ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Tuesday, October 25, 2022

কানাডার ডায়েরি : ছোট্ট ইয়ানের চোখে

।।বাবলী হক।।


হান্টসভিল।

হান্টসভিল এখন রিল্যাক্স মুডে!
বসন্ত নিজেই এক উৎসবের নাম! রঙিন ফুলগুলো সব আহ্লাদে বাতাসের গায়ে ঢলে পড়ছে। প্রকৃতির কাছে যাওয়া শুধু নয় এ যেন প্রকৃতির মাঝে থাকা! দিগন্ত জোড়া সবুজ, ঘাস পাতা আর জলের এক জীবন্ত মানচিত্র! সন্ধ্যা হতেই ভারী বাতাসে সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ে। ফুলের সুবাস, জলের সুবাস! দিনের বেলায় এ সুগন্ধ মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যায়!

শুধু মাত্র বসন্তের এই কয়েকটা মাস। তারপর পাতাঝরার অনিন্দ্য সুন্দর সময় কেটে গেলে চারপাশ সাদা বরফে ঢেকে যাবে!

হান্টসভিল কানাডার অন্টারিওর মাসকোকা অঞ্চলের বৃহত্তম শহর। এটি টরন্টো থেকে ২১৫ কিলোমিটার উত্তরে। চারপাশে হ্রদে ঘেরা কানাডিয়ান শিল্ডের হান্টসভিল পাহাড়ি অঞ্চল।

১৮৬৯ সালে একজন ইউরোপীয় জর্জ হান্ট এখানে এসে একটি ছোটো কৃষিকেন্দ্র নির্মাণ করেন। এরপর লোকালয় বাড়তে থাকে। ১৮৭০ সালে এখানে একটি পোস্ট অফিস স্হাপিত হয়। হান্টের নামে এলাকাটির নাম 'হান্টসভিল' রাখা হল, যিনি এখানে প্রথম পোস্টমাস্টার হয়েছিলেন। হান্টসভিলের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রকল্পে পোর্ট সিডনি থেকে হান্টসভিলে নৌ চলাচল শুরু হয়। ১৮৮৫ সালে গ্র্যাভেনহার্স্ট থেকে রেলপথ নির্মিত হলে হান্টসভিল একটি পরিপূর্ণ শহর হয়ে ওঠে। পরের বছর, মাসকোকা রোড এই এলাকায় পৌঁছায়।

বিশ শতকের শুরুর দিকে হান্টসভিল গুরুত্বপূর্ণ শিল্প অঞ্চলে পরিণত হয় এবং বেশ কয়েকটি করাত, প্ল্যানিং, এবং ট্যানারি স্হাপিত হয়। এলাকার অনেক হ্রদ, পাহাড়, অ্যালগনকুইন পার্ক এবং টরন্টোর সাথে শহরের যোগাযোগ হওয়ায় হান্টসভিল ও মাসকোকা অঞ্চল একটি প্রধান পর্যটন কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

হান্টসভিল এখন টুরিস্টের শহর। নানান দেশের নানান ভাষার লোকজন ছুটি কাটাতে এসেছে। কভিডকালীন কড়া বিধিনিষেধ শিথিল হতেই, ঘর থেকে বেরোবার অনুমতি পেয়ে মানুষ ছুটে এসেছে মুক্ত হাওয়ায়! কিন্তু সচেতনতা হারায়নি। হোটেলে কক্ষ থেকে বেরিয়েই মুখে মাস্ক পরতে কেউ ভুলছে না। হিডেনভ্যালি রিসোর্টে ঘরের এক চিলতে বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি ঢেউ খেলানো সবুজ মাঠ, লেকের নীল জলের উপর সিগাল উড়ে বেড়ায়! সবুজের উঠোন পেরিয়ে সমর্পণের ভঙ্গিতে নীল হ্রদ! সব কিছু ছবির মতো সাজানো!

