ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Saturday, June 5, 2021

মালাকুল মউত

।।মাহবুব শাহরিয়ার।।

কাঠফাটা সারকাজমের মইধ্যে মাথা ফাটা কাঠঠোকরায় খুঁজে খালপাড়
হিজল গাছ
কবেই কাইটা লইছে রাজার পাইকে,
হেইচ্যা লইছে মাছ।
রাস্তার নিচে বয় খাল
গোপন সংবাদ বইয়া বইয়া যায়, তলে তলে
কত জহরতের চান্দা পকেটে
জহুরির পকেটে লাল বাত্তি ,পাবলিকে ফালায় বাল।
‘এইটা কোনো কবিতা অইলো, কী লেখলাম এইটা?’ চিন্তার আগা-মাথা খুঁইজা পাওনের চেষ্টা চলতে থাকে মাথার ভিত্রে। সুতার মাথা হারায়া গেলে যেমনে পুরা নাটাই খুঁজন লাগে, ঠিক ওমনে তোলপাড় চালায় বুলবুলে চিন্তার ভাঁজে ভাঁজে। শাহবাগ থেকা হাঁইটা আইতে আইতে এই কয়টা লাইন আইলো মাথায়, মাগার পছন্দ তো হইলো না। দিন দিন সব যাইতাছে উল্টায়া পাল্টায়া, লেখায় কোনো প্রেম’ই নাই। আর প্রেম লেইখাই বা কোন্‌ ইয়ে ফালাইবো, কোনোদিন তো একটা অক্ষরও পাবলিশ হইলো না কোনো পেপার পত্রিকায়। বালের প্রেমিকা আর বন্ধুবান্ধবের টিটকারি হুনতে হুনতেই তো দিলের আধা পেয়ার মোহাব্বত নাই হয়া গেছে, বিষের মতন লাগে মানুষ দেখলে। মহল্লার কেউ তাকাইলেই মনে হয় হালায় মনে মনে হাসতাছে, বালের কবি আমার।

বিষ্যুদবাইরা রাইত গিনি এমনই হয় প্রত্যেক হপ্তায়, খাট্টামিঠা নানান টেস্টে পার হয়া যায়। হপায় ইংলিশ রোডের মোচড়ে ঢুকে বুলবুলের আত্মা, কলতাবাজার অহনো দেরি আছে। বাটা পায়ে হাটার এই দিন কবে ফুরাইবো, নাকি আদৌ ফুরাইবো না? কবে যে মন ভইরা মাল খায়া মান্নান ভাইরে কয়েক’শো টেকা বখশিশ দিতে পারবো, আহ। চিন্তা ঘুরতেই থাকে হালার, আর বালের কবিতা লেখনের অপরাধে নিজেরে এর মধ্যে বুলবুল কয়েক’শো বার ফাঁসিতে ঝুলায়া দিছে। বিকট আওয়াজ কইরা ট্রাক যায় পাশ দিয়া, পারলে রাস্তার থেকা দুই একটা রিকশা শুদ্ধা বাজায়া লয়া যায় দানব গিনি। বুলবুলের মাথায় একটা সিনেমার সিন আহে, ”কোনো একদিন রাইতে শুনশান রাস্তায় আইতে সমে হুদাই ধোলাইখালের দিক থেকা হর্ন আর ডিপার মারতে মারতে আইতাছে একটা বেডফোর্ড ট্রাক, রাস্তা খালি।  চিত্রামহলের সামনে খাড়ায়া দেহা যায়, আগে পিছে কেউ নাই খালি ট্রাক আর বুলবুল।”
সাধারণ সিনারিটা হঠাৎ চেঞ্জ হয়া বুলবুলের হাতে একটা রকেট লঞ্চার আয়া পড়ে আর ট্রাকের হেডলাইটগিনি সব স্টেডিয়ামের ফ্লাড-লাইটের মতন উজ্জ্বল হয়া যায় আর বিকট এক হর্ন বাজতে থাকে। রাস্তার মাঝখানে বুলবুল, ধোলাইখালের দিকে ট্রাক উইড়া আইতাছে মনে হয়। ওয়েস্টার্ন সিনেমার ডুয়েল শুরু হওনের আগের কোনো মিউজিক চিন্তা করন যায় কিংবা সিদ্দিক বাজারের ‘বাংলাদেশ ব্যান্ড’ পার্টি যহন বিয়া কিংবা মিছিলে বাজাইতে বাজাইতে ক্লান্ত হয়া উড়াধুড়া বাজায় জলদি জলদি ফিনিশিং দিয়া পেমেন্ট লওনের আশায়, ঐ মিউজিকও ব্যাকগ্রাউন্ডে মাইরা দেওন যায়। ট্রাকটা মেসবা হোটেল পার হইতে থাকে শাই শাই কইরা আর বুলবুল রাস্তার মাঝখানে কান্ধে রকেট লঞ্চার রাইখা সোজা তাকায়া থাকে নিশানায়। হয় ট্রাক নয় কবি, কালকার ইত্তেফাকে যে কোনো একজনের ছবি তো আইবোই। ততক্ষণে ট্রাক রায়সাব বাজার মোচড়ে আর কবি প্রখর নিশানায় পাথর-কুঁদা মূর্তির মতন কান্ধের রকেটটারে কী জানি কইতে থাকে মনে মনে। মোচড়ের ট্রাফিক স্ট্যান্ডটা ততক্ষনে উড়ায়া দিয়া পিছের চাক্কাটা মোচড় পার হইতাছে, আর ঠিক ওইসমে কান্দুপট্টির গল্লি দিয়া এক ল্যাংটা ছেরি দৌড় দিয়া চোক্ষের পলকে বাজারের পিছের গল্লিতে ঢুইকা যায় ।
বাজনা বন, খালি ট্রাকের চাক্কার বিকট ব্রেকের আওয়াজ আর ধুঁয়া। হার্ড ব্রেক বুঝি এইটারেই কয়, ছ্যাস্রাইতে ছ্যাস্রাইতে একদম সোজা বুলবুলের নাক বরাবর আয়া থামে ।

