ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Saturday, June 5, 2021

শে : কাজল শাহনেওয়াজের প্রথম উপন্যাস

।।চয়ন খায়রুল হাবিব।।নাসরিন-জয়া হক।।তৃণা রাব্বানি।।কনক রহমান।। 

'শে' উপন্যাসের টোল এবং দিঘলী গ্রামের উপকথা

কাজল শাহনেওয়াজ অনেক বছর ধরে উপন্যাস লিখতে চাইছিলেন।অতিমারির ফুরসুতে লিখে ফেললেন, অতিমারির বই মেলাতে প্রকাশ করলেন।নিশ্চয়ই খুশি।

আশেপাশের অনেকে অনেক বছর ধরে , না কি কাজল নিজে অনেক বছর ধরে উপন্যাস লিখতে চাচ্ছিলেন, তাও কোটি টাকার প্রশ্ন।সঠিক উত্তর দিলে কোটি টাকা দিয়ে দিতে হবে, সে দায় থেকে বাচতেই হয়তো এটা ট্রেজার আইল্যান্ডের রহস্য ঘেরা প্রশ্ন হয়েই থেকে যাবে। কাজলকে একবার বলেছিলাম, আমাদের চেখভ নাই, চেখভেরা উপন্যাস লিখতে ক্ষেপে গেলে, ছোটো গল্পের অনেকগুলো প্লট একটা উপন্যাসের সার্কেলে এসে পড়তে পারে।কাজল যে এ-ব্যাপারে সচেতন ছিলেন, তা বলে দিতে পারি না পড়ে। কাজলের প্রথম গল্প প্রথম কবিতার প্রকাশক হিশেবে, চেখভজনিত প্রশ্নটি আমার অধিকারের আওতাতেই পড়ে।

