ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Monday, November 27, 2023

মুনীর চৌধুরী, নাট্যভাবনা প্রাসঙ্গিকতা

।।চয়ন খায়রুল হাবিব।। 

‘নন্দন বিশ্বমেলা - ২০২৪', বিশেষ প্রকাশনা ভূমিকা :

শহীদ বুদ্ধিজীবী, নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর জন্ম ২৭শে নভেম্বার, ২০২৩, ব্রিটিশ ভারতের মানিকগঞ্জ। ২০২৪, মার্চ মাসে বাংলাদেশের রাজধানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র শিক্ষক মিলন-কেন্দ্র, টি, এস, সিতে অনুষ্ঠিত হবে ''নন্দন বিশ্বমেলা - ২০২৪''। উৎসবে বিশেষ প্রকাশনা হিসেবে আসছে মুনীর চৌধুরীর ছোট ১০টি নাটক এবং কিছু প্রবন্ধের প্যাক। সম্পাদনা করেছেন ফ্রান্স নিবাসী কবি ও নাট্যকার চয়ন খায়রুল হাবিব। মুনীর চৌধুরীর ৯৮তম জন্মদিন উপলক্ষে 'তরঙ্গে' প্রকাশিত হলো বিশেষ প্রকাশনাটির সম্পাদকীয় ভূমিকা।সম্পাদক।তরঙ্গ।

মুনীর চৌধুরীর ৯৫তম জন্মদিনে গুগল ডুডল

''নন্দন বিশ্বমেলা - ২০২৪' ভবিষ্যৎ-বোধক আয়োজনটির প্রথম বিশেষ প্রকাশনা হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ১০টি ছোট নাটক এবং প্রবন্ধ ঘিরে একটি প্যাক। প্রকাশনার ব্যাপ্তির সাথে নাটকগুলোর আয়তনগত সাযুজ্য রক্ষার পাশাপাশি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা লেখার সময় আমার সামনে সবচেয়ে জরুরী প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, আজকের দোলাচলে নাটকগুলো এবং তাদের লেখক মুনীর চৌধুরীর প্রাসঙ্গিকতা কোথায়?

যে ১০টি নাটক আমি নির্বাচন করেছি, প্রাসঙ্গিকতা আলোচনার প্রয়োজনে, তাদের বিষয় এবং চরিত্রদের দিকে ফেরা যাক :

১) 'একতালা দোতালা' : ওপরতলার অবাঙালি মহিলার সাথে, নিচতলার অবিবাহিত বাঙালি ডাক্তারের প্রেম এবং আনুষঙ্গিক জটিলতা।

২) 'ফিট কলাম' : পুরান ঢাকার রাস্তায় রিক্সা-যাত্রী বোরখাধারিকে পলাতক রাজনৈতিক কর্মি হিসেবে  পুলিশের সন্দেহ এবং লিঙ্গবোধকতা  নিরসনে ব্যর্থতা।

৩) 'মর্মান্তিক' : গীতিনাট্য, রেস্তোরায় কয়েকজন ছেলেমেয়ে।

৪) 'দণ্ডকারণ্য' : ‘দণ্ড’, ‘দণ্ডধর’ একাঙ্কিকার তৃতীয় সার্বভৌম অংশ। রামায়ণের একাংশের আলোকে নারী-পুরুষ সম্পর্কের ওপর সমকালীন দৃষ্টিপাত।

৫) 'আপনি কে' : বনভোজনে যাওয়া  তরুণ, তরুণীদের পিছু নেয়া গোয়েন্দা ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ।

৬) 'বংশধর' : নারী, পুরষের প্রেম, পাত্রীর বাবা, মায়ের রসালো কথাবার্তা এবং বানরের উপদ্রব।

৭) 'নেতা' : দেশ শাসকদের নিয়ে স্যাটায়ার।

৮) 'আগামী যুদ্ধ' : যুদ্ধ কেন্দ্রীক রচনা লিখতে গিয়ে এক কিশোরী  এক অদ্ভুত চরিত্রের মুখোমুখি। ট্রেঞ্চ এবং জাঁকজমকপূর্ন প্রাসাদের মিশেল পরাবাস্তবতায় যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলব্ধি ।

৯) 'ঢাক' : ঘরোয়া অতিপ্রাকৃত আবহে, নারী পুরুষের সম্পর্কের চড়াই উৎরাইএর মাঝে একটি ঢাকের বার বার উল্লেখ।

