ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Thursday, February 11, 2021

তরঙ্গ টমাটো মিটার : স্পর্শিয়াদের ভয়ার্ত স্পর্শকাতরতা!

স্পর্শিয়াদের ভয়ার্ত স্পর্শকাতরতা কি 'তরঙ্গ টমাটো মিটারে' যেতে পারে?না কি ঠোলাদের ঠ্যাঙ্গানি মিটারে? না কি মঙ্গল গ্রহের বালসাল মিটারে?

।।লুবনা ইয়াসমিন।।

বাম থেকে, অনন্য মামুন, অর্চিতা স্পর্শিয়া, শাহিন মৃধা

পরিচালক অনন্য মামুন ও অভিনেতা শহীন মৃধাকে গ্রেফতার, জেলে পাঠানোর ব্যাপারে পুলিশ বলেছিল, মামুনের নবাবএলএলবির কিছু দৃশ্য তাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ করেছে, এটা নেগেটিভ এন্টারটেইনমেন্ট, পর্নোগ্রাফি ইত্যাদি।অর্চিতা স্পর্শিয়া বলেছে, আমার আর সাকিব ভাইর কোনো দোষ নাই, আমরা আপত্তি করেছিলাম, পরিচালক শুনে নাই ব্লা ব্লা ব্লা।

