ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Tuesday, October 25, 2022

ন হন্যতে নগ্নতা ১ : হেমেন মজুমদারের দেহজ দর্পণে

 ।।চয়ন খায়রুল হাবিব।।

অভিব্যাক্তিজাত সকল শিল্প পরম্পরা সূত্রে বাধা। আবার পরম্পরার ভেতর কেউ কেউ অন্যদের চেয়ে বেশি প্রতিভাত, তার শৈলীর আবেদন হয়ে ওঠে সর্বজনপ্রিয়। সাহিত্য চর্চার স্বোপার্জিত নিক্তি পাল্লায় আমার কাছে সেসব শিল্পী প্রিয় হয়ে উঠতে থাকে যারা লৈঙ্গিক স্পর্শকাতরতায় নিজেকে পার হতে পেরেছে। আমি ইতিহাস বদলাতে পারবো না। ইতিহাসকে রূপকথার লোকনকাচে দেখাও ঠিক না। ভবিষ্যতমুখী দৃষ্টিকোণে ছেকে তোলা যেতে পারে বাংলাভাষী চিত্রকলার পথরেখা যারা প্রশস্ত করেছে তাদের কথা।

আমার ভালো লাগে হেমেন্দ্রনাথ মজুমদারের কাজ, যিনি বেঙ্গল স্কুল অব আর্টস ভঙ্গিমার প্রতিষ্ঠাতা অবনীন্দ্রনাথের ঐতিহ্য আনুগত্যকে 'অসার' আখ্যা দিয়ে বন্ধু অতুল বসু, যামিনী রায়দের নিয়ে নিজেদের মঞ্চ দাড় করিয়েছিলেন। ব্লাউজ, পেটিকোট, সেমিজ পরতে না শেখা আমাদের নারীমুখগুলোর স্বপ্ন, ব্রীড়া, একাকীত্ব, সেক্সসুয়ালিটি শরৎচন্দ্র যেরকম শব্দের তুলিতে এঁকেছিলেন, হেমেন্দ্রনাথ তাদের ক্যানভাসে লিখেছিলেন তুলি ভেজা শব্দে। একটি পথরেখা অনেকে মিলে তৈরি করে। পথের যথার্থ মূল্য অনেক সময় আদায় হয় না। এই পথরেখাতে আমার আলোচ্য যাত্রীরা এসেছে বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। হেমেন মজুমদার, জয়নুল আবেদিনের জন্ম কিশোরগঞ্জে , যামিনী রায় বাকুড়ার, সুলতানের জন্ম নড়াইলে, নভেরার জন্ম সুন্দরবন এলাকায়। লক্ষ্যে পৌঁছাবার পথে এদের মূল পাথেয় মৃগয়াজীবীর আরন্যক স্বপ্নে মেশা নগর পত্তনির খনিজ ঝনঝনা। শ্রম ও শিল্পের দরাদরি সামন্তবাদ থেকে এগোচ্ছে বাজার বিপণনের দিকে। মূল্য আদায়ের প্রশ্নে জয়নুল আবেদিনের মন্বন্তরের ছবির কথা আসে। সমস্ত শক্তি উজাড় করে মানুষটি সময়ের শিকার ও সময়ের প্রতিনিধিদের কথা বলেছেন নদীমাতৃক বদ্বীপের নরম প্যাস্টেল, জলরঙের পাশাপাশি, কাগজে কাঠ কয়লার চকখড়ি ঘসে। কালীঘাটের পটচিত্র থেকে বাংলাদেশের রিক্সাচিত্রি ব্রাত্যজনও কিন্তু দেব, দেবী, বোররাখ, ফুল, পাখি, নিসর্গের ঝকমকির পাঁশে অ, আ, ক, খ, শহীদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক শাসন তুলে ধরেছে। সাহিত্যের রসবোধ ও শিল্পের তাড়না ধারণ করতে গিয়ে মনে হয়েছে সামগ্রিকভাবে বাংলাভাষী চিত্রকলায় দুই বাংলার নারীরা এবং মুসলিম সমাজ পিছিয়ে গেলো কেনো? ব্যাপারটা শুধু যে বাংলাদেশে তা নয়, বিশ্বের বড় বড় গ্যালারিতে ঘুরে বার বার এই একই প্রশ্ন মাথায় এসেছে। শিল্প ও সাহিত্যের এই টোকেনিজম মি টু আন্দোলনের মতোই মর্মবিদারক শিল্পের চেয়ে শিল্পের মূল্য অনেক বেশি বিমূর্ত! প্রচুর টাকা দিয়ে কোরবানির বিপুল ষাঁড় ও বিশাল দামি আর্টস কেনা যায়। সুলতানের কাজগুলো এখন স্থাবর সম্পত্তি হয়ে গেছে। সুলতানের আকার অর্থমূল্যের চেয়ে আমি গুরুত্ব দিচ্ছি তার কাজকে কিভাবে দেখা হবে সেদিকে। কনক রহমান কেনো 'তরঙ্গ 'ওয়েবজাইনে বলছে,‘’সুলতান দেখার ক্ষেত্রে তারেক মাসুদের দৃষ্টিকোণ পরিহার জরুরি।’’ এটা কি হেমেন মজুমদার আর অবনীন্দ্রনাথের পুরনো দ্বন্দ্বের নবায়িত উৎসারণ? নভেরা জীবনের বেশির ভাগ যে ফ্রান্সে কাটিয়েছে, আমাদের নামি শিল্পী শাহাবুদ্দিনের উচ্চতর প্রশিক্ষণও সেই ফ্রান্সে। যামিনী রায় আমন্ত্রণ পেলেও বিদেশে আসতে চাইতেন না, একবার বলেই বসেছিলেন, 'আমরা গরিব দেশের মানুষ, এত পয়সা খরচ করে ওদের দেশে যাব কেন? ওদের অনেক পয়সা, ওরা এসে আমাদেরটা দেখে যাক।' এখানে যামিনী রায়ের কথায় আমার আপত্তি আছে। ফ্রান্সে, বিলাতে, ইটালিতে ঘুরে গেলে দেখতে পেতেন বিপুল পাবলিক গ্যালারিগুলোতে বিচিত্র সব শিল্পকর্মের সামনে সাধারণ আয়ের, সাধারণ মানুষের ভিড়! যত জানি, যত দেখি হেমেন মজুমদারের কাজে তত সম্মোহিত হই। ক্রিস্টি আর সদাবি কোম্পানির মূল ব্যবসা বিশ্বের প্রধান শহরে নিলাম পরিচালনা, যার একটি বিশেষ শাখা চারুকলা সামগ্রীর নিলাম। তাতে খ্যাত, অখ্যাত অনেক কিছু বিভিন্ন দামে নিলাম হয়। এর সাথে জড়িত থাকে চারুকলার ঝানু সমালোচক, যাদুঘরগুলোর বিশেষ দূত আর ব্যক্তি সংগ্রাহকদের প্রতিনিধি। ক্রিস্টির ২০১৭ সালের একটি ক্যাটালগে পাওয়া যাচ্ছে, সে-বছর মুম্বাই শহরে পরিচালিত চারুকলার এক নিলামে হেমেন মজুমদারের ১৯৭৪এ আকা শিরোনামহীন একটি কাজ বিক্রি হয়েছে ১৫কোটি রুপিতে। হেমেন, তার বন্ধু অতুল বসু, যামিনী রায় তারুণ্যে দিন কাবারি খরচ ওঠাতে মরা মানুষের পোট্রেট করে দিত, সেটা তখনকার নতুন চল। আরো সব বিচিত্র কাজ করতো তিন বন্ধু। কিন্তু শিল্পের সাথে তাদের সম্পর্ক সার্বক্ষণিক, প্রতি পল মুহূর্তে তাদের যাপন শিল্পকলা ঘিরে। মাস্টার পেইটারের একটি বিশ্বায়িত লক্ষণ ক্যানভাসে একটি গল্পকে ধরা, একটি উপন্যাসের ইঙ্গিত তৈরি করা, ইতিহাসের চাকাকে তার কাজের ভেতর থামিয়ে দিয়ে দর্শককে সেই ইতিহাস অবগাহনে প্রাণিত করা। সাহিত্যে মাস্টার পেইন্টারের তুলনা এপিক বা মহাকাব্যিক লেখকের সাথে। ভ্যান গগ, মাতিস, গগ্যা, হেমেন মজুমদার, যামিনী রায়, রদ্যা, দালি, পিকাসো, ক্যামি ক্লদেল, অমৃতা শের গিল, ফিদা হুসেন, এন্ডি ওয়ার হল, লুই বুর্জোয়া, ক্লি্মট কাজ করেছে ভিন্ন মাধ্যমে, কিন্তু তাদের কাজ মাস্টার পেইন্টার, এপিক লেখকের শর্ত পূরণ করে। একটি ক্যানভাসে, একটি চলচ্চিত্রে, একটি নাটকে, একটি সঙ্গীতে তাহলে আমি গল্প খুঁজি। বিমূর্ততা কি গল্প বলতে পারে? প্রবল গতিসম্পন্ন জ্যাকসন পলকের ক্যানভাসে রঙের তুমুল রায়ট আমাকে কি গল্প দেয়? না, দেয় না। তাহলে কি দেয়? বিমূর্ত