ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Saturday, June 5, 2021

রবীন্দ্র বিচিত্রা

।।গগন হরকরা।।ফারজানা আফরিন।।বাবলী হক।।লুবনা ইয়াসমিন।।
।।তামজিদ নওরিন পূর্ণি।।তাপস বন্দোপাধ্যায়।।সুধীর চক্রবর্তি।।
।।কিশোর কুমার।।অমর পাল।।কামাল আহমেদ।। 


গগন হরকরার খোজে!

ফারজানা আফরিন

আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনের মানুষ যে রে ........রবীন্দ্রনাথ জাতীয় সংগীত রচনা করেছিলেন, বাংলাদেশের বাচ্চা থেকে শুরু করে আবাল বৃদ্ধি বনিতা যারা একবার হলেও আমার সোনার বাংলা গেয়েছেন তারা জানেন আমাদের জাতীয় সংগিতের রচয়িতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই জানেনা যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি এই গানটি কুষ্টিয়ার বাউল শিল্পী গগণ হরকরার এর আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনের মানুষ যে রে এর সুরের অবলম্বনে লিখেছিলেন।

গগন হরকরার এই গানটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “কথা নিতান্ত সহজ, কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ অপূর্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।''
রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন "আমার লেখা যারা পড়েছেন তাঁরা জানেন, বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি ।শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখা
সাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা হত । আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি | এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে,বাউলের সুর ও বাণী কোন্ এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে "

আমি কোথায় পাবো তারে................
লেখক ও সুর : গগণ হরকরা, ভিডিওতে কন্ঠ অমর পাল :


আমি কোথায় পাবো তারে
আমার মনের মানুষ যে রে
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।
লাগি সেই হৃদয়শশী
সদা প্রাণ হয় উদাসী
পেলে মন হত খুশি
দেখতাম নয়ন ভরে।
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে
নিভাই অনল কেমন করে
মরি হায় হায় রে
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
ওরে দেখ না তোরা হৃদয় চিরে।
দিব তার তুলনা কি যার প্রেমে জগৎ সুখী
হেরিলে জুড়ায় আঁখি সামান্যে কি দেখিতে পারে
তারে যে দেখেছে সেই মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে।
মরি হায় হায় রে –
ও সে না জানি কি কুহক জানে
অলক্ষ্যে মন চুরি করে।
কুল মান সব গেল রে তবু না পেলাম তারে
প্রেমের লেশ নাই অন্তরে –
তাইতে মোরে দেয় না দেখা সে রে।
ও তার বসত কোথায় না জেনে তায় গগন ভেবে মরে
মরি হায় হায় রে
ও সে মানুষের উদ্দিশ যদি জানুস কৃপা করে
আমার সুহৃদ হয়ে ব্যথায় ব্যথিত হয়ে
আমায় বলে দে রে।

বাবলী হক

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বাধিক আলোচিত চারটি উপন্যাসের নারী চরিত্রের মনন ও তৎকালীন সাজসজ্জা নিয়ে কথা বলব।

বাঙালি নারী-সমাজে সাহিত্য, সংগীত, শিল্প এমনকী পোশাকেও নবযুগের বিকাশ ঘটেছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে। সমাজের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে ঘেরাটোপ-ঢাকা পালকিপ্রথা ভেঙে আঁটসাঁট পোশাকে ঠাকুরবাড়ির বউ কাদম্বরী দেবী স্বামীর সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেরিয়েছেন ময়দানে। সে সময় সতেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী বাঙালি মেয়েদের পরিচিত করালেন বাইরে পরার রুচিসম্মত সাজের সঙ্গে। আটপৌরে ধাঁচে শাড়ি পরায় তেমন সৌষ্ঠব ছিল না। স্বামীর পরামর্শে বোম্বাই যাবার প্রাক্কালে ফরাসি দোকান থেকে তিনি পোশাক বানিয়েছিলেন। বোম্বাইয়ে গিয়ে প্রথমেই জবরজং অস্বস্তিকর ওরিয়েন্টাল ড্রেস বাদ দিয়ে পারশি মেয়েদের শাড়ি পরার মিষ্টি, ছিমছাম ধরনটি নিজের পছন্দমতো সামান্য অদলবদল করে নিলেন। নতুন ধাঁচের এই শাড়ি পরার 'বোম্বাই দস্ত্তর' ঢংটি ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের খুব পছন্দ হল। জ্ঞানদানন্দিনী শাড়ির সঙ্গে ছায়া-সেমিজ-ব্লাউজ- জ্যাকেট পরাও প্রচলন করেন। আর তাঁর মেয়ে ইন্দিরা দেবী মাথায় শাড়ির আঁচলে ছোট্ট ঘোমটা টানা প্রবর্তন করেন। শাড়ির সঙ্গে ব্যবহার করতেন নানান ফ্যাশানের লেস দেওয়া জ্যাকেট ও ব্লাউজ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, "বিলিতি দরজির দোকান থেকে যত সব ছাঁটাকাটা নানা রঙের রেশমের ফালির সঙ্গে নেটের টুকরো আর খেলো লেস মিলিয়ে মেয়েদের জামা বানানো হত।"\


