রধান কেন্দ্র তখন আনন্দময়ী কেবিন।সেখানে টাংগাইলের কবি- সাহিত্যিক- পেশাজীবি ও স্থানীয় রাজনীতিকরা আড্ডায় বসেন এবং দফায় দফায় চা পান চলে।বাংলাদেশে তখন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায়। দেশে ঘরোয়া রাজনীতির নামে সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চলছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তখন জনতা পার্টির সরকার, মোরারজি দেশাই সেদেশের প্রধানমন্ত্রী।
আনন্দময়ী কেবিন |
আনন্দময়ী কেবিনে একে একে শিশিরের সংগে পরিচয় হলো বন্ধু শফিক ইমতিয়াজ, শামসেত তাবরেজী, সৈয়দ আমিনুল হক কায়সার, শ্যামল সেন (অকালপ্রয়াত) , নীহার সরকার, সৈয়দ শহিদ আনাম, হারুন রশীদ খোন্দকারসহ অনেকের সংগে। এ ছাড়াও কবি আবু কায়সার (প্রয়াত), বুলবুল খান মাহবুব, আল মুজাহিদী, মাহবুব সাদিক, নাট্যকর্মী আবদুর রহমান রককু (প্রয়াত), এডভোকেট কামাক্ষানাথ সেন (প্রয়াত), জাহাংগীর ফিরোজ, আলমগীর রেজা চৌধুরী, মাহমুদ কামাল ও মনোজ সাহা(কলকাতায় প্রয়াত), শরাফত খান (সম্প্রতি কোভিটে প্রয়াত), খঃ তোফাজ্জল হোসেনের সংগে ওর পরিচয় হলো।
সেবার কলকাতা থেকে কবি তারাপদ রায় টাংগাইলে এসেছিলেন। তাঁর বাবা এডভোকেট সুধীর রায় তাঁর একপুত্রসহ টাংগাইলের আদালত পাড়া পুকুরের দক্ষিণ পাড়ের বাড়িতে বাস করতেন। বাড়িটি পুরনো গোলাকৃতির খিলানঅলা টানাবারান্দার। সামনে খানিকটা সবুজ ঘাসের মাঠ। তারাপদপুত্র বালক তাতাই (কৃত্তিবাস রায়, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী) সে মাঠে ফুটবল নিয়ে খেলেছে!কালের করালগ্রাসে পুঁজিরনখরে চমৎকার সেই বাড়িটি আজ হারিয়ে গেছে!
তারাপদ দা'র সংগেও শিশিরকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মিনতী বৌদি আমাদের কফি বানিয়ে খাওয়ালেন। বৌদির দাঁত উঁচু ছিল বলে- তারাপদ দা তাঁকে নিয়ে মজার একটি কবিতা লিখেছিলেন। যদ্দুর মনে পড়ছে পঙক্তিগুলো এমন-
দাঁতাল শুয়োর নিয়ে ঘর করা
একমাত্র তোমাকে, তোমাকেই মানায়
বদ্ধঘরে চকচকে আয়নার সমুখে
পরিতৃপ্ত- তারাপদ রায়!
