ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Friday, April 16, 2021

শিক্ষা-বর্ণবাদ এবং হাইব্রিড বৈষম্য

।।নাসরিন-জয়া হক।।

মাদ্রাসা, ক্যাডেট কলেজ, শিক্ষা-বর্ণবাদ এবং হাইব্রিড বৈষম্য!

চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ, ভাস্কর মৃণাল হক, নাট্য নির্দেশক জামিল আহমেদ, জেলে নিহত লেখক মোশতাক আহমেদ, পুড়ে নিহত নুসরাত রাফির শৈশব শিক্ষার পটভূমি!
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিশু শিক্ষালয়
মাদ্রাসা ও ক্যাডেট কলেজ শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকালে আমরা দেখি দুটোই বানানো হয়েছে শিশুদের মানস গঠনের চেয়ে মানস নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে।ক্যাডেট কলেজগুলোকে চালানো হয় সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায়, মাদ্রাসাগুলোকে চালানো হয় ধর্মিও প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায়। ক্যাডেট কলেজগুলোকে অর্থায়ন করা হয় জনগণের করের টাকায় বিপুল ভুর্তুকি দিয়ে, মাদ্রাসাগুলো চলে জনগণের চাঁদায়। দুটো ব্যবস্থাকে কৌশলে জন প্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহিতার বাইরে রাখা হয়েছে। ক্যাডেট কলেজ ও মাদ্রাসা দুটো ব্যবস্থাই তৈরি হয়েছে উপনিবেশিক আমলে, উপনিবেশিক কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্য। উপনিবেশিক আমলে শিক্ষার আরো কাঠামো তৈরি হয়েছে, সেগুলো নবায়িত হয়ে যেরকম বিশ্বজনীন হয়েছে, মাদ্রাসা ও ক্যাডেট কলেজ ব্যবস্থাপনা সেভাবে নবায়িত হয় নি।কিম্বা সরলিকৃতভাবে বলতে হলে দুটো ব্যবস্থাকেই ব্যাবহার করা হচ্ছে শিক্ষা বর্ণবাদের সামাজিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে।

ন্যুনতমো বিনিয়োগে মাদ্রাসা ছাত্রছাত্রীদের একটি রৈখিক শৃঙ্খলায় আনা হয়, আর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে কথিত মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের ১২ বছর বয়সে ক্যাডেট কলেজে এনে ৬ বছর ধরে বিপুল অর্থায়নে একই ধরনের রৈখিক শৃঙ্খলায় আনা হয়।ক্যাডেট কলেজে যাকে এডজুটেন্ট বলা হয়, মাদ্রাসায় তাকে বলা হয় হুজুর। এই এডজুটেন্ট বা হুজুরগন একটি শিশুর মানস গঠনে ভূমিকা রাখেন, যা শিশুটির সারা জীবনের বিভিন্ন পদক্ষেপে প্রতিভাত হয়।আমরা যদি প্রয়াত ছিটর নির্মাতা তারেক মাসুদ, জেলে বিনা বিচারে মরে যাওয়া লেখক মোশতাক আহমেদ ও নাট্য নির্দেশক জামিল আহমেদেরকাজ পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাবো কিভাবে তাদের শৈশবের রৈখিক শৃঙ্খলাজাত শিক্ষা তাদের সারা জীবনের দৃষ্টিকোণকে প্রভাবিত করেছে।

তারেক মাসুদ এসেছেন মাদ্রাসা পটভূমি থেকে এবং মাটির ময়না সিনেমাতে সে প্রভাব তিনি আন্তরিকভাবে তুলে ধরেছেন ৬৯এর গন আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর দৃষ্টিপাতে।সে দৃষ্টিকোণ যে এই দুটি ব্যাপক বহুস্তরবিশিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনা তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট নয়, তা হয় তিনি বুঝতে পারেন নাই, কিম্বা তার আয়ত্তাধীন চরম রৈখিক শৃঙ্খলাজাত শিক্ষায় তার বাইরে আসবার অবকাশ তৈরি করা সম্ভব হয় নি। তারেক মাসুদের ক্ষেত্রে মাদ্রাসা শিক্ষা শৈশবের মাত্র কয়েক বছর। ১৯৭১ এর পর তিনি মাদ্রাসা কাঠামোর বাইরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্ব শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। মাটির ময়না দেখলে বোঝা যায় যে শৈশবের ঐ দৃষ্টিকোণকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন।একই আরোপিত অন্তর্মুখি শৃঙ্খলা থেকে তিনি তার আদম সুরত প্রামান্য চিত্রে শিল্পী সুলতানকে ব্যাক্তির জায়গা থেকে না দেখে সামাজিক রাজনীতির জায়গা থেকে দেখেছেন। 