১০) 'নওজোয়ান কবিতা মজলিস' : ব্ল্যাক-আউট আবহে পূর্ণিমায় কয়েকজন ছেলেমেয়ের নিজেদের লেখা পাঠ এবং তা নিয়ে কথোপকথন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৮।
বাংলা বিভার সহকর্মিদের সাথে
সাদা দাড়িতে মোহাম্মদ শহীদুলাহর পেছনে, 
সর্বশেষ সারিতে মুনীর চৌধুরী।
সঙ্কলিত নাটকগুলো কোনটি বাস্তব, কোনটি পরাবাস্তব। চিত্রিত চরিত্রদের একটি বড় দিক হলো রাজনৈতিক টানাপোড়েনে মানবিক সম্পর্কগুলোর প্রাত্যহিক সঙ্কট  এবং উত্তরণের আত্যন্তিক ব্যক্তিক প্রয়াস। অভিযোগ, অনুযোগ প্রহসনগুলোর ভরকেন্দ্র হলেও বার্নার্ড শ শৈলীর প্রভাবে কৌতুকাশ্রয়ী, মুনীর চৌধুরীর নিজের কথায়, ‘কৌতুকাবহ, অন্তরাশ্রয়ী এবং অদ্ভুতরসাত্মক।’ শেক্সপিয়ারের কমেডি ‘টেমিং অফ দ্যা শ্রু’, অনুবাদের নামকরণ করেছিলেন ‘মুখরা রমনী বশিকরণ’, এ-অনুবাদ এবং একাঙ্কিকাগুলো রসস্থতার দিক থেকে তুলনীয়। ইউরোপিয় ধারাতে আলফ্রেড জারি, ফার্নান্দো আরাবাল মঞ্চে যে অযৌক্তিক, অসংলগ্ন, উদ্ভটরসের সঞ্চার করেছিলেন, মুনীরের একাঙ্কিকাগুলো সে ছোঁয়াচ অল্প কিছুটা নিলেও মুলত পূর্ব এবং পশ্চিমের ধ্রুপদ নাট্যধারার সংলগ্ন, যৌক্তিক পারম্পর্যে বিশ্বস্ত ছিলেন।


 একটি নাটক সাহিত্য থেকে যেভাবে থিয়েটার বা মঞ্চ-নাটকে রুপান্তরিত হয়, ওপরের ১০টি নাটকে সে-পর্বগুলো এমনভাবে এসেছে যে এগুলো আক্ষরিক-পাঠ্য-নির্ভর থেকেও সরাসরি মঞ্চায়ন করা যায়, আবার ইস্যু-নির্ভরভাবে বাড়ানো যেতে পারে। প্রাচীন ঋষি ভরতের ‘নাট্যশাস্ত্রে’ মঞ্চায়িত কলাগুলোতে আবেগের যে উচাটন তুলে ধরা হতো, কিম্বা প্রাচীন গ্রীক থিয়েটার বা ড্রামাতে মুখোশের অভিব্যক্তির তারতম্য ঘটিয়ে হাস্যরস এবং করুণরসের ভেতর চড়াদাগে যেভাবে সঙ্ঘাত তৈরি করা হতো, মুনীর চৌধুরীর সামগ্রিক নাটকে সে সঙ্ঘাত তৈরি হয় সংলাপ এবং আবহ মিলিয়ে

 

একাঙ্কিকাগুলোতে শৈলীর দিক থেকে মুনীর মিনিমালিস্ট বা স্বল্পাশ্রয়ী, যাতে হাত পাকিয়েছিলেন  পঞ্চাশ দশকের শুরুতে কারাগারে ‘কবর’(১৯৫৩) নাটক লিখে এবং মঞ্চায়নে। কারাগারে মঞ্চ সামগ্রি থাকবে না,  ঘটনাস্থল হলো  গোরস্তান, অপর কারাবন্দী নির্দেশক ফণি চক্রবর্তিকে জানালেন, 'হারিকেন, প্রদীপ ও দিয়াশলাইয়ের কারসাজিতে নাটকের প্রয়োজনীয় ভয়াবহ, রহস্যময়, অশরীরী পরিবেশকে সৃষ্টি করিতে হইবে।''