শিশির ওর স্কেচ খাতায় তারাপদ দা'কে দেখে আঁকলো। দাদা তার আঁকার প্রশংসা করে বললেন- শিশির তুমি হিন্দুর ছেলে, তাই বলছি- মনে রেখো, ভুল করেও স্বদেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমাবে না! এখানে তোমার প্রতিভার যে মূল্যায়ন হবে, ওখানে সেই মূল্য তুমি পাবেনা।
অংকন ও চিত্রায়ণ বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সংগে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে শিশির ভট্টাচার্য বরোদার এম এস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়।
শিশির ভট্টাচার্যের স্কেচবুক সবসময় আকর্ষণীয় ছিল! তাতে চেনা অচেনা মানুষের পোর্ট্রেটের ছড়াছড়ি! আমাকেও এঁকেছে বারকয়েক! প্রথমবার সেই প্রথম পরিচয়ের পর টাংগাইলে অসীমের বাবা প্রয়াত হরেন্দ্রনাথ রায়ের মোক্তারি চেম্বারে! আঁকতে আঁকতে শিশির বলেছিল- আমার নাকের সংগে নাকি ইন্দিরা গান্ধির নাকের বেশ মিল! শিশিরের স্কেচবুক আর ওর হাতের আশ্চর্য অংকন দেখে আমি আবার ছবি আঁকায় ঝুঁকে পড়ি। প্রতিবেশী মনোজ সাহা ছবি আঁকতেন। তাঁকে আমরা মইন্টা দা বলে ডাকতাম, তিনি আমাদের জড়জীবনের বিষয় সাজিয়ে দিতেন। তা দেখে অসীম আর আমি আঁকতাম। তবে পরিবারের অসম্মতিতে আমি চারুকলায় ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারলাম না! ১৯৭৮ সালে আমি উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েও যথাসময়ে ভর্তিফর্ম না তোলায় সে সুযোগ বাতিল হয়। সেবার বন্ধু অসীম রায় আর্ট কলেজে ভর্তি হলো। আর চারুকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের প্রতি আমার আগ্রহ প্রবল হয়ে ওঠে! বন্ধু শিশির ভট্টাচার্য তখন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ১৯৭৯ সালে আমি আর্টকলেজে ভর্তি হই। শিশির তখন আমার গাইড ও ফিলোসফার।
সহপাঠিদের সাথে |
পনেরোটি পদের মধ্যে ভিপিসহ নয়টি পদে আমাদের প্যানেল প্রার্থীরা নির্বাচিত হন! শিল্পী মোহাম্মদ ইউনুস-নাজভী প্যানেল থেকে নাজভী ইসলাম (যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী) জিএস নির্বাচিত হন। এজিএস হয়েছিলেন আমাদের প্যানেলের হাবিবুর রহমান (ভারতপ্রবাসী)। প্রদর্শনী সম্পাদক হন আবু সাঈদ ভাই (প্রয়াত), পরে তিনি চারুকলায় মৃৎশিল্প বিভাগের শিক্ষক হয়েছিলেন। শিল্পী রওজাতুল জান্নাত চম্পা (প্রয়াত) সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এতো সৃজনশীল, বর্ণাঢ্য ও সংগীতমুখর নির্বাচনী প্রচারণা আর কোথাও দেখিনি! সমীর দা (কলকাতাপ্রবাসী) ঢোল বাজিয়ে আর দরাজ কণ্ঠে গান গেয়ে শিশির ভট্টাচার্য আমাদের নির্বাচনী শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দিত। আমাদের প্যানেলের নেতৃত্বে ছিলেন শিল্পী নিসার হোসেন (বর্তমানে চারুকলা অনুষদের ডিন), বাবুল ভাই, ময়না আপা (যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী), ফরিদ হোসেন সিদ্দিকী, নকশাকেন্দ্রের শিল্পী সুধীর কুমার দত্ত, আলী মোরশেদ নোটন প্রমুখ শিল্পী।
ঢাকা নিউমার্কেটের পেছনে আর্ট কলেজের শহিদ শাহনেওয়াজ হল (বর্তমানে শাহনেওয়াজ ভবন)। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে আর্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী শাহনেওয়াজ ও কার্টুনিস্ট নজরুল এখানে ছিলেন। ক্র্যাকডাউনের সময় হানাদার পাকিস্তানি আর্মি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ঢুকে নিরিহ নিরস্ত্র শিক্ষক ও ছাত্রদের খুঁজে খুঁজে বের করে নির্মমভাবে হত্যা করে! এখানেও হায়েনারা তাণ্ডব চালায়। ঘটনাস্থলে শাহনেওয়াজ (দিনাজপুরের সন্তান) শহিদ হন ও নজরুল গুলিতে গুরুতর আহত হন। ভোরবেলায় মুমূর্ষু নজরুলকে উদ্ধার করে কোন প্রতিবেশি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান এবং চিকিৎসা পেয়ে সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান!
