ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Friday, April 16, 2021

সম্পাদকীয় : বাঙালি দেহগুলো গেলো কোথায়?

 ।।তৃণা রাব্বানি।।

বাঙালি কিশোরি সার্ফার, কক্সবাজার, বাংলাদেশ।ছবি, ভেনেসা রুড।

বাংলাদেশের ঘাটে, মাঠে, পথে, সৈকতে, জঙ্গলে মানব দেহের মেলা।কিন্তু বাঙালি মানব, মানবীর দেহ বাঙ্গালি ক্যানভাসেও নাই, ফটোগ্রাফিতেও নাই।কোথাও কি নাই?কোভিডে যা আক্রান্ত হলো তাও দেহ, কোভিড থেকে যা বাঁচবে তাও দেহ।বেহুলা, লখিন্দর, রাধা কৃষ্ণ, লাইলি মজনু, শিরি ফরহাদ, রোমিও জুলিয়েট আলিঙ্গন, চুম্বন, আকুতি, আর্তনাদ যা করেছে তার সবই দৈহিক।এসব চরিত্র,গাছের গায়ে ঠোট ঘসে প্রতীকী চুম্বন সারে নাই।

সার্ফিং শিক্ষক রাশেদ আলম ও ছাত্রছাত্রি,
কক্সবাজার, বাংলাদেশ।
ছবি, ভেনেসা রুড।

নদীমাতৃক বদ্বীপে নদীর সাথে, সগরের সাথে ছেলেমেয়েদের সম্পর্ক নাই।শহর কি, এখন গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ে সাতার জানে না। এই বিচ্ছিন্নতা, ভীতি, গোঁড়ামি পার হয়ে নাসিমা আক্তার সহ আরো কিছু স্থানীয় তরুণী কক্সবাজারে রাশেদ আলমের কাছে সার্ফিং শেখে, সাগরের ঢেউয়ের সাথে দেহের সম্পর্ক শেখে।যে সম্পর্কের প্রাথমিক ব্যাকরণ আমাদের শিল্পী সমাজ, আমাদের নাগরিক বুদ্ধিজীবী সমাজ শিখতে আগ্রহী নন।আমাদের নৌ বাহিনী সবচেয়ে দুর্বল বাহিনী।উর্মিমালা যে ঢেউ সেটাই আমরা বুঝে উঠতে পারি না।এভাবে শব্দের সাথে, সঙ্গীতের বিচিত্রতার সাথে সম্পর্ক ছুটে যেতে যেতে, আমরা সবচেয়ে খোলামেলা নান্দনিক বর্ণনা বুঝতে পারি না, সাগরের দিকে তাকায়ে থাকি ফ্যালফেলিয়ে, পূজা ও  প্রার্থনার মন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু নিতে পারি না। 

আজকের মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টার থেকে বাদবাকি ক্যানভাসে, NGo  ক্যামেরার লেন্স খেলনাপাতি, মুখোশ আর ইস্যুতে ভরা। যেই মানবের ইস্যু নিয়ে এত হল্লাচিল্লা সেই মানবদেহটা নাই।পোস্টারগুলোতে যেই মহেঞ্জোদারো, হরোপ্পা, গঙ্গা অববাহিকার মাটির খেলনার ছবি সেই গঙ্গা উপত্যকাতেই পাওয়া গেছে প্রাচীনতম নগ্ন নর্তকীর, হালকা পোষাকের কিষান, কিষানির টেরাকোটা। মূর্তি।ভাস্কর্য ও মূর্তি ভাঙ্গার লোকজনকে সমাজের কাণ্ডারি বানিয়ে আশেপাশের আলো, বাতাসের সাথে আমরা আমাদের সম্পর্ক নাজুক করে ফেলেছি ভেতরে এবং বাইরে। 

শুচিবাইগ্রস্ত ভিক্টোরিয়ান মূল্যবোধ, মুসলিম প্রেজুডিস, হিন্দু ব্রাক্ষন্যবাদ দেহকে টার্গেট করেছে, যৌনতাকে প্রজনণকেন্দ্রিক আর পুরুষ নিয়ন্ত্রণে এনেছে।দেহকে সামাজিকভাবে লজ্জার বিষয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে অত্যাচার ও গুমের বিষয় করে সেই মধ্যযুগ থেকে এখনো আমাদের দেহ নিয়ে বিড়ম্বনাতে রাখা হয়েছে।এই বিড়ম্বনার বিরুদ্ধাচার করেছে ময়মনসিংহ গীতিকা, অজন্তা ও ইলোরার মিথুন মুরাল,লেসবো দ্বিপের কবি শাপো, বাৎস্যায়ন, রাধা কৃষ্ণ, শিরি ফরহাদ, লাইলি মজনু। ভিক্টোরীয় শুচিবাইকে চ্যালেঞ্জ করেছে রোকেয়ার নারীস্থান, আনাইস নিনের ডেলটা অব ভিনাস, ডি, এইচ লরেন্সের ল্যাডী চ্যাটার্লি, নাবোকভের লোলিটা, চয়ন খায়রুল হাবিবের জুলেখা ট্রিলজি।এগুলো প্রতীক, ইস্যু, সামাজিক নৈয়ায়িকতা ছাড়িয়ে তুলে ধরেছে দেহের ভিতিবোধ ও প্রীতিবোধ।

অনেক সময় আমরা বলি, অমুকের লেখা বুঝতে পারি না, এটা নিজেকে না বুঝতে পারার মত, নিজের দেহকে না বুঝতে পারার মত।দেখা গেলো, অমুকের লেখাটি আসলে  যোগাযোগ সফল, কিন্তু আমরা গাড়ির পেছনের সিটে বসে স্মার্টফোন টিপাটিপিতে ব্যাস্ততার মতো ড্রাইভার যেই রাস্তাটা দেখছে সেই রাস্তাটা দেখছি না।বিয়ে বাড়িতে যাবার আগে মোটকা, মুটকি ব্যাটা, বেটিগুলো এই পার্লার, সেই জরিদার, ঐ আচকান, এই ব্লো ড্রায়ারে অস্থির হয়ে, এয়ার কন্ডিশনিংএ বসে যেসব ছবি তুলে ছাড়ছে সেগুলোকে বলা চলে দেহের লুকোচুরি, জম্বিদের জবড়জং কবরস্থান।

একটা দেশের, একটা অঞ্চলের আবহাওয়া দিয়ে সেদেশের ভাষা, পোশাক-আশাক, সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। আবহাওয়াকে রীতিনীতির দোহাই দিয়ে ঢেকে দিলে দেহ এবং মন ভুগতে থাকে মহাঅস্বস্তিতে।বিমূর্ততা ও প্রতীক হলো অভিব্যক্তির বোরখা। চর্যাপদ, ময়মনসিংহ গীতিকার লেখকদের হাতে আজকের ক্যামেরা, তুলি, কালি, ল্যাপটপ দেয়া হলে আমরা পেতাম আজকের দেহভাষা।কিম্বা আজকের দেহভাষা যারা লিখতে পারবে, আঁকতে পারবে, সেলুলয়েডে খেলাতে পারবে তারাই আগামী বর্ষবরণগুলোকে সত্যিকারভাবে নবান্নের নবায়নে নিয়ে যেতে পারবে।


তৃনা রাব্বানি

৫/৪/২০২১

ভিয়েনটিয়ান, লাওস


Photography: © Venessa Rude/Bangladesh Surf Girls and Boys Club