ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Saturday, October 22, 2022

বিদেশ-বিভূঁই : কাস্মীর, চন্ডিগড়, দিল্লি

।।খায়রুল আলম চৌধুরী।।

দুধপত্রী পাহাড়ে

১.
ঢাকা থেকে সকালে রওনা দিলাম। দিল্লি হয়ে শ্রীনগর যাচ্ছি। আড়াই ঘন্টা পর পৌঁছবো দিল্লি। প্লেন ছাড়ার আগে সব সময় জরুরি মুহূর্তে কীভাবে লাইফ ভেস্ট পরে অক্সিজেন মাস্ক মুখে লাগায়ে জীবন বাঁচাতে হবে বিমানবালারা তা দেখায়।

অনেকবার প্লেন চড়া হয়েছে, কিন্তু নিয়মটা আর শেখা হয় নি। এখন আর নির্দেশনাগুলি মনযোগ দিয়ে শোনা হয় না, তবে বিশ্বাস করি সমস্যা যদি কিছু হয়ই তখন সবার যা হয় আমার কপালেও তাই হবে। কিন্তু একটা বিষয় এখনো রহস্য রয়ে গেছে, প্লেনে সমস্যা হলে লাইফভেস্টটা পরে কি আকাশে লাফ দিয়ে বাঁচা যাবে, নাকি প্লেনটা সাগরে পড়লে পানিতে ভেসে থাকতে সাহায্য করবে ভেস্টটা— তা ঠিক জানা নেই। মজার ব্যাপার হলো, এ কথাটা শুধু প্লেনে চড়ার সময়, আরো নির্দিষ্টভাবে বললে, বিমানবালাদের নির্দেশনা দেয়ার সময়ই কেবল মনে পড়ে এবং এরপর যথারীতি ভুলে যাই।

শ্রীনগরে ডাল লেকের পাশে

কোলকাতা, রাঁচি, বারানাসিকে বামে রেখে পাটনা, লক্ষ্নৌর ওপর দিয়ে ঘন্টায় ৩০০ মাইল বেগে সাড়ে ৭ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে উড়ে প্রায় ৯০০ মাইল পাড়ি দিয়ে সমুদ্রের একটানা গর্জনের মতো শোঁ শোঁ শব্দ করে ডানে-বামে দোল খেতে খেতে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধি এয়ারপোর্টের রানওয়েতে নামছে প্লেন।
প্লেনের ভেতর সব সময় শোঁ শোঁ একটা শব্দ কানে লাগে— সাগরের একটানা গর্জনের মতো। সাগরের গর্জনে কোথায় যেন একটা প্রাণ আছে, জীবন্ত মনে হয়, কিন্তু প্লেনের একঘেঁয়ে শব্দটা ভাবায় না, আমাদের গতিমান করে।

প্লেনটা নামার সময় জানালার পাশে বসা কয়েকজন নিচের দৃশ্যের ভিডিও করছে, আমার পাশের লোকটিও করছে। পাখির চোখে পৃথিবী দেখাটা সত্যি অনেক রোমাঞ্চকর। টারমার্কের এদিক সেদিকে অনেক প্লেন দাঁড়ায়ে আছে, কোনোটি টেকঅফ মার্কের দিকে রওনা দিচ্ছে, কোনোটি আবার খানিক আগে ল্যান্ড করে পার্কিং মার্কের দিকে এগোচ্ছে ধীরে ধীরে। প্লেনগুলি দেখতে প্রায় পাখির মতো, দৈত্য পাখি। এদের ডানা আছে, লেজ আছে। পাখির ক্ষেত্রে ওড়ার জন্য ডানা আর লেজ যে ভূমিকা রাখে, যে প্রযুক্তি-কৌশলে প্লেন আকাশে ওড়ে তার ডানা আর লেজ এখনো অনেকটা সে ভূমিকাই রাখে। আর সে জন্যই প্লেন দেখতে একটা বড় পাখির মতো মনে হয়। মানুষের বানানো এই যন্ত্রের পাখিগুলিই আমাদের তার পেটের ভেতর বহন করে নিয়ে যাচ্ছে দেশ থেকে দেশান্তরে। কিন্তু মনে হয় সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নেই যখন বিজ্ঞানের অগ্রগতির কল্যাণে প্লেনের দেহ থেকে তার ডানা আর লেজটা হারিয়ে প্লেন আরো আধুনিক রূপ লাভ করবে। তখন হয়ত আমরা আরো সূক্ষ্ণ উৎকর্ষ লাভ করবো, কিন্তু পাখির সাথে আমাদের দূরত্ব বেড়ে যাবে।

দিল্লি এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে লাখ লাখ মানুষ, মানুষের মাথা খায় মানুষ। এত লোক দেখে হতবাক, দিশেহারা। মাত্র দেড় ঘন্টা সময়ের মধ্যে ইমিগ্রেশন করে লাগেজ নিয়ে ডোমেস্টিক টার্মিনালে গিয়ে আবার লাগেজ জমা দিয়ে সিকিউরিটি চেক করে এক কিলোমিটার হেঁটে ফ্লাইটে বোর্ডিং করতে হবে। এত অল্প সময়ে কাজটা প্রায় না, পুরোই অসম্ভব। কিন্তু উপায় তো নাই, হাল ছাড়া যাবে না, চেষ্টা করতে হবে। আমরা তিনজন— আমি, স্ত্রী আর কন্যা। একটা লাইনে দাঁড়ায়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম। কমপক্ষে দুই ঘন্টা লাগবে ইমিগ্রেশন শেষ করে লাগেজ পেতে।

শেষ চেষ্টা করার জন্য তৈরি হলাম। লাইনের সামনে দাঁড়ানো শিখদের একটা দল। তাদের মধ্যে সিনিয়র ধরনের একজনকে সমস্যাটা বুঝিয়ে বলতেই তারা সবাই আমাদের সামনে এগিয়ে দিলেন। এতে আমাদের সময় বেঁচে গেলো অনেকখানি। শিখদের ওপরও শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো বহুগুণ। তারপর দৌড়ঝাঁপ করে কোনো রকমে কানেকটিং ফ্লাইট ধরে শ্রীনগরের উদ্দেশে রওনা দেয়া গেল। কাশ্মীর উপত্যকায় যখন পৌঁছলাম তখন শেষ বিকেলের আলো ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ে গায়ে গায়ে। দিনের বিদায়ের একটা সুর যেন বাজছে উপত্যকা জুড়ে। প্লেন ল্যান্ড করেছে শ্রীনগরের ছোট নিরিবিলি এয়ারপোর্টে। বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই বাজছে প্লেনের ভিতর। বিষন্ন এক বিকালে কাশ্মীর এসে নামলাম।

দুধপত্রী আপেল বাগানে
২.
শ্রীনগরে আমরা উঠেছি ডাল লেকঘেঁষা বুলভার্ড রোডের পাশে একটা হোটেলে। কাশ্মির ঘুরে দেখতে আগে থেকেই ড্রাইভার ঠিক করা ছিল। ইনোভা জিপ নিয়ে এসেছে সে। সকাল সকাল রওনা দিলাম দুধপত্রীর উদ্দেশে। ওখানে শালিগঙ্গা নদী আর দুধধোয়া তৃণভূমি দেখতে যাব।দূরত্ব প্রায় ৪৫ কিলোমিটার, যেতে প্রায় দুই ঘন্টা লাগবে। দুধপত্রী নিয়ে একটা কিংবদন্তী আছে, গল্প শুরু করে ড্রাইভার ফাইয়াজ আহমেদ। শেখ নুর উদ্দিন নূরানি নামের একজন কামেল একবার এখানে এসে নামাজ পরার জন্য অজুর পানি পেতে উপত্যকার মাটিতে লাঠির আঘাত করলে সেখান থেকে দুধ বের হয়ে আসে। এ থেকেই জায়গাটির নাম হয়েছে দুধপত্রী। শ্রীনগর পার হয়ে বড়গাম জেলার শেষ প্রান্তে দুধপত্রী।

বড়গাম মানে বড় গ্রাম। কাশ্মিরী ভাষায় গ্রামকে ‘গাম’ বলে। আর গ্রামে থাকে যারা তাদের বলে ‘গামুক’, বাংলায় কী বলে তা চিন্তা করে যুৎসই কিছু মনে এলো না। কাশ্মিরীদের নিজস্ব ভাষা আছে। উর্দূর মতোই আরবি হরফে লেখা হয় কাশ্মিরী ভাষা। ফাইয়াজ বলল, স্কুল কলেজে হিন্দি ইংরেজির পাশাপাশি কাশ্মিরীতেও পাঠদান করা হয়। তার সাথে কথা বলতে বলতে আমরা পথ চলি, জানতে চাই কাশ্মির সম্পর্কে। পেছনের সিটে বসা স্ত্রী কন্যারাও মনযোগ দিয়ে শুনে আমাদের কথপোকথন।

কাশ্মিরীরা বিদ্যা শিক্ষায় ভারতীয় অপর জাতিগোষ্ঠিগুলোর তুলনায় অনেক প্রাগ্রসর। স্বাক্ষরতার হার গড় ভারতীয়দের চেয়ে অনেক বেশি। পুরো ভারতে স্বাক্ষরতার হার যেখানে শতকরা ৭৪ ভাগ, কাশ্মিরে তা ৮৫ ভাগের ওপর। ডিপিএস, অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল, প্রেজেন্টেশন কনভেন্ট হাই স্কুল সহ আরো বেশ কটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ক্যাম্পাস আর স্কুলবাসও দেখলাম পথিমধ্যে।

অনেক কাশ্মিরী ছাত্র ছাত্রী প্রতি বছর বাংলাদেশে যায় চিকিৎসাবিদ্যা পড়তে। তাই এতোদিন আমার ধারনা ছিল কাশ্মিরে বোধহয় পড়ালেখার ভালো ব্যাবস্থা তেমন একটা নেই। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কোনো ইউনিভার্সিটি নাই? অবাক হল সে, বলল, কাশ্মির ইউনিভার্সিটির নাম তুমি শোনো নাই! সব সাবজেক্ট পড়ানো হয় এখানে।

