ফ্রান্সে প্রকাশিত বাংলা ওয়েবজিন। প্রকাশক : প্যাট্রিসিয়া গিদাস, ভ্যান, ৫৬০০০, ব্রিটানি, ফ্রান্স। সম্পাদক : নাসরিন-জয়া হক, চয়ন খায়রুল হাবিব। Contact : choygypsy@yahoo.com

Tuesday, October 25, 2022

ভাত : মহাশ্বেতা দেবীর গল্পে

এবং বাঙালি লেখক, লেখিকার কলমে!

।।কনক রহমান।।


'মৈমনসিংহ গীতিকায়' 'মলুয়া'র রচয়িতা বর্তমান কিশোরগঞ্জের নারী চন্দ্রাবতী ষোড়শ শতকে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন এভাবে,

'ঘরে নাই ধান-চাল, চালে নাই ছানি।
আকর ভেদিয়া পড়ে উচ্ছিলার পানি।।
ভাসান গাইয়া পিতা বেড়ান নগরে।
চাল-কড়ি যাহা পান আনি দেন ঘরে।'
রবীন্দ্রনাথ তার কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটকে মোট ১০৮ বার ধান শব্দটি ব্যাবহার করেছে, চাল শব্দটি ব্যাবহার করেছে ১৭৬ ব্যাবহার, ভাত শব্দটি ব্যাবহার করেছে ১২১ বার।
'আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়
লুকোচুরির খেলা।
নীল আকাশে কে ভাসালে
সাদা মেঘের ভেলা।
আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে,
উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে,
আজ কিসের তরে নদীর চরে
চখাচখির মেলা।' (গীতাঞ্জলি)
রবীন্দ্র রচনাবলীতে চাল শব্দটি ধান্য চাল ছাড়া চালবাজি অর্থে ব্যাবহার করা হয়েছে। ধান ক্ষেতের নান্দনিকতার পাশাপাশি চাল, ডালের দৈনন্দিন দর নিয়ে রবীন্দ্রনাথের জ্ঞান যে টনটনে ছিল তা নিচের লাইনগুলো পড়লে বোঝা যায়,
'আমরা নিজেরাই রান্না করব। চাল ডাল তরকারী তেল ঘি ও মস্‌লা সবই আজ সকালবেলা কিনেছি।' ...'পরিশিষ্ট'।
'মামা আনে চাল ডাল। আর কেনে শাক। আর কেনে আটা। দাদা কেনে পাকা আতা, সাত আনা দিয়ে।'...'প্রথম ভাগ'।
ভাত নিয়ে রবীন্দ্রনাথের লাইনগুলো হৃদয় নিংড়ানো বাস্তবতার আয়না,
'নুনের ট্যাক্সের দায়ে অনেক গরীব সুদু ভাত খাইয়া মরে, নুনও জোটে না।'.... 'লাঠির ঊপর লাঠি'।
'এখনো আমার রূপার এত অভাব যে অন্যের সমুখে রূপার থালায় ভাত না খাইলে লজ্জায় মরিয়া যাইতে হয়।'...'গরীব হইবার সামর্থ্য'।
রবীন্দ্রনাথের পরের কিছু বাঙালি কবির লাইন তুলে দিয়ে ভেতো বাঙ্গালের নান্দনিক বিবর্তন দেখা যাক। বরিশালে বড় হওয়া, কোলকাতায় বসবাসরত জীবনানন্দ দাশ 'বনলতা সেন' সংগ্রহে লিখলেন,
'ধান কাটা হয়ে গেছে কবে যেন — ক্ষেত মাঠে পড়ে আছে খড়
পাতা কুটো ভাঙা ডিম — সাপের খোলস নীড় শীত।
এই সব উৎরায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর
ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ — কেমন নিবিড়।'
(ধান কাটা হয়ে গেছে)
'ফলন্ত ধানের গন্ধে—রঙে তার—স্বাদে তার ভ'রে যাবে আমাদের সকলের দেহ;
রাগ কেহ করিবে না—আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ।'
(অবসরের গান)
২০এর রবীন্দ্রনাথ, ৩০শের জীবনানন্দের পর ৫০শে সুনীল গাঙ্গুলী ধান ক্ষেতের রূপকল্প, ভাত খাওয়ার উপাচার ব্যাবহার করেছেন বিভিন্ন অনুষঙ্গে। তার একটি গল্পের শিরোনাম 'গরম ভাত অথবা নিছক ভুতের গল্প'। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের মত গ্রাম বাংলায় সরাসরি বসবাস না করলেও, তার যাপনের পুরোটা আরবান বা নাগরিক হলেও গ্রামীণ অনুষঙ্গের ট্রিটমেন্ট ও দৃষ্টিকোণে সুনীল নিবিড়তার পরিচয় দিয়েছেন। ধান ক্ষেত ভিত্তিক সুনীলের লাইন পড়লে বোঝা যায়, কেনো নাগরিকতার সাথে আদিবাসের সংঘাত দেখাতে সত্যজিৎ রায় সুনীলের লেখা বেছে নিয়েছিলেন।'বন্দী জেগে আছো' সংগ্রহের 'ধান' কবিতায় আমরা পাচ্ছি,
'হলুদ শাড়ি আর পরো না, এবার মাঠে হলুদ ধান ফলেনি
ঘরে তোমার হল্‌দে পর্দা! মিনতি করি খুলে রাখো
এবার মাঠে হলুদ ধান ফলেনি।
এপাড়া জুড়ে সানাই বাজে, ওপাড়া জুড়ে শামিয়ানা
ব্যস্ত মানুষ, সুখী মানুষ, শঙ্খ আর উদ্ধ্বনি লাল চেলি
সবই থাকুক, বন্ধ রাখো গায়ে-হলুদ
এবার মাঠে হলুদ ধান ফলেনি'
এসবের ভেতর ঘটে গেছে ভারত ভাগ, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। আল মাহমুদ 'সোনালী কাবিনে' লিখলেন,
'বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই
দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর,
লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই
হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করে না কসুর।'
এখানে একই স্তবকে মাহমুদ 'হৃদয়ের ধর্ম' এবং হালাল, হারামের বিভেদ এনে ফেলছেন। প্রকৃতি ও নারী যেভাবে মাহমুদের কবিতায় পারস্পরিক প্রতীক হয়ে ওঠে, তা অনেক ক্ষেত্রে নারীবাদী ও জেন্ডার রাজনীতির দিক থেকে অস্বস্তিকর হলেও দেখা যাচ্ছে 'সোনালী কাবিনের' লাইনগুলো, সুলতানের চিত্রকর্মের মত স্থায়ীত্বের মহিমা পাচ্ছে। 'প্রকৃতি' কবিতায় লিখলেন,
'কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে
ভাবলাম, এ-মৃত্তিকা প্রিয়তমা কিষাণী আমার।
বিলের জমির মতো জলসিক্ত সুখদ লজ্জায়
যে নারী উদাম করে তার সর্ব উর্বর আধার।'
এর পর আমরা ধান, চাল, ভাতের গন্ধমাখা চরনের খোজে আশেপাশে তাকাচ্ছি।পত্রিকাতে চালের দরের ওঠানামার খবর পড়তে পড়তে আমরা বাংলাদেশের চিত্রকর্মগুলোকে দেখছি বিমূর্ত হয়ে যেতে, যা ব্যক্তিক অনুভূতিকে ধারণ করতে ব্যার্থ হচ্ছে। এখানে কবিতাকৃতি ব্যক্তিক অন্তর্মুখিতায় সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়বার কথা, প্রকৃতির ক্যানভাস সঙ্কুচিত হয়ে পড়বার কথা। এই ক্যানভাসগুলো বিস্তৃত করতে চয়ন খায়রুল হাবিব ব্যক্তিক চড়াই, উৎরাইতে আবহমান প্রাকৃতিক উপাচারগুলো ধারণ করলেন নাগরিক সাইকাডেলিয়াতে, 'মৌল জন্তুর ভাষায়' ভাত এলো এভাবে,
'মন্ত্রোচ্চারণের ভঙ্গিতে চন্দ্রাক্রান্ত বেশ্যা এক বিড়বিড়িয়ে বলছে
দুর্ঘটনা চাই দুর্ঘটনা চাই
চোখের বদলে চোখ প্রশ্নবোধক তবু দুর্ঘটনা চাই
যদি কোন দিন খদ্দের নয়া জোটে
সন্তানঘাতী ঠোঁটে ভাত তুলে দিস তোর মরা হাতে
বিছানার নিচে গর্ত খুড়ে সে ধামাচাপা দিয়েছে
শরীরের সংলগ্ন জারজ।গর্তে পোরার আগে
সদ্যজাত শিশুটির ডান হাতের থাবায়
তুলে দিয়েছে এক লোকমা প্রথাবিদ্ধ ভাত'
দেখা যাচ্ছে বাঙালি কবি দেশে, প্রবাসে, নাগরিক ও গ্রামীণ আবহে ধান, চাল, ভাতের প্রতীককে শাশ্বত দৈনন্দিন নান্দনিকতায় ধারণ করছেন, সমাজ ও শ্রেণীর বৈষম্যকে সাংবাদিকতার বাইরে এনে সাহিত্যের যোগাযোগ সফল মাত্রা দিতে পারছেন।ওপরে যাদের লেখা উদ্ধৃত করেছি, জেন্ডারের জায়গাতে তারা নিরপেক্ষ উভলিঙ্গ না হলেও, পুরুষতন্ত্রের পাল্লায় তাদের কাব্যকৃতিকে খাটো করা যায় না, চন্দ্রাবতীকে যেরকম নারীত্বের ঐতিহাসিক শৃঙ্খলে বেধে মূল্যায়ন করা যায় না। অবশ্য সেটা ইচ্ছা করলে কেউ করতে পারে, তাতে এদের কবিতার লাইনগুলো মহিমা হারাবে না। 

লাইনগুলো এবং উদ্ধৃত কবিদের পক্ষে বললেও চন্দ্রাবতী একজন নারী এবং অপর লেখকেরা পুরুষ, সেটা তারা বদলাতে পারবেন না। সুলতান যেরকম তার নারী, পুরুষ সবাইকে পেশল করে তুললেও নিজে একজন চিকনাচাকনা পুরুষ। সুলতান যেরকম তুলিতে, উল্লেখিত কবিগনও বাংলা শব্দের উত্তীর্ণ শিল্পী। এই উত্তীর্ণতার জায়গা থেকে একজন নারী ধান, চাল, ভাতকে অনুষঙ্গ করে যখন সাহিত্য রচনা করেন, তার রূপটি কি রকম? সে জন্য আমাদের পড়তে হবে মহাশ্বেতা দেবীর 'ভাত' 

নতুন ধান গোলায় ওঠানোর উৎসবকে বাঙালি বলে নবান্ন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিউট অনেক নতুন ধানের বীজ আবিষ্কার করেছে, আগের বীজগুলোর দুর্বলতা সংশোধন করেছে যাতে ধানের চারা প্লাবন রুখে দাড়াতে পাড়ে। বাংলা ভাষার চর্চার ক্ষেত্রে বৈষম্য পার হয়ে, একাডেমিক স্বার্থান্ধতা পার হয়ে সাহিত্যের পাতায় বার বার ধান, চাল, ভাত নবায়িত হচ্ছে, এটা আমাদের জন্য সঞ্জিবক এবং আশাব্যঞ্জক।

কনক রহমান

মহাশ্বেতা দেবী

ভাত 

মহাশ্বেতা দেবী

লোকটার চাহনি বড়বাড়ির বড়বউয়ের প্রথম থেকেই ভালো লাগেনি। কী রকম যেন উগ্র চাহনি। আর কোমর পর্যন্ত ময়লা লুঙ্গিটা অত্যন্তই ছোট। চেহারাটা বুনো বুনো। কিন্তু বামুন ঠাকুর বলল, ভাত খাবে কাজ করবে।-কোথা থেকে আনলে?

