ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Saturday, June 5, 2021

শাড়ি ভেঙ্গেছে লিঙ্গের সীমানা

।।নাসরিন জয়া হক।।শর্মিলা নায়ার।।জিনাত নেসার জামান।।

।।আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদ।।চয়ন খায়রুল হাবিব।।  


ট্রান্সজেন্ডার শাড়ি মডেল মায়া মেনন

পোশাক শিল্পের অন্যতমো বৃহত্তমো রপ্তানীকারক দেশ বাংলাদেশে পোষাকের বৈচিত্র দিন দিন কমছে।শাড়ি উৎপত্তির ইতিহাস খুব একটা স্পষ্ট নয়। শাড়ি ধারণাটির উৎপত্তি সেলাইবিহীন বস্ত্রখণ্ড থেকে।নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, আদিতে পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরিধানের প্রচলন ছিল না। সেলাইবিহীন প্রচলিত কাপড় পুরুষদের ক্ষেত্রে ধুতি এবং নারীদের ক্ষেত্রে শাড়ি নামে অভিহিত হতো। মূলত বয়নশিল্পের প্রচলন ঘটার পরই শাড়ির প্রচলন ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়।চৌদ্দ শতকের কল্পকাহিনী, গল্প-গাঁথা ও গীতিকবিতায় শাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। সে সময়কার কবি চণ্ডিদাস (১৩৭০-১৪৩০) লিখেছেন : 

নীল শাড়ি মোহন করি
      উচ্ছলিতে দেখি পাশ।
কি আর পরানে সপিনু চরণে
      দাস করি মনে আঁশ

পেইন্টিং, রাজা রাভি ভার্মা
শাড়ি' শব্দটি জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্যে মহিলাদের পোশাক হিসাবে উল্লিখিত 'সাত্তিক' থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। শাড়ি বা সাত্ত্বিক নিচের পোশাক অন্ত্রিয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি তিন অংশের একত্রে পরিধেয় পোশাক; কাঁধ বা মাথার উপর একটি পর্দা উত্তরিয়া পরা; এবং স্তনপাট্টা বা বুকবন্ধনী। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর সংস্কৃত এবং বৌদ্ধ পালি সাহিত্যে শাড়ির উল্লেখ রয়েছে। এই সম্পূর্ণ তিন টুকরো পোশাক একটি পূর্ণাঙ্গ পরিধেয় পোশাক হিসাবে পরিচিত।

প্রাচীন ধুতি সদৃশ অন্ত্রিয় "মাছের লেজের" মতোন প্যাঁচিয়ে পড়া হয় যা ঢিলেভাবে পা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পা আবৃত রাখে এবং যার সামনের পায়ের অংশে আলংকারিক পরিধান শৈলীর চর্চা করা হয়। কালক্রমে এটি ভৈরনিবাসানী স্কার্টে বিবর্তিত হয়েছে, যা এখনকার যুগে ঘাগড়া এবং লেহেঙ্গা নামে পরিচিত। উত্তরিয় কাঁধ বা মাথার উপরে একটি শাল জাতীয় পর্দা ছিল, যার ব্যবহার ক্রমশ বিস্তৃত হয়। এটিই আজকের যুগে ওড়না নামে পরিচিত। একইভাবে, স্তনপাত্তা প্রথম শতাব্দীতে চোলিতে বিবর্তিত হয়েছে।

লাইফ ম্যাগাজিন আলোকচিত্রিকে
শাড়ি পরা দেখাচ্ছে হিন্দি অভিনেত্রী
বেগম পারা
কালের বিবর্তনে বদলেছে শাড়ির পাড়-আঁচল, বুনন এবং পরিধান কৌশল। ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাধারণত‍ শাড়িকে সবচেয়ে উপযোগী পোশাক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নারী সেনারা শাড়ি পরলে কোমরে শার্ট বেঁধে রাখেন। শাড়ি পরার আধুনিক শৈলী এসেছে ঠাকুর পরিবার থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বোম্বেতে অধ্যয়নকালে থাকার পর কলকাতায় শাড়ি পরার এই ভিন্নধর্মী শৈলীর প্রচলন ঘটান। এই পদ্ধতির জন্য শাড়ির নিচে সেমিজ বা জ্যাকেট (ব্লাউজের পুরানো নাম) এবং পেটিকোট পরার প্রয়োজন ছিল এবং এই পোশাকে তৎকালীন নারীদের অন্দরমহল থেকে বাইরে আসার প্রচলন ঘটেছিল।

বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শাড়ির দোকানে দেখা যাবে পুরুষ বিক্রয় কর্মিরা শাড়ি পরে ক্রেতাদের দেখাচ্ছেন।শাড়ি বিক্রি ও শাড়ি ফ্যাশনে জড়িত ভারতীয় পুরুষ হিমাংশু ভার্মা খ্যাতিমান মডেল।ফ্যাশান ডিজাইনার শর্মিলা নায়ার কাজ করেন ট্রান্সজেন্ডার মডেল মায়া মেনন, গৌরী সাবিত্রীকে  নিয়ে।শাড়ির লৈঙ্গিক সীমান্ত ভিঙ্গে  নিচের সনেটটি লিখেছেন চয়ন খায়রুল হাবিব :

শর্মিলা নায়ার, বসে
ট্রান্সজেন্ডার মায়া মেনন, গৌরী সাবিত্রী
''শাড়িতো নিজেই একটা মনোরম দেহ
পুরুষটিকে প্যাচালো শরতের দ্বিধামুগ্ধ কাঞ্জিভরম
সামনে বসা রমনিরা তাকাচ্ছে কৌতুকে নরমশরম
জমিন আচলে নক্সিকাটা পৌরুষের বহিরাঙ্গিক নির্বাহ
একটা স্বপ্ন না কি দুস্বপ্ন খুলে গেলো
একটা ঝলমলে সোনালি বাজপাখি
গলা বুকে ডানায় জিঘাংসা ধারালো
আততায়ির দোলায় বাংলায় হননের রাখি
রক্তরংগিলা অকেশানে একেক জবড়জংগিলা শাড়ি
সময় আটকানো অডানায় রাতের প্রহর
ঘুমের ক্লান্তিতে গড়ালো আগোছালো খেলাঘর
ছোট আয়ের সেলসম্যানদের ঘিঞ্জি ঘিঞ্জি মেসবাড়ি
হিমাংশু ও মায়া ঘোরায় পোষাকি সেক্সের পরম পরমা
পরতে যদিও সময় লাগে খুলতে লাগে শুধু এক লহমা''
চয়ন খায়রুল হাবিব
২৮/০৩/১৮


পিঙ্ক প্যান্থার সিনেমায় ক্লডিয়া কার্ডিনাল
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাইয়ীদের ফতোয়া
একদিকে যখন শর্মিলা নায়ার, চয়ন খায়রুল হাবিবেরা পোশাক ও লিঙ্গের সীমান্তরেখা ভেঙ্গে দিচ্ছে, আরেকদিকে তখন একই ভুখন্ডে প্রতিক্রিয়াশীলেরা নারীরা কিভাবে কি পরবে অনলাইনে, অফলাইনে তার ফতোয়া দিয়ে বেড়াচ্ছে।এই ফতোয়াবাজেরা সবাই মাদ্রাসা থেকে এসেছে তা ভাবা আমাদের চড়াদাগের ভুল।