বড়গাম শহরটা পার হচ্ছি। কাশ্মিরের এত ভেতরে এতবড় একটা শহর আর লোকজনের কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। কাশ্মিরের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকান্ড মূলত কৃষিভিত্তিক। প্রচুর আপেল, আখরোট, কাজুবাদাম আর মূল্যবান জাফরান উৎপাদন হয় এখানে। পশমিনা শালের জন্য কাশ্মির পৃথিবী বিখ্যাত। হর্টিকালচার কাশ্মিরীদের আরেকটি অন্যতম আয়ের উৎস। সবকিছু ছাপিয়ে পর্যটনই কাশ্মিরীদের আয়ের প্রধান উৎস। বিরাট সংখ্যক একটা জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থান হয়েছে এ খাতে।

বড়গাম শহরে ঢোকার মুখে ফাইয়াজ জানালো এখানে মূলত শিয়া সম্প্রদায়ের লোকরা বাস করে। পুরো কাশ্মিরে শিয়ারা সংখ্যায় বেশি নেই, অল্পসংখ্যক যা আছে তারা সবাই এখানে বাস করে।

দুধপত্রীতে লেখক
দুধপত্রীর প্রবেশমুখে দেখা যায় অদূরে হিমালয় পর্বতের পূবশাখার বিশাল পাহাড় শ্রেণী দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে অবিচল। তার মাথায় মুকুটের মতো খেলা করছে মেঘরাশি। জানালা দিয়ে হাত বাড়াতেই বাইরের শীতল বাতাস টের পেলাম। পাহাড় জুড়ে পাইন আর দেওদার গাছ দাঁড়িয়ে আছে ছবির মতো। গাছগুলো একহারা, লম্বা, পাহাড়ের মতো ঋজু। সামনে পান্না-সবুজ ঘাস বিছানো বিশাল খোলা মাঠ। একটু দূরে পাহাড়ি পথ বেয়ে এগুলে শালিগঙ্গা নদী, উপত্যকার পাথুরে পথ বেয়ে নেমে এসেছে। গাড়ি থেকে নেমে ঘোড়ায় চেপে শালিগঙ্গার কাছে গেলাম। দূর থেকে শালিগঙ্গার পাথরভাঙা জল গড়ানোর একটানা শব্দ শোনা যায় পাহাড়ের নিস্তব্ধতা চিরে।

ফেরার পথে কালাই রুটি আর মাসালা চায়ের স্বাদ নিলাম। পথে একটা রেস্তোঁরায় দুপুরের খাবার খেলাম। ওয়েটারটা খুব মজার। আমার কাছে বাংলাদেশি যেকোনো নোট চাইলো স্মারক হিসেবে। একটা একশ টাকার নতুন নোট উপহার পেয়ে খুব খুশি হলো। রেস্তোঁরার পাশে দেখলাম একটা আপেল বাগান। জীবনে প্রথম স্বচক্ষে গাছে আপেল দেখলাম। সত্যি কিনা পরীক্ষা করতে হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখা হলো।

ফেরার সময় ফাইয়াজের কাছে জানতে চাইলাম, কাশ্মিরীরা কি চায়— স্বাধীন রাষ্ট্র, নাকি পাকিস্তানের সাথে মিলতে? সে বলল, আমরা ইন্ডিয়াতেই থাকতে চাই, কিন্তু অন্য প্রভিন্সগুলো যেমন স্বাধীনতা ভোগ করে, তেমন স্বাধীনতাই আমরা চাই। বললাম, কাশ্মিরীদের তো বেশ কটি পার্টি আছে, কোন দল ক্ষমতায় এলে ভালো হবে মনে কর তুমি? ‘কোনো দলই ভালো না, ক্ষমতায় এলে নিজেদের লোক ছাড়া অন্যদের কোনো কাজে লাগে না, তারচেয়ে কেন্দ্রের সরকারই ভালো’— ফাইয়াজের জবাব দ্ব্যর্থবোধক, অনিশ্চিত— যেমন অনিশ্চিত কাশ্মিরীদের রাজনীতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত।

আহারবালের পাহাড়ে, পাশেই সাত হাজার ফুটের বেশি গিরিখাদ। নিচে বিশাল উপত্যকা। শিহরণ জাগানো সুন্দর!

৩.
আজকে যাব আহারবাল। এটি একটি হিল স্টেশন, শ্রীনগর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে, দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার, যেতে প্রায় আড়াই ঘন্টা লাগবে। আজকে আরেকজন নতুন ড্রাইভারের সাথে চলেছি আমরা, নাম আজহার সিদ্দিকী, দেখতে ভীষণ স্মার্ট, লম্বা, সুদর্শন, বয়স তেত্রিশ-চৌত্রিশের বেশি হবে না, পরনে জিনসের প্যান্ট, গায়ে ক্রিম কালারের জ্যাকেট।

যথারীতি টুকটাক ব্যক্তিগত পরিচয় দিয়ে শুরু হলো। শ্রীনগরেই বাড়ি আজহারের, জাগাটার নাম নওগাম, শ্রীনগরের শহরতলি। আজহার জানালো আমাদের যাবার পথেই পড়বে তার বাড়ি। মূল শহর থেকে বের হয়ে দক্ষিণমূখে কিছুদূর যেতেই তার বাড়ির রাস্তাটা দেখালো সে আমাদের।

শহর থেকে বের হয়ে হাইওয়েতে উঠতেই রাস্তায় দেখা মিললো একদল লোকের, দশ বারোটা ঘোড়া নিয়ে পথ চলছে ওরা। আজহার জানালো এরা হলো ‘বকরওয়াল’। মেষপালকদের এখানে বকরওয়াল বলে। এই বকরওয়ালরা পাহাড়ে থাকে এবং মেষপালনই তাদের জীবিকা আর ঘোড়া তাদের দৈনন্দিন চলার বাহন।

ভ্রমণে এলে দীর্ঘ যাত্রায় আমি ড্রাইভারের পাশে বসি ইচ্ছে করেই। প্রথমত, তাদের সাথে কথা বলে অনেক কিছু জানা যায়, অনেকটা গাইডের মতো কাজ হয়। দ্বিতীয়ত, লম্বা জার্নিতে ড্রাইভারের সাথে কথা বললে তার চোখে ঘুম আসে না। দেখলাম আজকের ড্রাইভার আজহারও গাড়ি চালাতে চালাতে আমাদের না-জানা না-চেনা জিনিশগুলো সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে। দিনের শুরুটা ভালোভাবে হচ্ছে বুঝতে পারছি, একটা ভালো লাগা ছড়িয়ে গেলো মনে।

বিদেশিদের সাথে সাধারণত তাদের ভাষা আর ঋতু নিয়ে কথা বলা শুরু করি আমি। এখানেও ব্যতিক্রম হলো না। জিজ্ঞেস করলাম, তার মাতৃভাষা কি কাশ্মিরী? জবাব স্বভাবিকভাবেই হ্যাঁ সূচক হলো। জানতে চাইলাম কি কি ভাষা জানে সে। দেখলাম অন্য প্রায় সব কাশ্মিরীদের মতো সেও কাশ্মিরী ছাড়া হিন্দি, উর্দু আর ইংরেজিতে কথা বলতে পারে।

হেমন্তের সকাল, আকাশ মেঘলা, রোদের দেখা নেই, মাঝে মধ্যে দুএক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে। গাড়িতে গান বাজছে, হিন্দি গান। কাশ্মিরে চারটি ঋতু— শীত, বসন্ত, গ্রীস্ম এবং হেমন্ত। এখন হেমন্ত। সেপ্টেম্বর-নভেম্বর তিন মাস হেমন্ত, ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি তিন মাস শীত, মার্চ-এপ্রিল দুই মাস বসন্ত, আর মে-অগাস্ট চার মাস গ্রীস্মকাল। কাশ্মিরের প্রকৃতি এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে আসন্ন শীতের, যখন বরফে ঢেকে যাবে পুরো কাশ্মির।

পথের দুপাশে রাজকীয় চিনার আর ওয়ালনাট গাছের সারি। চিনার গাছ যেন কাশ্মিরের আত্মা। পুরো কাশ্মির জুড়ে দেখা মিলে এই অপরূপ সুন্দর গাছটির। কাশ্মির এসে চিনারের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় নি এমন পর্যটকের দেখা মেলা ভার, এমনি জাদু তার অনন্য রূপে। গাছটি লম্বায় প্রায় ২৫ মিটার পর্যন্ত হয়। ম্যাপল গাছের পাতার সাথে চিনারের পাতার আশ্চর্য মিল আছে। হেমন্তের শুরুতে চিনারের পাতা হলুদ রং ধারণ করে, তারপর ধীরে ধীরে বাদামি এবং শীতের শুরুতে লাল হয়ে ঝরে যায়। চিনারের পাতার এই রং বদল ভূস্বর্গ কাশ্মিরের সৌন্দর্যকে অনন্যতা দিয়েছে। এখন চিনারের পাতাগুলো হলুদ হয়ে এসেছে, অন্যদিকে ওয়ালনাট গাছের পাতারাও হলুদ হতে শুরু করেছে। পথের দুই পাশের এ অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে সামনে চলেছি।

সামনের স্টেশনটার নাম পুলাভামা। পুলাভামার প্রবেশমুখে আজহার জানালো এ এলাকাটি টেরোরিস্টদের ঘাঁটি। ২০১৯এ কাশ্মিরের উন্নয়নের কথা বলে সংবিধানের ৩৭০ আর ৩৫এ ধারা রহিত করা হয়েছে। আর এখন বেকারত্ব শতকরা ৪৬ ভাগের ওপর। মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ছুঁয়েছে। রাত নটা দশটার পর কেউ বের হতে পারে না ঘর থেকে, দেয়ার ইজ নো নাইট লাইফ হিয়ার। রাতে ঘর থেকে বের হলে কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়। ক্ষোভের আগুন দেখা যাচ্ছে আজহারের কথায়। আই অ্যাম নট এন ইন্ডিয়ান, আই এম কাশ্মিরী!

