ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Saturday, June 5, 2021

তিন ঢাকাইয়ার কাসিদা

শামসুর রাহমান, লাকি আখন্দের সাথে  বিদায় সাক্ষাৎ

।।চয়ন খায়রুল হাবিব।।

বাম থেকে, লাকি আখন্দ, শামসুর রাহমান, চয়ন খায়রুল হাবিব।শ্যামলি, ১৯৯৩।

কৈশোরের ঢাকা নিয়ে শামসুর রাহমানের স্মৃতিকথার শিরোনাম ছিলো স্মৃতির শহর।একই শিরোনামের একটি দীর্ঘ কবিতা নিয়ে পরে সুনীল গাঙ্গুলির একটি বই বেরিয়েছিল।সে হিশেবে ঢাকা নিয়ে নব্বই দশকের এ স্মৃতিচারণের শিরোনাম হতে পারে 'স্মৃতির শহর ৩'।আবার যাদের নিয়ে এই কথন, তাদের সবাই আজন্ম ঢাকার বাসিন্দা হওয়াতে এই লেখার নাম হতে পারে 'তিন কুট্টির কাসিদা'!
প্রাককথন :

১৯৯৩ সালের ঢাকা।এখনকার কয়েক লাখ যান বাহন, লোক জন রাস্তাঘাট থেকে সরিয়ে নিলে লকডাউন পরিস্থিতিতে রাজধানিতে যে খালিখালি ভাব তৈরি হয় তার সাথে আশির, নব্বইয়ের ঢাকা মিলবে না।স্কাইলাইন, ল্যান্ডস্কেপের ব্যাপারটাও আছে।আজিম্পুরের অগ্রনি বালিকা বিদ্যালয় ঘেরা সরকারি কলোনিতে একটু পর পর পুকুর ও মাঠ।আজিম্পুর রোডের এখন যেখানে ভিখারুননেসা স্কুল সে দিক ধরে চায়না বিল্ডিং থেকে দায়রা শরিফ একের পর প্রাইভেট একতলা, দোতালা বাড়ি।আজিম্পুর গার্লস স্কুল, কলোনির ভেতরের পঞ্চম শ্রেনি অব্ধি লিটেল এঞ্জেলস স্কুল, লালবাগ কেল্লা ঘেশা ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুল, আরেকটু ছাড়িয়ে এ-মাথায় সলিমুল্লাহ এতিম খানা, ওমাথায় ঢাকেশ্বরি মন্দির সবখানে যাপনের চাঞ্চল্য, কিন্তু দুস্বপ্নের জ্যাম তখনো শুরু হয় নাই, স্কাইলাইনের দুরমুজ আরো কয়েক বছর বাকি।

ভিড়েভিড়াক্কার বলতে তখনো আমরা বুঝি গুলিস্তানের মোড়, সদরঘাট।ইদ চলে গেলে গাউসিয়া, চাদনি চকেও আর গায়ে লাগালাগি ভিড় নেই, প্রায় একটা সোশাল ডিস্টেন্সিং ভাব।এর ভেতর শিতে, বর্শায়, গরমে কামরাঙ্গির চর মুখি গার্মেন্টসের তরুন শ্রমিকদের ঢল শুরু হয়ে গেছে।দুরান্তের কারখানাগুলো থেকে বাসে করে এসে নামতো ওরা আজিম্পুরের মোড়ে, তারপর মাইলকে মাইল হাটাপঠে আজিম্পুর, হাজারিবাগের পাকা রাস্তা, নওয়াবগঞ্জ কাচা বাজার, বেড়িবাধের ওপর বাশের সাকো পার হয়ে কামরাঙ্গির চরের বাশের খুটিতে মাচা বাধা বুড়িগঙ্গার পানিতে দাড়ানো ব্যাড়ার ঘরগুলোতে ফেরা।

তিন কুট্টির কাসিদা

শামসুর রাহমানের জন্ম ১৯২৯ সালের ২৩ শে অক্টোবার ব্রিটিশ বাংলার  পুরোনো ঢাকার মাহুতটুলিতে।তারপর পগোস স্কুল, ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।চাকুরি যাপনের পুরোটাই ঢাকা ভিত্তিক।তুমুল কলম নিয়ে জন্মেছিলেন।লিখেছেন প্রচুর, ওনাকে নিয়ে লিখেছে অনেকে, আরো লেখা হবে।আমি ওনাকে নিয়ে যতবার কিছু লিখতে বসেছি, দেখেছি নিজের ভেতরে আরেকটি দৃষ্টিকোন আবিস্কার করতে পারছি।বাংলা কবিতাকে তিরিশিও আবহ থেকে হ্যাচকা টানে বের করে আনবার পাশাপাশি স্মৃতির শহরে  উনি লিখে রেখে গেছেন, একজন মানুষের একই ভুমায় তিন বার পাস্পোর্ট বদলের জবরদস্তিগুলো পার হয়ে কৈশোরের চকমেলানো, সবুজের সমারোহে মশগুল এক ঢাকার কথা।