খালি ধুঁয়া দেহা যায় কতক্ষণ, কোনো আওয়াজ নাই ।
এক মিনিট, দুই মিনিট, তিন মিনিট চইলা যায়। ধুঁয়া কাইটা ট্রাকের বর্বর চেহারার অবয়ব ফুইটা উঠে কবির চোখে , তহনো কান্ধে রকেট বয়া রইছে। এই নিশি রাইতের শুনশান সিনারি তে ট্রানজিশনের মতন কান্দুপট্টির গল্লি থেকা আস্তে আস্তে ততক্ষণে একটা ঢোলের আওয়াজ আগাইতাছে মেইন রাস্তার দিকে ।
কী হয়, কী হয় কেউ ভাবতাছে না। রাস্তা খালি, ভাবার তো লোক লাগবো। পুরা সিনারি’তে কবি আর ট্রাক, ট্রাকের ড্রাইভার আছে নাকি তা’ও বুঝা যাইতাছে না। কান্দুপট্টির দিকে ঢোলের আওয়াজ আরো বাড়ে, কিমুন জানি মরিয়া হয়া বাজাইতাছে। অস্থির বাজনা একটা, মনে হইতাছে কেউ জান বাঁচানের লেগা বাজাইতাছে। যতই বাজনা আগায় ততই অস্থিরতা বাড়ে, ট্রাক আর কবি মুখোমুখি, কেউ লড়ে না। কানের পর্দায় চাপ পড়তে থাকে কবির, ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জইমা গড়ায় কপাল থেকা নাকের দিকে। এইটুকু উত্তেজনা তো সিনেমায় থাকেই, নাইলে তো চলে না। ঢোলের আওয়াজে চাইরদিকে কী জানি এক উত্তেজনা কান্ধের উপর আয়া পড়তে থাকে আর ওই উত্তেজনার মূল মিঠাই এর বাক্সটা এইবার দেহা যায়, ব্যাংগা আইতাছে। গল্লি থেকা বাজাইতে বাজাইতে ব্যাংগা বাইর হয়, এইবার অস্থিরতা কমতে থাকে। কবিও মনেহয় ট্রাকের দিক থেকা কিঞ্চিৎ ওইদিকে মনোযোগ সরায়, আর এই চান্সে একফোঁটা ঘাম নাক বায়া রকেটের উপরে পইড়া যায়। আরে এ কুন তেলেশমাতি? ঘামের ফোঁটা রকেটের উপরে পড়তে না পড়তেই রকেটটা এক লহমায় এক ল্যাংজা কাট্টা বান্দর হয়া গেছে, এইসব কী? এই মাঝ রাইতে ইংলিশরোডে নিওনের এই ম্যান্দা মার্কা আলোয় কী হইতাছে এইসব!