এ সংসারে সব কিছুই চলে বড়পিসিমার নিয়মে। বড়পিসিমা বড়বউয়ের পিসি-শাশুড়ী হন। খুবই অদ্ভুত কথা। তাঁর বিয়ে হয়নি।
সবাই বলে, সংসার ঠেলবার কারণে অমন বড়লোক হয়েও ওরা মেয়ের বিয়ে দেয়নি। তখন বউ মরে গেলে বুড়ো কর্তা সংসার নিয়ে নাটাঝামটা হচ্ছিল।
বড়বাড়ির লোকরা বলে, ওর বিয়ে ঠাকুরের সঙ্গে। উনি হলেন দেবতার সেবিকা।
বড়বাড়িতে শিবমন্দিরও আছে একটা। বুড়ো কর্তা এ রাস্তার সবগুলো বাড়িই শিব-মহেশ্বর-ত্রিলোচনা-উমাপতি, এমন বহু নামে শিবকে দিয়ে রেখেছিলেন। দূরদর্শী লোক ছিলেন। তাঁর জন্যেই এরা করে খাচ্ছে। বড়পিসিমা না কি বলেছিলেন, ঊনি আমার পতিদেবতা। মানুষের সঙ্গে বিয়ে দিও না।
এসব কথা সত্যি না মিথ্যে কে জানে। বড়পিসিমা চিরকাল এ সংসারে হেঁসেল দেখেছেন, ভাড়াটে বাড়িতে মিস্তিরি লাগিয়েছেন এবং তাঁর বাবার সেবা করেছেন।
বড়বউয়ের কথা শুনে বড়পিসিমা বলেন, কোথা থেকে আনলে মানে? ঝড় জলে দেশ ভেসে গেছে। আমাদের বাসিনীর কে হয়। সে-ই ডেকে আনলে।
বড়বউ বলে, কি রকম দেখতে!
-ময়ূরছাড়া কার্তিক আসবে নাকি? তোমরা তো দশটা পয়সা দিতে পারবে না প্রাণে ধরে। এই চৌদ্দ দফায় কাজ করবে, পেটে দুটো খাবে বই তো নয়। কেনা চাল নয়, বাদা থেকে চাল আসচে। তা দিতেও আঙুল বেঁকে যাচ্ছে?
বড়বউ চুপ করে যায়। বড়পিসির কথায় আজকাল কেমন যেন একটা ঠেস থাকে। ‘তোমাদের মানে কী? বড়পিসিমা কি অন্য বাড়ির লোক নাকি?’
বড়পিসিমা শেষ খোঁচাটা মারেন। তোমার শ্বশুরই মরতে বসেছে বাছা। সে জন্যে হোমযজ্ঞি হচ্ছে। তার জন্যে একটা লোক খাবে...
বড়বউ কোনো কথা বলে না। সব কথাই সত্যি। তার শ্বশুরই মরতে বসেছেন। বিরাশি বছরটা অনেক বয়েস। কিন্তু শ্বশুর বেশ টনকো ছিলেন। তবে ক্যানসার বলে কথা। ক্যানসার যে লিভারে হয় তাই বড়বউ জানত না। বড়বউ প্রায় দৌড়ে চলে যায়।
আজ অনেক কাজ। মেজবউ উনোন পাড়ে বসেছে। শাশুড়ীর মাছ খাওয়া বুঝি ঘুচে যায়। তাই কয়েকদিন ধরে বড় ইলিশ, পাকা পোনার পেটি, চিতলের কোল, ডিমপোরা ট্যাংরা, বড় ভেটকি মাছের যজ্ঞি লেগেছে। রেঁধে-বেড়ে শাশুড়ীকে খাওয়ানো তার কাজ।
শ্বশুরের ঘরে নার্স। বড়বউ এখন গেল সে ঘরে। সে একটু বসলে পরে নার্স এসে চা খেয়ে যাবে। সেজছেলে বিলেতে। তার আসার কথা ওঠে না। ছোট, মেজ ও বড় ঘুমোচ্ছে। এ বাড়ির ছেলেরা বেলা এগারোটার আগে ঘুম থেকে ওঠে না। সেই জন্যেই তাদের চাকরি করা হয়ে ওঠেনি। আঠারোখানা দেবত্র বাড়ি আর বাদা অঞ্চলে অসাগর জমি থাকলে কাজ বা করে কে?