লাকি আখন্দ আকা লাকি ভাইর জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৮ই জুন।লাকি ভাই, ওনার ছোট ভাই হ্যাপিকে ছেলেবেলা থেকে আজিম্পুরে দেখে এসেছি।লাকি ভাইর জন্ম ঠিক কোথায় বের করতে পারি নাই।আজিমপুরে আসবার আগে ওনারা ছিলেন পুরান ঢাকার পাতলা খান লেনে, সেখানে ১৯৬০ সালে হ্যাপির জন্ম হয়।সে বাসার আগে ওনারা অন্য কোনো বাসায় থাকতেন কি না তা জানতে পারি নাই।হ্যাপি কৈশোরে গিটার শেখে লাকি ভাইর কাছ থেকে, আর লাকি ভাই সঙ্গিতের তালিম নেন ওনার বাবার কাছ থেকে।১৪ বছর বয়সে পাকিস্তানি HMV ও ১৬ বছর বয়সে ভারতিয় HMVর তালিকাভুক্ত শিল্পি হওয়া দেখে আমরা ওনার সর্বভারতিয় মাপটুকু একটু বুঝতে পারি।আবার সে মাপে পৌছাতে ওনার বাবার অবদানটা এখানে অনেক ভাবে আলাউদ্দিন খানের হাতে আলি আকবর ও অন্নপুর্নার তালিমের মতো।পরিতাপের বিষয় যে আমরা লাকি, হ্যাপির বাবা ও মায়ের নাম এখন আর খুজে পাচ্ছি না।স্বাধিনতার পর উচ্চারন, স্পন্দন, উইন্ডি সাইড অফ কেয়ার, মাইলস , ফিডব্যাক  সব বড় ব্যান্ডের পেছনে এই দুই ভাইয়ের অবদান পাওয়া যাবে।শামসুর রাহমান যেরকম কবিতাকে বাংলাদেশি যোগাযোগ সফল প্রমিতের ভুমাতে নিয়ে এসেছিলো, লাকি ও হ্যাপি দুজনেই বানি, গায়কি, সুর ও প্রক্ষেপনে একই সাথে সমকালিন, দেশিও এবং বিশ্বায়িত নবায়নের মাত্রা যোগ করতে পেরেছিলো।লাকি ভাইর জন্মের এলাকা বা বাসাটা কোথায় সেটা যেরকম হদিশ করতে পারি নাই, সেরকম উনিও কি সেন্ট গ্রেগরিজে পড়াশোনা করেছিলেন কি না নিশ্চিত নই।লাকি ও হ্যাপির জন্মের ব্যাবধান ৪ বছরের, হ্যাপি গ্রেগরিয়ান, এটা দেখে আমার ধারনা লাকি ভাইও গ্রেগরিয়ান।নিশ্চিত নই। 


হ্যাপি, সাবদার, কায়েস, কঙ্কনের ঢাকা


হ্যাপিকে প্রায় দেখতাম আমার বড় মামা ডক্টর ফজলুল হকের আজিম্পুরের বাসায়, তেতালায় মামাতো ভাই রুবেনের সাথে খোশগল্পে মেতে আছে।রুবেনের হাতে ক্লাস সেভেন, এইট থেকে জাপান থেকে মামার এনে দেয়া ইয়ামাহা গিটার, রুবেন খুব ভালো বাজাতো।রুবেন আমার একটু বড়, কিন্তু দিনমানের বন্ধু ছিলো, দুজন খুব এদিক ওদিক ঘুরতাম।লাকি ভাইকে দেখতাম আজিম্পুর কমিউনিটি সেন্টারের ঘাস ছাটা মাঠে  কখনো ঘোর দুপুরবেলা, কখনো সন্ধ্যায় শুয়ে আছে আকাশমুখি।ওনার বাবাকেও সেভাবে দেখতাম মাঝে মাঝে।ওনাদের সামনে না পড়তে রুবেন বলতো, চলো অন্য দিক দিয়ে যাই।লাকি, হ্যাপির বাবা, মার যখন ডিভোর্স হয় তখন ওনারা খুব ছোট।মার কাছে যেতো কি যেতো না, তখন থেকে বা আরো কিছু আছে কি না জানি না, ওনাদের বাবা, দুই ভাই তিনজনই আকাশচারি।লাকি ভাই রেডিও বাংলাদেশে প্রযোজকের কাজ পাওয়া অব্ধি ওনাদের বাবা কলোনির সরকারি বাড়িটা চাকুরি সুবাদে ধরে রাখতে পেরেছিলো।পরে হয়তো সেটা লাকি ভাইর নামে বরাদ্দ হয়।মুশকিল হলো, এখানে যদি লিখি লাকি ভাই গাজার স্প্লিফে মৌতাত সেরে মাঠে আকাশমুখি হতেন, তাহলে হয়তো ওনার মেয়ে খাপ্পা হয়ে যাবে।আবার নাও হতে পারে।আমার নিজের মেয়ে এলিস এ মাসে ২৫ হবে।ছেলেমেয়েরা যে তাদের মা, বাবাকে ভালবাসে তা আমি জানি।গাজা খেলেও ভালবাসে, না খেলেও ভালবাসে।ডিভোর্স হলেও ভালবাসে, না হলেও ভালবাস।


