ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Saturday, June 5, 2021

রবীন্দ্র দর্পণে সামরিক শাসন

জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে রাশিয়ার চিঠি

।।লুবনা ইয়াসমিন।।

জালিয়ানওয়ালা বাগ গনহত্যা স্মৃতিসৌধ।অমৃতসর।

সাহিত্যের নন্দন বনাম বুলেটের বণ্টন : 
রাজ শাসনের শেষ পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার ভারতের বিভিন্ন এলাকায় সামরিক শাসন জারি করেছিল।জালিয়ানওয়ালা বাগে জেনারেল ডায়ারের আদেশে নিরস্ত্র জনতার সমাবেশে গণহত্যার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইটহুড প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাশের দেশ রূপকধর্মী হলেও, এ নাটকেও রবীন্দ্রনাথের ছাচে ফেলা গা জওয়ারি শিক্ষা বা রেজিমেন্টেশান বিরোধিতা প্রকাশ পেয়েছে,

জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে
রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড প্রত্যাখ্যান পত্র

বিভিন্ন রকম জেলহত্যা, বিচার বহির্ভূত হত্যার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে অনেকে এখন পুলিশ ও সেনাবাহিনীর তৎপরতা গুলিয়ে ফেলেছে।পুলিশের কাজ আইন রক্ষা এবং জনগণের সুরক্ষা, পুলিশকে মানুষ মারার ট্রেনিং দেয়া হয় না।যে কোনো সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের মূল অংশ হচ্ছে কমান্ডারদের আদেশে নরহত্যা এবং তা নিয়ে অনুতপ্ত না হওয়া।নিয়ম শৃঙ্খলার নিরন্তর ট্রেনিং দিয়ে সৈনিক এবং তাদের অফিসারদের এই যান্ত্রিক হত্যাকারীর পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়।

সারা বিশ্ব এখন জানে যে সেনাবাহিনীর দলবদ্ধ অপারেশন থেকে ব্যাপক গণহত্যা এবং ধর্ষণ ঘটে, বেসামরিক জনগণকে যুদ্ধের নামে এই গণহত্যা ও ধর্ষণ করলে তাকে এখন যুদ্ধাপরাধ বলে গণ্য করা হয়।যুদ্ধাপরাধের জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক আদালত ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়াতে সামরিক বাহিনী মিলিশিয়ার সহায়তায় এথনিক ক্লিন্সিং ও জেনোসাইড চালানোর দায়ে সার্বিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি মিলোশেভিচকে যাবতজীবন কারাদন্ড দিয়েছে। একই আদালত রাওয়ান্ডাতে টুটসিদের ওপর এথনিক ক্লিন্সিং ও জেনোসাইড চালানোর দায়ে সে দেশের তাবা অঞ্চলের মেয়র জা পল আকায়েউশিকে যাবজ্জীবন কারান্দন্ড দিয়েছে।

বিভিন্ন লেবাসের সামরিক শাসন

রাজত্ব, রাষ্ট্র ব্যবস্থার শুরু থেকেই মানুষের এক দল আরেক দলকে হত্যার জন্য সেনাবাহিনী তৈরি করেছে এবং এবং এই হত্যাকারী বাহিনীকে ভরন পোষণ করতে জনতাকে দেশপ্রেম ও বিভিন্ন কৌশলে বাধ্য করেছে।বিভিন্ন রকম জেলহত্যা, বিচার বহির্ভূত হত্যার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে অনেকে এখন পুলিশ ও সেনাবাহিনীর তৎপরতা গুলিয়ে ফেলেছে। পুলিশের কাজ আইন রক্ষা এবং জনগণের সুরক্ষা, পুলিশকে মানুষ মারার ট্রেনিং দেয়া হয় না।যে কোনো সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের মূল অংশ হচ্ছে কমান্ডারদের আদেশে নরহত্যা এবং তা নিয়ে অনুতপ্ত না হওয়া।নিয়ম শৃঙ্খলার নিরন্তর ট্রেনিং দিয়ে সৈনিক এবং তাদের অফিসারদের এই যান্ত্রিক হত্যাকারীর পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়।ফরাসি বিপ্লবের পর, সেনাপ্রধান নেপোলিয়ান বিপ্লবের বন্ধু  সেজে ক্ষ্মতে দখল করে এবং আমৃত্যু ফ্রান্সকে একের পর এক যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলে।অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে বিপ্লবী নেতা বনে যাওয়া এবং বিভিন্ন বিপ্লবী দলের সমর্থন পেয়ে যাওয়া সেনা শাসকদের তালিকা ও বৃত্তান্ত তৈরি করলে এনসাইক্লোপিডিয়ার কয়েক খণ্ড লেগে যাবে।রোমান সিজারদের সবারই শুরু সামরিক জেনারেল হিশেবে, এদের রাজ্য জয়ের মূল কৌশল শিল ব্যাপক গণহত্যা এবং ধর্ষণ।তারপর নেপোলিয়নের পথ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এসেছে ফ্রাঙ্কো, নাসের, হাফেজ আল আসাদ, আনোয়ার সাদাত, সিসি, গাদ্দাফি, সাদ্দাম, পিনোশে, পেরন, ইদি আমিন, সানি আবাচা, বোকাসা,জাফর নিমেইরি, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়াউল হক, পারভেজ মোশারফ, জিয়াউর রহমান, এরশাদ।গণতন্ত্র এবং বেসামরিক প্রশাসনের বুনিয়াদ ধ্বংস করে দিতে এরা সবাই সামরিক বাহিনীকে জনশাষন বা অপশাসনের প্রতিটি পর্যায়ে ব্যাবহারে করেছে।এই সেনাশাসকেরা বিভিন্ন দেশে মৌলবাদী শক্তির বিকাশে সহায়তা করেছে।আবার আসাদ পরিবার, গাদ্দাফি, সাদ্দাম বাথ সমাজতন্ত্র নামের যে এক নায়কতন্ত্র কায়েম করেছিল তাতে মৌলবাদের বিকাশের বিরোধিতা করা হলেও, একদলীয় ব্যবস্থাকে ধর্ম সঙ্ঘের বিকল্প করে ফেলা হয় এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিভিন্ন অজুহাতে নিশ্চিহ্ন করা হয়।


সেনাবাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতা দখলের পর, বা বিদেশি শক্তির সহায়তায় গেরিলা যুদ্ধ করতে করতে ক্ষমতা দখল করে, অনেক বিপ্লবী শক্তি সরকার, রাষ্ট্র এবং দলিও সামরিক ক্যাডারদের এক কাতারে নিয়ে আসে।এরকম ঘটেছে ভিয়েতনামের ভিয়েত কং,কম্বোডিয়ার খেমার রুজ, ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী গার্ডের বেলায়।এই সংগঠনগুলো অনুসরণ করেছে ফ্যাশিস্ট জার্মানির এস,এস বাহিনীকে, কমিউনিস্ট রাশিয়ার রাশিয়া এবং চিনের লাল ফৌজ সংগঠনকে।এই একদলীয় ব্যবস্থায় সরকার বা রাষ্ট্রীয় দল সেনাবাহিনীকে ব্যাবহার করেছে তার নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধে।কম্বোডিয়ার খেমার রুজ হয়ে দাঁড়ায় ব্যাপক গণহত্যার সমার্থক একটি নাম।তত্বিয় সেনাবাহিনীগুলো গণহত্যা চালিয়েছে সবসময় শ্রেণীশত্রু নিধনের নাম করে।এক্ষেত্রে জার্মানির ফ্যাশিস্ট সেনাবাহিনী, সিরিয়ার বাথ সোশালিস্ট সেনাবাহিনী, ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর কোনো পার্থক্য নেই।১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর সেনাবাহিনীর মেজর, কর্নেল, জেনারেলরা অনেকটা ৪০, ৫০শের দশকের মিশর, ইরাক, সিরিয়ার সেনাবাহিনীর অফিসারদের মতো কে কাকে খুন করে ক্ষমতা দখল করতে পারে তার রক্তক্ষয়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে পড়েছিল।যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বাংলাদেশিদের জেনোসাইড ঘটেছিল, এই খুনে মেজর, কর্নেলরা সেই সেনাবাহিনীর হাতেই প্রশিক্ষিত।


১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পালাবদল এবং অবৈধভাবে সেনা শাসন কায়েম হবার পর সেই শাসনকে বিপ্লবের তকমা দিয়ে ফেলেছিল মাওলানা ভাষানি এবং জাসদ ধরনের অনেক বামপন্থি অনেক দল।মৌলবাদী শক্তিতো পর্দার অন্তরালে অপেক্ষাই করছিলো।স্পেনে রিপাবলিকানদের হটিয়ে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর আজীবন ক্ষমতা দখল এবং রাজতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার সাথে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের খুব একটা পার্থক্য নাই।বার্মা, পাকিস্তান, সিরিয়া, মিশর, থাইল্যান্ডের জান্তাদের লক্ষ্য সবসময় আজীবন ক্ষমতায় থাকা।দেখা যাবে এই জান্তা শাসকেরা কোনো না কোনো পাদ্রি, পুরোহিত, ভিক্ষু, মাওলানা, কোনো নয়া কোনো বিপ্লবীর সমর্থনও যোগাড় করে ফেলে।জাসদ নামের দলটি সমাজতন্ত্রের ধূয়া তুলে হাজার হাজার বাংলাদেশি তরুণকে যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি দেশে অন্তর্ঘাতী গৃহযুদ্ধে জড়িত করে ফেলেছিল।১৯৭১ এর পর আওয়ামী লিগের হাতে গঠিত রক্ষীবাহিনীর হাতে জাসদের অনেক কর্মি নিহত হয়েছে, অনেক কর্মি বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছে।এই দলের নেতা রব, জলিল সামরিক সরকারের প্রভূত সুবিধা পেয়েছে, একই দলের নেতা হাসানুল ইনু, শিরিন আখতার আওয়ামী মন্ত্রী, সাংসদ হয়েছে।আজ পর্যন্ত যত অজুহাতে জাসদ খণ্ড, বিখন্ড হয়েছে তাতে এই দলটির নেতাদের পারস্পরিক অসহনশীলতা বোঝা যায়।একই সাথে বোঝা যায় জাসদ জাতীয় কোনো দল বাংলাদেশে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে দেশটির অবস্থা হতে পারতো কম্বোডিয়া, সিরিয়া বা কলাম্বিয়ার মতো।ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এই অসহনশীল, লোভী নেতারা যে দক্ষিণ এমেরিকার বিপ্লবী জেনারেলদের মতো মাদক ব্যবসার দলিয় পৃষ্ঠপোষকতা করতো এবং সেনাবাহিনীকে তাতে জড়িয়ে ফেলতো তাও বোঝা যায়।দ্রষ্টব্য যে সংসদের ভেতরে এবং বাইরে কখনো এই সেনাবাহিনী তোষণকারী বাম দলগুলো বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জোরালো প্রতিবাদ করে নাই।

