ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Friday, April 16, 2021

মাইকেলের দাঁতন, ইস্কান্দারের নুবা ও শর্মিলার ট্যাগোর!

 ।।স্বরুপ সোহরাওয়ার্দী।।

আলেকজান্ডারকে এশিয়ার কোথাও বলা হয় সিকান্দার, কোথাও ইস্কান্দার।মিশরে তৈরি হয়েছে আলেকজান্দ্রিয়া, ভারতের তেলেঙ্গানায় আছে সিকান্দ্রাবাদ, যার নামকরণ হায়দ্রাবাদের নিজাম সিকান্দার ঝাঁর নামে।তেলেঙ্গানার লোকজন এখন অনেকেই জানে না কে আলেকজান্ডার, কে সিকান্দার ঝাঁ।যিশুকে পশ্চিমে জেসাস, মধ্যপ্রাচ্যে ঈসা, অর্থোডক্সেরা ডাকে যশুয়া।হিব্রু সলোমন হয়ে গেছে সুলেমান, সোলেমান, সোলাইমান।বাইবেলের পটিফারের স্ত্রী কখনো জোলেইখা, কখনো জুলেখা!

দত্ত কূলের মহাকবি মধুসূদন ম্লেচ্ছ হবার পরও কুল পদবি রেখেছিলেন, তার সন্তানেরা তা বদলে ফেলে ডাঁটন।ভারতের বহু দত্তই এংলো ডাঁটন হয়ে গেছে।বাঙ্গালের কাছে দাঁতন আর ডাঁটনের কোনো পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না।বিলাত থেকে ব্যারিস্টারি সেরে দেশে ফিরে মাইকেল এক কোনো এক মহারাজার সেরেস্তায় কাজ নিয়েছিল, সেখানে না কি অন্য কর্মচারীরা তাকে দাঁতন বাবু ডাকতো।মাইকেলের যে এসব নিয়ে বালাই ছিল না, তা তার নাটকের ভাঁড়ামি অংশগুলো পড়লে বোঝা যায়, কৌতুকপ্রিয় মানুষ ছিলেন।

ঠাকুর পরিবারের মেয়ে শর্মিলা রুপালি পর্দায় হাঁক ডাক সেরে যখন পাতৌতির মুসলিম নবাব কুমারকে বিয়ে করলেন, তার আগে এবং পরেও নিজেকে শর্মিলা ট্যাগোর বলে পরিচয় দিয়েছেন।ঠাকুর বাড়ির পত্তনিদার দ্বারকানাথ থেকে শুরু করে মহর্ষি বলে খ্যাত দেবেন্দ্রনাথ, ভারতের প্রথম বাঙালি আমলা সত্যেন্দ্রনাথ, লালনের ছবি আকা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, বেঙ্গল আর্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অবনীন্দ্রনাথ কেউ কিন্তু তাদের ট্যাগোর সম্বোধনে উষ্মা প্রকাশ করেন নাই।এস্টেট হিশেবে শান্তিনিকেতন, বিশ্ব ভারতীয় এই সম্বোধনের বিরোধিতা করবার কারণ পায় নি।

ট্যাগোর সম্বোধন এসেছে সম্মান থেকেই, ব্যাঙ্গ থেকে নয়।অবশ্য কাশ্মীরের এবং উত্তর ভারতের পণ্ডিত ও ঠাকুরেরা জোড়াসাঁকোর পিরিলি ঠাকুরদের বেলায় বলবে, ওরাতো ঠাকুর নয় ট্যাগোর।তবে মোটের ওপরে এই ট্যাগোর, আলেকজান্ডার, সলোমন, দত্তের ভিন্নস্বর গ্রহণের মত, এটা বিকৃতি নয়, অর্থের ব্যঞ্জন এতে ভাংছে না।

কখনো কখনো নাম বিকৃত করে ঘৃণা প্রকাশ করা হয়। ১৯৪৭এর দাঙ্গার পর থেকে আমাদের পদবিকে পশ্চিম বঙ্গে বলা হয় সুরাবর্দি।শেখ সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দিখানা থেকে ফিরে কোলকাতার প্যারেড গ্রাউন্ডে আরো অনেক বাঙালি নেতার সাথে হোসেন শহীদের নাম নেয়া মাত্র পিন ড্রপ সাইলেন্স।প্রয়াত কবি বেলাল চৌধুরী সেই মহা সমাবেশে ছিলেন, চয়ন খায়রুল হাবিবের কাছে বলেছেন, ওনার ব্লগে পড়েছি, বঙ্গবন্ধু যখন একেক বাঙ্গালি নেতার নাম নিচ্ছিলেন মুহুর্মুহু তালির ঢেউ, কিন্তু হোসেন শহীদের নাম নেয়া মাত্র সব থেমে গেলো।বেলাল চৌ বলেছেন যে সেই নীরবতা থেকে ঘৃণার পরিমাপ করা যায়।