শাহাবুদ্দিন ও  মাহমুদুল হকের সাথে  
ঢাকা চারুকলা ইন্সটিউটের ১৯৮৩ ব্যাচের ছাত্রছাত্রীরা।
কঙ্কণ দ্বীতিয় সারিতে দাঁড়িয়ে মাহমুদুল হকের পেছনে।

কির্তিমানদের পাশে এবার নিজের কথা বলি!আমার ও জমজ কঙ্কনের জন্ম ১৯৬৫ সালের ১২ইডিসেম্বার ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের এক কেবিনে।বাবা হাবিবুল বশর বাংলাদেশ বিমানের ভারি প্রকৌশল বিভাগের প্রথম ব্যাবস্থাপক, মা জাহানারা বেগম ছয় সন্তানের জননি ও গৃহবধু।জন্মের এক সপ্তাহ বাদে আজিম্পুরের সেই বাগানঘেরা একতলা গোল বারান্দার বাড়ি থেকে ১৯৯৩ এ দেশ ছাড়া অব্ধি ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুল, সিটি কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ চুকানো সবই একই বাসা থেকে।আমি পড়তাম ম্যানেজমেন্ট বিভাগে না পড়বার মতো, তার ওপর ছিলো সামরিক স্বৈরতন্ত্রের যাতাকল।কঙ্কন মেট্রিকের পর থেকে চারুকলায়।ফলে নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার আগেই ১৯৮৩ থেকে চারুকলায় যাতায়াত।শামসুর রাহমানকে দেখেছি আরো আগে থেকে, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অপু চৌধুরীর বড় মামা বেলাল চৌধুরীর সাথে এখানে সেখানে।অপু থাকতো চায়না বিল্ডিং।অপু, আমি মাঝ আশিতে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ওয়ার্কশপে যাবার সুবাদেও অনেক জ্যাষ্ঠ কবি, শিল্পীকে দেখতে, জানতে থাকি।কিন্তু অমুক ভাই ডাকা, তমুক মামা ডাকা আমার মুখে আসতো না।


মেট্রিক, কলেজের সময় এলিফেন্ট রোডে এরোপ্লেন মসজিদের কাছে আমার একটা বড় আড্ডা ছিলো কায়েসদের চিলেকোঠায়।কায়েস ছিলো স্বনামখ্যাত বিটিভি প্রযোজক আতিকুল হক চৌধুরীর ছোট ছেলে।কায়েসের সাথে দিনকাবারি আড্ডা দিচ্ছি, ওর বাবা তখনই বিড়াট মাপের মানুষ, সিড়িতে উঠতে নামতে দেখা হলে কুশল সুধাচ্ছেন, এটুকুই।উনি যে বিড়াট, কত বিড়াট তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা ছিলো না।শামসুর রাহমানের আপন বোনের মেয়ে লিনা আপা আমার সেঝো বোন রুবির সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে প্রায়ই আজিম্পুরের বাসাতে আসা যাওয়া করছে।সবাই সবাইকে নিয়ে আছে।কিন্তু সেলিব্রিটি ব্যাপারটা নিয়ে ঢাকার মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত তখনো ক্ষেপে যায় নাই।মার্কেটিং কোম্পানিগুলোর উত্তরাধিকেরা আক্ষরিক অর্থে তখনো দুগ্ধপোষ্য, ওদের দুধদাত পড়ে গিয়ে দানবিয় দাতাল হাসির ইতিবৃত্ত তখনো পারস্পরিক সম্ভ্রমে লুকানো।


