।।নভেরা হোসেন।।
খাবার সময় বড় মাছটা তোমার-
শীতের রাতে যখন ঘুমিয়ে থাকি
গায়ে টেনে দাও রেশমি কম্বল
এইসব গার্হস্থ্য জীবনের ফাঁকে
দুজনেই বেড়ে চলি
দুজনের মতো
জানতে দেই না ভেতরের অলি-গলি
সুঁই - সুতো কাটাছেঁড়া
একটা ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো মাঝ আকাশে
তুমি ভাবছো সুতোটা তোমার হাতেই আছে
আমি ভাবছি সীমানা ছাড়িয়ে অনেকদূর
একদিন ঘুড়ি কাটা পড়ে পাশের বাড়ির ছাদে
সেখানে যাওয়া যায় না
ভেতর থেকে সব তালা চাবি দেয়া
চাইলেই খুলতে পারছো না
ঘুড়িটা একা একা ছাদের কার্নিশে-
ঝড়ো বাতাস এসে উড়িয়ে নিয়ে গেলো দূরে কোথাও
এইভাবে প্রতিদিনকার একেকটা ঘুড়ি
সুতো কেটে হারিয়ে যায়
আমরা ভাবি সব সুতো আমাদের হাতে
জীবন খুব বেশি নিজের দখলে
নিজস্ব ঘড়ির মতো
১/ ১ / ২০২২
মুখোশ
নতুন বছরে আনকোরা গন্ধ ছড়িয়ে আছে
সারা বিছানা জুড়ে ,
বালিশ -কাঁথার যুদ্ধ শেষে
সবাই দুই হাত দুই পায়ের মানুষ-
কখনো সে মুখোশের আড়ালে
ঢাকা পরে থাকে রোমশ থাবা
কখনো শুধুই নির্ভেজাল প্রেম
একুশ শতক শেষ হয়ে আসছে
আমরা এখনো হাটি হাটি পা -পা
আমাদের শরীরে জিয়ল মাছের ঘ্রাণ
আমাদের রক্তে অযুত মৃত্যুর শীতলতা
এইভাবেই অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে
দুই মেরুর পৃথিবী
তুমি ছোট হতে হতে বিন্দুকে ছাড়িয়ে
কপালে লাল তিলক
গায়ে গেরুয়া বসন
পথ হাঁটিতেছ পৃথিবীর পথে
শেয়াকুল , লেমন গ্রাস প্রান্তরে ছড়ানো
ধু ধু শুন্যতা ওপারে যাবার পথে
মুখোশের মুখ তবু কথা বলে যায়
মুখোশের জীবন সত্যি হয়ে ওঠে
১৬ / ৪ / ২০২২
অপেক্ষা
বর্ষার ধারাপাতের মতো ঝরছে হৃদয়
একটা রিনরিনে শব্দ ছুঁয়ে আছে
সারা শরীর মনকে
বাইরে ঝকঝকে রোদ
ভাবছো বিগত দিনগুলোর কথা
আরো কতশত দিন পড়ে আছে সামনে
এসব পার হয়ে পৌঁছে যাবে
কোনো এক অনিদৃষ্টের কালে-
প্রতি দিন প্রতি ক্ষণ
যার জন্য অপেক্ষা সেই
বোধি বৃক্ষের দেখা মেলে না
তুমি তবু সাঁতরে পার হও নিঃসীমকাল
মধ্য থেকে অন্ত
আদি থেকে অনন্ত
একবার মনে হয় পেয়ে গেছো
যা কিছু খুঁজেছো এতকাল
বারবার শুন্যতায় ভেসে বেড়ানো
সমস্ত তছনছ ওই ভাবনার মধ্যেই
সব কিছু ভাসিয়ে দিয়ে
উড়ে চলো দিগন্তে ব্যাপে
এখানে কিছু পাওয়ার নেই
নেই হারাবার
সব কিছু আছে তোমার
সব কিছুই হারিয়েছো
২ ০ / ৬ / ২০২২
প্রিয়তমেষু
কতদিন খুঁজিনা তোমায়
তুমিও আমাকে
ভিজে জবজবে চুলে বারান্দায় দাঁড়াতে
একটা চড়ুই এসে বলে যায়
একদিন এখানেও ভোর হয়েছিল
মাটি ফুঁড়ে জেগে উঠেছিল অংশুমান
তুমি শরতের মেঘের মতো
চঞ্চলা হরিণী
এ পথ থেকে সে পথ
এ গলি থেকে সে গলি
ক্লান্ত দুপুরে ঘুমিয়েছিলে তুরাগের তীরে
টার্কিশ রুমাল হাতে ক্যাটস আই তরুণ
তার সাথেই ভেসে চলা
যমুনার জলে-
একটা রক্ত জবা তোমাদের ঢেকে দিয়েছিলো
পেছন থেকে হাতমোড়া
নিজেরাই নিজেদের কাছে
হয়ে গেলে অচেনা
গোকূলে হারিয়ে গেলো মনি -মানিক্য
সেই থেকে দিগ্ভ্রান্ত
কেউ কি খুঁজে পায় হারানো মেঘ
বয়ে যাওয়া জল ?