শ্বশুরের ঘরে বসে বড়বউ ভাবতে চেষ্টা করে শ্বশুর নেই, সে অবস্থাটা কেমন হবে। ক্যানসার, লিভারে ক্যানসার, তা আগে বোঝা যায়নি। বোঝা গেল যখন তখন আর কিছু করার নেই। বড়বউ ভাবতে চেষ্টা করে, তখনো চাঁদ সূর্য উঠবে কিনা। শ্বশুর তার কাছে ঠাকুরদেবতার সমান।
-তাঁর জন্যে দই পেতে ইসবগুল দিয়ে শরবত করে দিতে হত, শত ঠাকুর থাকুক, তিনি খেতে আসার পাঁচমিনিট আগে বড়বউকে করতে হত রুটি লুচি। তাঁর বিছানা পাততে হত, পা টিপতে হত। কত কাজ করতে হত সারা জীবন ধরে। এখন সে সব কি আর করতে হবে না, কে জানে।
ডাক্তারেরা এলে দিয়েছে বলেই তো আজ এই যজ্ঞিহোম হচ্ছে। ছোটবউয়ের বাবা এক তান্ত্রিক এনেছেন। বেল, শ্যাওড়া, অশ্বত্থ, বট, তেঁতুল গাছের কাঠ এনেছে আধ মণ করে। সেগুলো সব এক মাপে কাটতে হবে। কালো বিড়ালের লোম আনতে গেছে ভজন চাকর। শ্মশান থেকে বালি, বেশ্যাঘরের হাতআর্শি, এমন কত যে ফরমাশ।
তা ওই লোকটাকে ধরে আনা কাঠ কাটার জন্যে। ও নাকি কদিন খায়নি। বাসিনী ধরে এনেছে। বাদায় থাকে অথচ ভাতের আহিংকে এতখানি। এ আবার কী কথা? বাদায় চালের অভাব না কি? দেখো না একতলায় গিয়ে। ডোলে ডোলে কতরকম চাল থরে থরে সাজানো আছে।
নার্স এসে বসে। বড়বউ নেমে যায়। আজ খাওয়া-দাওয়া ঝপ করে সারতে হবে। তান্ত্রিক হোমে বসবার আগে। হোম করে তান্ত্রিক শ্বশুরের প্রাণটুকু ওই হাতআর্শিতে ধরে রাখবেন। তান্ত্রিক নীচের হলঘরে বসে আছেন।
বড়পিসিমা বলেন, নামতে পারলে বাছা? চালগুলো তো বের করে দেবে?
-এই যে দিই।
ঝিঙেশাল চালের ভাত নিরামিষ ডাল তরকারির সঙ্গে। রামশাল চালের ভাত মাছের সঙ্গে। বড়বাবু কনকপানি চাল ছাড়া খান না, মেজ আর ছোটর জন্য বারোমাস পদ্মজালি চাল রান্না হয়। বামুন-চাকর-ঝি-দের জন্যে মোটা সাপটা চাল।
বাদার লোকটি কাঠ কাটতে কাটতে চোখ তুলে দেখে। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে তার।
-হ্যাঁ বাসিনী, এত নানাবিধি চাল?
-বাবুরা খায়।
-ওই পাঁচ ভাগে ভাত হয়?
-হবে নে? বাদায় এদের এত জমি। চাল এনে পাহাড় করছে। বড়পিসিমা বেচেও দিচ্ছে নুক্কে নুক্কে। আমিই বেচতেছি সে চাল।
-বাদায় এদের চাল হয়! তা দে দেকি বাসিনী। এক মুষ্টি চালই দে। গালে দে জল খাই। বড্ড ঝ্যামন আঁচড় কাটতিছে পেটের মদ্যিখানে। সেই কদ্দিন ঘরে আঁদা ভাত খাই না। দে বাসিনী, বাগ্যতা করি তোর।
-আরে আরে! কী করো উচ্ছব দাদা। গাঁ সম্পর্কে দাদা তো হও। কেন-বা এমন করতেছ। পিসিমা দেকতে পেলে সব্বনাশ হবে। আমি ঠিক তাগেবাগে দে ঝাব। তুমি হাত চালিয়ে নাও দেকি। বাবা! এদেরকে বলিহারি ঝাই। এট্টা লোক কদিন খায়নি শুনচ। আগে চাট্টি খেতে দে।
বাসিনী চালগুলি নিয়ে চলে যাবার সময় মাথা নাড়তে নাড়তে চলে যায়। লোকটির নাম উৎসব। চিরকালই সে উচ্ছব নাইয়া নামে পরিচিত। গত কয়েকদিন সে সত্যিই খায়নি। কপালটা মন্দ তার। বড়ই মন্দ। যতদিন রান্না খিচুড়ি দেয়া হচ্ছিল ততদিন সে যেতে পারেনি। অ চন্নুনির মা। চন্নুনিরে। তোমরা রা কাড়ো না ক্যান?-কোতা অইলে গো!
বস্তুত এসব বলে সে যখন খুঁজছিল বউ-ছেলে-মেয়েকে তখন তার বুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। একদিকে তুমুল ঝড়-বৃষ্টি, ছেলে-মেয়েকে জাপটে সাপটে ধরে বউ কাঁপছিল শীতে আর ভয়ে। সে ঘরে মাঝ খুঁটি ধরে মাটির দিকে দাবাচ্ছিল। মাঝ খুঁটিটি মাতাল আনন্দে টলছিল, ধনুষ্টংকার রোগীর মতো কেঁপে ঝেঁকে উঠছিল। উচ্ছববলে চলছিল ভগমান! ভগমান! ভগমান! কিন্তু এমন দুর্যোগে ভগবানও কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমোন বোধ করি। ভগমান! ভগমান! উচ্ছব বলছিল। এমন সময় মাতলার জল বাতাসের চাবুকে ছটফটিয়ে উঠে এসেছিল। জল উঠল। জল নামল, উচ্ছবের সংসার মাটিতে লুটোপুটি গেল।
সকাল হতেই বোঝা গিয়েছিল সর্বনাশের বহরখানা। তারপর কয়েকদিন ধরে ঘরের চালের নিচ থেকে কোনো সাড়া পাবার আশায় উচ্ছব পাগল হয়ে থাকে। কে, কোথায়, পাগল নাকি উচ্ছব? সাধন দাশের কথা উচ্ছব নেয় না। সাধন বলে, তোরেও তো টেনে নেচ্ছেল। গাচে বেঁধে রয়ে গেলি। উচ্ছব বলে, রা কাড় অ চন্নুনির মা! ঘরের পাশ ছেড়ে সে নড়তে চায় না। তাছাড়া টিনের বেশ একটা মুখবন্ধ কৌটো ছিল ঘরে। তার মধ্যে ছিল নিভুই উচ্ছবের জমি চেয়ে দরখাস্তের নকল। উচ্ছব নাইয়া/পিং হরিচরণ নাইয়া/সে কৌটোটা-বা কোথায়?