এ বাউল চলেছে কোথায়?
তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

যদি বলি বীরভূমে আর বাউল নেই, তা হলে অনেকেরই সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হবে। কিন্তু এটাই সত্যি। এখন আমরা যাদের গেরুয়া বা গুদুরি গায়ে ভাবের গান, তত্ত্বের গান গাইতে দেখি, তাঁরা আসলে ‘গায়ক বাউল’। ধর্মেকর্মে আখড়াবাসী নন প্রায় কেউই। বীরভূমের প্রাচীন আখড়াগুলি এখন সুখী গৃহকোণ। অথবা জমিসম্পত্তির যন্ত্রণায় জীর্ণ, ক্ষতবিক্ষত। সব আশ্রমেই প্রায় উৎসব-অনুষ্ঠান-সাধন-ভজন-গানের আলোচনা উঠে গিয়েছে। রসকলির ফারাককথা, একতারার চরণ-চারণ, গাবগুবির ঠাঁটবাট, ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে শরীরটাকে ছেড়ে দিয়ে পাক খেয়ে খেয়ে নাচ অথবা কোমরের বাঁয়াতে তাল তুলে উচ্চ লম্ফন—এ সব আর ‘গায়ক বাউল’-এরাও পারেন না। মঞ্চে এখন সব তারের যন্ত্র। ব্যাঞ্জো-কিবোর্ডের আখরমালায় ধরা বাউলের গান। একতারার গাবগুবিতেও তারের সংযোগ।
তবে, এটা মানতেই হবে, এর ফলে বাউল গান শ্রুতি মধুর হয়েছে আরও। দেশ-বিদেশের শ্রোতা দর্শক তা গ্রহণ করেছেন ভাল ভাবেই। আর এর ফলেই প্রতি রাতে কয়েক ঘণ্টার অনুষ্ঠান করে বাউলদের রোজগার মন্দ হচ্ছে না। দিনজীবী বাউল উঠে আসছেন মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ বিত্তে। সাধারণের মতোই এসি, গাড়ি প্রভৃতি প্রয়োজন পড়ছে। পাচ্ছেনও। বাউল সঙ্গীতের বাহিরাণাই তাঁকে দিয়েছে এই সম্মান, প্রতিপত্তি। ধর্মের খোলস খুলতে পেরেই এসেছে এই আভিজাত্য। এ বড় আনন্দেরই খবর। মাটির মমতা মাখানো সুর, গানের দর্শন— সবই তো আছে। শুধু সময়ের সঙ্গে পা মেলাতে গিয়ে গৌণধর্মী বাউল তার প্রকৃতি সাধনা-সহ অন্যান্য গুপ্ত আচরণবিধিকে সরিয়ে রেখেছে। এখন স্বরলিপিহীন এই বাউল গান বিশিষ্ট শিল্পীরাও গাইছেন নিজের মতো করে। শিক্ষিত-পরিশীলিত-ধ্রুপদী গানের শিল্পীরাও ঢুকে পড়ছেন বাউল গানে। তাতেই অসুবিধা হচ্ছে দীনজীবী ভিক্ষাজীবী ট্রেনে-বাসে গেয়ে পেট চালানো বাউলদের।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শান্তিনিকেতন চিরকাল বাউল আর বাউলের গানকে লালন করে এসেছে। ক্ষিতিমোহন সেন এবং প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে গরুর গাড়িতে চেপে কেঁদুলির পৌষ সংক্রান্তির মকর মেলায় গিয়েছেন। ফিরে এসে কবিকে তার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ কোনও দিন কেঁদুলির মেলায় যাননি। বাউলের টানেও না। বরং পারুলডাঙার নবনীগোপাল দাসকে আহ্বান জানিয়ে শুনেছেন তাঁর গান। নবনীগোপালের জন্য দু-একটি গানও লিখেছেন। অন্য দিকে, লালন ফকিরের গানের দেহতত্ত্ব, সহজতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, ভাব সম্মিলন, মানুষ ভজন এবং জাতিভেদহীনতা উপনিষদের কবিকে আকৃষ্ট করেছিল।
১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবরে ‘হিতকরী’ পত্রিকার মতে, ১১৬ বছর বয়সে লালনের মৃত্যু হয়। আর ১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথ যান শিলাইদহে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালন ফকিরের দেখা হয়নি। অন্যদের কন্ঠে তিনি লালনের গান শুনেছেন। ছেঁউরিয়ার লালন মাজারের ধারেপাশে এখনও একটি গুঞ্জন শোনা যায়, ‘রবীন্দ্রনাথ নাকি লালন সাঁই-এর গান লেখা মূল খাতাটি এনেছিলেন। কিন্তু আর ফেরত দেননি’। যদিও এ অভিযোগের যথার্থ উত্তর দিয়েছেন উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তিনি স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছেন, জমিদারি এস্টেটের কর্মী বামাচরণ ভট্টাচার্য ওই খাতাটির গানগুলি নকল করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথ তার থেকেই কুড়িটি বেছে ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ‘প্রবাসী’তে প্রকাশ করেন। এর পরেই সুধী জনের নজরে আসে বাউল এবং বাউলগান। এর পর শিলাইদহ থেকে স্থায়ী ভাবে শান্তিনিকেতন চলে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ও-পার বাংলার লোকায়ত মরমি সুর আর রাঢ় বাংলার রুক্ষ রৌদ্ররসে ভেজা সুরের সমন্বয় তাঁকে আকুল করেছে। তিনি উভয় ক্ষেত্রেই খুঁজে পেয়েছেন উপনিষদের বার্তা। আরও গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরেছেন বাংলার বাউলগানের আন্তরসত্তাকে। মূলত তিনি এবং তাঁর শান্তিনিকেতনই লালন ফকির ও বাউল গানের আবিষ্কারক ও প্রচারক!