                                          'প্রথম কবিতা' পাঠ, লন্ডন ওয়াটারলু স্টেশান

শে
 প্রকাশনাটি একটা ধারাবাহিক পাঠক পাবার কথা।তারা কাজলের ভঙ্গি, বিষয় পছন্দ করে।।তারা কি একই জিনিস ঘুরে ফিরে পায়, না কি নিজেদের চলিষ্ণুতার আশেপাশের যে চোখা ঘাতগুলো বুঝতে পারে নাই, তা দেখতে পায়?জনরাগত সময়ের গ্যাপও আছে।এটা বলতে বোঝাচ্ছি, কাজল কবিতা, গল্প এবং বর্তমান শে কান্ড পরিচয়ে কবি, গল্পকার, উপন্যাসিক, কিন্তু বডি অফ ওয়ার্কের দিক থেকে বিরলপ্রজ।আবার আমাদের আগে, পরের দিক থেকে শুধুমাত্র সাক্ষাতকারের সংখ্যা দিয়ে ওনার বড় বই বেরিয়েছে।পরের প্রজন্মে বেশ কিছু মিনিয়েচার কাজলকে সাহিত্য সার্কিটগুলোতে ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়।এদের অনেকেই বিভিন্ন লেখাকে চালিয়াতি মার্কা দুই তিন লাইনে 'নিটোল' কাহিনী, 'নিটোল বর্ণনা' বলে সাহিত্যের কাতারে সামিল হতে চায়।আমি ঘোরতর ভাবে নিটোলতা বিরোধী পাঠক, লেখাতেও আমি টোল বা ফ্ল এর চর্চা করি।সেদিক থেকে তৌহিদুল ইসলামের রিভিউটিকে সাব্জেক্টিভ ও অবজেক্টিভ মনে হলো।এখানে আমি একজন পাঠক তৌহিদুল ইসলামের রিভিউর শেষাংশ পুনশ্চসহ তুলে দিচ্ছি,
''উপন্যাসের পুরো বর্ণনাই পুরুষ চরিত্রটির অতি সাবজেক্টিভ বয়ানে উঠে আসা। আর ওই নারী চরিত্র “শে” তারই ফ্যান্টাসমাটিক নির্মাণ। যে ফ্যান্টাসিই আবার হয়তো তার অভিজ্ঞতার জগতকে আকার দেয়। অতীত স্মৃতিকে পুনর্নির্মাণ করে। একই ঘটনা বার বার ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়। সময়ের পরিক্রমা সরলতা হারায়। ভবিষ্যৎ বর্তমান হয়ে অতীতে ফিরে গিয়ে অভিজ্ঞতাগুলিকে নতুন করে বিন্যস্ত করে। আর আমরা তো জানিই, সত্য আগে থাকতেই হাজির থাকে না। প্রতিনিয়তই তাহা নির্মীয়মাণ!
পুনশ্চ:
১. উপন্যাসের উৎসর্গপত্রে লেখা: বাংলা ভাষায় স্ত্রী-বাচক সর্বনাম নাই, তাই আমি নারী "সে" কে পাল্টে করেছি "শে"
২. জানা ছিল না, লেখক পরিচিতিতে পাওয়া গেল- কাজল শাহনেওয়াজ এবং আমার জন্ম একই গ্রামে। বিক্রমপুরের লৌহজং থানার দিঘলী। যে গ্রাম এখন পদ্মাগর্ভে বিলীন।''
পাঠক তৌহিদুল ইসলাম আমার কাছে গুরত্বপূর্ন, তার সাথে একমত বা দ্বিমত যাই হই, তার কোরক বাংলা ভাষাতে যে ভাবেই সাধু, চলতির মিশেল থাকুক।কারণ এই রিভিউকারের সাথে ডিস্কোর্স করা যায় যায়।যেভাবে আমি মুস্তফা আনোয়ারকে নিয়ে ডিস্কোর্স করতে পেরেছি তার রিভিউকার আবু রুশদের সাথে, যেভাবে আমি ডিস্কোর্স করতে পেরেছি সাবদার সিদ্দিকীর মৃত্যু পরবর্তী সমগ্রের সম্পাদক আব্দুল মান্নান সৈয়দের সাথে। এটা ঠিক আগরতলা, চকির তলার ব্যাপার নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক বা এপ্টিচ্যুডগত তুলনার জন্যও নয়।আবু রুশদ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ মহাজন মানুষ, কিন্তু শুধু মহাজনে নির্ভর করে আজকের গুড রিডস বা রটেন টমাটো চলবে না।
কাজল শাহনেওয়াজ,
কুষ্টিয়া, ২০১০
কাজল শাহনেওয়াজ যেভাবে সামাজিক নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে থাকেন, তাতে আমাদের ব্যক্তিক অনুভূতির অন্তর্মুখীনতার সাথে বৈশ্বিক বহসচলতার দ্বন্দ্ব কিছুটা উঠে আসে।কাজলকে ব্যাক্তিকভাবে জানি ভেতরগোজা আবার হুল্লোড়বাজ মানুষ, সব বিষয়ে শেষ কথা বলতে ভালবাসেন, যে কোনো সভাতে প্রিয় সভাপতি হয়ে উঠবেন।একই কাজল খুবই আন-অর্থোডক্স বা প্রথাশাষনের বাইরে থাকেন।আবার বড় সংসারের বড় ছেলে, দীর্ঘ দাম্পত্য, মেয়ের বড় হওয়া, প্রতিষ্ঠিত হওয়া সবার সাথে ভাগ করে নেন।এসবের ফাকে একজন কাজল লেখেন।লেখক কাজল লেখার ফাঁক পেতেই হয়তো দম্পতি কাজল, বাবা কাজলকে ফলাও করেন।
ছোটো বড় সব লেখকেরই এখানে ব্রাজিলের নাট্যকার আগুস্তো বোয়ালের অবস্থা।রিয়োর ফাভেলাতে নাটক নির্দেশনা দিতে গিয়ে বোয়াল বুঝতে পারে যে তার বন্ধু যেসব অভিনেতা, অভিনেত্রী তারই আবাসিক এলাকা থেকে ফাভেলাতে অভিনয় করতে এসেছে, তাদের পক্ষে ফাভেলাবাসীর আবেগ ছোঁয়া সম্ভব নয়।তখন বোয়াল ফাভেলাবাসীকে তাদের জীবন যাতে তারা অভিনয় করে তাতে ব্রতি হয়।বোয়ালের গলতি এটুকুই, এটা বোঝার পরেও বিপুল শিক্ষাভিত্তিক NGO গঠন করেন ফাভেলাতে কেন্দ্র করে, অর্থাৎ যাদের আবেগকে অভিনয়ে আনতে চেয়েছিলেন, তাদের আবেগকেই বশ করবার প্রক্রিয়াতে চলে যান।

