ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Saturday, June 5, 2021

আনমনার না পাওয়ার গল্প

।।কাকলী সরকার।।


জীবনটাকে খুব সুন্দর স্বচ্ছ ভাবে কাটিয়ে নিয়ে চলছিলাম। হটাৎ রাস্তার সামনে এসে কেউ হাটাহাটি করছিল।কিছু বুঝে উঠার আগেই হাতটি ধরে নিল।বাঙালী বোলে কথা, এই হাত কি আর ছাড়ানো যায়।

মেয়েটি খুব রূপসী।কারো ভাষায় শ্রী,আবার কারো ভাষায় সাজুন্তি।মেয়েটির ভাষায় সে একটি মানুষ। বড্ড বেশি যন্ত্রনা, এই মানুষ হওয়ায়। কারো মিথ্যা সে শুনতে পারেনা,কারো হটকারিতা সে মানতে পারে না।কারো অভিনয় সে সহ্য করতে পারেনা। তাঁকে নিয়ে তোলপাড় হয় অনেক জায়গায়।
অপমান, অবহেলা, অপবাদ এতো নিত্য দিনের উপহার। এগুলো সময়ের সাথে সাথে সয়ে গেছে। চুপ করে থাকা তাঁর স্বভাব না, সারাক্ষণ সবাই কে মাতিয়ে রাখে।বন্ধু মহলে তাঁর বেশ নামডাক। ভাল গান করে। অনেক জায়গার গানের উপহারও আছে।
চার ভাইবোনের মধ্যে সে তৃতীয়। বিয়ের পিড়িতে বসে পড়তে হলো পড়াশোনা শেষ না করেই।আস্তে আস্তে সংসারে দুই সন্তানের আর্বিভাব।একটি মেয়ে তার তিন বছর পর একটি ছেলে। স্বামী বড় ব্যাবসা করে, কোন কিছুর অভাব নেই।লোকের কাছে ও বড়ো ভাগ্যবতী।ওর মতো ওত সুখী ক'জনা হয়।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বাগান পরিচর্যা করা সংসারী মহিলার কাছে অসুবিধা জনক।কিন্তু স্বামীর আদেশ শুনতেই হবে।নানান কাজের জন্য সব ঠিকঠাক পরিপাটি রাখার জন্য রোজ ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে বসে। তারপর সুইস অন আনমনার।