প্রখ্যাত মঞ্চ নাটক নির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদ মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ক্যাডেট কলেজে, গত সিকি শতক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে লাখ লাখ না হলেও, হাজার হাজার অনুসারী বানিয়েছেন, যারা অভিনয়ের উদ্ভাবনাধর্মি স্বাতন্ত্র্যকে একেবারেই গুরুত্ব না দিয়ে মঞ্চকে মনে করে প্যারেড গ্রাউন্ড, তার নাটকে কুশীলবদের অভিনেতা মনে না হয়ে সুতোয় নাড়ানো নৈর্ব্যক্তিক পুতুল মনে হয়। বিভিন্ন এফেক্টের আড়ম্বরে সে পুতুল নাচ দেখতে যে তরুণ তরুণীরা ভিড় করে, তাদের পুরোটাই গড়ে উঠেছে গত কয়েক দশকের চরম প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক আবহে। জামিল আহমেদ তার থিয়েটার বিষয়ক তত্বিয় লেখালেখিতে সরাসরি ধর্মিও বিশেষ করে ইসলামিক প্যারাডাইমের উপস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দেন। তিনি বিশ্ব ইসলামি তাত্বিকদের সেই ভিক্টিম ন্যারেটিভটুকু নেন, যেখানে মুসলিমদের নির্যাতিত হিশেবে দেখা হচ্ছে এবং তার প্রতিক্রিয়াতে মুসলিমদের চালানো নির্যাতনগুলো গৌণ বা খারিজ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এই দৃষ্টিকোণ যারা মডারেট ভাবে শেয়ার করেন, তাদের কাছে ১৯৭১ এর চেয়ে ১৯৪৭ বেশি গুরত্বপূর্ন। এদের কাছে ভারতীয় মুসলিমদের রাজনৈতিক পরিচয় এত গুরুত্বপূর্ণ যে তার পাঁশে ভারত বিভাজনের রক্তক্ষয়ী প্রক্রিয়া, তার প্রভাবে বহু সংস্কৃতির সহাবস্থান গৌণ হয়ে যায় এবং ১৯৭১এর জেনোসাইড পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার বেশি কিছু উল্লেখ পায় না।

সম্প্রতি বাংলাদেশের জেলখানায় বিনা বিচারে মরে যাওয়া লেখক মোশতাক আহমেদের মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা জীবন কেটেছে ক্যাডেট কলেজে। ক্যাডেট কলেজের ছাত্রদের অনেক প্রভাবশালী মঞ্চ থাকলেও সে মঞ্চগুলো ডিজাইনগত ভাবে কায়েমি স্বার্থ বা এস্টাব্লিশমেন্টের ধ্বজাধারী, সেটা উপনিবেশিক হোক, সামরিক বা বেসামরিক হোক। এই মঞ্চগুলো থেকে বন্যা ত্রাণ তৎপরতা দেখা যাবে, রক ব্যান্ড সঙ্গীতের আয়োজন দেখা যাবে, কিন্তু সামাজিক কোনো চ্যালেঞ্জ দেখা যাবে না, যে কারণে মঞ্চ হিশেবে ক্যাডেট কলেজ সংঘগুলো থেকে মোশতাক আহমেদের বিনা বিচারে মৃত্যুর কোনো প্রতিবাদ আমরা আশা করতে পারি না।