পুরানো মুকুরে দেখে চলো
নতুন নতুন মুখচ্ছবি
সেই চোখ তবু অচেনা
কতদিন তোমাকে খুঁজিনা
তুমিও আমাকে
২ ০ / ৬ / ২০২২
আয়নায় দেখা চোখ
আয়নায় দেখা চোখ
বলে যায় বিগত দিনের কথা
গোলাপি ফ্রকে দৌড়ে যাওয়া সরু রাস্তা ধরে
তখন সাপের মতো ছিপছিপে পথকে
বিরাট দুনিয়া মনে হতো
দুহাতে কাশফুল জড়িয়ে
অনন্ত আকাশে ভেসে চলা
আড়িয়াল খাঁর পশ্চিম তীরে
ধু ধু একটা পথ
তুমি একটা ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো
আটকে ছিলে নক্ষত্র হয়ে
আয়নায় সেই চোখ দুর্বিনীত চেয়ে থাকে
খুঁজেফেরে হারানো দোকান এল দরাদো
পৌষের রাতে কুয়াশায় ঢাকা সকাল
আস্ত একটা দুনিয়াকে খুলে দেয় চোখের সামনে,
বায়োস্কোপে দেখা যায়
আবাবিল পাখি, কারবালার রক্তাক্ত ময়দান
হায় হাসান ! হায় হোসেন !
রব তুলে বুকে ছুরি নিয়ে মহররমের দল
এই চোখ খুঁজে নেয় লক্ষ্মীর পেঁচা
দুর্গার ধারালো অস্ত্র
কেটে চলে শত শত কচি ঘাস
রোবটের দুনিয়া
তুমি চেয়ে দেখো আয়নায় সেই চোখ
আজ আর চেনা যায় না
ফোলা ফোলা, ভেজা চোখ
শুন্যদৃষ্টি
যেন শাপগ্রস্ত মনসা
এই চোখ তুমি আর চেনো না
টুপটাপ ঝরে পরে শীতের রাতে
আয়নার পারদ গলে ঢাকা পড়ে গেছে বিস্তৃত জীবন
কিরিচের মতো তবু সেই চোখ
ঝলসে ওঠে অমাবশ্যার রাতে
৪ / ১০ / ২০২২
কুড়িয়ে পাওয়া
কুড়িয়ে পাওয়া কাঠ খড় এনে
জড়ো করছো বারান্দায়
তৈরী করছো চোখ -মুখ, কারো প্রস্থান
কারো আগমন -
দিনমান চলে বস্তুর গতায়াত
হাত দিয়ে একটু ছুঁয়ে দিলেই
ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ছে সিকিয়া ঝোরা
এই জলে অবগাহন, এই জলেই নাওয়া-খাওয়া
ছোট্ট একটা খাঁচার ভেতর অফুরান জীবন
স্বপ্নটা আকাশ ছোঁয়া
পা দুটো শেকল-বন্দী
একটু একটু বালু সরিয়ে
খুলে নিচ্ছ হৃদয়ের ভার
হৃদয়ের একূল, ওকূল
দুকূল ভেসে যায় সজনী
তুমিও কুড়িয়ে আনো জীবনের সম্ভার
একেই বলে বেঁচে থাকা
নিরন্তর ঘাস -বিচালি খেয়ে
জোৎস্নার মাঠে ধু ধু রাত
৫ / ৫ / ২০২২
নভেরা হোসেন
Cover painting by Dilruba Papia