আনমনা আনমনে সকল কাজ ও কর্তব্য করে বেড়ায় সারাদিন। তারপরও পিয়াশের কাছে ওর জবাবদিহি দিতেই হবে। কটকটে পিয়াশের যন্ত্রনায় বিয়ের পরই গানটা ছেড়ে দিয়েছে। বাপের বাড়ির সাথেও তেমন কোন সম্পর্ক নাই।আনমনা নিজেই নিজের কাজ নিয়ে ব্যাস্ত থাকে।
মা মা এদিকে দেখে যাও;
একটু উচ্চ স্বরে আনমনা বলল আসছিরে--,
বাস অমনি কটকটে বলে উঠলেন কেন জোরে আওয়াজ হচ্ছে।
সকাল বেলা বাসি ঘর ঝাড়ু দেয়া থেকে শুরু করে বাগানে জল দেয়া,জলখাবার তৈরি করা,খাবার পরিবেশন করা, সন্তানদের স্কুলে পৌঁছে দেয়া সবই আনমনা র কাজ।পিয়াশ তখন চা আর খবরের কাগজে মগ্ন থাকে।
পিয়াশ খুব পছন্দ করে আনমনাকে।সংসারী ও কথা শোনার জন্য আনমনার প্রেমে মুগ্ধ পিয়াশ।সবার কাছে বৌএর প্রসংশায় গলে পরে।মাঝে মাঝে উপহার স্বরুপ শাড়ি ও গয়নাও নিয়ে আাসে।তবে সেই কটকটে স্বভাবেই তা পরিবেশন করে।
আনমনার বাড়ি ঢুকতে হলে তিনটি বিশাল দরজার সাথে যুদ্ধ করে ঢুকতে হয়।সে কারণে পেপার,দুধ ওয়ালা খুব বিরক্ত। প্রথমটি মোটা কাঠের তৈরী ঢাসা নামক লাঠি দিয়ে উপর দিকের ছোট এক কাঠের টুকরো সরিয়ে দরজা খুলতে হয়।২য় টি গ্রীলের মধ্যে একটি লোহার কাঠির মতো কিছু থাকে তা দিয়ে একটি বিশেষ কায়দায় খুলতে হয়।আর তৃতীয় টিকে,
বেল দিয়ে নীচে দাঁড়িয়ে থাকলে আনমনা দোতলা থেকে নেমে এসে খুলে দেয়।
আজ সকালে জলখাবারের আগে পিয়াশ কে বেল পানা দেয়া হলো। দেখেই শুরু করলো,এগুলো খাওয়ার কি দরকার। খেলে রাস্তায় অসুবিধা হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। পিয়াশ কাজে বের হয়ে গেছে।
আনমনা খুব ঠান্ডা মাথায় সবকিছু মেনে নেয়। রোজ পিয়াশ বের হলে ঘরে গান ছেড়ে কখনো গান গায় আবার কখনও বা আয়নার সামনে নিজেকে দেখতে দেখতে অতীতে হারিয়ে যায়---------কোন এক বিকেলে আকাশ মেঘলা ছাদে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনার চোখে জল ছল ছল,,,,,,,,,,।
মেঘলা আকাশ ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনার মনেপরে গেল প্রথম দেখা পিয়াস কে।প্রথম পলকে মনটা ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। দু'জন দুজনের চোখে চোখ পরতেই পলকে আঁটকে ছিল কিছুক্ষন। সেদিনও ⛅ মেঘলা আকাশ ছিল।পিয়াশ কে দেখে যে কোন মানুষের মন ভরে যাবে। ওর সুদর্শন চেহারা যে কাউকে আকর্ষণ করবে।
আনমনার দিকে তাকিয়ে পিয়াশ-- টানা টানা চোখের চাহনি , পাতলা ঠোঁটের মিষ্টি হাসি, পিঠ ভরা লম্বা চুল,সেই চুলগুলো বাতাসে উড়ছে, গায়ের রং টি যেন এত সুন্দর হয়ে আকাশের সাথে মিশে যাচ্ছে, সবমিলিয়ে এই দৃশ্যে পিয়াশ আনমনায় আনমনা। এর মধ্যে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। দৌড়ে দুজনেই মাঠের পাশে এক ঝুপড়ি দোকানে এসে আশ্রয় নিল।সেখানে আরো দুতিনজন লোক এসেও দাড়িয়েছে।
দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে, বৃষ্টির ঝাপটা গায়ে লাগছে। যতোই ঝাপটা বেশি লাগছে দুজন ততটাই আরো বেশি কাছে আসছে।এক সময় গায়ে লেগেই দাড়িয়ে থাকতে হলো।অনুভব টা তখন অস্বাভাবিক। আনমনার শরীর ও মন তখন
শিহরিত। নতুন কিছু আবির্ভাব হচ্ছে বোলে মনেহল।
এরপর মাঝে মাঝে দেখা করা হতো,তারপর গুরুজনেরা চারহাত এক করে দিল।
ছেলে মেয়েদের স্কুলে পৌঁছে বাসায় আসার পথে মোড়ের মুদি দোকানের সামনে হটাৎ আনমনা রাস্তায় পড়ে যায়।
কি যে লজ্জা পেয়েছে আজ!
দোকানদার দৌড়ে গিয়ে ধরে উঠিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে।
আনমনার মোবাইল দিয়ে পিয়াশকে ঘটনাটা জানায়।
আনমনা তরি ঘরি করে বাড়ি ফিরে আসল।শরীরটা খুব একটা কথা শুনছেনা।আগের মত সংসারটাকে দেখাশোনা করা যাচ্ছে না।ঘরের দিকে ঘরনির যত মন থাকে, তার একভাগও নিজের শরীরের দিকে থাকে না।
খুব জোর গলায় আওয়াজ করে আনমনা আনমনে কোথায় তুমি!!!!!
শরীরটা অবশ হয়ে গেছে। মাত্রই বিছানায় গা লাগিয়েছে, আওয়াজ শুনে উঠে বসে পড়লো।
কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ! আগে তো বলনি কোনদিন? চল ডাক্তার দেখাতে হবে।ওঠো রেডি হয়ে নাও।অনেক দিন পর আগের পিয়াশ কে পাওয়া গেল।