ধর্মিও মৌলবাদীরা যেরকম নারী কিভাবে পর্দা করবে তার নির্দেশনা বেঁধে দিচ্ছে, কথিত প্রাগ্রসর বুদ্ধিজীবিরাও তাতে উস্কানি দিচ্ছে।বাংলাদেশে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা স্বনামধন্য অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদ প্রথম আলো পত্রিকাতে যেভাবে কয়েক বছর আগে কোন উচ্চতার মেয়েরা শাড়ি পরলে মানায়, বাঙ্গালির দৈহিক সৌষ্ঠব নিয়ে যেসব ঢালাও মন্তব্য করেন, তাকে বর্ণবাদি, বাংগালি বিদ্বেষী, নারীবিদ্বেষি বললে অত্যুক্তি হবে না।এধরনের ঢালাও বক্তব্যের মুখপত্র হয়ে প্রথম আলো প্রমান করেছে যে বহুল প্রচারিত হলেও লৈঙ্গিক বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে গুনগত বিকাশে সহায়তার যোগ্যতা পত্রিকাটির নেই।নিচে হুবহু উদ্ধৃত করা যাক অধ্যাপক আবু সাইয়ীদের বক্তব্য
''বিশালদেহী আফ্রিকার নারীর জন্য এ পোশাক নয়, জার্মান বা ইংরেজ নারীর উদ্ধত সৌন্দর্যেও এ পোশাক হয়তো খাপ খাবে না।.....
কবি ওমর আলী লিখেছিলেন, ‘এ দেশের শ্যামল রং রমণীর সুনাম শুনেছি।’ কেন এই শ্যামল নারীদের রূপের এত সুনাম? এর কারণ তিনি ব্যাখ্যা করে বলেননি, কিন্তু তাই বলে গড়পড়তা বাঙালি নারী রূপের দিক থেকে পৃথিবীর সেরা সুন্দরীদের মধ্যে পড়ে এ বললেও যেন কিছুটা বেশি শোনাবে। বাঙালি পুরুষদের ব্যাপারেও হয়তো তা–ই। ইংল্যান্ডের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: এখানে রাস্তায় বেরোনোর বড় সুবিধা যে থেকে থেকেই সুন্দর মুখ দেখতে পাওয়া যায়। বাঙালি জাতির বেলায় কথাটা হয়তো ওভাবে খাটবে না।....
বাঙালি সৌন্দর্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা: আমার ধারণা ‘উচ্চতা’। সবচেয়ে কম যে উচ্চতা থাকলে মানুষকে সহজে সুন্দর মনে হয়—যেমন পুরুষের ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি ও মেয়েদের ৫ ফুট ৫ বা ৬ ইঞ্চি—আমাদের গড় উচ্চতা তার চেয়ে অন্তত ২–৩ ইঞ্চি কম। দৈহিক সৌন্দর্য ছেলেদের বড় ব্যাপার নয় বলে এ নিয়েও তারা কোনোমতে পার পেয়ে যায়। কিন্তু আটকে যায় মেয়েরা। আমার ধারণা, একটা মেয়ের উচ্চতা অন্তত ৫ ফুট ৪–এর কম হলে তার শরীরে নারীজনিত গীতিময় ভঙ্গি পুরোপুরি ফুটে ওঠে না।..... ''
জিনাত নেসার জামান
পিঙ্ক প্যান্থার সিনেমাতে ইটালিয়ান একহারা গড়নের স্বেতাঙ্গিনী ক্লডিয়া কার্ডিনালকে যেরকম মনরোম লেগেছে, ছোটোখাটো, আটোসাটো কৃষ্ণাঙ্গিনী অপ্রা উইনফ্রিকেও শাড়িতে সেরকম আবেদনময়ি মনে হয়েছে।সোনালি চুলের দিঘল চিত্র তারকা জুলিয়া রবার্টসের সৌষ্ঠব শাড়িতে যেরকম  ফুটে উঠেছে ইট প্রে লাভ সিনেমাতে, তরঙ্গের জুন, জুলাই গরমকালীন কভার মডেল সিডানিবাসী বাঙালি আনিকা হক, তরঙ্গের চলচ্চিত্র রিভিউয়ার কানাডাবাসী  জিনাত নেসার জামানের কমনিয়তাও শাড়িতে সেরকম ফুটে উঠেছে।

