।।দিলরুবা পাপিয়া।।
![]() |
দূরের ঘুমবাগিচা
আবছায়া সন্ধ্যাবেলা! ক্রিমসন লেকের থোকাথোকা আঁচড় এখনও আকাশ ছেয়ে আছে। হাঁটছি শাহবাগ, চারুকলা ধরে নজরুল- জয়নুলের ঘুমবাগিচার পাশ ঘেঁষে, অতি সন্তর্পণে! সরগরম মধুর কেন্টিন, বাটারটোস্ট, ফটোকপি, বইপোকা আর নীভু নীভু গ্রন্থাগার। কলা ভবনের ললাটে শোভা পায় আব্দুল্লা খালিদের অপরাজেয় বাংলা। মল চত্ত্বরে সোনালু, জারুল, রাধা আর কৃষ্ণচূড়া পাটির বুননে লুটোপুটি! টুংটাং রিকশার পাশ কেটে চলে ঝাঁজালো গাড়ি। পাশে ছন্নছাড়া একজন 'তুমি' এসে হাত ধরে বল্লো- আচ্ছা চলো! মনে হলো এমনই কথা ছিলো। মনে হলো যেন তাকেই খুঁজে আমি হয়রান। সে আকাশের আলোয়ান সরিয়ে,থোকা থোকা মেঘের কুঞ্জ থেকে শুধু আমার জন্যই হয়েছে লাব্বাইক।
তখনও টিএসসির সবুজ চত্বরে উর্ধ্বশ্বাসে কেউ
পড়ে চলেছে হেলাল হাফিজ-
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়!
উত্তাল তারুণ্য বিবর্তনের মহড়াকক্ষে গাইছে মতলুব আলীর- লাঞ্ছিত নিপীড়িত জনতার জয়!
চায়ের কেটলি তখনও ফুটছে, ঝালমুড়ি, ভাপা পিঠা, ভিড়ভাট্টা কিছুটা সিথিল।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আঁধারী মিশিয়ে চলছে স্বতঃসিদ্ধ নিষিদ্ধ মোকামের ঠিকাদারি। কেউ বাঁচার তাগিদে, কেউ স্বভাবে।
আধো আঁধারি ফুটপাতে তখনও তার হাত ছুঁয়ে হাঁটছি আর খেলছি-
ওপেনটি বায়স্কোপ নাইন টেন টায়স্কোপ!
হাঁটছি নিশ্চিন্ত নির্ভার!
আচমকা বাজ এলো বুঝি-
হাত ধরা হাতসহ ছিটকে গেলে তুমি।
তুমিও অতঃপর হয়ে যাও অনিঃশেষ দূর- ঘুমবাগিচা!
আন্ধারবাতি
জ্যামিতির কাঁটা ধরে সূর্যটা অস্তাচলের সীমানায়।
আঁধার উঁকিঝুকি দিচ্ছে।
অপেক্ষার প্রহর পেরিয়ে লন্ঠনটা জ্বলে উঠলো,
কিন্তু আঁধার ঘুচলো না।
চৌকোণা বারান্দার এককোণে ঝুলছে লন্ঠন।
এমন ঘুটঘুটে নিশিতে
সাধ্য কী তার, আলোতে ভাসায়!
তার উপর শাওনের বাতাসের ধাপাধাপি।
লন্ঠনটা নিভু নিভু হয়ে ধপ্ করে জ্বলে ওঠে।
তবু প্রতীক্ষা ঘোচে না।
সেদ্ধ ভাতের ঘ্রাণ
এঁটো থালের ঝনঝনানি
কুপিবাতির সলতে পোড়া গন্ধ
হেঁসেলের ঝাপ ফেলা- সবই ফুরালো।
কিন্তু মাইনষের গলা কাঁখারি,
নিঃশব্দ পা টিপেটিপে গৃহপ্রবেশ
কাঁসার গেলাসে পানি ঢালা
কোনো শব্দই কানে এলো না।
রাত বাড়ে!
অপেক্ষাও বাড়ে!
চারদিক নিথর হয়।
বিমলার কান খরগোস সম, যেন নিজের
নিঃশ্বাসের শব্দটাও বুকে করাতের মতো বাজে।
অভিমান হয়,
হাতের চুড়িটা ঝনাৎ করে বাজায়।
বিমলার অভিমান ঠেলে
ভেজানো কপাট সন্তর্পণে খুলে যায়।
চেনা চেনা গন্ধে ঘরখানা ভরে ওঠে।
বিমলা এক লাফে উঠে দাঁড়ায়।
শক্ত হাতের বন্ধনে ভাঙা চুড়িটা বিমলার হাতে
কুট করে ফোটে।
আর মানুষটা ঠোঁট চেপে শুষে নেয়
লোনা রক্ত!
লুকানো ভাতের থালাটা সামনে ধরে বিমলা।
নিঃশ্বাস ফুরাবার আগে ভাতের থালা ফুরায়।
তারপর,
চোখের পলকে মানুষটা গহীন আঁধারে মিলায়।
সাতচল্লিশ বছর,
আঁধারে বসে বিমলা শুধু ভাবে-
আহারে...যদি আর কয়টা ভাত বেশি রাখতাম!
যদি আর একবার মাইনষের খাওনটা দেখতে পারতাম!
