ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Thursday, February 11, 2021

জার্নাল : মেট্রোরেল

।।অমিতাভ পাল।।

লেয়া গ্লিকম্যান।ঢাকা, ইবাদতকারীদের ভিড় ও ট্রাফিক জ্যাম।

ঢাকার জ্যাম আর ভালো লাগে না আজকাল। সামান্য দূরত্বেও এতো এতো সময় খরচ হয়ে যায়, এতো এতো স্থবিরতা- আমার অসহ্য লাগে। হয়তো বৌদ্ধভিক্ষু হলে এই স্থবিরতাকে নির্বাণ ভেবে শান্তি পেতাম, হয়তো যেকোন সময় যেকোন জায়গায় ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস থাকলে ঘুমিয়ে পার করে দিতাম সময়ের গিঁটগুলি। কিন্তু এর কোনটাতেই নিমগ্ন হওয়া হয় না আমার ফলে মহাশূন্যযানের মধ্যে মহাশূন্যচারীর মতো আটকে থাকতে হয়।

চারপাশের এই অসহ্য স্থবিরতা বাস থেকে নেমে আমাকে হাঁটতেও দেয় না অনেক দূরে দূরে নক্ষত্রের মতো গন্তব্যগুলি ছড়িয়ে থাকে বলে। ফলে অটল এক শূন্যতার সাথেই বন্ধুত্ব করতে হয়।প্রথম প্রথম এইসব দুঃসহ জ্যামে সহযাত্রীদের সাথে গল্পগুজব করে সময় কাটানো যেতো। নিজের নিজের মনের পুঁটলি খুলে গল্পের খাবার পরস্পরের সাথে ভাগ করে নিতাম আমরা। আজকাল আর সেসবও হয় না। আমিসহ এইসব সহযাত্রীরাওতো খুব বেশি বিচিত্র না ফলে একইরকম গল্প, একইরকম খাবার, একইরকম মেন্যু অনেকদিন আগেই একঘেঁয়ে হয়ে গেছে এবং আমরাও নিশ্চুপ হয়ে গেছি। এখন ঢাকা শহরে কোনদিন আসেনি- এইরকম কেউ বাসভর্তি আমাদের দেখলে মনে করবে আমরা সব দার্শনিকের দল নিজের নিজের তত্ত্বচিন্তায় বিভোর হয়ে আছি।


কিন্তু বিভোর হয়ে থাকলেই কি আর পৃথিবী বদলায়? অনেকে হয়তো বলবেন, পৃথিবী বদলায় অলক্ষ্যে আমাদেরকে পাত্তা না দিয়ে। কিন্তু আমিতো দেখছি পৃথিবী বদলাচ্ছে আমাদের হাতেই। পৃথিবী নোংরা হচ্ছে, অস্থির হচ্ছে, বিরক্ত হচ্ছে আমরা দিনের পর দিন কুসন্তান হচ্ছি বলে। পৃথিবীর আত্মার কাছে গিয়ে কান পাতলে হয়তো শুনতে পাবো সে আমাদের ত্যাজ্যপুত্র করতে চায়। কিন্তু আমরা বৃদ্ধ পিতার মতো তাকে পাত্তা না দিয়ে বরং খুন করে তড়িঘড়ি সম্পত্তি হাতাতে চাইছি। জুয়ার টেবিলে আমাদের যে ধার জমে গেছে প্রচুর। দেনা শোধের আর কোন উপায়ই যে নেই আমাদের।