সঙ্গম যুগ এবং নাভি 
বাণভট্ট রচিত কাদম্বরী এবং সিলাপোধিকারামের মতো প্রাচীন তামিল কাব্যে নারীদের নিদারুণ বর্ণনায় আচ্ছাদন বা শাড়ির বর্ণনা দেয়।প্রাচীন ভারতে মহিলারা মধ্যচ্ছাদন হিসেবে শাড়ি পরার পরেও ধর্মশাস্ত্র লেখকরা বলেছিলেন যে নারীদের এমন পোশাক পরিধান করা উচিত যাতে নাভিটি কখনই দৃশ্যমান না হয় । এরপর থেকে কিছু সময়ের জন্য নাভি প্রদর্শন একটি ট্যাবু হয়ে উঠেছিল এবং নাভি গোপন করা হতো।প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যে এবং নাট্য শাস্ত্রে (একটি প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ, যা প্রাচীন নৃত্য এবং পোশাকের বর্ণনা দেয়), পরম সত্তাসম্পন্ন নাভিকে জীবন এবং সৃজনশীলতার উৎস হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে । এ কারণে শাড়ি পড়ার সময় মধ্যাচ্ছাদন উন্মুক্ত রাখা হয়। এছাড়াও চতুর্দশ শতাব্দীর শেষার্ধে মিথিলার প্রথিতযশা কবি বিদ্যাপতির রচনায়ও অঞ্চল (আঁচল), কাঁচুলি, শাড়ি শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়:

উরহি অঞ্চল বাঁপি চঞ্চল
আধ পয়োর হেরু।
পবন পরাভব সরদ ঘন জনু
বেকত কএল সুমেরু।।

— বিদ্যাপতি 

আনিকা হক, অস্ট্রেলিয়া
সাধারণত ধারণা করা হয় যে নিম্নাঙ্গের জন্য শাড়ির মতো পোশাক এবং ঊর্ধাঙ্গের জন্য কখনও কখনও শাল বা স্কার্ফের মতো পোশাক,যা 'উত্তরীয়' নামে পরিচিত, দীর্ঘকাল ধরে ভারতীয় মহিলারা পরিধান করেছিলেন এবং শত শত বছর ধরে তারাবর্তমান রূপে একে পরিধান করছেন। প্রাচীনকালে নিচের পোশাকটিকে 'নিভি' বা 'নিভিবন্ধ' বলা হত, এবং ঊর্ধাঙ্গের বেশিরভাগই উন্মুক্ত থাকত । কালিদাসের রচনায় 'কুরপাস' নামক এমন একধরনের আঁট-সাঁট বস্তুর কথা বলা হয়েছিল, য কেবল স্তনগুলিকে আবৃত রাখে। এটি কখনো কখনো 'উত্তরাসঙ্গ' বা 'স্তনপট্ট' নামেও অভিহিত হত।


সিলাপোধিকারামের  মতো কাব্যগ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, দক্ষিণ ভারতে প্রাচীন তামিলনাড়ুর সঙ্গম যুগে নিম্নাঙ্গ এবং মাথা ঢাকার জন্য এক টুকরো পোশাক ব্যবহৃত হত এবং শরীরের মধ্যাঙ্গ পুরোপুরি অনাবৃত থাকতো। শাড়ির অনুরূপ শৈলীর উদাহরণ কেরালার রাজা রাভি ভার্মার চিত্রগুলোতে রয়েছে। বহু সূত্র বলেছে যে প্রাচীন ভারতে এবং কেরালায় প্রতিদিনের পোশাকগুলোয় 'কুরপাসিকা' বা 'স্তনপট্টের সাথে মিল রেখে ভাঁজ করা বা পাতানো ধুতি (সারং) মোড়ানো হতো এবং মাঝে মধ্যে 'উত্তরিয়া' নামক একটি টুকরার ব্যবহার হতো যেটি ঊর্ধাঙ্গ বা মাথা ঢাকার কাজে ব্যবহার করা হতো।দুই-টুকরো মুন্ডুম ন্যারিয়াথুম ছিল প্রাচীন কেরালার দৈনন্দিন পোশাক। কেরালার এক টুকরো শাড়ি মধ্যযুগীয় সময়কালে তামিলনাড়ু বা ডেকান থেকে মধ্যযুগীয় কেরালার বিভিন্ন মন্দির ম্যুরালগুলির উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল।