সামনের স্টেশনটার নাম শোপিয়ান, এটা একটা জেলা। শোপিয়ানের আরেক নাম ‘আপেল টাউন’। এখানেই কাশ্মিরের সবচেয়ে বেশি আপেল উৎপাদন হয়। শোপিয়ানে ঢোকার মুখে নিচু স্বরে জানায় আজহার, এটাও আরেকটা টেরোরিস্ট হাব! একথা বলে আবার আমাদের আশ্বস্ত করলো, ওরা শুধু সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে, ট্যুরিস্টদের কোনো ক্ষতি করে না, বরং সব কাশ্মিরীরাই অসম্ভব ভালো মানুষ, আর ট্যুরিস্টদের প্রতি সর্বোচ্চ যত্নশীল।

পথের দুই পাশে শুধু আপেল গাছ। লাল বড় বড় পাকা আপেল ঝুলে আছে গাছে। মনে হয় যেন স্বপ্ন দেখছি, বাস্তব নয়। আজহারকে বললাম, সম্ভব হলে একটা আপেল বাগান ঘুরে দেখতে চাই। বাগান মালিকরা আমাদের ঢুকতে দিবে তো? অবশ্যই, জানায় সে। অনতিবিলম্বে পথের পাশে একটা বাগানের পাশে গাড়ি পার্ক করে আজহার। আমাদের বাগানটিতে যেতে বলে সে। আশে পাশে কেউ নেই। বাগানে ঢুকে পড়ি আমরা, আজহার ছবি তুলে দেয় আমাদের। এমন সময় দুজন তরুণ কাছে এলে আজহার তাদের সাথে কথা বলে। ওরা আমাদের কাছে জানতে চায় আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি কিনা। হ্যাঁ বলার পর ওরা বাগান থেকে আমাদের আপেল নেয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! আমাদের অবাক করে দিয়ে তারা নিজেরাই গাছ থেকে অনেকগুলো আপেল তুলে আমাদের উপহার দেয়। খুশি মনে সেগুলো গ্রহণ করে আমরা তাদের ধন্যবাদ দেই। আজহার মুচকি মুচকি হাসে, অর্থটা অনেকটা— দেখলে, বলেছিলাম না, কাশ্মিরীরা খুব ভালো মানুষ, অতিথিদের তারা সম্মান করে!

দেখতে দেখতে আহারবাল চলে এসেছি। আমাদের গন্তব্য আহারবাল হিল স্টেশন আর জলপ্রপাত। সামনের পথটা বনের ভেতর দিয়ে। দুই পাশে পাইন বন। কিছুদিন আগে মেরি অলিভারের কবিতা অনুবাদ করছিলাম। অলিভারের অসংখ্য কবিতায় পাইন গাছ আর বনের কথা এসেছে ঘুরে ফিরে। তখন আমার খুব ইচ্ছা হয়েছিল গাছটা স্বচক্ষে দেখার, কিন্তু আর হয়ে ওঠে নি। এখন দেখছি, দেখছি একটা গাছ না, বনের পর বন।

একটু পর শুরু হলো ভয়াবহ পাহাড়ি চড়াই উৎরাই। বামে তাকালে দেখা যায় গভীর গিরিখাদ। সামান্য একটু এদিক ওদিক হলে বাঁচার উপায় নেই। এমন ভীতিকর পাহাড়ি রাস্তার অভিজ্ঞতা আগে আর কখনো হয় নি আমাদের। বিপরীত দিক থেকে আরেকটি গাড়ি আসলে পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর হয়ে উঠছিলো। আমাদের অবস্থা দেখে আজহার ভরসা দেয়, কোনো ভয় নেই, এ পথে বিশ বছর ধরে গাড়ি চালাই আমি, আমার ওপর আস্থা রাখো। সত্যি সত্যি দেখলাম অসম্ভব দক্ষতায় এক সময় আহারবাল হিল স্টেশনে পৌঁছলাম আমরা।

সাত হাজার চারশ চৌত্রশ ফুট উঁচু এ জায়গাটিতে একটা জলপ্রপাত আছে। জলপ্রপাতের জলের রং দুধনীল। এমন রংয়ের পানি কোথাও কখনো দেখি নি। পাশের পাহাড়ে দেখলাম মেঘের মুকুট, স্রোতের মতো ভেসে যাচ্ছে মেঘদল। বেশ কয়েকটি ট্রেকিং রুটও আছে এখানে।

অনেক ছবি তুললাম আমরা। কিছুক্ষণ ঘুরাফিরা করে ফেরার পথ ধরলাম। আজহারকে বললাম দুপুরের খাবার শ্রীনগরে গিয়ে খাব। সে জানতে চাইলো কাশ্মিরের সিগনেচার ডিশ ‘বাজওয়ান’ খেয়েছি কিনা। বললাম, না এখনো সুযোগ হয় নি। জবাবে বলল, আজ তোমাদের বাজওয়ান খাওয়াবো। শ্রীনগরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। গাড়িতে জগজিৎ সিংয়ের গজল বাজতে শুরু করেছে।


ডাল লেকে শিকারা ভ্রমণ
৪.
আজকে শুধু শ্রীনগর ঘুরবো। চারটা মোগল বাগান আছে এখানে, সবগুলি কাছাকাছি, ডাল লেকের পাশে, যে জাবারওয়ান পর্বতের পাদদেশে গড়ে উঠেছে শ্রীনগর শহর, তার কোলেই মোগলরা তৈরি করেছে পৃথিবী বিখ্যাত এই স্বর্গীয় উদ্যানগুলি।

প্রথমে গেলাম শালিমার বাগ। সম্রাট জাহাংগীর ১৬১৯ সালে এ বাগানটি নির্মাণ করেছিলেন তার প্রিয়তমা বেগম নূর জাহানের জন্য। জাবারওয়ান পর্বতের পাদদেশে তৈরি বিশাল এ বাগান থেকে সামনে তাকালে ডাল লেকের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায়। বাগানটি জাহাংগীর-নূর জাহানের খুব প্রিয় ছিল। প্রতি বছর গ্রীস্মে এখানে এসে থাকতো তারা। বাগানটি মূলত চিনার গাছে সজ্জিত, একঘেঁয়েমি কাটাতেই হয়ত কিছু কিছু ম্যাগনোলিয়া আর সাইপ্রাস গাছও লাগানো হয়েছে এখানে। আর পুরো বাগান জুড়ে ফুটে আছে বড় বড় গোলাপ, ডালিয়া আর নাম না জানা অসংখ্য রঙিন ফুল।

তারপর গেলাম নিশাত বাগ। নূর জাহানের বাবা, সম্রাট শাহজাহানের শ্বশুর আসিফ খান বাগানটি নির্মাণ করেছিলেন ১৬৩৩ সালে। বাগানটি শাহজাহানের খুব পছন্দ হয়, তিনি আশা করেছিলেন আসিফ খান হয়তো এ বাগানটি তাকে উপহার দিবেন। কিন্তু আসিফ খান দেন নি এবং সম্রাট তাতে কুপিত হয়ে বাগানের পানি সরবরাহ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। এতে বাগানটি যখন মরতে বসে তখন বিমর্ষ আসিফ খান বাগানে গাছের ছায়ায় বসে যখন সাতপাঁচ ভাবছিলেন তখন হঠাৎ বাগানের ঝরনাগুলো সচল হতে দেখে জানলেন বাগানের এক কর্মচারি বাগান বাঁচাতে নিজেই পাশের শালিমার বাগ থেকে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে। আসিফ খান ভয় পেলেও, অবস্থা দেখে শাহজাহান পুনরায় পানি সরবরাহ করার অনুমতি দিয়ে বাগানটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করলেন।

আমার মতে কাশ্মিরে মোগলদের চারটি বাগানের মধ্যে এটিই সবচেয়ে সুন্দর। কারণগুলো হলোঃ বাগানটির আয়তনের অসাধারণ নান্দনিক পরিমিতি— খুব বড়ও না, আবার ছোটোও না, একটা স্বপ্নের বাগান যেমন হওয়া দরকার বাগানটি ঠিক সে রকম। এখানেও বাগানটি সাজানো হয়েছে কাশ্মিরীরের আত্মা চিনার, ম্যাগনোলিয়া, সাইপ্রাস এবং আরো কয়েকটি নাম না জানা গাছ দিয়ে। তবে, শালিমারের মতো চিনার এখানোও প্রধান গাছ। শালিমার এবং নিশাত এ দুই বাগানেই চারশ বছর বয়সি বেশ কয়েকটি বিশাল চিনার গাছ আছে। বলা বাহুল্য, শালিমার বাগের নিকটবর্তী নিশাত বাগও তৈরি হয়েছে জাবারওয়ান পর্বতের পাদদেশে, আর বাগান থেকে সামনে তাকালে দেখা যায় ডাল লেকের অপূর্ব দৃশ্য।

পরবর্তি গন্তব্য চশমা শাহী। এ বাগানটি তৈরি করেছিলেন সম্রাট শাহজাহান, ১৬৩২ সালে। তবে, জাবারওয়ান পর্বতকে পিছনে রেখে নয়, এটি নির্মিত হয়েছে এর ওপরেই। ফলে, এখান থেকে শুধু ডাল লেকের সৌন্দর্যই নয়, দেখা যায় শ্রীনগর শহরের বিরাট একটা অংশও। প্রিন্স দারা শিকোর উপহার হিসাবে বাগানটি নির্মাণ করেছিলেন সম্রাট শাহজাহান।

