ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Friday, April 16, 2021

আদিকথনে বর্ষবরণ : ফুল বিজু ও শজিবু চৈরাউবা

।।এ.কে.শেরাম।।নকু চাকমা।।খাইদেম সিথি।।


বৈশাখে নতুন বছরের আগমন আদিবাসীরা বেশ বড়ভাবে উদযাপন করে। চাকমারা বলে বিজু, ত্রিপুরা ভাষায় বৈসু, মনিপুরী ভাষায় বলা হয় শজিবু চৈরাউবা। নতুন বছরের আগমনে অশুভ গিয়ে শুভ বয়ে আসুক সবার জীবনে।

ফুল বিজু, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ
ফুল বিজু

চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিনকে চাকমারা ফুল বিজু বলে। মূলতঃ আজ ২৮ চৈত্র ১৪২৭ বঙ্গাব্দ; ১১ এপ্রিল ২০২১ বিকেল থেকেই এই আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। এই আয়োজন চলবে সারারাত ধরে। এরপর ভোরে ফুল তুলে নদীতে ভাসানো হবে। মূলত জীবনে পানি'র অবদানকে স্বীকার করার জন্য, পানির প্রতি কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ এটি। এর পাশাপাশি পানির যত উৎস আছে সেখানেও ফুল দেওয়া হবে। যেমনঃ কুয়া,ছড়া, ঝর্ণা,ঝিরি যা থাকে পানির উৎস। গ্রামে গবাদি পশুদের জন্য খাবার, চাল,গম,ভাত ছিটানো হবে! যাতে পশুপাখিরা খেতে পারে। ঠিক একই ভাবে সূর্য ডোবার সাথে সাথে পানির উৎসে (ছড়া,নদী,কুয়া,ঝর্ণা,ঝিরি) এবং সবুজ বৃক্ষের নীচে মোমবাতি জ্বালানো হবে প্রকৃতিকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য।

যে প্রকৃতি আমাদেরকে সারা বছর ফুল,ফল দেয় সেই প্রকৃতিকে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য। এই দিনে পরিবারে এবং গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের স্নান করানো হয়। মূলতঃ আগেকার দিনে পানির উৎস দূরে হওয়ায় তাঁরা নদীতে যেতে পারেন না বলেই এ আয়োজন। তবে এখনও এ ঐতিহ্যবাহী প্রথাটা চালু রয়েছে। এখন শহর অঞ্চলে আয়োজন করেই এ রীতিটা পালন করে! ফুল বিজু'র দিনে ফুল দিয়ে ঘর সাজানোও একটা ঐতিহ্যর অংশ। সাথে থাকবে নিমপাতা। নিমপাতা শুদ্ধতার প্রতিক। প্রতিটি বাড়ীতে বুদ্ধকে ফুল দিয়ে পূজা করা হবে।

ফুলবিজু'র দিনে ভোরে উঠে স্নান করার একটা রীতি আছে। বিশ্বাস যে আগে স্নান সারবে সে বিজুগুলো পাবে। এটা মূলতঃ শারীরিক শুদ্ধতাকে উদ্বুদ্ধ করে! পরিচ্ছন্নতাকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস।