চল্লিশের দশককে বলা যায় মুনীর চৌধুরীর প্রস্তুতি পর্ব। এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, ‘কবর’, রচনার সময় সচেতন না থাকলেও পরে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ৪৩-৪৪ সালে আমেরিকার বেশ কিছু বামপন্থী সৈনিকের সঙ্গে কুর্মিটোলায় তার যে আলাপ হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে ড. নরমান স্প্রিংগার যে তাকে আরউইন শ’র 'বারি দ্যা ডেড' নাটক পড়তে দিয়েছিলেন, তার প্রভাবও অবচেতনভাবে কবর-এ পড়েছে।

 

মুনীর চৌধুরী মূলত নাট্যনেশায় উন্মাতাল একজন লেখক। শুরুতে কয়েক বছর গল্প লিখেছিলেন। গ্রাম এবং নগর কেন্দ্রীক সে গল্পগুলোর লেখার সময়খন্ড ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৮, পাঁচ বছর। বিচিত্র আঙ্গিকে তার নাট্য চর্চার মেয়াদ ১৯৪৩ থেকে ১৯৭১। সহকর্মীদের বলেছেন, নাটক লেখা থেকে যথেষ্ট আয় করতে পারলে শিক্ষকতা করতেন না। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছিলেন, ‘‘বাস্তব জীবনযাত্রার উচ্চ পর্যবেক্ষনক্ষমতা,  ঘটনাবিন্যাসের নাটকীয়তা,  আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগনৈপুণ্য, প্রকাশভঙ্গির সুক্ষতা,  এবং, সর্বোপরী লেখকের নির্লিপতা ও সংযম’’, তার গল্পে পাওয়া যাচ্ছে,  কিন্তু ‘’শক্তিশালী গল্প লেখক হওয়ার  এ সম্ভাবনাকে মুনীর চৌধুরী কাজে লাগান নি। তার প্রধান কারণ হয়তো নাটকে তার অসাধারণ আসক্তি।'


স্ত্রী লিলি এবং তিন সন্তানের সাথে।
আরো গল্প না লিখলেও মুনীরের একাঙ্কিকাগুলোতে আমরা চেখভের সমগোত্রীয় একজন লেখককে পেয়েছি, যিনি চেখভের মতো  গল্প এবং নাটক একাধারে না লিখলেও, গল্পের বুনোট নাটকে ধরে রেখেছেন। গল্প লেখা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে এবং লেখালেখির অন্যান্য জন্রেতে মনোনিবেশ না করে মুনীর নাটক লেখা এবং প্রয়োগকে সারা জীবনের  আরাধ্য করে তোলায় আমরা কি পেয়েছি? মাইকেল মধুসূদন এবং রবীন্দ্রনাথের নাট্য চর্চার ধারাবাহিকতার পর আধুনিক উল্লম্ফনের জন্য যে হ্যাচকা টানের দরকার ছিলো তাই স্থিতিশীলভাবে ঘটেছে মুনীর চৌধুরীর ধীমান, আজীবন নাট্যচর্চায়।  তার হত্যাকান্ডের পরপর স্মৃতিমূলক লেখায় অগ্রজা সহকর্মী নীলিমা ইব্রাহিম মন্তব্য করেছিলেন, ‘’নাটক লেখা মুনীর চৌধুরীর পেশা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এ ছিল তাঁর স্বভাব নেশা। তাই ভাষাতাত্বিক মুনীর চৌধুরী, সমালোচক মুনীর চৌধুরী  চরম কর্মব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে নাটক রচনা করে গেছেন।’’


মুনীরের নাট্য চর্চা নিয়ে তার অগ্রজ, সহশিক্ষকদের পাশাপাশি অনুজ শিক্ষকদের কেউ কেউ লিখেছেন। সরাসরি ছাত্রদের ভেতর অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন এবং অধ্যাপক মনসুর মুসার লেখা দ্রষ্টব্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ ‘কবর’, নাটকের কাঠামো এবং বাংলা নাটকে প্রিজন-থিয়েটার/অন্তরিন মঞ্চ-নাট্য নিয়ে ইংরেজি সন্দর্ভ  পাঠ করেছেন ১৯৭১-উত্তর করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ে। মুনীর চৌধুরী সঙ্ক্রান্ত আনিসুজ্জামান, নীলিমা ইব্রাহিম থেকে সৈয়দ জামিল আহমেদের সময়কে একটি একাডেমিক রৈখিকতায় আনলে আমরা দেখছি যে আলোকপাতের ধরণ বদলাচ্ছে, কাঠামোগত আলোচনা অগ্রাধিকার পচ্ছে, যা অনেক সময় মুনীরের চর্চিত ধর্মনিরপেক্ষ অঙ্গিকারের জায়গাটি গৌণ করে ফেলছে। প্রকারান্তরে কাঠামোগত আলোচনা, গবেষণা হয়ে পড়েছে ধর্মিও প্যারাডাইমের সাফাইভাষন।