সে সময় হোস্টেলের একটি কক্ষে আর্ট কলেজের কৃতিশিক্ষক মোহাম্মদ কিবরিয়া স্যার থাকতেন। পাকি আর্মিরা তাঁকেও মারতে যায়, তখন পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত একটি সনদপত্র দেখিয়ে তিনি ছাড়া পান! নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ভোরবেলায় কিবরিয়া স্যার অনতিদূরে সহকর্মীশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর আবাসে যেয়ে আশ্রয় নেন। (তথ্যসূত্রঃ প্রয়াতশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর লেখা ও অধ্যাপক শিল্পী আবদুস সাত্তার)।
শাহনেওয়াজ হলের সামনে |
শাহনেওয়াজ হল এবং আশির ঢাকা
শাহনেওয়াজ হলের তিনতলায় ১৩ নম্বর কক্ষের চারটি বিছানার একটিতে শিশির ভট্টাচার্যের বাস। অসীমের পাশাপাশি এই রুমের মেঝেয় আমার স্থান হলো। নীলক্ষেত থেকে তোষক, চাদর, বালিশ আর মশারি কিনে আনলাম। রাত গভীর হলে মেঝেয় বিছানা পেতে ঘুমাই। আবার সকালের আলো ফুটতে না ফুটতেই বিছানা গুছিয়ে খাটের তলে চালান করে দিতাম! মুখহাত ধুয়ে শিশিরের সংগে হলের সামনে কাদের ভাইয়ের ছাপড়ায় আমরা নাস্তা করে নীলক্ষেত, কলাভবন, মধুরক্যান্টিনের সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে চারুকলায় ঢুকতাম। এমনও হয়েছে- নীলক্ষেতের বিউটি, লাভলি, দেশবন্ধু থেকে শুরু করে আমরা মধুর ক্যান্টিন, চারুকলায় শরিফমিয়ার ক্যান্টিন কিংবা মোল্লার ছাপড়ায় যেয়ে নাস্তা করেছি। আমাদের মধ্যে যাঁরা সামর্থবান, তাঁরা রিকশায় করে যাতায়াত করতেন।
১৯৭৮, ৭৯, ৮০ সালে দেখেছি রাজধানি ঢাকায় কতো আনন্দময় অথচ বাহুল্যবর্জিত আড়ম্বরহীন জীবন যাপন ছিল সবার! পথে ঘাটে যানবাহন চলাচল ছিল খুবই কম! শাহবাগ মোড়ের দক্ষিণপূর্বের অশত্থ ও পাকুড়গাছের সারি! এসবের শেকড়-বাকড়ের স্কেচ করেছি বিনা পেরেশানিতে!নকশাকেন্দ্রের শিল্পী গোলাম সরওয়ার (প্রয়াত)- অশ্বত্থের পাতা ধরে ধরে কালি-কলমে ড্রইং করতেন। তিনি ছিলেন ভারী রসিক মানুষ! তাঁর প্রয়াণের পর নিসার ভাই মর্মস্পর্শী একটি লেখা লিখেছিলেন!
শাহনেওয়াজ হলের ভেতরের রাস্তা। |
বাংলাদেশের চারুশিল্পের গুরু প্রজন্মের শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ তাঁর স্বামীবাগের বাসা থেকে আর্ট কলেজে আসতেন রিকসাযোগে। গুরু প্রজন্মের শিল্পী আনোয়ারুল হককে চারুকলায় রিকসাযোগেই আসতে দেখেছি, কামরুল হাসান অবশ্য গাড়ি করেই মাঝে মধ্যে আসতেন। শিল্পী ও গুণী শিক্ষক মোহাম্মদ কিবরিয়া, আবদুর রাজ্জাক, জুনাবুল ইসলাম, মীর মোস্তফা আলী, কাজী আবদুল বাসেত, শামসুল ইসলাম নিজামী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, গোপেশ মালাকার, হাশেম খান, রফিকুন নবী, মাহমুদুল হক, মাহবুবুল আমিন, শহিদ কবির স্যাররা রিকসায় আসা যাওয়া করতেন। কারুকলা বিভাগের শিক্ষক আবদুল জব্বার ও মরণচাঁদ পাল স্যার সাইকেল চালিয়ে কলেজে আসতেন।
সফিউদ্দিন আহমেদ (২৩ জুন ১৯২২ - ১৯ মে ২০১২) |
আমি যখন চারুকলায় স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়ছি তখন শাহনেওয়াজ হলের হাউস টিউটর ছিলেন শিল্পী আবদুস শাকুর। স্যার এখন মাঝে মাঝে আমাকে সস্নেহে ফোন করে খোঁজ খবর নেন!