সামরিক শাষনের সাফাই ভাষণ : কাইয়ুম চৌধুরী, জেবুন্নিসা গং 

স্পেন, চিলি, সিরিয়া, মিশর, ইরাক, পাকিস্তান, বাংলাদেশে সেনা শাসকেরা সব সময় সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের একাংশের আশীর্বাদ পুষ্ট। ১৯৭১ এ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাঠানো সাংবাদকিদের সবাই পশ্চিম পাকিস্তানের ফিরে গিয়ে গন মাধ্যমে মিথ্যা ফিরিস্তি দেয়।একমাত্র এন্থনি মাসকারেনহাস  লন্ডনে পালিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের জেনোসাইডের খবর ফাঁশ করে দেয়।বাংলাদেশের খুশি কবির, আফসান চৌধুরী, শহিদুল আলমদের প্রিয় পাকিস্তানি লেখক সাংবাদিক জেবুন্নিসা হামিদুল্লাহ ১৯৭১ এ বাটা জুতা কোম্পানির পাঞ্জাবি স্বামীর সাথে অবস্থান করছিলেন আয়ারল্যান্ডে।বাংলাদেশে কি ঘটছে, জেবুন্নিসা তা পশ্চিমা মাধ্যমে খোজ পান নাই তা হতেই পারে না।ধুরন্ধর এই পশ মহিলাকে ১৯৭২এ জাতিসঙ্ঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের দ্বিতীয় প্রধান করা হয়।ঐ পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের প্রধান ছিলেন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়।জেবুন্নিসা আবার টেলিগ্রাম করে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ গঠনের জন্য শুভেচ্ছাও জানিয়েছিলেন।কিন্তু জেনোসাইডের ব্যাপারে আজীবন ছিলেন নিশ্চুপ।বাংলাদেশে বিভিন্ন মেয়াদে সেনা শাসনের দোষর বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিকদের নিয়েও এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি করা যাবে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরীর আপন ভাই কাইয়ুম চৌধুরী ১৯৭১এ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানী বাহিনীর পুরোপুরি কর্নেল ছিলেন।২৫শে মার্চের পর থেকেই পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙ্গালি সৈনিক ও অফিসারদের নিরস্ত্র করে, কঠোর নজরদারির ভেতর গৃহবন্দী করে ফেলা হয়।কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন ব্যতিক্রম।মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার ঘৃণা এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতি তার আনুগত্য আজীবন বহাল থাকে।মুক্তিযুদ্ধের সময় কাইয়ুম চৌধুরীকে ট্রেনিং নিতে পাঠানো হয় বার্লিনে।গৃহবন্দী বাঙালি সৈনিক এবং অফিসাররা আশা করেছিল, কাইয়ুম এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পশ্চিমে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইবে এবং বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরবে।কাইয়ুম তা না করে, বার্লিনে আগত অন্যান্য দেশের অফিসারদের কাছে মুক্তিবাহিনী এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রচার চালায়।কাইয়ুম চৌধুরী এরকম প্রচারণাও চালায় যে ভাই মুনির চৌধুরীকে মুক্তিবাহিনী হত্যা করেছে।পাকিস্তান সেনাবাহিনী কাইয়ুম চৌধুরীকে জেনারেল পদে উন্নীত করে এবং জিয়াউল হক তাকে বিশেষ উপদেষ্টা বানায়।কাইয়ুম চৌধুরী যে কাজটি করেছিল উর্দি পরে, উর্দির বাইরে সেই কাজটি করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিন মোহাম্মদ ও বিচারপতি নুরুল ইসলাম।দিন মোহাম্মদ, কাইয়ুম চৌধুরী, নুরুল ইসলামদের মত যারা জেনেও একটা ব্যাপারকে ধামাচাপা দিতে চায় বা আই ওয়াশ করাতে চায় বা গা সওয়া স্বাভাবিক করে তুলতে চায় তাদের বলা হয় এপলোজিস্ট বা রিভিশানিস্ট।জার্মানদের হাতে নিহত লক্ষ লক্ষ ইহুদি নিধনযজ্ঞকে বলা হয় হলোকস্ট।এই হলোকস্টকে অস্বীকার করা অনেক বুদ্ধিজীবী, লেখক পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশে যেরকম নয়া রাজাকার, নয়া জামাতিদের হাইব্রিডদের বলা হয় বামাতি, যারা বামপন্থি হয়েও জামাতি ইসলামকে সমর্থন করেন।এরকম একটি বুদ্ধিজীবী সংগঠন বাংলাদেশ লেখক শিবির।হাসান আজিজুল হক এক সময় এই সংগঠনের প্রধান ছিলেন, পরে ঘোষণা দিয়ে সরে আসেন।মিডিয়াতে জেনারেল জিয়ার লাউড স্পিকার হিশেবে কাজ করতেন হেদায়েত হোসাইন মুরশেদ, গিয়াস কামাল চৌধুরী, দুজনকেই সামরিক সরকার বারিধারা, গুলশানে প্লট দিয়েছিল।এরশাদ তার দশ বছরে পেয়েছিল ফজলে লোহানিসহ আরো অনেক গুনগ্রাহিকে।এরশাদ কবিতাকেন্দ্র নামে যে রত্নসভা গঠন করে তাতে যোগ দেয় আল মাহমুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, শিকদার আমিনুল হক, ফজল শাহাবুদ্দিন, আবিদ আজাদের মত কবিরা।মাত্র দুই বছরের জন্য অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকা জেনারেল মইন ইউ আহমেদ দোসর হিশেবে পায় মাহফুজ আনামকে, যিনি গোয়েন্দা রিপোর্টগুলোকে খবর বলে পরিবেশন করতেন এবং মাইনাস টু বা বাংলাদেশের বিরাজনিতিকরনের ধারনার পক্ষে জনমত তৈরিতে সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করতেন।বিরাজনিতিকরনের লক্ষ্যে সামরিক বাহিনীর আরেক ভড়ং ছিল সংস্কার।