একাডেমিক আলোচনায় বড় শুন্যতা হচ্ছে কোন পটভূমিতে ভাষানি, বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে মুনীর চৌধুরীরা বারবার জেলে ছিলেন, তার উল্লেখের অভাব এবং পক্ষপাত। এটা দু’ কারণে হতে পারে, প্রথমত স্ববিস্তারে সে কারাদন্ডগুলোর আলোচনা য্যামন একদিকে তৎকালীন রাস্ট্র বা অপরাস্ট্র পাকিস্তানে নাগরিকের অধিকার শূন্যতা তুলে ধরবে, সেরকম পরবর্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক বন্দীদের সাথে রাস্ট্রের আচরণে তুল্যমূল্য তৈরি করবে। দ্বিতীয়ত বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের একাডেমিক আলোচনায় রাস্ট্রিয়-সেন্সর ইস্যুটি  সুনির্দিষ্টভাবে না আনাকে আমার পাঠে যান্ত্রিক এবং ঐতিহাসিক কৈফিয়ত মনে হয়েছে। মুনীর চৌধুরীর চর্চাকে একাডেমিক আনুষ্ঠানিকতার বাইরে এনে অনানুষ্ঠানিক আলোকপাতের সূত্রপাত ঘটান নাট্য ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার তার সম্পাদিত ত্রৈমাসিক ‘থিয়েটার’ পত্রিকায়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর যে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন বিকশিত হয় তার শেকড়ও প্রোথিত অনানুষ্ঠানিক, কিন্তু নিবেদিত অঙ্গিকারে।

 

বর্তমান সিরিজে সঙ্কলিত একাঙ্কিকাগুলোতে যতই হাসি, তামাসা থাক,  চরিত্রদের সবাই এক কেন্দ্রাতিত  চাপা উদ্বেগে আক্রান্ত। এ-উদ্বেগের তুলনামূলক ওঠানামা ঘটিয়ে চরিত্রগুলো নিজেদের ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, আর বাইরের পরিস্থিতে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি। নিবাচিত ১০টি নাটকে এ -প্রবনতা হয়ে উঠেছে কিছু ক্ষেত্রে জমাট, কিছু ক্ষেত্রে গুমোট। নাটকগুলোর প্রবর্তনা থেকে অপরাস্ট্র পাকিস্তানের সাথে নাট্যকারের অস্বস্তিকর সম্পর্ক স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। বিশ্বযুদ্ধত্তোর উত্তর উপনিবেশিক পরিস্থিতি, দেশভাগের অবসাদ, নতুন রাষ্ট্রে সামরিক স্বৈরতন্ত্র এবং দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিকতার তিক্ততার ভেতর মুনীরকে একটি কল্পিত আশাবাদ তৈরি করতে হয়েছিলো, যেখানে পক্ষ এবং বিপক্ষ দুটোই তার নিজের ভাষায় কথা বলছে।


বঙ্গবন্ধুর সাথে, হার্ভার্ড, ১৯৫৭।

ছাত্র জীবনে এবং পরেও কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হলেও,  পূর্বনির্ধারিত পন্থার প্রতি অন্ধ আনুগত্যের বদলে তার সংলাপ তত্ত্বিয় অভিভাবকত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে। সন্নিবেশিত নাটকগুলোতে চরিত্রগুলোর উন্মেষ গনতান্ত্রিক এবং লক্ষ্য ব্যক্তিক। এ-প্রবণতার ফলে, ‘কবর’ নাটকের শেষটুকু যে তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতা রণেশ দাশগুপ্তের ভালো লাগে নি, তা রণেশ নিজে জানিয়ে গেছেন।