বাঙালি শাড়ি পরার আধুনিক শৈলী এসেছে ঠাকুর পরিবার থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বোম্বেতে অধ্যয়নকালে থাকার পর কলকাতায় শাড়ি পরার এই ভিন্নধর্মী শৈলীর প্রচলন ঘটান। এই পদ্ধতির জন্য শাড়ির নিচে সেমিজ বা জ্যাকেট (ব্লাউজের পুরাতন নাম) এবং পেটিকোট পরার প্রয়োজন ছিল এবং এই পোশাকে তৎকালীন নারীদের অন্দরমহল থেকে বাইরে আসার প্রচলন ঘটেছিল।


বিয়ের শাড়িগুলির জন্য লাল রঙ সবচেয়ে পছন্দের এবং এটি ভারতীয়-বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে নববধূদের কাছে জনপ্রিয়। মহিলারা ঐতিহ্যগতভাবে রেশম, সুতি, ইক্কাত, ব্লক-প্রিন্ট, সূচিকর্ম এবং টাই-ডাই কাপড়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক তাঁত শাড়ি পরিধান করতেন। ঐতিহ্যগতভাবে এবং আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে ব্রোকেড সিল্কের শাড়িগুলির পর পরই সর্বাধিক জনপ্রিয় স্থানে রয়েছে বনসারি, কাঞ্চিপুরম, গাদওয়াল, পাইথানি, মহীশূর, উৎপদা, বাবলপুরি, বালচুরি, মহেশ্বরী, চন্দেরি, মেখেলা, ঝিচা ইত্যাদি।পাটোলা, পোচাম্পল্লি, বোমকাই, খান্দুয়া, সমবলপুরি, গাদওয়াল, বারহামপুরী, বারগড়, জামদানি, তন্ত, মঙ্গলগিরি, গুঁতুর, চন্দেরি, মহেশ্বরী, নুয়াপাটন, তুষার, ইলকল, কোটপাদ এবং মণিপুরী নামে পরিচিত সিল্ক ইকাত এবং সুতির শাড়ি উৎসব এবং দৈনন্দিন পোশাক হিসাবে পরা হয়।বন্ধনী, লেহেরিয়া, বাগরু, আজরখ, সুনগুদি, কোটা ডাবু/ডাবু প্রিন্ট, বাঘ ও কালামকারি নামে পরিচিত টাই-ডাই এবং ব্লক-প্রিন্ট শাড়িগুলি বর্ষা মৌসুমে ঐতিহ্যগতভাবে পরা হতো। অনুষ্ঠানে পরিহিত শাড়িগুলিতে ব্যবহৃত প্রচলিত সূচিকর্মের মধ্যে গোটা পট্টি জনপ্রিয় রূপ নিয়েছে, অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী লোক সূচিকর্ম যেমন মোচি, পাক্কো, খড়ক, সুফ, কাঠি, ফুলকড়ি এবং গামথি সাধারণত অনানুষ্ঠানিক উপলক্ষে পরা হয়।


