ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Saturday, June 5, 2021

রবীন্দ্র নায়িকাদের মনন ও সাজসজ্জা

।।বাবলী হক।।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য সর্বতোমুখী, তার ব্যাপ্তি অন্তহীন এবং পরিপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বলা শুরু করলে বলতে হয়–বলা আমার ফুরাবে না। আজ শুধুমাত্র তাঁর সর্বাধিক আলোচিত চারটি উপন্যাসের নারী চরিত্রের মনন ও তৎকালীন সাজসজ্জা নিয়ে কথা বলব।

বাঙালি নারী-সমাজে সাহিত্য, সংগীত, শিল্প এমনকী পোশাকেও নবযুগের বিকাশ ঘটেছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে। সমাজের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে ঘেরাটোপ-ঢাকা পালকিপ্রথা ভেঙে আঁটসাঁট পোশাকে ঠাকুরবাড়ির বউ কাদম্বরী দেবী স্বামীর সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেরিয়েছেন ময়দানে। সে সময় সতেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী বাঙালি মেয়েদের পরিচিত করালেন বাইরে পরার রুচিসম্মত সাজের সঙ্গে। আটপৌরে ধাঁচে শাড়ি পরায় তেমন সৌষ্ঠব ছিল না। স্বামীর পরামর্শে বোম্বাই যাবার প্রাক্কালে ফরাসি দোকান থেকে তিনি পোশাক বানিয়েছিলেন। বোম্বাইয়ে গিয়ে প্রথমেই জবরজং অস্বস্তিকর ওরিয়েন্টাল ড্রেস বাদ দিয়ে পারশি মেয়েদের শাড়ি পরার মিষ্টি, ছিমছাম ধরনটি নিজের পছন্দমতো সামান্য অদলবদল করে নিলেন। নতুন ধাঁচের এই শাড়ি পরার 'বোম্বাই দস্ত্তর' ঢংটি ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের খুব পছন্দ হল। জ্ঞানদানন্দিনী শাড়ির সঙ্গে ছায়া-সেমিজ-ব্লাউজ- জ্যাকেট পরাও প্রচলন করেন। আর তাঁর মেয়ে ইন্দিরা দেবী মাথায় শাড়ির আঁচলে ছোট্ট ঘোমটা টানা প্রবর্তন করেন। শাড়ির সঙ্গে ব্যবহার করতেন নানান ফ্যাশানের লেস দেওয়া জ্যাকেট ও ব্লাউজ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, "বিলিতি দরজির দোকান থেকে যত সব ছাঁটাকাটা নানা রঙের রেশমের ফালির সঙ্গে নেটের টুকরো আর খেলো লেস মিলিয়ে মেয়েদের জামা বানানো হত।"

উনিশ শতকের ফ্যাশান ধারণাটি পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের গল্প, উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্র থেকে।


চোখের বালি