এখানে কিশোরগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে ঢাকাতে দীর্ঘ সময় বসবাসকারী কাজলকে ঠিক করে নিতে হয়েছে তার প্রটাগনিস্ট, এন্টাগনিস্ট কাকে প্রতিনিধিত্ব করবে।তবে তুলনামূলকভাবে যার এন্টাগনিস্ট হবার কথা কাজলের কমবেশি সব বয়ানেই তারা প্যাসিভ।তাদের মেয়ে হারিয়ে গেলেও তারা প্যাসিভ, মুক্তিপণ চাওয়া কিডনাপার হলেও তারা প্যাসিভ, এগ্রেশান বা হুমকির যায়গাটা এখানে প্যাসিভ, অর্থাৎ প্যাসিভ এগ্রেশান, যা প্রকারান্তরে গল্পে, ক্যানভাসে, সেলুলয়েডে বোতলবন্দী অবসাদ তৈরি করে।আগুস্তো বোয়াল যা ফাভেলাতে এসে আবিষ্কার করে, চেখভ যা ১০ নং ওয়ার্ডে আবিষ্কার করে, কাজল তার যাবতীয় গদ্যে সেখানেই ঘুরেফিরে আসে।এটাকে সামগ্রিক অর্থে বলা যায় Internalization of feelings versus externalization of feelings. অনুভূতির নান্দনিক অভিব্যক্তিগুলোতে অন্তর্মুখিতা আগে ঘটে, তার পর তার সামাজিক প্রতিক্রিয়া শুরু হয় না কি ভাইস ভার্সা, তার জরিপ হতে পারে।

রাশিয়াতে চেখভ, স্টানিস্লাভস্কিরা ঠিক বিপ্লবী ছিলেন না, তাদের দর্শক, পাঠক ছিলো মূলত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত।সেই মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে যখন বিপ্লব হলো, তখন সেই বিপ্লবের আপামর ইতিহাস ধারাবাহিক এক অন্তর্মুখীনতার গুমোট আবহ তৈরি করে।মধ্যবিত্তকে আত্মঘাতি অপরাধবোধের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।কাজলের সামগ্রিকতায় প্রভাবিত অনেকে কবিতা, গদ্যে এই অন্তর্মুখীনতায় ভুগলেও কাজলের কবিতা এই লক্ষণ থেকে মুক্ত।আবার তার এবং তার আশেপাশের কবিতার, গদ্যের বয়ান ক্রমশ ছোট হয়ে আসাটাও ভাষার সামগ্রিক ৯ঋকাল গুণবাচকতার জন্য আশঙ্কাজনক।ছোট হয়ে আসাটাও বলে অনেকগুলো ভাঙ্গা ৯ঋক যোগ করে একটা বয়ান দাঁড়াচ্ছে।এখন এই বয়ানের দিক থেকে কাজল একজন পুরুষকে বেছে নেন, সেখান থেকে 'অতি সাবজেক্টিভ' না কি কম সাবজেক্টিভে বয়ানে আসেন, তা সেই অতি বা কমের মাত্রা যে বলছে সেই পাঠকের সাংস্কৃতিক পটভূমির ওপর নির্ভর করে।আমি অতি বা কম না খুঁজে যা খুঁজি তা হচ্ছে যে টোল বা flaw বা ত্রুটি, সেই টোলটাই আমার কাছে ভালো সাহিত্যর লক্ষণ।