কাজও শিল্পের বিভিন্ন শর্ত আদায় করতে পারে। এই কাজগুলোকে আমার মনে হয় সঙ্গীতের ধুন বা আলাপ, বাদ্যযন্ত্রের টিউনিং। রং এর গসিপ। একেক জায়গার মূর্ততার চেহারা, অবয়ব, দেহ বল্লরি যেরকম বিভিন্ন, সেরকম বিমূর্ততাও বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে। অভিব্যক্তির মুক্তির লক্ষ্যে যে বিমূর্ততা, তা অভিব্যক্তির আড়ালচারিতা, ভয়, রক্ষণশীলতা, লিঙ্গ বৈষম্য থেকে আসা বিমূর্ততা থেকে ভিন্ন। বাস্তবিক অবস্থা থেকে জানি, ঢাকা চারুকলা অনুষদে মাস্টার্সের ছাত্রছাত্রীরা লাইফ স্টাডির সুযোগ পায়, মডেল যে তেমন পায় না, তা লেখা বাহুল্য। পশ্চিমে এ-সুযোগ ঘটে ফাউন্ডেশান কোর্সের সময় অর্থাৎ ১৫/১৬ বছর বয়সে। রেনেসাঁর শিল্পীরা মানুষের দেহের ভেতর, বাইরেটা পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে অনেক সময় কাটাতো লাশকাটা ঘরে। দা ভিঞ্চি ছাড়াও প্রচুর পশ্চিমি শিল্পীর কার্টুন বা প্রাথমিক খসড়ায় এই লাশকাটা ঘরে আকা দেহাংশ পাওয়া যাবে। কার্টুন এখন একটি স্যাটায়ারমূলক জনরা হিশেবে পরিচিত হলেও, শিল্পের পরিভাষায় কার্টুন হচ্ছে যে কোনো ফ্রেস্কো, মুরাল, তেলচিত্র, ট্যাপেস্ট্রির প্রস্তুতিমূলক খসড়া। ভারতের সব খানে এক সময় নারী, পুরুষ সবাই স্বল্প বসনধারী হওয়ায় উপমহাদেশের শিল্পীদের বিভিন্ন বয়সে মানুষের দেহের বাক জানতে বেগ পেতে হতো না। এ-পারস্পরিকতা থেকে বাৎসায়নের কামসূত্র সামাজিক সাহিত্য হয়ে উঠতে পেরেছিল। যে-দেশের সুকুমার কলার পুরোটা দাঁড়িয়ে আছে দেহের ভাষার ওপর, সেখানে এটা অভিব্যক্তির মিনিমালিজম বৈ কি।গল্পের ক্ষেত্রে যাকে এখন চালিয়াতি করে বলা হয় অনুগল্প। মিনিমালিজম এবং সামাজিক ভয়ের শর্ত জড়ানো বিমূর্ততায় একটা রাতকানা ধুসর ব্যাপার থাকে। জীবনানন্দের ধুসর পাণ্ডুলিপি কিন্তু সমস্ত বিমূর্ততা পার হয়ে একজন বনলতা সেনের অবয়ব খোজ করে, একটা ঘোড়ার দানা খুটে খাওয়া মনে রাখে। আমার কাছে বাংলাদেশ ও ভারতের বেশির ভাগ শিল্পী ও লেখককে ভিতু মনে হয়। স্লোগান দিলে, রাজনীতি করলে একজন সাহসী হয়ে যাবে তা নয়। সেটা শিল্পীর পথ নয়। গয়া যেভাবে ভয়ের, আর্ততার অবয়ব ধরেছে বিকট সব মুখভঙ্গিতে তা সবাই করবে, তাও নয়। কিন্তু বিভিন্ন বয়সী শিল্পীর সমাবেশ যদি ভয়জনিত বিমূর্ততার অজুহাত হয়ে যায় সেটা আশঙ্কাজনক। গয়া, ভ্যান গগ আকতো বিকট মুখ। ক্লি্মট তার স্বর্নখচিত বিমূর্ততায় ফুটাতে থাকতো চুম্বণরত নারীপুরুষের অবয়ব বা শুধু নারী বা পুরুষ, মুখ ছাড়া যাদের অবয়ব পুরো ক্যানভাসে ছড়ানো সোনা জহরতের উল্লাস। ট্রেসি এমিন তার অগোছালো বিছানাকে গ্যালারির মাঝখানে ফেলে রাখলো, ব্যবহৃত কনডমসহ। ডামিয়ান হার্স্ট বিশাল এক হাংগরকে ফর্মালডিহাইডে তাজা করে ঝুলিয়ে রাখলো এক একুয়ারিয়ামে, নাম দিলো, 