ডাক্তার সাহেবা অনেক টেস্ট দিয়ে বলে দিল--- তেমন কিছু না,তবে টেস্ট করে নিয়ে আসলে সব বোঝা যাবে।এই টেস্ট এখন নতুন চিকিৎসার একটা অঙ্গ।
সকালের কাজ সেড়ে আটটার মধ্যে বের হয়ে গেল আনমনা আর পিয়াস,টেস্ট গুলো করার জন্য।আনমনা কে নিয়ে পিয়াশ একটু টেনশনে আছে। বাড়ি থেকে বের হয়েই দেখে রাস্তায় জটলা। পাশের বাড়ির বৌদি নাকি আত্মহত্যা করেছে।
কি ভয়ানক!!!!
বৌদিকে এবাড়িতে এসেই পেয়েছে আনমনা। বধুবরণ থেকে শুরু করে ফিরে উল্টো আসা পর্যন্ত কুলো হাতে সকল কাজ গুছিয়েছে এই বৌদি। ফিরে চলে আসলাম বাড়িতে, আজ আর যাব না।
আজ সকাল করে বের হয়ে সব টেস্ট দিয়ে এলাম।দুদিনের মধ্যে সব রিপোর্ট চলে আসবে। নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে, প্রকৃতির কাছে যেতে ইচ্ছে করছে।
আজকাল নিয়ম মেনে চলাটা ভালো লাগে না।নিয়ম ভাঙার খুব আকাঙ্খা!!!!!
হটাৎ কে যেন এসেছে! জোরে কথা শোনা যাচ্ছে। ঘরের দিকেই আসছে,,,,,,,,
ও বাবা কাঁকন তুই, এতদিন পর কি মনে করে? কিছু মনে করে আসতে হবে বুঝি……
কেমন আছো? কি হয়েছে? কেমন লাগে?
আরে আস্তে বলি, তোর ডাক্তারী শুরু হবে তা তো তোকে দেখেই বুঝেছি। তুই কেমন আছিস? কি খাবি বল!!!!!
সারাদিন আছি আগে তোমার সব কথা শুনি পরে খাওয়া যাবেক্ষন।
সব শুনে কাঁকন একটু গম্ভীর। গম্ভীরমুখেই বলল টেস্টগুলো আসুক আগে।এতদিন পর কেন ডাক্তার দেখাচ্ছ?
পিয়াশ বলে উঠলো কোনো কমপ্লেন তো করেনি,,,
কাঁকন কে কিন্তু চিন্তিত মনে হচ্ছে!! কি রে কোন খারাপ কিছু নাকি!!!!
আবারো বললো টেস্ট গুলো আগে আসুক। এগুলো মুখের কথায় কিছু বোঝা যায় না।
ঘুম ভাঙলো নাকি!!!!
কি ব্যাপার স্যাপার এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছ???
সেই সকাল থেকে এসে বসে আছি, তোমার ঘুম ভাঙছে না।কি সব ঠিক আছে তো?
ও বাবা কাঁকন তুই এসেছিস,আমি ঘুমাচ্ছি একদম টের পাইনি।
হ্যাঁ, দাদা আর আমি বের হবো,তুমি মুখ ধুয়ে আসো।
ওরা রিপোর্ট আনতে বের হয়ে গেল। আজ প্রথম বোধ হয় এত বেলায় ঘুম থেকে উঠলাম।
বেলা হ'য়ে গেছে তারাতাড়ি করে কাজ সেরে ফেলি,আবার সব এসে পড়বে দুপুরে।
"
"স্নানে গেলাম"
জল ঢালতে ঢালতে মনে হল শরীরে শক্তি পাচ্ছি না। আজকে দিনটা পার হতে চাচ্ছে না।শরীরে কি কোন রোগ বাসা বাঁধলো!!!!
তারাতাড়ি করে বের হয়ে এসে শুয়ে পড়লাম।
ওরা এসেছে, দুজনের মুখ ভার হয়ে আছে!
কি এসেছে রিপোর্টে? সাথে সাথে পিয়াশ উত্তর দেওয়ার আগেই মুখের কথা কেরে নিয়ে কাঁকন বলে উঠলো --
আরো কিছু টেস্ট করতে হবে।
এই টেস্টে খারাপ কিছু আসেনি তো!!!
পিয়াশ বলে উঠলো ভালো কিছুও আসেনি।
সাথে সাথেই কাঁকন বললো সারাক্ষণ তোমাকে কি বুঝাতে বুঝাতে আসলাম,আর এসেই কিনা,,,,,,,
আমার মাথা ব্যাথা ছাড়া আর তো কোন অসুবিধা ছিল না।
কিন্তু এদের মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে অন্যকিছু! ¡!!!
বিছানা থেকে নামার জন্য যেই পা বাড়ালাম, মনে হলো চোখে সব অন্ধকার। না, নামতে পারিনি ওরা দু'জন আমাকে ধরে শুইয়ে দিল।
আজ ঘরের কোন কাজই হয়নি। আমি তো টেরই পাইনি কখন সকাল হলো!
তাকাতেই পারছি না, এখন কি হবে?ওদের খাওয়া দাওয়া কিভাবে চলব?বাকি কাজ না হয় বাদ দিলাম.......
এই তো সংসার!সংসারে দুজনের বোঝাপড়া ভালো থাকতে হয়। বোঝা পড়া ঠিক না হলে একই ছাদের নীচে থেকেও মনের কাছাকাছি কেউই আসতে পারে না।
আজ পিয়াশ খুব চিন্তিত আমাকে নিয়ে কারণ আমার যদি কিছু হয় ওর সংসার কিভাবে চলবে?
কিন্তু এতো বছরে একদিনও আমার মাথা ব্যথায়, কাছে এসে জিজ্ঞেস করতে পারেনি কিছু লাগবে নাকি আমার!!!!!
আমি একাই এই সংসারে নিজের মতো করে কখনো ঘরের আসবাবপত্রে কখনো রান্নায় আবার কখনো বা আতিথেয়তায় সুখ অনুভব করে শান্তি খুঁজে নিয়েছি।
জীবন বেলায় এই আক্ষেপ গুলো মেনে নিয়েও সংসার নামক স্বপ্নের জায়গায় সুখের নেশা করার আর সময় পেলাম না।
নিঃশ্বাসটা কেন জানি আর আমার কাছে থাকতে চাইছে না।
সব অন্ধকার হয়ে আসলো।

।।কাকলী সরকার।।
১৬/০৫/২১
ঢাকা, বাংলাদেশ

কভার পেইন্টিং, হ্যাজেল মিলার