কাজল তার উপন্যাসের নাম রেখেছে শে, তা যে স্ত্রী বাচক সর্বনাম, তাও উৎসর্গপত্রে লিখেছে।কাজল তার প্রথম গল্প প্রথম কবিতা প্রকাশ করে ১৯৮৫সালে।সেখানে চরিত্রদের নাম ছিলো কান্তি, সুমনা, ফয়সাল এবং তারা বার বার সরাসরি নামেই উপস্থাপিত, বিমূর্ত উপস্থাপনায়ও তাদের লৈঙ্গিকতা স্পষ্ট।এর পর ক্রমশ কাজলের লেখার পরিধি ছোট বড় যাই হোক, সর্বনামের প্রয়োজন যে সব ক্ষেত্রে বেড়ে গিয়েছে তা বলা যাবে না।কাছিমগালা বাদে বাসেত হিরনচিবাবা নুরদীন, আবুল সুন্দর শিরোনাম সরাসরি পুরুষবাচকতা ধারণ করে, তার অনেক গল্পের শুরুতেই সামাজিক বিভিন্ন অবস্থানে কেন্দ্রীয় পুরুষের রূপকল্প নির্ণীত ও মীমাংসিত।কিন্তু স্ত্রী বাচকতাকে সর্বনামে আনার প্রয়োজন হলো কেনো?এখানে কাজলের নভিস পাঠকও বুঝবে যে এই শে ফ্যান্টাসি নির্ভর সর্বনাম, এতে নারী চরিত্রের বিশেষ কোনো বাস্তবতা বা সীমানা বা সামাজিক শর্ত উঠে আসছে না।কষ্টকল্পনায় না যেয়েও এই ফ্যান্টাসি নির্ভর শে কে রবীন্দ্রনাথের, শরৎচন্দ্রের নায়িকাদের এন্টিথিসিস কিছুটা বলা যেতে পারে।আমাদের সব জনপ্রিয় পুরুষ লেখকই তাদের নায়িকাদের বাস্তবতার পরিধি, সীমানা, যথাসাধ্য দ্বন্দ্ব তুলে ধরেছে।যারা যাদু বাস্তবতার দুঁদে লেখক তাদের নায়িকা, খলনায়িকারাও লৈঙ্গিক জায়গাতে স্পষ্ট।এখানে শিরোনামে এসেও নারী প্রটাগনিস্ট না, শক্তিদায়িনী।কি রকম জানি খটকা লাগে।শে কি তাহলে কেবলই পটে আঁকা ছবি, কেবলই কস্মেটিক্স?

মানে বিমূর্ততা, যে যেভাবে বুঝে নিতে চায় তার স্কোপ রেখে দেয়া।সেই মিনিমালিজম।যেই মিনিমালিস্ট বিমূর্ততা আসলে গল্পের উপাদান, যা উপন্যাসে জনরা হিশেবে ভেঙ্গে দেয়া হয়।মেটামরফোসিসও বিমূর্ত থাকে না।কাজলের গল্পগুলোতেও লৈঙ্গিক, বিশেষ করে মেয়েদের জায়গাটা কল্পনা নির্ভর বা সফট।তাদের চারপাশে সব রাফ কিছু ঘটছে, কিন্তু তাতে তারা অংশ নিচ্ছে স্বপ্নের বা দুঃস্বপ্নের মতো, একটা দেবী পর্যায়ে উপনীত।পুরুষ পেঁপে গাছ বুঝতে পারলেও, দীর্ঘ দাম্পত্যে থাকলেও, মেয়ে বড় করলেও এই জায়গাটাতে কাজল একজন মেথড অভিনেতা থাকতে চাইছে, এক্টে প্রবেশ করে যে এক্টটা দিনের পর দিন ধরে রাখে।ইমিডিয়েট বিপরীত লিঙ্গকে ফ্যান্টাসিতে রাখার সুবিধা, তাতে কোনো তর্কে যেতে হয় না, যারা একবার ভঙ্গি পছন্দ করেছে, তারা ভঙ্গিটার ভেতরেই বুদ হয়ে থাকে।যারা ভঙ্গিটার সাথে পরিচিত না, তারা একটা নূতন ঝাজ পায়, নিজের যেসব ধোঁয়াশা, ফ্যান্টাসি, বিমূর্ততা আছে সেটার একটা সান্ত্বনা পায়।মিনিমালিস্ট ভঙ্গি বা স্টাইলাইজেশানের ক্ষেত্রে কাজল যে এখন মাস্টার তা এখন অনস্বীকার্য।কিন্তু সে-ভঙ্গিটা বিষয়ের, চরিত্রের যে ফিগারেটিভ ভেতর ও বাইরের ত্রিমাত্রিকতা তাকে বিমূর্ততা থেকে বের করে আনতে পারছে কি না শত যাদু, পরাবাস্তবতা, অধিবাস্তবতা, অলৌকিকতার পর তার একটা বিবেচনা আমাদের থাকে।আবার পাঠকের, তাকে খেলানো এস্টাবলিশমেন্টেরও কিছু বিবেচনা থাকে।