সাকিব, স্পর্শিয়া কোথায় সহকর্মির আটকের প্রতিবাদ করবে, সলিডারিটি জানাবে, না লেজ তুলে পালানো।মানে ছবিটা করছে শুধু টাকার জন্য, স্ক্রিপ্টও সম্ভবত পড়ে নাই।ধর্ষণ ইস্যুতে একটা ছবি কিভাবে ঢাকাই বা বলিউডি স্টাইলে আদর করাকরি নামের ঝাকানাকা দেখাবে এই ঘিলুটা নাই।আর আশেপাশের মেরুদণ্ডহীন, সুবিধাভোগী, স্বার্থপর, কাপুরুষ, কামহিলা শিল্পীদের কাছ থেকে সলিডারিটিটা শেখে নাই।শিখে থাকলেও ভয় এখন সব কিছুকে গ্রাস করেছে।
পুরোটা সংসদ, সেনাবাহিনী, পুলিশের প্রধান ভূমিকা যদি হয় খুনিতে, খুনিতে মামাতো, ফুপাতো ভাই, পররাষ্ট্র মন্ত্রী যদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর হয়ে সাফাই ভাষণ দেয় যে গত বছর মাত্র ১৭, ১৮ টা নির্বিচার হত্যা হয়েছে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে না কি হাজার হাজার নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ঘটছে।তাহলে কি আরো নির্বিচার হত্যা, গুম, অপহরণ ঘটতে হবে?প্রেস্ক্রিপশানটা হচ্ছে : আসুন সকলে, আইন প্রণয়নে, বিনোদনে আমরা মিশর, পাকিস্তান, তুরস্ক, সুদানের মতো হয়ে যাই এবং সংস্কৃতির জন্য বই মেলা, পহেলা বৈশাখ, ভালোবাসা দিবস, ইদের বাজার, ইনবক্স তো আছেই!
মামুন, মৃধার গ্রেফতারের অজুহাত হিশেবে পুলিশ যে সুনাম ক্ষুণ্ণ হবার কথা বলেছে, বাংলাদেশে পুলিশের সেরকম কোনো সুনাম আছে বলে জানা নেই।কিন্তু গগনচুম্বী উপরির জোরে পুলিশ যে বিয়ের বাজারে হট কেক তা জানা আছে।মামুনের ছবিটি ডিল করেছে ধর্ষণ, ধর্ষিতার পুলিশের কাছে যাওয়া।পুলিশ বলেছে যে যেভাবে জেরার দৃশ্য দেখানো হয়েছে তাতে ভিক্টিমেরা পুলিশের সেবা নিতে নিরুৎসাহিত হবে।আর শাহিন মৃধা যেভাবে অভিনয় করেছে তা বাস্তবসম্মত নয়, তার ওপর অনুমতি ছাড়া পুলিশের ইউনিফর্ম ব্যাবহার করেছে।এ সংক্রান্ত পুলিশের প্রেস রিলিজ নিয়ে কোনো ডকুমেন্টারি বানানো হলে, তা পাবলিক হ্যরাসমেন্টের একটা ভালো নিদর্শন হবে।
চলেশ রিসিল, কল্পনা চাকমা, সাগর রুনি, তনু নিয়ে পুলিশ যেসব টালবাহানা করে আসছে, তাতে কি ভিক্টিম, পাবলিক পুলিশের সেবা নিতে উৎসাহিত হয়?
'সাংবাদিকের অনুসন্ধিৎসু মন, তারা তথ্য তো খুঁজবেই, এতে অপরাধের কিছু দেখছি না বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট বলেন, ‘সাংবাদিকদের সুযোগ করে দিলে সে তো তথ্য প্রকাশ করবেই।’বুধবার (৩ ফেব্রুয়ারি/২০২১) ফেনীর নুসরাত জাহান রাফির ভিডিও প্রকাশ হওয়ায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের জামিন আবেদনের শুনানিতে বিচারপতি হাবিবুল গনি ও বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এমন মন্তব্য করেন।বরগুনাতে রিফাত হত্যায় তার স্ত্রী মিন্নি প্রধান সাক্ষী ছিল, এখন সে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত।অভিযোগ আছে যে স্থানীয় সাংসদের প্রভাবে পুলিশ মামলার গতি ঘুরিয়ে দেয় এবং প্রধান সাক্ষী মিন্নিকে অভিযুক্ত বানায়।মেজর রাশেদ সিনহা মামলায় পুলিশ কর্তারা কি করেছে, কাদের ফাঁসাতে চেয়েছে এবং আর্মি, পাবলিকের চাপে পরে কি হয়েছে তা সবার জানা।সম্প্রতি আল জাজিরার প্রতিবেদনে এসেছে কিভাবে পুলিশের নিয়োগ ও বদলিতে কোটি টাকার দুর্নীতি হয়।পুলিশ আগে নিজে সেবার মর্ম শিখুক, কার করের টাকায় তাদের বেতন, সুবিধা চলে তা হৃদয়ঙ্গম করুক।সে বুঝ আসার আগে পাবলিক পুলিশ ও তাদের গডফাদার রাজনীতিবিদদের নিরুপায় শিকার বৈ কিছু নয়।
সিনেমা নির্মাণে উৎসাহী তরুণেরা বিকল্প স্ট্রিমিং এর পথ খুঁজে নিয়েছে।একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হচ্ছে।চলচ্চিত্র আন্দোলনের নামে টোকন ঠাকুরেরা সরকারি অনুদান জালিয়াতি করছে সরকারের লোকের যোগসাজশে।মুক্তিযুদ্ধের ছবির নামে পরিচিতদের হাতে কোটি কোটি টাকা তুলে দেয়া হয়েছে, আমরা পেয়েছি বাচ্চাদের এক্সারসাইজ।স্ট্রিমিং এর পথ ধরে নতুন ডেয়ারিং আসবেই।সেখানে ভুল হবে, খারাপ ও ভালো দুইই হবে।