শিশির ভট্টাচার্যের সুবাদে ওর সহপাঠী মাসুদুল হাসান, মুর্শিদা আরজু আল্পনা (জার্মান প্রবাসী) ও আতিয়া ইসলাম য়্যানির সংগে আমার বেশ সখ্য হয়! মাসুদ এখন যুক্তরাষ্ট্র বাস করে। জলরংয়ে ভালো হাত ছিল তাঁর। দেদারসে ছবি আঁকতো, ওর ওসব কাজ বিক্রিও হতো! এমন সংগীত ও কবিতাপ্রেমি ভীষণ রোম্যান্টিক ছেলে আমি জীবনে কমই দেখেছি! তখন ভারতীয় বাঙালি কণ্ঠশিল্পী মান্না দের প্রেম ও বিরহের গান তুমুল জনপ্রিয়। মাসুদের ঠোঁটে মান্না দের গান সবসময় লেগে থাকতো!
শাহনেওয়াজ ভবনের নীচতলায় ৫ নম্বর কক্ষে থাকত সে। ১৩ নম্বর থেকে বিতাড়িত হয়ে বন্ধু শিশির ভট্টাচার্য ও অসীম রায় পাশের ৬ নং কক্ষে আশ্রয় নিয়েছিল। এই কক্ষে ছিলেন আমাদের অগ্রজশিল্পী চাঁদপুরের শাহাদাত হুসেন। তিনিও এক কবিতাপ্রেমি শিল্পী। আমার কেনা সুনীল গংগোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতার বইটি তিনি পড়তে নিয়ে আর কাছছাড়া করেন নি! শাহাদাত ভাই পরে চারুকলা ইনস্টিউটের শিক্ষক হয়েছিলেন। অনেক বছর ধরে প্যারিসে বসবাস করছেন। তাঁর সাবেক স্ত্রী বাবলি আপার চিত্রকর্ম ও অন্যান্য কাজের একটা প্রদর্শনী উদ্বোধন করেছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। আমি সেটি নিয়ে প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায় লিখেছিলাম। শাহাদাত ভাই ভালো আঁকেন, প্যারিসে পুরস্কৃত হয়েছেন। ইদানিং মাঝে মাঝে তাঁর সংগে ফোনে কথা হয়।
এই দু'জন ছয় নম্বর অধিবাসীর সামান্য তোতলামির বাতিক ছিল। উত্তেজনার সময় এটির উদ্ভব ঘটতো! এ নিয়ে মজার এক ঘটনা আছে! চারুকলায় টেবিলটেনিস খেলার প্রচলন ছিল। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আমরা টেবিলটেনিস খেলতাম। মাসুদ আর শাহাদাত ভাই একবার টেবিলটেনিস খেলতে যেয়ে কথায় কথায় উত্তেজনায় তোতলামি করতে শুরু করলেন! শাহাদাত ভাই ভাবলেন মাসুদ তাঁকে ব্যাংগ করছে। এটি ভেবে তিনি মহা ফায়ার! মাসুদকে বে বে বেয়াদব টেয়াদব বললে, সেও ক্ষেপে যেয়ে ক্ষোভে-দুঃখে কাঁপছে আর তোতলামি করে বলছে- কে কে বে বে বেয়াদব! এতে শাহাদাত ভাই আরও ক্ষেপে যাচ্ছেন। পরে তাঁকে বোঝানো হলো দু'জনের সমস্যার ধরণ একই !এই ঘটনার পর থেকে শাহাদাত ভাই আর মাসুদের আন্তরিকতা শনৈ শনৈ বাড়তে থাকে।শাহনেওয়াজ হলের তিনতলার কক্ষ থেকে শিশির ভট্টাচার্য ওর স্বভাবসুলভ আওয়াজে প্রধানতঃ ভূপেন হাজারিকার গান গাইতে গাইতে নীচে নামত! আমি আর অসীম ছিলাম ওর সেই যাত্রাকালের সংগী। আমরাও সে গানে সুর মেলানোর চেষ্টা করতাম! ডি এল রায়ের লেখা- ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এ বসুন্ধরা আর রবীন্দ্রনাথের গান- ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায় কিংবা আনন্দলোকে মংগলালোকে ছিল আমাদের কোরাস সংগীতে সবচেয়ে বেশি গীত গান!