চোখের বালি'র রচনাকাল ছিল বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। ঘটনাগত দিক দিয়ে চোখের বালি ত্রিভুজ প্রেমের গল্প। মহেন্দ্র-আশা-বিনোদিনী কাছাকাছি তিনটি বিন্দুতে থাকলেও খুব কাছেই আরেকটি চরিত্রও পাশে ছিল, বিহারী। এরা চারজনই অপ্রাপ্তির শূন্যতায়, অস্তিত্বহীনতার সংকটে দগ্ধ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নৈর্ব্যক্তিকভাবে বিনোদিনী-আশা মহেন্দ্র-বিহারীর স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের পরস্পর সংঘাত, যন্ত্রণা, আত্মপীড়ন ও মানসিক অবদমনের কথা উল্লেখ করেছেন। এদের সংকট শুধুমাত্র হৃদয়বৃত্তির নয়, যে সমাজব্যবস্হার বিরুদ্ধে তাদের চিন্তাভাবনা প্রতিবাদ করেছে, সেই সমাজের সঙ্গেই আজীবন যুক্ত হয়ে থাকতে হয়েছে। মহেন্দ্রর স্ত্রী আশালতা এক অনভিজ্ঞ বালিকাবধূ। বয়স তার কত হবে এই বারো-তেরো কিংবা চৌদ্দ-পনেরোর বেশি নয়। আশালতা বোকা- ভালো মানুষ, নিরীহ গোবেচারা–শ্রেণির গৃহস্থ ঘরেরবধূ এই জাতীয় পটভূমিকায় বিকশিত এটাই আশা সম্পর্কে শেষ কথা নয়। বিনোদিনীর প্রতি মহেন্দ্রর প্রণয়াসক্তি ও তার গৃহত্যাগজনিত ঘটনায় আশালতার আত্মমর্যাদার ভিন্ন এক উপলব্ধিতে তার ব্যক্তিত্বের সুপ্ত উজ্জ্বলতা প্রকাশ পায়। "সে তাহার মাসির উপদেশ, পুরাণের কথা, শাস্ত্রের অনুশাসন কিছুই মানিতে পারিল না–এই দাম্পত্যস্বর্গচ্যুত মহেন্দ্রকে সে আর মনের মধ্যে দেবতা বলিয়া অনুভব করিল না। এ আজ বিনোদিনীর কলঙ্কপারাবারের মধ্যে তাহার হৃদয়-দেবতাকে বিসর্জন দিল।" (পরিচ্ছেদ ৪২) বিনোদিনী শিক্ষিতা সুন্দরী ও নাগরিক রুচিশীল মার্জিত। তার বাবা ধনী না হয়েও একমাত্র কন্যাকে মিশনারি মেম রেখে বহুযত্নে লেখাপড়া ও কারুকার্য শিখিয়েছিলেন। অকস্মাৎ পিতার মৃত্যুর পর বিধবা মা তাকে কোনো রকম পাত্রস্থ করেন এবং অনতিকাল পরেই সে বৈধব্য বরণ করে। তার সজাগ অধিকারবোধ, রুচিবোধ, রোম্যান্টিক জীবনদৃষ্টি, বৈদগ্ধ্য ও অন্তর্দ্বন্দ্ব হল উনিশ শতকের মধ্যবিত্ত শ্রেণিচরিত্র। রবীন্দ্রনাথ বিনোদিনীর সমগ্র জীবনপরিপ্রেক্ষিত সূক্ষ্ম মানসপ্রবণতার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে তার মূল জটিলতা উত্থাপন করেছেন। বিনোদিনীর নিরানন্দ অস্তিত্বহীন বৈধব্যের জন্য মহেন্দ্রর একদিনের প্রত্যাখ্যান যে দায়ী–এই ভাবনা তার অবচেতন মনে সক্রিয় ছিল।