মোটের ওপর শৈশব থেকে যদি একজনকে ধাতস্থ করা হয় যে তোমার সমাজ যেখানেই থাকুক, তুমি বিশিষ্টভাবে মেধাবী এবং এলিট হওয়া তোমার জীবনে প্রাপ্য, তাহলে সেটা এম্পাওয়ারমেন্টের একটি বিকৃত অর্থ তৈরি করে।সাধারণত এম্পাওয়ারমেন্ট হচ্ছে একজনের স্বাতন্ত্র্য, উদ্ভাবনা, সম্ভাবনাকে উদ্বুদ্ধ করা। কিন্তু একটি ব্যবস্থা যদি সমাজের একটি অংশকে বাবা, মা সমাজ থেকে আলাদা করে সমষ্টিকভাবে বিশিষ্ট করে তুলতে থাকে, তাহলে সেটা এম্পাওয়ারমেন্ট এবং প্রিভিলেজের মিশেল বা ক্ষমতায়ন ও বিশেষ অধিকারের মিশেলে একটি হাইব্রিড।এই হাইব্রিড এলিট সমাজের যেদিকে যাক, সে তাকে ভাবতে থাকে সবচেয়ে উপযুক্ত।নিজের উপযুক্ততার প্রায়োগিক সাফল্যের জন্যই তাকে অন্যকে অনুপযুক্ত বা নিচু মানের ভাবতে হয়। এখন যে সামাজিক ইঞ্জিনিয়ারিং এই হাজার হাজার ছেলেমেয়েদের আলাদা করে হাইব্রিড শিক্ষা ও সুবিধা দেয়া হচ্ছে, সে সমাজ এদের কাছ থেকে বিনিময়ে চায়, আমি সবার থেকে লুটে তোমাকে দিয়েছি, তুমি আমার ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করো।মোশতাক আহমেদ এখানে ব্যতিক্রম হলেও তা সামগ্রিক রাজনৈতিক শুন্যতার প্রতিক্রিয়াজনিত ব্যতিক্রম। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ক্যাডেট কলেজের যাদের কথা বললাম, তারা কোনো না কোনো ভাবে রক্ষণশীল মূল্যবোধকে আমাদের শুন্যতাগুলোর বিকল্প হিশেবে উপস্থাপন করেছেন। নিজেদের যাপনে এরা কি পালন করেন, তা মুখ্য নয়, কি প্রেস্ক্রাইব করেন তা এখানে বিবেচ্য।এই প্রেসক্রিপশন যাদের দিকে অর্থাৎ যে জনতা বা আমজনতার দিকে ছুড়ে দেন, তাদের তারা ইনফেরিওর বা ছোটলোক মনে করেন।

ক্যাডেট কলেজ ছাত্রছাত্রীদের মানসিকতা বুঝতে হলে, বাধ্যতামূলক মিলিটারি সাইন্স বা সামরিক বিজ্ঞান বিষয়টিকে বোঝা দরকার।এই বিষয়টির মাধ্যমে শিশুকাল থেকে একজনের মনে স্ট্রাটেজিক জয় বা কৌশলগত জয়ের ধারনা গেঁথে দেয়া হয়, যার মূলে আছে, Ends justify the means। এই বিজ্ঞান বা কৌশল গান্ধীবাদের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক, যেখানে Means বা উপায় লক্ষ্যের মত গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাডেট কলেজে জাঁকজমক, কালচার ক্লাব ইত্যাদি করে যে নৈর্ব্যক্তিক সামরিক বিজ্ঞান শেখানো হয়, মাদ্রাসাতে তা শেখানো হয় ন্যুনতমো আয়োজনে। মসজিদ সেখানে কেল্লা, সমর-বিদ্যা সেখানে জেহাদ বিদ্যা, শ্ত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বী সেখানে কাফের বা অবিশ্বাসী। সামরিক বিজ্ঞানের ভিত্তি হচ্ছে জয় নিশ্চিত করা বা জোর যার মুল্লুক তার, বিপ্লবী সামরিক বিজ্ঞানের পরিভাষাতে বলা হয়, বন্দুক হচ্ছে ক্ষমতার উৎস।