।।নকু চাকমা।।


মণিপু্রী বর্ষবরণ,  শজিবু চৈরাউবা,
কমলগঞ্জ, সিলেট, বাংলাদেশ
মণিপুরী বর্ষ-পঞ্জি

🌷
🌷

মণিপুরীদের প্রাচীন ইতিহাস অনুযায়ী সেই প্রাচীনকাল থেকে বর্ষগণনা প্রদ্ধতি প্রচলন ছিলো।এটি 'মলিয়াফম পালচা কুম' বা সংক্ষেপে 'মলিয়াকুম'নামে পরিচিত।
🔸এ রীতি চন্দ্রের আবর্তন হিসেব করে গণনা করা হয়।🔸প্রতি বছর ১৩ এপ্রিল থেকে শুরু হয় মণিপুরী নতুন বছরের গণনা।
🔸ঐতিহাসিক সূএ থেকে জানা যায়,১৩৭৯ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে মণিপুর রাজা "কোইকোই" প্রথম মণিপুরী বর্ষগণনা পদ্ধতি শুরু করেছিলেন।রাজা ২৫বছর বয়সে সিংহাসনে আহরণ করেছিলেন।সিংহাসন আহরণের সময় "মোরিয়া ফমপালচা" নাম ধারণ করেন।ওনার নামানুসারে বর্ষপঞ্জি "মলিয়াফম পালচা কুৃম" সংক্ষেপে "মলিয়াকুম" হয়
🔸মণিপুরী ভাষায় কুম অর্থ বর্ষ বা সন।
🔸মণিপুরী সন গণনার হিসেব অনুযায়ী বারো মাসের নাম হলো:
বৈশাখ মাস- শজিবু থা(মাস)
জ্যৈষ্ঠ -কালেন
আষাঢ় -ইঙা
শ্রাবণ- ইঙেল
ভাদ্র -থাওয়ান
আশ্বিন -লাংবন
কার্তিক- মেরা
অগ্রহায়ণ-হিয়াঙ্গৈ
পৌষ-পোইনু
মাঘ-ওয়াকচিং
ফাল্গুন- ফাইরেন
চৈএ- লামতা।

চৈরাউবা বা মণিপুরী নববর্ষের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত ফুল - কোম্বীরৈ।
চৈরাউবা কুম্মৈ - মণিপুরীদের নববর্ষ উৎসব

পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের বর্ষগণনারীতি আছে; প্রচলিত আছে অনেক সন বা অব্দ। পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনেই এই সময় গণনার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। এইসব বর্ষগণনারীতির অনেকগুলো যেমন সৌর পদ্ধতির, তেমনি আবার অনেক সন বা অব্দ আছে যেগুলো চন্দ্রের আবর্তন বা চান্দ্র পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রচলিত।

মণিপুরীদের প্রাচীন ইতিহাস অনুযায়ী সেই প্রাচীন কাল থেকে একটি বর্ষগণনার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। 'মলিয়াফম পালচা কুম' বা সংক্ষেপে 'মলিয়াকুম' নামে পরিচিত এই বর্ষগণনারীতি অনুযায়ী এবছর ১৩ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে 'মলিয়াকুম'-এর ৩৪১৯ তম বর্ষ। উল্লেখ্য মণিপুরী সন 'মলিয়াকুম' চান্দ্র সন।

বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায়, প্রায় ১৩৭৯ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে মণিপুরে রাজত্ব করেছেন 'কোইকোই' নামের একজন রাজা, যিনি সিংহাসনে আরোহণের সময় 'মোরিয়া ফমবালচা' নাম ধারণ করেন। তিনিই প্রথম মণিপুরীদের বর্ষগণনার পদ্ধতি চালু করেন। এই সন বা অব্দ তাঁরই নামানুসারে 'মলিয়াফম পালচা কুম' বা সংক্ষেপে 'মলিয়াকুম' নামে পরিচিত হয়। উল্লেখ্য, মণিপুরি ভাষায় 'কুম' অর্থ বর্ষ বা সন। মণিপুরী সন গণনার হিসেব অনুযায়ী বারোটি মাসের নাম হলো- শজিবু, কালেন, ইঙা, ইঙেন, থওয়ান, লাংবন, মেরা, হিয়াঙ্গৈ, পোইনু, ওয়াকচিং, ফাইরেন ও লমতা।

মণিপুরী ভাষায় নববর্ষকে বলা হয় 'অনৌবা কুম'; তবে বর্ষবরণ উৎসবকে বলা হয় 'শজিবু চৈরাউবা' বা শুধুই 'চৈরাউবা'। 'চৈরাউবা' শব্দবন্ধটি দুটি পৃথক শব্দ 'চৈ' অর্থাৎ লাঠি বা দণ্ড এবং 'রাউবা' বা 'লাউবা' অর্থাৎ চিৎকার বা উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা দেওয়া, এই দুইটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। সেই প্রাচীনকাল থেকেই রাজাদের আমলে একজন বিশেষ ব্যক্তিকে নির্বাচন করা হতো নতুন বছরের ভালোমন্দের দায়দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। নববর্ষের আগেরদিন তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হতো এবং তাঁর হাতে একটি বিশেষ কাষ্ঠদণ্ড প্রদান করা হতো। তিনি ঐ কাষ্ঠদণ্ড মাটিতে আঘাত করে ঐ দায়িত্ব গ্রহণের কথা ঘোষণা করতেন। এটিকে বলা হতো 'চৈথাবা'; 'চৈ' মানে দণ্ড আর 'থাবা' অর্থ মাটিতে স্থাপন বা আঘাত করা। নববর্ষের ভোরে চৈথাবা ব্যক্তি ঘোড়ায় চড়ে ঘণ্টা হাতে একটি কাষ্ঠদণ্ডের মাথায় পতাকা লাগিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে প্রজাসাধারণকে জানান দিয়ে নববর্ষের সূচনা হয়েছে বলে উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা দিতেন। এটিকে বলা হয় 'চৈরাউবা'।