বলরাম হাড়ি
সুধীর চক্রবর্তি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে গানটিতে বৃষ্টি নেশা ভরা সন্ধ্যাবেলা/কোন বলরামের আমি চেলা...।' এখানে যে বলরামের কথা রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন উনি কি উনিশ শতকের মেহেরপুরের মালোপাড়ার বলরাম হাড়ি? অসাধারন বাকচাতুর্য ও নিগূঢ় ব্যাখ্যা করতে পারতেন জগৎ ও জীবনের নানা বিষয়ে। নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখে ধর্মসাধনা করতেন। বলরামীরা গুরুবাদে বিশ্বাসী নয়। নিম্ববর্ণের হিন্দু, অন্ত্যজ ব্রাত্য সব মানুষ আর দলছুট মুসলমান এদের দলের অংশীদার ছিলেন। এদের আসন দুই জায়গায়, বাংলাদেশে মেহেরপুর আর ভারতে নিশ্চিন্তপুর।
কুবির গোসাঁইয়ের গানেও বলরামের উল্লেখ আছে।
'বলরামের চেলার মতো/ কৃষ্ণকথা লাগে তেতো।.......

পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে।কন্ঠ, কিশোর কুমার।


লুবনা ইয়াসমীন

রাজ শাসনের শেষ পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার ভারতের বিভিন্ন এলাকায় সামরিক শাসন জারি করেছিল।জালিয়ানওয়ালা বাগে জেনারেল ডায়ারের আদেশে নিরস্ত্র জনতার সমাবেশে গণহত্যার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইটহুড প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

......নাইটহুড প্রত্যাখ্যানের সারবত্তাতে যেতেই আমাদের সেনাবাহিনী রেজিমেন্টেশান বা নিয়মানুবর্তিতা বলতে কি বোঝে, জনগণের ওপর তার জবরদস্তি প্রয়োগে হিতে বিপরীত কি ঘটে, এই হিতে বিপরীতকে বৃহত্তর কল্যাণের নামে কি ধরনের বুদ্ধিজীবীরা অপরাপর নির্যাতন, ব্যাক্তি বিনাশকে গা সওয়া করে দিতে চায়, তার ফিরিস্তি আমার জরুরি মনে হয়েছে।রেজিমেন্টেশানের একটা সোজা বাংলা হচ্ছে ছাঁচ।...

রবীন্দ্রনাথ তার সারা জীবনে যেসব লেখালেখি করেছে তার পুরোটাই ছাঁচ ভাঙ্গা, খেলা ভাঙ্গার খেলা।...

জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবোত্তর রাশিয়াতে দু সপ্তাহ কাটিয়েছিলেন।রাশিয়ার চিঠির ছত্রে ছত্রে বিস্ময়ের পাশাপাশি এক সাবধানবাণীও ফুটে ওঠে :
''এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই তা বলি নে; গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে, শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে—কিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না—সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিম্বা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।''
নাইটহুড প্রত্যাখ্যান ও রাশিয়ার চিঠির আলোকে লবনা ইয়াসমিন তুলে ধরেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে  সাম্প্রতিক সময়ের সামরিক শাষকদের সাথে বুদ্ধিজীবি, লেখকদের বিভিন্ন স্তরের আপোষ এবং তাদের পক্ষের সাফাই ভাষণ।