ক্যানোর গায়ে চিত্র প্রদর্শনী

শহরের রাস্তার দুপাশে কিছু রেস্তোরাঁ আর ছোটো ছোটো গিফটশপ। কিছু সামার হাউস,কন্ডোস রয়েছে। অনেকে মেগা সিটি থেকে এসে এখানে কয়েকমাস নিরিবিলি সময় কাটান। ছবিতে যেমন ল্যান্ডস্কেপ দেখি, অবিকল তেমনি উচু-নীচু ছায়াময় পথে গাড়ি ছুটছে। আকাশের গাঢ় ছায়ায় লেকের নীল জল টলটল করে। প্রায় প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনায় ফুলের কেয়ারি। কোনো আঙ্গিনায় দুটি চেয়ার, ছোটো গোল টেবিলে হোয়াইট ওয়াইন নিয়ে বসে আছে কোনো এক দম্পতি! খুব নৌকা প্রীতি এই সময় এই এলাকায় লোকজনের। অনেকে গাড়ির উপরে নৌকা বেঁধে নিয়ে চলে এসেছে! আর নৌকা প্রীতি হবে না কেন! এরকম শান্ত হ্রদের নীল জলে গা ভাসিয়ে বোটিং করতে কার না ভালো লাগবে! লেকের ধারে, এদিক সেদিক কাঠের বেঞ্চ পাতা রয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হলেই বসার ব্যবস্হা!

সাজানো শহরের চারপাশে ছোটো-ছোটো বেডে পথে পথে ফুল ফুটে আছে। ঝকঝকে সব বাড়িঘর। তকতকে পথঘাট। পথের চেয়ে ঘাট বেশি! পথের পাশে রেস্তোরাঁয় ছাতার তলায় লোকজন আয়েশ করে পান করছে, খাচ্ছে! টুরিস্টের তুলনায় রেস্তোরাঁ কম। টেবিল খালি হবার অপেক্ষায় রেস্তোরাঁর সামনে লাইন দেখা যাচ্ছে। আমরাও এদিক সেদিক ঘুরে একটি থাই রেস্তোরাঁর বাইরে প্রায় আধা ঘন্টা অপেক্ষা করলাম। খেতে বসে মনে হল অপেক্ষা সার্থক! টম ইয়াম স্যুপে চুমুক দিয়ে সমস্ত ক্লান্তি কেটে গেল! ভিতরে ঢুকে অবাক হলাম ছোট্ট একটা রেস্তোরাঁ। মাত্র দুজন থাই স্বামী-স্ত্রী এটা চালাচ্ছে! আটটা টেবিলে চারটা খালি! বাইরে আমাদের মতো এখনো আরও দুইটা পরিবার অপেক্ষা করছে। জিজ্ঞেস করতে বলল, কভিডের জন্য একটা করে টেবিল খালি রেখে বসার নিয়ম!
লাঞ্চ শেষে হাঁটতে হাঁটতে পথের পাশে একটা পার্কে বসতেই চোখ পড়ল ক্যানোর গায়ে চিত্র প্রদর্শনী চলছে। সেভেন গ্রুপের টম থমসন থিম নিয়ে প্রদর্শনী! না, এই প্রদর্শনী কোনো আর্টগ্যালারীতে হচ্ছে না। সারা শহর জুড়ে বিশাল বিশাল পেন্টিং টাঙানো। বড়ো কোনো বিল্ডিংএর দেয়ালে, কিংবা কোনো দোকানের উপরে! লেকের পাশে মাঠে। ক্যানোর তলায় টম থমসনের থিম পেন্টিং! অনেকটা সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে প্রদর্শনী দেখে মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে এলাম ঘরে।