এন্টারটেইনমেন্ট শাড়ি, কাপড়, গয়নার মতো, চাহিদা থাকলে সরবরাহ কোনো না কোনো পথ খুঁজে নেবে।সহজ পথ বন্ধ করা হলে তা কালো বাজারে যাবে।অভিনয় ছেড়ে দেয়া অভিনেতা শাহিন আলমের বক্তব্য এখানে দ্রষ্টব্য হিশেবে তুলে ধরছি এ-কারনে যে শাহিন বহু ছবিতে চরিত্র অভিনয় ছাড়াও গাউসিয়া মার্কেট এলাকায় কাপড়ের ব্যাবসায়ী হিশেবে আমাদের খেটে খাওয়া উঠতি সামাজিক চলিশ্নুতার প্রতিনিধিত্ব করে।অভিনয়ে ছেড়ে দেবার কারণ হিসেবে শাহিন বলেছিলেন, 'ছবি যখন পরিচালকদের হাত থেকে প্রযোজকদের হাতে চলে গেল, তখন থেকেই সিনেমার অবস্থা খারাপ হতে শুরু করল। প্রযোজকেরা আমার কাছে ভালগার শট দেওয়ার অনেক অনুরোধ করেছে। আমি করিনি। পরে তারা কাটপিস শুট করেছে। পর্দায় আমার ক্লোজআপ ব্যবহার করেছে। আমি ধরলে বলেছে, না করে উপায় নেই, ভাই। এসব দেখেশুনে অভিনয়ের নেশাটা কেটে গেল।'
ছবি প্রযোজকদের হাতে চলে যাবার কারণ, প্রায় সব পরিচালকের ক্যারিয়ার শুরু হয় এড এজেন্সির বেতনভুক কর্মি হিশেবে, তারা হয়ে দাঁড়ায় কর্তার ইচ্ছায় কর্মবীর।এড এজেন্সিগুলো হাতে শত কোটি টাকা থাকলেও আগে দেখে হাত কচলানো আনুগত্য, পরে সৃজনশীল স্বাধীনতা। সেখানে শাহিন আলমদের কথা যেরকম শোনার আছে, আবার শাহিন আলমদের যদি চলচ্চিত্রের সার্বিক অভিভাবক বানিয়ে দেয়া হয় তাহলে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বলে আর কিছু থাকবে না।চলচ্চিত্রের ভাষা আর রেডিওর ভাষা এক নয় তা বলা বাহুল্য।অমিতাভ রেজা, আতিকুল আলম, অনন্য মামুন যে ভিন্ন ভাবে সিনেমা বানাবে তাও লেখা বাহুল্য।বড় পরিচালকেরা পশ্চিমে বিশেষ আমন্ত্রণে পারফিউমসহ অন্যান্য ব্র্যান্ডের বিজ্ঞপ্তি তৈরি করে দেয়, সেগুলোকেও ধরা হয় চলচ্চিত্রের ভাষা হিশেবে।আমাদের দেশে উলটো, অমিতাভ রেজারা তৈরি হয়েছে বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে, তাদের ছবিগুলোও বেশির ভাগ সময় বিজ্ঞাপনের কাটপিস জোড়া লাগানো ছবি মনে হয়, চলচ্চিত্রের ভাষা সেখানে কাজ করে না।হলে না কি স্ট্রিমিং এ দেখানো হলো তা মূল নয়, মূল হচ্ছে মাধ্যমের ভাষা।বিচিত্রভাবে বলতে না দেয়া হলে ভাষা ও মাধ্যম দুটোই মুখ থুবড়ে পড়বে।পুরো নগ্নতা দেখিয়েও লোক টানতে পারবে না।কারণ, নগ্নতা অনেক ভাবেই পাওয়া যাচ্ছে এখন।
আমাদের কথিত দ্রোহের কবিতা এবং কথিত ভয়েস আর্টিস্টরা ঢোড়া সাপের সুপ খাওয়া পোষা মার্কেটিয়ার ছাড়া কিছুই না।সেখানে অনলাইন আয়ের সুযোগে তরুণেরা অনেক ভেঞ্চারে যাবে, সেসব ভেঞ্চারে ধর্ষণের মতো ইস্যুও উঠে আসবে।পুলিশের কিশোরী মেয়ে ঐশী যে বাবা মাকে হত্যা করেছিল, তাও এই ধারাতে সিনেমা বানিয়ে অনলাইনে মুক্তি দেয়া হয়েছে।সম্ভাবনাময় অনন্য মামুন, শাহিন মৃধা, স্পর্শিয়াদের নিজেদের আবিষ্কৃত আয়ের পথে যেতে না দিলে আরো লাখো জনের মতো এরাও মাদকের দিকে যাবে।বিনোদনের পথ, বাক স্বাধীনতার পথ বন্ধ করে দেয়াতে তাই হয়েছে।বাংলাদেশের শিল্পীদের এখন বিজ্ঞাপনের রোবট বললে অত্যুক্তি হয় না।ঢাকা এটাক নামে সিনেমাটি না কি পুলিশের খরচে, পুলিশ কর্তার লেখা স্ক্রিপ্টে হয়েছিল।পুলিশ যদি আমাদের বিনোদন সেবা দিতে চায়, আমাদের আপত্তি নাই।কিন্তু অপর পরিচালক, অভিনেতাদের জেল, জুলুম করাতে প্রবল আপত্তি ও তীব্র নিন্দা আছে।
শেষ খবর অনুযায়ী অনন্য মামুন ও শাহিন মৃধাকে জামিন দিয়েছে আদালত।ছবিটি যে চূড়ান্ত মুক্তির আগে বহুভাবে কাটাছেড়া করা হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে।কাটাছেড়ার অনিবার্য ফলাফল হাসপাতাল গমন, জরুরি চিকিৎসা লাভ।সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসকদের নিয়ে যেসব খবর বেরুচ্ছে, তাতে নবায়িত বিনোদনের কোনো লক্ষণ নেই।আমাদের ভরসা, কাউবয় হিট এন্ড রান যত বাড়ে, তত তাজা রক্ত সঞ্চালনা বাড়বে।স্পর্শিয়াদের ভয় তত কমবে।

লুবনা ইয়াসমিন

ফটো : বাম থেকে অনন্য মামুন, স্পর্শিয়া ও পুলিশের ভূমিকায় শাহিন মৃধা।সূত্র : গুগল