মোহাম্মদ পনির হোসেন।ঢাকা, উড়ন্ত যাত্রী।
এরকম সময়ে মেট্রোরেল যেন আমাদের আশার গাছে জল ঢাললো। সারি সারি পিলারের গজিয়ে ওঠা যেন মনে করিয়ে দিল এমন এক বনভূমির কথা- যে সব কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নেবে, অফুরন্ত অক্সিজেন ছড়িয়ে দেবে চারদিকে, রক্ষা করবে সব প্রাণীদের বিলুপ্তি আর আমাদের বাঁচাবে জুয়ার টেবিলের ধারের হাত থেকে। কেবল কুকুরগুলিই মানতে চাইলো না এসব। সারাক্ষণ ওই পিলারগুলির দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে ঘেউঘেউ করতে লাগলো যেন ওরাই আসল শত্রু। অথচ আমার ধারণা ছিল কুকুরেরা মানুষের সাথে থাকতে থাকতে মানুষের সব অভ্যাস, চিন্তার অনুগামী হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখন দেখছি কুকুরদেরও ব্যক্তিত্ব আছে, মানুষের সবকিছু তারা মেনে নেয় না। আসলে কুকুরদেরতো জ্যামের মুখোমুখি হতে হয় না, স্থবিরতার জেলখানায় নষ্ট করতে হয় না জীবনের অমূল্য সব সময়- তাই ওরা পিলারগুলিকে শত্রু ভাবছে। ওরা অনেকটা পাঠাওয়ের মোটর সাইকেলের মতো- সামান্য ফাঁক পেলেই সেখান দিয়ে গলে যেতে পারে। পিলারগুলি যেন ওদের ওই সামান্য ফাঁকটুকুকে আটকে দিতে চাইছে। কিন্তু আমরা যে আকাশ ছুঁতে চলেছি- আবার যুধিষ্টির হয়ে পৌঁছাতে চাচ্ছি স্বর্গে- সেটা ওদের কে বোঝাবে?

যাকগে- কুকুরের কাজ কুকুর করবে, কামড় দেবে মেট্রোরেলের পায়ে, তা’বলে আমরাতো আমাদের মুক্তির সুযোগটাকে হেলায় হারাতে পারিনা। ভাবুনতো একবার- আপনি মেট্রোরেলের কোন একটা কামরায় জানালার পাশের সিটে বসে আছেন জাগতিক সব ধরাছোঁয়ার বাইরে গিয়ে, অনেক কষ্টে আঁচড়ানো আপনার অবশিষ্ট চুলগুলি বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, জানালার একটু দূরেই একগুচ্ছ মেঘ- এসময় কেরানির গুটি কেটে কল্পনার প্রতিভায় ভরা কোন কবি হয়ে উঠে আপনি যদি একটা কবিতা লিখেই ফেলেন, বা গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন এককলি গান- তাতে কি চাকরির কোন ক্ষতি হবে? না আপনার বেতন কেটে নেবে অফিস? বরং এটা যদি নিয়মিত হয় তাহলে একটা বই ছেপে কিংবা সিডি বানিয়ে সেটাকে বইমেলা বা গানের ডালিতে পুশিং সেল দিয়ে বেশকিছু টুপাইস কামিয়ে নিতে কোন অসুবিধাতো হবার কথা না। এদিকে অফিসে পৌঁছাতেও আর দেরি হবে না আপনার, শুনতে হবে না উর্ধ্বতনের গালিগালাজ এবং অফিসের সময়টা বেশ ফুরফুরে মেজাজেই কাটিয়ে দিতে পারবেন। সেইসাথে করুণা করতে পারবেন সেইসব হতভাগা উর্ধ্বতনদের, যারা স্ট্যাটাসের কারণে মেট্রোরেলে চড়তে না পেরে নীচের জ্যামভর্তি রাস্তায় গাড়িটাকে একটা অ্যাকুয়ারিয়াম বানিয়ে বসে থাকতে বাধ্য হয়।
আমিও আজকাল ভবিষ্যতের ভাবনায় এসবকিছুই ভাবছি।

অনেক অনেক দিন পরের কথা। মেট্রোরেলের পিলার এখন বুড়িয়ে গেছে। তাদের ফোকলা দাঁতে আটকে আছে শ্যাওলা আর বটের চারা। কিন্তু লাইন এখনো বসানো হয়নি প্রকল্প পরিচালকের বখরার হিসাব মেলেনি বলে। ঢাকার রাস্তায় জ্যাম আরো বেড়েছে। বাসের ভিতর দাঁড়াবার জায়গাও কমে এসেছে অনেক। আকাশ এখনো অনেক দূরে। কুকুরেরা এখনো চিৎকার করছে সমানে। নতুন সম্পাদক মহাভারত থেকে ছেঁটে ফেলেছে যুধিষ্টিরের স্বর্গারোহণ পর্ব।
সবচেয়ে বড় কথা- আমার কবি কিংবা গায়ক হওয়া হয়নি।

।।অমিতাভ পাল।।
২২/০১/২১
ঢাকা