আশালতার অপটুতার কারণে নেপথ্য থেকে মহেন্দ্রর খাবারের ব্যবস্হা, জামা কাপড় গুছানো সর্বত্রই বিনোদিনীর সেবা মহেন্দ্র অনুভব করত। "বিনোদিনীর রচিত পশমের জুতা তাহার পায়ে এবং বিনোদিনীর বোনা পশমের গলাবন্ধ তাহার কণ্ঠদেশে একটা যেন কোমল মানসিক সংস্পর্শের মতো বেষ্টন করিল। আশা আজকাল সখীহস্তের প্রসাধনে পরিপাটি পরিচ্ছন্ন হইয়া সুন্দর বেশে সুগন্ধ মাখিয়া মহেন্দ্রর নিকট উপস্থিত হয়, তাহার মধ্যে যেন কতকটা আশার নিজের, কতকটা আর-একজনের – তাহার সাজসজ্জা- সৌন্দর্য আনন্দে সে যেন গঙ্গাযমুনার মতো তাহার সখীর সঙ্গে মিলিয়া গেছে।" ভালোবাসার উৎসব দুজনের সমাপ্ত হয় না তাই বিনোদিনী আশার সঙ্গিনী হল আদরের গালি 'চোখের বালি' সম্পর্ক পাতিয়ে! বিহারী মহেন্দ্রের পরম বন্ধু। যাকে রাজলক্ষ্মী "স্টীমবোটের পশ্চাতে আবদ্ধ গাধাবোটের মতো মহেন্দ্রর একটি আবশ্যক ভারবহ আসবাবের স্বরূপ দেখিতেন ও সেই হিসাবে মমতাও করিতেন।" বিহারীর বিনোদিনীকে দেখেই মনে হয়েছিল, এই শিখা ঘরের প্রদীপ হয়ে যেমন জ্বলতে পারে তেমনি ঘরে আগুনও ধরিয়ে দিতে পারে! মহেন্দ্রের প্রতি বিনোদিনীর প্রণয়ের চেয়ে অহংবোধ বেশি কাজ করেছে৷ বিনোদিনী যে তুচ্ছ অবজ্ঞার বস্তু নয় সেটাই প্রমাণ করতে চেয়েছে সে। লেখক নিজেই বলেছেন, "যে জ্বালা মহেন্দ্র তাহার অন্তরে জ্বালাইয়াছে তাহা হিংসার না প্রেমের না দুইয়েরই মিশ্রণ বিনোদিনী তাহা ভাবিয়া পায় না। দগ্ধ হইতেই হউক বা দগ্ধ করিতেই হউক মহেন্দ্রকে তাহার একান্ত প্রয়োজন।"
মহেন্দ্র বিনোদিনীর রহস্যময় আচরণে বিস্মিত হয়ে ভাবে, " কিছুই বুঝিবার যো নাই! স্ত্রীলোকের মন।" 'চোখের বালি'তে রবীন্দ্রনাথ সাজসজ্জার খুব একটা উল্লেখ করেননি 'শেষের কবিতা' য় যেভাবে পোশাক বর্ণিত হয়েছে। তারপরও বিভিন্ন সময়ে উপন্যাসটি যেভাবে নাটক ও চলচ্চিত্রে এসেছে, বোঝা যায় উনিশ শতকের শেষভাগের নায়ক-নায়িকার পোশাক পরিকল্পনা করতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। ১৯০৪ সালে অমরেন্দ্রনাথ দত্ত এই উপন্যাসের নাট্যরূপ দেন। ১৯৩৮ সালে অ্যাসোসিয়েট পিকচার্সের প্রযোজনায় 'চোখের বালি' নিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ২০০৩ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষ ঐশ্বরিয়া, প্রসেনজিৎ ও রাইমা এই তিন সুপারস্টারকে নিয়ে চোখের বালি করলেন। পরবর্তীতে নেটফ্লিক্সে দেখতে পাই অনুরাগ বসুর সিরিয়াল ‘স্টোরিস বাই রবীন্দ্রনাথ টেগোর’। এছাড়া বহুবার এই সামাজিক রোমান্টিক উপন্যাসটি টিভি সিরিজ ও মঞ্চায়নে দেখা দিয়েছে।



শেষের কবিতা

