।।নাসরিন জয়া হক।।শর্মিলা নায়ার।।জিনাত নেসার জামান।।
।।আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদ।।চয়ন খায়রুল হাবিব।।
![]() |
ট্রান্সজেন্ডার শাড়ি মডেল মায়া মেনন |
উচ্ছলিতে দেখি পাশ।
কি আর পরানে সপিনু চরণে
দাস করি মনে আঁশ
![]() |
পেইন্টিং, রাজা রাভি ভার্মা |
প্রাচীন ধুতি সদৃশ অন্ত্রিয় "মাছের লেজের" মতোন প্যাঁচিয়ে পড়া হয় যা ঢিলেভাবে পা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পা আবৃত রাখে এবং যার সামনের পায়ের অংশে আলংকারিক পরিধান শৈলীর চর্চা করা হয়। কালক্রমে এটি ভৈরনিবাসানী স্কার্টে বিবর্তিত হয়েছে, যা এখনকার যুগে ঘাগড়া এবং লেহেঙ্গা নামে পরিচিত। উত্তরিয় কাঁধ বা মাথার উপরে একটি শাল জাতীয় পর্দা ছিল, যার ব্যবহার ক্রমশ বিস্তৃত হয়। এটিই আজকের যুগে ওড়না নামে পরিচিত। একইভাবে, স্তনপাত্তা প্রথম শতাব্দীতে চোলিতে বিবর্তিত হয়েছে।
![]() |
লাইফ ম্যাগাজিন আলোকচিত্রিকে শাড়ি পরা দেখাচ্ছে হিন্দি অভিনেত্রী বেগম পারা |
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শাড়ির দোকানে দেখা যাবে পুরুষ বিক্রয় কর্মিরা শাড়ি পরে ক্রেতাদের দেখাচ্ছেন।শাড়ি বিক্রি ও শাড়ি ফ্যাশনে জড়িত ভারতীয় পুরুষ হিমাংশু ভার্মা খ্যাতিমান মডেল।ফ্যাশান ডিজাইনার শর্মিলা নায়ার কাজ করেন ট্রান্সজেন্ডার মডেল মায়া মেনন, গৌরী সাবিত্রীকে নিয়ে।শাড়ির লৈঙ্গিক সীমান্ত ভিঙ্গে নিচের সনেটটি লিখেছেন চয়ন খায়রুল হাবিব :
![]() |
শর্মিলা নায়ার, বসে ট্রান্সজেন্ডার মায়া মেনন, গৌরী সাবিত্রী |
পুরুষটিকে প্যাচালো শরতের দ্বিধামুগ্ধ কাঞ্জিভরম
সামনে বসা রমনিরা তাকাচ্ছে কৌতুকে নরমশরম
জমিন আচলে নক্সিকাটা পৌরুষের বহিরাঙ্গিক নির্বাহ
একটা ঝলমলে সোনালি বাজপাখি
গলা বুকে ডানায় জিঘাংসা ধারালো
আততায়ির দোলায় বাংলায় হননের রাখি
সময় আটকানো অডানায় রাতের প্রহর
ঘুমের ক্লান্তিতে গড়ালো আগোছালো খেলাঘর
ছোট আয়ের সেলসম্যানদের ঘিঞ্জি ঘিঞ্জি মেসবাড়ি
পরতে যদিও সময় লাগে খুলতে লাগে শুধু এক লহমা''
২৮/০৩/১৮
''বিশালদেহী আফ্রিকার নারীর জন্য এ পোশাক নয়, জার্মান বা ইংরেজ নারীর উদ্ধত সৌন্দর্যেও এ পোশাক হয়তো খাপ খাবে না।.....কবি ওমর আলী লিখেছিলেন, ‘এ দেশের শ্যামল রং রমণীর সুনাম শুনেছি।’ কেন এই শ্যামল নারীদের রূপের এত সুনাম? এর কারণ তিনি ব্যাখ্যা করে বলেননি, কিন্তু তাই বলে গড়পড়তা বাঙালি নারী রূপের দিক থেকে পৃথিবীর সেরা সুন্দরীদের মধ্যে পড়ে এ বললেও যেন কিছুটা বেশি শোনাবে। বাঙালি পুরুষদের ব্যাপারেও হয়তো তা–ই। ইংল্যান্ডের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: এখানে রাস্তায় বেরোনোর বড় সুবিধা যে থেকে থেকেই সুন্দর মুখ দেখতে পাওয়া যায়। বাঙালি জাতির বেলায় কথাটা হয়তো ওভাবে খাটবে না।....বাঙালি সৌন্দর্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা: আমার ধারণা ‘উচ্চতা’। সবচেয়ে কম যে উচ্চতা থাকলে মানুষকে সহজে সুন্দর মনে হয়—যেমন পুরুষের ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি ও মেয়েদের ৫ ফুট ৫ বা ৬ ইঞ্চি—আমাদের গড় উচ্চতা তার চেয়ে অন্তত ২–৩ ইঞ্চি কম। দৈহিক সৌন্দর্য ছেলেদের বড় ব্যাপার নয় বলে এ নিয়েও তারা কোনোমতে পার পেয়ে যায়। কিন্তু আটকে যায় মেয়েরা। আমার ধারণা, একটা মেয়ের উচ্চতা অন্তত ৫ ফুট ৪–এর কম হলে তার শরীরে নারীজনিত গীতিময় ভঙ্গি পুরোপুরি ফুটে ওঠে না।..... ''
![]() |
জিনাত নেসার জামান |
![]() |
আনিকা হক, অস্ট্রেলিয়া |
সিলাপোধিকারামের মতো কাব্যগ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, দক্ষিণ ভারতে প্রাচীন তামিলনাড়ুর সঙ্গম যুগে নিম্নাঙ্গ এবং মাথা ঢাকার জন্য এক টুকরো পোশাক ব্যবহৃত হত এবং শরীরের মধ্যাঙ্গ পুরোপুরি অনাবৃত থাকতো। শাড়ির অনুরূপ শৈলীর উদাহরণ কেরালার রাজা রাভি ভার্মার চিত্রগুলোতে রয়েছে। বহু সূত্র বলেছে যে প্রাচীন ভারতে এবং কেরালায় প্রতিদিনের পোশাকগুলোয় 'কুরপাসিকা' বা 'স্তনপট্টের সাথে মিল রেখে ভাঁজ করা বা পাতানো ধুতি (সারং) মোড়ানো হতো এবং মাঝে মধ্যে 'উত্তরিয়া' নামক একটি টুকরার ব্যবহার হতো যেটি ঊর্ধাঙ্গ বা মাথা ঢাকার কাজে ব্যবহার করা হতো।দুই-টুকরো মুন্ডুম ন্যারিয়াথুম ছিল প্রাচীন কেরালার দৈনন্দিন পোশাক। কেরালার এক টুকরো শাড়ি মধ্যযুগীয় সময়কালে তামিলনাড়ু বা ডেকান থেকে মধ্যযুগীয় কেরালার বিভিন্ন মন্দির ম্যুরালগুলির উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল।
বাঙালি শাড়ি পরার আধুনিক শৈলী এসেছে ঠাকুর পরিবার থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বোম্বেতে অধ্যয়নকালে থাকার পর কলকাতায় শাড়ি পরার এই ভিন্নধর্মী শৈলীর প্রচলন ঘটান। এই পদ্ধতির জন্য শাড়ির নিচে সেমিজ বা জ্যাকেট (ব্লাউজের পুরাতন নাম) এবং পেটিকোট পরার প্রয়োজন ছিল এবং এই পোশাকে তৎকালীন নারীদের অন্দরমহল থেকে বাইরে আসার প্রচলন ঘটেছিল।