সন্ধ্যার পর নিউমার্কেটের মডার্ন স্টেশনারির বিপরীতে খালি জায়গায় হামিদ ভাইয়ের চা দোকানকে ঘিরে আমরা একটি আড্ডা শুরু করি গত শতকের আশির দশকে সম্ভবত জিয়া জমানা অবসানের পর। এখানে অনেকেই এসে এ আড্ডায় যুক্ত হয়েছেন। এখানে বসে চা পানের সংগে কেনাকাটা করতে আসা সুন্দরীদের দেখার আকর্ষণও ছিল !
আর্ট কলেজ হোস্টেলে রাতভর নানারকম কাজ চলতো। পোস্টার, ব্যানার লেখা থেকে দেয়ালে চিকা মারা, প্রতিকৃতি আঁকা, মুদ্রণের জন্য ট্রেসিং কাগজে পোস্টার নকশা, বই-পত্র-পত্রিকার প্রচ্ছদ, ইলাস্ট্রেশন এসব নানা ধরনের কাজে ব্যস্তসময় পার করতেন শিল্পীরা। শিক্ষার্থীশিল্পীরা নিজেদের খরচ চালাতে এসব কাজ করতেন, আমরাও করেছি, এখনকার শিক্ষার্থীশিল্পীরাও করেন।
মজিদ খানের শিক্ষানীতি বিরোধি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পোস্টার, ১৯৮৩। |
আর্ট কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বরাবরই ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ প্রভাব ছিল। ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হিসেবে শিল্পী সুধীর কুমার দত্ত তখন সুপরিচিত। তাঁর উত্তরাধিকারি ছিলেন- পটুয়াখালির কলাপাড়ার দত্ত প্রবীর। শিশির ভট্টাচার্যের সহপাঠী। বন্ধুরা তাঁকে আদর করে দৈত্য বলে ডাকে! চিকা মারা ও পোস্টার লেখায় বেশ পারদর্শী ছিলেন।
পটুয়াখালিতে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনের তিনটি দিন দাদা আমাদের সংগ দিয়েছেন। ওখানে আমি অনুজপ্রতীম শিল্পী আলাউদ্দিনকেও পেয়েছিলাম! প্রসংগক্রমে মনে পড়লো- আমাদের অগ্রজ, বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ডিন জামালপুরের শিল্পী সিদ্ধার্থশংকর তালুকদার ও একই প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ও তাঁর সহপাঠী শিল্পী নেত্রকোণার ঋতেন্দ্র কুমার শর্মার পরস্পরের ডাকাডাকির গল্প। শর্মা দা নীচ থেকে জোরে জোরে ডাকেন - সিদ্ধার্থ অপদার্থ! ওপর থেকে সিদ্ধার্থ দা জবাব দেন- শর্মা অকর্মা!
কেউ কারে নাহি পারে সমানে সমান!
ঝিনাইদহের শৈলকূপার শেখ আফজাল হোসেন বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অংকন ও চিত্রায়ণ বিভাগের সভাপতি, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম সহপাঠী। প্রতিকৃতি অংকনে সিদ্ধহস্ত হওয়ায় তাঁর খ্যাপের অভাব ছিল না। রাতভর তিনি প্লেয়ারে গান শুনতে শুনতে তেলরঙে প্রতিকৃতি আঁকতেন আর ষোল নম্বর কক্ষের অন্য বোর্ডারদের তত্ত্বীয় পড়াশুনা ও ঘুমের বারোটা বাজাতেন! বিশেষ করে গভীররাতে ক্যাসেটবন্দি কৌতুক শুনতে শুনতে দমফাটানো হো হো হাসিতে ঘুমন্তদের মধ্যে ভূমিকম্পের অনুভূতির কথা ভুলবার নয়!