যা আর নেই, যা ঝড়-জল-মাতলার গর্ভে গেছে, তাই খুঁজে খুঁজে উচ্ছব পাগল হয়েছিল। তাই রান্না খিচুড়ি তার খাওয়া হয়নি। তারপর যখন তার সম্বিত ফিরল, তখন আর খিচুড়ি নেই। ড্রাইডোল। চালগুলি সে চিবিয়ে জল খেয়েছিল। এভাবে কিছুদিন যায়। তারপর গ্রামের লোকজন বলে, মরেচে যারা তারাদের ছেরাদ কত্তে হয়। এ কাজ করার জন্যে তারা মহানাম শতপথিকে খবর দেয়। কিন্তু মহানাম এখন আর দুটো গ্রামে অনুরূপ শ্রাদ্ধশান্তি সেরে তবে এখানে আসবে। গ্রামবাসী অন্যেরা মাছ-গুগলি-কাঁকড়া যা পাচ্ছে ধরতে লেগেছে। উচ্ছবকে সাধন বলে, তুমি একা কলকেতা যাব বলে নেচে বা উটলে কেন? সরকার ঘর কত্তে খরচা দেবে শুনচ না?
উচ্ছব হঠাৎ খুব বুদ্ধিমান সাজতে চাও ও বলে, সে এট্টা কতা বটে।
ঝড়-জলে কার কী হল, মা-ভাই-বোন আছে না গেছে দেখতে বাসিনী আসতে পারেনি। তার বোন আর ভাজ কলকাতা যাচ্ছিল। ওরা কিছুকাল ঠিকে কাজ করবে। উচ্ছব আগেও গিয়েছিল একবার। বাসিনী যেখানে কাজ করে, সে ঘরবাড়ি দেখেছিল বাইরে থেকে। বারবাড়িতে ঠাকুরদালান আছে, মন্দিরের মাথার পেতলের ত্রিশুলটা দেখেছিল। বাসিনীর মনিববাড়িতে হেলা ঢলা ভাত, এ গল্প গ্রামে সবাই শুনেছে। উচ্ছবের হঠাৎ মনে হয় কলকাতা গিয়ে খেয়ে মেখে আসি। কেন মনে হয়েছিল তা সে বলতে পারে না। উপোসে, এক রাতে বউ-ছেলে-মেয়ে ঘরদোর হারিয়ে সে যেন কেমন হয়ে যাচ্ছিল। মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করে, কোনো কথা গুছিয়ে ভাবতে পারে না। খুব ভাবে সে, না না। এইবার গুচিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কী যে হল তা এখনো দিশে হচ্ছে না তেমন। ভাবতে গেলেই তার প্রথমে মনে হয় ধানে গোছ আসার আগেই ধান গাছ থেকে সবুজ রঙ চলে যেতে থাকে। কার্তিক মাসেই ধান খড় হয়ে গেল। তা দেখে উচ্ছব মাথায় হাত দিয়েছিল। সতীশ মিস্তিরির হরকুল, পাটনাই, মোটা, তিন ধানে মড়ক। উচ্ছব তো সতীশবাবুর জমিতে কাজ করেই ক-মাস বেঁচে থাকে। অ উচ্ছব, মনিবের ধান যায় তো তুই কাঁদিস কেন? কাঁদব না, সাধানবাবু, কাঁদব না? লক্ষ্মী না আসতে সেধে ভাসান যাচ্ছে তা কাঁদব না এতটুকু? আমরা খাব কী?
তা গুছিয়ে চিন্তা করতে বসলে আগে মনে হয় ধানক্ষেতে আগুন লাগার কথা। তারপরই মনে পড়ে যে রাতে ঝড় হয়। সেই সন্ধ্যেয় অনেকদিন বাদে সে পেট ভরে খেয়েছিল। এই এত হিঞ্চে সেদ্ধ আর এত গুগলি সেদ্ধ নুন আর লঙ্কা পোড়া দিয়ে। দিনটা এমন ছিল যে সেদিনে গ্রামের সকল উচ্ছবেরা ভরা পেট খেয়েছিল। খেতে খেতে চন্নুনির মা বলেছিল, দেবতার গতিক ভালো নয়কো। লৌকো নে ঝারা বেইরেচে বুঝি-বা বোট মারা পড়ে।
এ কথাটাও বেশ মনে পড়ে। তারপরেই মনে পড়ে মাঝখুঁটিটা সে মাটির দিকে ঠেলে ধরে আছে। মা বসুমতী ঝেমন সে খুঁটি রাকতে চায়নে, উগরে ফেলে দেবে। ভগমান! ভগমান! ভগমান! তারপর বিদ্যুচ্চমকে ক্ষণিক আলোয় দেখা মাতলার সফেন জল ছুটে আসছে। ব্যস, সব ঘোলামেলা একাকার তার পর থেকে। কি হল। কোথায় গেল সব। তুমি কোথায়, আমি কোথায়। উচ্ছব নাইয়া/পিং হরিচরণ নাইয়া/কাগজসহ কোটোটি কোথায়। বড় সুন্দর কৌটোখানি গো! চুন্নুনিদের যদি রেখে যেত ভগবান, তাহলে উচ্ছবের বুকে শত হাতির বল থাকত আজ। তাহলে সে কৌটো নিয়ে সবাই ভিক্ষেয় বেরোত। সতীশবাবুর নাতি ফুট খায়। উচ্ছব কৌটোটা চেয়ে এনেছিল। অমন কৌটো থাকলে দরকারে একমুঠো ফুটিয়ে নেয়া যায়। চমৎকার কৌটো।
-কী হল, হাত চালাও বাছা। উদিকে শুষচে কত্তা, হোম হবে, তা কাটগুনো দাঁড়িয়ে দেখচ? বড়পিসিমা খনখনিয়ে ওঠে।
-বড় খিদে নেগেছে মা গো!