বিয়ের শাড়িগুলির জন্য লাল রঙ সবচেয়ে পছন্দের এবং এটি ভারতীয়-বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে নববধূদের কাছে জনপ্রিয়। মহিলারা ঐতিহ্যগতভাবে রেশম, সুতি, ইক্কাত, ব্লক-প্রিন্ট, সূচিকর্ম এবং টাই-ডাই কাপড়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক তাঁত শাড়ি পরিধান করতেন। ঐতিহ্যগতভাবে এবং আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে ব্রোকেড সিল্কের শাড়িগুলির পর পরই সর্বাধিক জনপ্রিয় স্থানে রয়েছে বনসারি, কাঞ্চিপুরম, গাদওয়াল, পাইথানি, মহীশূর, উৎপদা, বাবলপুরি, বালচুরি, মহেশ্বরী, চন্দেরি, মেখেলা, ঝিচা ইত্যাদি।পাটোলা, পোচাম্পল্লি, বোমকাই, খান্দুয়া, সমবলপুরি, গাদওয়াল, বারহামপুরী, বারগড়, জামদানি, তন্ত, মঙ্গলগিরি, গুঁতুর, চন্দেরি, মহেশ্বরী, নুয়াপাটন, তুষার, ইলকল, কোটপাদ এবং মণিপুরী নামে পরিচিত সিল্ক ইকাত এবং সুতির শাড়ি উৎসব এবং দৈনন্দিন পোশাক হিসাবে পরা হয়।বন্ধনী, লেহেরিয়া, বাগরু, আজরখ, সুনগুদি, কোটা ডাবু/ডাবু প্রিন্ট, বাঘ ও কালামকারি নামে পরিচিত টাই-ডাই এবং ব্লক-প্রিন্ট শাড়িগুলি বর্ষা মৌসুমে ঐতিহ্যগতভাবে পরা হতো। অনুষ্ঠানে পরিহিত শাড়িগুলিতে ব্যবহৃত প্রচলিত সূচিকর্মের মধ্যে গোটা পট্টি জনপ্রিয় রূপ নিয়েছে, অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী লোক সূচিকর্ম যেমন মোচি, পাক্কো, খড়ক, সুফ, কাঠি, ফুলকড়ি এবং গামথি সাধারণত অনানুষ্ঠানিক উপলক্ষে পরা হয়।
![]() |
অপ্রা উইনফ্রে |
নিভি, ডেকান অঞ্চল থেকে আজকের সবচেয়ে জনপ্রিয় শাড়ি পরিধান শৈলীতে পরিণত হয়েছে।ব্রিটিশদের সাথে ক্রমবর্ধমান কথোপকথনে দেখা গিয়েছিল যে রাজপরিবারের বেশিরভাগ মহিলারা ১৯০০-এর দশকে পর্দা প্রথা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। কোচবিহারের মহারাণী ইন্দিরা দেবী শিফন শাড়ি জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তিনি জীবনের প্রথম দিকে বিধবা হয়েছিলেন এবং ঐতিহ্য অনুসারে নিরলংকার শোকের পক্ষে সূচীশিল্পিত বরোদা শালস ত্যাগ করেছিলেন। চরিত্রগতভাবে, তিনি তার "শোকের" কাপড়টিকে উচ্চ ফ্যাশনে রূপান্তরিত করেছেন। ফ্রান্সে তিনি তার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যগুলিতে সর্বদা শিফন শাড়ি পরেছিলেন, এবং রাজকীয় ফ্যাশন স্টোরের রেশম শিফন শাড়ির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
![]() |
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শাড়ি উৎসব |