-আজকা কি মাল বেশি খায়া ফালাইছি?
-নাহ, তর আজ্রাইল তরে লইতে আইছিলো।(ব্যাঙ্গা ততক্ষণে সামনে আয়া পড়ছে)
-তাইলে মারলো না ক্যান?
-দেখলি না তর আমল মাঝ রাস্তা দিয়া এক লোড়ে আজ্রাইল’রে দেহা দিয়া গেলো।
-আমল?
-হ , তর আমল।
-মাগার ল্যাংটা ছেরি ক্যা?
-তুই কাপড় পিনছস ক্যা?
-সতর ঢাকতে।
-খালি লেংটি পিনলেই তো পারতি!
-খারাপ দেহা যায় না!
-খারাপ মাইনষের চোখে, মনে, কর্মে। তর শরীর কি নাপাক? নাপাকি তর নফসে।

রকেট এক লাফে কবির কান্ধের থেকা ব্যাংগার কান্ধে গিয়া উঠে। ইয়ার দোস্তের মতন ভাব লয়া ব্যাংগার কান্ধের গামছা দিয়া মুখটা পুইছা ট্রাকের ড্রাইভারের জানালার দিকে এক নজরে চায়া থাকে, মনে হয় চোখে চোখে কথা কয় রকেট। চোখ নামেই না হালার।

ব্যাংগা আসমানের দিকে দেহায়, ‘দেখ কত রুহ, দেখ এই কালা আসমানেও দেহা যায় তাগো সোয়াবের জ্বালোয়া’ কবি এক নজরে তাকায়া থাকে। কত তারা এই অমাবস্যার আন্ধারে দেহা যায়, না জানি তাগো কত জনমের সোয়াব এই আলো দিছে পাপের রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট হয়া রাস্তা দেহানের লেগা। কবির মনে হয়, ‘আমার মায়’ও আছে বুঝি হোনে’ । গুনা তো তেমন করে নাই বেটি, নামায কালামেই সারাজীবন কাটাইলো আর আমি হইলাম মদোক্তি। মায়ের ভাবনায় হারায়া যাওনের মধ্যেই রকেট আবার এক ফাল্‌ দিয়া কবির কান্ধে, ধড়ফড়ায়া উইঠা কবি আবার তাকায় ব্যাংগার দিকে। কই ব্যাংগা? কই ট্রাক? কান্ধে রকেট আর রকেটের কান্ধে গামছা। এত বড় ট্রাক, একটা আলাম মানুষ সব কই গেলো গা? 
মনের ভুল, চোখের ভুল হইতে পারেই মানুষের; নেশার চোদনে উল্টাপাল্টা দেহা যাইতেই পারে, মাগার রকেট! রকেট তো কান্ধেই, আবার ব্যাংগার গামছাও আছে।
তবদা লাইগা খাড়ায়া থাকে কবি, মনে হইতে থাকে কত হাজার বছর জানি পার হয়া যাইতাছে। এক নজরে তাকায়া থাকে, যুদি আবার ওই ট্রাক দেহা যায় তাইলে তো আবার রকেট লঞ্চার হয়া যাইবো। মাগার তবদাই লাইগা থাকে, কিছুই হয় না। অনেক দূর থেকা ঢোলের আওয়াজ পাওন যায়, মনে হয় ব্যাংগা ঢোল বাজাইতে বাজাইতে রথ খোলার দিকে যাইতাছে আবার পরক্ষণে মনে হয় কোট-কাচারির দিকে। কান্ধে খালি রকেট আর মন ভরা সওয়াল, ‘কী হইলো?’

ঘটনা তো ঘইটা গেলো, মাগার এতবড় রাস্তায় কি একটা কুত্তাও নাই যে দেইখা একটা ঘেউ কইরা আওয়াজ দিলো না?  একটা  সুন্দর বাতাস আইতে থাকে দক্ষিণ দিক দিয়া। মনে হয় কান্দুপট্টির দিক থেকা আইতাছে, ফুরফুরা ঘেরাণ’ও আছে। এই ছেরিগিনিরে বেশ্যা কয় মাইনষে, ঘিন করে মহল্লার লোকে। আবার কতজনেই তো রাইত বিরাইতে আয়া হাজিরা দেয়, বাংলা খাইতে আইলে সবই দেহা যায়। ক্যাঠা হাজী আর ক্যাঠা পাঁজি।
বাইত যাওন দরকার, ভাত খাওনের সাইরেন বাজতাছে প্যাটে। রকেট’রে কিছু কওনেরও সাহস হয় না, আজরাইলের চোখে চোখ রাখে যে হালায় অরে কেমনে কী কই? থাউক কান্ধেই থাউক, সকালে উইঠা যাইবো গা নে। বুলবুল হাঁটা দেয় রায়সাব বাজার মোড়ের দিকে। কতক্ষণ খাড়ায়া আছিলো মনে নাই, অনেকক্ষণও হইতে পারে আবার দুই এক মিনিটও হইতে পারে।
সিনেমার সিনারি ভাবতে গিয়া কুন ঝামেলা হয়া গেলো, কবিতার চিন্তা কুনসমে পলাইছে মাথার থেকা; এহন খালি মাথায় ঘুরতাছে রকেট, ব্যাংগা, আজরাইল এইসব। রকেট, ব্যাংগা, আজরাইল ঘুরতেই থাকে মাথায় আর কান্ধে রকেট বয়াই রয়। কোনো টু শব্দ করে না হালায়, এইটা আবার কিমুন বান্দর! পালা বান্দর হইলেও তো মাইনষের এক কান্ধের থেকা আরেক কান্ধে যায়, এই হালায় একদম বোবা লাইগা রইছে পুতলার মতন। ভাবনায় ব্যাংগার ঢোল এক লুপে বাইজা যাইতেই থাকে আর এর মধ্যে দিয়া কবি আগায়া যায় একটা ঘোর এর রশির এক প্রান্ত ধইরা। ঘোরটাই মনে হয় তারে বাড়ির রাস্তা চিনায়া লয়া যায়।