'ফিট কলাম' এবং 'নেতা' নাটকে উল্লেখিত ‘পঞ্চমবাহিনী’ এবং ‘শাসক’ বাদে অন্যান্য সব চরিত্র বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিনিধি। এদিক থেকে নাটকগুলো একই সাথে সামাজিক চলিষ্ণুতা, শ্রেণীযুদ্ধ এবং ভবিষ্যৎবোধক পরিচয়গত আকাঙ্ক্ষার যৌথ দর্পণ। ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধে ৯মাস ব্যাপী ক্রমাগত গণহত্যা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাক্কালে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞে এ-দর্পণকে ভেঙ্গে ফেলবার পাশাপাশি, ভাষা এবং কৃষ্টিগত পরিচয়-জ্ঞাপনকারীদের নিশ্চিহ্ন করবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এ-দর্পণকে একটি জাতির পরিচয়জ্ঞাপক উন্মেষকাল বলে ধরলে আমরা ভুল করবো, বরং দর্পণটিতে বাঙালির বহুমিশ্র হাজার বছরি, হাজার দুয়ারি পরিচয়বোধকতার পরিণত প্রতিফলন ঘটেছিল।


মুনীর চৌধুরী এবং তার চরিত্রদের কৃষ্টিসঞ্জাত প্রতিসরণ নিশ্চিতভাবে আক্রমণকারীদের চেয়ে অনেক বেশী গতিশীল, যার আত্মতাচিহ্নিত অভিঘাত এখনো ঘটছে এবং যার প্রবহমানতা বলে দেয় যে ভবিষ্যতেও বিভিন্ন মাত্রায় ও মাত্রিকতায় এ-প্রতিসরণ সচল থাকবে। নাটকের চরিত্রগুলো যাতে সামাজিক কুশীলব হয়ে উঠতে না পারে, হয়ে উঠলেও তাদের দৈনন্দিনতার মঞ্চ যাতে সবসময় নড়বড়ে থাকে, তা নিশ্চিত করতে আক্রমণকারীদের কাছে এই চরিত্রগুলো এবং তাদের প্রতিফলনকারীদের হত্যা করা জরুরি ছিলো।


আমার পাঠে, মুনীর চৌধুরী একজন অবিরাম নিরিক্ষাধর্মী লেখক। আমাদের সৌভাগ্য যে এই লেখক নাট্য-সাহিত্য এবং তার মঞ্চ-প্রয়োগকে সারাজীবনের আরাধ্য করে তুলেছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে স্বাধীনতার পর পর বাংলাদেশে যে ‘গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের’ সূত্রপাত হয় তাতে ওনার অনুপস্থিতি। তার চরিত্রদের ভাষা নাগরিক এবং প্রমিত। চরিত্রায়নে এবং ভাষা প্রক্ষেপণে কোনো প্রিটেনশান বা ভান নেই। নাগরিক বাঙালির পটভূমি ঐতিহাসিকভাবে কৃষিভিত্তিক গ্রামাঞ্চল হলেও এদের আচরণে, প্রক্ষেপণে গ্রাম্যতা একেবারে অনুপস্থিত। নাগরিকতার ছাঁকুনিতে এরা গ্রাম্যতার বদলে গ্রামীণতাকে তুলে ধরতে দ্বিধাগ্রস্ত নন।


মিথকে যদি আমরা নাগরিক এবং গ্রামীণ আদিবাসের নান্দনিক ভিত্তি ধরি, তাহলে তার সবগুলো শর্ত আদায়ের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে মুনীর চৌধুরীর লেখাগুলোতে। 'সম্ভাবনা' এখানে অপূর্ণাঙ্গতা অর্থে নয়। বরং লেখাগুলো পুর্নাংগ এবং পরিণত হবার পরও আরেকজন নতুন লেখকের জমিনকে আরো বিস্তৃত করবার উস্কানি দিচ্ছে। এটি মুনীর করেন অত্যন্ত আলতোভাবে, উচ্চকিতভাবে নয়। একই পেলবতায় ওনার উপস্থাপনাগুলোতে যে জাতীয়তাবাদের মন্ত্রগুপ্তি, তাতে উগ্রতার বদলে বার বার পারস্পরিক সংলাপের অবকাশ তৈরি হচ্ছে।

 