এর ভেতর সারা দেশের মধ্যবিত্ত সামরিক জান্তার ওপর নাখোশ হলেও সংগঠিতভাবে তা প্রকাশ করতে পারছিলো না।সংখুব্ধতার বিকল্প প্রকাশগুলো ঘটছিলো ছাত্র আন্দোলনগুলোতে।উত্যুংগ সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর আমার গতিবিধি ও চিত্ত চাঞ্চল্য কবিতা, নাটক ঘিরে টি, এস, সি, নজুরুলের মাজার, চারুকলা, মকৃবির পাশাপাশি আজিম্পুরের বয়রা কারিঘরের ঘর, নিলক্ষেত বাবুপুরা বস্তি এসবে বিস্তৃত হতে থাকে।বাংলায় পড়া, রোকেয়া হল নিবাসি, ছাত্র ইউনিয়নের একনিষ্ঠ  নীলার সাথে গড়ে ওঠে চিঠি চালাচালি, নৈমিত্তিক দেখাদেখির উথাল পাথাল।নীলা ঢুকে গেলো হলে, আমি চলে গেলাম বস্তিতে।ভোর রাতে বাসায় ফিরে, মশারির আলো আধারিতে কি কি সব সাইকাডেলিয়াতে চিঠি ভরাচ্ছি, তা নীলার হাতে দিয়ে দিচ্ছি, নীলাও কিছু একটা লেখালেখি আমাকে দিয়ে দিচ্ছে।তার সাথে অনুযোগ, পড়াশোনাটা করছো না কেনো!ফার্স্ট ইয়ারেই হাকিম চত্বর, টি, এস, সি, চারুকলায় পেয়েছিলাম হ্যাপিকে।পাশে বসে চা খাচ্ছিলাম হাকিম চত্বরে, চোস্ত প্রমিতে হ্যাপি সুধালো, তুমি চয়ন না, রুবেনের কাজিন!এর পর ড্রাগ ওভারডোসে  হ্যাপির মৃত্যুর আগ অব্ধি প্রায়ই দেখা হতো, খুচরা আলাপে এটা ওটা জানাতো, লাকি ভাইর প্রসংগ খুব একটা আসতো না।ঢাবিতে, চারুকলায় নতুন, নতুন ব্যাচ আসছে, হ্যাপি তাদের সবার হ্যাপিদা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ধারাবাহিক কিছু বন্ধু ছিলো পুরান ঢাকার, যে যেখানে কিছু বাজাতো বা বাজাতে চাইতো হ্যাপির বন্ধু হয়ে যেতো।এদিক থেকে লাকি ভাই সিলেক্টিভ ছিলেন।একদিকে হ্যাপিদের বেহিশাবি আত্মহনন, আরেকদিকে কবি সাবদার সিদ্দিকীদের হাটাবাবা, ছন্নছাড়া যাপনের হাতছানি। তখন প্রায় ভুর্তুকি দিয়ে সামরিক সরকার বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজগুলোতে ম্যান্ড্রেক্স, পেথেডিন ছড়িয়ে দিয়েছে।পাড়ায়, বেপাড়ায় তরুনদের ভেতর নতুন নেশারু, বেমক্কা হার্টফেল সঙ্খ্যা বাড়ছিলো দাবানলের মতো।


আমি পরে একটা নান্দনিক প্রতিতুলনায় এসেছি।হিশাব, বেহিশাব ডিঙ্গিয়ে শহীদ কাদরি, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, মাহমুদুল হক, সাবদার সিদ্দিকী বাংলাদেশের ভেতরে পশ্চিম বঙ্গিও নস্টালজিয়ার একটি ধারাবাহিকতা।অন্যদিকে শামসুর রাহমান থেকে লাকি আখন্দ, আজম খান যে ভাষাগত, নান্দনিক পারস্পরিকতা তৈরি করেছিলো তা একান্তভাবে লোকাল প্রডাক্ট।এ দুটো মিলিয়েই আমার 'ভাঙ্গা ৯ঋক ও ভাঙ্গা বয়ান'!


আমাকে স্বরলিপির ব্যাপারটা হ্যাপি বুঝিয়ে দিয়েছিলো রিক্সার বেল, আইসক্রিমওয়ালার ঘন্টি, ট্রাকের হর্ন, ফকিরদের গান এসব থেকে, কখনো হাকিম চত্বরে, কখনো টি, এস, সিতে।স্টাফ নোটেশানও বোঝাতে চাইতো, ধৈর্জ ছিলো না।ওকে জানিয়েছিলাম, রুবেনের ইয়মাহা আমলে আমাকেও আব্বা একটা ঢাকাই গিটার কিনে  দিয়েছিলো, কিছুদিন যেতে না যেতে সেটা কি একটা ব্যাপারে ভেঙ্গে যায়, আমারও আর তেমন এগোতে ইচ্ছা করে নাই।বিলাতে ব্রডকাস্টিং ডিপ্লোমাতে সাউন্ড বেস, পিচ ট্রেনিং নিয়েছি, ছেলের পিয়ানো শেখবার সুবাদে পশ্চিমি স্টাফ নোটেশানের ধারা জেনেছি অনেক বছর ধরে, উত্তর ভারতে গিয়ে সংস্কৃত মন্ত্র শিখেছি বছরের পর বছর, কিন্তু স্বরলিপি, নোটেশান নিয়ে হ্যাপির সে-কথাগুলো আমার এখনো পাথেও হয়ে আছে।হ্যাপি ওর নিরব উ আ কথায় এরকমও জানিয়েছিলো, লাকি ভাই অনেক বেশি গোছালো, অনেক জানে, বলে না। নব্বইয়ের পর লাকি ভাই ও কাওসার* ভাইয়ের সাথে যখন ঘনিষ্ঠতা হয় তখন লাকি ভাই জানতে চেয়েছিলো, হ্যাপি কি আমার কথা তোমাদের কাছে বলতো?