জেলা পরিষদের পুরানা দালানটা পশ্চিম দিকে পুলিশ ক্লাব আর ইউসুফ বেকারির দিকে চায়া রইছে এই রাইতের আন্ধারে। কেক বিস্কুট খাইবার মনে চায় বুঝি, নাইলে এমনে তাকায়া থাকবো ক্যা? জেলা পরিষদের শইল্যের উঠান বায়া ওভার ব্রিজটা গেছে কাচারির দিকে, মনে হয় আইনের প্যাঁচ লোড়া লোড়ি করে এই ওভার ব্রিজ দিয়া। প্রশাসন আর আইনের প্রেমের মেটাফোর মনে হয় মাঝে মধ্যে এই ব্রিজ টারে।
বায়ে মোচড় লইলেই কারকুন বাড়ি লেন, আন্ধার হয়া রইছে। কবির রাস্তা এইটা, রাইতে মাতাল থাকলে উর্দি আলাগো ডরে এই রাস্তায়ই যাওন লাগে বাইত। আজাদ হল পার হইলে এক গাড়ি উর্দি থাকবোই, আর বাটে পাইলে শেষ। টেকার টেকা, ইজ্জতের ইজ্জত সব যাইবো। হুদাই নিরীহ মদারু ধইরা এই হয়রানি কইরা এক পৈশাচিক মজা লুটে এরা,  মনে হয় ট্রেইনিঙেই শিখায়া দেয় এগোরে এইসব। কবির যদি কোনোদিন পুলিশ বন্ধু হয় তাইলে জিগাইবো ভাইবা রাখছে, ‘হাও টু হ্যারাজ ইনোসেন্ট পিপল’ – এইটার ট্রেনিং একাডেমিতে দেয় কিনা। যদিও পুলিশ বন্ধু হওনের কোনো সম্ভাবনা নাই, তাই এই উত্তরও মনে হয় পাওয়া যাইবো না। কারকুন বাড়ি লেনের একটা গন্ধ আছে, এইটা একটা কেমিস্ট্রির মতন লাগে মাঝে মইধ্যে। যেদিনই মাতাল রাইতের আকেলা সফর হয়, ওইদিনই পাওন যায় এই ঘেরাণ। মাঝে মধ্যে মনে হয় কেউ উপর থেকা এক বালতি আতর স্প্রে কইরা দিলো, মাঝে মধ্যে লাগে চাইরদিকের সব বাড়িতে বুঝি নানান ফুলের বাগান। এই গল্লিতেই বলে দেওবন্দ থেকা মাওলানা পাশ কইরা আহনের পর মাখন হাজীরে পরীরা ধইরা লয়া গেছিলো গা টমটমে কইরা। কি আজব কাহিনী, রূপ গুণে পাগল হয়া আগুনের জ্বীন পরী বলে মাটির মানুষ উঠায়া লয়া গেছে। বিশ্বাস করতে না চাইলেও দুদু মাম্মা আর জয়ফুলের মুখে গেন্ডারিয়ার হুজুরের কোহকাফ যাত্রা আর জ্বীনের বাদশার লগে দেন দরবার কইরা চকের আলাউদ্দিন হালুইকরের এক কেজি জিলাপির বদলে মাখন হাজীরে ফিরত আননের গল্পটা মনে হয় এই গল্লিতে আইলে। এই গল্প মার মুখেও কয়েকবার হুনা আছে, বিশ্বাস হয় আবার হয় না। এই গল্পে ঈমান আননের দোটানায়ই পইরা থাকন লাগে সবসমে। জ্বীনের বাদশার মাইয়া যেহেতু কিডন্যাপ করছিলো মাখন হাজীরে টমটম লয়া, লগে পাইক পেয়াদায় আছিলো নিশ্চয়। জ্বীনের বাদশার মাইয়া পরী, তাইলে খুবসুরতও আছিলো শিওর। আমি হইলে আইতাম না। গেন্ডারিয়ার হুজুর রে কইতাম যাও গা, বাইত গিয়া কয়ো শান্তিতে আছি কোহকাফে। মাঝে মধ্যে রাইতে টমটমে কইরা মহল্লার উপর দিয়া ঘুইরা যাইতাম, বাড়ি ঘরটা দেইখা যাইতাম একটা সান্তা ক্লজ ভাব লয়া ।