চৈরাউবা বা নববর্ষের দিনে নানা ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদির পাশাপাশি বিভিন্ন ক্রীড়ানুষ্ঠান বা আনন্দ উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। চৈরাউবার আগের রাত না ঘুমিয়ে সারারাত জেগে যুবক-যুবতীরা কড়ি খেলে। মণিপুরী লোকবিশ্বাসে এই রাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ; এই রাতকে বলা হয় ভাগ্যরজনী। এই রাতেই দেবতারা মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকেন। তাই সবাই মিলে খেলাধুলা করে হাসি-আনন্দে কাটিয়ে দেয় তারা যাতে পরবর্তী বৎসর কোনো ধরনের দুঃখ-কষ্ট ছাড়া হাসি-আনন্দে কেটে যায় তাদের জীবন। শুধু এই রাত নয়, চৈরাউবার পরের পাঁচদিনও মণিপুরিরা খুব কঠিন কোনো কাজে নিযুক্ত না হয়ে কড়ি খেলে হাসি-আনন্দেই কাটিয়ে দেয়। চৈরাউবা উৎসবের সাথে আরো একটি খেলার নাম যুক্ত আছে অবিচ্ছেদ্যভাবে। এই খেলা হলো 'কাং খেলা'। কাং খেলা মণিপুরীদের খুব প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি খেলা। বলা হয়, ১১১৭ খ্রিষ্টাব্দে মণিপুরের রাজা লোইতোংবা এই খেলার সূচনা করেন। চৈরাউবা উৎসবের আরেকটি আকর্ষণীয় আয়োজন হলো মণিপুরি লোকনৃত্য 'থাবল চোংবা' অনুষ্ঠান।

গত প্রায় এক যুগেরও অধিককাল ধরে মণিপুরী নববর্ষ 'চৈরাউবা' উপলক্ষে বাংলাদেশের মণিপুরী জনগোষ্ঠীর সর্বজনীন উৎসব হিসেবে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলাধীন আদমপুরবাজারে আয়োজিত হয়ে এসেছে দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানাদি। এবছরও ১৩ এপ্রিল ২০২১ বুধবার কমলগঞ্জের ৭ নং আদমপুর ইউনিয়ন পরিষদের তেতইগাঁও গ্রামে অবস্থিত মণিপুরি কালচারেল কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে মণিপুরী চৈরাউবা পর্ষদের উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছে নানা অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে মণিপুরী নববর্ষ 'চৈরাউবা কুম্মৈ' উদযাপনের আয়োজন। তবে করোনা সংক্রমণের উর্ধগতির কারণে এবার শুধুমাত্র উদ্বোধন এবং ধর্মীয় কিছু অনুষ্ঠানাদির মধ্যে সীমিত রাখা হয়েছে চৈরাউবা উদযাপনের কর্মসূচি।

মণিপুরী নববর্ষে সবাইকে জানাচ্ছি প্রাণপূর্ণ শুভেচ্ছা। পৃথিবী করোনামুক্ত হোক। সকল মানুষের কল্যাণ হোক। 'চৈরাউবা কুম্মৈনা য়াইফরে'।

এ.কে শেরাম
সিলেট,
১৩ এপ্রিল ২০২১


কভার পেইন্টিং, তাহিতি, মাতামুয়া, ১৮৯২, পল গগ্যা।
ছবি ও মণিপুরী বর্ষ-পঞ্জি সৌজন্য, এ.কে শেরাম।
সংগ্রহ, খাইদেম সিথি, ফেসবুক 'জুলেখা সিরাপ' গ্রুপ পেজ।