অন্টারিও, কানাডা
১৫/১০/২২

ইয়ানের সাথে লেখিকা

ছোট্ট ইয়ানের চোখে

ম্যাপল পাতার দেশে আমার জন্ম।
যখন চারদিক শুভ্র চাদরে মোড়ানো। তুষারপাতের দিনগুলো যখন শূন্য তাপমাত্রার অনেকটা নীচে, আবহাওয়া খুব খারাপ। বাবা মাকে নিয়ে এল হাসপাতালে। সারারাত ধরে তুষারপাত। ভীষণ তুষারঝড় বয়ে যাচ্ছিল। তখন আমার জন্ম হতে যাচ্ছিল জগতের আনন্দযজ্ঞে। যদিও আমি বলছি আনন্দযজ্ঞ, আসলে ওই সময়ে আমার চারপাশে ভয়াবহ এই শব্দগুলোর সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছিল– আইশোলেশন, অবজারভেশন, কভিড, কোরানটিন।
সারা পৃথিবী কাঁপিয়ে দেখা দিয়েছে করোনা মহামারীর আর্বিভাব। অদৃশ্য শত্রু যাকে চোখে দেখা যায় না অথচ তার ভয়ে সারা পৃথিবী কম্পমান! সবাই মুখে মাস্ক এঁটে বাইরে যায় আর সারাদিন সেনিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া ধুয়ি করে।
আমার জন্ম হল ২০২০ সালে ৪ জানুয়ারী। রাত দশটায়। আমি পেন্ডামিক চাইল্ড। অতঃপর প্রতি বছর করোনার চলতে থাকল ২০২১...২০২২...২০২৩ – ফাস্ট ওয়েভ, সেকেন্ড ওয়েভ, ডেল্টা, ওমিক্রন নামে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে এল। যতবার আমার জন্মদিন আসে, প্রতিবার জন্মদিনের আয়োজন করে বাবা পার্টি ক্যানসেল করে। বাবা-মা মন খারাপ করে। বন্ধুদের ডাকতে পারে না। দশজনের বেশি লোক এক জায়গায় জড়ো হতে পারবে না। কারণ লোকডাউন চলছে। কী যে মন খারাপ করে! আমার অবশ্য তেমন মন খারাপ হয় না।
দিদা বলে ছোটোরা সবসময় খুব সুখীমানুষ। কেননা তারা খুব অল্পতেই খুশি হয়। দিদা তো ঠিকই বলে, এই যে আমি সবসময় কত হাসি-খুশী থাকি! সারাক্ষণ গুনগুনিয়ে গান করি।
আমার তখন আঠারো মাস বয়স। মাত্র একপা দুপা হাঁটতে শিখেছি। হঠাৎ একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি দিদা ফোন থেকে বের হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! দিদাকে দেখে হতবাক, তাকিয়ে থাকি! আমার অবাক চাহনি দেখে বাবা-মা, দিদা হাসছে। সবাইকে হাসতে দেখে আমার লজ্জা লাগল। বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে কোলে উঠে বাবার কাঁধে মুখ গুজে দিলাম! দিদা বাবাকে জিজ্ঞেস করল,
–আমি কি ওকে ছুঁতে পারব?
বাবা বলল,
–হ্যাঁ হ্যাঁ কোনো অসুবিধা নাই!

দিদা কি ভেবেছে আমাকে ধরলে আমি কাঁদব? পরে বুঝতে পারলাম, এয়ারপোর্টের কভিড টেস্টের রিপোর্ট তখনো আসেনি বলে দিদা এমন প্রশ্ন করেছিল! আমার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে আদর করল দিদা। বাবার কোল থেকে নেমে আমি দিদার পিছু পিছু দিদার ঘরে গেলাম। ইশ্! বাবা-মা দিদার ঘরটাকে কী সুন্দর করে সাজিয়েছে! দিদার বিছানাটা আমারটার মতো আটকানো না, চারপাশে খোলা আর বড়ো! অনেকগুলো বালিশের মাঝেখানে একটা টেডিবিয়ারও বসে আছে! পাশে কী সুন্দর একটা টেবিল ল্যাম্প! আমার ঘরে এসব কিছুই নেই! আমি বড়ো হয়ে বাবাকে বলব আমার ঘরটাকেও দিদার ঘরের মতো করে সাজিয়ে দিতে! দিদার ঘরের জানালা থেকে বড়ো বড়ো গাছগুলোর ফাকে রাস্তা দেখা যায়। ড্রাইভওয়েতে বাবার গাড়িটাও দেখা যায়!