সাহিত্যের আড়ালে সমরবাদের স্টেটাস কো 

পশ্চিম বাংলার শির্শেন্দু মুখোপাধ্যায়সহ আরো যারা রক্ষণশীল স্টেটাস কোর পক্ষে ফিকশন তৈরি করে তাদেরকে ধরা বেশ সহজ।আনন্দ বাজার ঢাক ঢোল পিটিয়ে এদের কিশোর, তরুণদের মগজে সিধিয়ে দেয়।বাংলাদেশে যারা সামরিক বাহিনী বা মৌলবাদী রক্ষণশীলতার পক্ষে এবং বা কায়েমি স্টেটাস কোর পক্ষে সাহিত্যক্ষেত্রে কাজ করেন, তাদের ভেতর ইমাম বোখারি, আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদদের ধরা সহজ।কিন্তু যারা বামপন্থা, মার্ক্সবাদ, বিপ্লবের নামে সামরিক বাহিনীর রেজিমেন্টেশানের পক্ষে সাহিত্যে কাজ করেনতাদের চিহ্নিত করা অত সহজ নয়।ধরুন কর্নেল তাহেরকে কেন্দ্র করে শাহাদুজ্জামান লিখেছেন ক্রাচের কর্নেল, শাহাদুজ্জামান সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছেন।ধরুন ইমতিয়ার শামীম তার প্রবন্ধে ঘুরিয়ে, ফিরিয়ে স্টালিনের এটা ভালো, ওটা ভালোর পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রসঙ্গে লিখতে থাকেন যে আশির দশকে কৃষি ভিত্তিক গ্রামীণ বাংলাদেশকে নাগরিক কাঠামোতে আনতে যেই রেজিমেন্টেড ফোর্সের দরকার ছিল, তা আর কোনো দলের ছিলো নয়া, সেনাবাহিনী ছাড়া তার আর কোনো বিকল্প ছিল না।চয়ন, খায়রুল হাবিবের কবিতার সামগ্রিক রিভিউতে ইমতিয়ার আরো যোগ করেন, সামরিক জান্তার বিরোধিতার নামে কবিতা ও সামগ্রিক সাহিত্য চর্চা অবসন্ন হয়েছে, কিন্তু ঐ অবসন্নতার ভেতরেও চয়ন তার কবিতার সবুজ আরবান চারা নাগরিকতার দেয়ালে রোপণ করতে পেরেছেন ।এখন এই যে শাহদুজ্জামান কর্নেল তাহেরকে ইতিহাসের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন, ইমতিয়ার শামীম সেনাবাহিনীর রেজিমেন্টেড ফোর্সের দরকারি ধারাবাহিকতা মনে করেন, এসব বুদ্ধিবৃত্তিক একদেশদর্শিতার ভেতর দিয়েই সিরিয়া আজকের জায়গাতে এসে ঠেকেছে।