-এই শোনো কতা। ভাত নামলেও খাওয়া নেই একন। তান্ত্রিকের নতুন বিধেন হল, সর্বস্ব রেঁধে রাখো, হোম হলে খেও। তুমি হাত চালাও।
উচ্ছব আবার কাঠ কাটতে থাকে। প্রত্যেকটি কাঠ দেড়হাত লম্বা হবে। ধারালো কাটারিটি সে তোলে ও নামায়। ফুটন্ত ভাতের গন্ধ তাকে বড় উতলা করে। এদিক-ওদিক চেয়ে বাসিনী ঝুড়ি বোঝাই শাক নিয়ে উঠোনে ধুতে আসে। ঝপ করে একটা ঠোঙা তার হাতে দিয়ে বলে, ছাতু খেয়ে জল খেয়ে এসো রাস্তার কল হতে। দেরি কোরো না মোটে। এ পিচাশের বাড়ি কেমন তা ঝাননি দাদা। গরিবের গতর এরা শস্তা দেকে।
-কে মরতেচে, হ্যাঁ বাসিনী?
-তেকেলে বুড়ো। বাড়ির কত্তা। মরবে নে? মদ রে, মেয়েছেলে রে, ওই ঝে হোমের জোগান দিচ্ছে, ওই মুটকি ওনার খাস ঝি। কত্তা মোলে পরে ওকে সাত নাতি না মেরিচি তো আমি বাসিনী নই। তেকেলে বুড়ো মরচে তার ঝন্যি হোম!
ছাতু কটি নিয়ে উচ্ছব বেরিয়ে যায়। বাপ রে! এতে তরকারি, এত চাল এত মাছ, এ একটা যজ্ঞি বটে! সব নাকি বাদার দৌলতে। সে কোন বাদা? উচ্ছবের বাদায় শুধু গুগলি-গেঁড়ি- কচুশাক-সুষনো শাক। উচ্ছব ছাতুটুকু একটু খায়, মিষ্টির দোকানে ভাঁড় চেয়ে নিয়ে জল খায়। ছাতু নাকি পেটে পড়লে ফুলেফেঁপে ওঠে। তাই হোক। পেটের গভর ভরুক। কিন্তু সাগরে শিশির পড়ে। উচ্ছব টের পায় না কিছুই। আবার সে ফিরে আসে।
-কোথা গেছলে?
-এট্টু বাইরে গেলাম মা!
কাঠ কাটলে হোম, হোম হলে ভাত, উচ্ছব তাড়াতাড়ি হাত চালায়।
মেজবউ চেঁচিয়ে বলে, খাবার ঘর মুছেচ বাসিনী? সব রান্না তুলতে হবে।
বাসিনী বলে, মুছিচি!
বড়বউ হেঁকে বলে, সব হয়ে গেল?
-মাচের ঘরে সব হল।
এলো সব কথা শুনে উচ্ছব বুকে বল পায়। ভাত খাবে সে, ভাত। আগে ভাত খাবে, জিভে ভাতের সোয়াদ নেবে। আসার সময়ে গাঁ-জ্ঞেয়াতি বলেছিল, কলকেতা ঝাচ্চ ঝকন, তকন কালীঘাটে ওদের ছরাদ সেরে দিও। অপঘাতে গেচে ওরা। হ্যাঁ, তাও করবে উচ্ছব। মহানাম শতপতি তো এল না। এলে পরে নদীর পাড়ে সারবন্দী ছরাদ হবে। উচ্ছব কালীঘাটে ছরাদ সারবে। শতীশবাবু বলেছে, উচ্ছবের মতিচ্ছন্ন হয়েছে বই তো নয়। বউ-ছেলে-মেয়ে অপঘাতে মরল, মানুষ পাগল হয়ে যায়। উচ্ছব ভাত ভাত করচে দেখো।
তুমি কী বুঝবে সতীশবাবু! নদীর পাড়েও থাক না, মেটে ঘরেও থাক না। পাকা ঘর কি ঝড় জলে পড়ে? তোমার ধান চালও পাকা ঘরে রেখেছে। চোর ডাকাতে নেবে না। দেশজোড়া দুর্যোগেও তোমার ঘরে রান্না হয়। ভাত খেতে দিলে না উচ্ছবকে। তোকে এগলা দিলে চলবে? তাহলেই পালে পালে পঙ্গপাল জুটবে নে? এ হল ভগমানের মার। এর চোট থেকে তোরে বাঁচাতে পারি?- তা তুমি ভাত দিলে না, দেশে ভাত নেই। সেই যে পোকায় ধান নষ্ট, সেই হতেই তো উচ্ছবের আধপেটা সিকি উপোসের শুরু। পেটে ভাত নেই বলে উচ্ছবও প্রেত হয়ে আছে। ভাত খেলে সে মানুষ হবে। তখন বউ-মেয়ে-ছেলের জন্যে কাঁদবে। দুঃখ তো ওর হয়নি। ও শুধু পাগল হয়ে বউ-মেয়েকে ডেকেছিল কয়েকদিন ধরে। তখনি উচ্ছব প্রেত হয়ে গেছে। মানুষ থাকলে ও ঠিকই বুঝত যে জলের টানে মানুষ ভেসে গেছে। কত গরু মোষ ভেসে গেল, চন্নুনির মা তো কোন ছার। উচ্ছব কাঠ কাটা শেষ করে। আড়াই মণ কাঠ কাটল সে ভাতের হুতাশে। নইলে দেহে ক্ষমতা ছিল না।
পাঁচ ভাগে কাঠ রেখে আসে দালানে। উঠোনে কাঠের কুচো, টুকরো সব ঝুড়িতে তুলে উঠোন ঝাঁট দেয়। তারপর বড়পিসিমাকে দেখতে পেয়ে শুধোয়, মা! বাইরে ঝেয়ে বসব?