সহপাঠিদের সাথে |
সে সময় নৌডাকাতি বেড়ে যাওয়ায় লঞ্চে যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য আনসার মোতায়েন করা হতো। বরিশাল থেকে ঢাকায় আসার পথে মনি দা লক্ষ্য করলেন তিনজন আনসার সদস্য তাদের অস্ত্রশস্ত্র একজন আনসারের কাছে জমা রেখে চা খেতে গেল। দীর্ঘক্ষণ তাদের ফিরতে না দেখে অপেক্ষাকারী আনসার সদস্য একসময় অস্থির হয়ে পায়চারি শুরু করলো। আরও বেশ কিছুক্ষণ পর হাস্যরস করতে করতে ওই তিনজন ফিরতেই অপেক্ষাকারী উত্তেজিত স্বরে বলে ওঠলো- তোরা মোরে এরলারে এরলারে ফালাইয়া গেছস, চাহু টাহু দেহাইয়া যদি এই মালগুলি লইয়া যাইতো, তহন মুই কী হরতাম!
আফজাল ভাই এই গল্প শুনে হেসে গড়িয়ে পড়েন। এবং সাগ্রহে মনি দা'র কণ্ঠে সেই ঘটনার বিবরণ ক্যাসেটবন্দি করলেন! এই পর্যন্ত উপভোগ্য। ওই কক্ষে যেই আসেন ক্যাসেট ছেড়ে তাকেই মনিদা'র ওই গালগল্প শোনান। শেখ আফজাল অন্যদের শোনাতে অক্লান্ত, আর আমরা ওই এক গল্প শুনতে শুনতে বিভ্রান্ত! কারণ,আমি আর দিনাজপুরের নিরিহদর্শন সিংহ অর্থাৎ হিমাংশু কুমার সিংহ রায় তখন ওই কক্ষেই থাকতাম!এরকম অসংখ্য মজার ঘটনা ঘটেছে আমাদের ছাত্রত্বকালে ও হলজীবনে!
সন্ত্রস্থ ছাত্রাবাস
বিয়োগান্তক ও কিছু রূঢ় ঘটনাও ঘটেছে সে সময়ে। হিমাংশুর কথাই বলি। চারুকলায় ১৯৮০ সালের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পর পরাজিতদের প্ররোচনায় চারুকলার কয়েকজন ছাত্রের নেতৃত্বে বহিরাগত সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা শাহনেওয়াজ হলে ঢুকে আবাসিক ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়। দুর্বৃত্তরা ১২ নম্বর রুমে যেয়ে ছাত্র সংসদের সহ সাধারণ সম্পাদক হাবিব ভাই, আজিজ ভাই ও সিঁড়িতে পেয়ে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হিমাংশুসহ কয়েকজন ন্যাক্কারজনকভাবে পিটিয়ে আহত করে! ওরা রুমে রুমে যেয়ে বিছানায় বাড়ি মেরে মেরে খোঁজ করছিল নোটন, ওয়াকিল, শিশির, জাহিদদের! দরজার আড়ালে লুকিয়ে বেঁচে যায় আমার সহপাঠী অশোক কর্মকার!