বিকালে ভোরের জানালা
এভাবেই কেটে গেলো কতোটা বছর।
এভাবেই সময়ের কাঁটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে,
ইস্টিশনের ঘন্টা বাড়ি খায় বুকে।
চায়ের নেশা চাপে কোনো ওষ্ঠ চুম্বনের মতো।
তবুও ঠাঁয় বসে থাকা!
অগুণতি মানুষের সাকিন খুঁজে খুঁজে
একদিন হয়তো ঠিক পৌঁছে যাবো তোমার বাড়ি।
দেখবো, নীলিমা শাড়ির জমিন বিছিয়ে,
কাঁঠালীচাঁপার গন্ধে বিভোর তুমি
লালপাহাড়ে হেলান দিয়ে,
ঠিক কিছু ভাবছো!
তোমার অভিব্যক্তি আমায় ভুলিয়ে দেবে সব।
পথের ক্লান্তি, রোজদিনকার অপেক্ষা, কিছুই যেন ঘটেনি।
পাহাড়ে মাথা ঠেকিয়ে তুমি খিলখিল করে হাসছো!
দোলানো বেণীর ফাঁকে তোমার
খয়েরী চোখ দুটো আমার কতো চেনা!
আমি বলবো- কতোদিন পরে দেখা!
সেই যে ইস্টিশনের এলোমেলো চাহনি,
বলো, কতোদিন!
তুমি শুধুই খিলখিল করে হাসবে।
যেন কিচ্ছু সময় যায়নি।
যেন পলক ফেলেছো মাত্র।
যেন বলতে চাও- খুব হয়েছে!
কিন্তু আমি তো জানি,
এই খয়েরী চোখের নেশায়
আমার কেটেছে কতোটা বছর!
তোমার তারুণ্য, আমার ধূসর জামার পকেটে তোমার খিলখিল হাসি,
তোমার অক্লান্ত কর্মযজ্ঞ, তোমার উদ্যমী চলাচল-
কতটা চেয়েছি!
আমি তো জানি,
তোমার গোলাপী ঠোঁটের আভায় আমি কতোটা মেতেছি।
লালদালানের করিডোর ধরে তোমার ব্যস্ত চলাচল,
তেজী কন্ঠের কবিতাপাঠ, মঞ্চ কাঁপানো অভিনয়,
আমি কতোটা খুঁজেছি!
বয়স আমাদের মুঠির ভিতর থাকেনি।
সে-ও চলেছে সময়ের সাথে।
কুড়ি কুড়ি বছর পরে
আবার এসেছি তুমি আমি
অজানা গন্তব্যের ইস্টিশন ধরে,
যখন সময় বড়ই বেমানান
আমাদের সময়ে।
ধর্ষণের স্বাধীনতা
বাবা, আমি কি মারা যাইতাছি?
আমার কি হইছে?
এইডা কি খুব খারাপ অসুখ?
মা কেন আঁচলা দিয়া মুখ চাইপ্যা চিক্কুরপাড়ে!
গতকাইল সক্কাল বেলায় কইলা-
শোন্ মা শোন্, উৎসবের ঢোলক বাজে!
ঢোলের তালে তালে আমগর জীবনও নাচে,
দেবী, আরতি, ধূপকাঠি সাজে,
নানান জাতির দ্যাশে নানান উৎসব আছে!
বাবা, উৎসবের দিনে যদি মানুষ মারে,
তয় আমারে কেন্ রাখ নাই,
বুকের পাঁজরে!
বাবা, আমি কি মারা যাইতাছি?
বাবা বলে,
বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি:
ধম্মং শরণং গচ্ছামি!
ত্বমাদি দেব পুরুষ পুরান
তমস্য. বিশ্বস্য পরমং নিধানম!
তার বাদে পূবের আসমান যহন রক্তজবার মতন লাল হইবো, চক্ষু বুইজা শুনবি-
আস সালাতু খাইরুম মিনান নাউম!
নানান জাতি- ধর্মের নানান কথন- বাচন,
তবে মাবুদ সবার এক,
গড- খোদা- ঈশ্বর!
দাদীজান বলছে,
একদিন দ্যাশ পরাধীন আছিলো।
মেয়েছেলে জবরদস্তি ধইরা নিতো।
দাদীজানের মা তারে ধানের ডোলায় লুকাইয়া রাখতো।
আইজো কি দ্যাশ স্বাধীন না?
তয় আমারে কেন ধইরা নিলো?
কি দোষ আমার!
বাবা, আমার কষ্ট কি বুকে, মুখে, তলপেটে?
আমি বুঝিনা, কোথায় কষ্ট?
ও মা আমার কোথায় কষ্ট, তুমি জানো?
সবাই যে কান্দ এইডাই আমার কষ্ট।
যন্ত্রনাক্লিষ্ট বাছা আকথা, কুকথা কইতে কইতে
দশ বছরের শিশু নিকেতন
পঞ্চাশ বছরের সুবর্ণ জয়ন্তীর মজলিসে
তুথু দিয়া ভবের নাও ছাইড়্যা গেলো!
।।দিলরুবা পাপিয়া।।
কভার ফটোগ্রাফিতে দৃশ্যমান তেলচিত্র, দিলরুবা পাপিয়া।