কর্নেল তাহেরকে নিয়ে লেখার পর ধরুন শাহাদুজ্জামান বুদ্ধদেব বসু নিয়ে লিখলেন।স্টালিনে মোহাচ্ছন্ন ইমতিয়ার শামীম এক সময় চয়ন খায়রুলেকে নিয়ে লিখেছেন।এদের এই পরিমাপগুলো যে প্রবর্তনার নামে প্রোপাগান্ডার পরিধি বিস্তারের প্রয়াস, তা বুঝতে সাহিত্য বিশেষজ্ঞ হবার দরকার নাই।গতকাল এরা যাকে নিয়ে লিখেছে, আজকে আর তাকে বাজার উপযোগী ভাবছে না।প্রোপাগান্ডা ও প্রবর্তনার এই বেখাপ্পা মিশেলে পাঠক, দর্শক বন্দী হয়, একটা পুরো জনগোষ্ঠী এর থেকে ভ্রান্তিবিলাসে ভুগতে পারে।বাংলাদেশে যখন নাট্যকলার অধ্যাপক জামিল আহমেদ শহিদুল জহিরের টেক্সট থেকে মুসলিম ভিক্টিমহুড এবং বাংলাদেশের পত্তনির বিরোধিতার প্যারাডাইম বের করে নেন, দেখা যায় হাত তালি দেবার অনেক লোক পেয়ে যান।

একজন কামালুদ্দিন নিলু যখন মঞ্চে স্টালিনের সমালোচনা করেন, তখন শাহাদুজ্জামান ও ইমতিয়ারদের প্রক্সিরা সেই সমালোচনাকে নাকচ করে দেন।মাওলানা ভাষানি, তারেক মাসুদ, শহিদুল জহির, শাহাদুজ্জামান, সৈয়দ জামিল আহমেদ, শামীম ইমতিয়ার হয় রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড প্রত্যাখ্যানের কারণ বুঝতে পারেন নাই, নয়তো তত্বকে মনুষ্যত্বের চেয়ে বড় করে দেখেছেন।

রবীন্দ্রনাথ যে ছাচবন্দী শিক্ষা নিয়ে হুশিয়ার করেছিলেন

জালিআনওয়ালাবাগে জেনারেল ডায়ারের আদেশে চালানো গণহত্যার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড প্রত্যাখ্যান দিয়ে শুরু করেছিলাম।রবীন্দ্রনাথ ছাড়াই কি এতদূর চলে এসেছি?

নাইটহুড প্রত্যাখ্যানের সারবত্তাতে যেতেই আমাদের সেনাবাহিনী রেজিমেন্টেশান বা নিয়মানুবর্তিতা বলতে কি বোঝে, জনগণের ওপর তার জবরদস্তি প্রয়োগে হিতে বিপরীত কি ঘটে, এই হিতে বিপরীতকে বৃহত্তর কল্যাণের নামে কি ধরনের বুদ্ধিজীবীরা অপরাপর নির্যাতন, ব্যাক্তি বিনাশকে গা সওয়া করে দিতে চায়, তার ফিরিস্তি আমার জরুরি মনে হয়েছে।রেজিমেন্টেশানের একটা সোজা বাংলা হচ্ছে ছাঁচ।সামরিক বাহিনী যাকে বলে রেজিমেন্টেশান, রাজনৈতিক দল তাকে বলে পার্টি লাইন।ব্যাক্তি তার অস্তিত্বের জন্য যেরকম কিছু নিয়মের ছাঁচে থাকতে চায়, আবার তার বিবর্তনের জন্য, তার বিকাশের জন্য সেরকম ঐ ছাঁচ ভেঙ্গে ফেলতে চায়।পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট শাসকদের দমন, নির্যাতন উপেক্ষা করে জনতা বার্লিনের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলেছিল।পাকিস্তানপন্থীরা বাংলাদেশিদের যেই রেজিমেন্টেশান বা ছাঁচে ফেলতে চাইছিল, মুক্তিযুদ্ধ করে বাঙালি সেই ছাঁচ ভেঙ্গে ফেলে ১৯৭২এর সংবিধান গড়েছিল।সেই সংবিধানও আবার একটা ছাঁচ, যে ছাঁচ থেকে আরো ছাঁচের প্রোটোটাইপ গড়া যায়।রবীন্দ্রনাথ তার সারা জীবনে যেসব লেখালেখি করেছে তার পুরোটাই ছাঁচ ভাঙ্গা, খেলা ভাঙ্গার খেলা।