দিঘলী বাজারের স্কেচ, পদ্মায় ডুবে যাবার আগে
এবার দিঘলী নিয়ে পড়া যাক।কাজলের জন্মস্থানে যেতে যে স্কুবা ডাইভ দিতে হবে তা জানতাম না।কাজলের বাড়ি কিশোরগঞ্জে তাই জানতাম।আমার কাছে যে কাঠ কয়লায় আঁকা তোমাকে আমার/কবিতা সংগ্রহ/২০০৯, গতকাল লাল/গল্পসংগ্রহ/২০০৭আছে, তাতে কেবল জন্মসাল, ১৯৬১ দেয়া আছে, জন্মস্থান নাই।এত দিনে কাজল জন্মস্থান জানান দিলো।জন্ম তারিখ, স্থান নিয়ে আমাদের সবার বিড়ম্বনা আছে।আমার যমজ বোন থাকা সত্ত্বেও প্রথম প্রবাসে আসার সময় পাসপোর্ট ফর্মে আমার বাবা স্থায়ী গ্রামের নিবাস কুমিল্লার ঠিকানা বসিয়ে দিয়েছিল জন্মের ঠিকানার জায়গাতে, তাড়াহুড়াতে তা নিয়েই পাসপোর্ট নিয়েছিলাম, তাই আজ তক বহন করে যাচ্ছি, অথচ আমার ও যমজ বোনের জন্ম ঢাকাতে।কাজলদের কিশোরগঞ্জে গেছি রিফাত চৌধুরী, আহমেদ মুজিব সহ। নীরদ চন্দ্র চৌধুরী, জয়নুল আবেদিনের, আবিদ আজাদের কিশোরগঞ্জকে চিনি।চন্দ্রাবতী কিশোরগঞ্জের সুবিখ্যাত শে।দিঘলী নিয়ে আমাদের তরঙ্গে শিল্পী কামাল আহমেদের চমৎকার একটি স্কেচ ও দীর্ঘ কাব্যিক বয়ান আছে।দিঘলী বাজার স্থায়ীভাবে ডুবে যাবার আগে কামাল পদ্মাতীরবর্তি বাজারটিকে ওর স্কেচে ধরে রাখে।ডুবে যাওয়া আটলান্টিসের উভচর লেখকের নোনায় ধরা হাত থেকে মাছকুমারী শে'র সাথে পাঠকের অন্তরঙ্গতা কামনায়, নিবেদক ইতি!

চয়ন খায়রুল হাবিব
১৬/০৫/২১
                                          'কাছিম গালা' পাঠ, অপু চৌধুরী, ম্যানচেস্টার

শে ও ফ্যান্টাসি!
''ফ্যান্টাসি নির্ভর শে কে রবীন্দ্রনাথের, শরৎচন্দ্রের নায়িকাদের এন্টিথিসিস কিছুটা বলা যেতে পারে।''......''শিরোনামে এসেও নারী প্রটাগনিস্ট না, শক্তিদায়িনী।কি রকম জানি খটকা লাগে।শে কি তাহলে কেবলই পটে আঁকা ছবি, কেবলই কস্মেটিক্স?মানে বিমূর্ততা, যে যেভাবে বুঝে নিতে চায় তার স্কোপ রেখে দেয়া।সেই মিনিমালিজম।''....এন্টিথিসিস মেনে নিলেও এই ভঙ্গি কিন্তু মিনিমালিস্ট রিগ্রেশান।আমার তাই মনে হয়েছে, খটকা ছাড়া।

''রাশিয়াতে চেখভ, স্টানিস্লাভস্কিরা ঠিক বিপ্লবী ছিলেন না, তাদের দর্শক, পাঠক ছিলো মূলত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত।সেই মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে যখন বিপ্লব হলো, তখন সেই বিপ্লবের আপামর ইতিহাস ধারাবাহিক এক অন্তর্মুখীনতার গুমোট আবহ তৈরি করে।মধ্যবিত্তকে আত্মঘাতি অপরাধবোধের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।''.....গনতন্ত্রকে বিপ্লবের শ্ত্রু বলে, আর টেররকে বিপ্লবের চলক বলে এরা আসলে ফেরার পথ বন্ধ করে দিয়েছিল।ফলশ্রুতিতে একের পর এক ব্যাক্তি বিনাশি দমন নিতিতে যেতে হয়েছে।ডগমাটিক শক্তি কোনো না কোনো ভাবে এদিকে চলে যায়, মধ্যবিত্ত হয় আপোষ করে, একে অন্যের শত্রু হয়ে দাড়ায়।বোয়ালের থিয়েটার প্রকল্পে কিছুদিন জড়িত ছিলাম, NGO আর চরমপন্থী রাজনীতি মেশানো এক সার্কাস, ইন্টারপ্রিটেশানের কাছে টেক্সটের আর কোনো গুরুত্ব থাকে না।মিনিমালিজমের পাঁশে অনুভূতির অন্তর্মুখিনতা এনে ভালো করেছেন।আমার কাছে থার্ড ওয়ার্ল্ড লিটারেচার আর বুদ্ধিজীবিদের সেমিনারগুলোতে এটা বার বার মনে হয়েছে।কর্মজীবি শ্রেনি রিসোর্স এত কম থাকার পরও অনেক সময় যে ভিক্টিমহুডে ভুগছে না, উত্তরন বা মোবাইলিটির অনেক পথ পাবার পরও মধ্যবিত্ত ভিক্টিমহুডে বা অপরাধবোধে ভুগছে।সেখান থেকে ওয়ার্কিং ক্লাসের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মৌলবাদি চাপ তৈরি করছে।একটা সাইকেলের মতো।ব্যাঙ্কিং সেকটরে কোনো এক কারণে এটা বেশি দেখেছি।.........টোল বা ফ্ল ধারনাটি সবচেয়ে ভালো লেগেছে।