লাকি ভাই আমার কাছে যেভাবে হ্যাপির কথা জানতে চেয়েছিলো, তা শতাংশে আন্তরিক।হ্যাপি মারা যায় ১৯৮৭ সালে ২৭ বছর বয়সে।রেডিওতে প্রযোজকের কাজ করলেও, লাকি ভাই সুধি মহলে নিজের গান উপস্থাপন করে ১৯৮৪ সালে।তিন বছরের ভেতর অর্থাৎ হ্যাপির মৃত্যুর পর প্রায় এক যুগ উনি নিজেকে গানের জগত থেকে গুটিয়ে নেন।১৯৯৮ তে ফেরত আসেন বিতৃষ্ণা জীবনে আমার পরিচয় কবে হবে এলবাম দুটি নিয়ে।দ্বিতিয় এলবামটিকে হ্যাপির আগের একটি একক এলবামের নবায়ন বলা যেতে পারে।আমি যখন স্প্যানিশ কিম্বা ব্রাজিলিও পুর্তুগিজ সহজিয়া গান শুনি গিটার স্ট্রামিংএর সাথে, লাকি ভাইর গানের ভঙ্গির খুব মিল পাই।


ছবির মানুষেরা  


এবার আবার ছবির মানুষগুলোর কথায় ফেরা যাক।শামসুর রাহমান থাকতেন নতুন উঠে আসা শ্যামলির ভাড়া বাড়িতে।সামরিক জান্তা বিরোধি আন্দোলনের শেষ দিকে দৈনিক বাংলার সম্পাদকীয় পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।যে-আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে সামরিক জান্তার পতন হয়েছিলো, তার সূত্র ধরে জামাতে ইসলামির বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় শরিক হয়ে যাওয়া, ক্ষমতাচ্যুত সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সংসদে জাকিয়ে বসার পাশাপাশি আশেপাশের এক্টিভিস্টদের রাতারাতি টাকার কুমির বনে যাওয়াটা দেখছিলেন।নিজের দিকেও বার্ধক্যের পাশাপাশি মৌলবাদিদের হুমকি টের পাচ্ছিলেন।সেদিনের সে-আলাপে অল্প কথায় বলেছিলেন, এদের গনভিত্তি নেই, কোনো দেশেই নেই।এজন্য সন্ত্রাশের আশ্রয় নেয়, বড় লোকজনদের আক্রমন করে ছোটদের ভয় দেখায়, ক্ষমতায় গেলে তাই করে। আশেপাশের এক্টিভিস্টদের নিয়ে বলেছিলেন, ধান্দাবাজ, ঠিকাদারি স্বভাব, মিডিয়ায় কাজ জোটাতে একটা কিছু দরকার, তাই  চারপাশে ঘুরঘুর করছে। 


কাওসার ভাই, লাকি ভাই আর আমি শামসুর রাহমানের বাসার উদ্যেস্যে সেদিন যাত্রা শুরু করেছিলাম আজিমপুর থেকে।একেবারে হেটে হেটে শ্যামলি।আমি তখন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে কাজ করি কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে।সে-কাজটির আগে এক দফা নব্বইয়ে বিলাতে এসে রেস্তোরায় বাসন, কোসন মাজা, ওয়েটারিং করে গেছি কয়েক মাস।ঢাকাতে ব্রিটিশ এয়ারোয়েজ স্টাফ নিচ্ছে, মেজো বোন ইভা এ-খবর জানাতে পরীক্ষা দিলাম, ওরা নিলো।বিলাতে আর ফিরলাম না তখন।এর আগে কিন্তু ঢাবিতে শেষ সেমেস্টার না দিয়ে বিলাত চলে গেছিলাম।নীলাও ছেড়ে গেছে, নাটক, কবিতাও তেমন আর টানছিলো না।ব্রিটিশ কাউন্সিলে নাটক পরিচালনা, সচিত্র সন্ধানি ইত্যাদিতে কবিতা ছাপা, আবিদ আজাদ এখানে ওখানে আমার কথা বলছে, নির্মলেন্দু গুন এক দফায় ১০ স্তবকের কবিতা ছেপে দিচ্ছে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্নেহভরে উলটাপালটা বকতে দিচ্ছে, শুরু হিশেবে মন্দ ছিলো না।কিন্তু টানছিলো না।বৈমানিক বড় ভাই আপন মারা গেলো ১৯৮৮ সালে, জমজ কঙ্কনের মানষিক অসুস্থতা দেখা দিলো।