মানুষের শৈশবে, কৈশোরে আরোপিত ছাঁচগুলো স্পঞ্জের মতো গায়ে লেগে থাকে বলেই ধর্মিও প্রতিষ্ঠানে, সামরিক বাহিনীতে টিন এজারদের নেয়া হয়।রুশ বিপ্লবের সময় বলশেভিক দলের সাম্যবাদী প্রবর্তনায় অনুপ্রাণিত তরুণ কবি মায়াকোভস্কি লেনিনকে নিয়ে একের পর এক কবিতা লেখে।মায়াভোস্কির মোহভংগ ঘটে, সবাইকে এক ছাঁচে ঢালার প্রতিবাদ হিশেবেই দেখা যেতে পাড়ে তার আত্মহত্যাকে।এই একই ছাঁচে সমাজকে বন্দী করবার প্রবর্তনার বিরোধিতা করেছিল এসেনিণও, সেই আত্মঘাতী হয়।পাস্তেরনাক, সোলঝেনিতসিন, আখতামোভা, ইয়েফতুশেঙ্কো, রাহুল সাঙ্কির্তায়নদের মতো লেখকেরা সাম্যবাদের সমর্থক হবার পরেও সবাইকে একই ছাঁচে ফেলার বিরোধিতা করেছে।পুরো সমাজকে সামরিক বাহিনীর রেজিমেন্টেশান বা ছাঁচে এনে দেখা, সেখান থেকে নন্দনতত্ত্ব তৈরি করাকেই অনেকে বলেছে জঙ্গলের আইন।বাংলাদেশের সমকালীন সৃজনশীলতায় যে এই ছাঁচে ফেলা রেজিমেন্টেশানের সাফাই ভাষণ তৈরি হয়ে গেছে তা আগে বলেছি।এখানে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের কথা আসতে পারে।তরঙ্গ ওয়েবজাইনে কনক রহমান বিস্তারিত আলোচনায় দেখিয়েছে যে শৈশবের মাদ্রাসা শিক্ষা কিভাবে তারেকের দৃষ্টিকোণকে একটি ছাঁচে ফেলে দিয়েছিল, ঐ একই ছাঁচ থেকে উনি মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছেন, একই ছাঁচ থেকে শিল্পী সুলতানের মূল্যায়ন করেছেন।তারেকের এই ছাঁচে বাধা দীক্ষাই হয়তো তাকে আহমেদ ছফার  ছাঁচগুলোতে প্রভাবিত করেছিল এবং ব্যক্তিকে গনমানুষের বিমূর্ততা থেকে দেখতে উদ্বুদ্ধ করেছি

রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড প্রত্যাখ্যানের চিঠি আর রাশিয়ার চিঠি, একই ব্যক্তির কলম থেকে এসেছে, যে কোনোদিন নিজেকে এবং তার পাঠককে ছাচবন্দী দেখতে চায় নাই।


যে রবীন্দ্র চর্চা রবীন্দ্রনাথকে ক্রমশ সঙ্কুচিত করে!

রবীন্দ্রসংগিতে ভালো গায়ক গায়িকারাও কেনো সংবেদনশুন্য স্নব হয়ে যাচ্ছে!

রবীন্দ্রনাথের গড়া শান্তিনিকেতন, কোলকাতার রবীন্দ্রভারতি, ঢাকার ছায়ানটের ছাত্রছাত্রিদের তুলনামূলক আলোচনা করলে বোঝা যাবে আজকের রবীন্দ্রসঙ্গিত ভালো জানা, রবীন্দ্র অধ্যাপকদের অনেককেই কেনো সংবেদনশুন্য মনে হয়।

শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে অন্ত্যজ জনগোষ্ঠির রাম কিঙ্কর এবং উচু বর্নের, সম্পদশালী পরিবারের ইন্দিরা গান্ধী পাশাপাশি বসে পড়াশোনা করতো।........অনেকেই বলে রবীন্দ্রনাথ তার পড়শি সাওতালদের খবর নিতো না। দ্রষ্টব্য যে শান্তিনিকেতনের শাওতাল পল্লি ছিল রবীন্দ্রনাথদের বোলপুর এস্টেটের অন্তর্গত।শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতির কোনরকম উন্নয়নে সাঁওতালদের কোনো উচ্ছেদের মুখে পড়তে হয় নি, যা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি চা বাগান, আনারস বাগান, কলার খামার ও সুগার মিলগুলোর আশেপাঁশে খাটছে।রবীন্দ্রনাথের এই সর্বজনগ্রাহ্যতার মর্ম বোঝা যায় নজরুল ইসলামের রবিহারা কবিতায়।
ঢাকার ছায়ানটে ইন্দিরাদের পাঁশে কোনো রামকিঙ্করকে চিন্তাই করা যায় না।ওখানে যে নালন্দা স্কুল হয়েছে, সেখানে বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রি সচিব, ব্যাঙ্কার, ব্যাবসায়ি, সম্পদশালীদের ছেলেমেয়ে।সম্পদশালীরা সংবেদনশীল হতে পারবে না, তা কেউ বলে নি।মধুসুদন, রবীন্দ্রনাথ, টলস্টয় এসেছে সম্পদশালী পরিবার থেকে।কিন্তু একটি স্কুলের আচরন যখন হয়ে যায় একটা ওভাল ক্রিকেট ক্লাবের মতো, সেখানে কেতাকানুন হয়ে ওঠে প্রধান, কেতাকানুনকে তখন আমরা ভুল করি সংবেদনশীলতা বলে।তখন একটি মাদ্রাসা আর ছায়ানটে কোনো পার্থক্য থাকে না।''