রবীন্দ্রনাথ ও দা ভিঞ্চি
কামাল আহমেদ
সময় ১৯৩৫, বলা হচ্ছে জন্মদিনের স্কেচ রবীন্দ্রনাথ নিজ দ্বারা অংকিত! আমি বলবো-- "আধুনিক ধারা ফলিত এক স্কেচ! যত খ্যাতিমান আধুনিকরা এভাবে করেই জগত-ত্রিমাত্রিক রূপ ধরন হতে বেরুতে চেয়েছে আর তখন এভাবে না করে বেরুবার মানে নিজেস্বতা দেখাবার পথ ছিল না; রবীন্দ্রনাথের আঁকা- তাঁর মনের প্রবল সৌন্দর্য, মনের--বিবেকের উন্নত রুচির প্রকাশ; যা অনুশীলন ছাপিয়ে ইচ্ছাশক্তি মুল হয়েছে! অন্যটি দা ভিঞ্চির নিজ প্রতিকৃতি ঐ বিষয়ের উপর তাঁর দীর্ঘ অনুশীলনের ফল অর্জন! যা রবীন্দ্রনাথের দ্বারা সেই চর্চা না হলে কখনোই তাঁর ভিঞ্চির মতো এমন শিল্প করা সম্ভব ছিল না! ভিঞ্চির প্রতিকৃতি দৃষ্টিগ্রাহ্য বাস্তব ধারার শ্রেষ্ঠ নমুনা! হেরফের যা-ই; উভয়ের মধ্যে শৈল্পিক ব্যাপার বিদ্যমান; কারণ উভয় শিল্প- উচ্চ রুচিজ্ঞান হতে হয়েছে! এই দুটো আর্ট কারো উচ্চ রুচি জ্ঞানের প্রকাশ!

রবীন্দ্রনাথ এবং ফটো ম্যানুপুলেশান
তামজিদ নওরিন পূর্ণি

আমার সাথে ওনার পরিচয় খুব ছোটবেলায়।বিকেল হলেই আমার ফুপুর কোলে বসে বারান্দায় গান গাইতাম "মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি আহা হা হা হা।"এই আহা হা হা হা শোনার জন্য ফুপি যে কত কিছু করে আমাকে দিয়ে গান গাওয়াতো।তখনও এই বৃদ্ধ মানুষটিকে অজানা কারণে ভালো লাগতো।তবে ভালো লাগাটা ভালোবাসা হয়েছিলো যখন কৈশোরে পা দিলাম।প্রথম উপন্যাস হিসেবে পড়ে ফেললাম "নৌকাডুবি"।আর সবার মতোই কমলা না আমি নিজেকে খুজেছিলাম হেমনলিনীর ভেতরে।এরপর একে একে শেষের কবিতা,যোগাযোগ,ঘরে বাইরে,মালঞ্চ,দুই বোন,বউ ঠাকরুণের হাট,গোরা পড়ে ফেললাম।শেষ হয়ে গেলো গল্পগুচ্ছও।

খুব খুব ধীরে ধীরে বইগুলো পড়তাম শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়ে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কখনো হয়ে উঠাতাম চারুলতা,কখনো লাবণ্য কিংবা কুমুদিনী।আমি বৃষ্টি ভালবেসেছি তার গান শুনে।আমি হয়তো ভালবাসাই শিখেছি ওনার প্রেম পর্যায় থেকে,ঈশ্বরকে বুঝতে চেষ্টা করেছি প্রার্থনা পর্যায়ে। আমার শৈশব,কৈশোর আর যৌবন সমস্তটা দখল করে আছেন এই মানুষটি।বেঁচে থাকলে হয়তো বৃদ্ধকালটাও কেটে যাবে ওনাকে নিয়েই।হতে পারে,রবীন্দ্রনাথ মেইনস্ট্রিম কেউ এবং সমলোচনার অনুর্ধ্বে।তবে আমার জন্য মানুষটি আমার সকল অনুভূতির স্রষ্টা।

কথাগুলো লিখতে লিখতে মনে পড়ছে তারই লেখা গান-"নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছো নয়নে নয়নে,হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে হৃদয়ে রয়েছো গোপনে,রয়েছো নয়নে নয়নে।"

যারে চোখে দেখা যায় না তারে ভালবাসা যায়।তারে সব সমর্পন করা যায়।নিজের ভেতরে চারুলতা,লাবণ্য কিংবা বিমলার খোঁজ করতেই এই ফটো ম্যানুপুলেশনের সৃষ্টি।

*কভার ফটোগ্রাফি, বাবলী হকের লেখাতে এবং অন্যান্য অংশের আলোকচিত্র তামজিদ নওরিন পূর্ণি।

সম্পাদনা : তরংগ