এক অর্থে এই সামরিক বিজ্ঞান ঠাণ্ডা মাথার খুনে তৈরি করে।আবার দেখা যাবে যুদ্ধের প্রয়োজনে এখান, সেখান থেকে ধরে কিছুদিন ট্রেনিং দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, সেখানে হয় মরো না হয় মারো এই ভাবে অস্তিত্ব রক্ষা করে প্রাণ বাচিয়ে ফিরতে পেরেও অনেকে সারা জীবনের জন্য মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেছে।স্ট্যানলি কুব্রিকের ফুল মেটাল জ্যাকেটসহ আরো অনেক ফিল্মে এই খুনে তৈরির নারকিয় ট্রেনিং দেখা যাবে। ক্যাডেট কলেজগুলোতে ১২/১৩ বছরের ছেলেমেয়ে নিয়ে এসে এই নারকিয় যজ্ঞকেই করে তোলা হয় মর্যাদাবান।ইতিহাসের মোড়ে এই যুদ্ধযজ্ঞের ট্রেনিং ও প্রয়োগে হারিয়ে গেছে লাখো লেখক, শিল্পী, গায়ক।আবার এই সামরিক বিজ্ঞান প্রশিক্ষনের সময় সেটুকুই শিল্প, সাহিত্য, নন্দন শেখানো হয় যেটুকুতে দরকার পড়লে খুনে হিশেবে ব্যাবহার করা যাবে।বাংলাদেশের ভাস্কর মৃণাল হকের প্রাথমিক শিক্ষাও ক্যাডেট কলেজে।মৃণাল হকের তৈরি লেডি জাস্টিস ভাস্কর্য হাইকোর্টের সামনে থেকে সরাতে যখন মোল্লারা আন্দোলন শুরু করে, তখন নিশ্চয় মৃনাল রেজিমেন্টেশান ট্রেনিংএর মর্ম বুঝতে পেরেছিলেন। অনেকে বলেন, মৃণালের ভাস্কর্যগুলোর ফিগারেটিভ প্রপোরশান বা মাপের অনুপাত ঠিক নেই। উনি শৈশবে যে ক্যাডেট কলেজে কাটিয়েছেন, তা বিশ্বের অপরাপর মিলিটারি স্কুল গুলোর মতোই, এখানে মাপ বলতে নিয়মের মাপামাপি, সেই অনুপাত মাথায় গেঁথে দেবার পর অন্য অনুপাতে পর্বান্তর কঠিন বৈ কি, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে অসম্ভব।

ইংল্যান্ডসহ পশ্চিমে সরাসরি ক্যাডেট কলেজ নেই এখন, সেগুলোর বদলে আছে বোর্ডিং স্কুল, যাদের সবখানে সামরিক বিজ্ঞান পড়ানো হয় না।যেসব দেশে রাজতন্ত্র আছে, সেখানে রাজকীয় পরিবারের ছেলে মেয়েদের ক্যাডেট কলেজ ধরনের বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয় এবং ধরে নেয়া হয় যে যারা এসব বোর্ডিং স্কুলে আসবে তারা কায়েমি কাঠামো বজায় রাখতে সহায়তা করবে।ইংল্যান্ডের টোরি বা রক্ষণশীল নেতাদের অনেকে এসেছেন এসব বোর্ডিং স্কুল থেকে। দেখা যাবে ক্যাডেট কলেজ, মাদ্রাসা, সামরিক বিজ্ঞানের অনুশিলক, বিপ্লবীদের কাছে গান্ধির প্রতিবাদের অহিংস ভাষা জনপ্রিয় নয়।তবে ব্যতিক্রম আছে।আমি যাদের নামোল্লেখ করেছি তারা সবাই সহিংস না হয়ে সাংস্কৃতিক মঞ্চ থেকে তাদের বক্তব্য পেষ করেছেন। তবে এই বক্তব্যগুলো কি সামরিক বিজ্ঞানের কৌশলগত জয়ের অংশ কি না সে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। মানে, আমি খুন করবো না, কিন্তু বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষ্যে তুমি খুন করতে পারো, নিহতের সংখ্যা সে কৌশলের অংশ।

বাংলাদেশের সামাজিক নিতি নির্ধারকেরা যখন NGO কাঠামোর আওতায় আরেকটা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত প্রাইভেট, হাইব্রিড শিক্ষা ব্যবস্থা দাড় করিয়েছে, তার পথিকৃৎ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য মোহাম্মদ তামিমও এসেছেন ক্যাডেট কলেজ থেকে।বাংলাদেশের সমাজে সাধারণভাবে বলা হয়, উনি ক্যাডেট কলেজের, উনি কি সুন্দর করে কথা বলেন। আর সাধারণভাবে মাদ্রাসার ছেলেমেয়েদের জন্য রাজ্যের কৌতুক, তামাশা বরাদ্দ করে রাখা আছে। ক্যাডেট কলেজ মহামানব, মহামানব বানাচ্ছে, আর মাদ্রাসা হচ্ছে মহামানব, মহাদানবি বানাবার কারখান, এই ধারনা আমাদের গেলাচ্ছে এখন আমাদের নিতি নির্ধারকেরা।সেনাশাসকেরা ইচ্ছেমত মাদ্রাসা নেতা ও ছাত্রদের ব্যাবহার করেছে, কিন্তু তাদের সুবিধাকে এবং অন্যান্য সব শিক্ষা ব্যবস্থাকে একটি সমান বণ্টনের আওতায় আনে নাই। আওয়ামী লিগ, বি, এন, পি, জামাত মাদ্রাসাগুলোকে যথেচ্ছ ব্যাবহার করছে কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার সমতায়ন করে নি।