কুনসমে কারকুন বাড়ি লেনের মসজিদ, বরিশাইলাগো মেস পার হয়া গেছে খেয়ালই নাই। বুলবুল তাকায়া দেহে নাসিরুদ্দিন সর্দার লেনের মাথার ডাস্টবি টা দেহা যাইতাছে। ডাইনে গেলে আল মঈন মাদ্রাসা, বায়ে গেলে কল্লা শাহ বাবার মাজার। লাইট একটাও জ্বলে নাই রাস্তার, ঘুঁটঘুইটা আন্ধার। খানে গো বাড়ির বারান্দার একশ পাওয়ারের বাত্তিটার আবছায়ায় ঠাহর করন যাইতাছে আর কি। 
কিছু একটা সমস্যা আছে সামনে, কী জানি একটা গন্ডোগোল এই গল্লি তে। বুলবুল আগে বাড়ে না, কিছু একটা গড়বর হইছে। রকেটও এতক্ষণে একটা নড়াচড়া দেয়। শুনশান চাইরদিক, একটা বাতাসের ঝটকা আতখা চাইরদিকের দরজা জানালা কাপায়া দিয়া গল্লি টারে এক লহমায় জিন্দা বানায়া ফালায়। একতলা বাড়ি গিনির চাল, টিনের দরজা, জানালা সব একবারে কাঁইপা উঠে। পিছন থেকা একটা বাতাস আয়া কবিরে ধাক্কা দিয়া ফালায়া দিবার চায় মাগার আরেকটা জাজবা কাজ করে, কবি পরে না, খালি লইড়া উঠে একটু। কারা জানি বিড়বিড় কইরা কী পড়তাছে, অসংখ্য মৌমাছির মতন আওয়াজ হুনা যায়। গায়ে কাঁটা দিয়া উঠে আর কানে বাজে দূর থেকা ব্যাংগার ঢোলের আওয়াজ। এর মধ্যে দিয়া শন শন আওয়াজে এই গল্লির মধ্যে বাতাস বইতে থাকে, বইতে থাকে, বইতেই থাকে। চাইরদিক মনে হয় জইমা গেছে, রাস্তার কলে পানিও পড়ে না, খালি বাতাস বয়। কী হইতাছে আজকা এইসব, দৌড় দিয়া পলানেরও উপায় নাই। এমন কিছু একটা আছে যেইটা লোড় দিবার দিবো না, চাইরদিক দিয়া আটকায়া রাখছে সব। রকেট একদম ঠায় বহা, নিঃশ্বাসও বন্ধ মনে হয়। কান্ধে যে কেউ আছে টেরই পাওন যায় না, মাগার সে সব আঁচ করতাছে।  রকেট জানে কী ঘটতাছে, কে আইছে। যে আইছে সে’ও রকেটরে টের পাইতাছে। তাই আগাইতাছে না, বুঝবার চাইতাছে।
বাতাসটা কইমা যাইতাছে, কিন্তু আছে ।  
শক্ত হয়া গেছে হাত পাও, রকেট এক হাত কিংবা পাও দিয়া কান্ধে খামচি দিয়া রাখছে। রকেটের খামচিটা মনে হইতাছে সাহস, ডরাইস না বুলবুল ডরাইস না। রকেট বুলবুলের অন্তরের ভিতরে ঢুইকা আওয়াজ দিতাছে, চাইরদিকে মেঘ জমনের মতন একটা আতংক জইমা উঠতাছে। অপেক্ষা করতাছে দুইজনে, এরপর কী? আজরাইলের উপর তো কেউ নাই , সে’ই তো ছাইড়া দিলো । এ কোন বিপদ আবার?
বরাবর নাসিরুদ্দিন সর্দার লেনের দিক থেকা একটা আওয়াজ আইতাছে। মনে হইতাছে কেউ জোরে দৌড়ায়া আইতাছে অনেক দূর থেকা, বিড়বিড় আওয়াজও বাড়তে থাকে। চাইরদিকে লাখ লাখ মৌমাছির মতন আওয়াজ, দৌড়ানের আওয়াজও আস্তে আস্তে বাড়তাছে। বাড়তে বাড়তে এক সময় দেহা যায় এক ছাদ থেকা আরেক ছাদে পাও ফালায়া এক বিরাট দেহ আগায়া আইতাছে, এক পাও খানে গো বাড়ির ছাদে, আরেক পাও আঁকালি ব্যাপারীর ছাদে। আইতে আইতে সমস্ত আতঙ্ক কান্ধে লয়া সেই বিশাল দেহ কারকুন বাড়ি লেনের মাথায় ডাস্টবিনের মুখে আয়া খাড়ায়া যায়। এইটা কি তাইলে ওইটা!
সারাজীবন পীরজাদা হাসান পাগলার মুখে হুনা কাহিনী, কুঞ্জবাবুলেনের উকিল গো বাড়ির ছাদে এক পাও আর ভাঙ্গা বাড়ির ছাদে আরেক পাও দিয়া যে জ্বীন দুপুইরা রইদ্যে সুতপা গো বাড়ির ডাব গাছে উইঠা পাও ঝুলাইতো সেই গল্পের চরিত্র কি তাইলে সামনে খাড়া? রাস্তার দুই দিকে দুই পাও তারখাম্বার মতন রাইখা খাড়ায়া  রইছে, অপরিচিত আতঙ্ক। বাতাস থাইমা গেছে,  লাখ লাখ মৌমাছির বিড়বিড় আওয়াজও বন্ধ। মাথার ভিতর ঘুরতাছে মাখন হাজীর কোহকাফ নগরের যাত্রা, খালি জ্বীনের বাদশার মাইয়া নাই। রকেটের শক্ত হাত কিংবা পায়ের ছোঁয়া টের পাওয়া যাইতাছে এখনো কান্ধে – আমি আছি ডরাইস না। 
ঘড় ঘড় কইরা আওয়াজ আহে উপর থেকা। তার খাম্বার মতন পাও থেকা শুরু কইরা এইবার উপর দিকে তাকায়া দেহা যায় খালি একটা মাছের আইশটার মতন শরীর, আর উপরে গর্দান ছাড়া একটা চ্যাপ্টা মাথার পুরাটাই চোখ দিয়া ভরা ।