বড়পিসিমা কোনো জবাবই দেন না। কেননা তান্ত্রিক হঠাৎ “ওঁ হ্রীং ঠং ঠং ভো ভো রোগ শৃণু শৃণু” বলে গর্জে উঠে রোগকে দাঁড় করান, কালো বেড়ালের লোমে রোগকে বেঁদে ফেলেন ও হোম শুরু করেন। একই সঙ্গে ওপর থেকে নার্স নেমে এসে বলে, ডাক্তারকে কল দিন।- বড়, মেজ ও ছোট ঘুমভাঙা চোখে বিরস মুখে হোমের ঘর থেকে বেরিয়ে যায় বাসিনী। উচ্ছবকে বলে, তুমি ঝেয়ে বাইরে বোসো দাদা। না, মন্তর বললে বটে। ঝেমন হাঁকুড় পাড়লে অমনি কত্তা টাল নিলে? কত্তার দেহ থেকে ব্যাদিটা হাঁচোড়পাঁচোড় করে বেইরে এল। চ্যান করবে তো করে নাও কেন?
-একন চ্যান করব নে। মাতায় জল পড়লে পেট মানতে চায় নে মোটে।
বাইরে এসে উচ্ছব শিবমন্দিরের চাতালে বসে। কেমন মন্দির, কেমন চাতাল! বাপ রে! এসব নাকি বাদার দৌলতে। সে বাদাটা কোথায় থাকে? ভাত তো খায়নি উচ্ছব অনেকদিন। ভাত খেয়ে দেহে শক্তি পেলে উচ্ছব সেই বাদাটা খুঁজে বের করবে। উচ্ছবের মতো আরো কত লোক আছে দেশে। তাদেরকেও বলবে।
মন্দিরের চাতালে তাস পেটে তিনটি ছেলে। তারা বলে, বুড়োকে বাঁচিয়ে তুলতে হোম হচ্চে। ফালতু!
-কী ফালতু?
-বেঁচে ও কতদিন জীবন পাবে? একশো? যত সব ফালতু।
উচ্ছব চোখ বোজে। এমন যজ্ঞির পরেও বুড়োকত্তা বেশিদিন বাঁচবে না? কী কাণ্ড! মাতলা নদী যদি সে রাতে পাগল হয়ে মাতাল মাতনে উঠে না আসে তো উচ্ছবের বউ, চন্নুনি, ছোট খোকা অনেকদিন বাঁচে। উচ্ছবের চোখের কোলে জল গড়ায়... ভাত খাবে আজ। সেই আশাতেই প্রেত উচ্ছব মানুষ হয়ে গেল নাকি? বড়-মেয়ে ছোট খোকার কথা মনে হতে চোখে জল এল এমন হঠাৎ? ভাতই সব। অন্ন লক্ষ্মী, অন্ন লক্ষ্মী, অন্নই লক্ষ্মী, ঠাগমা বলত। ঠাগমা বলত, রন্নো হল মা নক্কী।
-কি হে, কানছ কেন?
-আমারে শুদোচ্ছেন বাবু?
-হ্যাঁ হে।
-আবাদ থেকে আসতেচি বাবু গো! ঝড়ে জলে সব নাশ হয়ে, ঘরের মানুষ...
-ও!
তাস পিটানো ছেলেগুলি অস্বস্তিতে পড়ে। বয়স্ক ছেলেটি বলে, ঠিক আছে ভাই ঘুম এসো। উচ্ছব সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমিয়েই থাকে সে অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ। অবশেষে কার পায়ের ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভাঙে তার!
ইস! এ যে সাঁঝবেলা গো। কিন্তু তাকে ঠেলা দিচ্ছে কেন লোকটা?
-ওঠো ওঠো, কে তুমি?
-বাবু... আমি...
-চুরির মতলবে পড়ে আছ?
-না বাবু, এই বাড়িতে কাজ করতেছিলাম।
-ওঠো ওঠো।
উচ্ছব উঠে পড়ে। তারপর সে অত্যন্ত ঘাবড়ে যায়। রাস্তায় বেশ কয়েকটি গাড়ি। লোকের ছোট ছোট জটলা। -কী হয়েচে বাবু?
-কেউই তার কথায় জবাব দেয় না। উচ্ছব বাড়িতে ঢোকে। ঢুকতেই বড়পিসিমার বিলাপ শোনে, তোমার ছোট বেয়াই কী ডাকাতে সন্নেসী আনল গো দাদা। যজ্ঞি হল আর তুমিও মল্লে। অ দাদা! তুমি যে বিরেশিতে যাবে তা কে জানত বলো গো! তোমার যে আটানব্বুই বচর থাকার কথা গো দাদা।
বাসিনীকে দেখতে পায় না উচ্ছব। তবে খুব কর্মব্যস্ততা দেখে। কেত্তন না এলে বেরুনো নেই। কে যেন বলে।
- কেওন কি বলছিস বড় খোকা। বোনরা, দিদিরা আসুক। বড়পিসিমা বলেন। চন্দন বাটছ কেউ?