'শেষের কবিতা'র প্রকাশকাল ১৯২৮ সাল যখন রবীন্দ্রনাথ ব্যাঙ্গালোরে অবকাশ যাপন করছিলেন। শিলং পাহাড়ের পরিবেশে উচ্চশিক্ষিত, উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে চরিত্রগুলো এসেছে। অমিত রায় ব্যারিস্টার। লাবণ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ডিগ্রিতে কৃতি ছাত্রী। সিসি-কেটি-লিসি-লিলি ও নরেন প্রত্যেকে শিক্ষিত ও পাশ্চাত্যানুসারী। চরিত্রগুলোর বৈশিষ্ট্য হল দ্বন্দ্বহীন মানসিকতা কেবল লাবণ্য ব্যতিক্রম। রোমান্টিক এই উপন্যাসের প্রেমভাবনা অনন্য। লেখক হালকাভাবে ও ইঙ্গিতে গভীর কথা বলেছেন। আধুনিকতার উৎস থেকে মোহনার দীর্ঘ তরঙ্গপথ পার হয়েছে এই উপন্যাসটি। এখানে চরিত্রগুলো স্থিতিশীল বদ্ধকাঠামো ভেঙে মুক্তি পায় অনুভূতির বাস্তবতায়। শিলং পাহাড়ের নির্জনতায় মোটর দুর্ঘটনায় অমিত-লাবণ্যের অকস্মাৎ দেখা হওয়া যেন দৈব ঘটনা, ইঙ্গিতপূর্ণ, প্রাত্যহিকতার ঊর্ধ্বে, কল্পনাপ্রসূত। দুর্লভ অবসরে অমিত লাবণ্যকে দেখল–"মেয়েটির পরনে সরু-পাড়-দেওয়া সাদা আলোয়ানের শাড়ি, সেই আলোয়ানেরই জ্যাকেট, পায়ে সাদা চামড়ার দিশি ছাঁদের জুতো। তনু দীর্ঘ দেহটি, বর্ণ চিকন শ্যাম, টানা চোখ ঘন পক্ষ্মচ্ছায়ায় নিবিড় স্নিগ্ধ; প্রশস্ত ললাট অবারিত করে পিছু হটিয়ে চুল আঁট করে বাঁধা, চিবুক ঘিরে মুখের ডৌলটি একটি অনতিপক্ক ফলের মতো রমণীয়। জ্যাকেটের হাত কব্জি পর্যন্ত, দু হাতে দুটি সরু প্লেন বালা। ব্রোচের বন্ধনহীন কাঁধের কাপড় মাথায় উঠেছে, কটকি-কাজ-করা রুপোর কাঁটা দিয়ে খোঁপার সঙ্গে বদ্ধ।" এই ছিল রবীন্দ্রনাথের ভাষাতে লাবণ্যের সাজসজ্জা!
অধ্যক্ষ অবনীশ দত্ত মাতৃহীন মেয়ে লাবণ্যকে গড়ে তোলেন কঠিন সাধনায়। তিনি এমনও ভেবেছেন যে লাবণ্য বিয়ে না করে, পাণ্ডিত্যের সঙ্গে চিরদিন গাঁটবাঁধা থাকলেই বেশি খুশি হবেন। লাবণ্য বাস্তববাদী, সূক্ষ্মমানসিকতাসম্পন্ন। তার জীবনে হৃদয়াবেগের জায়গাটি নেই। জীবনক্ষেত্রে তার ধারনা – “জীবনের উত্তাপে কেবল কথার প্রদীপ জ্বালাতে আমার মন চায় না। জগতে যারা উৎসব সভা সাজাবার হুকুম পেয়েছে কথা তাদের পক্ষেই ভালো। আমার জীবনের তাপ জীবনের কাজের জন্যই।” কিন্ত অমিতের সঙ্গে দেখা হবার পর তার উদ্দীপ্ত প্রেমে লাবণ্য সাড়া না দিয়ে পারেনি। অমিতের প্রবল প্রাণশক্তি, অকুণ্ঠিত অনুরাগ-প্রকাশ লাবণ্যর দ্বিধা-সংকোচকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। কবিতাপাঠের মধ্য দিয়ে অমিত ও লাবণ্য কাছাকাছি এসেছে। কিন্তু এই কাছে আসার স্বরূপটি অন্যরকম। অমিত যখন লাবণ্যকে গভীর ভাবে আবিষ্কার করতে চেয়েছে, বিয়ের প্রস্তাব পর্যন্ত করেছে তখনই লাবণ্যের মর্ত্যমুখী মন স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে, ভিতরে সে যেসব ভাব গড়ে তুলেছে সংসারটা তার উপযুক্ত নয়। অমিত তার জীবনের একটা দিককেই গ্রহণ করতে চায়, সমগ্র জীবনের বাস্তবতাকে নয়। লাবণ্য অমিতকে বলছে, “কিছুই তোমার সহজে পছন্দ হয় না, সেই জন্যই তোমাকে এত ভয় করি মিতা।”