'মৃত্যুর অসাম্ভব্যতা!' অনেকে কাজ করেন শুধুই বিমূর্ত। সেখানে রেখা, রঙ, প্রিন্টের অনেক রকম খেলা। কিন্তু সেটা খেলা। একটা সময় আমরা খেলার মাঠ থেকে বেরোই। বড় খেলা নিয়ে উত্তেজিত হই, বলতে থাকি আমার দল। আবার অন্যরা সে-খেলাটি নিয়ে বলছে দেখেও আমরা তাতে যোগ দেই। খেলাগুলো কয়েকবার দেখলে বোঝা যায়, যারা বার বার খেলছে, তারা তাতে মজা পাচ্ছে, অন্য কারো মজা লাগছে বা বিস্ময় জাগছে, তাও হতে পারে।আমার তাতে বিস্ময় না জাগলে সে খেলার রস কমে যাবে তাও নয়। বিমূর্ততা বা মূর্তটা কেন করছি ক্যানভাসে, ভাস্কর্যে, লিনোকাটে, উডকাটে এই প্রশ্নটি চারুকলার শিক্ষকেরা তাদের ছাত্রদের সাহিত্যের ব্যাপক অধ্যয়ন ছাড়া শেখাতে পারবেন না। পাঠ দারিদ্র্য শুধু চারুকলাতে নয়, বাঙ্গালি সব শ্রেণীতে এটা ঘটেছে। এক রিকশাওয়ালা ভাই অভিযোগ করেছিলেন, কেউ কিচ্ছু পড়ে না। যে যাত্রিকে উনি অভিযোগ করেছিলেনে, সে যাত্রী জানিয়েছিলেন যে ঐ রিকশাওয়ালা ভাই পশ্চিম বঙ্গের বড় কিছু লেখক, কবিকে পড়ে ফেলেছেন। আমার জানতে ইচ্ছে করছিলো, বিপণনের কলাকৌশল পার হয়ে এবং আমাদের সহজাত কিছু হীনমন্যতা পার হয়ে আশেপাশের সমকালীন সাহিত্য উনি পাঠ করেছেন কি না। ওনার দেয়াল ঘুরে দেখলাম, উনি নিজেও পাঠ নিয়ে বলেন না, বা যাদের নিয়ে বলাটা ফ্যাশনের তা বলেন। হেমেন্দ্রনাথ, যামিনী রায়ের বড় অংশ কেটেছে থিয়েটার পর্যবেক্ষণে। এডভার্ড মাঞ্চের বড় সময় কেটেছে ইবসেনের থিয়েটার ডিজাইন করে। এগুলো শুধু পেট চালানোর দায় থেকে নয়। হেমেন, যামিনী রায়, এডভার্ড মাঞ্চ নাট্যকলা থেকে শিখেছে একটি চরিত্র, একটি বিষয়, একটি অধ্যায় কি করে মঞ্চের এক পাশ থেকে ঢুকে আরেক পাঁশে যায়। খালি রং, তুলির কেরামতি, কেরদানি শিখে এই বিষয়টি আয়ত্তে আসে না। মঞ্চের ধারনা ছাড়া ক্যানভাসে বিমূর্ততা ধুসর হতে থাকে, ভেজা রং, ভেজা মাটি শক্ত হতে থাকে। ক্যানভাস বা ভাস্কর্যের বেস বস্তুত একটি মঞ্চ, বিষয়টি একটি রস, আর সে-রসের উপস্থাপনাটি একটা বয়ান বা ন্যারেশান। অমৃতা শেরগিল, ফ্রিদা কাহলো তাদের শরীরকে করে তোলেন মঞ্চ। গল্প, গতি, বিস্ময়ের পর এরা যোগ করে সাসপেন্স। পর্নোগ্রাফি তো অহরহ দেখা যায় এখন। কিন্তু বেটি টমকিন্সের ব্লো আপ সংগম দৃশ্যগুলো ক্যানভাসে দেখতে দর্শক হিশেবেও আমাদের প্রচণ্ড হিম্মতের দরকার। সেই সংগমের আংশিক কিন্তু সরাসরি দৃশ্যায়ন আমাকে একটা সাসপেন্সের দিকে নিয়ে যায়, যা হয় অজন্তা, খাজুরাহের মিথুন মুরালগুলোর সামনে দাঁড়ালে। শৈশবে ও কৈশোরে যৌন শিক্ষাকে ডিমিথিফিকেশান করে লৌকিকতায় নিয়ে আসতে পারলে পর্নোগ্রাফি যেরকম অবদমনজনিত উস্কানি, যৌন অপরাধের ইন্ধন না হয়ে উন্মোচনে সহায়ক হতে পারে, সেরকম শরীরকে নান্দনিকভাবে জানার ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারে। প্রথমত