ভারতে শিফন শাড়ি অধিপত্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে সমস্ত দেশ জুড়ে ফ্যাশনগুলিকে একত্রিত করে। এর স্নিগ্ধতা, হালকা ওজন এবং সৌন্দর্য, মার্জিত, স্নেহপূর্ণ কুঁচির শৈলী ভারতীয় জলবায়ুর সাথে আদর্শভাবে উপযোগী ছিল। বিভিন্ন আদালত শাড়ির দেশীয় বা নিজস্ব শৈলী গ্রহণ করেছিল। বেশিরভাগ আদালতে বারাণসীর সোনালি পাড়ের শাড়ি, সূক্ষ্ম জারদোজি কাজ, গোটা, মকাইশ এবং টিলা কাজ যা মসৃণ কাপড়ে শোভিত করেছিল, একইসাথে ঐতিহ্যবাহী এবং অলঙ্কারের অন্তর্নিহিত পছন্দ উভয় চাহিদাই পুরণ করেছিল। ডেকানে মহারাণীদের কয়েকটি আলোকচিত্রে দেখা যায় যে মহিলারা তাদের হাতাবিহীন ব্লাউজ পরিধান করতো, সাথে সমৃদ্ধভাবে সুসজ্জিত কোমর কোট থাকতো। তাদের সমাবেশে শিফন শাড়ি কতটা চটুল হয়ে ওঠে সাভানুরের বেগমের সঙ্গে তা মনে পড়ে যায়। কিছু আদালতে এটি জালি বা নেট কুর্তা এবং অ্যামবুসকৃত রেশমের কোমর বন্ধনীর সাথে সারদি বা জ্যাকেটের সাথে পরা হতো। এগুলির মধ্যে কিছু এত সমৃদ্ধ ছিল যে পুরো জমিটি মুক্তো এবং জারদোজি সূচিকর্ম করা হতো।
তরংগ ফিল্ম রিভিউয়ার জিনাত নেসার জামান দেশে ও ডিয়াস্পোরাতে শাড়ির হালনাগাদ নিয়ে লিখেছেন এভাবে :
''কবি শেখ সাদীর পোশাকের মর্যাদা গল্পটা আমাদের সবারই মনে আছে। তবে মানুষের বৈশিষ্ট্যের, পছন্দের অনেকটাই জানা যায় তার পোশাক দেখে, সেও ঠিক। ট্রেন্ডের থেকে অনুষ্ঠান ও আবহাওয়া অনুযায়ী পোশাক নির্বাচন অবশ্যই বেশি শ্রেয়।ফ্যাশন ডিজাইনারা রেগুলার বলে যান মানুষকে সুন্দর দেখানোর থেকে মানুষের মধ্যে আস্থা জাগিয়ে তোলা তাদের ফ্যাশন পন্যের উদ্দেশ্য। তবে সেটা ক্যারি করা আরেকটা ব্যাপার- তাই একই কাপড় সবাইকে একই রকমভাবে মানায় না।
ইন্টারনেট পূর্ব যুগের মানুষ হওয়ায় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নাম আমরা আকাশে বাতাসে তেমনভাবে ছোট থেকে শুনিনি। ছাত্রাবস্থায় এক্সক্লুসিভ ড্রেস পড়াকে আমরা অনেক স্মার্টনেস মনেও করতাম না, কামিজে বা ওড়নায় লেস লাগিয়ে নিজের মতো করে নেওয়াই স্টাইল ছিল, ভালো জামা জুতা বরাদ্দ ছিল ঈদে।
গত বেশ কিছু বছর শীতপ্রধান দেশে থাকি, ঘরে বাইরে কাজের পোশাকের ধরন বদলে গেছে অনেকটাই। তবে শখের পোশাক হিসেবে সবসময় আছে শাড়ি, আর শাড়ির জন্য ভালোলাগা দিন দিন বেড়েই গেছে, পছন্দের এক একটা শাড়ি যেন এক একটা গল্প!
হয়তো মা-খালাদের শাড়িতে দেখে বড় হয়েছি বলে অথবা ঈদ-পরব, বৈশাখের উৎসবে শাড়ি পরা শুরু হয়েছিল বলে সাবকনশাস মাইন্ড শাড়ি কে পার্ট অফ উৎসব হিসাবে নিয়েছে, অথবা বহুদূরে থাকি বলেই নিজের ঐতিহ্য আজ বেশি প্রিয় হয়েছে।''
![]() |
শাড়ি নিয়ে ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রাচীন গীতিকা |