আমি ইংল্যান্ডে, এমেরিকায় বাংলাদেশের পি, এইচ, ডি ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথা বলেছি, যাদের অনেকে শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য, মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে সন্দর্ভ করে পি, এইচ, ডি করেছেন। এরকম পিএইচডি বাংলাদেশে এখন অসংখ্য।কিন্তু এরা কখনো একত্রিত হয়ে বলে নি এই বিকৃত বৈষম্য বন্ধ হওয়া দরকার। দ্রষ্টব্য যে চড়া সম্মানীর বিনিময়ে অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামসহ আমাদের অনেক নাম করা শিক্ষক এই বৈষম্য সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখছেন, ব্র্যাক, দৃক সহ আরো প্রাইভেট শিক্ষা কাঠামোর বিকাশকে প্রমোট করছেন।

বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্যাডেট কলেজের ছাত্রছাত্রীদের উঁচু পর্যায়ে দেখা গেলেও, মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের বেলায় সে সুযোগ নেই।যে ফেনির সোনাগাজীতে মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে তার শিক্ষক ও সহছাত্ররা পুড়িয়ে মেরেছে, সে ফেনিতে বাংলাদেশের প্রথম নারী ক্যাডেট কলেজের একজন ছাত্রী কি কি সুবিধা পাচ্ছে তা দেখা যাক। ফেনি ক্যাডেট কলেজে পাঠ্য কার্যক্রম ও সামরিক শিক্ষার বাইরে ছাত্রীরা যে যে কার্যক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাবগত পর্যায়ে অংশ নিচ্ছে সেগুলো হলো, কোরানিক সোসাইটি, ফিজিক্স ক্লাব, কেমিস্ট্রি ক্লাব, বায়োলজি ক্লাব, জিওগ্রাফি ও পরিবেশ ক্লাব, শিল্পকলা ক্লাব, কারেন্ট এফেয়ার্স ক্লাব, বাংলা সাহিত্য ক্লাব, ইংরেজি সাহিত্য ক্লাব, সংগীত ও নৃত্য ক্লাব, প্রাথমিক চিকিৎসা ক্লাব, কম্পিউটার ক্লাব, সেলাই ও রান্নাবান্না ক্লাব, ফটোগ্রাফি ক্লাব। নুসরাত জাহান রাফি ও তার সহছাত্ররা যে ফেনি ক্যাডেট কলেজের ছাত্রদের ধারেকাছে কোনো সুযোগ সুবিধা পায় না, তা বলা বাহুল্য।

শুধু যে মাদ্রাসাগুলো সমস্ত সুবিধা বঞ্চিত তাই নয়, ক্যাডেট কলেজগুলোতে অতিরিক্ত সুবিধা দিতে যে ব্যায় করা হচ্ছে তা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের পেছনেও ব্যায় করা হয় না।ক্যাডেট কলেজে একজন শিশুর মাথায় গেঁথে দেয়া হচ্ছে যে তুমি বিশেষ মেধাবী শিশু, তোমাকে সমাজের এলিট হিশেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এই শিশুদের ভেতর যারা দরিদ্র পটভূমি থেকে আসে তারা যে সারা জীবন একটি জেকিল এন্ড হাইড মনস্তত্বে পড়ে যায়, তাও মনে রাখা দরকার।একই দেশে, জনগণের অর্থায়নে একটি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কাঠামোকে রাখা হয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় এবং সরাসরি সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর একের পর এক ক্যাডেট কলেজ গঠনের মাধ্যমে বোঝা যায় এই খাতে অসম ভাবে কি পরিমাণ বাজেট সেনাবাহিনী নিয়ে নিচ্ছে।