নিজের শরীরকে জানা, সে-শরীরের ঔনারশিপ নেয়া, তার নান্দনিক যত্নবোধের পাঁশে অধিকার সচেতন হওয়া। এরোটিকা নির্ভর জাপানের শুঙ্গা আর্ট ফর্ম মূলধারায় বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হওয়াতে সেখানে যৌন অপরাধ বেড়ে গেছে বলে কোনো প্রমাণ নেই। এরোটিক গোপিলিলা ভারতের বিভিন্ন দর্শনে যৌনতাকে বরণ করে সহজিয়া ধারাতে বিচিত্র পত্রে পল্লবিত হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে আমরা পেয়েছি মিরা বাইর ভজন ও লালনের গান। হেরমান হেসের সিদ্ধার্থ, কাজানজাকিসের লাস্ট টেম্পটেশান অব জিশাস, তানিজাকির নাওমি মূলত আমাদের দেহের ভাষাকে বিমূর্ত দৈবের, অলৌকিকের আলোআঁধারি পার হয়ে মূর্তের মুখোমুখি সচকিত করে তোলে, আমাদের স্নায়বিক চাপগুলোকে অর্গলমুক্ত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে মূর্ততাকে মিনিমালিস্ট করে ফেললে শুধু যে যৌন অবদমনজনিত মানসিক অসুস্থতা, নৃশংসতা শুরু হয় তা নয়, সঙ্গীত, সাহিত্যসহ অন্যসব সুকুমার কলা স্থবিরতায় গড়ায়। বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ পেইন্টার লুসিয়ান ফ্রয়েডের ছেলেমেয়েরা আজকে তাদের বাবার হাজার কোটি টাকা মূল্যের শিল্প এস্টেটের মালিক। ভিক্টোরিয়ান মূল্যবোধের অবরুদ্ধতা পার হয়ে পঞ্চাশ, ষাটের হিপি সময়ে লুসিয়ান তার ছেলেমেয়েদের নগ্ন পেইন্টিং করেছে প্রকাশ্য সামাজিকতার ভেতর এবং তার সন্তানেরা এ-নিয়ে পরে লিখেছে। মেয়ে এনিকে লুসিয়ান নগ্ন এঁকেছিল ১৪ বছর বয়সে। এনি এই আকা নিয়ে মি টু সময়েও কোনো অভিযোগ আনে নাই। নিজের সন্তান, স্ত্রী তাদের বন্ধুরা লুসিয়ানের মডেল হয়েছে বিভিন্ন বয়সে। এমন নয় যে লুসিয়ান শুধু কিশোরী ও তরুণীদের নগ্ন দেহ এঁকেছে। তার সবচেয়ে দামি পেইন্টিঙের একটিতে বিশাল দেহি এক মাঝবয়সী রমণী, যাকে আমরা ঘরোয়া ভাষাতে বলবো দুই রিকশাওয়ালা মুটকি, এলিয়ে কাত হয়ে সোফাতে নগ্ন শুয়ে আছে। লুসিয়ান তার ক্যানভাসে তারুণ্যের নগ্ন টেনশানের পাঁশে বার্ধক্যের কোঁচকানো ক্ষয়িষ্ণু নগ্নতাকে এঁকেছে। হাজার হাজার বছর আগে মানুষ যদি নিজেদের দেহকে হুবহু একে ফেলতে পারতো, তাকে কি তারা আদৌ ন্যুড স্টাডি বলতো? বিবর্তনের সাথে আমাদের মিসিং লিংগুলোর সেতুবন্ধন তৈরি করে দেয় হেমেনচন্দ্র, লুসিয়ান ফ্রয়েড, বেটি টম্পকিন্স। ভয় পার হয়ে যে-শিল্প আমাকে এগিয়ে নিতে চায়, তা আমি নেবো। যে-শিল্প আমার সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় তাকে আমি নেব না।এ-প্রবর্তনা থেকেইতো গুহাচিত্র আঁকতে আঁকতে আমরা গুহা থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম! চয়ন খায়রুল হাবিব ১৭/০২/২১ ব্রিটানি, ফ্রান্স


Cover Photos : Paintings by Hemendranath Mazumder.