বাংলাদেশে প্রয়াত বারিন মজুমদারের নির্দেশনায় সরকারি বা পবালিক পরিসরে যে মিউজিক কলেজের বিকাশ হচ্ছিল,তার ধারনা এসেছিল শান্তিনিকেতনের আদলে।সেই মিউজিক কলেজ এখন নামে মাত্র একটি আজেবাজে প্রতিষ্ঠানে পরিনত, স্থায়ী ক্যাম্পাসও পায় নাই।ছায়ানট জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গুনগতভাবে বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোর মতো।মাদ্রাসাগুলোতে যেরকম হুজুরের পরিবার বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত, ছায়ানটের হাইরার্কিও সেভাবে চলে, সেই হাইরার্কিকে সমালোচনা করাও ট্যাবু।কারণ সেই সমালোচনা চলে যাবে আমলাতন্ত্র, কথিত প্রাগ্রসর রাজনিতির সুবিধাবাদি, আপোষবাদি, বুর্জোয়াজি, পাতি বুর্জোয়াজিদের সমালোচনার দিকে।

ওপরে যেভাবে লিখেছি, একই মিশেলে বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির সাংস্কৃতিক নেতাদের যোগসাজসে তৈরি হয়েছে প্রথম আলো।নন্দনের বিকাশকে সর্বজনাশ্রয়ি করা এদের লক্ষ্য নয়, এদের লক্ষ্য মুনাফা।মুনাফা ছাড়া শান্তিনিকেতনও চলবে না।কিন্তু সেই মুনাফার সমিকরন যখন কর্পোরেট ব্যাঙ্কারের দিকে হেলে পড়ে এবং তাদের ছেলেমেয়েরা এসব প্রতিষ্ঠানে অগ্রাধিকার পায়, তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।একজন ব্যাঙ্কার মাসরুর আরেফিনের প্রথম আলো পৃষ্টপোষ্কতা পাওয়া খুব স্বাভাবিক।সনজিদা খাতুনের পরিবারভুক্ত একজন মাঞ্জারে হাসিন মুরাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া খুবই স্বাভাবিক।এসবের ভেতর যেসব অর্নব, শাহানা বাজপায়িদের আমরা পাই,  তাদের অনেকেই ফ্যাশনেবল হলেও, সুধিমহল তাদের ব্যাপারে আহ্লাদিত হলেও সংবেদনশীলতার মাপামাপিতে তারা কোথায় যাবে, ছায়ানট ধরনের উৎকট বৈশম্যপুর্ন স্নব প্রতিষ্ঠানের আলোকে তা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না।এই একই সুধিমহলের প্রিয় চল্লচিত্র নির্মাতা হচ্ছে তানভির মোকাম্মেল, উনি বিদেশে অবস্থানরত বন্ধুদের নেটওয়ার্ক খুব যত্ন করেন, রবীন্দ্রনাথের মতো ওনারও একটি বোট আছে, যাতে উচ্চমুল্যে বন্ধুরা নদি বিহার করতে পারে।নদী বিহারে তুষ্ট বন্ধুরা চমৎকার সব ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে।এরা সেই প্রমোদতরিতে করে যে শিলাইদহের কুঠিবাড়িতেও ঘুরে আসে তাও লেখা বাহুল্য।এরা যে মানিক ব্যানার্জির দারিদ্র নিয়ে হাহুতাশ করে তাও অস্বাভাবাবিক নয়।বরং আজকের মানিক ব্যানার্জিদের একটি বই নিয়ে তাদের আলোচনা বরং অস্বাভাবিক ঠেকবে, যেহেতু তা দেখা যায় না।সেটা এরা তুলে রাখে রোজার সময়ের বিশেষ পোস্টিং এর জন্য।