এই রাস্তাটায় বাইরের কোনো গাড়ি আসে না। শুধু যারা এখানে থাকে তাদের গাড়িগুলো আসা-যাওয়া করে।
আমাদের প্রতিবেশী পদ্মা আর রাম। ওদের কালো পুডল হেনরিকস আমাকে দেখলেই ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। ওকে ধরে আদর করতে চাইলে রেগে যায়! একদিন আমাকে ওর লেজ দিয়ে ধাক্কাও দিয়েছে! আমি অবশ্য ব্যথা পাইনি! দিদা ওকে দেখে ভয় পেয়ে দূরে দাঁড়িয়েছিল। হেনরিকস কিন্তু কাউকে কামড়ায় না, এমনি শুধু ঘেউঘেউ চিৎকার করে! সকাল বিকাল পদ্মা অ্যান্টির সঙ্গে হেনরিকস প্রতিদিন পার্কে হাঁটতে যায়! ওদের আরও একটা সাদা কুকুর আছে, নাম পাইপার। পাইপার খুব একটা বাসা থেকে বের হয় না। কিন্তু ও খুব চিৎকার করতে থাকে যখন হেনরিকস বাইরে আসে। আমি ঠিক জানি না পদ্মা অ্যান্টি পাইপারকে কেন বাইরে নিয়ে যায় না।
আমাদের আরেকপাশে প্রতিবেশী মিস্টার আর মিসেস ফ্র্যান্সিস। মিসেস ফ্র্যান্সিস কথা বলতে খুব ভালোবাসে। মাকে কিংবা বাবাকে দেখলে অনবরত বকবক করেই যায়। একবার কথা বলতে শুরু করলে আর থামতেই চায় না। একটা বিষয় থেকে আরেকটা বিষয়ে কোনো বিরতি না দিয়েই কথা বলতে থাকে। তাই মা বলে, মিসেস ফ্রান্সিসের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া খুব কঠিন! বাবার সঙ্গে কথা বলতে দেখলে মা দূর থেকে পালিয়ে যায়। মিসেস ফ্রান্সিস আমাকেও অনেককিছু বলে, আমি কিছুই বুঝতে পারি না।

বাবার সঙ্গে আমার খেলতে খুব ভালো লাগে। বাবা আমার মতো খেলে। বাবাকে যা কিছু করতে বলি বাবা সেগুলো আমার মতো করে করতে পারে। আমি যা কিছুই করতে চাই বাবা খুব একটা নিষেধ করে না। মাকে বলে, ওকে এক্সপ্লোর করতে দাও।
যখন পাশে শুয়ে বাবা আমাকে গল্পের বই পড়ে শুনায় আমি বাবার পেটের উপর একটা পা তুলে দেই। খুব মজা লাগে।

আমার ঘরের জানালার বাইরে একটা ম্যাপল ট্রি । সামারে প্রতিটি গাছ যে সময়টায় সবুজ পাতার ঝলমলে জীবন্ত তখন এই গাছটির বেশ কিছু পাতা হলুদ হয়ে ঝড়ে পড়ছিল। বাবা খুব চিন্তিত হয়ে বলল, গাছটির মনে হয় অসুখ করেছে। এই গাছটিকে প্রতিদিন দেখতে দেখতে আমারও মনে হত সে আমাদের পরিবারেরই একজন। বাবা মার দুর্ভাবনা দেখে আমারও মন খারাপ করত গাছটার জন্য। এই গাছটায় কত যে পাখি আসে যায়। নানারকম শব্দ করে ডাকে। কোনো কোনো পাখি ডাকে সাইরেনের মতো লম্বা সুরে। কোনোটা ডাকে ভেঙে ভেঙে চি চি চি করে। আবার কখনো শুধু কিচির মিচির করতে থাকে।

অন্টারিও, কানাডা
৯/১০/২২