পরিমহল, শ্রীনগরে লেখক

সবশেষ বাগানটি হলো পরিমহল। ১৬৫০ দশকে দারা শিকো নির্মাণ করেছিলেন সাত স্তরের বাগানটি। নিশাত বাগের পর এ বাগনটিও আমাকে মুগ্ধ করেছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো, অনেক উপরের এ বাগান থেকে পুরো ডাল লেকটি খুব ভালো ভাবে দেখা যায়, বাগানটির স্থাপত্য কৌশল এমন যে, সাধারণ মানুষের কাছে মনে হবে বাগানটি নিখুঁত, যেন একটা স্বর্গের বাগান। বাগানটি দারা শিকো তার স্টাডি প্লেস হিসাবে ব্যবহার করতো। ভাবা যায়? মোগল রাজন্যদের মধ্যে দারা শিকোই মনে হয় প্রকৃত অর্থে সবচেয়ে জ্ঞানী ছিলেন।

আজকে হোটেল ছেড়ে বোট হাউজে উঠলাম বিকালে। ডাল লেকের বোট হাউজে থাকবো দুই দিন। ডাল লেকে ছৈঅলা এক রকম নৌকা আছে এগুলোতে চড়ে পর্যটকরা লেকে ঘুরতে বের হয় আর কিছু ভাসমান দোকান আছে তারাও ঘুরে ঘুরে চা-কফি, গয়না, ফ্রুট সালাদ এসব বিক্রি করে। এসব নৌকাগুলোকে শিকারা বলে। বিকালে বোট হাউসে উঠে ডাল লেকে শিকারায় চড়ে সূর্যাস্ত দেখলাম। অসাধারণ অভিজ্ঞতা হলো। কত রংবেরংয়ের মানুষ ঘুরে ফিরছে দুনিয়ায়! যতই মানুষ দেখি, যতই সংস্কৃতি দেখি, ততই নিজেকে হারাই বিচিত্র মেলায়। কাল ভোরে পাহেলগাম যাব।

পেহেলগামের পথে বকরওয়ালদের দেখা মিললো
৫.
আজকে আর সকাল না, খুব ভোরে রওনা দিলাম পেহেলগামের পথে। তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কুয়াশা নেই, ঠান্ডা বাতাস নেই, সূর্য আছে, কিন্তু গায়ে শীত লাগছে বেশ। শ্রীনগর থেকে পেহেলগামের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। যেতে প্রায় আড়াই ঘন্টা লাগবে। দিনে দিনে ফিরে আসবো তাই একটু আগেভাগে রওনা হলাম। শ্রীনগর থেকে বের হয়ে হাইওয়েতে উঠেছি। রাস্তার দুই পাশে চিনার আর উইলোর বিথী। আমাদের বামে জাবারওয়ান পর্বত, ডানে বয়ে চলেছে ঝিলম নদী।

পেহেলগাম মানে রাখালগাঁও, কাশ্মিরী ভাষায় puheyl মানে রাখাল, puheyl থেকে pahalgam এসেছে। স্থানিয়রা একে পেহেলগাম বলে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭ হাজার দুইশ ফুট উঁচু জায়গাটি কাশ্মিরের আরেকটি বিখ্যাত হিল স্টেশন। এখানকার বিস্তীর্ন সবুজ তৃণভূমি আর নিটোল জল নিয়ে পাহাড়ের বুক থেকে নেমে আসা লিডার নদী যাযাবর বকরওয়ালদের খুব প্রিয়। এখানে দেখা মিলবে এই বকরওয়ালদের— বিশাল ভেড়ার পাল নিয়ে যাচ্ছে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে, সাথে আছে দশ-বারোটা ঘোড়ার বহর। পাহাড়ের গায়ে মেষগুলো যখন নির্বিকার ঘাস খেয়ে চড়ে বেড়ায় তখন এগুলো কীভাবে নিচে পড়ে না গিয়ে খাড়া পাহাড়ের গায়ে নিজেদের আটকে রাখে তা খুব আশ্চর্য লাগে, মনে হয় মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যেন কাজ করছে না এদের বেলায়! জীবিকা হিসাবে মেষপালন পৃথিবীর আদিবৃত্তি যা এখনো টিকে আছে। কাশ্মিরের হিল স্টেশনগুলোর সবুজ তৃণভূমিতে মেষ চরানো এই যাযাবর বকরওয়ালদের জীবনযাপন সম্পর্কে জানা অনেক আকর্ষণীয় বিষয় হতে পারে।

পেহেলগাম তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত হলেও অমরনাথ যাত্রার জন্যও জায়গাটি বিশেষভাবে পরিচিত। প্রতি বছর জুলাই-আগস্ট মাসে এখান থেকেই তীর্থযাত্রীরা ১২ হাজার আটশ ফুট উচ্চতায় অমরনাথ যাত্রা শুরু করেন। তখন বেসক্যাম্প হিসাবে তারা পেহেলগামকে ব্যবহার করে থাকেন। গল্প আছে, পার্বতিকে অমরত্বের গুঢ় তত্ত্ব বলার জন্য শিব এই অমরনাথ গুহাকেই বেছে নিয়ে ছিলেন। সেখানে যাবার সময় তারা পেহেলগামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য কয়েকটি জায়গায় যাত্রা বিরতি করেছিলেন। অমরনাথ মন্দিরে প্রবেশের আগে শিব তার বাহন নন্দিকে এখানে রেখে গিয়েছিলেন। একটা ষাঁড়ের রূপ ধরে নন্দি এখানেই থেকে গিয়েছেন। এজন্যই পেহেলগাম থেকে আমরনাথ যাত্রা শুরু হয়।

কাশ্মিরি ক্রিকেট ব্যাট বানানোর কারখানায়
হাইওয়ে ছেড়ে আমরা বিজবেহারা শহরে প্রবেশ করলাম। শহরের অভ্যর্থনা তোরণে লেখা ‘ওয়েলকাম টু চিনার টাউন’! আশ্চর্য হলাম দেখে যে, পুরো একটা শহরই চিনারকে উৎসর্গ করে রেখেছে কাশ্মিরীরা। চিনারকে এতোই ভালোবাসে তারা!

বিজবেহারা থেকে বের হয়ে চলছি পেহেলগামের পথে। দুই পাশে ঘন আপেল বাগান। লাল লাল আপেল ঝুলে আছে বাগানে। এ দৃশ্য বর্ণনাতীত। সব বাগানেই টাটকা জুস পানের ব্যবস্থা আছে। বাগানে বসে চিনি, প্রিজারভেটিভ ছাড়া আপেল জুস খেতে কার না মন চায়! আমরাও হাতছাড়া করলাম না সুযোগটা। প্রতি গ্লাস পঞ্চাশ রুপি। বাগানতাজা আপেলরসের স্বাদ বাকি জীবন মনে থাকবে এ কথা বলাই যায়।

আপেল চাষ কাশ্মিরীদের অন্যতম প্রধান জীবিকা। প্রায় সাত লক্ষ লোক সরাসরি কাজ করে এ সেক্টরে এবং তিরিশ লক্ষ লোক পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল আপেল চাষের ওপর। পরপর গত দুই বছর অগ্রিম তুষারপাতের কারণে ফলন ভালো হয় নি, তাছাড়া বাজারে আপেলের দামও কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। তুরুস্কের আমদানি করা আপেলের সাথে প্রতিযোগিতায় মার খাচ্ছে কাশ্মিরী আপেল। এদিকে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কড়াকড়ির কারণে বাংলাদেশে রপ্তানি করা আপেলও সীমান্তে পৌঁছতে দেরি হওয়ায় পঁচে গিয়ে খামারিরা কয়েক বছর ধরে লোকশানের মুখে পড়েছেন। এদিকে আপেল চাষকে কেন্দ্র করে কাশ্মিরে কোনো শিল্প কারখানা গড়ে না ওঠায় আপেলকে ফল থেকে পণ্যে রূপান্তরিত না করতে পারায় কাশ্মিরের আপেল চাষ এখন বড় সমস্যার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

পৌঁছে গেছি পেহেলগাম। স্হানীয় কর্মসংস্থানের জন্য আরু ভ্যালি, বেতাব ভ্যালি, এসব ট্যুরিস্ট স্পটে যেতে হলে নিজের গাড়ি ছেড়ে নির্ধারিত দামে এখানকার গাড়ি নিতে হয়, আমরাও নিলাম। যাবো শুধু আরু আর বেতাব ভ্যালি। প্রতিটি স্পটে যেতে আধা ঘন্টার মতো সময় লাগে। ভ্যালিগুলোতে যাবার রাস্তাগুলি বেশ ভীতিকর, উচ্চতাভীতি থাকলে অবস্থা বেশ করুণ হয়ে উঠতে পারে। তবে চৌকস গাড়িচালকদের ওপর আস্থা রাখলে দুই পাশের সৌন্দর্য উপভোগ্যই হবে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ভ্যালিগুলো এমনিতেই সাত হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় তার ওপর সেখানে দাঁড়িয়ে উপরের পাহাড়চূড়ায় তাকিয়ে প্রথমে মনে হল যেন পাহাড়ের ভাজে ভাজে ঘুমিয়ে আছে মেঘ। কিন্তু পরক্ষণেই বোঝা গেল এগুলো জমে থাকা তুষার! পাহাড় চূড়ায় বরফ দেখে, সবুজ তৃণভূমির সৌন্দর্য উপভোগ করে আর দূর্লভ মুহূর্তগুলোর স্মৃতি ধরে রাখতে অসাধারণ কিছু ছবি তুলে ফিরে এলাম পেহেলগাম। এখানে বেশ কিছু অল-ভেজ রেস্তোঁরা আছে। অসাধারণ রান্না তাদের। লাঞ্চটা এগুলোর একটাতেই সেরে শ্রীনগরের পথ ধরলাম।