-কোন গুর্দার শরির তর নাচিজ এর জাত? (একটা বিশাল মাটির কলসি যদি কোনো হলরুমের মধ্যে দিয়া কেউ টাইনা লয়া যায়, যে আওয়াজ হইবো, তার চাইতে অনেক বেশি ফাপা আর ঘড়ঘড়া এক কন্ঠ)
-কে আপনে ? (মনে হইলো রকেট জবাব দিলো)
-আমার ঘর, আমার বাড়ি সব ধ্বংস কইরা জিগাস আমার পরিচয়? কেউরে ছাড়ি না, আমি ঘ্যাসুংগিঢ়া । ছাড়ছি কোহকাফ, আইছি দুনিয়ায়। আমার শান্তির ঘর খালপাড়ের পর, ধ্বংস করছে নাচিজের দল। আমার তওলা পাড়ের বাগান, আমার ঘাটপাড়ার শান্তিখানা সব ধ্বংস করছে নাচিজের বাচ্চা রা। আমি কেউরে ছাড়ুম না, কেউরে না।
-আমি কি করলাম?
-আমি তুমি নাই, সব এক। যারে পামু তারেই আছড়ায়া মারুম।
-যাইতে দে (আবার রকেট ভিতর থেকা জোর গলায় হাক দেয়)
-যাবি তো, একবারেই যাবি দুনিয়া ছাইড়া নাচিজের জাত।