লাবণ্যের অন্তর্দ্বন্দ্ব, শ্রেণি-মনস্তত্ত্ব, আগামীর দুর্ভাবনা তাকে নিয়ে যায় মিলন-পরিসরে নয়– বিচ্ছেদের বাণীতে। অমিত আর তার সমাজ এক নয় সে বুঝতে পেরেছিল সিসি, কেটি, নরেনদের দেখা পেতেই। লাবণ্য তার বিনাশী অন্তর্দ্বন্দ্বের অবসানে নিজেকে নারী রূপে আবিষ্কার করল। তার জীবনের সিদ্ধান্তগুলো ভেসে যায়, গলে যায় অমিতের প্রেমের উত্তাপে। শোভনলালকেও গ্রহণ করল সেই ভালোবাসার উত্তাপেই। অমিত স্বসমাজের কেতকীকে গ্রহণ করে নিজের কবিসত্তা ও দাম্পত্য সম্বন্ধকে 'ঘড়ায় তোলা জল' আর 'দিঘির জল' এক করে ফেলে অন্তর্দ্বন্দ্বে উদ্বেগ ও শুন্যতার শিকার হয়নি। লাবণ্য ও অমিত-চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হল তারা দুজনেই উপন্যাসের পরিণতিতে একটি বিশ্বাসের জায়গায় স্পষ্ট হয়েছে। উপন্যাসের পরিণামে লাবণ্যের সীমাহীন প্রেম ও কেতকীর সীমাবদ্ধ প্রণয়ে অমিত তৃপ্ত। শেষের কবিতার সাজসজ্জা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজে বলেছেন, "মেয়েদের বেশের বর্ণনায় আমি আনাড়ি, তার পরিভাষা জানি নে।" কেটি মিটারকে নিয়ে লিখেছেন– "মোটের উপর চোখে পড়ে, উপরে একটা পাৎলা সাপের খোলসের মতো ফুরফুরে আবরণ, অন্দরের কাপড় থেকে অন্য একটা রঙের আভাস আসছে। বুকের অনেকখানিই অনাবৃত।"
এই উপন্যাসে অমিতের দুই বোন সিসি আর লিসি, রবীন্দ্রনাথ বলছেন "যেন নতুন বাজারে অত্যন্ত হালের আমদানি, ফ্যাসানের পসরায় আপাদমস্তক যত্মে মোড়ক করা পয়লা নম্বরের প্যাকেট বিশেষ। উঁচু খুরওয়ালা জুতো, লেসওয়ালা বুককাটা জ্যাকেটের ফাঁকে প্রবালে-অ্যাম্বারে মেশানো মালা, শাড়িটা গায়ে তির্যকভঙ্গিতে আঁট করে ল্যাপ্টান। এরা খুট্-খু্ট্ করে দ্রুত লয়ে চলে, উচ্চৈঃস্বরে বলে, স্তরে স্তরে তোলে সূক্ষ্মাগ্র হাসি, মুখ ঈষৎ বেঁকিয়ে স্মিত-হাস্যে উঁচু কটাক্ষে চায়, –জানে কাকে বলে ভাবগর্ভ চাউনি, গোলাপি রেশমের পাখা ক্ষণে ক্ষণে গালের কাছে ফুর ফুর ক'রে সঞ্চালন করে এবং পুরুষ বন্ধুর চৌকির হাতার উপর বসে সেই পাখার আঘাতে তাদের কৃত্রিম স্পর্দ্ধার প্রতি কৃত্রিম তর্জন প্রকাশ করে থাকে।" অমিতের কাছে –ফ্যাশানটা হল মুখোশ,স্টাইলটা হল মুখশ্রী!