দুপুর পড়ে এসেছে, বিকালের কোমল রোদ বাইরে। দুই পাশে বিশাল পাহাড়, এর ভেতর দিয়ে ফিরে চলেছি আমরা। বাম পাশে আমাদের সাথে সাথে বয়ে চলেছে পেহেলগামরাণী লিডার নদী।

বিজবেহারা পার হয়ে সংগম নামে একটা জায়গা আছে। এখানে তৈরি হয় পৃথিবী বিখ্যাত উইলো গাছের কাঠের তৈরি ক্রিকেট ব্যাট। একটা কারখানায় নামলাম আমরা। ভেতরে প্রবেশ করে বললাম বাংলাদেশ থেকে এসেছি, কিনবো না, শুধু কারখানাটা ঘুরে দেখতে চাই। এক কথায় সানন্দে রাজি হয়ে গেল ম্যানেজার। নিজেই ঘুরেফিরে সব দেখালো আমাদের, ছবিও তুলতে দিল।

কাশ্মিরের জাফরান পৃথিবী বিখ্যাত। এক কেজির দাম আড়াই লক্ষ রূপি। জাফরানকে হিন্দিতে কেসার আর ইংরেজিতে স্যাফরন বলে। কাশ্মিরের পমপুরায় চাষ হয় এই জাফরান, আর জায়গাটি আমাদের পথেই পড়ে। পমপুরার একটা দোকানে থেমে ১ হাজার দুইশ পঞ্চাশ রূপিতে ১০ গ্রাম জাফরান কিনলাম স্মারক হিসাবে। দোকানি আমাদের কাহাবা চা দিয়ে আপ্যায়ন করলো। বাদাম দিয়ে বানানো কাশ্মিরী কাহাবা চা পান করতে বেশ সুস্বাদু, দেশে ফিরে চেষ্টা করতে হবে।

পেহেলগাম কাশ্মিরের অন্যতম সুন্দর দর্শনীয় স্থান। ট্রেকিংয়ের জন্য আদর্শ। কয়েক কিলোমিটার ভেতরে গেলে দেখা মিলবে কলোহই গ্লেসিয়ারের। প্রায় ৩৫ কিলোমিটার বিস্তৃত এই গ্লেসিয়ার ঝুলে আছে হিমালয়ের কলোহই চূড়ার নিচে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে দ্রুত গলে যাচ্ছে এই গ্লেসিয়ার।

প্রতি বছর এতো পর্যটক আসে এখানে যে তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখন পর্যটন কর্তৃপক্ষের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে মনে হলো পাহাড়ের বোধহয় কোনো সম্মোহন আছে, নাহলে মানুষকে এতো টানে কেন? কিসের টানে ছুটে আসে মানুষ পাহাড়ের কাছে? তবে কী পাহাড়ও কথা বলে, একান্তে! যুগযুগ ধরে সুফিরা সাধকরা পাহাড়েই খুঁজেছেন নির্বাণ। শিব তার অমরত্বরের বাণী পার্বতিকে বলেছিলো এই পাহাড়ের গুহায়।আবার আসবো আমি পাহাড়ে!

পেহেলগামের পাহাড়ে স্ত্রী-কন্যা

৬.
ভূস্বর্গ থেকে এক সন্ধ্যায় নেমে এলাম ‘সৌন্দর্যের শহর’ চন্ডিগড়ে। প্লেনে যাত্রিদের উদ্দেশে জানানো হল, চন্ডিগড় বিমানবন্দরটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্পর্শকাতর স্হাপনা হওয়ায় এখানে ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষেধ। তাই সবাইকে ছবি তোলা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করা হল। আগে কখনো অন্য কোনো বিমানবন্দরে এমন ঘোষণা শুনি নি, তাই একটু খটকা লাগলো। ভালো যোগাযোগ না থাকায় এখানে আগেভাগে কোনো গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারি নি। তবে, যেহেতু ফোনে রোমিং কাজ করবে এখানে তাই অন্তত উবার-ভরসা তো ছিলোই। কিন্তু বেশি চিন্তা করতে হলো না, লাউঞ্জ থেকে বের হবার মুখেই দেখলাম প্রিপেইড ট্যাক্সি কাউন্টার। গন্তব্য বলতেই তারা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিল।


এত সহজে ট্রান্সপোর্ট পেয়ে স্বস্তি পেলাম। তরুণ ড্রাইভার। যেখানে যাব সে জায়গাটি চিনে কিনা জিজ্ঞেস করতেই বলল, চিনি, তবে আমি না চিনলেও অসুবিধা কী, গুগল তো চিনে! অনেকটা পথ এক সাথে যাব, তাই দুএকটা কথা বলে জড়তা কাটানোর জন্য জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু বুঝলাম হিউমার আছে ছেলেটার। আমি হিন্দি বলতে পারি না, কিন্তু বুঝতে পারি। তাই আমাদের কথাবার্তা হিন্দিতে না হওয়ায় আমরা যে ভারতীয় না তা মোটামুটি আন্দাজ করেছে সে। সোজা জানতে চাইলো, কোথা থেকে আসছি আমরা। ভালোই কাজ চালানোর মতো ইংরেজি জানে সে। একটু পর বললো, জানো আজকে আমাদের এয়ারপোর্টের নতুন নামকরণ হয়েছে? ভাবলাম বিজেপি সরকার তো অনেক নামই বদলাচ্ছে সে রকমই কিছু করেছে হয়তো।
—ও, তাই নাকি! কি নাম হলো এখন?
—ভগত সিং এয়ারপোর্ট। আজ তাঁর জন্মদিন।
চমকে উঠলাম আমি! আমাদের তরুণ বয়সে ভগত সিংয়ের কথা জেনেছি আমরা। বিপ্লবী ভগত সিংয়ের নামে বিমানবন্দরের নামকরণ হয়েছে জেনে খুব ভালো লাগলো।

পৃথিবীর আর কোনো শহর একসাথে দুটি রাজ্যের রাজধানী আছে কিনা জানা নেই, তবে চন্ডিগড় শহরটি একইসাথে পান্জাব এবং হরিয়ানা এ দুই রাজ্যেরই রাজধানী। বিষয়টা ইতিহাসের ঘোরপ্যাচের। স্বাধীনতার সময় পান্জাবের তৎকালীন রাজধানী লাহোর পাকিস্তানের ভাগে পড়লে ভারতীয় পান্জাবের নতুন রাজধানী হিসাবে নির্মাণ করা হলো চন্ডিগড়। পন্ডিত জওহারলাল নেহেরু এটিকে মডেল করতে চেয়েছিলেন। আমেরিকা থেকে এনেছিলেন আর্কিটেক্ট আলবার্ট মায়ারকে। উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার মুক্ত স্থাপত্য কলায় গড়ে তুলবেন নতুন শহর, যা আদর্শ হিসাবে পথ দেখাবে সদ্য স্বাধীন ভারতবাসীকে।

মায়ারের ‘সিটি অব বিউটি’র স্বপ্নের সাথে নেহেরুর আকাঙ্খাও মিলে গিয়েছিল। কিন্তু আকস্মিক বিমান দূর্ঘটনায় সহকর্মী পোলিশ আর্কিটেক্ট মেসিজ নওভিস্কির মৃত্যুর পর বিশাল এ কর্মযজ্ঞে আর আগ্রহ পান নি মায়ার। পরে হাল ধরেন আরেক স্বপ্নদ্রষ্টা সুইস-ফ্রেঞ্চ স্থপতি লো কহবুসিয়ে (দ্য আর্কিটেক্ট) নামে বিখ্যাত চার্লস এডওয়ার্ড। নিজ হাতে গড়ে তোলেন পৃথিবীর সবচেয়ে পরিকল্পিত আধুনিক ও নান্দনিক শহর চন্ডিগড়।

একাশিটি সেক্টরে ১১৪ বর্গ কিলোমিটার জায়গায় যে মাস্টারপ্ল্যানে হিমালয়ের শিভালিক পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে তোলা হয়েছে এ উত্তর-ঔপনিবেশিক নগর তাকে মানবদেহের সাথে তুলনা করা যায়। এর আছে মাথা (ক্যাপিটল কমপ্লেক্স), হার্ট (সিটি সেন্টার), ফুসফুস (পার্ক), মগজ (শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান), রক্ত সংবহন (পরিবহন ব্যবস্থা) এবং নাড়িভুঁড়ি (শিল্পকারখানা)। চারটি মূল বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে এ নগর— বসতি, জীবিকা, শরীর ও মনের যত্ন এবং সঞ্চলন। আবাসিক সেক্টরগুলো নিশ্চিত করেছে বসতি; ক্যাপিটল কমপ্লেক্স, সিটি সেন্টার আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে গড়া সেক্টরগুলি নিশ্চিত করেছে জীবিকা। অন্যদিকে পার্ক, বাগান, বোটানিক্যাল গার্ডেন আর খোলা সবুজ চত্বরের সেক্টরগুলো করা হয়েছে শরীর ও মনের যত্নের জন্য। শিল্প বিপ্লবোত্তর ইউরোপে নিরাপদ ও অবাধ চলাচলের অসুবিধাগুলো মাথায় রেখে নির্মাণ করা হয়েছে নগরের সঞ্চলন ব্যবস্থা। ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স রাখা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ক্যাপিটল কমপ্লেক্স থেকে দূরে। গাড়ি চলাচলের রাস্তা এমনভাবে করা হয়েছে যেন শব্দ ও পরিবেশ দূষণ থেকে বাসাগুলো মুক্ত থাকে।