ঘ্যাসুংগিঢ়া যেই উপর থেকা হাত টা বাড়াইছে আর কথা নাই, রকেট একটা বিদ্যুতের মতন ছুইটা গেলো হাতের উপর দিয়া। পুরা গল্লি একটা ফুলকির আলোয় দেহা গেলো একবার, আবার সব আন্ধার। ঘ্যাসুংগিঢ়া নাই, গল্লির মাথায় দেহা যাইতাছে না। রকেট’রে দেহা যাইতাছে খানে গো বাড়ির বারান্দায়, চোখ দুইটা জ্বলতাছে লোহা গলা আগুনের মতন। আবার দৌড়ানের আওয়াজ, একলগে লাখ লাখ মৌমাছির বিড়বিড়। কোনদিক দিয়া আইতাছে কিচ্ছু বুঝা যাইতাছে না, খালি বুঝা যাইতাছে বিপদ। সোজা তাকায়া আছি রকেটের চোখে, জ্বলতাছে, সব জ্বালায়া দিবো মনে হইতাছে। চাইরদিকে মৌমাছির বিড়বিড় চলতাছে, সব চুপ আবার। আবার গায়ে কাঁটা দিয়া উঠতাছে। রকেট নাই, চোখের পলকে হাওয়া। আমি দিলাম দৌড়, জান বাঁচান ফরজ। খালি দুই পাও আগাইছি আর উপর থেকা এক বিরাট চুন সুরকির ড্যালা পড়লো সামনে, যাইবার দিবো না। খানেগো বাড়ির ছাদ থেকা খালি আলো দেহা যাইতাছে, মাঝে মধ্যে কী জানি উইড়া যাইতাছে চাইরদিকে। বিশাল যুদ্ধ, আর এই যুদ্ধের মাঝখানে আমি। আগে বাড়লেই রাস্তা আটকায়া দিতাছে ঘ্যাসুংগিঢ়া, ভিতরে রকেটও কথা কইতাছে না। মাথার সাইড দিয়া কি জানি উইড়া গেলো, লাগলে মাথাটা গুড়া হয়া যাইতো। কোনোমতে দেওয়ালে মাথাটা ঠ্যাকা দিয়া খাড়াইলাম। এইবার নবারুণ সংসদের ছাদে আলো দেহা যাইতাছে, তারপর আরেক ছাদ পরে আলো। গল্লিটা পুরা অবরুদ্ধ, বাইর হওয়া মুশকিল। নড়লেই কিছু না কিছু বাঁধা দিতাছে, একদম পাথর হয়া খালি দেখতাছি। আলো নাই, সব আন্ধার। ছাদ থেকা ছাদে আলোর মারামারি দেহা যাইতাছে না, আমি কি লোড় দিমু? 
খালি লোড় দেওনের কথা ভাবছি আর লগে লগে ঘুর্ণিঝড়ের মতন বাতাস আবার, খাড়ায়া থাকন যাইতাছে না। আবার দেওয়ালে ঠ্যাকা দিয়া রইলাম। মাথার উপর দিয়া একটা মিসাইলের মতন কিছু গেলো, ডাস্টবিনের সামনে  গিয়া থাইমা আবার নাইমা আইলো।
ঘ্যাসুংগিঢ়া, হাত একটা খাম। আরেক হাত দিয়া ডাস্টবিনের ময়লা লাড়তাছে আর গন্ধ বাইর হইতাছে, খাচ্চর পুরা একটা। হালায় বদজ্বীন, এতক্ষণে নিশ্চিত হইলাম ।
-কই যাবি তুই?
-বাইত
-তর শইল’টা রাখুম তওলা পাড়ের কচুরির তলে আর মাথাটা বেলগাছ তলার জোড়া পায়খানার মধ্যে
-আমার অপরাধ?
-তুই নাচিজ
আস্তে আস্তে আগে বাড়তে থাকে ঘ্যাসুংগিঢ়া। বাতাস, মৌমাছির বিড়বিড় সব বন্ধ। রকেটের কথা মনে হইতাছে, আপন মনে হইতাছে খুব রকেট রে। রকেট না থাকলে এতক্ষণে তওলাপাড়ে পৌছায়া যাইতাম শিওর। রকেটের চোখটা মনে হইতাছে খুব, সবসমে কিছু একটা কইতে চায়। দোয়া দরুদ কিচ্ছু মনে নাই, কারে ডাকুম বুঝতাছি না। ঘ্যাসুংগিঢ়া আগাইতাছে, আমি একই জায়গায় জইমা রইছি দেওয়ালের লগে সাঁইটা। ঘ্যাসু হাত দিয়া ড্রেনের ময়লা লাড়তাছে, বিড়বিড় করতাছে আর চোখ ঘুরাইতাছে। আমার কান বন্ধ হয়া যাইতাছে, কিছু হুনতাছি না। সব কেমন জানি ঝাপসা লাগতাছে, আমি কি মইরা যাইতাছি তাইলে?