নৌকাডুবি

'নৌকাডুবি' উপন্যাসে মনোবিশ্লেষণের চেয়ে ঘটনা বিবরণ মূলত বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। এর কাহিনির পটভূমি দেশের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে রচিত। গ্রাম থেকে শহর। কলকাতার কলুটোলা, দরজিপাড়া, কাশী-এলাহাবাদ পর্যন্ত এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। উপন্যাসের চরিত্রগুলো মধ্যবিত্ত সমাজের নিরুত্তাপ বাস্তবসত্য। ভারতীয় ত্যাগধর্মী জীবনবোধের সঙ্গে দৈব ঘটনা জুড়ে লেখক নৌকাডুবির দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে রমেশ-কমলা-হেমনলিনী ও নলিনাক্ষকে নিয়ে কাহিনীতে ঘটনার যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে সেটা হৃদয়বৃত্তির নয়, প্রচলিত সমাজ সংস্কারের। কমলার বিয়ে হয়েছিল নলিনাক্ষের সঙ্গে। নববিবাহিত কমলা বিয়ের সময় স্বামী নলিনাক্ষকে দৃষ্টি মেলে দেখবার অবকাশ পায় নাই। কালবৈশাখী ঝড়ে নৌকাডুবির পর নির্জন দ্বীপে রমেশকে স্বামী ভেবে নেয়া কমলার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। বিস্ময় জাগে রমেশ তিনমাস কমলাকে সুশীলা ভেবে সংসার করেছে! কিন্ত কমলা তো তার স্বামীর নাম জানত, সেও কি একবারও বুঝতে পারেনি এ মানুষটি নলিনাক্ষ নয় রমেশ! একদিন হঠাৎ কমলার যথার্থ পরিচয় পেয়ে রমেশ তার সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টা করতে থাকে। রমেশ কমলাকে পেয়ে হেমনলিনীকে বিস্মৃত হয়েছিল আবার কমলার যথার্থ পরিচয় পেয়ে হেমনলিনীর প্রতি প্রেমানুভূতি জেগে ওঠা সবই রমেশ চরিত্রের দ্বিধান্বিত, স্বভাবদুর্বলতার লক্ষণ। হেমনলিনীর প্রতি প্রণয়ানুভূতি ও কমলার প্রতি কর্তব্যবোধ রমেশকে সঙ্কটের সম্মুখে এনে দাঁড় করাল।
মীরাট যাবার পথে স্টেশনে উমেশের সঙ্গে কমলার হঠাৎ দেখা, ক্ষেমঙ্করীর সূত্রে নলিনাক্ষের বাড়িতে কমলার আশ্রয়, হেমনলিনীর ভাই যোগেন্দ্রের সঙ্গে রমেশের কাশী আগমন ও তার পরবর্তী একের পর এক ঘটনা অতিনাটকীয়। দৈব ঘটনা পল্লবিত হয়ে কাহিনি বিস্তার লাভ করেছে কয়েকবার। যেমন দুটি নব দম্পতির একই সময়ে, একই নদীতে নৌকা ডুবি হয়। আবার দৈবচক্রে কমলা নলিনাক্ষের গৃহে আশ্রয় পেয়ে স্বামীকে ফিরে পেল।
নৌকাডুবিতে রমেশের প্রতি কমলার ভালোবাসা প্রাধান্য না পাবার কারণ, হিন্দুশাস্ত্র মতে স্বামী সম্পর্কে কমলার সংস্কার। কমলার মনে সমাজের চিরকালীন সংস্কার এমনই প্রবল যে অদেখা অচেনা স্বামী নামক মানুষটার জন্য নিমেশে ভালোবাসা তুচ্ছ হয়ে গেল। কমলা যখন জানল রমেশ তার স্বামী নয়, আশ্চর্যজনক ভাবে কমলা দ্বিধাহীন হয়ে সিদ্ধান্ত নিল। “রমেশের প্রতি—অজ্ঞানজনিত প্রথম প্রণয়ের আকর্ষণ এবং স্বামী নামক সংস্কার, কমলার হৃদয়ে দুই সমান