এক কথায় বলা যায়, লো কহবুসিয়ে শুধু একটা আধুনিক নগরই নির্মাণ করতে চান নি, চেয়েছেন স্বপ্নের মতো একটা নগর বানাতে। বলাই বাহুল্য, তার হাতে গড়া চন্ডিগড় আজ রূপ লাবণ্যে পরিপূর্ণতা পেয়েছে। লো কহবুসিয়ে একজন স্বপ্নদ্রষ্টা স্থপতিও। খোলা হাতকে উপজীব্য করে যে শিল্পকর্ম বানিয়েছেন তিনি দাঙ্গা বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন ভারতের পান্জাবের রাজধানীর জন্য সে হাত দেয়ার এবং নেয়ার, শান্তি ও সম্প্রীতির। তার অসাধারণ এই শিল্পকর্মটি স্থান পেয়েছে ক্যাপিটল কমপ্লেক্সে। তার এই ভাস্কর্যটি এখন চন্ডিগড়ের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার হয়। তবে, ক্যাপিটল কমপ্লেক্সের নিরাপত্তা ঘেরাটোপ পার হয়ে মূল স্থাপত্য নিদর্শনটি এবার দেখা হয় নি আমাদের।

রাস্তার দুই পাশ জুড়ে আছে বিশাল বিশাল গাছ— শাল, মেহেগনি, শিরীষ, বহেরা, জুনিপার, সপ্তপর্ণি, রুদ্রাক্ষ, রক্তকাঞ্চন, হিজল, নিম, ইউকিলিপটাস সহ আরো নাম না জানা কত গাছ! মানুষ এখানে বাস করে উদার প্রকৃতির নৈকট্যে, মুক্ত হাওয়ায়।

বেশিরভাগ বাড়িই দুই কিংবা তিনতলা, কোনো হাইরাইজ স্কাইস্ক্র্যাপার নেই এখানে।রাস্তায় নেই কোনো ট্রাফিক জ্যাম। বেশির ভাগই ব্যাক্তিগত গাড়ি। উবার কার পাওয়া যায় খুব সহজ। আমাদের মতো অনাবিল, তুরাগ, আবাবিল এসব নামের প্রাইভেট গণপরিবহনের দৌরাত্ম্য নেই। আছে কেবল ‘চন্ডিগড় ট্রান্সপোর্ট আন্ডারটেকিং’, মানে সরকারি গণপরিবহন ব্যবস্থা। কোনো ভিড়-ধাক্কাধাক্কি নেই। নির্দিষ্ট স্টপেজে দাঁড়িয়ে বাসে নামতে উঠতে হয়। আর অল্প দূরত্বে যাবার জন্য আছে অটো।

আমাদের দেশের বিরল পারুল গাছ।
চন্ডিগড়ের রাস্তার পাশ থেকে তোলা ছবি।
চন্ডিগড়ের রক গার্ডেন আর সুকনা লেক বেশ বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান। রক গার্ডেনটি মূলত চল্লিশ একর জায়গা জুড়ে পাথরে নির্মিত ভাস্কর্যের এক আশ্চর্য প্রদর্শনী। শিল্পী নেক চাঁদ সাইনি প্রথমে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলেন পাথর ভাস্কর্যের এ বাগানটি, পরে এখন জাতীয় সম্পদ হিসাবে রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে। সুকনা লেকটিও লো কহবুসিয়ের আরেক সৃষ্টি। নাগরিকদের বিনোদন এবং শরীরচর্চ্চার সুবিধার জন্য শিভালিক পাহাড়ের পাদদেশে তিন বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে এ লেকটি। সূর্যাস্তের সময় দূর সবুজ পাহাড়ের পটভূমিতে লেকের মনোহর দৃশ্য উপভোগ করতে প্রতিদিন প্রচুর নগরবাসীদের সমাগম হয় এখানে।

দেখা হলো ‘জাকির রোজ গার্ডেন’। ভারতের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জাকির হোসেনের নামে উৎসর্গীকৃত এ গোলাপ বাগানটি করা হয়েছে ১৯৬৭ সালে। চল্লিশ একরের ওপর জায়গা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এশিয়ার সবচেয়ে বড় এই গোলাপ বাগানটি। ৩২ হাজার পাঁচশ বৃক্ষ পরিবেষ্টিত এ বাগানে প্রায় ৮ শ পঁচিশ জাতের গোলাপ আছে।

গোলাপ বাগানের পাশেই চন্ডিগড় ললিতকলা একাডেমি। ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে শিল্পীদের আঁকা ছবির প্রদর্শনী চলছে। ছবিগুলোর রং আর ভাবনা মনে দাগ কাটে, ভাবায়। ছবির উজ্জ্বল রং আশা আর আকাঙ্খার দরোজা খুলে, ভাবনাগুলো কল্পনাকে মূর্ত করে আমাদের মনোজগতে।

দেখা হলো হিবিসকাস গার্ডেন। আট একর জায়গায় ৪০টিরও বেশি জবাফুলের প্রজাতির সমন্বয়ে ১৯৭৪ সালে গড়ে তোলা হয়েছে এ বাগানটি। চন্ডিগড়ে ৩১টি ১০০ বছরের বেশি বয়সি গাছকে হেরিটেজ গাছ হিসাবে চিহ্নিত করে সেগুলো বিশেষ যত্ন দিয়ে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। তাদেরই একটি বিশাল কড়ই গাছ দেখা হলো এখানে।

তারপর গেলাম Leisure Valley বাগানে। বিশাল এ বাগানে সময় যেন স্থির হয়ে থাকে, কারো কোনো তাড়া নেই। বিশাল এলাকা জুড়ে বড় বড় গাছ, মাঠভরা সবুজ ঘাস। মানুষের কাজ হলো সময়ের দ্রুত ধাবমান গাড়ি থেকে নেমে শুধু এখানে বসে থাকা। এখানে মাঠের ভেতর অলস শুয়ে থাকা একটা বিরাট পাথরের দিকে হঠাৎ চোখ গেলো। সামনে এগিয়ে দেখলাম তাতে খোদাই করে লেখা,
‘What matter is not to add years in your life, but to add life to your years.'' — Alexis Carrel.

 


হোটেলে ফেরার পথে উবার নিলাম। গাড়িতে ওঠার পর ড্রাইভার পেছনের সিটের যাত্রিদেরও সিট বেল্ট বাঁধতে অনুরোধ করে বলল, চন্ডিগড়ে নিয়ম কানুন বেশ কড়া, কিছু মনে কোরো না। বেশ ভালো ইংরেজি বলে ড্রাইভার। বললাম, এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ কড়াকড়ি দেখছি! জবাবে জানালো, শিখ, বৌদ্ধ এদের সবার মূলই হিন্দুত্বে এটা কেউ মানতে রাজি না হলে সমস্যা তো হবেই। বুঝলাম একেবারে মূলে হাত দিয়েছে সে। চন্ডিগড়ে বেশ কজন শিখ উবার ড্রাইভারের সাথে দেখা হয়েছে, যাত্রির সাথে সাধারণত কোনো বলে না তারা। উনি হিন্দু। জিজ্ঞেস করলাম, আর ইউ ফ্রম চন্ডিগড়? বলল, না, থাকি এখানে কিন্তু বাড়ি রাজস্থান। আমরা কোথা থেকে আসছি জানতে চাইলো সে। বাংলাদেশ জানার পর বললো, জগতের সব মানুষই এক, সৃষ্টিকর্তা একজনই। আমাদের একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিত আমরা মানুষ, কি বলো?

চন্ডিগড় মূলত একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। এখন জীবন এখানে চলছে ঠিক, কিন্তু কোথায় যেন অভাব আছে প্রাণস্পন্দনের।

শতবর্ষি কড়ই গাছ। চন্ডিগড়ের হেরিটেজ ট্রি’র তালিকাভূক্ত।
মায়া হোটেল, চন্ডিগড়
৭.