সিরিজে পরিবেশিত  ১০টি নাটক, বিশেষ করে নারী-পুরষের সম্পর্ক কেন্দ্রীক 'একতালা দোতালা', 'দণ্ডকারণ্য', 'আপনি কে', ‘বংশধর',  'ঢাক'  পড়বার সময় মুনীরের আজীবন সহধর্মিনী লিলি মির্জার কথা মনে পড়েছে। দাম্পত্যের বাইরে দুজনের পথবন্ধন ঘটেছিল বাংলা সাহিত্যের সেতুপথে। বিয়ের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর লিলি চৌধুরী পরবর্তিতে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা ও ফরাসি ভাষা অধ্যয়ন করেছিলেন। স্বামী নাটক লিখেছিলেন মঞ্চ, বেতার, টেলিভিশনের জন্য, যার সব মাধ্যমে লিলি অভিনয় করেছেন। একাকিঙ্কাগুলো পড়বার সময় মনে হয়েছে এগুলোকে সহজে টেলিভিশন সিটকমে রুপান্তর করা যাবে। উল্লেখ্য যে ঢাকা টেলিভিশনের প্রথম নাটক ছিলো এখানে সঙ্কলিত ‘একতালা দোতালা’ যাতে লিলি চৌধুরী অভিনয় করেছিলেন।


দুজনের নান্দনিক যৌথতা ইটালিয়ান নাট্যকার দারিয়ো ফো এবং অভিনেত্রি ফ্রাঙ্কা রামের পারস্পরিক যাত্রাপথের কথা মনে পড়িয়ে দিয়েছে। দারিয়ো ফোর জন্ম মুনীর চৌধুরীর জন্মের এক বছর পর ১৯২৬ সালে। স্বামীর অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি টেনিসি উইলিয়ামসের 'স্ট্রিটকার নেমড ডিসায়ারের' অনুবাদ 'গাড়ির নাম বাসনাপুর' লিলি সমাপ্ত করেছিলেন। ‘দিনপঞ্জি-মনপঞ্জি-ডাকঘর’ শিরোনামের একটি বই, যা  মুনীর চৌধুরী ও তার লেখা চিঠির সংকলন, লিলি তা  প্রকাশ করে গেছেন।


ছোট ৫ বোনের সাথে মুনীর চৌধুরী।
একাডেমিক অর্জন, রাজনৈতিক সচেতনতার পাশাপাশি ব্যক্তি মুনীরের একটি শখ বা হবির খবর পাচ্ছি আমরা, আর তা হচ্ছে মাছ ধরা। ম্যাজিস্ট্রেট বাবার বদলি সূত্রে বাংলার বিভিন্ন জেলার পুকুরে যেরকম ছিপ  ফেলেছেন, সেরকম ঢাকার এখানে, ওখানেও মোড়া পেতে বসে হুইল বর্শিতে মাছ ধরেছেন। মাছ ধরবার সময় আত্মমগ্ন, আবার অত্যন্ত মিশুক এ-মানুষটির কথা, যাপন দেখলে বঙ্গবন্ধুর সাথে একটি  মর্মান্তিক মিল খুজে পাই। দুজনেই বাঙালিকে ভালোবেসেছিলেন,, বাঙালির পরিচয় অর্জনে  সারা জীবন ব্যয় করেছেন, বাঙালিকে বিশ্বাস করেছিলেন গভীরভাবে, নিহত হয়েছেন  বাংলাভাষী বাঙালির হাতে। প্রজন্মান্তরে আমি যে ভাষিক, সাংস্কৃতিক পরিচয়ের উত্তরাধিকার বহন করে এই সম্পাদনাটি করছি, তার ত্রিমাতৃক জীবন্ত ভাস্কর্যটি আমাদের জন্য আরো অনেকের সাথে মিলে  পারস্পরিকভাবে গড়ে দিয়েছেন এ-দুই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব।


১৯৭১,জানুয়ারিতে ভাষা সম্মেলন উপলক্ষে মার্কিন যুক্ত্ররাস্ট্রে অবস্থান করছিলেন, এসময় গুজব রটে যে পাক কর্তৃপক্ষ ঢাকা গামী আন্তর্জাতিক বিমান যাতায়াত সীমিত বা পুরোপুরি বন্ধ করে  দিতে পারে। তখন যুক্তরাস্ট্র সফর সংক্ষিপ্ত করে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকা ফেরেন। (লন্ডনে যাত্রা বিরতিতে ২৮ জানুয়ারি বিবিসি বাংলা বিভাগ তার সাথে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি আলাপচারিতা  রেকর্ড করে,যা প্রচারিত হয় ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১।) কিছুদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা অনুষদে ডিন হিসেবে নিযুক্তি পান। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে ১৯৬৬সালে প্রাপ্ত  ‘সিতারা ই ইমতিয়াজ’ খেতাব বর্জন করেন। মার্চের পর  উনিশ বছর বয়সী বড় ছেলে ভাষণ মুনীর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহন করতে চলে যান।  ১৪ই ডিসেম্বর বাবা, মায়ের বাসভবন সেন্ট্রাল রোডের ‘দারুল আফিয়া’ থেকে মুনীর চৌধুরীকে আল বদর বাহিনী অপহরণ করে,, সম্ভবত সেদিনই তাকে হত্যা করা হয়।''