বিমানবন্দরের কাজে যেতাম ঢাকা কলেজ, ফার্মগেট হয়ে টেম্পো, বাস মিলিয়ে।বাইরের পোছপাছ যাই থাকুক, কাজটা ছিলো বোরিং।তারকাদের বিদেশ যাওয়া, লন্ডনগামি সিলেটিদের পান,  চুনের হিশাব নেয়া, মুম্বাইগামি মডেলদের সাথে খোশালাপ এক জিনিস আর নির্বাসিতার আতঙ্কিত মুখ দেখা আরেক জিনিস।লজ্জা  ততদিনে নিষিদ্ধ।মৌলবাদিরা যার ফাশি চাইছে, তাকে নিয়ে সতির্থ লেখকেরা কথা বলতে চাইছে না।মৌলবাদিদের সাথে মিলে সবগুলো দল একটা স্ট্যাটাস কো করে নিতে চাইছে দির্ঘ মেয়াদে, উঠতি ও প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজিবিরাও তাতে সমবেত।ফার্মগেটের কাছাকাছি তেজগা যাবার পথে সুরম্য এক বাড়ির সামনের লনে রাখা ভাস্কর নভেরার ফোয়ারা ঘেরা ভাস্কর্জগুলো ভেঙ্গে তখনো বহুতল ওঠে নাই।যেহেতু বিমানবন্দরের ডিউটি ফৃতে তখন আমার যাতায়াতে চাকুরি সুত্রে কোনো বাধা নাই, NGOতে কাজ করা বন্ধুরা ডলার ধরিয়ে একটু বিয়ার এনে দিতে বলে, আমিও এনে দেই।কাজল শাহ নেওয়াজ তখন ঢাকার নুতন বাসিন্দা,এঞ্জিওতে কন্সাল্টেন্সি করছে আর বেশুমার কামচ্ছে।মকৃবি শেষ করে এমবিএ পড়তে আসা মুরাদ ভাইর ডেরা তখন গ্রিন রোডের এমবিএ হোস্টেলে, সেখানে কাজল, রিফাত, চৌধুরী অমিতাভ পাল, আতিক ভাইদের অনুষংগজাত আড্ডা। শুনলাম আড্ডা থেকে উঠিয়ে কাজলকে ওর মামা নারায়নগঞ্জে নিয়ে বিয়ে করিয়ে দিয়েছে।এখানে ওখানে পুরানা ইয়ার কচি ওরফে আহমেদ মুজিব, তারিক সুজাত, লিটু ওরফে খায়রুল আলম চৌধুরীদের সাথে দেখা হয়।বিশাল দেহি মাহবুব পিয়াল এসে গিটার বাজিয়ে ওর নতুন বাধা গানগুলো শোনায়।ঢাকায় ঠাই বিহীন, অথচ ঢাকায় পরিবেশ থিয়েটারের শেকড় গাড়তে পরিকর আশিষ খোন্দকার, লোক চর্চার নবিশ কফিল আহমেদ মাঝে মাঝে এসে টানা কয়েকদিন আজিমপুরের বাসাতে কাটিয়ে যায়, এটা ওটা বলে।আমার মন মানে না, কেবল পলাই, পলাই।


এর ভেতর দেখা হলো, সখ্যতা হলো বিমান কর্মি মুন্নির সাথে।মহা পাগলুটে।মুন্নি আর আমি রাত, বিরাতে এহেনো যায়গাতে নাই রিক্সাতে, পায়দলে ঘোরাঘোরি করি নাই।রাস্তার পাশে দাড়িয়ে, বাস যাচ্ছে, বলে উঠলো, উঠেন, উঠেন।আমরা দুইজনকে আপনি আপনি করতাম।বাস এসে থামলো সাভার ক্যান্টনমেন্টে।মুন্নি বল্লো, এটা সুন্দর জায়গা, চলেন হাটি।  আমি বললাম, মুন্নি এটা ক্যান্টনমেন্ট।মুন্নি বলে উঠলো, গুল্লি মারেন ক্যান্টনমেন্ট।  চলেন হাটি।সুন্দরিদের আর্মিরা কিছু বলে না।ওর ভাই ন্যাভাল অফিসার হওয়াটা আসল জোর না কি ওর ভেতরটাই ছিলো আসল জোর, তা তো আর এ বেলায় জানা যাবে না।এরকম নিরুদ্দিষ্ট ঘোরাঘোরির এক দিন মুন্নি আমাকে আজিমপুর গার্লস স্কুলের কাছাকাছি পরিবার পরিকল্পনার অফিসে ঢুকিয়ে ছাড়লো।বলে যে ওখানে না কি আকাম, কুকামের জিনিস সস্তায় পাওয়া যায়।বেহুদা ওখানের এ বারান্দা, সে বারান্দায় ঘোরাঘোরির সময় একটা রুমের মাথায় লেখা দেখলাম কাওসার চৌধুরী, একই বোর্ডে লেখা আলতাফ হোসেন।বিশ্বাস করেন, দুজনের কাউকেই চিনি না।মুন্নি জানালো, চলেনতো দেখি এই কাওসার সেই কাওসার কি না!ঘরে