আমাদের পরিবারের ঊর্ধ্বতনদের হাত ধরে ওপারের বিষ্ণু দে সহ আরো অনেকে আধুনিক শিল্প, সাহিত্য চর্চায় এসেছে, এপারের শিল্পী সুলতান কোলকাতা আর্ট স্কুলে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে।সেসব কেউ মনে রাখে নি।রাজনীতির বিরোধ একই পরিস্থিতির শিকার দুই দল শরণার্থীকে রক্তাক্ত বিরোধে নামিয়ে দিতে পারে।ঢাকাতে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিনের পাশে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্মৃতি সৌধকে নাম দেয়া হয়েছে 'তিন নেতার মাজার', তিন নেতাই পাকিস্তান প্রবর্তনার ধারক।হোসেন শহীদ ব্যক্তিগত যাপনেও বর্ণাঢ্য ছিলেন, প্রথম স্ত্রী নিয়াজ ফাতেমার মৃত্যুর অনেক বছর পর বিয়ে করেছিলেন রুশ অভিনেত্রী ভেরা আলেকসান্দ্রভনাকে।হোসেন শহীদের অধস্তনদের কেউ জর্ডানের রাজ পরিবারে বিয়ে করেছে, কেউ পাকিস্তানে বড় পদে আসীন হয়েছে, আবার অনেক সোহরাওয়ার্দী নাম লুকিয়ে বিলাতে ফিশ এন্ড চিপসের দোকান খুলেছে, কেউ নিউ ইউর্কে ট্যাক্সি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছে, ঝাঁকের কই ঝাঁকে হারিয়ে গেছে ।

এটাই বলতে চাইছিলাম, ঠাকুর বা ট্যাগোর যেটাই হোক জোড়াসাঁকোর দ্বারকানাথের অধস্তনদের নাম লুকিয়ে ফেলতে হয় নি।আলেকজান্ডারের নামও এরকম, ইস্কান্দারের নুবা বা আলেকজান্দ্রিয়ার পাঠাগারে বা সিকান্দ্রাবাদের গরিব পরিবারের কেউ ইতিহাস ঘাঁটলে এক তরুণ বীরের নাম জানতে পারবে, যার নাম যশ সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষার সীমান্ত পেরিয়ে গেছিল।এরকম বাঙ্গালি বলতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।ট্যাগোর কেবল একটি মাত্র বিচিত্রতা, আরো কত নামে যে তাকে ডাকা হবে কাল পেরোলে, তার পরিচয় কেবল রূপকথাতে।সোহরোওয়ার্দী পরিবারের হোসেন শহীদ এই অর্জনটুকু ধারণ করলে কোলকাতার আধুনিক মানস গঠনে তার ভাই হাসান শহীদের অবদান স্বীকার করতে কেউ দ্বিধা করতো না, পারিবারিক নামের পাশে সুরাবর্দিও যোগ হতো না।আবার উত্তর ভারতীয় জমিদারদের অর্থায়নে বাধানো রক্তাক্ত দাঙ্গার মুখে তিনি কি করতে পারতেন, এরকম প্রশ্ন যারা করে, তাদের বলতে পারি যে মাওলানা আজাদের কথা শুনতে পারতেন।

অনেককে দেখি রবীন্দ্রনাথের ট্যাগোর সম্বোধনে মাথা নাড়ান।মোতসার্তকে আমাডিউস ডাকলে তার সঙ্গীত সুধা পানে আসলে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না।শর্মিলা ট্যাগোরের আয়েশা সুলতানা খান হওয়াতেও রুপালি পর্দায় তার অভিনয়ের ভিন্টেজ সুধা পানে আমাদের রসভঙ্গ হবার কথা নয়!

স্বরুপ সোহরাওয়ার্দী

Photo : Sharmila Tagore in Satyajit Ray's film The Hero.She played the role of a Journalist.