দৃঢ় হয়ে 'দুই পক্ষের অস্ত্র চালাচালি' করতে ব্যর্থ হয়েছে।” সংস্কারের বিরুদ্ধ কোনো ভাবনা কমলার মনে কোনো অবস্থাতেই প্রশ্রয় পায়নি। হেমানলিনীর প্রেমবোধ নীরব ও সংযত। তার মানসিক দৃঢ়তা প্রবল। রমেশের অন্তর্ধানে সে পারিবারিক বিরোধিতার সঙ্গেই শুধু নয় নিজের সঙ্গেও বোঝাপড়া করে অবিশ্বাসী প্রেমকে প্রজ্জ্বলিত রেখেছে। নির্লিপ্ত ভাবে সে বলতে পারে "যেটুকু পাইবার মতো পাওয়া সেটুকু পাইয়া যেন সুখী হতে পারি, তার চেয়ে বেশি যতটুকুই পাওয়া যায় তার অনেক ভার, অনেক দুঃখ।"
এই উপন্যাসে হেমনলিনীর চরিত্রটির সাজসজ্জার বর্ণনা লেখক এভাবে করেছেন— তার শাড়ি পরার, চুল বাঁধবার নিজস্ব বিশেষ ধরন আছে৷ তার হাতের প্লেন বালা এবং তারাকাটা দুইগাছি করে সোনার চুড়ি যা দেখে রমেশের বুকের মধ্যে একটা ঢেউ যেন কণ্ঠ পর্যন্ত উচ্ছসিত হয়। তার সযত্ন কবরীর ভঙ্গি, গ্রীবার উপরে নরম কেশ, তার নীচে সোনার হারের একটুখানি আভাস। বাম কাঁধ ছুঁয়ে নেমে আসা লম্বা আঁচল তাকে করে তোলে অনন্যা। নৌকাডুবির নান্দনিক অভিজ্ঞতার অভাব ও শিল্পসত্তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং সমালোচনার মুখে পড়ে 'বঙ্গদর্শন'এ বিচলিত হয়ে বলেছিলেন, "খণ্ড খণ্ড করে এ রকম গল্প বেরলে জিনিসটা অসমান হয়ে পড়ে। সব জায়গা ত সমান সরস ও কৌতুকাবহ হতেই পারে না— সুতরাং মাঝে মাঝে বিরুদ্ধ সমালোচনা শুনে হতাশ হতোদ্যম হতে হবেই।"(চিঠিপত্র ৮) ঋতুপর্ণ ঘোষ একটা ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথকে জাপটে ধরে তিনি বড়ো হয়েছেন।রবীন্দ্রসাহিত্য নির্ভর বেশ কয়েকটি গল্প নিয়ে তিনি চলচ্চিত্রও করেছেন। নৌকাডুবি তাদের মধ্যে একটি। কিন্তু ঋতিপর্ণর এই কাজটি চলচ্চিত্রের ভাষাতেও যেরকম টেনে রাখতে পারে নি, সেরকম রবীন্দ্রনাথকেও এখানে পাওয়া যায় নি। নায়িকাদের সংলাপ স্বগতোক্তির মতো মনে হয়েছে। সাজসজ্জাও অতি অবাস্তব লেগেছে। তবে গান সিলেকশন চমৎকার ছিল।


ঘরে বাইরে

চলিত ভাষায় লেখা রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস 'ঘরে বাইরে'। ডায়রির মাধ্যমে মনঃকথন উচ্চারণে নিখিলেশ, সন্দীপ ও বিমলার আত্মকথা লিখিত হয়েছে।
সন্দীপ ও নিখিলেশের আত্মকথা ঘটনা-অন্তর্গত কিন্তু বিমলার আত্মকথা অনেকটা স্মৃতিচারণমূলক। বিশ শতকের ব্রিটিশ-শাসন বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনকে ঘিরে এই উপন্যাসের মূল কাহিনি। বিদেশী দ্রব্য বর্জন, নেতাদের বিভিন্ন হাটে-ঘাটে উদ্দাম বাগ্মিতা, পড়াশোনা ছেড়ে ছাত্রদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ, অগ্নিসংযোগ, ডাকাতি, হিন্দু-মুসলমান বিরোধ— ঘটনাগুলো এই উপন্যাসে রূপ লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার শিল্পিত প্রতিফলন এই তিনটি চরিত্র। রাজনৈতিক তত্ত্ব ছাড়াও এখানে নিখিলেশ ও বিমলার দ্বন্দ্বময় প্রেমতত্ত্ব রচিত হয়েছে। নিখিলেশের চাওয়া সংসার আবর্তের বাইরের বিমলার লোকোত্তর প্রণয়কে উপলব্ধি করা।