তৃণা রাব্বানি
১৭/০৫/২১

কাজল শাহনেওয়াজ, চয়ন খায়রুল হাবিব
বই মেলা, ঢাকা, ২০০৭।
শে ও ক্ষুধিত পাষান
চয়নের লেখাটা অনেক দিকে আলোকপাত করেছে।'রবীন্দ্রনাথের এন্টিথিসিসে' চোখ আটকালো।রবীন্দ্রনাথ এতো ধরনের কাজ করেছে যে ঢালাও এন্টিথিসিস হওয়া প্রায় অসম্ভব।'শে' সর্বনামের যে ব্যাখ্যা, আর উপন্যাসটির যে সারবত্তা উঠে এসেছে, তাতে 'ক্ষুধিত পাষানে'র কথা মনে পড়ছে।সেখানেও ন্যারেটর পুরুষ, মেহের আলী পাগল আর অদেখা, অধরা, অতৃপ্ত নারীদের আত্মা।তবে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আপনাদের উৎসাহ আমাকে আরো রবীন্দ্রনাথ পড়ায়।

মুস্তফা আনোয়ার আলোচনার শিরোনাম কাজল শাহনেওয়াজ রেখেছিলেন, 'কালো রবীন্দ্রনাথ',তাও দ্রষ্টব্য।মিনিমালিজমের জায়গাটা নিয়ে একটু বলতে চাই।কাজল এই 'শে' কাজটুকু করলেন পরিনত বয়সে।অবস্য উত্তির্ন কাজের বেলা বয়স প্রাসঙ্গিক নয়।অনেক সময় অভিজ্ঞতার পাকা সময়ে কৌশল বা ভঙ্গি প্রধান হয়ে যায়, সেখান থেকে মিনিমালিজম একটা দরকারি টুলস হতে পারে, কিন্তু তা দরকারি ব্যাপ্তিকে বাধাগ্রস্থ করতে পারে।কাজলের সমসাময়িক পারভেজ হোসেন একই সময়ে এসে ইদ সংখ্যাতে 'প্রথম উপন্যাস' প্রকাশ করলেন।ওনারা দুজন সাহিত্য বাসরে আছেন অনেক দিন, ওনাদের ঘিরে উতসাহ স্বাভাবিক, তার দাবিদারও ওনারা।কিন্তু অনেক বছর ধরে বাংলাদেশে নভেলাকে, কখনো বড় গল্পকে বলা হচ্ছে উপন্যাস।জন্রে সঙ্কোচনের এই একটা বিপদ থেকে যাচ্ছে।

কেউ যদি মনে করেন যে ফারহিন চৌধুরীদের উপন্যাস লিখতে অনেক বছর অপেক্ষা করা দরকার, তাহলে ঝানু কৌশলের কাছে কাচা আবেগের পথ বন্ধ হয়ে যাবে।আবার বাবলী হকের নভেলাগুলো আসছে পরিনত বয়সের অভিজ্ঞতার আলোকে।কজল শাহনেওয়াজ তার ট্রেড সিক্রেট সেই কাচা আবেগের পথ মেরে ফেলে এই উপন্যাস খেলাতে ব্রতি হলেন কি না তা বিবেচ্য।সব কিছু ছাড়িয়ে লেখকেরা অন্য লেখকদের কাজ নিয়ে আলোচনা করা দরকার।এখানে বাংলা লেখালেখির কাঠামো, পরিবেশনা, প্রকাশনায় Internalization of feelings এর দিকে ইঙ্গিত দেয়াটা যথার্থ।অনেক ধন্যবাদ।