ভারত স্বাধীন হবার কিছু আগে থেকে পান্জাবের শিখরা তাদের ধর্ম রক্ষা আর অধিকার আদায়ের দাবিতে শিরোমানি আকালি দলের নেতৃত্বে যে পান্জাব সুবাহ আন্দোলন শুরু করে তারই ফলশ্রুতিতে ইন্ডিয়া রিঅরগানাইজেশন অ্যাক্টের মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধির সময়ে ১৯৬৬ সালে হিমাচল প্রদেশকে কিছু অঞ্চল দিয়ে পান্জাব ভাগ হয়ে হিন্দু প্রধান এলাকা নিয়ে হরিয়ানা এবং শিখ প্রধান এলাকা নিয়ে পান্জাব রাজ্য গঠিত হয়।। আবারো ধর্মকে কেন্দ্র করে ভৌগলিক সীমানার ভিত্তিতে রাজনৈতিক সীমানার সৃষ্টি করা হলো। শিখরা নিজেদের রাজ্য পেলো বটে, কিন্তু শুরু হলো অস্তিত্বের নতুন সংগ্রাম। চন্ডিগড়কে করা হল পান্জাব ও হরিয়ানা এ দুই রাজ্যেরই রাজধানী, এলো কেন্দ্রশাসিত ইউনিয়ন টেরিটোরির আওতায়। রাজধানী ভাগাভাগি শিখদের একেবারেই মনপূত হয় নি। হিন্দু বলতে শিখ এবং বৌদ্ধদেরকেও বোঝাবে এবং শিখদের বিয়ে তাদের রীতিতে হলেও রেজেস্ট্রি করতে হবে হয় হিন্দু কিংবা বিশেষ রেজিস্ট্রি আইনে, সংবিধানের এই ২৫ ধারার ২ (বি) অনুচ্ছেদটি শিখদের কাছে গ্রহণযোগ্য হল না। যে হারে পান্জাবের রাভি, বিয়াস ও সুতলেজ নদীর পানি পান্জাব, হরিয়ানা ও রাজস্হানের মধ্যে ভাগাভাগি করা হল তাও মেনে নিতে পারে নি শিখরা। আরো স্বায়ত্বশাসন এবং কেন্দ্রের পরিবর্তে রাজ্যের কাছে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করলো আকালি দল। যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইতালি সহ প্রবাসী ধনী শিখদের পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীন খালিস্তানের দাবিতে শুরু হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগ্রাম। ভারত-পান্জাব, পাকিস্তান-পান্জাব এবং চন্ডিগড়কে নিয়ে নতুন শিখ রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখতে থাকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পরাজিত হবার পর পাকিস্তানও শিখদের এ আন্দোলনে মদদ দিতে থাকে। উগ্রপন্থী শিখ নেতা জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের নেতৃত্বে আশির দশকের শুরুতে উগ্রপন্থীদের জঙ্গী তৎপরতা আশংকাজনকভাবে বেড়ে গেলে ১৯৮৪ সালে অপারেশন ব্লু স্টারের মাধ্যমে অমৃতসরে শিখদের পবিত্র স্বর্ণ মন্দিরে রক্তক্ষয়ী অভিযান চালিয়ে তা দমনের চেষ্টা করা হয়। রক্তপাত যে কোনো সমস্যা সমাধান করতে পারে না বরং সমস্যাকে আরো গভীর করে তোলে একথা আবারো প্রমাণ হল স্বর্ণ মন্দির অভিযানের পর। এ অভিযানের প্রতিশোধ হিসাবে সে বছরই হত্যা করা হয় ইন্দিরা গান্ধিকে। ফলশ্রুতিতে পুরো উত্তর ভারত জুড়ে শিখ বিরোধী যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে তার লেলিহান আগুনে পুড়ে মরে হাজার হাজার শিখ প্রাণ। আরো জঙ্গী রূপ লাভ করে শিখদের সংগ্রাম। উনিশ শ’ ৮৫ সালে একই দিনে আয়ারল্যান্ড এবং জাপানে বিমান বিস্ফোরণে শত শত মানুষ হত্যা, ১৯৮৭ সালে ট্রেনে এবং ১৯৯১ সালে বাসে আগুন দিয়ে অসংখ্য মানুষ হত্যা সহ ব্যাপক জঙ্গী তৎপরতা শুরু করে শিখরা। এক পর্যায়ে ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পান্জাব বিধান সভায় ১৩টির মধ্যে ১০টি আসনেই জয়লাভ করে। অবস্থা বেগতিক দেখে কেন্দ্র থেকে নির্বাচন বাতিল করে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় পূননির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে কংগ্রেস সরকার কঠোর পথ অবলম্বন করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মুখ আপাতত বন্ধ রাখতে সক্ষম হয়েছে। ইতোমধ্যে শিখদের একটা বড় অংশই বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, এ রক্তপাত কোনো সমাধানের দিকে নিচ্ছে না, বরং দূর্বল করছে নিজেদেরই। কাশ্মিরীদের মতো তাদের মধ্যেও আছে রাজনৈতিক দোলাচল, ধর্মীয় ও জাতিগত অস্তিত্বের সংকট এবং হতাশা। কঠিন শাসনের বজ্রআটুনি এখনো বিদ্যমান চন্ডিগড়, পান্জাবে। সেজন্য বিমানবন্দরে ছবি তোলার এ নিষেধাজ্ঞা। সেজন্য পান্জাবের বিধানসভার অধিবেশনে চলাকালীন নিরাপত্তা ঘেরাটোপে লো কহবুসিয়ের ‘খোলা হাত ভাস্কর্য’ দেখা থেকে বঞ্চিত থাকে সাধারণ মানুষ। সংবিধানের ২৫, ২ (বি) ধারা এখনো বলবৎ আছে। সেজন্য রাজস্থানি গাড়িচালক বলছে শিখ, বৌদ্ধ সবার মূলেই আছে হিন্দুত্ব। আশার কথা, তিনি বলছেন সব মানুষই এক, সবার পরিচয় একটাই— আমরা সবাই মানুষ! একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আধুনিক নগর পরিকল্পনার বিচারে চন্ডিগড় পৃথিবীর অন্যতম এক নগর। নান্দনিক সৌন্দর্যের প্রদর্শনী এবং গ্রীষ্মকালে উত্তর ভারতীয় জলবায়ুর রুদ্রতা প্রশমন করতে যেভাবে এখানে ফুল ও বৃক্ষের ব্যবহার করা হয়েছে তা যেন এক জীবন্ত ল্যাবরেটরি। স্থাপত্যকলা এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ছাত্রদের এখান থেকে শেখার আছে অনেক কিছু।

জ্বীনের নগর, ফিরোজ শাহ্ কোটলা।
৮.
এক সন্ধ্যায় ‘সৌন্দর্যের নগর’ থেকে এসে নামলাম ‘জ্বীনের নগরে’। নয়া দিল্লির ভেতর আছে আরো সাতটি মৃত নগর। এখন যে দিল্লি আমরা দেখি এটি অষ্টম দিল্লি। শুরু হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৫০ সালের দিকে পান্ডবদের তৈরি ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে। তারপর দিল্লির বাতি আর নেভে নি কখনো, বরং বহু বর্ণে বর্ণিল হয়েছে তার ইতিহাস। বলা হয়, একটা জনপদ গড়ে ওঠতে তিনটা জিনিসের প্রয়োজন— বাদশাহ্, বাদল আর দরিয়া— এর সবই ছিল দিল্লির। আর সে জন্যই হিমালয়ের দক্ষিণের এই সমতল ভূমিতে রাজত্ব করতে মধ্য এশিয়ার তুর্কি, পারসি, মোগল, মোঙ্গল আর মেসিডোনিয়ার আলেকজেন্ডার সহ হালের পর্তূগাল, ফরাসি আর বৃটিশরাও ইতিহাসের বিভিন্ন কালে তাদের পায়ের চিহ্ন রেখে গেছে এখানে। স্থানীয় কাশ্মিরী, পান্জাবি, রাজপুত, মারাঠা— আর্য আর অনার্যের মেলবন্ধন হয়েছে এখানে। হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন ধর্মের সাথে মধ্য এশিয়া থেকে এসে মিশেছে ইসলাম। সাড়ে তিন হাজার বছরের দিল্লির জনপদের ইতিহাস যেমন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর ভূবনবিখ্যাত রাজন্যের কীর্তিতে দীপ্তিমান, তেমনি এখানেই জন্ম হয়েছে উর্দূ ভাষার, সৃষ্টি হয়েছে মির্জা গালিব, আমির খসরু, মীর ত্বকির কালজয়ী অমর উর্দূ গজল, কবিতা, শায়ের। হাজার বছর ধরে দিল্লি একটা বিশ্বজনীন সাংস্কৃতিক মিলনকেন্দ্র হিসাবে কাজ করছে। ভারতের সব অঞ্চলের নিজস্ব ভাষা থাকলেও এদেশের সবাই নিজের মাতৃভাষার মতোই হিন্দি ভাষাটাও জানে। ভিন দেশ-ধর্মের লোকের যোগাযোগের মাধ্যম হিন্দি। আঞ্চলিক ভাষাগুলো শাসকদের সাথে নিয়ে আসা চুগতাই, তুর্কি, ফারসি আর উপনিবেশিক কালের ইউরোপিয় ভাষা থেকে অনেক শব্দ নিয়ে নিজেদের ঋদ্ধ করেছে। মানুষ আর ভাষার এই অপূর্ব মিলন পৃথিবীর অন্যত্র বিরল। নয়া দিল্লির ভেতরে ছড়ানো মৃত সাত প্রাচীন নগর একে যেমন রহস্যময় করেছে তেমনি ইতিহাস, ভাষা ও সমাজবিজ্ঞানীদের কাছেও এটি হয়ে আছে এক জীবন্ত জাদুঘর।

হুমায়ুন সমাধি, দিল্লি

দপ্রথম দিন দেখা হলো হুমায়ুনের সমাধি কমপ্লেক্স। এখান থেকেই ভারতে মোগলদের শুরু, এখানেই সমাপ্তি তাদের। মোগল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন বাবর করলেও দিল্লির চেয়ে আগ্রা বেশি পছন্দ ছিল তার। তিনি নিজে কোনো কিছু নির্মাণও করেন নি তার স্বল্পকালে, থেকেছেন ইব্রাহিম লোদির আগ্রা দূর্গেই। শেষ শয্যা হয়েছে তার কাবুলে। কিন্তু হুমায়ুন তার ‘দিনপানাহ’ (বিশ্বাসীর আশ্রয়) গড়ে তুলেছিলেন দিল্লিতেই।

শেষ মোগল সম্রাট কবি বাহাদুর শাহ্ উন্মত্ত ইংরেজদের হাত থেকে বাঁচার সম্ভাবনা নেই জানার পর লাল কিল্লা ছেড়ে পরিবার পরিজন সহ অসহায় আশ্রয় নেন এখানেই। আঠারো শ ৫৭ সালের নির্মম সেই পরাজিত দিনগুলোয় এখানেই রচিত হয়েছে মোগলদের করুণ অন্তিম অধ্যায়। দারা শিকোহ সহ মোগল বংশের শতাধিক রাজন্যবর্গের কবর রয়েছে এখানে। তাই এটিকে শেষ মোগল গণবিছানাও (dormitory) বলা হয়। মোগলরাই প্রথম ভারতে বাগান-কবরের প্রচলন করেন। বিশাল বাগানঘেরা সমাধি কমপ্লেক্সটিতে এলে মনে প্রশান্তি আসে। অনিত্য জীবনের ভাবনা উঁকি দেয় মনে।

নিজামউদ্দিন দরগাহ, দিল্লি

পাশেই হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার (রঃআঃ) (১২৩৮-১৩২৫) দরগাহ। মাওলানা ফরিদ উদ্দিনের শিষ্য নিজামউদ্দিন ভারতবর্ষে চিশতিয়া তরিকার প্রধান সুফি সাধক। ‘দিল্লি বহু দূর’ কথাটি তার প্রসঙ্গেই জনশ্রুতি হয়ে আছে। দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ১৩২০ সালে যখন দিল্লির দ্বিতীয় নগর তুঘলকাবাদ নির্মাণ করছিলেন একই সময় নিজামউদ্দিনও তার দরবার সংলগ্ন জায়গায় একটি কূপ খনন করছিলেন। সুলতান চায় নি শ্রমিকরা নিজামউদ্দিনের জন্য কাজ করুক। তবুও শ্রমিকেরা রাতে কাজ শুরু করলে সুলতান দিল্লিতে জ্বালানি তেল বিক্রি বন্ধের আদেশ দিল যাতে শ্রমিকরা রাতে কাজ না করতে পারে।