-আমার বাড়ি, আমার বাগান, আমার পুকুর সব খাইছস।
-না।
-আস্তে আস্তে মারুম তরে।
আমি খাড়ানের চেষ্টা করলাম। বহুত কষ্টে গুজা হয়া খাড়াইতে চাইলাম, আবার পইড়া গেলাম। আবার পাশের দোকানে সিড়ি ধইরা খাড়াইলাম। কী জানি একটা হইলো, আমার পিছে কী জানি একটা লাগলো। ভিতরে কে জানি কথা কইতাছে, ডরাইসনা। এইটা তো রকেট না, অন্য কেউ। ঘ্যাসু আমারে দেখতাছে ঘুরায়া ঘুরায়া, কিছু একটা আঁচ করতাছে। আমি খাড়ায়া থাকনের চেষ্টা চালায়া যাইতেই আছি, আর ভিতরে আওয়াজ আইতাছে – ডরাইস না। ঘ্যাসু কাছে আয়া পরছে, আর দুই হাত। আমিও মরার লেগা রেডি হইতাছি, ঘ্যাসুর হাত দিয়া মনে হয় ছিঁড়া ফালাইবো আমার কল্লা টা। ঘ্যাসু একদম কাছে, ময়লার বিকট গন্ধে বমি আইতাছে। আমার পিছে কী জানি একটা ঝুলতাছে। খালি দেখলাম ঘ্যাসু শেষ পাও টা ফালায়া আমার দিকে হাতটা বাড়াইলো আর আমার মেরুদন্ডের মধ্যে কী জানি একটা চাপ দিলো আর আমার পুরা শরির দিয়া বাজ পরনের মতন একটা কারেন্ট পাস হয়া গেলো ঘ্যাসুংগিঢ়ার হাতে।

-রকেট , রকেট
-অই মান্দার পোঁ ওঠ
চোখ খুলতে পারতাছি না। অনেক কষ্টে চোখ খুললাম, পুলিশ চায়া রইছে। 
-রকেট কই?
-রকেট তোমার হোগা দিয়া ভরুম
-মদোক্তির মদোক্তি, আজকা তোমারে মেডিকেলে নিয়া ওয়াশ করামু। কত ধানে কত চাইল আজকা বুঝবা
– আমি কি অজ্ঞান হয়া গেছিলাম?
– না, তুমি মাগিপাড়ায় নাচতাছিলা। অই উঠা গাড়িতে।

আমি এতক্ষণে দেখলাম আমি লবণের গোডাউনের সামনে, বায়ে গেলেই বেলগাছ তলা। আমি তো আছিলাম কারকুন বাড়ি লেন, হেনে আইলাম কেমনে? টেকাও নাই পকেটে যে পুলিশ’রে দিয়া ছুটুম ।
এইবার দারোগা আইলো সামনে।
-মাল মনে হয় ভরপুর?
-কই?
-ভরপুর না হইলে কেউ রাস্তায় খায়া পইড়া থাকে?
-আমারে জ্বীনে ধরছিলো, আমি কিচ্ছু জানি না। ঈমানে কইলাম আমি কিচ্ছু জানি না।
-জ্বীনে না জিনে ধরছিলো, মজা লও আমার লগে বাইঞ্চোত। অই অরে মেডিকেলে পাঠা, ওয়াশ করলেই বুঝবো জ্বীন নাকি জিন।
– ঈমানে কইলাম , আমারে জ্বীনে ধরছিলো ।
-থাকস কই ?
-কুঞ্জবাবু লেন, ঐ যে বরাবর দেহা যায়।
-কি করস
– কবি
দারোগা  দশ সেকেন্ড চুপ থাইকা হাসা শুরু করে, তার দেহা দেহি লগের সেপাইরাও আমার দিকে তাকায়া হাসতেই থাকে।
-আইছে আমার কবি
-হ, আমি কবি।
-কবিতা পড় দেহি একটা।
-আমার কিছু মনে নাই।
-কবিতা তোমার পাছা দিয়া ভরা হবে, চলো থানায় ।
-যেকোনো কবিতা হইলেই চলবো ?
-আগে পড় কবিতা মামদার পোঁ মদোক্তি, তারপর দেখতাছি ।

কী পড়ুম, কিছুই তো মনে থাকে না। ভাবতে থাকি কী কই পুলিশ রে। তারপর মনে মনে গুছাইতে না পাইরা যা ইচ্ছা তাই কওয়ার প্রস্তুতি লয়া তাকাই দারোগার দিকে –
– মালাকুল মওতের ইচ্ছায় আইলাম ফিরা
মউত এর কাছে জীবনের দাম দিয়া
যদি আজকা লয়া যাইতো আজরাইল, দেখা হইতো না
মুর্দার ল্যাংটা শরির, কেমন দেহায়
আমলের শইল্যেও কাপড় নাই 
নাই ঈমানের শইল্যেও
মওতের কাছেই সকলে ফিরা যাই।
শেষ রাইতে হুশ মেলনের পর জিগাই
আমারে তুমি কেমনে ছাড়বা,
যাইবা কই মালাকুল মউত ?
।।মাহবুব শাহরিয়ার।।
কভার ছবি : মোহসিন রাহুল