মুনীর চৌধুরী সহ  বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড ১৯৭১এ সংগঠিত জেনোসাইডের অংশ এবং রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত রয়েছে। সারা বিশ্ব জুড়ে বুদ্ধিজীবীদের একাংশই রাষ্ট্রের হাতে অপরাপর বুদ্ধিজীবীদের দমন, পীড়ন, হত্যা নিয়ে কৈফিয়ত তৈরি করেছে এবং পরবর্তীতে সেন্সরের পরিসর বিস্তৃত হবার অবকাশ দিয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা হয়ে দাঁড়িয়েছে একাধারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী এবং আত্মঘাতী। শুধু কাঠামোগত  জায়গা থেকে দেখলে মুনীর চৌধুরীর অনুশীলনসহ সাহিত্যের সামগ্রিকতার প্রতি দৃষ্টিপাত হয়ে পড়ে খণ্ডিত। অনেক সময় কথিত বিশ্লেশনধর্মি গবেষণা যান্ত্রিকতার কারণে পূর্ববর্তী কোনো অপশাসনের সাফাই-ভাষণ হয়ে উঠতে পারে, যার ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্র ছাড়াও সামাজিক বিভিন্ন তৎপরতায় বিভিন্নসময় প্রকাশনার ওপর সেন্সর, লেখকদের নির্বাসন, ব্লগার হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

 

ভাষা, শিল্প এবং শ্রমিকের মুখের  বুলির সূত্র ধরে এবড়োথেবড়োভাবে হলেও বাংলা প্রমিতের আরো চলিষ্ণু হবার কথা। ভাষার সৃজনশীল চর্চা কোথায় যেন হোঁচট খাচ্ছে। নাট্যকলা, চারুকলার আনুষ্ঠানিক পাঠদান বেড়েছে, কিন্ত নাট্য-সাহিত্য হয়ে পড়েছে রুগ্ন, চারু প্রদর্শনীগুলোর বিমূর্ত ক্যানভাসগুলো ঢেকে ফেলেছে বাঙালির অবয়ব। ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অর্জিত, মীমাংসিত পরিচয়গুলো আজকে প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে। রেওয়াজি আয়োজনগুলোর কোনো কোনোটি রমরমাভাবে হলেও যোগসূত্র ঢিলে হয়ে গেছে। এই ঝিমুনিকে ঝাঁকুনি দেবার জন্যে মুনীর চৌধুরীর সংলাপগুলো এবং তাদের চরিত্রদের বার বার প্রাসঙ্গিক করে তোলা আমাদের জন্য জরুরি।


'নন্দন বিশ্বমেলা - ২০২৪' পরিচয়গত নিষ্পত্তিগুলোর লক্ষ্যে পরিবেশ-বান্ধব প্রাণস্পন্দনের আবহমান ডানা মেলে ধরবার প্রয়াস। সে-লক্ষ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবী, নাট্যকার  মুনীর চৌধুরীর লেখনী নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরি সাথে নিয়ে একটি নতুন উৎসব এগিয়ে যাক বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, কর্ণফুলী ধরে বঙ্গোপসাগরের মোহনায়, বিশ্বায়িত বাঙালির চেতনায়।


চয়ন খায়রুল হাবিব

৭/১১/২৩

ব্রিটানি, ফ্রান্স


নন্দন বিশ্বমেলা - ২০২৪ 

স্থায়ী সহযোগী :

‘লিলি-মুনীর স্মৃতিরক্ষা ট্রাস্ট’, ‘পরিসর আর্ট সেন্টার’, ‘জুলেখা সিরাপ রিডার্স লাউঞ্জ’।


শহীদ মুনীর চৌধুরী এবং লিলি চৌধুরীর বনানী পুরোনো বাসভনে
তাদের কনিষ্ঠ সন্তান আসিফ মুনীরের সাথে চয়ন খায়রুল হাবিব।
ফটো : জুনায়েদ ইউসুফ।