আমির খসরুর সমাধি
এদিকে বাংলার বিদ্রোহ দমন করে গিয়াসউদ্দিনের দিল্লি ফেরার সময় হলে তিনি নিজামউদ্দিনের ওপর চড়াও হতে পারেন এ ভয়ে সবাই যখন উদ্বিগ্ন তখন নিজামউদ্দিন বলেছিলেন, ‘দিল্লি বহু দূর’! গিয়াসউদ্দিন দিল্লির উপকন্ঠে এলে অভ্যর্থনা তোরণ ভেঙ্গে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। কথিত আছে নিজাম উদ্দিন অভিশাপ দিয়েছিলেন এই তুঘলকাবাদ ‘হয় মরু হবে, না হয় যাযাবরদের আস্তানা হবে’। তুঘলকাবাদের অস্তিত্ব আজ আর টিকে নেই। ভারতের মহান সুফি সাধক নিজামউদ্দিন আউলিয়া ভারতবাসীকে সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থান ও সহজ জীবনের সন্ধান দিয়েছেন। ভালোবাসা আর দয়া— এ ছিল নিজাম উদ্দিনের মূল কথা। দুঃখি, ক্ষুধার্ত, ন্যায় বঞ্চিত মানুষের পাশে থেকেছেন সব সময়। এখানে এলে দেখা মেলে কত অসহায় মুখ, কত শত মানুষ তার দুঃখ, বেদনা আর বিচারের আশায় ফরিয়াদ নিয়ে ছুটে এসেছেন নিজামউদ্দিনের দরগায়। তার সমাধির পাশেই শেষ শয্যায় শায়িত আছেন সুফি গায়ক, কবি আমির খসরু আর শাজাহান কন্যা জাহানারা বেগম।

তারপর গেলাম লাল কিল্লার পাশে জামে মসজিদে। সম্রাট শাহজাহান ১৬৫৬ সালে নির্মাণ করেছিলেন মার্বেল পাথরের বিশাল এই লাল মসজিদটি। আঠারশো ৫৭ সালে বাহাদুর শাহের পরাজয়ের পর অনেক মর্মান্তিক ইতিহাসের স্বাক্ষি এ মসজিদটি। প্রতিদিন অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি দেখতে আসলেও নিদারুন অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে মসজিদটি এখন, দেখে মনে হলো বোধহয় এখানে এখন আর নামাজ পড়া হয় না। অনেক জায়গায় মেরামতের কাজ চলছে দেখা গেল। মসজিদে ঢোকার রাস্তাগুলো গুলিস্তানের মতো হকারদের দখলে। পরিবেশ ভীষণ অপরিচ্ছন্ন। বোঝা যায়, জায়গাটি এখন অনেকটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে আছে।


দেখা হলো পাশের চাঁদনী চক। লাল কিল্লা, জামে মসজিদ, চাঁদনী চক এগুলো সবই কাছাকাছি। চাঁদনী চক নির্মাণের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন শাহজানের প্রিয় কন্যা জাহানারা বেগম। একটা লেকের দুই পাশে বানানো হয়েছিল এ রাজকীয় বিকিকিনির হাট। মোগল নির্মাণের আরেকটি উজ্জ্বল উদাহরণ এ মার্কেট এখন তার জোলুস হারিয়েছে। সেই লেক ভরাট করে ইংরেজরা এখানে সড়ক বানিয়েছে। দোকানের কাছ দিয়ে যাবার সময় দোকানদাররা টানাটানি করে। বিদেশি দেখলে চিনে ফেলে তাদের অভ্যস্ত অব্যর্থ চোখ। আমদেরকেও সবাই এটাওটা বোঝাচ্ছিলো, যদিও শুধু দেখতেই এসেছি আমরা, কিনতে নয়। একজন শিখ ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন আমাদের পাশ দিয়ে। চুপিচুপি আমাদের সাবধান করে দিলেন— এরা এজেন্ট, খদ্দের এনে কমিশন পায়। এদের কথা শুনো না, কিছু কিনতে হলে তুমি নিজে সিদ্ধান্ত নাও। তাকে ধন্যবাদ দিলাম।
দিল্লির সাতটি কিংবদন্তি নগরেরে প্রথমটির নাম লালকোট। রাজা অনঙ্গপাল তোমার এটি নির্মাণ করেছিলেন ১০৫২ সালে। এগার শ ৯২ সালে গজনির সুলতান মোহাম্মদ ঘোরি এটি জয় করে তার এক সময়ের ক্রিতদাস কুতুব উদ্দিন আইবেককে এর শাসক নিয়োগ করেন। কালক্রমে দিল্লিতে অনেক বিখ্যাত নগর গড়ে উঠে বিস্মৃতির অতলে হারিয়েও গেছে। সিরি, তুঘলকাবাদ, জাহানপানাহ, ফিরোজাবাদ, দিনপানাহ ও শাহজাহানাবাদে এক সময় মানুষ বাস করেছে এবং পরিত্যক্তও হয়েছে, কিন্তু মুসলমানদের ৬৬৪ বছরের ভারত শাসনের ইতিহাসে কখনোই গুরুত্ব হ্রাস পায় নি লাল কোটের কুতুব কমপ্লেক্সের। কুতুব উদ্দিনের কুতুব মিনার এখন দিল্লির লোগো এবং ভারতের রাজধানী এখন এ পরিচয়েই পরিচিত। এই লালকোটেই সমান্য ক্রিতদাস থেকে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছেন কুতুব উদ্দিন আইবেক, ইলতুতমিশ এবং বলবন। মানুষের অদম্য আকাঙ্খা, ক্লান্তিহীন জীবন সংগ্রাম আর অদম্য কর্মশক্তি এবং শেষ পর্যন্ত সালতানাতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সফল উত্থানের নীরব স্বাক্ষি এই লাল কোট। এই সেই লাল কোট যেখানে সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে এসে ভারতের প্রথম নারী সুলতান হিসাবে ক্ষমতায় আরোহণ করেন সুলতানা রাজিয়া। সেই মধ্যযুগে পর্দা প্রথাকে অস্বীকার করে জনসমক্ষে উপস্থিত হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সে জন্য লাল কোট নারীমুক্তি ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসাবেও পরিচিত। কুতুব মিনারের পর দেখা হল হাউজ খাস। দর্শনীয় স্থান হিসেবে জায়গাটা খুব জনপ্রিয় নয়। কিন্তু এখানেই আছে পুরনো দিল্লির আরেক মৃত শহর ‘সিরি’! উর্দূতে হাউজ মানে ট্যাংক আর খাস মানে রাজকীয়, অর্থাৎ রাজকীয় জলাধার। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি এখানে গড়ে তুলেছিলেন তার সিরি নগর। অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন একটা জলাধার আছে এখানে। ভারতের প্রথম মাদ্রাসা ছিল এ নগরে। এখানে সমাধি আছে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ও আলাউদ্দিন খিলজির। এ যাত্রায় সবশেষ দেখা হল ‘জ্বীনের শহর’ ‘কোটলা ফিরোজ শাহ্’। বিখ্যাত ক্রিকেট স্টেডিয়াম ফিরোজ শাহ্ কোটলা’র পাশেই অবস্থান দিল্লির পঞ্চম নগর কোটলা ফিরোজ শাহ্’র, যা জ্বীনের শহর নামেও বিখ্যাত। সহৃদয় পাঠক এ প্রসঙ্গে উইলিয়াম ডালরিম্পলের দ্য সিটি অব জ্বীনস পড়তে পারেন। তেরশ ৫৪ সালে বিশাল এলাকা জুড়ে সুলতান ফিরোজ শাহ্ তুঘলক নির্মাণ করেছিলেন এ নগর যার কঙ্কাল ছাড়া তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই আর। ইতিহাসখ্যাত সম্রাট অশোকের একটি স্তম্ভ এখানে সংরক্ষণ করেছেন ফিরোজ শাহ্। এখানে এলে দেখা মিলবে দুই হাজার বছরের বেশি বয়সি এ স্তম্ভটির। রহস্যে মোড়া একটা মসজিদ আছে এখানে। তের শ ৯৮ সালে দিল্লি বিজয়ি তৈমুর লং বিশাল এই মসজিদের স্থাপত্য কৌশলে মুগ্ধ হয়ে এখান থেকে রাজমিস্ত্রি নিয়ে সমরখন্দে অনুরূপ আরেক মসজিদ নির্মাণ করেন। প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। বলা হয় জ্বীনরা তখন এসে মানুষের অভাব-অভিযোগ শুনে থাকে। জ্বিনদের উদ্দেশে চিঠি লিখে তাদের কাছে প্রতিকার চায় মানুষ। গা ছমছম করা এক হাজার বছর আগের পরিত্যক্ত এ নগরটি দিল্লির অনেকের কাছেই পরিচিত নয়। অনেকবারের চেষ্টায় এবার আমরা দেখতে পেলাম এ জায়গাটি। সময় হল দেশে ফেরার কাল চলে যাবো, কিন্তু দিল্লির আকর্ষণ কখনো শেষ হবে না। বারবার আসতে হবে এখানে। খায়রুল আলম চৌধুরী
২৩ সেপ্টেম্বর - ৬ অক্টোবর ২০২২
ভারত

All photography by the writer except Humayun's Tomb and Nizamuddin Dargah.
Writer's solo pictures taken by daughter Farheen Chowdhury