ঢুকলাম  মুন্নি  জানি, কি কি সব কেমন আছেন ইত্যাদি করে , আমাদের পরিচয় দিয়ে চম্পট।মুন্নিকে পরে তেড়েমেড়ে জিজ্ঞেস করতে জানালো, হ্যা হ্যা উনি সেই সঙ্গিতকার, আপনের কলিগের জামাই।এটা বুঝে আমি ফুট। আমিতো হাসতে হাসতে চিত।মুন্নি বেরিয়ে যাবার পর, আমিও কুশলাদি জেনে বেরিয়ে পড়ি।আলতাফ হোসেন অনেক দিন ধরে কবিতা লিখছেন।ঢাকেস্বরি মন্দিরের কাছাকাছি আবিদ ভাইর শিল্পতরু প্রেসের এত কাছাকাছি অফিস থাকবার পরেও আলতাফ ভাইর সাথে দেখা হয়ে উঠে নাই।পরেও আর জমে নাই।এর পর আমি আর পরিবার পরিকল্পনার অফিসের দিকে যাই নাই।আজিমপুরে আবার কাওসার ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেলো, এটা ওটায় জমে গেলো।


লন্ডনে, ২০০৭সালে 'চাকমা চিত্র' পাঠ :

লিসা গাজী, অপু চৌধুরী


সেসময় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একবার আমার রাঙ্গামাটি মনোঘর অনাথ আশ্রমের ভ্রমনের ব্যাবস্থা করে দেয়।ওখানে গিয়ে সময় কাটাই ঝিমিত, শিশির, মৃত্তিকাদের সাথে।ইতিমধ্যে লোগাংসহ পাহাড়ের আরো অনেক জায়গায় সামরিক, বেসামরিক তান্ডব চালানো হয়েছে।সেগুলোর খবর ঢাকায় আসে না।মনোঘর ভ্রমন, আদিবাসি পাহাড়িদের প্রতিক, উতপ্রেক্ষা মিলিয়ে লিখলাম কবিতা সিরিজ,
চাকমা চিত্র।ছাপালাম গ্রন্থিকা হিশেব।ছাপাছাপি করেছিলো, কচি আকা আহমেদ মুজিব।গ্রন্থিকাটির পেছনের ছবি তোলা উপলক্ষ্যে, কাফি বিল্লাহ আমার অনেক ছবি তুলেছিলো।কাফি বিল্লাহ পরে কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে নামজাদা অর্থনিতিবিদ হয়, ক্যারিয়ারের কয়েক বছরের মাথায় কাফি নিউইয়র্কে মারা যায় হার্ট এটাকে।কাফির কাজের স্বিকৃতি হিশেবে কর্নেল ইউনিভার্সিটি একটি পদক চালু করেছে।চাকমা চিত্র উতসর্গ করেছিলাম  শামসুর রাহমানকে।হরতালের ভেতর বিমানবন্দরে না গিয়ে বাসায় বসে আছি।কাওসার ভাইকে দেখি লাকি ভাইসহ বাসার সামনে দাড়িয়ে মেজো বোন ইভার সাথে কি কি বলছে।এর আগে জিন্দেগিতেও ওনাকে আমাদের বাসার দিকে দেখি নাই।আমাদের অফিস পার্টিতেও দেখি নাই।ইভা বুঝেছিলো যে আমার কাছে এসেছে।কাওসার ভাই হাটতে বেরোবার আমন্ত্রন জানালো।জিজ্ঞেস করলো, কিসে ব্যাস্ত ছিলাম।মনোঘর যাবার কথা জানালাম, চাকমা চিত্র প্রকাশের কথা জানালাম।শামসুর রাহমানকে উতসর্গ করেছি শুনে বল্লো, তাহলে চলো দিয়ে আসি।


বোকা বুড়ো পাহাড় কেটেছে


তারপর তিনজন হাটা শ্যামলির দিকে।শামসুর রাহমানের বাসার সামনে এসে লাকি ভাই আর ঢুকতে চান না।তখন জানলাম, ওনারা কি রকম য্যানো আত্মিয় হোন, কিন্তু অনেক বছর ওনাদের দেখাসাক্ষাত নাই।কাওসার ভাই গুতোগুতি করে ওনাকে ঢোকালেন।ভেতরেও লাকি ভাইর একটা অস্বস্তি থেকেই গিয়েছিলো।পুরো পথে আমাকে এটা ওটা বলছিলেন, সেটাও নেই।শামসুর রাহমান সপ্রতিভভাবে আমাদের স্বাগত জানালেন।আমার গ্রন্থিকাটি নিয়ে খুব খুশি হলেন, উলটে পালটে পড়তে থাকলেন।এক জায়গাতে এসে বললেন, কারো কিছু পড়বার সময় দেখি যে এমন কোনো শব্দ আছে কি না, যা এখনো আমি ব্যাবহার করি নি, মানতাষা শব্দটি খুব ভালো লাগছে।