নাসরিন-জয়া হক
১৮/০৫/২১

শে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
তৃণা রাব্বানি, যেভাবে লিখেছেন, অর্থাৎ শে সর্বনামকে ফ্যান্টাসিতে রাখার অর্থকে রিগ্রেশান হিশেবে নিলে, যেসব ঐতিহাসিক জেন্ডারগত শর্ত থেকে এই প্রতিক্রিয়াতে তৃণা আসছেন, তার কোনো উপকার হবে বলে আমি মনে করি না।এটাকে ফ্রেশ ফেনোমেননের জায়গা থেকে দেখা যেতে পারে।নতুন সর্বনাম অন্তত একজন বা কয়েকজন ব্যাবহার করছে, সুতরাং এই ব্যাবহারকারীরা জেন্ডারগত নুতন বিন্যাসের অপেক্ষা করছে।চয়ন খায়রুল বলেছে, 'খটকা আছে'।রিগ্রেশানও বলছে না, নেতিবাচকতাও যোগ করছে না, বরং বিন্যাসটার জায়গা বা স্পেস রাখছে।এটা AI বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের অপেক্ষমান স্পর্শকাতরতার জায়গা থেকে দেখা যেতে পারে।চয়ন খায়রুল যেখান থেকে আবহমান জুলেখার উলটো বয়ান তৈরি করে সেখান থেকে দেখা যেতে পারে।একই সময়খন্ডে কিছু সাহিত্য পারস্পরিক হতে পারে।শেলি, কিটস, মেরি শেলির মিথস্ক্রিয়াতে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বিজ্ঞানি হিশেবে একটা নুতন মানব তৈরি করেছিল।বাংলাদেশে আশির কয়েকজন কবি কয়েকটা জন্রেতে এখনো সক্রিয়, এরা য্যানো একটা গবেষনাগারে কাজ করছে।চয়ন যাদের মিনিয়েচার কাজল বলছে, তারাও এই নুতন বিন্যাসের জায়গাটি ধরতে চাচ্ছে, পরের অনেকেই চাবে।

কিন্তু এটা শুধু বিন্যাস, বা ভঙ্গি, বা কৌশল নয়, যেভাবে নাসরিন-জয়া হক নিয়েছে।নাসরিন- জয়া বলছে ভঙ্গিটার প্রয়োজনে মিনিমালিজম টুলস হিশেবে এসেছে।আমার ধারনাতে, বেশ কিছু হিশাব বা অঙ্ক থেকে যে এই লেখাগুলো ঘটছে।কাজল শাহনেওয়াজ আনুষাঙ্গিক রেফারেন্স টেক্সট তৈরি না করাতে এগুলো হুট করে ধরা যাবে না।আমরা রেজাল্ট দেখতে পাচ্ছি, প্রক্রিয়া নয়।আবার চয়ন একটা বিবর্তনগত পরিক্রমা দিচ্ছে কান্তি, সুমনা পার হয়ে নারী সর্বনামে আসা।সামগ্রিক সর্বনাম দিলে চেহারা বিমুর্ত হয়ে যাচ্ছে, তা নয়, বরং নুতন চেহারা বা অবয়বের একটা তাগিদ এখানে থাকছে।শে সর্বনাম, জুলেখা উল্টো বয়ান মিলে স্পর্শকাতরতার একটা পারস্পরিক দিগন্ত রেখা উন্মোচিত হচ্ছে।এখান থেকে লৈঙ্গিক আচরনের অনেকগুলো নন বাইনারি সম্ভচাবনা উন্মোচিত হলো।প্রাথমিক বিমুর্ত কাজ আর জ্যাকসন পলকের গতিশীল রং এর খেলার পার্থক্য যেরকম।এখন এই পাঠকেরা পারস্পরিক হবে কি না, তাও একটি প্রশ্ন।চয়ন খায়রুল যে খোড়াখোড়িটা করলেন, তার ব্যাটন আশা করি কেউ নেবে।

কনক রহমান
১৮/০৫/২১

Photos :

1)Kajal Shaahnewaz portrait by Patricia Guedas
2) Kajal Shaahnewaz and Choyon Khairul Habib 
by Tariq Al Banna
3) Skecth of Dighly Bazar by Kamal Ahmed