-খাটের টাকা কে নিয়েছে?
-বাগবাজারে ফোন করেচো?
-ফর্দটা দেকে দাও দিকি কেউ। খই, ফুল, ধুতি। শববস্তর...
উচ্ছব পাঁচিলের গায়ে সিটিয়ে লেপটে দাঁড়িয়ে থাকে। কত যে সময় যায়, কত কী যে হতে থাকে।
মস্ত খাট আসে। রাতে রাতে বের কত্তে হবে। রাতে রাতে কাজ সারতে হবে। নইলে দোষ লাগবে।
অনেক তোড়জোড় হয়, মেয়েরা এসে কাঁদে! হোমযজ্ঞ করেও বুড়ো কত্তার প্রাণটা যে রইল না, তাতে তান্ত্রিককে এতটুকু কুণ্ঠিত দেখা যায় না। তিনি লাইন করে ফেলেন তাঁর। ফলে বড়পিসিমা চেঁচিয়ে বলতে থাকেন, তিন ছেলে হোম ছেড়ে উঠে গেল যে?
এসব কাজে বিঘ্নি পড়লে রক্ষে আচে?-এ কথার আলোচনায় খুব সরগরম হয় বাড়ি। শোকের কোনো ব্যাপার থাকে না। বাড়ির উনুনি জ্বলবে না। রাস্তার দোকান থেকে চা আসতে থাকে। অবশেষে রাত একটার পর বুড়োকত্তা বোম্বাই খাটে শুয়ে নাচতে নাচতে চলে যান। পেশাদারি ও দক্ষ শববাহকেরা আধা দৌড় দেয়। ফলে কীর্তন দলও দৌড়তে বাধ্য হয়। বড়পিসিমা বলেন, বাসিনী। সর্বস্ব রান্না পথে ঢেলে দিগে যা। ঘর দোর মুক্ত কর সব। বউরা যাও না। দাঁড়িয়ে বা রইলে কেন?
উচ্ছবের মাথার মধ্যে যে মেঘ চলছিল তা সরে যায়। সে বুঝতে পারে, সব ভাত ওরা পথে ফেলে দিতে যাচ্ছে।
বাসিনী বলে, ধর দেকি দাদা।
-এই যে ধরি!
উচ্ছবের মাথায় এখন বুদ্ধি স্থির, সে জানে সে কী করবে।
-আমাকে দে ভারীটা।
মোটা চালের ভাতের বড় ডেগটি নিয়ে সে বলে, দূরে ফেলে দে আসি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, নয়তো কুকুরে ছেটাবে, সকালে কাকে ঠোক দেবে-বামুন বলে।
বেরিয়ে এসে উচ্ছব হনহনিয়ে হাঁটতে থাকে। খানিক হেঁটে সে আধা দৌড় মারে। ভাত, বাদার ভাত তার হাতে এখন। পথে ঢেলে দেবে? কাক কুকুরে খাবে?
-দাদা!-ত্রস্ত বাসিনী প্রায় ছুটে আসে, অশুচ বাড়ির ভাত খেতে নি দাদা!
-খেতে নি? তুমিও ঝেয়ে বামুন হয়েচ?
-অ দাদা, ব্যাগ্যতা করি-
উচ্ছব ফিরে দাঁড়ায়। তার চোখ এখন বাদার কামটের মতো হিংস্র। দাঁতগুলো বের করে সে কামটের মতোই হিংস্র ভঙ্গি করে। বাসিনী থমকে দাঁড়ায়।
উচ্ছব দৌড়তে থাকে। প্রায় এক নিশ্বাসে সে স্টেশনে চলে যায়।
বসে, ও খাবল খাবল ভাত খায়। ভাতে হাত ঢুকিয়ে দিতে সে স্বর্গসুখ পায় ভাতের স্পর্শে। চন্নুনির মা কখনো তাকে এমন সুখ দিতে পারেনি। খেতে খেতে তার যে কী হয়। মুখ ডুবিয়ে দিয়ে খায়। ভাত, শুধু ভাত। বাদার ভাত। বাদার ভাত খেলে তবে তো সে আসল বাদাটার খোঁজ পেয়ে যাবে একদিন। আছে, আরেকটা বাদা আছে। সে বাদাটার খোঁজ নির্ঘাৎ পাবে উচ্ছব। আরো ভাত খেয়ে নি। চন্নুনিরে! তুইও খা, চন্নুনির মা খাও, ছোট খোকা খা, আমার মধ্যে বসে তোরাও খা! আঃ! এবার জল খাই, জল! তারপর আরো ভাত। ভোরের টেনে চেইপে বসে সোজা ক্যানিং যাচ্চি। ভাত পেটে পড়েচে এখন ঝানচি ঝে ক্যানিং হয়ে দেশঘরে ঝেতে হবে।
উচ্ছব হাঁড়িটি জাপটে, কানায় মাথা ছুঁইয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
পেতলের ডেগটি চুরি করার অপরাধে সকালে লোকজন উচ্ছবকে সেখানেই ধরে ফেলে। পেটে ভাতের ভার নিয়ে উচ্ছব ঘুমিয়েছিল, ঘুম তার ভাঙেনি।
মারতে মারতে উচ্ছবকে ওরা থানায় নিয়ে যায়। আসল বাদাটার খোঁজ করা হয় না আর উচ্ছবের। সে বাদাটা বড়বাড়িতে থেকে যায় অচল হয়ে।
মহাশ্বেতা দেবী
কভার তেলরং, এস, এম, সুলতান