গুন্টার গ্রাস ও বেলাল চৌধুরী
পুরানো ঢাকা, ১৯৮৬।

প্রসঙ্গত ওনাকে মনেও করিয়ে দিলাম যে গুন্টার গ্রাস ঢাকাতে এসে অনেকের কাছে ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেছিলেন যে বাংলাদেশের কোনো লেখক আদিবাসী ও বিহারিদের সমস্যা নিয়ে মুখ খুলছে না।জানতে চাইলাম, ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ এবং আশির দশকেও ওনাদের অনেকে অধিকারগত আন্দোলনগুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে, কিন্তু সংখ্যালঘুদের অধিকার বঞ্চনা নিয়ে নীরব থেকেছে, এটা হলো কি করে!উনি জানালেন যে ঢাকাতে গুন্টার গ্রাসের সফরসঙ্গী ছিলেন বেলাল চৌধুরী, তার থেকে উনি গ্রাসের এই বক্তব্য শুনেছেন।জানালেন যে এটা একটা বড় গ্যাপ হয়ে গেছে।আরো যোগ করে বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মিও রাজনীতি উস্কে দিয়ে যেভাবে ১৯৭২ সংবিধান থেকে সরে আসা হচ্ছে, তাতে এই দূরত্ব আরো বাড়বে, এই গ্যাপটাতে সহিংসতার বীজ লুকিয়ে আছে।সেই সহিংসতা শামসুর রাহমান নিজের জীবনে দেখে গেছেন এবং তার শিকার হয়েছিলেন।


শামসুর রাহমান আমার পাশে বসে আমার কবিতা পড়ছেন, এটা আমার মন ভরিয়ে দিয়েছিলো।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশন জট প্রসঙ্গে জানতে চাইলেন, মাস্টার্স করছি না কি।জানালাম যে মাস্টার্সে ভর্তি হই নাই, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে চাকুরি করছি এয়ারপোর্টে, সেটা ছেড়ে দেবো শুনে, অন্য কিছুর ব্যাবস্থা করেছি কি না জানতে চাইলেন।বল্লাম যে আমি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি কিছুদিনের ভেতর, কি করবো ঠিক জানি না, তবে কবিতা লিখবো।দেশ ছাড়ার সে ঘোষনাটি ফাপা ছিলো না, তার কিছুদিনের ভেতর আমি  স্থায়ি ভাবে দেশ ত্যাগ করি, তারপর ২০০৭ অব্ধি নিরুদ্দিষ্টভাবে ১৪ বছর।সে ঘোষনাটির আগ থেকেই আমার মনে উদাস বোহেমিয়ার ঢেউ আছড়ে পড়ছিলো, ছবির চয়নের মুখে হাসি দেখি না, কিন্তু চোখে দেখি সুদুরের পিয়াসা।শামসুর রাহমান কাউকে তেমন তুমি বলতে শুনি নাই।লাকি ভাইকে খুব স্পষ্টভাবে সম্ভাষন করেছিলেন, 'লাকি কেমন আছো, অনেকদিন পর।' সে  সম্ভাষনে কি লুকিয়ে ছিলো লাকি ও হ্যাপির হারানো মাতৃকুলের  নিবিড়  আকুলতা ?


আসলে অনেক মানুষ থাকে যাদের কিছু হবার চাইতে পথ চলাতে বেশি আনন্দ।এরা পেছনের নৌকা পুড়িয়ে ফেলে।লাকি ভাই যে ফিরে এসেছিলেন, অনেকের সাথে গান করেছিলেন, কিন্তু ওনার সেই ছোট ভাইয়ের সাথে কি উনিও অনেক আগে হারিয়ে যান  নাই?এক যুগ গুটিয়ে থেকে হয়তো বুঝতে পারছিলেন নিজের  থেকে পালানো, নিজের থেকে সরে যাবার থেকে কঠিন।আমার মনে হয়েছে, হ্যাপির  স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানোটা ছিলো আত্মপ্রবোধ।উকিঝুকি মেরে নিজেকেই খুজছিলেন।দৃষ্টিপাত আরো বড় করতে চাইছিলেন, আরো মেলে ধরতে  চাইছিলেন নিজেকে।বাংলাদেশের যে ভাংচুরের  ভেতর  লাকি ভাই একই শহরের ভেতর ফিরে এসেছিলেন, তার মেটাফোরটা বুঝতে অমুক তারকার গাওয়া তমুক গানের দিকে তাকালে বিচুর্ন আয়নাটি আরো আরো ত্যাড়াব্যাকা হবে।



ছবির দুজন মানুষ আর আমাদের সামনে  গান গাইবেন না, কবিতা পড়বেন না।কির্তি রেখে গেছেন।আমিও একদিন থাকবো না।এইতো করোনাকালে চিলির লেখক সেপুল্ভেদার মৃত্যুতে তার স্ত্রি কবি কারমেন ইয়ানেজের বিদায় গাথাটি অনুবাদ করছিলাম, যার শেষ দুটো লাইন,

''এখন অন্যরা বলবে

তোমার বেচে থাকার গল্প''


চয়ন খায়রুল হাবিব

২১/০৪/২০

ব্রিটানি/ফ্রান্স


Photos :

1) Cover photo by Kowser Ahmed Chowdhury.

2) Shahabuddin with fine arts student by Akram Hossain Dolon.

3) Gunter Grass and Belal Chowdhury, byNasir Ali Mamun.