প্রায় দুই দশক আগে একটি চার্টে দেখেছিলাম যে ক্যাডেট কলেজে একজন ছাত্রের পেছনে সরকারি ভুর্তুকির পরিমাণ বছরে ৭০, ০০০ টাকার মতো।বল্গাহিন মুদ্রাস্ফীতিতে যে সে ভুর্তুকি যে ছাত্র প্রতি লাখের কোঠা ছাড়িয়েছে তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। এই বিশেষ সুবিধা প্রাপ্ত শিক্ষা কাঠামোতে যে ব্যাপক প্রতিযোগিতা হয়, তাও ডিজাইনগতভাবে যারা ইতিমধ্যে সুবিধাপ্রাপ্ত তাদের দিকে চলে যাচ্ছে। হাজার হাজার প্রি ক্যাডেট কলেজ সেন্টার, ক্যাডেট কলেজ কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে যেখানে অভিভাবকেরা তাদের শিশুদের দিচ্ছেন।এটি একটি বিপুল ইন্ডাস্ট্রি এখন।বলা চলে একটি বিকৃত বণ্টন থেকে আরো সব বিকৃত বণ্টনের শাখা প্রশাখা তৈরি হয়েছে। ক্যাডেট কলেজ থেকে যারা পরে বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষাতে সফল হয়েছেন, তাদের ব্যবসায় বাণিজ্যে বড় পদ দেয়া হয়, সেরকমভাবে মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরা সুযোগ পান না। এটা হতে পারে পোশাক, চলনের জন্য।সেটুকু বাদ দিলে সমাজের বিভিন্ন স্তরে এদের অংশ গ্রহণের ব্যবস্থা করলে এরাও ক্যাডেট কলেজীয়দের মত সামাজিক বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারবে। মোটের ওপরে সবচেয়ে আগে দরকার একজনকে একই দেশে বিশেষ সুবিধামূলক শিক্ষা দেয়া এবং আরকজনকে হেয় চোখে দেখা বন্ধ করা।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সহিংসতায় মাদ্রাসা ছাত্রদের মৃত্যুতে আমার খুবই খারাপ লেগেছে।এই জায়গাতে আমাদের বার বার নিয়ে আসা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে গত পোস্টে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরীকে উদ্ধৃত করেছিলাম, যেখানে উনি বলেছিলেন, "বাংলাদেশে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা চলছে, সেটা সবাই জানেন, যেখানেই রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়, সেখানেই উগ্রপন্থীদের উত্থান ঘটে, সেটা ডানপন্থী বলেন কিংবা বামপন্থী বলেন। বাংলাদেশে বামপন্থীদের তো সেরকম তৎপরতা নাই। এই ডানপন্থীদেরই তৎপরতা বেশি আছে গ্রামপর্যায়ে। সুতরাং ডানপন্থীরা শূণ্যতা পূরণের চেষ্টা করবে, তা স্বাভাবিক। এবং সেটাই তারা করছে। সেজন্য এরা শুধু ধর্মীয় বিষয় নয়, অনেক রাজনৈতিক বিষয়েও বক্তব্য বিবৃতি দিচ্ছে।" 

আমার মনে হয় রাজনৈতিক শুন্যতার পাশাপাশি শিক্ষা বর্ণবাদ, শিক্ষা ব্যবস্থার চরম বৈষম্যকে আমাদের শিক্ষাবিদ, অধিকার আন্দোলনকারীদের আলোচনায় অগ্রাধিকার দেয়া দরকার।আরেকটা ব্যাপার খেয়াল থাকা দরকার, আমাদের দাদা, নানা, দাদি, নানিদের অনেকের নামের আগে মৌলভি আছে, মোসাম্মাৎ আছে।সেই নানা, দাদাদের প্রজন্ম শিক্ষার জন্য নৌকায় চড়ে, ট্রেনে চড়ে দূরান্তে গিয়েছেন।বেগম রোকেয়ার কথা কেনো বার বার মনে পড়িয়ে দিতে হবে? আমাদের নারী সম্পাদিকারা কেনো তাদের সম্পাদনায় নারীদের লেখা খুঁজে পান না, সার্চের এত সুবিধা থাকতে।শিক্ষা আমাদের উন্মোচন করবার কথা, খুলে দেবার কথা।হাজার হাজার অ্যাাপ্স নিয়ে আমরা গুটিয়ে যাচ্ছি, এটা টেকনোলজির কারণে নয়, বরং অনেক আগে থেকে তৈরি শিক্ষার বৈষম্যগত বুনিয়াদের জন্য এটা ঘটছে।বুনিয়াদে সম বণ্টন না করলে তার রক্তক্ষয়ী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আমরা এড়াতে পারবো না।

নাসরিন-জয়া হক
৩০/০৩/২০২১

ছবি : ওয়াইকিপিডিয়া