অপ্রা উইনফ্রে
নিভি শৈলী
ভিক্টোরিয় সংবেদনশীলতার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রয়োজনীয়তার কারণে নিভি পরিধান শৈলীর প্রচলন ঘটেছিল এবং এটি ওপনিবেশিক অতীতের একটি স্বীকৃতিস্বরূপ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভগ্নিপতি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী নিভি শৈলীর প্রচলন করেছিলেন এবং ভারতীয় পরিচয় বজায় রেখে একটি ব্রিটিশ অধ্যুষিত সামাজিক কাঠামোয় মানানসই করার উপায় হিসাবে সাথে ব্লাউজ এবং পেটিকোটের বভ্যবহার শুরু করেছিলেন। জটিল ভারতীয় সংস্কৃতিকে সু-সংজ্ঞায়িত স্টেরিওটাইপে মানানসই করে ব্রিটিশরা আনুষ্ঠানিক করার চেষ্টা করেছিল। শাড়ি ভিক্টোরিয় যুগের নীতিগুলির সাথে খাপ খায়নি, যা চলাফেরার স্বাধীনতার চেয়ে বিনয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। ব্রিটিশরা ভারতীয় সংস্কৃতির সারল্য মেনে নিতে পারেনি এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মাধ্যমে তাদের একক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন।[


নিভি, ডেকান অঞ্চল থেকে আজকের সবচেয়ে জনপ্রিয় শাড়ি পরিধান শৈলীতে পরিণত হয়েছে।ব্রিটিশদের সাথে ক্রমবর্ধমান কথোপকথনে দেখা গিয়েছিল যে রাজপরিবারের বেশিরভাগ মহিলারা ১৯০০-এর দশকে পর্দা প্রথা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। কোচবিহারের মহারাণী ইন্দিরা দেবী শিফন শাড়ি জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তিনি জীবনের প্রথম দিকে বিধবা হয়েছিলেন এবং ঐতিহ্য অনুসারে নিরলংকার শোকের পক্ষে সূচীশিল্পিত বরোদা শালস ত্যাগ করেছিলেন। চরিত্রগতভাবে, তিনি তার "শোকের" কাপড়টিকে উচ্চ ফ্যাশনে রূপান্তরিত করেছেন। ফ্রান্সে তিনি তার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যগুলিতে সর্বদা শিফন শাড়ি পরেছিলেন, এবং রাজকীয় ফ্যাশন স্টোরের রেশম শিফন শাড়ির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শাড়ি উৎসব

ভারতে শিফন শাড়ি অধিপত্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে সমস্ত দেশ জুড়ে ফ্যাশনগুলিকে একত্রিত করে। এর স্নিগ্ধতা, হালকা ওজন এবং সৌন্দর্য, মার্জিত, স্নেহপূর্ণ কুঁচির শৈলী ভারতীয় জলবায়ুর সাথে আদর্শভাবে উপযোগী ছিল। বিভিন্ন আদালত শাড়ির দেশীয় বা নিজস্ব শৈলী গ্রহণ করেছিল। বেশিরভাগ আদালতে বারাণসীর সোনালি পাড়ের শাড়ি, সূক্ষ্ম জারদোজি কাজ, গোটা, মকাইশ এবং টিলা কাজ যা মসৃণ কাপড়ে শোভিত করেছিল, একইসাথে ঐতিহ্যবাহী এবং অলঙ্কারের অন্তর্নিহিত পছন্দ উভয় চাহিদাই পুরণ করেছিল। ডেকানে মহারাণীদের কয়েকটি আলোকচিত্রে দেখা যায় যে মহিলারা তাদের হাতাবিহীন ব্লাউজ পরিধান করতো, সাথে সমৃদ্ধভাবে সুসজ্জিত কোমর কোট থাকতো। তাদের সমাবেশে শিফন শাড়ি কতটা চটুল হয়ে ওঠে সাভানুরের বেগমের সঙ্গে তা মনে পড়ে যায়। কিছু আদালতে এটি জালি বা নেট কুর্তা এবং অ্যামবুসকৃত রেশমের কোমর বন্ধনীর সাথে সারদি বা জ্যাকেটের সাথে পরা হতো। এগুলির মধ্যে কিছু এত সমৃদ্ধ ছিল যে পুরো জমিটি মুক্তো এবং জারদোজি সূচিকর্ম করা হতো।