আমার এক খালা যেতো ধানমন্ডিতে পাপিয়া সারোয়ারের বাসাতে গান শিখতে।গান শেখাশেখি উসিলা।সেটা ছিল, বড়লোকদের বৌদের আড্ডা।ওনারা সবাই পাপিয়া ডাকে পাপ্পু দি।পাপ্পু দি একটু শেখায়, এটা ওটা বলে, কখনো আড্ডাবাজ ধনবতিদের হাতে বাসা ছেড়ে দাওয়াতে চলে যায়।এর ভেতর বাসার যত কাজের ছেলে মেয়ে, বুয়া ডাইনিং টেবিলের আসেপাশে মেঝেতে ঘুমাবার আয়োজন করে।সেও এক বিশাল বাহিনী, এতক্ষন যে এরা কোথায় ছিল।পাপি্যারও ট্রেনিং হয়েছে শান্তিনিকেওনে।রেজওয়ানা বন্যারও।পাপিয়ার বাসার সেই বিশাল গৃহ পরিচারক বাহিনীর ঘুমাবার আয়োজনে বোঝা যায়, রামকিঙ্কর আর ইন্দিরার পাশাপাশি বসে পাঠ নেবার পরিবেশ কোথা থেকে গড়িয়ে কোথায় তলিয়েছে।ব্যাপারটা যে শুধু পাপিয়া বা পাপ্পুদির বাসাতে তাই নয়, খোদ শান্তি নিকেতন হয়ে গেছে বাবুবাজির রিয়েল এস্টেট।বাউল মেলাতে স্থানীয় কেউ খাতির জামিয়ে নিলো জাপানি এক তরুন বা তরুনের সাথে, ইয়েনের শক্তি বলে সেই তরুন বা তরুনীকে দিয়ে আখড়ার নামে জমি কিনিয়ে নিল, একটা মোটেল চালু হয়ে গেলো।একেবারে যেভাবে  মাহফুজ আনাম, মতিউর রহমান ট্রান্সকমের লতিফুর রহমানকে মন্ত্রমুগদ্ধ করে ফেলেছিল।আর কোলকাতার রবীন্দ্রভারতি হচ্ছে নিম্ন মধ্যবিত্ত কমপ্লেক্সের আখড়া।ঢাকার ছায়ানট, কোলকাতার রবীন্দ্রভারতি, বোলপুরের শান্তিনিকেতন এক জায়গাতে সমান তালে এগিয়েছে, সেটা হচ্ছে বিগট্রি।ঢাকার ছায়ানটে ঢুকতে একটা ব্যাঙ্কের চেয়েও বেশি দারোয়ান পেরুতে হবে। শান্তিনিকেতনে ছবি তুলবার সময় সাইকেল চালক কোনো অতি উতসাহি এসে বলবে, এখানে ছবি তুলতে অনুমতি লাগে, ছবি অনেক খানে না কি মেনিপুলেট করা হয়, ব্লা ব্লা ব্লা।আমি হাসতে, হাসতে খুন।শান্তিনিকেতনের বাড়িগুলোর সামনে আলখাল্লাধারী রবীন্দ্রনাথকে উলংগ করে নাগা সন্যাসিদের কাতারে নিয়ে কার কি লাভ বুঝি না, যেখানে এখন সবাই ইচ্ছে মত লুকিয়ে ইনবক্সে উলংগ হচ্ছে, যত খুশি পর্নো দেখতে পাচ্ছে।


বৈশম্যের শুরু সেই গোড়াতেই।ইন্দিরা শান্তিনিকেতনের পাঠ চুকিয়ে, অন্যান্য উচ্চ শিক্ষা নিয়ে সমাজতন্ত্রি ফিরোজ গান্ধিকে বিয়ে করেছিল।ফিরোজের সমাজতান্ত্রিক দিক্ষা ছিল আন্তরিক, নিজের প্রতিষ্ঠিত সংবাদ পত্রে কংগ্রেসের ধনি তোষন এবং স্ববিরোধী ততপরতাগুলোর কড়া সমালোচনা করতে লাগলেন, যার তর্জনি ওচানো ছিল শ্বশুর নেহেরুর দিকে।ইন্দিরা গেলো বাবার পক্ষে, কংগ্রেস সর্বভারতীয় দল থেকে রুপান্তরিত হলো স্টেস্টাস কো দলে, যার ফলশ্রুতিতে আজকের বিজেপির বিকাশ।নেহেরু সারা জীবন সমাজতন্রের কস্মেটিক্স স্লোগান বজায় রেখেছিল।ঢাকাতে ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদুল হকের সাথে নেহেরুর তুলনা করা ঠিক না।মাপের দিক দিয়ে দুজন ভিন্ন হলেও দুজনেই ইতিহাসের ভিন্ন মোড়ে রাবিন্দ্রিক আবহকে সামাজিক ও নান্দনিক ভারসাম্যের মাপকাঠি ধরেছিলেন।নেহেরু ইন্দিরাকে শৈশবে পাঠিয়েছিল শান্তিনিকেতনে।রবীন্দ্র চর্চায় পাকিস্তানি নিশেধাজ্ঞা পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথকে সর্বসাধারনে গৃহিত করাই ছিল ওয়াহিদুল হকের ব্রত।সেই সাধারন যখন রবীন্দ্রনাথকে তাদের নৈমিত্তিকতায় নিয়ে নিয়েছে, তখন দেখা গেলো ছায়ানট হয়ে উঠেছে স্নবদের ক্লাব।এটা অনেকটা ভারতের কংগ্রেস দলের রুপান্তরের মত।একজন স্নবের সংবেদনশিলতা ঠিক সেতু নয়, এটা স্টেটাস কো রক্ষার ঢাল বা বর্ম।এই স্নবারির গুনে এখন রবিন্দ্র চর্চা দিয়েই রবীন্দ্রনাথকে সঙ্কুচিত করা হচ্ছে।

রবীন্দ্র ভাস্কর্য, মস্কো
রাশিয়ার চিঠি

জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবোত্তর রাশিয়াতে দু সপ্তাহ কাটিয়েছিলেন।রাশিয়ার চিঠির ছত্রে ছত্রে বিস্ময়ের পাশাপাশি এক সাবধানবাণীও ফুটে ওঠে :
''এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই তা বলি নে; গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে, শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে—কিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না—সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিম্বা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।''

সেই অশনিসঙ্কেতের মুখে পতন ঘটে সোভিয়েত ইউনিওনের, ভেঙ্গে যায় বার্লিনের দেয়াল।

।।লুবনা ইয়াসমিন।।