বাহুল্য সরিয়ে আইডিয়া মুগ্ধতায় বিমলাকে সে নির্বিশেষ পেতে চায়। তালা-দেওয়া লোহার সিন্দুকের জিনিস নিখিলেশ চায়নি। জ্ঞানে, শক্তিতে, প্রেমে পূর্ণবিকশিত বিমলাকে পেতে চেয়ে বলেছে, — "তুমি একবার বিশ্বের মাঝখানে এসে সমস্ত আপনি বুঝে নাও। এই ঘরগড়া ফাঁকির মধ্যে কেবলমাত্র ঘরকর্নাটুকু করে যাওয়ার জন্যে তুমিও হও নি, আমিও হই নি। সত্যের মধ্যে আমাদের পরিচয় যদি পাকা হয় তবেই আমাদের ভালোবাসা সার্থক হবে।"
কিন্তু রক্তমাংসের স্বতন্ত্র সত্তা বিমলা শুধু আইডিয়া নয়, সে সংসারমুখী নারী। নিখিলেশ স্বভাব বৈরাগী। বিমলার অতৃপ্ত মানসিক শূন্যতায়, স্বদেশী আন্দোলনের স্লোগান তুলে সন্দীপের প্রবেশ। বিমলার কথায়, "সন্দীপের কথার সুর যেন স্পষ্ট হয়ে আমাকে ছুঁয়ে যায়, তাঁর প্রেমের চাউনি যেন ভিক্ষা হয়ে আমার পায়ে ধরে। আমি সত্য কথা বলব, এই দুর্দান্ত ইচ্ছার প্রলয়-মূর্তি দিন-রাত আমার মনকে টানছে! মনে হতে লাগল, বড় মনোহর নিজেকে একেবারে ছারখার করে দেওয়া। তাতে কত লজ্জা, কত ভয়, কিন্তু বড় তীব্র-মধুর সে।" 'ঘরে বাইরে'র শেষে নিখিলেশ উপলব্ধি করে নিজের আইডিয়ার আবর্তে বিমলাকে গড়তে চেয়ে সে স্ত্রীকে হারিয়েছে। অবশেষে নতুন চেতনায় সংসারসীমার মাঝেই বিমলাকে গ্রহণ করে। তেমনি দুঃখ ও হারানোর মাঝে বিমলাও উপলব্ধি করে, কেবল বাস্তবের স্হূলতায় তৃপ্তি হয় না। আবেগে তরঙ্গে ভেসে যেতে হয়। দুজনের নব উপলব্ধি হয়েছিল—তবে দেরিতে৷ সবশেষে বিমলা বলছে– "আমি আগুনের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসেছি; যা পোড়বার তা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, যা বাকি আছে তার আর মরণ নেই।" এই উপন্যাসে বিমলার সাজসজ্জা এসেছে চিরন্তন সাবেক সম্ভ্রান্ত ঘরের নারীরা যেভাবে সাজতেন সেরূপে-"দিনের কাজ সেরে, গা ধুয়ে, যত্ন করে চুল বেঁধে, কপালে সিঁদুরের টিপ দিয়ে, কোঁচানো শাড়িটি পরে...।" 'ঘরে বাইরে' এই উপন্যাসটিরও চলচ্চিত্রায়ণ হয়েছে এবং করেছেন সত্যজিৎ রায়। এই চলচিত্রে সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রনাথকে পেতে চেয়েছেন এবং আমরা যারা দর্শক তারা রবীন্দ্রনাথকে এখানে পেয়েছিও।
।।বাবলী হক।।
৩১/০৫/২১
ঢাকা

আত্মপ্রতিকৃতি ফটোগ্রাফি : তামজিদ নওরিন পূর্ণি

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস-সৈয়দ আকরম হোসেন, রবি বন্দনা - সম্পাদনাঃ বারিদবরণ ঘোষ, ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল- চিত্রা দেব।