তরংগ ফিল্ম রিভিউয়ার জিনাত নেসার জামান দেশে ও ডিয়াস্পোরাতে শাড়ির হালনাগাদ নিয়ে লিখেছেন এভাবে :

''কবি শেখ সাদীর পোশাকের মর্যাদা গল্পটা আমাদের সবারই মনে আছে। তবে মানুষের  বৈশিষ্ট্যের, পছন্দের অনেকটাই জানা যায় তার পোশাক দেখে, সেও ঠিক। ট্রেন্ডের থেকে অনুষ্ঠান ও আবহাওয়া অনুযায়ী পোশাক নির্বাচন অবশ্যই বেশি শ্রেয়।ফ্যাশন ডিজাইনারা রেগুলার বলে যান মানুষকে সুন্দর দেখানোর থেকে মানুষের মধ্যে আস্থা জাগিয়ে তোলা তাদের ফ্যাশন পন্যের উদ্দেশ্য। তবে সেটা  ক্যারি করা আরেকটা ব্যাপার- তাই একই কাপড় সবাইকে একই রকমভাবে মানায় না।

ইন্টারনেট পূর্ব যুগের মানুষ হওয়ায় বিভিন্ন ব্র‍্যান্ডের নাম আমরা আকাশে বাতাসে তেমনভাবে ছোট থেকে শুনিনি। ছাত্রাবস্থায় এক্সক্লুসিভ ড্রেস পড়াকে আমরা অনেক স্মার্টনেস মনেও করতাম না, কামিজে বা ওড়নায় লেস লাগিয়ে নিজের মতো করে নেওয়াই স্টাইল ছিল, ভালো জামা জুতা বরাদ্দ ছিল ঈদে।

গত বেশ কিছু বছর শীতপ্রধান দেশে থাকি, ঘরে বাইরে কাজের পোশাকের ধরন বদলে গেছে অনেকটাই। তবে শখের পোশাক হিসেবে সবসময় আছে শাড়ি, আর শাড়ির জন্য ভালোলাগা দিন দিন বেড়েই গেছে, পছন্দের এক একটা শাড়ি যেন এক একটা গল্প!
হয়তো মা-খালাদের শাড়িতে দেখে বড় হয়েছি বলে অথবা ঈদ-পরব, বৈশাখের উৎসবে শাড়ি পরা শুরু হয়েছিল বলে সাবকনশাস মাইন্ড  শাড়ি কে পার্ট অফ উৎসব হিসাবে নিয়েছে, অথবা বহুদূরে থাকি বলেই নিজের ঐতিহ্য আজ বেশি প্রিয় হয়েছে।''
শাড়ি নিয়ে ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রাচীন গীতিকা

শাড়ি নিয়ে শেষ কথা কখনোই বলা যাবে না। শাড়ি নিজেই য্যানো একটি জীবন্ত লিংগধারি উপস্থিতি।একজন শাড়ি পরছে, না কি শাড়ির সংগ নিচ্ছে তাও একটা রহস্য।ইটালিয়ান সোনিয়া গান্ধি পেয়েছে কাস্মিরি ইন্দিরা গান্ধির সব শাড়ি।সোনিয়া, ইন্দিরার ধাঁচেই শাড়ি, ব্লাউস পরেন।বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রি শেখ হাসিনা আবার নিজের ধাঁচে শাড়ি পরেন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রিয় সফরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শাড়ি উপস্থাপন করেন।আগে আমরা আলোচনা করেছি যে শাড়ি লিংগ সিমান্ত ভেঙ্গে দিচ্ছে,  লিংগ বিভেদ, ধর্মভেদ পেরিয়ে শাড়ি হয়ে উঠেছে সম্প্রিতির সেতু।স্থানীয় পালা পার্বনে  দক্ষিন ভারতের কিষানী থেকে বাংলার কর্মজীবি নারীর প্রধান পরিধেয় এখনো শাড়ি।নটে গাছটি মুড়ায়, কিন্তু শাড়ির গল্প ফুরায় না!


।।নাসরিন-জয়া হক।।