যদ্দূর মনে পড়ে শিশিরসহ আমরা কয়েকজন অগ্রজশিল্পী এখন প্যারিসে বসবাসকারী শাহাদাত হুসেনের ছয়নম্বর কক্ষে অবস্থান করায় ওদের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম। শাহাদাত ভাইয়ের হুংকারে দুর্বৃত্তরা আর এগোয়নি। চারুকলার যে কোন সমস্যা-সংকট সমাধানে তিনি কাণ্ডারির ভূমিকা নিতেন। শাহাদাত ভাই ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শিল্প-সংস্কৃতির নিষ্ঠাবান প্রেমিক।
সেদিনের সেই অপরাধের পর চারুকলার লিচুতলায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছিল। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ও অধ্যক্ষ শিল্পী আমিনুল ইসলাম মর্মস্পর্শী বক্তব্য রাখেন, আহত শিক্ষার্থী হাবিব ভাই ঘটনার বর্ণনা দেন। এসব শুনে শিক্ষার্থীদের অনেকেই সেদিন অশ্রু সংবরণ করতে পারেন নি।
দুঃখজনক হলেও সত্য- ওই সন্ত্রাসী অপকর্মের কোন বিচার হয়নি! ফলে দুর্বৃত্তরা আরও সোৎসাহে তাদের অপকর্ম চালিয়ে গেছে! দুঃখজনক হলেও সত্য- ঘটনার সংগে জড়িত কেউ কেউ পরবর্তীতে নানাভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন!
সামরিক শাসনের বাতাবরণে
১৯৮১ সালের মার্চে ঢাকায় আয়োজিত প্রথম এশীয় দ্বি-বার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন সেনাশাসক জিয়াউর রহমান। আর্ট কলেজের জয়নুল গ্যালারিতে ওই প্রদর্শনীর কিছু শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হওয়ায় তিনি সেগুলো পরিদর্শনে চারুকলায় আসেন। শিল্পী শাহাদাত হোসেন সাহসের সংগে তাঁর গতিরোধ করে চারুকলার নানা সমস্যার কথা তুলে ধরলে এর সমাধানহেতু পাঁচ লক্ষ টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দেন। এই টাকা দিয়ে চারুকলার বকুলতলার মঞ্চ বাঁধানোসহ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ এবং ছাত্রদের আবাসন সমস্যা সমাধানকল্পে শাহনেওয়াজ হলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তিনকক্ষবিশিষ্ট টিনশেড নির্মাণ করা হয়।
এই দাবি বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের নিমিত্তে আমরা ঘটিবাটি বাক্সপ্যাটরা নিয়ে চারুকলায় অবস্থান নিই। প্রতীকী এই আন্দোলন ছিল ন্যায্যদাবি আদায়ে প্রশংসিত দৃষ্টান্তমূলক এক অনন্য নজির!
আমাদের সুরসিক সহপাঠী কুষ্টিয়ার আলতাফ হোসেন শরীফ (২০২০ সালের এপ্রিলে প্রয়াত) লাঠিতে বদনা বেঁধে কাঁধে নিয়ে শাহনেওয়াজ ভবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দিয়ে চারুকলা পর্যন্ত যাত্রাপথে কৌতুককর অথচ এক কৌতুহলদ্দীপক পরিস্থিতি তৈরি হয়!
১৯৭৯ - ৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতিতে অস্ত্র, অর্থ আর ক্ষমতার দাপট দেখা দেয় ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায়। এর চিত্রনাট্য রচিত হয় ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে। সে সময় সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে সেনাশাসনবিরোধী সচেতন শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে ফিরে যান। আমি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি সে দৃশ্য!
অসংখ্য শিক্ষার্থী টিএসসির সামনের রাস্তায় বর্তমানে রাজু স্মৃতি ভাস্কর্যের স্থানে শুয়ে পড়েন। জেনারেল জিয়া তখন পিছু হটলেও পরের বছর দেশের চার শিক্ষাবোর্ডের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ ব্যয় করে তিনি হিজবুলবহর নামে নতুন এক জাহাজে দিনব্যাপি নৌভ্রমণ করেন আর তাঁদের মধ্যে নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শ তুলে ধরেন। এরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভি-নীরু-বাবলুদের উত্থান ঘটে।
লেখক সর্বডানে।মাঝখানে বাম থেকে চতুর্থ ইস্তেকবাল হোসেন, বাম থেকে তৃতিয় মোহন রায়হান, চতুর্থ ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়, পঞ্চম সাগর লোহানি। |
পাঁচ সহপাঠির কবিতা, ২০২০এ প্রকাশিত |
সাবদার সিদ্দিকী, বুলবুল ললিতকলার সিড়িতে* |
মুহম্মদ খসরু* |